কোভিড ও জাতীয়তাবাদ

শুভ্রাংশু পান 

এক

প্রেক্ষাপট : জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস যা দেশপ্রেমিকদের নিজস্ব পরিচিতির উপর জোর দেয় এবং স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, খাদ্য এবং জীবনধারণ সম্পর্কে কোনও একজনের নিজস্ব ও আবেগঘন ধারণা তৈরি করে। বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কোভিড-১৯ এর প্রকোপের জন্য আরও বেশি করে সারা পৃথিবী জুড়ে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলি যেমন ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা আবার মহান হবে’ বা ইংল্যান্ডের ব্রেক্সিট পর্যন্ত, এমনকি সাউথ আফ্রিকা, চিন এবং নরেন্দ্র মোদির ‘ভারতে তৈরি’-র প্রভাব জাতীয়তাবাদকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।  

এশিয়ায় জাপান এবং ভারত সমানতালে জাতীয়তাবাদের তীব্রতা প্রকাশ করে চলেছে। শিন্‌জো আবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাদের সংবিধানের ৯ নং ধারায় নতুন সংযোজন করেছেন। ট্রাম্প যেমন বহিরাগত কর্মীদের ভিসায় বাদ সেধেছেন, তেমনি মোদিও জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে জাতীয়তাবাদের মোড়কে নতুন করে রং লাগিয়েছেন। সাধারণভাবে বলা যায় আধুনিক জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। ইউরোপে এটি জাতি-প্রদেশ গঠনের পাশাপাশি জনগণের একটি নতুন পরিচিতি তৈরি করেছে। ভারতে অবশ্য ভিয়েতনামের মতো উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর আর এক নামই হল জাতীয়তাবাদ। 

দুই

নামকরণ : ইদানীং সবদেশই নামকরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় বা জাতীয়তাবাদকেই গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। বম্বে হয়েছে মুম্বাই, মাদ্রাজ হয়েছে চেন্নাই, বার্মা হয়েছে মায়ানমার , তাওয়াং হয়েছে ওগিয়াইনলিং — তবে এ সবই কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। খটকা লাগে তখনই যখন চিন অরুণাচল প্রদেশের নাম দেয় জাংনান (দক্ষিণ তিব্বত)। তাদের যুক্তি ভারতের এই অঙ্গ রাজ্যটি চিনেরই অংশ এবং সেই যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে ৯০,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে সার্বভৌম কর্তার মতো তারা আচরণ করছে। সেজন্য ভারতের অঙ্গরাজ্যে উপরাষ্ট্রপতি পদার্পণ করলেও তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে, দালাই লামার (বেজিংয়ের রাজনৈতিক শত্রু) মতো ভারতীয় অতিথির কথা না হয় বাদই থাকল।  

করোনাকালে চিনের উপর ভাইরাস ছড়ানোর যে অভিযোগ উঠেছে তা থেকে নজর ঘোরাতেই অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখের সীমান্ত এলাকায় তারা খবরদারি শুরু করেছে। তাইওয়ান নিয়েও চিনের মনোভাব আমেরিকা সহ অনেক দেশেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। আমেরিকা এবং জাপান সরাসরি চিনকেই করোনা ভাইরাসের আঁতুড়ঘর বলে দাবি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যদিও এই দাবিকে মান্যতা দেয়নি তথাপি আমেরিকা ও চিন এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য একে অপরের উপর দোষারোপ করেই চলেছে। এর পিছনে রয়েছে জাতিগত বিদ্বেষ — সেই চিরাচরিত সাদা ও কালো চামড়ার, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এবং আদি ও নব্যর দ্বন্দ্ব। প্রত্যেক জাতিই নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেই আদি বলে প্রমাণ করতে মরিয়া যা জাতীয়তাবাদের সূত্রকে উসকে দিয়ে চলেছে সারা পৃথিবীজুড়ে। 

