ক্রিকেট, ভারত এবং জাতীয়তাবাদ

অঙ্কন চক্রবর্তী 

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক খেলাধুলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরায়েলি খেলোয়াড়েরা নিহত হলে খেলার মাঠ হয়ে ওঠে ঘোর রাজনীতির ক্ষেত্র। বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা রাজনৈতিক কারণে বহুকাল আন্তর্জাতিক খেলায় নিষিদ্ধ থাকে। আবার, ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে খেলাধুলাই ছিল সমাজতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রদর্শনীর ক্ষেত্র। ১৯৭২ সালে ববি ফিসার ও বরিস স্প্যাসকির বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধের সমতুল্য একটা কিছু। এখানেই শেষ নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো মস্কোয় অনুষ্ঠিত ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক বর্জন করেছিল। বিপরীতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার মিত্রবর্গ বর্জন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের অলিম্পিক। বিশ্বমঞ্চে জাতিগত প্রতিদ্বন্দিতা নিয়ে রাজনীতি তাই নতুন কিছু নয়। নতুন নয়, খেলার মাঠে জাতীয়তাবাদী অনুষঙ্গের ব্যবহার।  

জাতীয়তাবাদী প্রেক্ষাপট থেকে ক্রিকেটের কথা বলতে গেলে প্রথমেই অ্যাশেজ সিরিজের কথা মনে আসে, যেটি ছিল ঐতিহাসিকভাবে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার পরস্পর জাতিগত মর্যাদা রক্ষার খেলা। মনে পড়ে, ১৮৭৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে দু-টি দল অস্ট্রেলিয়া সফর করেছিল, একটি ছিল জেমস লিলিহোয়াইটের নেতৃত্বে প্রফেশনাল ট্যুর, অন্যটি ফ্রেড গ্রেসের নেতৃত্বাধীন বন্ধুত্বপূর্ণ সফর। এখানে উল্লেখযোগ্য হল, এই সফরগুলির স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে ব্রিটিশরা পরোক্ষে অস্ট্রেলিয়ানদের পরাধীন জাতিসত্তাকে মান্যতা দিয়েছিল। আবার, আয়ারল্যান্ডও একসময় তাদের দেশে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি খেলাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিল। কারণ, এসব খেলার জন্ম ইংল্যান্ডে, যাদের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের ছিল ঐতিহাসিকভাবে জাতিগত বিরোধ। মোট কথা, আন্তর্জাতিক খেলার মঞ্চকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার উপায় নেই। 

ভারতের সঙ্গে ক্রিকেটের যোগাযোগের শুরু সেই অষ্টাদশ শতক থেকে। ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ার সুবাদে খুব সহজেই এদেশে ক্রিকেট আত্মপ্রকাশ করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিল অনুযায়ী, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ক্রিকেট খেলা হয়েছিল গুজরাতের কচ্ছে, ১৭২১ সালে। ১৭৯২ সালে কলকাতায় প্রথম একটি ক্রিকেট ক্লাবের সূচনা হয়, নাম ছিল ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব ক্লিপার্স। ১৭৯৯ সালে দক্ষিণ ভারতের শ্রীরঙ্গপত্তমে তৈরি হয় এরকম আরও একটি ব্রিটিশ ক্রিকেট ক্লাব। এভাবেই সূচনা। প্রথমদিকে রাজপরিবার, জমিদার, প্রভৃতি সামাজিক প্রতিপত্তি সম্পন্ন মানুষ ব্রিটিশদের আমন্ত্রণে এই খেলা শেখে বা অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তবে ধীরে ধীরে এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্রিকেটের বীজ রোপিত হয়ে যায়। অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন যে কৃষি প্রধান দেশ হওয়ার সুবাদে ভারতীয়রা খুব সহজেই খেলাটির সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। কারণ কৃষির মতো ক্রিকেটেও পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার একটা প্রভাব রয়েছে। আশিস নন্দী দাবি করেছেন যে, “Cricket is an Indian game accidentally discovered by the English.”

মোটামুটিভাবে ঐতিহাসিকদের ধারণা ভারতে সংগঠিত ক্রিকেটের সূচনা হয় ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে, পারসিদের দ্বারা, মুম্বাইতে ওরিয়েন্টাল ক্রিকেট ক্লাব স্থাপনার মাধ্যমে। এর প্রতিক্রিয়াতেই ১৮৫০ এবং ১৮৬০-এর দশকে একাধিক পারসি ক্লাব গড়ে উঠতে থাকে। এই ক্লাবগুলোর পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের সাথে খেলার মাঠে প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যায়। বোম্বাই জিমখানায় পারসি এবং ইউরোপীয়দের মধ্যে ১৮৯২ সালের ২৭ আগস্ট ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণির ম্যাচটি খেলা হয়েছিল। এটি সম্পূর্ণ পারসি দল ছিল। এটি ছিল প্রথম বোম্বে প্রেসিডেন্সির ম্যাচ। ১৯০৭-০৮ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু দল যোগ দিলে এর নাম হয় ট্রাংগুলার কাপ। তবে পরে ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম দলের যোগদানের ফলে এর নাম হয় কোয়াড্রাঙ্গুলার কাপ এবং ১৯৩৭-৩৮-এ অবশিষ্ট ভারতের অন্তর্ভুক্তির দৌলতে প্রতিযোগিতার নাম হয় পেন্টাঙ্গুলার কাপ। 

অতএব দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেটের সূচনার বছরগুলিতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের যত না ভূমিকা ছিল, তার থেকে বেশি ছিল সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রদর্শনের তাগিদ। তবে জাতীয়তাবাদী মনোভাব যে একেবারেই ছিল না তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমরা সকলেই একটি বিষয়ে অবগত যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিপাহিরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসনের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই ঘটনাকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চা প্রথম উপনিবেশ বিরোধী বিদ্রোহের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বোরিয়া মজুমদার এমন দাবি করে থাকেন যে, এরূপ স্পর্ধা দেখানোর আত্মবিশ্বাস সিপাহিরা কিছুটা হলেও অর্জন করেছিলেন ক্রিকেটের মাঠ থেকে। তাঁর এই বক্তব্য ওয়াটারলু যুদ্ধজয়ী ডিউক অফ ওয়েলিংটনের বক্তব্যকেই যেন অনুসরণ করে, “the battle of waterloo was won on the playing fields of Eton.” 

১৮৩০ এবং ১৮৪০-এর দশকে ক্রিকেট ম্যাচগুলিতে ভারতীয় সিপাহিরা অনেকবারই ইংরেজদের নিজস্ব খেলাতেই তাদের আধিপত্যকে সফলভাবে রুখে দিতে সমর্থ হচ্ছিল। এক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, কেন প্রথমে ভারতীয় সিপাহিরা এবং পরবর্তী সময়ে দেশীয় রাজন্যবর্গ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিদেশিদের সঙ্গে ক্রিকেট সংক্রান্ত প্রতিযোগিতাকেই বরণ করে নিল। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের কথা বলা যেতে পারে — প্রথমত, তাদের মনে হয়েছিল এই খেলাটি একটি উপযুক্ত সাংস্কৃতিক মাধ্যম, যার সাহায্যে তাদের আহত আত্মসম্মান আর ঝিমিয়ে থাকা পৌরুষকে শুশ্রূষা করা যাবে এবং দ্বিতীয়ত, তাদের মনে হয়েছিল অন্ততপক্ষে খেলার মাঠে ব্রিটিশ প্রভুদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়া যেতে পারে। এটা ছিল এমন একটা সময় যখন মনে করা হয়েছিল, খেলাধুলো এমন একটি অস্ত্র যা বিভেদকে সামান্য হলেও সামঞ্জস্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

খেলার মাঠে এই ধরনের আদি জাতীয়তাবাদী কাজকর্মই ১৮৫৭-এর পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক ক্রীড়া সংক্রান্ত কর্মবিধির প্রসার ঘটায়। তবে, ভারতীয় ক্রিকেট সংগঠনের ব্যাপারে ব্রিটিশরা প্রশ্রয় দিয়েছিল রক্ষণশীলতাকেই, যা ১৮৫৭ এর বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নিয়েছিল। অন্যদিকে মেটকাফ ও অন্যান্যরা জানাচ্ছেন, বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রভুদের লক্ষ্য ছিল দেশীয় রাজাদের প্রশাসনের পুরোভাগে ফিরিয়ে আনা। এই সুবাদেই অর্থবান ও অভিজাত দেশীয় রাজন্যবর্গকে যেমন প্রশাসনের উচ্চপদ দেওয়া হয়, তেমনই তাদের নিজস্ব খেলা ক্রিকেটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ উলটো দিকে, দেশীয় অভিজাতরাও প্রভুর দাক্ষিণ্য পাওয়ার তাগিদে খেলাটিকে আপন করে নেয়। 

যাইহোক, ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে খেলার মাঠে সম্প্রদায়ভিত্তিক লড়াইয়ের কারণে বোম্বে প্রেসিডেন্সির  প্রতিযোগিতা বেশ জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। খেলার মাঠে জনসমাগম বাড়তে থাকে। অবশ্য, রজত ভট্টাচার্য দাবি করেছেন মূলত সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক চরিত্রের জন্য ১৯৪৫-এর পর এই প্রতিযোগিতা জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বোরিয়া মজুমদার দাবি করেছেন, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে BCCI-এর আবির্ভাবের পর তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, যাতে এই প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ এই প্রতিযোগিতা BCCI আয়োজিত রঞ্জি ট্রফির জনপ্রিয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছিল।

ইতিমধ্যে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা।  BCCI-এর আবির্ভাবের দৌলতেই সেই বছর নিখিল ভারতীয় ক্রিকেট দল পাড়ি জমাল সুদূর ইংল্যান্ডে, টেস্ট খেলার তাগিদে। ১৯১১ তেও অবশ্য একবার ভারতীয় ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডে সফর করেছিল, কিন্তু আইসিসির স্বীকৃতি না থাকায় সেই সময়ে কোনও টেস্ট ম্যাচ তারা খেলতে পারেনি। এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নির্বাচকদের অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা। সমাজের উচ্চশ্রেণির হিন্দু প্রাধান্য যুক্ত এই দলে জায়গা করে নিয়েছিল তথাকথিত অচ্ছুৎ জাতিভুক্ত দুই ভাই, বালু এবং শিবম পালওয়াঙ্কার। যাইহোক, ১৯৩২ সালের এই ইংল্যান্ড সফরও নিখিল ভারত ক্রিকেট টিমের পক্ষে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনটে টেস্ট ম্যাচ খেলার পরিকল্পনা থাকলেও আবহাওয়ার কারণে একটি টেস্টই অনুষ্ঠিত হয়। সেই টেস্টে ভারতীয় দল ১৫৮ রানে পরাজিত হয় ঠিকই, কিন্তু তাদের বোলিং ও ফিল্ডিং বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়ে। সাউদার্নটন ‘উইজডেন’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, “…the tour proved of immense value to the Indians and the lessons learnt will no doubt the past on the Indian cricket of the future. ” আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ইংল্যান্ডের মাটিতে এগারো জন ভারতীয়ের লড়াই কোথাও না কোথাও উপনিবেশ বিরোধী ভারতীয় জাতিবোধকে পরিপুষ্ট করেছিল। 

স্বাধীনতার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবেই বদলে যায়। এইসময় উপমহাদেশে একজন ভালো ক্রিকেটার হওয়াকে একজন ভালো নাগরিক হওয়ার সমতুল্য বলে মনে করা হতে থাকে। পাশাপাশি, খেলাটি হয়ে উঠেছিল জাতিসত্তা এবং পৌরুষ প্রকাশের মাধ্যম।  প্রথমপর্বের স্বাধীন ভারতে সিনিয়র পতৌদি এবং কে এস রঞ্জিত সিংজি ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক, তবে জাতীয়তাবাদের এই ধারণাটি বর্তমান জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে  ক্রিকেটাররা দেবতায় পরিণত হচ্ছিলেন, যে ধারা আজকেও বর্তমান। এই সম্পর্কে রামচন্দ্র গুহ-র বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন, “India will never be a tiger [in terms of economic power] to match the other Asian tigers [e.g. South Korea, Malaysia]. India ranks about 150 in the World Development Report, just below Namibia and above Haiti. It is the cricketers and they alone, who are asked to redeem these failures, to make one target, at least temporarily, the harsh realities of endemic poverty and corrupt and brutal politicians.” 

অনেকে বলে থাকেন ভারতীয় ক্রিকেটের গণভিত্তি মজবুত হয়েছিল কপিল দেবের হাত ধরে, ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে ১৯৭০-এর দশক থেকে নীতিগত পরিবর্তনের কারণে এবং astroturf আসার ফলে ভারতীয় হকি দলের পারফরম্যান্স ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল, ফলে হকির জনপ্রিয়তায় ভাটা এসেছিল। অন্যদিকে, সত্তরের দশক থেকেই ভারতীয় ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্স ভারতীয়দের মনে আশার সঞ্চার করে। ১৯৭০-৭১-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এবং ১৯৭২-৭৩-এর ইংল্যান্ড সফরে ভারত যথাক্রমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়। যেখানে শেষবারের মতো ভারতীয় হকি টিম স্বর্ণপদক লাভ করে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকে। সেখানে ভারতীয় ক্রিকেটের জয়যাত্রা শুরু হয় ঠিক এই সময় থেকেই। 

ভারতীয় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার পশ্চাতে এবং সেখানে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সঞ্চার ঘটাতে যে সমস্ত বিষয় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে অগ্রগণ্য হল প্রচারমাধ্যম বা মিডিয়া। বলা যেতে পারে ক্রিকেটের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের যোগসূত্র স্থাপনে মিডিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা শুরু হয়েছিল মোটামুটিভাবে ১৯৯৩ থেকে। সময়টা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখা যায়, মাত্র এক দশক আগেই কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারত শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রুডেন্সিয়াল কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ভারত ছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপে সেমিফাইনালিস্ট, ১৯৯২ সালে যদিও ভারতের পারফরম্যান্স ছিল খুবই হতাশজনক। ভারতীয় দলের পারফরমেন্সের খুঁটিনাটি মিডিয়ায় কভার হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এই খেলা নিয়ে উন্মাদনা চরমে ওঠে। সাধারণের মনে খেলার মাঠে জাতীয় দলের লড়াই জাতীয়তাবাদী জিগির তোলে। 

মিডিয়ার অবদান আলোচনা প্রসঙ্গে, দুজন মানুষের ভূমিকার কথাও উল্লেখযোগ্য। এঁরা একাধারে ভারতীয় ক্রিকেটের বাণিজ্যিকরণ ঘটিয়েছিলেন এবং ক্রিকেটকে ভারতের প্রতিটি কোণে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন হলেন BCCI সভাপতি, শ্রী জগমোহন ডালমিয়া এবং অন্যজন হলেন অস্ট্রেলীয় মিডিয়া টাইকুন, ইএসপিএন এবং স্টারস্পোর্টস চ্যানেলের কর্নধার, রুপার্ট মার্ডক। মনে রাখা দরকার, ৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দল আর ১৯৯২-এর হতাশাজনক পারফরম্যান্সকারী ভারতীয় দলের প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ ইতিমধ্যে ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণ ঘটে গিয়েছে, ভারতবাসী পরিচিত হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তথা মার্কিন কর্পোরেট জগতের সাথে। এ এক নতুন ভারত, সম্ভাবনাময় ভারত। বদলে যাচ্ছে তার আশা আকাঙ্ক্ষা। 

এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে টেলিভিশন যে কাজ করেছিল, রেডিও কি সেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল? উত্তরটা হল একেবারেই না। বরং বলা চলে রেডিও টেলিভিশনের কাজটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। রেডিওর কথা যদি বলি তাহলে এক নিশ্বাসেই যে নামগুলি বলে দেওয়া যায় তাঁরা হলেন— পিয়ার্সন, সুরিটা এবং বেরি সর্বাধিকারী, ‘ভয়েস অফ ইন্ডিয়ন স্পোর্টস’ যশদেব সিং, ’ভয়েস অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কমেন্ট্রি’ নামে পরিচিত ড. নরোত্তম পুরি, সুরেশ সরাইয়া, ডিকি রত্নাগর, কিশোর ভিমানি এবং আরও অনেকে। কলকাতার আকাশবাণী থেকে অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্য ও পুষ্পেন সরকারের ধারাভাষ্যে কণ্ঠস্বরের নাটকীয় উচ্চাবচতা, তথ্যতালাশের অনন্য উপস্থাপন সহ ক্রিকেটখেলার মাঠ জীবন্ত হয়ে উঠত। টিভি আসার আগে এঁদের খেলার ধারাবিবরণী শুনেই খেলা দেখে ফেলা যেত। 

ভারতীয় ক্রিকেটের টেলিভিশনে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছিল ডালমিয়ার হাত ধরে, তবে অতি সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন প্রধান আলি বাখার দাবি করেছেন এর পেছনে ছিল তাঁর মাথা। বর্ণবিদ্বেষের কারণে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসর থেকে নির্বাসিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন সিরিজে ক্লাইভ রাইসের দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয়েছিল মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারত। বাখার এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘কলকাতায় পৌঁছে দেখলাম দূরদর্শনে খেলা দেখানো হবে। তার জন্য বিসিসিআই তাদের টাকা দেবে। ভারতে নাকি সেটাই নিয়ম। আমি তো দেখে হতভম্ব। ডালমিয়াকে বললাম, আরও একটা ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা। তৈরি থাকুন। বললাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সিরিজ দেখানোর ব্যবস্থা করব আমরা। তার বদলে ভারতীয় বোর্ডকে মোটা টাকা পাইয়ে দেব। ডালমিয়া প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে চাননি। তারপর বুঝলেন, বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বাকিটা ভারতীয় ক্রিকেটে ইতিহাস।’’ 

১৯৯৩ সালে ডালমিয়ার সহযোগিতায় তৎকালীন বিসিসিআই সভাপতি মাধবরাও সিন্ধিয়া দূরদর্শনের বিরূদ্ধে টেলিভিশন রাইটস সংক্রান্ত মামলায় জয়লাভ করেন, ভারতীয় ক্রিকেটের পরিপ্রেক্ষিতে এই জয়লাভ ছিল সুদূরপ্রসারী। এই মামলাতে মহামান্য আদালত ঘোষণা করে এবার থেকে দূরদর্শন ক্রিকেট সম্প্রচার করার জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে অর্থ প্রদান করবে। ১৯৯৫ সালে শীর্ষ আদালত এই বিষয়ে মন্তব্য করেন যেহেতু ভারতীয় ক্রিকেট BCCI-এর একটি পণ্য, তাই BCCI-এর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে হায়েস্ট বিডারকে সম্প্রচারস্বত্ব বিক্রি করার। এই সময় থেকে BCCI ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী এবং আর্থিক দিক থেকে পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে থাকে। যে কাজটা রেডিও করতে পারেনি সেই কাজটা করে দিল টেলিভিশন l 

ভারতে অর্থনীতির উদারীকরণের ফল হয়েছিল দ্বিমুখী — একদিকে যেমন পেপসি এবং কোকাকোলার মতো কোম্পানি ভারতীয় ক্রিকেট তারকাদের তাদের বিজ্ঞাপনী মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিল, তার ফলে ঠান্ডা পানীয়ের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে, অন্যদিকে এর ফলে কর্পোরেট পুঁজি ভারতীয় সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল। একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হল, যাদের জন্য ক্রিকেটের সাথে জাতীয়তাবাদের নতুন করে যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল। 

দুই দেশের মধ্যে যখন খেলা হয়, তখন দর্শকের জন্য তা স্রেফ একটা আনন্দময় সময় কাটানোর ব্যাপার থাকে না। খেলার একটা প্রতীকী অর্থ তৈরি হয় তখন। খেলা হয়ে ওঠে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক, জাতির পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে এবং অবশ্যই জাতীয়তাবাদ চর্চার আধার। দেশপ্রেমের জাতীয়তাবাদ কখন যেন বদলে যায় শত্রু খোঁজার জাতীয়তাবাদে! এর সবচেয়ে কদর্য বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় প্রাথমিকভাবে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচের সময়, আর বর্তমানে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচে। ২০০৩ সালের সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কথা ধরা যাক। মিডিয়া একে প্রচার করেছিল ‘mimic warfare’ হিসেবে এবং এই বিশ্বকাপটি ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে স্মরণীয় হয়ে আছে সেঞ্চুরিয়নে পাকিস্তানের প্রথমে ব্যাট করে ২৭৩ রান তাড়া করতে গিয়ে সচিনের করা ঝকঝকে ৯৮ রানের সৌজন্যে। ভারত এখানে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জয়লাভ করে। সেইসঙ্গে জনমানসে জাতীয়তাবাদী সুখানুভূতি এনে দেয়। এরপর থেকে যতবার ভারত বিশ্বকাপে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছে  দুই দেশের মিডিয়া একে যুদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে, সেটা ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হতে পারে, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হতে পারে বা সম্প্রতি ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হতে পারে। একমাত্র পাকিস্তানের বিরূদ্ধে খেলার সময়ই দেশ অতিমাত্রায় ভারতীয় হয়ে ওঠে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সকলেই ক্রিকেটের মাঠে পাকিস্তানের পরাজয়ের বিনিময়ে ভারতের জয় দেখতে চায়। 

আবার ইদানীংকালের ভারত-বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ক্রিকেট যুদ্ধ কী শুধুই ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে? এতে ক্রিকেটের পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতির কী কোনও  ভূমিকা নেই? বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এখানে তিন ধরনের মনস্তত্ত্ব কাজ করে। সীমান্ত সংঘাত, সাম্প্রতিক ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান এবং অভিন্ন নদীর জল-সংকট। এই তিন ধরনের মনস্তত্ত্বের অভূতপূর্ব মিল ঘটে যায় ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে। ক্রিকেটের হার-জিতে আনন্দ ও ক্ষোভ মিলেমিশে যায় জাতীয় জীবনে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির মধ্যে। এভাবেই ২২ গজের খেলার মধ্যে রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ আর অসমাপ্ত প্রসঙ্গগুলো চলে আসে। 

এবার প্রশ্ন হল, ভারতবর্ষে ক্রিকেট জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে কিনা। উত্তরটা একই সঙ্গে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। ক্রিকেটের মাঠে ভারতের জয়লাভ যেমন মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তেমন এটাও দেখতে হয় ভারতের প্রতিপক্ষ কে? ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহর মতে, ব্রিটিশ ভারতের যেসকল প্রতিষ্ঠান আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে তা হল ভারতীয় রেল, সিভিল সার্ভিস এবং অবশ্যই ক্রিকেট। কিন্তু এর বিপরীতে এটাও তো সত্যি যে অনেক ক্ষেত্রেই ক্রিকেট জাতীয় সংহতির বদলে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে বহন করে আনে। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অসহিষ্ণুতার ঘটনাই তার প্রমাণ।

এই ধারা যে কেবল ভারতেই প্রত্যক্ষ করা যায় এমনটা নয়। উদাহরণের স্বার্থে শ্রীলঙ্কার কথা বলতে পারি, যেখানে বিশেষত তামিলরা নিজেদের জাতীয় দলকে সমর্থন না করে অতীতে ভারতকে সমর্থন করেছে। একইরকমভাবে অনাবাসী ভারতীয়রা যারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা বা ইংল্যান্ডে বসবাস করে, তারাও জাতীয়তাবাদী আবেগের বশে খেলার মাঠে তাদের ফেলে আসা দেশ ভারতকে সমর্থন করে। জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও দেখান। গত শতকের শেষ ভাগে ব্রিটেনের কনসারভেটিভ দলের সদস্য নরমান টেবিট দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের কাছে দাবি করেছিলেন, তারা যেন ক্রিকেটের মাঠে ইংল্যান্ডকে সমর্থন করে, ইংল্যান্ডের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার জন্য। ভারতের বুকেও এমন দাবিকে সমর্থন করেছিলেন শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে, “I want them with tears in their (Indian Muslims) eyes every time India loses to Pakistan”— এই ছিল তাঁর বক্তব্য। 

বাস্তবিকই, জাতীয়তাবাদ যে কল্পিত সমাজের কথা বলে, একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল মানুষকে একটি সুতোয় গেঁথে রাখার আশ্বাস দেয়, তা ভারতবর্ষের ক্রিকেটের বিস্তারে কতটা অনুঘটকের কাজ করেছে তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। ভারতীয় ক্রিকেটে দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকগুলি লবি কাজ করে, যেমন প্রভাবশালী মুম্বাই লবি, দিল্লি লবি বা দক্ষিণী লবি। অর্থাৎ ভারতীয় দলে একজন ক্রিকেটারের উত্থান কালে পরিচয়ের নিরিখে সে যতটা না ভারতীয় তার থেকে বেশি সে হয়তো মুম্বাইকর বা দিল্লিবাসী। আবার, ভারত এমন একটা দেশ যাকে বলা যায়, দেশের ভেতরে একাধিক দেশের সহাবস্থান। এই দেশ একাধিক ভাষা, সংস্কৃতির পীঠস্থান। তাই অনেকক্ষেত্রেই জাতিগত পরিচয়ের থেকে বড়ো হয়ে ওঠে আঞ্চলিক প্রাদেশিক পরিচয়। এই ঘটনাকে খুব ভাল ভাবে বোঝা যায় আই পি এল-এর সময়। আই পি এলের উত্তেজনাকে জাতীয়তাবাদের অতি বড় সমর্থকও জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা বলবেন না।  

শেষ করব আই পি এল-এরই একটি ঘটনা উল্লেখ করে। বছরটা ২০০৮, কলকাতা নাইট রাইডার্স বনাম দিল্লি ডেয়ার ডেভিলস ম্যাচ। কলকাতা দলের সাবেক সদস্য পাকিস্তানি জোরে বোলার শোয়েব আখতারের আগুনে বোলিংয়ের সামনে দিল্লির তারকাখচিত ব্যাটিং লাইন-আপ ধ্বংস হয়ে যায়। আর তা দেখে প্রায় সকল কলকাতাবাসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কিন্তু এই একই শোয়েব আখতার যখন পাকিস্তান দলের সদস্য হিসেবে একের পর এক ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে সাজঘরের রাস্তা দেখিয়েছেন তখন জাতীয়তাবাদী আবেগে এই কলকাতাবাসী শোয়েবের শাপ-শাপান্ত করেছে। ফলে জাতীয়তাবাদের হিসেব বোঝা সত্যিই দুরূহ। ক্রিকেট হোক বা জনজীবনের অন্যত্র, জাতীয়তাবাদ তাই শেষমেশ এক কল্পিত জনসমাজের কথাই বলে। 

সহায়ক গ্রন্থ :

১. ‘কাপমহলা’ : গৌতম ভট্টাচার্য 

২. ‘Batting for India’ by Ramchandra Guha

৩. ‘Eleven Gods and a Billion Indians : The On and Off the Field Story of Cricket in India and Beyond’ by Boria Majumdar

৪. ‘Pundits from Pakistan : On Tour with India 2003-04’ by Rajat Bhattacharya

৫. ‘The Miracle that is India’ by Ramchandra Guha

৬. ‘The Tao of Cricket : On games of Destiny and Destiny of Games’ by Ashis Nandy

৭. ‘Twenty two Yards to Freedom’ by Boria Maumdar 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান