ফ্যাসিবাদ ও জাতীয়তাবাদ : যোগসূত্র ও গতিপ্রকৃতি

কঙ্ক ঘোষ 

এক আপাত ঝঞ্ঝাটহীন সকালে একটা খবর ঢোকে সেলফোনে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘দেশ বিরোধী’ স্লোগান দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, এমন অভিযোগ কানে আসে। ঠিক, ভুল, ট্রুথ, পোস্ট ট্রুথ যাচাই করার আগেই ইনফোডেমিক বাসা বাঁধে শরীরে, মননে। এয়ার স্ট্রাইকের আদলে মুহুর্মুহু তথ্যের বিস্ফোরণ। দুর্বার গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমরা ভাত, ডাল, বিরিয়ানি, পপকর্ন খেতে খেতে পক্ষ নিই। রাষ্ট্রের বিশালাকার নির্মাণ, রাষ্ট্রব্যবস্থার দানবীয় উপস্থাপনার অনিবার্যতায় যাবতীয় দ্বন্দ্ব, বাস্তবতা, বস্তুবাদী বিশ্লেষণ ভুলে শক্তিশালীর পক্ষ নিয়ে ফেলি আমরা। প্রতিবেশী, ভার্চুয়াল বন্ধু, অ্যালগরিদম, টুইটার, মগজ, মন, বোধ, বীক্ষণ। ৭০ দশকে উদ্বাস্তু নীলকান্ত বাগচি বলেছিলেন ‘ভাবা প্র্যাকটিস করো’। ২০১৬-য় সেই অবকাশ ফুরিয়েছে। দুপুরের লাঞ্চ থেকে রাত্রে ডিনার করতে করতে শূন্যপন্থী আমরা ডানদিক ঘেঁষে বেডরুমে হাঁটা দিই। মিডিয়ার ফেড আউট ভাষ্যে ‘দেশদ্রোহী’ শব্দবন্ধ সশব্দে শিরায় প্রবেশ করে। স্বপ্নে অবচেতনের অবিরাম পদধ্বনি। ঘুম ভাঙা চোখে নতুন কয়েনেজ ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর ডোপ নিয়ে সম্মতি নির্মাণের ট্রায়ালে সম্মতি এবং স্বেচ্ছাশ্রম। সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্বিতচর্বণ। নিউজ মিডিয়ায় খাপ পঞ্চায়েত। প্রিন্ট মিডিয়ার মুখরোচক শিরোনাম। ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে ওঠে ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৩-এর ওয়াইমার রিপাবলিক। রাইখস্ট্যাগে আগুন। ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (নাৎসি) শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে কমিউনিস্টদের। ১৯৩২ অবধি জার্মান সংসদে (রাইখস্ট্যাগ) নাৎসি এবং সহযোগীদের আসন সংখ্যা ছিল ২৪৭, কমিউনিস্ট পার্টির আসন সংখ্যা ছিল ১০০। ২৭ ফেব্রুয়ারির অগ্নিসংযোগকে কমিউনিস্টদের ওয়াইমার রিপাবলিক উৎখাত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে তুলে আনা হয়। তরুণ ডাচ কমিউনিস্ট ভ্যান ডার লুবের গ্রেফতারি এই নির্মাণকে মান্যতা দেয়। জার্মান জনগণের ‘সুরক্ষা’-র তাগিদে ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিক্রি জারি করে সমস্ত গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি বন্ধ করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বিনা প্রশ্নে যেকোনও বিরুদ্ধস্বর রুদ্ধ করার ফর্মান জারি হয়। বিদ্যুৎগতিতে ওয়াইমার রিপাবলিকের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ বদলে যেতে থাকে। ২০ মার্চ দাখাউ (Dachau) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প দরজা খোলে। একের পর এক রাজনৈতিক বন্দিদের স্থান হয় দাখাউ। আগামী ৪ বছর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার লক্ষ্যে নাৎসি পার্টি ‘enabling act’ পাশ করানোর প্রস্তুতি নেয়। সংবিধান সংশোধনের এই বিল পাশ করাতে রাইখস্ট্যাগের দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোট জরুরি। জার্মান সেন্টার পার্টি ক্যাথলিক চার্চের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে নাৎসিদের সাথে সমঝোতা করে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৯৪টা ভোটের বিপক্ষে ৪৪৪টি ভোট পেয়ে ২৪ মার্চ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নাৎসি পার্টি। ওয়াইমার রিপাবলিকে বসন্ত ঘৃণায় জারিত হয়ে ওঠে। উগ্র জাতীয়তাবাদের গণ-হিস্টেরিয়া গণহত্যার সম্মতি দেয়। শিরায় শিরায় প্রতিক্রিয়াশীলতার স্রোত। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গণসম্মতির রক্তপাত। এবং গণহত্যার মহাকাব্য। 

দুটি ঘটনার প্রেক্ষিত আলাদা। আলাদা পটভূমি, সময়, সমাজ, বাস্তবতা। আবার ঘটনা দুটির পরবর্তী জনমত এবং জনগণের এক বড়ো অংশের সম্মতি উৎপাদনের প্রশ্নে নিবিড় যোগও চোখে পড়ে। দেখা যাবে ‘দেশ বিরোধী’ স্লোগান কী, কেন, কোন্ স্লোগান দেওয়া হয়েছিল, দেশ বিরোধিতার সংজ্ঞাই বা কী? এইসব প্রশ্ন অবাঞ্ছিত হয়ে গেছে দ্রুত। কিন্তু থেকে গেছে তার অভিঘাত। অনেক মানুষ স্লোগান না শুনেই পক্ষ নেন। অনেক মানুষ পরবর্তী আইনি কার্যকলাপ বা বিচারের রায় বা ফ্যাক্ট-চেক নিয়ে পর্যালোচনা করেন না। কে বা কারা যেন করতে দেয় না! এক সংবাদসংস্থার সম্প্রচারিত ভিডিও পরবর্তীকালে ‘doctored’ প্রমাণিত হয়। জার্মান নাৎসি প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য ও রাইখস্ট্যাগ আগ্নিকান্ডের সাক্ষী হ্যান্স-মার্টিন লেনিংসের স্বগতোক্তিতেও একইভাবে উঠে এসেছিল বিরুদ্ধমত। ভ্যান ডার লুবে রাইখস্ট্যাগে পৌঁছানোর আগেই হ্যান্স আগুনে পোড়া গন্ধ পান রাইখস্ট্যাগে। সেই স্বীকারোক্তি সময় ধরে রাখেনি। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গণজনমত প্রতিক্রিয়াশীল আবেগের হাত ধরে। কারণ, চিন্তন, বিবেচনা গৌণ হয়ে পড়ে। প্রকাশভঙ্গির তীব্র অভিঘাতই ইতিহাসে স্থান পায়। এই দুই ঘটনার সূত্র থেকে আমরা আলোচনা শুরু করব। কীভাবে গড়ে ওঠে এই জেনোসাইডের মহাকাব্য? কোন্ আর্থসামাজিক অবস্থায় এই বিভাজনের রাজনীতি মান্যতা পায়? অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে সামাজিক কাঠামোয় পুঞ্জীভূত পরিচিতি সত্তাজনিত বিভেদকে উসকে দেয়? নাকি এই বিভেদের বীজ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই? সেই বিভেদের পথ ধরে কীভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায় মানুষকে? কীভাবে বাড়ানো যায় দূরত্ব? 

পদ্ধতিগুলো খানিকটা আমাদের জানা। জাতি, বর্ণ, ধর্ম শতসহস্র পরিচিতি। সহস্র নিরাপত্তাহীনতা। তাকে উসকে, কাজে লাগিয়ে বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক সুরক্ষার অভাবকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল। ক্রমাগত দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুপক্ষের নির্মাণ, বিনির্মাণ। বিদ্বেষের আগুন জারি রাখা। সেই বিদ্বেষের আগুনে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারাবাহিক ব্যবহার। বিচ্ছিন্ন সামাজিক, জাতিগত, বর্ণগত, রাজনৈতিক সংখ্যালঘু নির্মূলের সম্মতি আদায়। কিন্তু এত বিচ্ছেদ, বিদ্বেষের ধারাবাহিক পুষ্টি আসে কোথা থেকে? সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য সংগঠিত রূপ পায় কীভাবে? নির্মিত ‘শত্রু’পক্ষের থেকে কী রক্ষা করার তাগিদে এই আয়োজন? ধর্মীয়, জাতিগত বা বর্ণগত একাধিপত্য, এই বিমূর্ত নির্মাণের বাস্তবরূপ কীভাবে প্রকাশ পাবে? এই প্রশ্নগুলোর সূত্র ধরে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোগত বিষয়গুলি নজরে আসে। ক্রমাগত শত্রু নির্বাচনের অনুশীলনে এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের আইডিয়া। উগ্র জাতীয়তাবাদের জঠরে বেড়ে ওঠে পরিচিতিজনিত সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য। আমার ধর্মীয়, জাতিগত বা বর্ণগত একাধিপত্যের প্রক্রিয়ায় মিশে যেতে থাকে রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির বৈধতা। রাষ্ট্রের শক্তিশালী কাঠামোর ছায়ায় আর্থসামাজিক নিরাপত্তাহীন আমি সাময়িক আশ্বস্ত হই। বদলে শাসকশ্রেণিকে জোগাতে থাকি আনুগত্য। আমি রাষ্ট্র এবং দেশ গুলিয়ে ফেলি। দেশ এবং শাসক গুলিয়ে ফেলি। শাসকের আগ্রাসনকে ভাবি দেশের কর্তব্য। রক্ত গরম হয়। ইনফরমেশন যুদ্ধের শিকার হই। মস্তিষ্কের জড়তা মূলস্রোতে আসে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে সহনাগরিক নিধনে, পীড়নে পৈশাচিক আনন্দ হয়। উদ্বাস্তু, শরণার্থী, অভিবাসী, পরিযায়ী, ঊর্ধ্বস্তন এবং অধস্তন নাগরিক শব্দবন্ধ দৈনন্দিন আলোচনায় ফিরে ফিরে আসে। জাতীয়তাবাদের প্রশ্নকে পরজীবীর মতো আঁকড়ে ধরে ঘৃণার তীব্রতা বাড়তে থাকে। উগ্র জাতীয়তাবাদের চারণভূমিতে আমাদের স্বাগত জানায় ফ্যাসিজম। 

ফ্যাসিবাদ এবং জাতীয়তাবাদের যোগসূত্রগুলি বিশ্লেষণের জন্য বিষয়টিকে আমরা কতগুলি ধাপে আলোচনা করব। প্রথমে আমরা ফ্যাসিবাদের মৌলিক ধারণা সম্পর্কে আলোচনা এবং বাস্তবায়নের বিভিন্ন পদ্ধতি সংক্রান্ত বিশ্লেষণ করে ফ্যাসিবাদের আদর্শগত ভিত্তি বোঝার চেষ্টা করব। এর পরের ধাপে উঠে আসবে ফ্যাসিবাদ উত্থান এবং স্থায়িত্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক অনুকূল পরিবেশ এবং ফ্যাসিবাদের বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা। শেষপর্যায়ে থাকবে ফ্যাসিবাদ এবং জাতীয়তাবাদের যোগসূত্রের বিন্যাসে রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য ভূমিকার প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ।

(১) ফ্যাসিবাদের বর্ণপরিচয় : কর্মপদ্ধতি, সংস্কৃতি, হিটলিস্ট

ল্যাটিন শব্দ ‘ফ্যাসইস’ থেকে ইতালিয়ানে ‘ফ্যাসিও’ হয়ে ‘ফ্যাসিসমো’-র ক্রমবিবর্তিত রূপ ফ্যাসিজম। ‘ফ্যাসিও’ শব্দটির অর্থ  ‘bundle’ বা ‘গোছা’, যার অনুপ্রেরণা প্রাচীন রোমান সংস্কৃতি অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি কর্তৃক ব্যবহৃত ‘লৌহ দণ্ড সজ্জিত কুঠার’। ক্ষমতার রূপক। রাজনৈতিক ফ্যাসিজম প্রথম সংগঠিত হয় বেনিতো মুসোলিনির তত্ত্বাবধানে, ইতালিতে, ১৯২২ সালে। মুসোলিনির এই ‘ক্ষমতার কুঠার’ দখল করার রাস্তায় আকস্মিকতার থেকেও ধারাবাহিকতা বোঝা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যালিস্ট রাজনীতিবিদ এবং ইতালিয়ান সোশ্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘আভান্তি’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে মুসোলিনির রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটে  ১৯১৪-র জুলাই মাসে ‘সোশ্যালিস্ট’ মুসোলিনি ‘আভান্তি’-তে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করেন। তাঁর লেখনীতে স্লোগান ওঠে ‘Down with the war!’। এমনকি ইতালির শাসকগোষ্ঠী যেন কোনোভাবেই জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াকে যুদ্ধে সমর্থন না করে, সেই উদ্দেশ্যে শ্রমিকশ্রেণিকে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়। ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইতালির সোশ্যালিস্ট পার্টি, মিলানোয় ‘সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিরপেক্ষতা’ বিষয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করে। ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’-র ধারণার সাথে ইতালির স্বার্থ, ইতালির জাতীয় ভিত্তি ইত্যাদি কনসেপ্ট নিয়ে এলেন মুসোলিনি। পাশে পান সেই সময়ের ইতালির উল্লেখযোগ্য কবি, নাট্যকার গ্যাব্রিয়াল দানুনজিওকে। জাতীয়তাবাদী পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতালীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম তখনও অপেক্ষাকৃত নতুন। আনুমানিক ১৮৬১ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত ইতালি প্রথম একসাথে একটি দেশের রূপ নেয়। এই অপেক্ষাকৃত নবীন, আংশিক বিকশিত ইতালীয় জাতীয়তাবাদী মননে সরাসরি উগ্র জাতীয়তাবাদ জায়গা নিতে পারবে কি? এর পথ খুঁজে পেতেই ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী প্রশ্নের সাথে যুদ্ধ জুড়ে দেওয়া। ১৯১৪ সালের ১০ অক্টোবর আভান্তি তে ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা’ থেকে ‘উদ্যমশীল যথার্থ নিরপেক্ষতা’ শিরোনামের প্রবন্ধ লেখেন মুসোলিনি। কিছুদিনের মধ্যেই আভান্তির সম্পাদকের পদ ত্যাগ করে ‘পপোলো দি’তালিয়া’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয় তার প্রথম সংখ্যা। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে এবার সরাসরি যুদ্ধের আহ্বান জানান মুসোলিনি। দ্রুত ঘটতে থাকে ট্রানজিশন। ১৯১৪-র ১০ ডিসেম্বর  ‘পপোলো দি’তালিয়ায়’ লেখা হয় ‘যুদ্ধ ইতালির জনসাধারণের জীবনের সর্বোত্তম যুক্তি রূপে দেখা দিয়েছে’। ক্রমে ১৯১৫-র ৯ এপ্রিল ডাক পাঠানো হয় ‘যুদ্ধে সত্বর এসো। তুমি স্বাগত’। এই সময় বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীকে নিয়ে মুসোলিনি ‘ফাসি দি আতসিওনে রিভলুতসিওনারিয়া’ নামের অনুষ্ঠান শুরু করেন। সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচির ফোকাল পয়েন্টে বারবার ঘুরে ফিরে আসে ‘যুদ্ধ’। 

ইতিমধ্যে কলকারখানার শ্রমিকরা শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তোলে। ১৯১৯-এর ফেব্রুয়ারি মিলানো শহর মুখরিত হয় হরতালে, ধর্মঘটে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ততদিনে সংগঠিত শ্রমিক বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক দেশের রূপ পেয়েছে। এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পক্ষে এবং শ্রেণি সংঘর্ষজাত গৃহযুদ্ধ এড়াতে মুসোলিনি একদিকে স্থানীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আহ্বান জানাচ্ছেন এবং অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ‘এশিয়ার বর্বরতা’ বলে চিহ্নিত করছেন। এই পর্বেই শুরু হচ্ছে শত্রু বাছাই। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে একইসাথে শত্রুর রাজনৈতিক এবং বর্ণবাদী চরিত্র নির্মাণ হতে থাকে। এই সময়ে, মুসোলিনির পশ্চিমি রক্ষণশীলতার পক্ষে একাধিক বিবৃতি সেই নির্মাণ বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯১৯-এ মুসোলিনির ভাষ্য — ‘আমরা স্থিতিশীল। পশ্চিম ইউরোপীয় সভ্যতায় এমন অনেক কিছু আছে যা রক্ষণীয়। ব্যক্তির স্বাধীনতা ও আত্মিক স্বাধীনতা শুধু রুটি খেয়ে বেঁচে থাকে না!’ এক্ষেত্রে শব্দের প্রয়োগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম ইউরোপীয় রক্ষণশীলতা, তাকে কেন্দ্র করে স্থিতিশীল সমাজের কল্পনা এবং ‘ব্যাক্তি স্বাধীনতা’-কে আত্মিক স্বাধীনতার সাথে জুড়ে বেঁচে থাকার, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার অর্জনের স্বাধীনতার সাথে সংঘাত ঘটানো। ১৯১৯-এর মার্চ মাসে এই স্থিতিশীলতার পক্ষে মধ্যবিত্ত, ছোটো বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত ছাত্র, অফিস কেরানিসহ বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী টুকরো টুকরো আরও সংগঠনকে জুড়ে ফ্যাসিস্ট সংঘ ‘ফাসি ইতালিয়ানি দি কম্বাত্তিমেন্তো’ পত্তন করেন মুসোলিনি। ‘ফাসি দি আতসিওনে রিভলুতসিওনারিয়া’-র তুলনায় আরও চরম দক্ষিণপন্থী এই সংগঠন। ১৯২১ সালে এই সংগঠনই পুনর্গঠিত হয়ে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯১৯-এর ১৮ মার্চ ‘পপোলো দি’তালিয়া’-য় জাতির সমৃদ্ধির দুটি নিদান দেন মুসোলিনি — ১) গণসাধারণকে রাষ্ট্রমুখী করে তুলতে হবে এবং ২) উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদে মালিক এবং শ্রমিকের বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটাতে হবে। ঐ বছরই সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে ‘পপোলো দি’তালিয়া’-য় মুসোলিনি লেখেন ‘সাম্রাজ্যবাদ জীবনের অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন নিয়ম’, ‘নিজেকে বিস্তৃত করার স্পৃহা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ডেমোক্র্যাটিক, শান্তিপ্রিয়, ইকোনমিক ও আধ্যাত্মিক ও হতে পারে’ ইত্যাদি। জমিদারের কর আদায়কে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী অসন্তোষ এবং ক্রমে ১৯২১-এর আগস্ট মাসে দেশব্যাপী হরতাল দানা বাঁধলে, বিরুদ্ধে পথে নামে ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী। ১৯২২-এর অক্টোবরে নেপলস এ মুসোলিনির ঘোষণা — ‘ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধতার জন্য পেতে হবে কঠোর শাস্তি’। ভয়, সামাজিক স্থায়িত্বের আকাঙ্ক্ষা, অপেক্ষাকৃত নতুন গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী চেতনা, তার সঙ্গে জুড়ে থাকা যুদ্ধস্পৃহা নির্মাণ। জনগণের মান্যতা ধীরে ধীরে নির্দেশিত হতে থাকে যুদ্ধাভিমুখে। ঐ বছরের ২৯ অক্টোবর ইতালির রাজা মুসোলিনিকে মিলানো থেকে রোমে ডেকে পাঠান। পৃথিবীর প্রথম ফ্যাসিস্ট সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় ইতালিতে।   

পর্ব ১        

মুসোলিনির শাসকশ্রেণি হয়ে ওঠার ধারাবাহিক ক্রমবিবর্তন ফ্যাসিজম অনুশীলনের একটা আবছা রূপরেখা তৈরি করে। সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এই চূড়ান্ত ক্ষমতা দখল এবং তাকে অব্যাহত রাখার পথ তৈরি করতে থাকে। ফ্যাসিজমের এই ‘পথ’ বা থিওরি সম্পর্কে আলোচনাকে সাময়িক স্থগিত রেখে এই প্রায়োগিক অভিঘাত সংক্রান্ত আলোচনা তুলে আনা যাক। সেই সময়ের উপাদান হিসেবে ভাবা যেতে পারে ইতালীয় জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিস্তার, শতধা বিভক্ত ইতালির নব্য বিকশিত জাতীয়তাবোধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, তার পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, রশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব, কলকারখানায় শ্রমিকশোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, অবরোধ, স্ট্রাইক ইত্যাদি। তখনও ইউরোপ জুড়ে ভীষণভাবেই রয়েছে রাজতন্ত্রের অবশেষ। রাজতন্ত্রের রেসিডিউ-এর সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে সামন্ততন্ত্রের, ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠত্ববোধ। পুঁজিবাদ সম্পূর্ণ বিকশিত রূপে না হলেও পদার্পণ করেছে সভ্যতায়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ পরিবর্তিত হচ্ছে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। ফলে মানুষের বিমূর্ত যৌথতা প্রকাশের মূর্ত মাধ্যম হিসেবে ঐক্যবদ্ধ শ্রমজীবী শ্রেণিচেতনার পরিবর্তে রাষ্ট্রধারণা স্থায়িত্ব পেতে থাকে। তাকে কেন্দ্র করেই  চলতে থাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের প্রতিযোগিতা। এবং প্রতিযোগিতায় প্রয়োজন প্রতিযোগী। ১৯২৮ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট দলের স্বেচ্ছাসেবী সংঘ ‘ফাসিস্ত মিলিতসিয়া’ সামরিক সংগঠন রূপে বিবেচিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বার্তা যায় — ‘ইতালির লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রত্যেক ইতালীয় যুবককে যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকতে হবে। ফ্যাসিজমই ইতালিতে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।’ অর্থাৎ যুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে উঠে আসছে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের ‘গৌরব’। সাম্রাজ্য, সম্পদ দখলের এই গৌরবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো শক্তি, চিন্তা শত্রুপক্ষ চিহ্নিতকরণের সহজ পথ। বা অন্যভাবে দেখলে ধারাবাহিকভাবে জাতি, ধর্ম বিভিন্ন পরিচিতিজনিত শত্রুপক্ষ ছাড়া যুদ্ধনিবদ্ধ দৃষ্টি ধরে রাখা সহজ নয়। ইতালির সামরিক ব্যয় যুদ্ধের আগে যা ছিল ৬৫০ মিলিয়ন লিরা, ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ বিলিয়ন লিরা। ক্রমাগত শত্রু অন্বেষণের তাগিদে দেশের ভিতরে শত্রু খোঁজার চর্চা বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর প্রথম আঘাত নামে। তারপর নিশানায় আসে বিভিন্ন অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী, সমকামী মানুষ। ১৯২০ সাল থেকে ‘স্লাভিক জাতিগোষ্ঠী বর্বর’ এই নির্মাণের অজুহাতে জুগস্লাভস সহ অসংখ্য পূর্ব-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠী চলে আসে ফ্যাসিস্টদের টার্গেট রেঞ্জে। এই প্রসঙ্গে ১৯২০-র সেপ্টেম্বরে মুসোলিনির ভাষণের কিছু অংশ ছিল এইরকম— ‘When dealing with such a race as Slavic — inferior and barbarian — we must not pursue the carrot, but the stick policy’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্-লগ্নে আফ্রিকায় সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, মিশরের দখলদারির দৌলতে ইতালীয় শত্রু নির্মাণের ন্যারেটিভে নাম লেখায় আফ্রিকান মানুষ। জার্মানির সাথে ফ্যাসিবাদী সহযোগিতার সূত্রে, আদর্শগত আদানপ্রদানের প্রক্রিয়ায় ক্রমে ইতালীয় ইহুদিরাও নাম লেখায় এই বিদ্বেষের পাণ্ডুলিপিতে। জাতিভাষাগত (ethnolinguistic) বিচ্ছিন্নতা, অপরায়ণ (otherisation) তৈরি করে শত্রু নির্মাণ এবং নিরন্তর পার্জ। ১৯২৬ থেকে ৪৩। অজস্র মানুষকে স্রেফ ‘অপ্রয়োজনীয়’, ‘ইতালি জাতির শত্রু’ দাগিয়ে হত্যা করা হয়। এক বিশাল সংখ্যক ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানুষদের দক্ষিণ ইতালিতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯৩৮-এর ১৪ জুলাই সরাসরি আইনি হস্তক্ষেপে ফ্যাসিবাদী শাসকশ্রেণি প্রকাশ করে ‘ম্যানিফেস্টো অফ রেস’ (‘Manifesto della razza’) বা জাতিবাদের ইস্তেহার। ইতালীয়দের আর্যজাতির উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপশি ইহুদি, উত্তর আফ্রিকা এবং অ-ইউরোপীয়দের সরাসরি বিচ্ছিন্ন করার নিদান দেওয়া হয়। সরাসরি রাষ্ট্রব্যবস্থার আইনশৃঙ্খলার পরিসরে মান্যতা দেওয়া হয় ঘৃণার, শত্রুবাছাইয়ের রাজনীতিকে। সাধারণ জনগণকে জাতিবর্ণগত বিভাজনে উৎসাহিত করা হয়। ব্যাক্তিমানুষের ব্যাক্তিগত ক্ষোভ পরিচিতিসত্তার ঘৃণার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ইহুদিদের ইতালীয় নাগরিকত্ব এবং সমস্ত সরকারি এবং পেশাদারি কর্মক্ষেত্রে কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই ইস্তেহারের স্বপক্ষে সাক্ষর করেন পেশাদার চিকিৎসক (S. Visco and N Fende), নৃতত্ত্ববিদ (L Cipriani), প্রাণীবিদ (E Zavattari), পরিসংখ্যানবিদ (F Savorgnan) সহ অনেক পেশাদার জগতের মানুষ। অমানবিক ঘৃণার সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় যুক্তি ও বিজ্ঞানকে ব্যবহার ও ম্যানিপুলেশনের দগদগে ইতিহাস রচিত হয়। ইতালির ফ্যাসিবাদ ততদিনে ঘৃণার পাহাড় গড়তে গড়তে ফ্যাসিবাদের ইতালি…        

পর্ব ২  

ইতালির ফ্যাসিবাদ যে ঘৃণার একচেটিয়া গঠনতন্ত্র তৈরি করল, সেই ফ্যাসিবাদী কর্মসূচিকে সংগঠিত নির্মমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেল জার্মানির নাৎসিবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৮ সালে জার্মানির আত্মসমর্পণ এবং ঘটনাক্রমে ভার্সাই চুক্তির পরবর্তী জার্মান রাজতন্ত্রের পতন। হাতছাড়া হয় জার্মানির উপনিবেশ, কিছু শিল্পাঞ্চল। ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপে ওয়াইমার রিপাবলিকে। সাধারণ মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। শ্রমিকশ্রেণি মাথা তোলে বিকল্প ব্যবস্থার তাগিদে। বলশেভিক বিপ্লবের আঁচ এসে পড়ে জার্মানিতে। এদিকে ভার্সাই-এর ‘অবমাননাকর’ চুক্তির প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী চেতনা ভিড় বাড়ায়। বিভ্রান্তি বাড়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। বিভ্রান্তি বাড়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের পরিসরেও। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যুদ্ধের পক্ষ নেওয়া এবং বিরোধিতার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠী পরবর্তীকালে জন্ম দেয় কার্ল লিবখ্ নেশ্ ট, রোজা লুক্সেমবুর্গের স্পার্টাকাস লিগ। এই স্পার্টাকাস লিগ ১৯১৮-এর শেষদিকে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উল্লেখযোগ্যভাবে মনে রাখতে হবে যে এই যুদ্ধের আবহেই, ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে ইতালিতে, আগের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে মুসোলিনির প্রবন্ধে সরাসরি উঠে আসছে যুদ্ধের ডাক। বস্তু থেকে চেতনার বিস্তার। সামাজিক রাজনৈতিক আবহে নির্ধারিত হয়ে চলে জনমানসের জাতিবর্ণগত বোধের কম্পাস।প্রতিবিপ্লবীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। শ্রমিকের ঐক্যে ফাটল ধরে। ১৯১৯-এ  লিবখ্ নেশ্ ট, রোজা লুক্সেমবুর্গ খুন হন তৎকালীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পরিচালিত সরকারি জার্মান মিলিটারির হাতে। অর্থনৈতিক সংকট, অনিশ্চয়তার হাত ধরে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা জাঁকিয়ে বসে জার্মান মননে। ‘জাতির অবমাননা’-র নির্মাণ জনগণের ঝোঁক নিয়ে যায় ম্যাসকুলিন ন্যাশনালিজমের দিকে। ধীরে ধীরে বেড়ে চলা ফ্যাসিবাদী প্রবণতা মুলস্রোতে উঠে আসে রাইখস্ট্যাগের অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরবর্তী সময়ে। শিল্পপতিরা  ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির (নাৎসি পার্টি) পাশে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদের উত্তরণ ঘটে আরও সংক্রামক এবং আরও মারাত্মক নাৎসিবাদে। ফ্যুয়েরার (Führer) হিটলারের তত্ত্বাবধানে, এলিয়েনেশন-ঘৃণা-জাতীয়তাবাদের ককটেলে কর্ষিত হয় মানবজমিন।         

১৯৩৩ পরবর্তী জার্মানি এক ধূসর, কালো মধ্যযুগীয় ঘৃণা-বর্বরতার হটবেড। উগ্র জাতীয়তাবাদের সপক্ষে মনস্তাত্বিক, সামরিক, প্রাতিষ্ঠানিক আঘাত নেমে আসে যুক্তিবোধের উপর। উগ্র জাতীয়তাবাদের মূল স্তম্ভ হিসেবে দুটি বিষয় উঠে আসে — (ক) নরডিসিজম (Nordicism), যা প্রাচীন নরডিক কল্পকথা থেকে উদ্ভূত জাতিবর্ণবাদ এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের (white supremacy) আদর্শ যা ‘নর্ডিক জাতি’-কে বিপন্ন (‘খতরে মে’ শব্দবন্ধ পাঠকের স্মৃতিতে থাকার কথা) এবং উচ্চতর জাতিগত গোষ্ঠী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। (খ) এবং এই নরডিসিজমের সফল প্রয়োগ হিসেবে ‘অপ্রয়োজনীয়’, ‘দুর্বল’, ‘হীনতর’ সামাজিক, জাতিগত, বর্ণগত, রাজনৈতিক ভাবে মানুষকে নির্মূল করা। এই ঘোষিত কর্মসূচির সাপ্লিমেন্টারি সহায়িকা হিসেবে কাজ করলেন জার্মানির অজস্র খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। তাঁরা দিলেন জাতিবর্ণগত কারণে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানুষের নির্বিচারে হত্যার ‘বৈজ্ঞানিক’ তাত্ত্বিক ন্যায্যতা। এই প্রসঙ্গে কাইজার উইলহেম ইন্সটিটিউট অফ অ্যানথ্রপলজি, হিউম্যান জেনেটিক্স এন্ড ইউজেনিক্স-এর ডিরেক্টর প্রফেসর ইউগেন ফিশারের বক্তব্য শোনা যাক — ‘তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের উন্নতির জন্য সেই সময় বিরল ও সৌভাগ্যজনক যখন প্রচলিত মতাদর্শ তাকে স্বাগত জানায়, এবং বিজ্ঞানের ফলাফল রাষ্ট্রের নীতির সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়।’ আউসুইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এরকমই এক নৃশংস ‘বৈজ্ঞানিক’ পরীক্ষা চালান ড. মেঙ্গেল ইহুদি এবং জিপসি যমজ শিশুদের উপর কেমিক্যাল এবং জীবাণু ইঞ্জেক্ট করিয়ে। এই পরীক্ষায় যেকোনও এক যমজ শিশুদের মৃত্যু হলে, অপর যমজ শিশুদের শুধুমাত্র দেহতাত্ত্বিক তুলনা (physiognomy comparison) করার তাগিদে খুন করা হত। ইহুদি জাতির প্রতি বিদ্বেষ বা ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’-এর পিছনে এই ‘ইউজেনিক্স’ ছাড়াও ইন্ধন যুগিয়েছিল ইউরোপীয় সুপ্ত জুডাইজম বিরোধী ধর্মীয় বৈষম্য, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা সহ অজস্র উপাদান। নরডিসিজম জাত ‘মাস্টার রেস’ বা জার্মান আর্য জাতির শুদ্ধতার পথে মূল বাধা হিসেবে গণ্য করা হয় ইহুদিদের। ‘সমস্যা’র নাৎসি ‘সমাধান’ সূচিত হয় ‘ফাইনাল সলিউশন’ কার্যকারী করার মাধ্যমে। ‘ফাইনাল সলিউশন’ অর্থাৎ অবাধ ইহুদি নিধন। জার্মান জাতির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে নিহিত, সুপ্ত ইহুদি বিদ্বেষের বিস্ফোরণ ঘটে।প্রায় ৬ মিলিয়ন ইহুদি নিধনযজ্ঞ সম্পাদিত হয় ফ্যুয়েরার এবং তার নাৎসি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে। রাইখ মিনিস্ট্রি অফ প্রোপাগ্যান্ডা জোসেফ গোয়েবলসের তত্ত্বাবধানে এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানুষদের জন্য নির্মিত হল ‘ইঁদুর’, ‘পোকা’, ‘untermenschen’ বা উনথারমেনশেন (subhumans) এর মতো কয়েনেজ।      

বিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক ন্যায্যতা এবং জাতিবর্ণবিদ্বেষী  প্রোপাগ্যান্ডার সম্প্রসারণ এবং জনমানসে প্রভাববিস্তারের পরের ধাপ হল এর প্রায়োগিক উপকরণের আইনি বৈধতা। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫ সালে রাইখস্ট্যাগে পাশ হয় ‘ন্যুরেমবার্গ আইনগুচ্ছ’ বা ‘Nuremberg laws’। এই আইনগুচ্ছে প্রকাশিত দুটি আইন হল — ১) The Reich Citizenship Law এবং ২) The Law for the Protection of German Blood and German Honor। রাইখ সিটিজেনশিপ আইনে বলা হল ‘একমাত্র জাতিগতভাবে শুদ্ধ জার্মানরাই বৈধ জার্মান নাগরিকত্বের জন্য অনুমোদিত’ (পাঠকের মনে কি সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের (CAA) কথা ভেসে আসছে?)। দ্বিতীয় আইন, ‘দ্য ল ফর দ্য প্রোটেকশন অফ জার্মান ব্লাড অ্যান্ড জার্মান হনার’ হল একটি জাতিগত সংমিশ্রণ (‘Rassenschande’) বিরোধী আইন। আর্য-অনার্য  জাতিগত সংমিশ্রণ বিরোধী আইন। সোজা ভাষায় জার্মান এবং অন্যান্য ‘হীন’ জাতির মধ্যে বিবাহ এবং যৌন সম্পর্কের উপর আইনত নিষেধাজ্ঞা (পাঠকের সচেতন মনে কি লাভ জিহাদের কথা স্মরণে আসছে?)। আইনি বৈধতার পর পড়ে থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক এই ধারণার সফল সম্পাদনা। গেস্টাপোর (The Geheime Staatspolizei) মতো গুপ্তচর পুলিশ কিংবা জার্মান অধিকৃত প্যান-ইউরোপিয়ান পরিসরে ছড়িয়ে থাকা প্যারামিলিটারি প্রতিষ্ঠান এস এস (The Schutzstaffel)-এর মাধ্যমে বিরুদ্ধতার উপর নৃশংসতার বুলডোজার। এবং মানুষ ভর্তি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ল্যাবরেটরি। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে নাৎসি জার্মানি এবং তার সহযোগী রাষ্ট্র মিলিতভাবে আনুমানিক ৪৪০০০ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করে। আউসুইৎজ, দাখাউ, লিচটেনবার্গ, বুকেনওয়াল্ড, ওয়ারশ, কাইজেরওয়াল্ড। এইসব কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে জায়গা হয় ইহুদি, জিপসি, যেহোভা-স উইটনেস, সমকামী, কৃষ্ণাঙ্গ, শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী, রাজনৈতিক বিরোধী, কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমক্র্যাট, পাদরি, যাজক, যুদ্ধবন্দি, মাস্টার রেস, স্লাভিক ক্রীতদাস সহ বিভিন্ন পরিচিতিসত্তার মানুষের। পোলিশ জনগণকে দাগানো হয় ‘subhumans’ বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাইনল্যান্ড নিবাসী আফ্রিকান সৈনিক বাবা এবং জার্মান মায়ের সন্তানের নতুন পরিচয় হয় ‘Rhineland Bastard’।  স্বাভাবিক নিয়মেই এই ‘বাস্টার্ড’-দের প্রজননের অধিকার থাকে না ফ্যুয়েরারের স্বর্গরাজ্যে। ১৯৩৯ সালে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের ‘অপ্রয়োজনীয় ভক্ষণকারী (useless eaters)’ হিসেবে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই কর্মসূচি অনুযায়ী আনুমানিক ৫০০০০ মানুষ হত্যা করা হয়। ১৯টি জার্মানি অধিকৃত দেশের ১০৩৪ জন পাদরিকে হত্যা করা হয়। জাতিগতভাবে ‘অশুদ্ধ’, সামাজিক ‘অনাঙ্কাঙ্খিত’ এবং মানসিকভাবে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত করা হয় নোম্যাডিক, যাযাবর ‘জিপসি’ মানুষদের। ফলস্বরূপ নির্বিচার বন্ধ্যাকরণ। কত পরিমাণ লবণজল শরীরে ঢুকলে তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে, সেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই জিপসিদের। প্রায় অর্ধেক মিলিয়ন জিপসিদের খুন করে নাৎসি রাষ্ট্র। সবটাই শক্তিশালী জার্মানজাতি প্রতিষ্ঠার তাগিদে। ডয়েশল্যান্ড জুড়ে তখন মাসকুলিন ন্যাশনালিজমের হুঙ্কার। পৌরুষদীপ্ত জার্মান জাতির গর্জন।          

তবে সবার প্রথমে এই আঘাত আসে রাজনৈতিক পরিসরে। রাইখস্ট্যাগের অগ্নিসংযোগের অব্যবহিত পরেই ১৯৩৩-এর মার্চ মাসে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি ওরফে KPD (Kommunistische Partei Deutschlands) নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আঘাত নেমে আসে ট্রেড-ইউনিয়নের কার্যকলাপের উপর। ১৯৩৩ থেকে ৩৯-এর মধ্যে প্রায় ১৫০০০০ কমিউনিস্টের (পার্টির সদস্য, সমর্থক) স্থান হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, এবং আরও ৩০০০০ পার্টিজান খুন হন গেস্টাপোর হাতে। এস এস (The Schutzstaffel) জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ শহরের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহরতলি থেকে অসংখ্য টাইপরাইটার বাজেয়াপ্ত করে। নিষিদ্ধ হয় কমিউনিস্ট পত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র। এইসময় কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের প্রধান আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মসূচি ছিল নাৎসিবাদ বিরোধী সাহিত্য, প্রবন্ধ সাধারণ মানুষের মধ্যে গোপনে ছড়িয়ে দেওয়া। নাৎসি-বিরোধী লিফলেট, সংবাদপত্র মূলত বিলি করা হত বিয়ার হল এবং শ্রমিকশ্রেণির কলকারখানায়, কর্মক্ষেত্রে। ১৯৩৩ থেকে ৩৫ এর মধ্যে কমিউনিস্ট সংবাদপত্র ‘Rote Fahne’ বা ‘Red Flag’ গোপনে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। গেস্টাপোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৩৪ সালে প্রায় ১.২ মিলিয়ন কমিউনিস্ট নাৎসি-বিরোধী প্যামফ্লেট বাজেয়াপ্ত হয়। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রাজনৈতিক নিষ্পেষণের পরও ছোটো ছোটো বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট সংগঠন নাৎসি বিরোধী লড়াই জারি রাখে। এর মধ্যে ‘Innere front (Home front)’, ‘Rote Kapelle (The Red Orchestra)’, ‘The Uhrig group’, ‘The Baum group’ উল্লেখযোগ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে জার্মান নাৎসি শাসনতন্ত্রের দু-ধরনের বিদ্বেষ লক্ষ করার মতো। রাজনৈতিক মতবাদগত বিদ্বেষ এবং রাশিয়ান জাতিবিদ্বেষ (স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর প্রতি জাতিবিদ্বেষী ‘untermenschen’ শব্দবন্ধের ব্যবহার)। এর মধ্যে দুই থেকে তিন মিলিয়ন রাশিয়ান যুদ্ধবন্দিদের খুন করা হয় জার্মানিতে। প্রসঙ্গত পূর্বে উল্লেখিত মুসোলিনির কমিউনিজমকে ‘এশিয়ার বর্বরতা’ হিসেবে নির্মাণের চেষ্টার কথা আর-একবার উঠে আসবে। ফ্যাসিবাদের সরাসরি মুখোমুখি দাঁড়ানো বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদকে জাতিবিদ্বেষের পরিচিতিসত্তার মোড়কে প্রকাশ করার কৌশল এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। সমস্ত বিরোধী মত, মতাদর্শ, মানুষকে একই জাতিবিদ্বেষী ছাঁচের পরিচিতির প্রশ্নে জুড়ে দিলে শত্রু বাছাইয়ের বিমূর্ততা কাটিয়ে উঠে সুস্পষ্ট, অবজেক্টিভ শত্রু চিহ্নিতকরণ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘জার্মান সুপ্রিমেসি’-র থিওরি প্র্যাকটিস করার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।               

পর্ব ৩ — ‘ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে… আমি পুড়ছি’  

১৯৩৩ সালের ১০ মে। নাৎসি জার্মানির ছাত্র সংসদ নাৎসি মনোভাবাপন্ন প্রফেসরদের সহায়তায় দেশব্যাপী ‘জার্মান-স্পিরিট’ বিরোধী সমস্ত বই সরকারি এবং বেসরকারি পাঠাগার, ব্যক্তিগত সংগ্রহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি থেকে খুঁজে বের করে। গ্রন্থাগারিক উলফগ্যাং হেরম্যানের  সুপারিশে তৈরি হওয়া ঐ ব্ল্যাকলিস্টেড বইয়ের ভিড় জমা করা হয় ২০টি জার্মান শহরে। বার্লিনের Opernplatz (অধুনা Bebelplatz) চত্বরে প্রায় ৭০০০০ মানুষ সমবেত হয়। প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলসের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচারিত হয় বেতার মাধ্যমে। কারণ, যুক্তি, তর্ক, মানবতার উপর সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। মানবতার বৌদ্ধিক চেতনা পুড়তে থাকে। পুড়তে থাকে কার্ল মার্কস। আলবার্ট আইনস্টাইন। সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড। কাউটস্কি, হেনরিখ মান, আলফ্রেড কার, রোজা লুক্সেমবুর্গ, অগস্ট বেবেল। সব পুড়ছে। ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে। আমি পুড়ছি। বেবেলপ্লাতজে ব্রোঞ্জ ফলকে খোদাই করা হয় হেনরিখ হেইনের নাটক ‘আলমানসোর’-এ বর্ণিত সতর্কবার্তা — 

‘That was but a prelude;                                                                                                                      where they burn books,                                                                                                                         they will ultimately burn people as well.’ 

পর্ব ৪ — ‘genocide was a priority

বিদ্বেষের আগুন এক জায়গায় থেমে থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। বিদ্বেষের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বিযুক্তিকৃত জাতীয়তাবাদ মিশে সংগঠিত রূপ পেলে সেই চিন্তাধারার প্রভাব বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ, সামাজিক রাজনৈতিক চরিত্র অনুযায়ী এক-এক রকম রূপ নেয়। প্রভাবিত হতে থাকে রাজনীতির প্রেক্ষিত। নাৎসি জার্মানির উত্থানের আগেই হাঙ্গেরিতে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯২০ সালে মিলকোস হর্থির সরকার উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে ইহুদি ছাত্রদের সংখ্যা বেঁধে দেয় ৬ %। নাৎসিবাদের উত্থানের পর জার্মানির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয় হাঙ্গেরির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯২০-র গ্রঁ ট্রিয়ানোর চুক্তির ফলে হাঙ্গেরির অধিকৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চল হাতছাড়া হয়। জনসংখ্যার প্রায় ৩০% মানুষকে প্রতিবেশী দেশে নির্বাসিত হতে হয়। এর প্রেক্ষাপটে দানা বাঁধতে থাকে এথনিক বা জাতিগত ন্যাশনালিজমের চেতনা যা উগ্রতায় রূপ নেয় ইতালির ফ্যাসিজম এবং জার্মানির নাৎসি ধারণার আবহে। জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে অস্ট্রিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিলে হাঙ্গেরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারানো কিছু অঞ্চল পুনরায় দখল করতে সমর্থ হয়। ‘জাতির গৌরব পুনরুদ্ধারের’ আর্যনির্মাণের আইডিয়ায় সহানুভূতি এবং নাৎসি রাষ্ট্রের একরোখা দখলদারির প্রতি সম্মতি। ১৯৪১-এ হাঙ্গেরির ক্ষমতাসীন সরকার প্রায় ২০০০০ নন-হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিদের ইউক্রেনে নির্বাসিত করে এবং নিয়মমাফিক ভাবেই  হত্যা করে। মার্চ ১৯৪৪-এ জার্মানি হাঙ্গেরি দখল করে এবং অ্যাডলফ এইচম্যান নামের এক নাৎসি অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় হাঙ্গেরির। এই অফিসারের নির্দেশে ৮০০০০০ মানুষকে পূর্ব-ইউরোপের বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯৪৪-এর মে এবং জুলাই মাসের মধ্যে প্রায় ৪৪০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিদের আউসুইৎজ সহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে মৃত্যুর অনিবার্যতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দুর্বার গতিতে ‘জাতীয়’ থেকে ‘আন্তর্জাতিক’ পথ পরিক্রমা করে চলে। জার্মানির সহযোগী রোমানিয়ায় আনুমানিক ৩৮০০০০ ইহুদি খুন করা হয়। রাষ্ট্রীয় জাতিবিদ্বেষী সন্ত্রাসের নির্মমতার প্যারামিটারে চূড়ান্ত নৃশংসতার সূত্রে আমাদের মনে পড়বে রোমানিয়ার কুখ্যাত ‘ইয়াস পগ্রম (Iasi pogrom)’। ১৯৪১-এর জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের শুরু অবধি চলা এই ম্যাসাকারে ১৩০০০ মানুষ খুন হন যা গোটা শহরের জনসংখ্যার ১০% মানুষ। এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল রোমানিয়ার তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক ইয়ন আন্তনেস্কু-র নির্দেশে পুলিশ এবং অসংখ্য সাধারণ নাগরিক এই নিধনযজ্ঞে অংশ নেন। ইহুদিবিদ্বেষ এবং পার্শ্ববর্তী সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের প্রতি যৌথ ঘৃণার একত্রিত প্রকাশ ঘটে ‘জুডা-বলশেভিজম’ কয়েনেজের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাধারণ জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদে হলোকাস্ট সংক্রান্ত ঘটনার শিক্ষা স্কুলে বাধ্যতামূলক করার বিল পাশ হয়। যদিও এখনও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি। ফলে এক বিরাট অংশের রোমানিয়ানদের কাছে এই পরিকল্পিত গণহত্যা সম্পর্কে খুব পরিষ্কার ধারণা নেই। পূর্ব-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সাধারণ নাগরিকের এই নির্মম প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ফ্যাসিবাদের বিবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য দিক। ফ্যাসিবাদ এখন আর কেবল চাপিয়ে দেওয়া নির্মাণ থাকল না। সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির অংশীদার হয়ে উঠল ফ্যাসিবাদ। বিভিন্ন দেশের নিজ নিজ স্থানীয় সমস্যা, বিরোধ ফ্যাসিবাদী উগ্র-নির্মম আউটলেট দিয়ে বেরিয়ে এল। 

‘অপারেশন বারবারসা’-র অব্যবহিত পরেই ইউক্রেন নাৎসি জার্মানির দখলিকৃত হয়। ইউক্রেনে লিফলেট বিলি করা হয় এই মর্মে যে জার্মান আক্রমণকারীদের ভয় পাবার কারণ নেই কারণ তারা শুধুমাত্র কমিউনিস্ট ইহুদিদের বিরোধী। বিশেষ ঘেটো-তে ইহুদি জনগণকে নিয়ে গিয়ে খুন করা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এই মানুষদের ঠান্ডা মাথায় খুন করার আগে ভুয়ো কৃষিকাজের নামে পরিশ্রম করিয়ে নিজেদের কবর খোঁড়ানো হত। সিনেমার অডিও-ভিস্যুয়াল কল্পনা নয়। দগদগে বাস্তব। ট্রুথ ইজ সামটাইমস স্ট্রেঞ্জার দ্যান দ্য ফিকশন। ২৯ এবং ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪১। কিয়েভে ঘটে বাবি ইয়ার ম্যাসাকার। প্রায় ৩৪০০০ ইহুদি মানুষের খুন করা হয় মাত্র দু-দিনের মধ্যে। রোমানিয়ার মতো ইউক্রেনেও স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সাহায্যে নাৎসি বাহিনী চালিয়েছিল নির্বিচার নিধনযজ্ঞ। গণহত্যায় সাধারণ জনসাধারণের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার আর-এক নিদর্শন লভভ পগ্রমস (Lvov pogroms), যেখানে প্রায় ৬০০০ ইহুদিদের মৃত্যু এবং ধর্ষণ ঘটে ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন স্থানীয় বাহিনীর মাধ্যমে। হলোকাস্ট সংক্রান্ত গবেষণায় ঐতিহাসিকরা আর-একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে এনেছেন। বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে যখন নাৎসি জার্মানির আত্মসমর্পণ, হার প্রায় নিশ্চিত এমন সময়েও ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলে গণহত্যা! যান্ত্রিক নির্মমতায় কেন আটকে যায় মানুষ? আসলে প্রবণতা ধীরে ধীরে ভাষায় রূপ নেয়। গণহত্যার প্রবণতা ফ্যাসিবাদের ভাষ্য তৈরি করে চলে ক্রমাগত। ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদ প্রকাশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জেনোসাইড যেখানে প্রায়োরিটি।       

পর্ব ৫ — ফ্যাসিবাদের শৃঙ্খলার পাঠ এবং হিন্দুত্ব  

ফ্যাসিবাদের আধিপত্যের ঢেউ ভারতবর্ষেও আছড়ে পড়ে সেই সময়। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে মারাঠি সংবাদপত্র ‘কেশরী’-তে নিয়মিত ইতালির রাষ্ট্রব্যবস্থা বিষয়ক প্রবন্ধ এবং সম্পাদকীয় ছাপা হত। এই লেখকদের দৃষ্টিতে ফ্যাসিজম ইতালিকে রাজনৈতিক চাপানউতোর, বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সংঘর্ষের থেকে মুক্ত করে এক শৃঙ্খলাবদ্ধ আইনানুগ জাতিতে পরিণত করার দিশারি। উদারপন্থী রাষ্ট্র থেকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে উত্তরণের সাথে নৈরাজ্য থেকে অনুগত, আইনানুগ সমাজপরিবর্তনকে সম্পর্কিত করা হয়। ১৯২৪-এর মে থেকে ১৯২৫-এর নভেম্বরের মধ্যে ‘কেশরী’-তে ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে একাধিক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখা হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ‘ওয়ান ম্যান’স গভর্নমেন্ট’-এর আইডিয়া-কে সময়ের দাবি হিসেবে তুলে আনা হয়। ১৯২৯-এর ১৩ আগস্ট ‘ইতালি এন্ড দ্য ইয়ং জেনারেশনস’ প্রবন্ধে ফ্যাসিস্ট মডেলে পরিচালিত ইতালীয় যুবকদের অর্জিত শৃঙ্খলা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়। যুবকদের এই শৃঙ্খলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে গভীর ধর্মীয় ভাবাবেগ, পরিবাবতান্ত্রিকতা এবং ট্র্যাডিশনাল সামাজিক মূল্যবোধ (বিবাহবিচ্ছেদ বিরোধী, অবিবাহিত বিরোধী, নারীদের রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার বিরোধী প্রভৃতি) মেনে চলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইতালীয় যুবদের ফ্যাসিস্ট সংগঠন ‘বালিল্লা’ (Balilla) এবং আভানগুয়ারদিস্তি (Avanguardisti) প্রসঙ্গে প্রশংসার ঝড় বয়ে যায় এই প্রবন্ধে। এই ধরনের সংগঠন তৈরির মূল কারণ ছিল ইতালীয় জনমানসে সামরিক উদ্দীপনা জাগরণ। সহজ জীবনযাপন এবং সাধারণভাবে অসামরিক, যুদ্ধবিমুখ ইতালীয় জাতিকে যুদ্ধমুখী করে তুলতে মুসোলিনির মাস্টার প্ল্যান। যুদ্ধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এই সংগঠনের জুড়ি মেলা ভার। ফ্যাসিবাদের উদ্দীপনায় আকৃষ্ট হয়ে ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে ইতালি গিয়ে পৌঁছান তৎকালীন হিন্দু মহাসভার নেতা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (RSS)-এর জন্মদাতা হেডগেওয়ারের মেন্টর হিসেবে পরিচিত বি এস মুঞ্জে। মুঞ্জে মুসোলিনির সাথে দেখা করেন এবং ফ্যাসিস্ট ইতালির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান, যুব সংগঠন এবং কিছু মিলিটারি স্কুল পরিদর্শন করেন। স্কুলের পঠনপাঠনজনিত শিক্ষার পরিবর্তে ফ্যাসিবাদী দীক্ষা নেবার ‘রোমহর্ষক’ আইডিয়া (Indoctrination rather than education) তাঁকে প্রভাবিত করে। তাঁর ডায়েরি থেকে এই উদ্ধৃতিটির কথাই ধরা যাক — ‘…The idea of fascism vividly brings out the conception of unity amongst people…India and particularly Hindu India need some such institution for the military regeneration of the Hindus : so that the artificial distinction so much emphasised by the British of martial and non-martial classes amongst the Hindus may disappear. Our institution of Rashtriya Swayamsewak Sangh of Nagpur under Dr Hedgewar is of this kind, though quite independently conceived. I will spend the rest of my life in developing and extending this Institution of Dr Hedgewar all throughout the Maharashtra and other provinces.’ অথবা ধরা যাক আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত এই  উদ্ধৃতি — ‘In fact, leaders should imitate the youth movement of Germany and the Balilla and Fascist organisations of Italy. I think they are eminently suited for introduction in India, adapting them to suit the special conditions. I have been very much impressed by these movements and I have seen their activities with my own eyes in all details.’ এর কিছু সময় পরে, ১৯৩৪ সালের ৩১ মার্চ মুঞ্জে, হেডগেওয়ার এবং লালু গোখেলের মিটিং-এ ইতালীয় এবং জার্মান অনুকরণে হিন্দুদের সামরিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৯৩৪ সালে মুঞ্জে সামরিক সংগঠন বানাতে উদ্যোগী হন। গোড়াপত্তন করেন ‘ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের’। একই বছর, হিন্দু যুবকদের সামরিক ভাবাদর্শ উৎপাদনের স্বার্থে ‘সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোস্যাইটি’ বানাতে উদ্যত হন। এমনকি আরএসএস-কেও এই ধরনের সামরিক সংগঠন বানানোয় অনুপ্রাণিত করেন। পরবর্তীকালে আরএসএস-এর কর্মসূচী এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অজস্র ফ্যাসিবাদী অনুপ্রেরণা, অনুকরণ চোখে পড়ে। ইতালীয় ফ্যাসিবাদী ‘এক নেতার প্রতি আনুগত্য’ নীতির অবিকল অনুলিপি উঠে আসে আরএসএস-এর ‘এক চালক অনুভরতিত্ব’ নীতিতে। ফ্যাসিবাদের আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কল্পকথার চিন্তাধারাও অনুকৃত হয় হিন্দুত্বের ধারণায়। ফ্যাসিবাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কনসেপ্ট ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু নির্বাচন’ পরবর্তীকালে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রূপে দেখা দেয়। সাভারকারের হিন্দুত্বের ধারণায় ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত থাকে ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু নির্বাচন’। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় আসবে। যে সময়ে এই হিন্দু সামরিক শক্তি জাগরণ বা যুবকদের যুদ্ধমুখী করে তোলার কারখানা তৈরি হচ্ছে ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশে, সেই সময় ভারতবর্ষের চিন্তা-মনন-চেতনার একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে  ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভেঙে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। অপরদিকে ফ্যাসিবাদী ইতালি বা নাৎসি জার্মানি ধীরে ধীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রিলিউড তৈরি করছে। নাৎসি জার্মানি এবং ইতালি এই যুদ্ধ শুরুর আগে নিশ্চিতভাবেই উপনিবেশকারী। জার্মানি দখল করছে পূর্ব-ইউরোপ, ইতালি আফ্রিকায় ইথিওপিয়া দখলে অংশ নিচ্ছে। ফ্যাসিবাদী মডেল তৈরি করছে উপনিবেশকারী (colonizer)। কিন্তু মুঞ্জে, আরএসএস এই ফ্যাসিবাদী মডেল দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে ভারতবর্ষে, যা তখন উপনিবেশিত (colonized)। দখলদারির দুই প্রান্ত। এইখানেই একটা দ্বন্দ্ব বা কন্ট্রাডিকশনের জন্ম হচ্ছে। যে ফ্যাসিবাদ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পুঁজিবাদী স্থিতাবস্থার পক্ষে মিলিটারাইজেশন কর্মসূচী নিয়েছে, সেই একই কর্মসূচী উপনিবেশিত ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ ব্রিটিশ পুঁজিবাদী, সামাজিক স্থিতবস্থার পক্ষে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কাজকর্ম ফ্যাসিস্ট মডেলে ‘নৈরাজ্যের’ জন্ম দেয় যা সামাজিক স্থিতবস্থার বিপরীত। এবং ব্রিটিশের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির সাথেও মতাদর্শগত সায় ছিল এই হিন্দুত্বনির্ভর সংগঠনগুলির। তাহলে এই দ্বন্দ্ব মিটবে কীভাবে? হিন্দুত্ব প্রজেক্ট কীভাবে পথ খুঁজে পাবে? এই কন্ট্রাডিকশন থেকে বের হবার হাতিয়ার হিসেবে দেখা দিল ঐ ফ্যাসিস্ট মডেলেরই ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু নির্বাচন’ কনসেপ্ট। হিন্দু জনগণকে মিলিটারাইজ করার জন্য, যুদ্ধমুখী, সংঘর্ষমুখী করে তোলার জন্য প্রয়োজন একমাত্রিকতা, homogeneity, সংঘবদ্ধতা। আর এই সংঘবদ্ধতার মূল এলিমেন্ট হল ‘বিরোধী’ বা ‘শত্রু’। বিরোধীর ভয়, খতরা। সেখান থেকে একজোট হওয়া। শত্রু নির্বাচন। সামাজিক স্থিতাবস্থা, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক একমাত্রিকতার বিরুদ্ধতার নির্ধারকে শত্রু নির্বাচন। এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘শত্রু’ হিসেবে অনিবার্যভাবে উঠে আসা। হিন্দুধর্মের বহুমাত্রিকতা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক যাপনের বিপরীতে হিন্দুত্বের প্রোজেক্ট একমাত্রিক সংস্কৃতির পাঠ দেয়। হিন্দু পরিচিতির সংজ্ঞায় ‘সংস্কৃতি’-র পরিবর্তে ‘জাতি’এবং ‘বংশ’ প্রশ্নকে হাজির করা হয়। ইতিহাস অস্বীকার করে মানানসই জাতিগত কল্পকথার উপর নির্মিত হয় এই উগ্র দক্ষিণপন্থী ঝোঁক। হিন্দুত্বের রাজনৈতিক ভঙ্গি থেকে ম্যাসকুলিন ন্যাশনালিজমের দরজা খোলে আরএসএস সহ অজস্র অন্যান্য সংগঠন। আরএসএস-এর আর-এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গোলওয়ালকারের ভাষ্যে সরাসরি উঠে আসে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিদ্বেষ — ‘they [Muslims] must cease to be foreigners or may stay in the country wholly subordinated to the Hindu nation claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment, not even citizen’s rights’। সাভারকারের সভাপতিত্বে আরও জোরালো হতে থাকে মুসলিম-বিরোধী স্বর। নাৎসি জার্মানির ইহুদি-বিরোধী পলিসির সমর্থক সাভারকারের বিভিন্ন বক্তৃতায়, লেখায় বারবার উঠে আসে নাৎসি জার্মানির ইহুদি নির্বাসন, নিধনের প্রসঙ্গ। ১৯৩৮ সালের ১৪ অক্টোবর মালেগাঁও-এর সভায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রশ্নে সাভারকারের স্বগতোক্তি — ‘A Nation is formed by a majority living therein. What did the Jews do in Germany? They being in minority were driven out from Germany’।  ১৯৩৯ সালে ‘কেশরী’ পত্রিকায় ‘Failure of Democracy and Rise of Fascism’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বীজ রোপণ, ভিত্তি স্থাপন চলতে থাকে সংগঠিত ভাবে, ধীরে ধীরে। স্বাধীনতা সংগ্রামের আড়ালে চুপিসারে তৈরি হতে থাকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বনিয়াদ।                   

(২) ফ্যাসিবাদের গণমাধ্যম

ফ্যাসিবাদের সম্প্রসারণ এবং জনগণের মধ্যে ফ্যাসিবাদী চিন্তার বিস্তারের প্রসঙ্গে গণমাধ্যম এবং ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডার ভূমিকা আশ্চর্যরকমভাবে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে ইতালির সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবনের উপাদান থেকেই ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির জন্ম। জাতীয়তাবাদ (nationalism), আভিজাত্যবাদ (elitism), সুরক্ষাবাদ (protectionism), রক্ষণশীলতা (conservatism), সাম্রাজ্যবাদ (imperialism) এবং কর্তৃত্ববাদ (authoritarianism) সহ বিভিন্ন উপাদান এই ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ১৯২২-এ ইতালিতে প্রথম ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয় ‘Ufficio Stampa della Presidenza del Consiglio’ (Premiership Press Office)। ১৯৩০ সালের পর থেকে এই প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার উপর ফ্যাসিস্ট নজরদারি শুরু করে। একইসাথে শুরু হয় মুসোলিনিকে ‘দুচে’ (Duce-এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ dux থেকে যার অর্থ leader) হিসেবে নির্মাণের প্রকল্প। ১৯৩৩ সালে নাৎসি জার্মানির রাইখ প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবলসের রোম পরিদর্শন, ফ্যাসিবাদে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য মত বিনিময়ের প্লাটফর্ম হয়ে ওঠে। ১৯২৪-এর ‘রয়্যাল ডিক্রি’ এবং ১৯২৫-এর প্রেস আইনের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয় সংবাদসংস্থাগুলিকে। ইতালির প্রভাবশালী সংবাদসংস্থা ‘আজেন্সিয়া স্তেফানি’-কে সরাসরি ফ্যাসিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ১৯২৮-এ তৈরি হয় ‘অলবো দে জর্নালিস্টি’ বা সাংবাদিকদের রেজিস্টার। সাংবাদিকতার লাইসেন্স হয়ে উঠল ফ্যাসিস্ট পার্টির এক্তিয়ারের অধীন। সংবাদপত্র, নিউজ মিডিয়ার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের দৃশ্য-শ্রাব্য প্রক্ষেপণের আকর্ষণীয়তা এবং অভিঘাত, নতুনভাবে যুদ্ধমুখী, বিদ্বেষমুখী চেতনার বিস্তার ঘটানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। ‘La cinematografia è l’arma più forte’ (‘Cinema is the most powerful weapon’) ছিল সেই সময়ে ফ্যাসিস্টদের জনপ্রিয় স্লোগান। উগ্র জাতীয়তাবাদী রেটোরিক, ফ্যাসিবাদী কল্পকথা এবং যুদ্ধের বীরগাথা নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রায়শই গড়ে উঠত সিনেমার প্লট। আরও বৃহত্তর পরিসরে ফ্যাসিজমের প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ‘ভেনিস বিনালে’ নামের স্বায়ত্তশাসিত সাংস্কৃতিক সংস্থাকে ভেনিস নগর পরিষদ থেকে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান মুসোলিনির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ১৯৩২ সালে ভেনিস বিনালে-তে যুক্ত করা হয় ‘The Exposizione d’Arte Cinematografica’ যা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল রূপে আত্মপ্রকাশ করে মুসোলিনিরই পৃষ্ঠপোষকতায়। পশ্চিমি দেশের অভিজাত শ্রেণিকে কাছে টানতে এই উদ্যোগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র প্রসারণ এবং বুর্জোয়া শ্রেণির উপর প্রভাব বিস্তার। ফ্যাসিবাদী প্রোপাগান্ডা প্রসারে গণমাধ্যমের ব্যবহার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বিভিন্ন কাঠামোগত সমস্যার মুখোমুখি হয়। ফলে আংশিক ব্যাহত হয় পরিকল্পনা। জাতিগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণে বিভক্ত ইতালিতে সমমাত্রিক, একচেটিয়া চিন্তাধারার প্রসার ঘটানো কঠিন হতে থাকে। আবার কখনও নিরক্ষরতা অনেক ক্ষেত্রে এই ফ্যাসিস্ট ইন্ডক্ট্রিনেশনের পথে বাধা হয় দাঁড়ায়। ১৯২১ এবং ১৯৩১-এর ইতালিতে যথাক্রমে প্রায় ৩৬% এবং ২১% মানুষ সম্পূর্ণ নিরক্ষর ছিলেন। সংবাদপত্র পড়তে না জানা এই মানুষের কাছে পৌঁছানোর সমস্যার সমাধান ফ্যাসিজম তখনও করে উঠতে পারেনি। ১৯৩০-এর শেষদিক সামাজিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হতে শুরু হলে রেডিও প্রোগ্রামে উল্লেখযোগ্যভাবে গানের আধিক্য বাড়তে থাকে। জনগণকে সমাজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এক কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে সংগীত ব্যবহৃত হতে থাকে। রেডিও সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলির ৫০% বরাদ্দ করা হয় সংগীতের জন্য। সিনেমার মধ্যেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সিনেমার মাধ্যমে জনগণকে মূল সমস্যা থেকে সরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করা হয়। বিনোদনের উদ্দেশ্যে বিচিত্র ধারা, শৈলীর আবির্ভাব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, আলোচনায় আসবে সেই সময়ের ইতালিয়ান সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় একটি জঁর ‘cinema dei telefoni bianchi’ অর্থাৎ সমাজের অভিজাত শ্রেণির টেলিফোনের মাধ্যমে পরনিন্দা-পরচর্চার বিষয়ে নির্মিত সিনেমা। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ইতালির ফ্যাসিজম বিভিন্ন ডিক্রি জারি করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করলেও তা ছিল আংশিক। বেসরকারি এবং বিদেশি কোম্পানির মালিকানায় পরিচালিত অনেকগুলি সংবাদসংস্থা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাগুলিকে এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়, কারণ জনগণের রাজনৈতিক ক্ষোভ এবং সংঘাত প্রশমিত করতে আভিজাত্যবাদ এবং বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিনোদনের উৎপাদন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রণ এবং বিনোদনের দোলাচলের বিন্যাসের মধ্যে দিয়েই বিবর্তিত হয়ে চলে ফ্যাসিবাদী গণমাধ্যম।                   

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ওয়াইমার রিপাবলিকের মতো গণসমাজে রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় নাৎসি শাসকশ্রেণির। ১৯২৪ সালে হিটলারের বক্তৃতায় সেই প্রয়োজন উঠে আসে — ‘The movement has two instruments, first the propaganda machine and then the assault division (SA)’। ১৯৩৩-এর আগে নাৎসি প্রোপাগান্ডার কোনও সুসংহত কাঠামো বা ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছিল না। বরং স্থানীয় স্তরে ছোটো ছোটো উদ্যোগের মধ্যেই সীমিত ছিল। লিফলেট, প্যামফ্লেট বিলি করার চল থাকলেও মূলত অভিজ্ঞ বাগ্মীর বক্তৃতার মাধ্যমেই নাৎসি মনোভাব পৌঁছানো হত গ্রামে, শহরে। পোস্টার, ফ্লাইয়ারের মতো ভিস্যুয়াল উপাদান নাৎসি চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেবার জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল। শিল্পপতি আলফ্রেড হুগেনবার্গের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণপন্থী ভাবধারার এক শক্তিশালী মিডিয়া কর্পোরেশন তৈরি হয় এই সময়ে। এই কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত সিনেমা, প্রকাশনা সংস্থা এবং সংবাদসংস্থার একযোগে প্রচার জনমানসে উগ্র দক্ষিণপন্থী নাৎসি মতবাদ প্রসারে গতি আনে। ১৩ মার্চ, ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাইখ মিনিস্ট্রি অফ পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা (Reichsministerium für Volksaufklärung und Propaganda, RMVP), জোসেফ গোয়েবলস এবং ওয়ার্নার নম্যানের নেতৃত্বে। ঐ বছরের ২২শে সেপ্টেম্বর তৈরি হয় রাইখ চেম্বার অফ কালচার (Reichskulturkammer, RKK), সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক জগতের নিয়ন্ত্রক হবার আকাঙ্ক্ষায়। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে সাতটি স্বতন্ত্র বিভাগ যথাক্রমে থিয়েটার, সিনেমা, গান, রেডিও, প্রেস, সাহিত্য এবং ফাইন-আর্টসের উপর নাৎসি নজরদারি শুরু করে। ‘অনার্য’ এবং নাৎসি রাজনীতির বিরোধী কর্মীদের মিডিয়ায় কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আর-একটি স্বতন্ত্র নজরদারির ব্যবস্থা ‘Filmkreditbank’ তৈরি হয় যা সিনেমা প্রযোজকদের অসময়ে ‘লোন’ দেওয়া ছাড়াও ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট (নাৎসি) প্রোপাগান্ডা সম্বলিত প্রোজেক্টে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার কাজ করতে থাকে। নাৎসি নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Sicherheitsdienst) তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে নাৎসি প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের খবরাখবর নেওয়া ছাড়াও আলাদা ভাবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গড়পড়তা আমজনতার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মনোভাব এবং মতামত বিষয়ে রিপোর্ট (‘Stimmungsberichte’ অর্থাৎ ‘Secret Reports on Popular Opinion’) পাঠাত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্ত এই অভাবনীয় প্রোপাগান্ডিস্ট গণমাধ্যম থাকা সত্ত্বেও মানুষের কল্পনা এবং মনোজগতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দুরূহ ঠেকছিল রাইখ মিনিস্ট্রির। কঠিন কাজ! মানব মনের চলন যে বড়ই অপ্রত্যাশিত! নিরন্তর হিংসা, জাতিবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা গোগ্রাসে নিরন্তর সে গিলতে পারে না। ইন্টারভ্যাল প্রয়োজন। ডিস্ট্র্যাকশন প্রয়োজন। প্রয়োজনমাফিক, জীবনের অনুভবে না মিশে যাওয়া অবধি দিবারাত্রি প্রোপাগান্ডা, হজমের পরিবর্তে তার বদহজমের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রেডিও শ্রোতার ভালো বিনোদনের অভাব-অভিযোগ কানে আসে রাইখ মিনিস্ট্রির। আনুগত্য অঙ্গীকারের (pledge) প্রাচুর্য, পুনরাবৃত্তি তৈরি করে  ‘reader fatigue’।  প্রোপ্যাগান্ডা সিনেমা সেইভাবে ‘পপুলার’ হয়ে ওঠে না। এই প্রবণতা খেয়াল করে ১৯৩৫-এর পর থেকে গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডার শৈলীর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করা হয়। নাৎসি রাজনীতির পাঠ যদিও একই প্রিসিশনে পৌঁছে যায় শ্রোতার কাছে কিন্তু এবার বিনোদনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। ‘অফেন্সিভ প্রোপাগান্ডা’ এবং ‘ডাইভার্সন এন্টারটেইনমেন্ট’, এই দুইয়ের নিখুঁত ভারসাম্যে এগিয়ে চলে জাতিবৈরিতার মগজধোলাই। এক্ষেত্রে অগ্রজ ফ্যাসিস্ট ইতালির চেয়ে সংগঠিত প্রোপাগান্ডার নিরিখে অনেক এগিয়ে ছিল নাৎসি জার্মানি।     

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে হাঙ্গেরির দক্ষিণপন্থী সরকার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গণতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিচালিত প্রেসকে হাঙ্গেরির যুদ্ধমুখী চেতনার বিপরীতে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। ১৯৩৫-এর পর হাঙ্গেরি সরকার জার্মানির সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রশ্নে আরও কাছাকাছি আসার ফলে হাঙ্গেরির বিভিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত ইহুদি-বিদ্বেষী, জাতিরক্ষক (race-defenders) এবং নাৎসিবাদের অনুগামীরা উজ্জীবিত হয়। এই জনমত হাঙ্গেরির দক্ষিণপন্থী সরকারকে নতুন মিডিয়া-পলিসির প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ জোগায়। জার্মান অনুকরণে ১৯৩৮-৩৯ সালে তৈরি হয় ‘প্রেস চেম্বার’। সমস্ত সাংবাদিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের ‘হাঙ্গেরিয়ান প্রেস চেম্বার’-এর সদস্য হতে বাধ্য করা হয়। ১৯৩৮ সালে ইহুদি সদস্যের সংখ্যা ছিল মোট সদস্য সংখ্যার ২০%, ১৯৩৯-এ যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬%। ‘থিয়েটার এন্ড ফিল্ম চেম্বার’ তৈরি হয় হাঙ্গেরিয়ান সিনেমাকে ‘আর্যায়িত’ (Arianize) করার উদ্দেশ্যে। ফ্রাঙ্কোর শাসনকালে স্পেনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ও গণমাধ্যম ব্যবহারের প্রশ্নে ফ্যাসিবাদী ঝোঁক দেখা যায়। ফ্রাঙ্কোর শাসনকাল পুরোপুরি ফ্যাসিবাদী চরিত্রের না হলেও, স্প্যানিশ স্বৈরতন্ত্রের মডেলকে নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত করেছিল ফ্যাসিজম। ইতালীয় ফ্যাসিজমের অনুপ্রেরণায় ১৯৩৮ সালে ‘প্রেস আইন’ চালু করা হয় যা চলেছিল ১৯৬৬ অবধি। ‘স্প্যানিশ ট্রুথ’ প্রচারের উদ্দেশ্যে তৈরি হয় নিউজ এজেন্সি ‘Efe’।     

(৩) ফ্যাসিবাদের ম্যাট্রিক্স এবং মতাদর্শগত গঠন বিন্যাস

এমিলিও জেন্তিলে, জিভ স্টার্নহেল এবং জর্জ মসে — ফ্যাসিজমের তিন উল্লেখযোগ্য ইতিহাসবিদ, গবেষকের মতে ফ্যাসিজম এমন এক আধুনিক ‘প্রতি’-বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ফেনোমেনন যা একইসঙ্গে উদারপন্থা ও মার্কসবাদ উভয়েরই বিরোধী। জেন্তিলের অনুভবে ফ্যাসিজম সাধারণভাবে পরিচালনা করে এক সামরিকীকৃত পার্টি যার মূলে আছে রাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আগ্রাসী অবস্থান, এক সংগঠন নির্ভর তত্ত্ববিরোধী (Anti-theory) মতাদর্শ। এই মতাদর্শের কাঠামো তৈরি হয়েছে কর্তৃত্বকারী পুরুষতান্ত্রিকতা এবং পৌরাণিক, কল্পকথা বা মিথের উপর। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রকে জাতিগতভাবে একমাত্রিক সম্প্রদায় হিসেবে বোঝাপড়া। এই একমাত্রিক দেশের চাই কর্তৃত্বের অনুক্রম, চাই যুদ্ধের প্রতি উদ্দীপনা যা ম্যাস্কুলিন ন্যাশনালিটির জন্ম দেয়। শুধুমাত্র প্রতিবিপ্লব নয়। ফ্যাসিজমের উদ্দেশ্য হল এক নতুন সামাজিক বিন্যাস। এবার এই সংজ্ঞাকে কাটাছেঁড়া করে ধাপে ধাপে বোঝার চেষ্টা করা যাক। প্রতিবিপ্লব শব্দে যে ‘বিরুদ্ধ’, ‘প্রতি’ বা ‘অ্যান্টি’ বিষয়টি রয়েছে তার উৎস কী? কীসের বিরুদ্ধাচরণ? সামাজিক, রাজনৈতিক কোন্ মতাদর্শ বা চিন্তাধারার ‘রিয়্যাকশনে’ এর সৃষ্টি? প্রথমত, উগ্র জাতীয়তাবাদের আইডিয়ার পিছনে রয়েছে ১৭ এবং ১৮ শতকের ইউরোপের বৌদ্ধিক আন্দোলন বা এনলাইটেনমেন্ট-এর প্রতিক্রিয়া। এনলাইটেনমেন্ট যুক্তিবাদের প্রভাব বিস্তার করে। এর বিপরীতে অ্যান্টি-এনলাইটেনমেন্ট ফ্যাসিবাদের মতাদর্শের ঐতিহ্যগত ভিত্তি স্থাপন করে। যদিও ফ্যাসিবাদ উদারপন্থী এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান করে তবুও ফ্যাসিবাদ বাজার অর্থনীতির বিরোধিতা না করে কর্পোরেট সংস্থা, পুঁজিবাদ এবং সম্পদ আহরণের পক্ষে অবস্থান নেয়। এখানে স্বাভাবিকভাবেই ‘অ্যান্টি-মার্কসিস্ট অবস্থান উঠে আসবে। আবার একইসাথে রাজনৈতিক পরিসরে উঠে আসবে চরমপন্থী হিংস্রতা। আর্জেন্টিনীয় ইতিহাসবিদ ফেডেরিকো ফিঞ্চেলস্টেইনের মতে এই হিংস্রতা এনলাইটেনমেন্টের এক চূড়ান্ত পর্যায় সোভিয়েত কমিউনিজমের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উঠে আসছে। দ্বিতীয়ত, এই ফ্যাসিস্ট প্রতিক্রিয়ায় মার্কসবাদ বিরোধিতার জায়গা হল ‘অর্ডারিং অফ সোস্যাইটি’ বা সামাজিক অনুক্রম ওরফে হায়ারার্কির প্রসঙ্গক্রমে। ফ্যাসিবাদে জনগণকে শুধুমাত্র দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা নিয়ে মাথা ঘামানোর নিদান দেওয়া হয় কারণ রাষ্ট্রশাসন ক্ষমতা থাকবে অভিজাত নেতৃত্বের হাতে (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নাৎসি জার্মানির শাসকশ্রেণির জনগণের উদ্দেশ্যে ফ্যুয়েরারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আর্জির ঘোষণা)। অন্যদিক মার্কসবাদ সাধারণ মানুষকে রাজনীতি সচেতন, শোষিত মানুষের মাথা তোলার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার আহ্বান জানায়। সামাজিক হায়ারার্কি ভেঙে নতুন সাম্যবাদী সমাজের বীজ বোনার স্বপ্ন দেখায়। অ্যালিয়েনেশনের নিরিখে ফ্যাসিবাদ প্রো-অ্যালিয়েনেশন, মার্কসবাদ অ্যান্টি-অ্যালিয়েনেশন। 

তবু তত্ত্ব-বিরোধী হবারও তত্ত্ব থাকে। ফ্যাসিজমের তত্ত্ব-বিরোধিতা থেকে জন্ম নেয় ফ্যাসিজমের খোলামুখ স্ট্রাকচার। যার নেই কোনও তাত্ত্বিক দৃঢ় গঠনকাঠামো। বরং ‘সামাজিক অনুক্রম’ এবং একমাত্রিক জাতি-ধর্ম-বর্ণের আদলে তৈরি প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের বিস্তার ঘটে। এর সুবিধা হল সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক তত্ত্ব, প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ নৈরাজ্যবাদ, প্রত্যেক চিন্তাধারায় প্রভাবিত মানুষের সমাগম ঘটে ফ্যাসিবাদ বা জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিজমে (নাৎসি)। প্রত্যেকেই পায় প্রতিনিধিত্ব।   

ফ্যাসিবাদের ম্যাট্রিক্স বা প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এই ম্যাট্রিক্স বা ধাত্রের গঠনকে পরমাণুর গঠনের অণুরূপে বোঝা যেতে পারে। ফেডেরিকো ফিঞ্চেলস্টেইনের গবেষণার নিরিখে-ফ্যাসিজম হল এক বিশেষ কোড বা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা এবং পদক্ষেপের ভাষা যা সবসময় পরিবর্তনীয় সংকেত বহন করে। স্থানকালের নিরিখে ক্রমাগত পরিবর্তনীয় এই ভাষ্যের কেন্দ্রে থাকে ফ্যাসিবাদের ম্যাট্রিক্স। মুসোলিনির ভাষায়  ফ্যাসিস্ট ‘fondo commune’ (common denominator)। ভাবা যেতে পারে একটি ফ্যাসিস্ট নিউক্লিয়াসের কথা যা সাধারণ কিছু ফ্যাসিস্ট নির্ধারক এবং সংকেত নিয়ে তৈরি যা তুলনামুলকভাবে কম পরিবর্তনীয়। ফিঞ্চেলস্টেইনের ভাষায় ‘মাস্টার কার্সার’ বা ‘অভিযোজন পয়েন্ট’। সহজ ভাষায় ‘ফ্যাসিস্ট মিনিমাম’ অর্থাৎ ন্যূনতম ফ্যাসিস্ট সংকেতসমূহ যা সাধারণভাবে স্থির বা রিজিড। এবার এই নিউক্লিয়াস থেকে যত দূরে যাওয়া যায় তত ফ্যাসিস্ট সংকেত হতে থাকে ফ্লেক্সিবল এবং পরিবর্তনীয়। ফ্যাসিস্ট ম্যাট্রিক্সের এই অবস্থানে থাকবে সাধারণ পাশ্চাত্যের বাইনারি ‘আমরা, ওরা’ অথবা ‘সভ্যতা এবং অসভ্যতা’ ইত্যাদি। এই পরিসরে যুক্ত হয় ক্রমাগত আদর্শ শত্রু নির্বাচনের পদক্ষেপ। যুক্ত হয় জাতিবিদ্বেষ, রাজনৈতিক বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষের বিশিষ্টতা। এবং এই বিদ্বেষী বিশিষ্টতার বিনিময়ে রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদ মিলিয়ে দেওয়া। এই ম্যাট্রিক্সের আরও বাইরে থাকে execution বা ফ্যাসিজমের গঠনগত ভায়োলেন্সের ছাপ। থাকে যুদ্ধ আদর্শ। থাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ফ্যাসিস্টদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ বা ইম্পেরিয়ালিজম ফ্যাসিস্ট ম্যাট্রিক্সের মধ্যেই অবস্থান করে। এই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যই হল ফ্যাসিবাদী থিওরি এবং প্র্যাকটিসের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যম। ভায়োলেন্স এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী অভিব্যক্তির বাস্তবায়ন।          

এখন, এই ফ্যাসিবাদী ম্যাট্রিক্স এর সাথে যুক্ত দুটি চিন্তাধারা বা আইডিয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসবে। 

(ক) ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিজম —সিন্ডিক্যালিজম বা শ্রমিক আন্দোলন ইতালীয় ফ্যাসিস্ট প্রেক্ষাপটে ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিজমে রূপ নেয়। মুসোলিনির শ্রমিক আন্দোলন থেকে ক্রমশ জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধমুখী প্রেক্ষিতে সরে আসা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী রেটোরিক তৈরির সূত্রে ন্যশনাল সিন্ডিক্যালিজম দানা বাঁধে। ইতালির ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিজমের কিছু সাধারণ নীতি ছিল এইরকম — বুর্জোয়া ভাবনার বিরোধিতা, গণতন্ত্র-উদারবাদ-মার্কসবাদ-আন্তর্জাতিকতাবাদ-শান্তিবাদ বিরোধিতা এবং বীরত্ব, জীবনীশক্তি, হিংস্রতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। 

(খ) ফিউচারিজম — ফ্যাসিবাদ উত্থানের পিছনে যে থিওরি বা চিন্তাভাবনার উল্লেখযোগ্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে আসবে ইতালির ফিউচারিজম-এর কনসেপ্ট। ১৯০৯ সালে ইতালিয়ান কবি ফিলিপ্পো তোমাসো মারিনেত্তি-র হাত ধরে ফিউচারিজম নামক সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয় যার অন্যতম মূল উপাদান ছিল যুদ্ধপ্রেম, বীরত্ব, ইতালির সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ইতিহাসবিমুখতা। ধীরে ধীরে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ইতালির বিভিন্ন কবি এবং অঙ্কনশিল্পী সহ শিল্প জগতের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন মানুষ যোগ দেন। ১৯০৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘লা গ্যাজেত্তা ডেল’এমিলিয়া’ নামক ইতালীয় সংবাদপত্রে এবং ২০শে ফেব্রুয়ারি প্যারিসের ‘ল ফিগারো(হো)’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ‘ম্যানিফেস্টো অফ ফিউচারিজম’। এই ফিউচারিজমের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্টের মধ্যে উঠে আসবে আবিষ্কার, আধুনিকতা, গতি, ইন্ডাস্ট্রি, ভাঙচুর, ভায়োলেন্স, বীরত্ব ইত্যদি। ইতালিয়ান ফিউচারিস্টদের কল্পনাশক্তির এক বড়ো অংশ আচ্ছন্ন হয়েছিল স্পিড, গাড়ি, এরোপ্লেন ইত্যাদির মধ্যে। মোট ১১টি পয়েন্ট উল্লেখ করা হয় ‘ম্যানিফেস্টো অফ ফিউচারিজম’-এ। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে আনা যাক। পয়েন্ট ৪ — ‘We affirm that the world’s magnificence has been enriched by a new beauty: the beauty of speed’. পয়েন্ট ৮ — ‘… Why should we look back, when what we want is to break down the mysterious doors of the Impossible? Time and Space died yesterday. We already live in the absolute, because we have created eternal, omnipresent speed’. পয়েন্ট ৯ — ‘We will glorify war — the world’s only hygiene-militarism, patriotism, the destructive gesture of freedom-bringers, beautiful ideas worth dying for…’. পয়েন্ট ১০ — ‘We will destroy the museums, libraries, academies of every kind, will fight moralism, feminism, every opportunistic or utilitarian cowardice’. স্পিড, ইতিহাসের প্রতি বিতৃষ্ণা, যুদ্ধপ্রেম, সামরিকীকরণ, দেশপ্রেম। এবং সর্বোপরি মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, একাডেমিক বিরোধী এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বর অনেকক্ষেত্রেই প্রতিধ্বনিত হয় ইতালীয় ফ্যাসিজমের কাঠামোয়। ক্রমবিবর্তনের পথে ফ্যাসিজম ফিউচারিজমের অনেক উপাদান ধারণ করে।  ইতিহাসবিমুখতা, ভায়োলেন্স, বীরত্ব, যুদ্ধগৌরব এই সমস্ত উপাদান পরবর্তীকালে ফ্যাসিজমেরে মতাদর্শকে পুষ্ট করে। ফিউচারিজমের সাথে ফ্যাসিজমের যোগাযোগ আমাদের আর-একটি ইঙ্গিত দেয়। যুদ্ধপ্রেম, ইতিহাসবিমুখতা এবং ভায়োলেন্সের পটভূমি, যার উপর ভিত্তি করে ফ্যাসিজম ইতালীয় সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তার গ্রহণযোগ্যতা, মান্যতার পরিবেশ ইতালীয় জনমানসে আগেই বাসা বেঁধেছিল।   

(৪) “এটা সামাজিক পরীক্ষাগার… এখানে লগ্নি কার আর ভিক্ষা কার?”

ফ্যাসিবাদের উত্থানে, প্রসারে ছায়ার আড়ালে থাকা পুঁজিবাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহজ করে ভাবা যাক। কোনও আদর্শ, চিন্তাধারা বা ধারণা কীভাবে সম্প্রসারিত হয়? কর্মসূচি বা প্রোগ্রামের মাধ্যমে। এখন এই কর্মসূচি, গণ-কর্মসূচি, মিডিয়ার মাধ্যমে যুদ্ধমুখী অভীপ্সা, জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, সাম্রাজ্যবাদ, এই সমস্ত বিষয় সাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন পুঁজি। এবার এই পুঁজি কথা থেকে আসবে? ফ্যাসিবাদে উদ্দীপ্ত করার জন্য কীভাবে মানুষকে কাছে টানা যাবে? ফ্যাসিবাদ যখন প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসেবে ইতালিতে, বা নাৎসিবাদ হিসেবে জার্মানিতে আত্মপ্রকাশ করছে, যখন শক্তি-সঞ্চয় করছে, জনভিত্তি বাড়িয়ে তুলছে, সেই গঠনমূলক স্তরে কোন্ পুঁজির উপর ভিত্তি করে সে শক্তি বাড়ায়? এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ পুঁজির জোগান না থাকলে এই ফরমেটিভ স্তরেই ফ্যাসিবাদ এগোতে পারে না। কোনও এক বিশেষ নেতাকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে ‘প্রতিষ্ঠা’ করার প্রক্রিয়াটি কীরকম? ইতালিতে মুসোলিনিকে ‘ডুচে’ বা জার্মানিতে হিটলারকে ‘ফ্যুয়েরার’ বা হালফিলে আমাদের দেশে ’৫৬ ইঞ্চি ছাতি’-র মতো শব্দবন্ধ কীভাবে আমাদের মননে স্থায়িত্ব পেল? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে অনেক দূরত্বে এই কয়েনেজ নির্মাণের মূলে আছে প্রাইভেট ক্যাপিটাল, বেসরকারি পুঁজি, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্য এবং অবশ্যই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফিন্যান্স ক্যাপিটাল। ফিরে যাওয়া যাক প্রাক্-দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ পর্বে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে  আংশিক রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ নিয়ে এক বহুমুখী মাল্টিপোলার বিশ্ব। পুঁজিবাদ বিকাশের পর্যায়ে অবধারিত ভাবেই পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কারণে সংকট তৈরি হতে বাধ্য। ১৯১৩-১৯৩৩ অবধি প্রায় তিনটি ধাপে গোটা পৃথিবী গ্রাস করে অর্থনৈতিক মন্দা। ১৯১৩ থেকে ১৯২৭-এর মধ্যে বিশ্বে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৪৭ বিলিয়ন ইউনিট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় প্রায় ২০০ বিলিয়ন ইউনিট, অথচ উদাহরণস্বরূপ, ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ৯.০৩ লক্ষ থেকে ৮.৭৪ লক্ষে ঠেকে। ইংল্যান্ডে ১৯১৯-১৯২৩-এর মধ্যে কলকারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পায় ৮.৩৬ লক্ষ থেকে ৭.৮৯ লক্ষ। ব্রিটেনে ১৯২০-৩৮ এর মধ্যে বেকারত্বের হার ৩.৯% থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৯%। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ওয়াইমার রিপাবলিকে জড়িয়ে যায় যুদ্ধ-ঋণ এবং ঘটনাক্রমে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি (hyperinflation)। এদিকে ফিন্যান্স ক্যাপিটাল জাঁকিয়ে বসেছে পুঁজিবাদের কাঠামোয়। ফিন্যান্স পুঁজিবাদ অর্থে সাধারণভাবে বোঝায় মুদ্রা এবং ‘বন্ড’ বা ‘স্টক’-এর মতো আর্থিক পণ্যের ক্রয় এবং বিক্রয় বা বিনিয়োগ জনিত মুনাফা অর্জনের আধিপত্যের পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের সংকটের এই পর্যায়ের একদিকে বেকারত্বের  ফলে কমতে থাকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, অন্যদিকে ক্রেতা কমে যাওয়ায় একই লাভ বজায় রাখতে পুঁজিপতিরা দ্রব্যের মূল্য বাড়াতে থাকে। ফলে আরও হ্রাস পায় ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা। পণ্যের মূল্য এবং ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে তৈরি হয় বিশাল ব্যবধান। বাজার সংকুচিত হতে থাকে। এই ক্রাইসিসের সময়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের (monopoly capitalist) প্রয়োজন আরও বড়ো বাজার। এক বাজার সংকুচিত হলেও যাতে দখল করা যায় অন্য বাজার, অন্য ক্রেতা। তাই প্রয়োজন পুঁজির ভ্রমণ। পুঁজির এই ‘আন্তর্জাতিকীকরণ’-এ অক্সিজেন জোগায় ফিন্যান্স ক্যাপিটাল। 

কিন্তু লগ্নি-পুঁজির এই অবাধ বিচরণে বাধা হয় দাঁড়ায় সেই সময়ের প্রেক্ষাপট। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে বেড়ে চলা চাপানউতোর ‘প্যারিস পিস কনফারেন্স’ থেকে উদ্ভূত ‘লিগ অফ নেশনস’-কে দুর্বল করে দেয়। আন্তর্জাতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে তৈরি হয় বিধিনিষেধ, শুল্ক, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। পুঁজিবাদের এই ‘গ্রেট ডিপ্রেশনের’ কালে ভয়ংকর বেকারত্ব থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন দেশ অর্থনীতিবিদ কেইনসের ‘The Means to Prosperity’-র অর্থনৈতিক তত্ত্ব গ্রহণ করল। নিয়ন্ত্রিত জাতীয় অর্থনীতির দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকল। আপাত স্থগিতাদেশ পড়ল লগ্নি-পুঁজির বিশ্বভ্রমণের বাসনায়। লগ্নি-পুঁজি থেকে তখন উঁকি দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দানব। এই প্রসঙ্গে বুলগারিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির জিওর্জি দিমিত্রভের ১৯৩৫ সালের তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম বিশ্ব-কংগ্রেসে উদ্ধৃত ফ্যাসিবাদের ডেফিনিশনের দিকে আমরা নজর দেব — ‘No, fascism is not a power standing above class, nor government of the petty bourgeoisie or the lumpen-proletariat over finance capital. Fascism is the power of finance capital itself. It is the organization of terrorist vengeance against the working class and the revolutionary section of the peasantry and intelligentsia. In foreign policy, fascism is jingoism in its most brutal form, fomenting bestial hatred of other nations.’ অর্থাৎ ফিন্যান্স ক্যাপিটালেরই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্র-জাতীয়তাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী অংশের পাশবিক রূপই হল ফ্যাসিবাদ। এই সংজ্ঞার অর্থনৈতিক অভিব্যক্তি বোঝার জন্য আমরা চোখ রাখব  ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা (great depression)-র সময়ে পৃথিবী জুড়ে সামরিক মহড়ার ছবিতে। একদিকে পুঁজি-শ্রমের নিরন্তর দ্বন্দ্বে বেড়ে চলে শ্রমিক অসন্তোষ, ধর্মঘট, অন্যদিকে একই সময়ে লগ্নি-পুঁজির বিশ্বায়নের স্বার্থে যুদ্ধের মহড়া চলে অবিরাম। একদিকে পৃথিবীর পুঁজিবাদী দেশগুলিতে ১৯২৯-৩২ অবধি প্রায় ১৯০০০ ধর্মঘট হয় আবার অন্যদিকে ১৯১৩ থেকে ১৯৩৪ সালে পৃথিবীজুড়ে সামরিক খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিনগুণ। শ্রমিক অসন্তোষ, সর্বহারা শ্রেণির ক্রোধ, আক্রোশ ঢেকে যায় পুঁজিবাদী শ্রেণি পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আবহে। অর্থনৈতিক মন্দার সাথে একযোগে চলতে থাকে যুদ্ধপ্রস্তুতি। যুদ্ধ মানেই একচেটিয়া আধিপত্যের প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধ মানেই মাল্টিপোলার পৃথিবী থেকে বাইপোলার বা মনোপোলার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিক্ষেত্র। লগ্নি পুঁজির অবাধ বিচরণ। রজনিপাম দত্ত, তাঁর ‘ফ্যাসিজম এন্ড সোশ্যাল রিভোলিউশন’ পুস্তকে জার্মান নাৎসি পার্টির সাথে ফিন্যান্স ক্যাপিটালের সম্পর্ক বোঝাতে সেই সময় নাৎসি পার্টি পরিচালিত সরকারের ইকোনমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সাথে আমাদের পরিচয় করান। নাৎসি সরকারের এই কাউন্সিলে ছিলেন সামরিক অস্ত্র শিল্পপতি হের ক্রুপ ভন বহ্লেন, ইস্পাত শিল্পপতি হের ফ্রিৎজ থাইসেন, বিদ্যুৎ শিল্পপতি হের এফ সি ভন সিমেন্স, রং প্রস্তুতকারক ট্রাস্টের মিলিওনার কার্ল বসচ, জার্মান স্টিল ট্রাস্টের এ ভল্গার, ম্যাক্সিমিলিয়ান স্টিল ওয়ার্কসের হের বাখিঙ্গার, ব্যাংকার হের ভন ফিঙ্ক প্রমুখ। ১৯৩২-এর ওয়াইমার রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এই শিল্পপতিদের নাৎসি পার্টির নির্বাচনি তহবিলে ‘অবদান’ ছিল উল্লেখযোগ্য।      

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়। ক্রমে কোল্ড ওয়ারের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার দ্বিমুখী বিন্যাস ঘটে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। কোল্ড-ওয়ার শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে আবার ইউনিপোলার হয়ে পড়ে রাষ্ট্রশক্তির বিন্যাস। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিতে উদ্ভূত হয় পুঁজিবাদের নতুন আঙ্গিক। বিশ্বায়ন, মুক্ত-অর্থনীতির দাপটে পুঁজিবাদ ক্রমে আরও বিমূর্ত হতে থাকে। ফলে আরও নতুন নতুন ফর্মে শুরু হয় ফিন্যান্স ক্যাপিটালের স্বৈরাচার। ফিন্যান্স ক্যাপিটালের আধুনিকীকরণের যুগে তাই স্বেচ্ছাচারী, প্রবল প্রতিবিপ্লবী, হলোকাস্টময় শাসন সামাজিক নিপীড়নের সংস্কৃতির বিশিষ্টতা অনুযায়ী প্রতিভাস হয় মাঝে মাঝে। অন্যত্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছায়ায়, ‘ইনফরমেশন ওয়ার’-এর সাযুজ্যে নির্বিবাদে চলে ‘ফ্যাসিস্টিক’ দমনপীড়ন। এখন তাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সহজেই চোখে পড়ে ‘ফ্যাসিবাদী চরিত্র’। পাশ্চাত্যের ইনফরমেশন ওয়ার তৈরি করে এক ‘মধ্যবিত্ত’ উপভোক্তার সারি যা পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠা করে এক সামাজিক শক্তি হিসেবে (capitalism as social force)। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাজ সহজ হয়।  কোভিডের চরম সংকটকালেও কিউবা, ভেনিজুয়েলায় অনায়াসে ঘটে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা (economic blockade)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রদপ্তর কখনও সিআইএ কখনও ন্যাটোর সহায়তায় চিলি, নিকারাগুয়া, ইরাক, লিবিয়ায় নির্বিঘ্নে ঘটায় ক্যু দে’তা (coup d’etat — সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসন পরিবর্তনের কৌশল)। চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দে চিলির তাম্র খনির (copper mines) জাতীয়করণ করে চিলির সম্পদ জনগণের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করলে ভ্রাম্যমাণ লগ্নি-পুঁজির দানব বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি, ২০১৯-এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো লিথিয়াম খনির দেশ বলিভিয়ায়, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থী প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস-এর বিরুদ্ধে ক্যু দে’তা (coup d’etat) ঘটায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মোরালেসের সরকার উৎখাত করে। আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গে নাম জড়ায় পৃথিবীর ধনীতম মানুষ, ‘টেসলা’, ‘স্পেস-এক্স’-এর কর্ণধার, বুর্জোয়া উদ্যোগপতিদের নয়নমণি এলন মাস্কের। প্রসঙ্গত, এলন মাস্কের ইলেকট্রিক গাড়ি ‘টেসলা’-র প্রয়োজন লিথিয়াম ব্যাটারির অনন্ত জোগান। ট্যুইটারে এই প্রশ্নের মুখে এলন মাস্কের স্পর্ধিত ঔপনিবেশিক অশ্লীলতা — ‘we will coup whoever we want! Deal with it’। (ট্যুইটার, টাইমস্ট্যাম্প : রাত ১১.৩২, ২৪ জুলাই, ২০২০) 

ডিল উইথ ইট। বিশ্ব অর্থলেনদেনের পরিসরে ডলারের আধিপত্য। ডিল উইথ ইট। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত অন্তর্দেশীয় অর্থলেনদেনের ব্যবস্থা ‘স্যুইফট’ সিস্টেম কন্ট্রোল হয় পশ্চিমি আনুগত্যে, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস থেকে। ডিল উইথ ইট। সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী না হলেই এম্বার্গো, স্যাংশন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ডিল উইথ ইট। একচেটিয়া পুঁজির নির্দেশানুসারে ইচ্ছেমতো সাম্রাজ্যবাদী ক্যু দে’তা। ডিল উইথ ইট। এখানে লগ্নি কার? স্পষ্ট। ভিক্ষা কার? স্পষ্ট। লাভ কার? স্পষ্ট। অক্সফ্যামের ২০২২-এ প্রকাশিত ‘Inequality kills’ নামক রিপোর্টের নয়ের পাতায় চোখ রাখুন। আরও স্পষ্ট হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রতি সেকেন্ডে ৪ জন মানুষ খুন করছে। উলটে দেখুন ঐ রিপোর্টের দশের পাতা। ১০ জন ধনীতম মানুষের মোট সম্পদ গরিবতম ৩.১ বিলিয়ন মানুষের মোট সম্পদের সমান। পুঁজিবাদী ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়ান্ট জন্ম নেয় পৃথিবীতে। বিলিয়নেয়ার ভ্যারিয়ান্ট। কোভিডের পর ভ্যারিয়ান্ট রূপ বদলে হয় ট্রিলিয়নেয়ার। ওদিকে লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকের রক্তমাখা পায়ের ছাপ লেগে থাকে ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে, রেল লাইনে। না, এই অসাম্যের বিরুদ্ধে কোনও ভ্যাকসিন নেই। আপাতত। ডিল উইথ ইট। আর অসাম্য থাকলে অর্থনৈতিক অসাম্য, বেকারত্ব আবার চক্রাকারে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার জন্ম দেবে। হয়তো অন্য রূপে। ডিল উইথ ইট! 

(৫) ভিসুভিয়াস ও আমরা : ফ্যাসিবাদের সামাজিক রসদ  

ফ্যাসিবাদ পরিস্ফুরণের পুঁজিবাদী কারণ আলোচনা করার সূত্রে অবধারিত ভাবেই ফ্যাসিবাদ উত্থানের  সামাজিক রসদ নিয়ে কাটাছেঁড়া করা প্রয়োজন। ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টির গণভিত্তি থেকে এখনকার সময়ে বিভিন্ন ‘ফ্যাসিস্টিক’ বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার, চরিত্রের রাজনৈতিক পার্টি, গোষ্ঠী তাদের পরিচালিত সরকারের গণভিত্তির কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। এই বিষয়ে ঢোকার আগে দুটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করব।

‘All human conditions and functions, no matter how and when they are manifested, influence material production and have a more or less determining effect on them’ (‘থিওরি অফ সারপ্লাস ভ্যালু’, কার্ল মার্কস)। 

‘Every psychic experience, such as a dream, a useless performance, the absurd utterances…has a function and a meaning’ (সিগমুন্ড ফ্রয়েড)। 

‘All human conditions and functions’ অর্থাৎ একটি মানুষের জীবনের প্রত্যেক পরিস্থিতি এবং সমস্ত কার্যাবলি, তার উপযোগিতা ব্যতিরেকে, যেকোনও বস্তুগত উৎপাদনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। ফ্রয়েডের আলোচনাতেও উঠে আসে একই সুর। ‘Every psychic experience’, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত সমস্ত মানসিক অনুভব মানুষের বিভিন্ন ‘অ্যাকশন’ বা ক্রিয়ার মধ্যে কোনোভাবে প্রকাশিত হবেই। কোনও পরিস্থিতি, কোনও মানবিক ক্রিয়াই ‘অপ্রয়োজনীয়’ বা ‘উচ্ছিষ্ট’ হয়ে থাকে না। বরং অপেক্ষা করে প্রকাশমাধ্যমের। কোন্ ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি এবং ক্রিয়া ফ্যাসিবাদ তার নিজের কাঠামোয় ধারণ করে সে বিষয়ে আলোচনার সূত্রে ১৯৩৫-এর তৃতীয় আন্তর্জাতিকে প্রকাশিত দিমিত্রভের রিপোর্টের এই অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ — ‘What is the source of the influence of fascism over the masses? Fascism is able to attract the masses because it demagogically appeals to their most urgent needs and demands. Fascism not only inflames prejudices that are deeply ingrained in the masses, but also plays on the better sentiments of the masses, on their sense of justice and sometimes even on their revolutionary traditions.’ এক্ষেত্রে আমরা ‘inflames prejudices that are deeply ingrained in the masses’ অংশে আমাদের আলোচনা কেন্দ্রীভূত করব। কুসংস্কার আসে সংস্কারের অংশ হিসেবে। সংস্কার আসে সংস্কৃতি থেকে। কোনও নির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক চেতনার ক্রমবিকাশের স্তরের উপর ভিত্তি করে সংস্কৃতি (বা সংস্কার) ‘সু’ বা ‘কু’ রূপ নেয়। ঘৃণা কেন মানুষকে আত্মবিশ্বাসের জোগান দেয়? আসলে পৃথিবীর প্রতিটা সংস্কৃতিরই একটি অংশ ধীরে ধীরে মানবিকতায় উন্নীত হয় এবং আরেকটি অংশ ক্রমে ঘৃণ্য, অমানবিক, ভায়োলেন্ট দমনমূলক কাঠামো তৈরি করে। মার্কসবাদী দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আইজাজ আহমেদের একটি কথা এই প্রসঙ্গের সারসংক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে — ‘Every country gets the fascism it deserves’ অর্থাৎ প্রতিটি দেশে সেই দেশের সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা এবং সেই দেশের দমনমূলক সাংস্কৃতিক উপাদান অনুসারে ফ্যাসিবাদী চেতনা বিস্তার লাভ করে। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত রূপ নাৎসিবাদ উত্থানের ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে জার্মানিসহ পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ভীষণভাবে প্রকট ‘বর্ণবাদ’ (racism)। ভারতবর্ষে ‘ফ্যাসিস্টিক’ শক্তির উত্থানের ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে আমাদের দমনমূলক পরিবারতন্ত্র, ভায়োলেন্ট ঘৃণায় জারিত ‘জাতিভেদ প্রথা’ (caste system), ধর্মীয় মেরুকরণ (religious polarisation)। সরল সমানুপাতিক অনুমান নয়, আমাদের বুঝতে হবে এই ‘পরিবারের হায়ারার্কি, পারিবারিক কর্তৃত্ববাদ’, জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কাঠামোয় অবস্থিত ‘নিষ্ঠুরতার সংস্কৃতি’ (culture of cruelty or violence)। শ্রেণিশোষণ, লিঙ্গবৈষম্যের কাঠামোর একেবারে কেন্দ্রে যে মানসিক এবং বাহ্যিক নিপীড়নের সূত্র জুড়ে আছে, সেই ‘সাংস্কৃতিক অভ্যেসগুচ্ছ’ আমাদের টেনে নিয়ে যায় ফ্যাসিবাদী সংগঠিত ঘৃণার অভিমুখে। এই ঘৃণার উত্তরাধিকারী আমরা বুঝে বা না বুঝে অথবা অভ্যেসমতো ঘৃণা-সংস্কৃতির বিষবৃক্ষে পুষ্টি যোগাতে থাকি। এই ঘৃণা যখন আত্মবিশ্বাসে রূপ নেয়, তখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে আমাদের বর্ণবাদী, জাতিবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, লিঙ্গবিভেদ, যৌনবিভেদের সত্তা। বেরিয়ে আসে ‘ফ্যাসিস্টিক’ উন্মত্ততা। এইখানে আমরা ফিরে আসব পূর্বে উল্লিখিত প্রশ্নে — ঘৃণা কেন মানুষকে আত্মবিশ্বাসের জোগান দেয়? আসলে ঘৃণার সাংস্কৃতিক কাঠামো মানুষকে এক লুপের মধ্যে নিয়ে চলে। একসময় পারিবারিক কর্তৃত্বের কাছে অবদমিত সত্তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণ করতে না পেয়ে প্রতিশোধস্পৃহায় ভোগে। স্কুলে কলেজে ‘বুলিড’ বা ‘র‍্যাগড’ শিশুমনে তৈরি হয় ঘৃণার চক্র। সামাজিক অসাম্যে জর্জরিত মনন আত্মবিশ্বাস হারায়। কিন্তু তখন অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে ঘৃণার শিকড়। হীনম্মন্যতায় ভোগা, অ্যালিয়েনেটেড মনন প্রতিহিংসা লালন পালন করে চলে নিভৃতে। সামাজিক, অর্থনৈতিক স্থিতিহীনতা সংগঠিত ঘৃণার সংঘে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। দলে দলে আমজনতা যোগ দেয় জার্মানির ঘোষিত নব্য-নাৎসি গোষ্ঠী এএফডি-র মিছিলে, ফ্রান্সে ভয়ংকর জাতিবিদ্বেষী দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল র‍্যালির (Rassemblement National) মারিন ল পেন রাষ্ট্রপতির দৌড়ে কাছাকাছি উঠে আসতে থাকে। ভারতবর্ষে ‘ফ্যাসিস্টিক’ আরএসএস, বিজেপি এবং বিভিন্ন সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সংগঠনের প্ররোচনায় দাঙ্গা লাগে রোজ। দেশের ‘তথ্য-সম্প্রচার’ মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর প্রকাশ্য জনসভা থেকে ফ্যাসিস্ট বার্তা ‘সম্প্রচারণে’ প্ররোচিত করেন — ‘গোলি মারো শালো কো’। সভায় হাততালি পড়ে। রাস্তাঘাটে হাততালি পড়ে। টিভিতে বাজারি মিডিয়ার নিরন্তর সম্প্রচারে হাততালি দেয় ঘরে বসা একলা মানুষ। একলা, অসহায় মানুষ। একলা ক্লান্ত মানুষ। ঘৃণার সংস্কৃতির চোরা স্রোতে আজীবন ভেসে চলা একলা মানুষ। সংগঠিত প্রোপাগান্ডা বনাম একলা মানুষ। জঁ পল সার্ত্রের ‘Critique de la Raison Dialectique’-এ বর্ণিত ‘সিরিয়ালিটি’-র কবলে একলা মানুষ। বাইরে ফ্যাসিবাদী চেতনা। ঘরের ভিতরে একলা মানুষ। বিদ্বেষের আগ্নেয়গিরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একলা মানুষ। একেকটা গুমড়ে থাকা ভিসুভিয়াস।                                   

(৬) জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন দিক

জাতীয়তাবাদের বিপন্নতার দিকগুলি নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। চার ধরনের জাতীয়তাবাদ নিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।   

প্রথমত, (ক) এথনিক ন্যাশনালিজম বা ‘জাতিগত’ জাতীয়তাবাদ — জাতিগত প্রশ্নে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী সত্তা। এই জাতীয়তাবাদ জাতি প্রশ্নে এক্সক্লুসিভ এবং বৈষম্যমূলক। কোনও একটি, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত সত্তাকে নেশন বা রাষ্ট্রের সত্তা হিসেবে নির্মাণ করে। স্বাভাবিকভাবেই এই জাতীয়তাবাদের মূলে সংঘাতের বীজ অবস্থান করছে। কোনও এক জাতির শ্রেষ্ঠতা, অপর জাতির নিকৃষ্টতা নির্মাণের সম্ভাবনা বহন করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নাৎসি জার্মানির ‘উনথারমেনশেন (subhumans)’ ধারণার উৎপত্তি। 

দ্বিতীয়ত, (খ) ধর্মীয় ন্যাশনালিজম — অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদী বা উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা কোনও বিশেষ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে কোনও এক জাতির শ্রেষ্ঠত্বের সাথে জুড়ে থাকে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের সূত্র। ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের জঠরেই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বেড়ে ওঠে। এই ধর্মীয় বৈষম্যের চিত্র ফ্যাসিবাদের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ফুটে ওঠে। নাৎসি জার্মানির উত্থানের বিভিন্ন পর্বে ক্যাথলিক চার্চের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ‘পাশে থাকার’ ঘটনা উঠে আসবে। সাধারণ জনগণের ‘ইহুদি-ফোবিয়া’-র একটা বড়ো কারণ হিসেবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সম্প্রসারণ, যা জাতিগত বৈরিতাকে প্রশ্রয় দেয়। যদিও চার্চের অনেক পাদরি হিটলারের নিধনযজ্ঞের বিরোধিতা করেছিলেন, এক বড়ো অংশের ক্যাথলিক পাদরিদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমর্থনের পিছনে ছিল ক্রুসেডের হিসেবেনিকেশ। নাৎসি আমলে পূর্ব-ইউরোপে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণার কারণ হিসেবে অনেকক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট, অ্যান্টি-ক্রাইস্ট এবং ইহুদি পরিচিতিকে (রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং জাতিগত পরিচিতি) এক ব্র্যাকেটে রাখা হত। সেই সময় রোমানিয়া এবং অন্যান্য দেশে ‘জুডা-বলশেভিজম’-এর নির্মাণ আমাদের মনে পড়বে। 

তৃতীয়ত, (গ) বৈজ্ঞানিক ন্যাশনালিজম — বিজ্ঞানকে ভেঙেচুরে, অপব্যাখ্যায় পুষ্ট করে পূর্বে উল্লিখিত জাতিগত ন্যশনালিজমের ভিত্তি, বৈধতা স্থাপন। ঐতিহাসিক জর্জ মসের গবেষণায় উঠে এসেছে বিজ্ঞানের এই অপব্যাখ্যার নির্মাণ। অজস্র পশ্চিমি জাতিবিদ্বেষী ধারণার সাথে অপব্যাখ্যায়িত ডারউইনিজম, দেহতত্ত্ব, প্রজননবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে বৈষম্যের রাষ্ট্রীয় পলিসিকে মান্যতা, বৈধতা দেওয়া হয়। নাৎসি জার্মানিতে চিকিৎসক, প্রাণীবিজ্ঞানীদের এই প্রবণতা জেনোসাইডের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে [‘জাতিগত শুদ্ধিকরণের’ (racial purification) তাগিদে নাৎসি জার্মানিতে ‘অপ্রয়োজনীয়’ জাতিগোষ্ঠীর বন্ধ্যাত্বকরণ, কেমিক্যাল প্রয়োগ করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মানুষ মেরে ‘বৈজ্ঞানিক, দেহতাত্ত্বিক স্টাডি’-র কথা স্মরণে আসবে]। 

চতুর্থত, (ঘ) ইকোনমিক ন্যাশনালিজম — জাতিগত বিরোধ এবং তার উৎস হিসেবে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের ধারণা অপেক্ষাকৃত নতুন। তার একটি কারণ অবশ্যই আধুনিক কালে পুঁজিবাদের নতুন নতুন ফর্মে আবির্ভাব এবং ক্রমবিকাশ। এই কারণ তাই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে হালফিলের আমলে ফ্যাসিবাদী ঝোঁক বা ফ্যাসিস্টিক রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মুক্ত বাজার অর্থনীতির (Free market economy) বাড়বাড়ন্তের সাথে তার সামাজিক অভিঘাতের কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দাপট বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের মূলগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে। বিশেষত অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশে বা নব্য গণতান্ত্রিক দেশে মুক্ত বাজার অর্থনীতির বুলডোজার অর্থনৈতিক পরিসরে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মে ‘winners’ (‘হ্যাভস’) এবং ‘losers’ (‘হ্যাভ-নটস’) তৈরি করে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশেষ জাতিগত সত্তাজনিত বৈষম্যের সাথে পরস্পর সম্পর্কিত হলে পরবর্তীক্ষেত্রে জাতিগত বিদ্বেষের রূপ নেয়। 

জাতীয়তাবাদের এই অন্ধকার দিকগুলির প্রত্যেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত জাতি, ধর্ম বা অন্যান্য কারণজনিত কর্তৃত্ব এবং আধিপত্য। ফ্যাসিবাদের পরিস্ফুরণের জন্য এই এক্সক্লুসিভ জাতীয়তাবাদের ভূমিকা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(৭) “জাতীয়তাবাদী গুটিপোকা থেকে সাম্রাজ্যবাদী প্রজাপতি” এবং ‘রাষ্ট্র শুকিয়ে মরছে না’ (আপাতত)  

এখন অবধি ফ্যাসিবাদ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত যে ধারণা গুলি উঠে আসছে সেগুলিকে সংক্ষিপ্তভাবে একসাথে সাজানো যাক — ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি, হিটলিস্ট, ফ্যাসিবাদী গণমাধ্যমের ভূমিকা, ফ্যাসিবাদের অ্যান্টি থিওরি আইডিওলজিকাল ম্যাট্রিক্স, বিভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদ এবং তার এক্সক্লুসিভিটি, তার অন্ধকার দিকগুলি, ফ্যসিবাদের প্রভাব বিস্তারে পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের গুরুত্ব এবং ফ্যাসিবাদ উদ্ভবের বিভিন্ন জাতিগত বৈচিত্র্যময় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উপাদান। এখন এই ফ্যাসিবাদ-সহায়ক উপাদানসমূহ তখনই জনগণমতের সম্মতি উৎপাদনে সক্ষম হয় যখন এই ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ধারণার এক আধিপত্য সৃষ্টি হয়। আনতোনিও গ্রামশি-র ‘হেজিমনি’-র কনসেপ্ট এক্ষেত্রে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে। আগে আমরা বোঝার চেষ্টা করব এই অজস্র ফ্যাসিবাদী উপাদান কোন্ ছাঁচ বা স্ট্রাকচারের মধ্যে নিহিত। অর্থাৎ এই ফ্যাসিবাদী এলিমেন্টগুলো নিজেদের মেলে ধরার জন্য কোন্ প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় নেয়? ফিরে যাব ফ্যাসিবাদের সামাজিক এলিমেন্টের একটি মূল প্রেক্ষিতে। বিভিন্ন সমাজের বিদ্বেষের, ঘৃণার সংস্কৃতির বিশিষ্টতা আঁকড়ে বেড়ে ওঠে ‘ফ্যাসিস্টিক’ প্রবণতা। পরিবারতন্ত্র, পুরুষতন্ত্রের হাত ধরে হাঁটতে শেখে বিভিন্ন সামাজিক অপরায়ণ, অবদমন, মনোজগৎ এবং বহির্জগতের উপর কর্তৃত্বের আধিপত্য, ভায়োলেন্স। একটি সাধারণ ঐতিহ্যবাহী পরিবারকে ধরা যেতে পারে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবচেয়ে ছোটো ইউনিট হিসেবে যেখানে একটি যথার্থ হায়ারার্কি, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং যা একটি শিশুর ‘শৃঙ্খলা’ (discipline) শেখার প্রথম পাঠ। শিশু এবার যাবে বিদ্যালয়ে, স্কুলে। সেখানে তার সাথে আর-একবার দেখা হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুরূপ ছোটো আর-একটি কাঠামোর সাথে। এই স্ট্রাকচারেও আছেন প্রধান শিক্ষক (রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী), সহ প্রধান শিক্ষক (মুখ্যমন্ত্রী), শ্রেণি-শিক্ষক (এম পি/ এম এল এ), ক্লাস-মনিটর (কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত প্রধান), সহপাঠী (সহনাগরিক)। সহপাঠীরা উঠে আসছে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবেশ থেকে। ছাত্র পুনরায় শিখছে ডিসিপ্লিন, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলার কোর্স-ওয়ার্ক। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন, কৌতূহলের উদ্রেক হলেও পাঠক্রমের (এক্তিয়ার) বাইরে প্রশ্ন করাকে সাধারণভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ বড়োই কম। এর পরেই তার সাথে দেখা হয় রাষ্ট্রের। ১৮ বছর বয়স। রাষ্ট্র পরিচালকদের নির্বাচিত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এদিকে এই মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে অ্যালিয়েনেটেড হতে শুরু করেছে। এখন রাষ্ট্রের সংজ্ঞার দিকে নজর দেব আমরা। লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বলছে, ‘রাষ্ট্র হল শ্রেণি-বিরোধের অমীমাংসেয়তার ফল’। মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গিতে, ‘রাষ্ট্র হল শ্রেণি-আধিপত্যের সংস্থা, এক শ্রেণি (শাসক) কর্তৃক অপর শ্রেণিকে (শাসিত) পীড়নের সংস্থা, রাষ্ট্র হল এমন ‘শৃঙ্খলার’ প্রতিষ্ঠা, যাতে শ্রেণি-সংঘাত নরম করে এই পীড়নকে বিধিবদ্ধ ও কায়েম করে।’ কেন এরকম বলা হচ্ছে? আসলে রাষ্ট্র হল সমাজ থেকে উদ্ভূত অথচ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, সমাজ থেকে দূরে উচ্চআসনে আসীন, হায়ারার্কিয়ালি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান যা আবার যে সমাজ থেকে উদ্ভূত সেই সমাজ নিয়ন্ত্রণেই ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন-আদালত, সৈন্যবাহিনী, পুলিশ-প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজই হল সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই ‘নিয়ন্ত্রণের’ পাঠ সেই পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেরিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যেও বর্তমান। রাষ্ট্রের স্বকীয় চরিত্রই হল এই নিয়ন্ত্রণে শামিল হওয়া। অর্থাৎ রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কাঠামোয় নিহিত থাকে নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, হায়ারার্কি, কর্তৃত্ব। পাঠককে মনে রাখতে হবে এখানে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো নিয়ে আলোচনার সূত্রে নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা শব্দগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের কাঠামোয় অবস্থিত একটি ধ্রুবক, তা ‘ন্যায্য নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘অন্যায্য নিয়ন্ত্রণ’ যাই হোক না কেন।  

ফ্যাসিবাদ এবং জাতীয়তাবাদের যোগাযোগের সূত্রে রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছ? দুটি পয়েন্ট মনে রাখব আমরা। শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্র। এবার উপরের বিভাগগুলিতে উঠে আসা সমস্ত আলোচনার নির্যাস থেকে উদ্ভূত ফ্যাসিবাদের গঠনগত বিন্যাস এবং কর্মপদ্ধতি সহজ ভাবে নীচের স্কিম্যাটিক থেকে বুঝে নেব।  

ডায়াগ্রামের বাম দিকে ‘বিভেদ/ঘৃণার সংস্কৃতি’ থেকে তৈরি অসাম্য, অসাম্য থেকে শ্রেণি-সংঘাত। শ্রেণি-সংঘাত নিরসন করতে না পারার অনিবার্যতায় রাষ্ট্রের আবির্ভাব। এরপর রাষ্ট্রের স্বকীয় চরিত্র অনুযায়ী সে একাধিপত্য বা হেজিমনি তৈরি করে। এখন এই হেজিমনি কেবলমাত্র দমনমূলক নয় (গ্রামসি, ‘প্রিসন নোটবুকস’, ১৯২৬-৩৭)। রাষ্ট্রের হেজিমনির একটি অংশ নাগরিক সমাজের বা সিভিল সোস্যাইটির উপর মতাদর্শ বা সাংস্কৃতিক হেজিমনি তৈরি করে যার মাধ্যম মিডিয়া এবং চলচ্চিত্রের মতো সাংস্কৃতিক যন্ত্র, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অযৌক্তিক, অপব্যাখ্যায়িত প্রয়োগ। রাষ্ট্র হেজিমনির আর-একটি অংশ রাজনৈতিক সমাজ বা পলিটিক্যাল সোস্যাইটির উপর হেজিমনি তৈরি করে। এই অংশের উপর আধিপত্যের জন্য প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সহিংস দমনপীড়ন পদ্ধতির। এই দুই ধরনের হেজিমনির সাথেই এক্সক্লুসিভিটি জড়িত। উদাহরণস্বরূপ ভাবা যেতে পারে, নাৎসি জার্মানির বিজ্ঞানীদের ‘থিওরি অফ পিওর রেস’-এর অনুশীলন, গোয়েবলসের নেতৃত্বে মিডিয়ার জাতিবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা নাগরিক সমাজের মধ্যে রাষ্ট্রের জাতিবিদ্বেষী হেজিমনি তৈরি করে আবার রাজনৈতিক সমাজে বিরোধীদের সরাসরি খুন, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের একাধিপত্য রচনা করা হয়। এই দুই প্রক্রিয়া থেকে শত্রু নির্বাচিত হয়ে উঠে আসে ইহুদি, কমিউনিস্ট, জিপসি, স্লাভিক, সমকামী, জিপসি, মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষেরা। অর্থাৎ এই দুই ধরনের হেজিমনির সাথে শত্রু নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। একদিকে শত্রুপক্ষ একদিকে সংগঠিত রাষ্ট্রের হেজিমনি। তৈরি হচ্ছে এক্সক্লুসিভ উগ্র জাতীয়তাবাদ। এই পর্যায়ে এক বড়ো অংশের মানুষের সম্মতি উৎপাদনের (manufacturing consent) কাজ সম্পন্ন হতে থাকে। রাষ্ট্রের দমনমূলক শোষণযন্ত্র এবং হেজিমনিগত সম্মতি উৎপাদনের পরবর্তী পর্যায়ে তৈরি হয় ফ্যাসিজম যা কখনও আরও চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়ে নাৎসিবাদে পৌঁছাতে পারে। আধুনিক লগ্নি-পুঁজি, বিশ্বায়ন, নিত্যনতুন পুঁজিবাদী অ্যাপারেটাসের যুগে বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং ‘ফ্যাসিস্টিক রাষ্ট্রের’ সহাবস্থান সম্ভব। এখন এই ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র’ পুনরায় স্টেট-হেজিমনি বা রাষ্ট্রের একাধিপত্যের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ধরে রাখে। ফলে ডায়াগ্রামের বর্ণনা অনুযায়ী ফ্যাসিবাদী কাঠামো একটা লুপ সৃষ্টি করে। বলাই বাহুল্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ডায়াগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে ছায়ার মতো পুঁজিবাদের সজীব উপস্থিতি। একদম ডায়াগ্রামের শুরুর বিভেদের মধ্যে নিহিত থাকে শতাব্দীপ্রাচীন শ্রেণিশোষণ। সেই শ্রেণিসংঘাতের দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের হেজিমনির প্রতি স্তরে পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা বা নিপীড়নের পদ্ধতি, দুই ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদের বিকল্প নেই। উদাহরণস্বরূপ, নাৎসি জার্মানির গোয়েবলস নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এবং অস্ত্র শিল্পের মালিক হের ক্রুপ ভন বহ্লেনের সাথে নাৎসি সরকারের সখ্যতার কথা আমাদের মনে পড়বে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিজমকে এভাবেই আগলে রাখে পুঁজিবাদ।                      

পূর্বে উল্লেখিত শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্র এই দুটি পয়েন্ট বোঝার জন্য দুটি উদাহরণ রাখা যেতে পারে। 

পয়েন্ট ১ (শৃঙ্খলা) — জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার উত্থান প্রসঙ্গে ‘শৃঙ্খলা’-র ভূমিকা নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিক মাক্স হর্কহাইমারের বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশ্যে ইহুদিনিধনের বিপরীতে সাধারণ জার্মানবাসীর নীরবতার পিছনে হর্কহাইমার দায়ী করেছেন জার্মান জাতির মধ্যে শৃঙ্খলা এবং কর্তৃত্বকামী সংস্কৃতির উপস্থিতি। ফরাসি সমাজের সঙ্গে তুলনা টেনে হর্কহাইমার ব্যাখ্যা করেন যে ফরাসি জাতি জাতিগতভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ম এবং শৃঙ্খলার বিরোধী। ইউরোপের বিপ্লবের বেশিরভাগই ঘটেছে ফ্রান্সে এবং এর জন্য ফরাসি নিয়ন্ত্রণবিরোধী সংস্কৃতি অনেকাংশে দায়ী। অন্যদিকে জার্মান জাতি সংস্কৃতিগতভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং একটি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রিকতার ঐতিহ্যে অভ্যস্ত জার্মান জাতির মধ্যে তাই অপেক্ষাকৃত বাধাহীনভাবে ফ্যাসিজম বিস্তার ঘটায়।          

পয়েন্ট ২ (রাষ্ট্র) — রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন অস্বস্তিকর ভাবে উঠে আসে পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে। একদা নাৎসি নির্মমতার শিকার ইহুদি জাতির পৃথক ‘ন্যাশনাল হোম’ নির্ধারিত হয় পশ্চিম এশিয়ার প্যালেস্তাইনে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ স্বাধীন আরব এবং ইহুদি দুটি রাষ্ট্রের সুপারিশ করে। ক্রমে ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল রাষ্ট্রশক্তির মেশিনারি বলে ক্রমাগত দখল করতে থাকে প্যালেস্তাইনের ভূ-খণ্ড। ‘অসলো চুক্তি’ (‘Oslo Accords’) অনুযায়ী ওয়েস্ট ব্যাংক এবং গাজা স্ট্রিপ প্যালেস্তাইনের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়লেও ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় মেশিনারি এবং পশ্চিমি কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবাদে জাতিসংঘের চুক্তি লঙ্ঘন করে দখলদারি রাষ্ট্রের রূপ নিয়েছে ক্রমশ। আজ, যখন এই প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে (১৯শে এপ্রিল, ২০২২), গাজার দক্ষিণ প্রান্তের শহর খান ইউনিসে তখন ইজরায়েলি এয়ার-স্ট্রাইক এবং বম্বিং চলছে অবিরাম। 

অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যেই নিহিত থাকে জাতীয়তাবাদের কিছু অন্ধকার দিক। আর সেই ‘জাতীয়তাবাদী গুটিপোকা থেকেই সাম্র্যাজ্যবাদী প্রজাপতি’ জন্ম নেয়। পরিবারের ‘কর্তৃত্বের সংস্কৃতির’ বৃহত্তর রূপ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের মধ্যে নিহিত থাকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের বীজ। বিশ্বায়ন এবং পুঁজিবাদী আগ্রাসী বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ‘রাষ্ট্র’-কেও ‘দুর্বল’ করার সুযোগ সীমিত। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের বর্তমান পর্যায়ে শ্রেণিসংঘাত আপাতত মিটছে না, রাষ্ট্র তাই শুকিয়ে মরছে না (‘ক্রম-অবলুপ্তি’) আপাতত। উপায় কী? রাষ্ট্র মেরামত? রাষ্ট্রের মধ্যে ইনক্লুভিসিটি বাড়ানো? ‘রাষ্ট্র’-কে ‘সমাজ’ হিসেবে গড়ে তোলা?   

(৮) “কী করিতে হইবে? হোয়্যাট ইজ টু বি ডান?”  

প্রথমেই আমাদের বুঝে নিতে হবে আধুনিক ফ্যাসিস্টিক শক্তির বৈশিষ্ট্য। নাৎসি জার্মানিতে জেনোসাইডের আগে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তখনও ফিন্যান্স পুঁজিকে পাশে পেয়েছিল নাৎসি শাসন। কিন্তু উত্তর-আধুনিক, বিশ্বায়ন-উত্তর, নব্য-উদারপন্থী পুঁজিবাদ আরও বেশি বিমূর্ত, আরও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল। আমাদের মনে রাখতে হবে কর্পোরেট পুঁজিবাদের সঙ্গে ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিস্টিক শক্তির কোনও মৌলিক সংঘাত বা দ্বন্দ্ব নেই। নব্য উদারবাদ আসলে একচেটিয়া বিলিয়নেয়ার বানানোর যন্ত্র। এই বিলিয়নেয়ারদের হাতেই থাকবে খনিজ সম্পদ, বন্দর, বিমান, টেলিকম, যুদ্ধসামগ্রী, প্রতিরক্ষার সামগ্রী, আধুনিক প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়ার শেয়