তিন

ভারতীয়ত্ব : ১৯১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন মহাত্মা গান্ধী যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন ১৯১৬ সালে চম্পারণ আন্দোলনে তাতে ভারতীয়ত্বের ছোঁয়া লাগে। এরপর ১৯১৮ সালে আমেদাবাদে সুতো কলের শ্রমিকদের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে যা ১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, নাতেশা শাস্ত্রীর ‘দক্ষিণ ভারতের লোকগাথা’, অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ থেকে শুরু করে মোতিলাল নেহেরুর ১৯২২ সালে স্বরাজ দল গঠন, আল্লুরি সীতারাম রাজুর অন্ধ্রপ্রদেশের গুদেম পাহাড়ের গেরিলা আন্দোলন থেকে শুরু করে জামশেদজি টাটার উত্থান, বিড়লার ফিকি প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে আব্দুল গফ্‌ফর খানের আইন অমান্য আন্দোলন — সবেতেই জাতীয়তাবাদের প্রকাশ পাওয়া যায়। 

আম্বেদকরের অবহেলিত শ্রেণি সংগঠনও নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য জাতীয়তাবাদের পথ বেছে নিয়েছিল। ১৯১৪-১৮-র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল ২০২০-২১ সালের করোনা মহামারিও একইভাবে ভারতের অর্থনৈতিক ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। যুদ্ধের সময় বিপুল পরিমাণে প্রতিরক্ষাখাতে খরচ সামলানোর জন্য যুদ্ধ লোন নেওয়া হয়েছিল যার ফলে শুল্ক বেড়ে গেছিল এবং আয়কর প্রতিস্থাপিত করতে হয়েছিল। জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলায় গ্রামীণ ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়েছিল। এই সমস্যা আরও গভীর হয়েছিল ১৯২০ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির আকার ধারণ করায়। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের পাশাপাশি বিদেশিদের বর্জনের সূত্রপাতও এই সময়ে ভারতের জাতীয়তাবাদ প্রকাশের নিদর্শন দেয়।

ভারতীয় জনগণ বিদেশি বস্ত্র পড়তে চাইছিল না, তাদের প্রথম পছন্দ ছিল খাদির পোশাক। শিক্ষক, উকিল, ছাত্রছাত্রীরা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বর্জন করছিল। কিন্তু ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি খুব ধীর গতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছিল বলে অনেকেই আবার ব্রিটিশ পরিচালিত বিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে এবং কাছারি অফিসগুলিতে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছিল। অধিকাংশ জায়গায় এই প্রতিবাদ অসহযোগ আন্দোলনের রুপে হলেও চাউরি চৌরায় প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। ফলে যতক্ষণ না ভারতীয়রা সত্যাগ্রহের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারে ততক্ষণ গান্ধিজি আসহযোগ আন্দোলনকে পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

চার

জাতীয়তাবাদের উত্তরণ : ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এ পূর্ণতা লাভ করে তবে তা ছিল ঔপনিবেশিকজাত আধুনিকতাপ্রসূত। ক্ষুদ্র পরিসরে কখনও আফগানদের বিরুদ্ধে, কখনও শক, পাঠান, মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, কখনও গ্রিকদের বিরুদ্ধে, আবার কখনও চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রতিরোধ গর্জে উঠেছিল। কিন্তু আপামর ভারতবাসী তাতে সামগ্রিকভাবে দৈহিক বা মানসিকভাবে অংশগ্রহন করেনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিবাদ সেদিক থেকে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। 

এই জাতীয়তাবাদের কাজ ছিল — প্রথমত, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং দ্বিতীয়ত , আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করা। প্রথমদিকের জাতীয়তাবাদীরা মনে করতেন জাতীয় চেতনাই মুখ্য, বাকি সব চেতনা তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেই তারা জাতি গঠনের প্রক্রিয়াটি বোঝার চেষ্টা করতেন। ঔপনিবেশিক ভারতের আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না, অথচ এই প্রাতিষ্ঠানিক চৌহদ্দির মধ্যেই প্রথম ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বার্তা প্রতিধ্বনিত হয় যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৯)-এর শেষ অবধি চলতে থাকে। গান্ধিজি এই সাংবিধানিক রাজনীতির বন্ধ দরজা ভেঙে দিয়ে গণ-জাতীয়তাবাদের নতুন অধ্যায় শুরু করেন চম্পারণ, অসহযোগ প্রভৃতি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। 

কেম্ব্রিজ ঘরানার রাজনীতি অবশ্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এই উত্থানকে কখনোই প্রাধান্য দেয়নি। অনেকে আবার মার্কসবাদী জাতীয়তাবাদের ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে তা ভারতের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম যত বাড়তে থাকে ততই ব্রিটিশ শাসনের স্বার্থ এবং ভারতীয় জনগণের স্বার্থের সংঘাতের বিরোধিতাগুলির মধ্যে বোঝাপড়া হতে থাকে। এরই ফলস্বরূপ ভারতে একটি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে , বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে, বিভিন্ন বর্গের মধ্যে যে গৌণ বিরোধিতা ছিল, জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে তা একাকার হয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হতে সাহায্য করেছিল। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে যে জাতি নির্মাণ হয় তা হল একটি বহমান প্রক্রিয়া যার মধ্যে বোঝাপড়া করে নেওয়ার চেষ্টা, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিরন্তর চলেছে।

একটা কথা প্রায়ই বলা হয় যে, শিল্পায়ন, নগরায়ন ও মুদ্রণ ধনতন্ত্রের ছত্রছায়ায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল। তবে একথা তর্ক সাপেক্ষ যে আফ্রিকা , এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পাশ্চাত্যের কোনও না কোনও আদর্শকে অনুসরণ করে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল। বিশেষ করে ভারতে ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক লড়াই শুরু হওয়ার অনেক আগেই ভারতীয় সমাজ ব্যক্তিগত সাংস্কৃতিক স্তরে জাতির কল্পনা করেছিল। এর অর্থ উনিশ শতকের গোড়াতেই উপনিবেশকারীদের হাতে থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমিসত্তা বাদ দিয়ে আধুনিক ভারতীয়ত্ব শুরু হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যতই তার প্রভুত্ব কায়েম করেছে, ভারতীয়দের পরম্পরাগত স্বদেশিকতা বিদেশি শাসকের সমালোচনায় ততই মুখর হয়েছে। বিদেশি শাসকের সঙ্গে বিদেশি দ্রব্য বর্জনও স্বদেশপ্রীতির অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। 

ভারতীয় সভ্যতা যে পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে কোনও অংশে কম নয়, বরং আধ্যাত্মিক গুণাবলিতে পাশ্চাত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর, তার বহু নিদর্শন পৃথিবীবাসী পেয়েছেন। শিক্ষিত ভারতীয়রা তাদের সংস্কৃতিকে একটি অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করে যাতে সহজেই সেই সংস্কৃতি বিশ্বদরবারে প্রদর্শন করা যায়, অন্যের সাথে তুলনা করা যায় এবং নির্দিষ্টভাবে উল্লেখও করা যায়। উনিশ শতকে সংস্কৃতি সম্পর্কে এই চিন্তাভাবনাই ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল যাকে আমরা রেনেসাঁ নামে জানি। এর উদ্দেশ্যই ছিল ভারতীয় সভ্যতাকে পুনরায় আবিষ্কার এবং শুদ্ধ করা। 

পাঁচ

নব্য ভাবধারা : ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও আন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির প্রায় অর্ধ শতক ধরে লড়াই পূর্ণতা লাভ করে যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি চরম মুহূর্ত বলে গণ্য করা হয়। এই সময় পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে জাতিরাষ্ট্র গঠনই প্রধান ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রোগভোগ, আয় বৈষম্যের হাত থেকে প্রতিটি নাগরিকের মুক্তিলাভের জন্য লড়াই-ই হয়ে উঠল জাতীয়তাবাদের নব্য-ভাবধারা। ভারতকে অনুন্নয়ন আর দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্ত করা ছিল নেহেরু সরকারের একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ, তবে তার থেকেও বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল ভারতকে অটুট রাখা। 

স্বাধীনতার আগে ইংরাজি সরকারি ভাষা থাকলেও দশ লক্ষাধিক লোকের মুখে প্রচলিত এমন প্রধান এগারোটি ভাষার মধ্যে একটি জাতীয় ভাষা ঠিক করা ছিল যথেষ্ট কঠিন কাজ। নেহেরু হিন্দুস্থানিকে জাতীয় ভাষা করতে চেয়েছিলেন, আবার উত্তর ও মধ্য ভারত থেকে হিন্দিকে জাতীয় ভাষা করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আপত্তি ও প্রতিরোধ হওয়ায় তা তখনকার মতো স্থগিত হয়ে গেলেও মোদি জমানায় ২০১৪ সালের পর থেকে আবার হিন্দিকে জাতীয় ভাষা করার প্রবণতা থেকে আধুনিক ভারতের নব-জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। 

১৯৬৭ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই জাতীয়তাবাদের প্রাদেশিক রূপ ক্রমশ সামনে আসতে লাগল। মুসলিম ভোটব্যাংক কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে বিরোধী দলগুলিকে সমর্থন করতে লাগল। তবে ইন্দিরা গান্ধির হাতে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় একটা অনভিপ্রেত ফলস্বরুপ ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে আঞ্চলিক দলগুলি মাথাচাড়া দিল। তামিলনাড়ুতে ডি এম কে, পাঞ্জাবের অকালি দল, অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু দেশম পার্টি, অসমে অসম গণ পরিষদ এবং পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরাতে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কংগ্রেসকে হারিয়ে রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় আসে। তবে সর্বভারতীয় দল হিসাবে এই দলগুলির অধিকাংশই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি বলে প্রাদেশিকতা নিয়ে তারা আন্তরিক থাকলেও জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যাথা ছিল না। এরপর ১৯৯০-এর দশকের শেষে প্রথম বিজেপি সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে সমর্থ হল। তখন থেকেই কংগ্রেসের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে সর্বভারতীয় স্তরে আবার নতুন করে জাতীয়তাবাদের প্রকাশ পেতে শুরু করল। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের পুনরায় ক্ষমতা দখল ঐ জাতীয়তাবাদকেই নতুন রূপে আপামর ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরে। ২০১৪ সালে পুনরায় বিজেপি সরকার গঠনের পর থেকেই ভারতবাসী এক নব্য উগ্র জাতীয়তাবাদ দেখতে শুরু করল। 

ছয়

করোনা এবং জাতীয়তাবাদ : নরেন্দ্র মোদি যখন একের পর এক পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলছেন, হঠাৎ করেই অধিকাংশ ভারতবাসী বিশ্বাস করতে লাগলেন যে সত্যিই এতদিন পর একজন খাঁটি ভারতীয়কে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানো হয়েছে। তবে শুধু হিন্দুত্বের আবেগই যে কোটি কোটি গরিব ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, তা বেশি করে বোঝা গেল ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে সারা বিশ্বের মতো ভারতকেও যখন গ্রাস করতে শুরু করল। সরকার যে এই ধাক্কা সামলানোর জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না তা কয়েক লক্ষ মানুষের অকালে প্রাণ চলে যাওয়াই বলে দেয়। 

যখন পশ্চিমের দেশগুলি নিজেদের পরিকাঠামো উন্নীতকরণে, কর্মসংস্থানে এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা করছে ভারত তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ, নাগরিক বিল (সিএএ), নোট বন্দী এবং ভারতে তৈরির (মেক ইন ইন্ডিয়া) মতো বিষয়েই নিজেদের আবদ্ধ রেখেছে। প্রজাতন্ত্রের গোড়ার দিকে সমাজতন্ত্র যদি নেহেরুপন্থী উন্নয়নের একটা বাঁধা বুলিও হয়ে থাকে, ১৯৯০-এর দশকে নানা ধরনের চাপে সে ধারণা উত্তরোত্তর দুর্বল ও অবমানিত হতে থাকে ও পরিশেষে বর্জিত হয়। তার আগে পর্যন্ত ভারত বিশ্বের কঠোরতম নিয়ন্ত্রিত অর্থব্যবস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। বৈদেশিক লেনদেনের হিসাবে গুরুতর ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে নরসিংহ রাও ও মনমোহন সিংহের হাত ধরে ভারত যে উদারীকরণের নীতি গ্রহণ করেছিল তা ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্বায়নের পথে উত্তরণের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।  

বিশ্বায়নের ফল মিশ্রভাবে ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে। একদিকে ১৯৯১ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে উচ্চ বার্ষিক হারে (৬.৫ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে , অন্যদিকে এই প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ সৃষ্টি করতে না পারায় অনেক গরিব চাষি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন। ২০০৫ সালে একশো দিনের কাজ প্রকল্প এবং ২০১২ সালের খাদ্য নিরাপত্তা আইন কিছুটা দারিদ্র্যতার প্রকোপ কমালেও আর্থিক বৈষম্য  ক্রমাগত বাড়তে শুরু করে। এরই প্রতিফলন ঘটে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে। 

কোভিড যেন জাতীয়তাবাদের প্রতি মানুষের পুনরাগ্রহকে উসকে দিল। প্রারম্ভিকভাবে নিম্ন মধবিত্তরা সরকার প্রদত্ত সবরকম সুবিধা গ্রহণ করলেও মধ্যবিত্তদের মধ্যে সংকোচ কাজ করছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরই রুজি ও রুটিতে টান পড়ে এবং সবাইকেই সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কর্মহীন অবস্থা চলতে থাকায় সরকার যে কোভিড প্যাকেজ ঘোষণা করে তার সুবিধা নেওয়ার জন্য ভারতবাসী মরিয়া হয়ে উঠল। যেসব সরকারি সাহায্যকে এতদিন শুধু গরিবদের জন্য মনে করা হচ্ছিল তা নিয়ে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরাও নড়েচড়ে বসলেন। বিনা পয়সায় রেশন নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যেতে লাগল। কোভিডের প্রতিষেধক নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে পকেট থেকে খরচ করে ভ্যাকসিন নিলেন কয়েকজন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই সেই সামর্থ্যটুকুও ছিল না। ফলে বিনা খরচে প্রতিষেধক গ্রহণ করার জন্য মাঝরাত্রি থেকে লোকজন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সামনে ভিড় জমাতে শুরু করল। 

ভারত সরকার প্রথমে করোনা মোকাবিলায় ধীরে চলো নীতি নিলেও মহামারির প্রকোপ বাড়তেই নিজেকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লাগল। পিছিয়ে থাকল না রাজ্যগুলিও। কেরালা, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা করোনা মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিল। কোভিডকালে যেন ভারতে জাতীয়তাবাদের পুনর্জীবন হলো বলা যায়। যা দ্বি-মাত্রিক স্তরে প্রকাশ পেতে থাকল। প্রথমত, রাষ্ট্র জনকল্যাণমুখী প্রকল্প গ্রহণ করে জনগণের পাশে থাকার আশ্বাস দিল এবং দ্বিতীয়ত, জনগণও হঠাৎ করে সরকার মুখাপেক্ষী হতে শুরু করল। এতদিন যে বাজার ব্যবস্থার প্রতি তারা মনোনিবেশ করেছিল যেন তা থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হল এবং জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নিজেদের আত্মগরিমা প্রকাশ করতে থাকল। 

নতুন বিজেপি সরকার নির্বাচনি ইস্তেহার মতো কাজ শুরু করলেও তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদ ক্রমশ ভারতবাসীকে অতিষ্ট করে তুলল। এরই প্রভাবে করোনার সময়ে উপযুক্ত পরিকাঠামোর ও পরিকল্পনার অভাবে কেউ মহামারির প্রত্যক্ষ আঘাতে বা কেউ কাজ হারিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের মতো পরোক্ষভাবে মারা পড়ল। আশু বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পরবর্তীকালে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা, বিনামূল্যে রেশন বিলি, কোভিড টিকাকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার জনকল্যাণে ব্রতী হয়েছে। যদিও করোনার আঘাত ভারতবাসীর মনে ও শরীরে এবং অর্থব্যবস্থায় যে ভয়ংকর ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা থেকে মুক্ত হতে শুধু জাতীয়তাবাদের জিগির তুললেই হবে না সঠিক পরিকল্পনা ও আর্থিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে। সেই সুদিন থেকে আপাতত আমরা দূরেই আছি তা বোঝার জন্য জাতীয়তাবাদের তকমা লাগবে না।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান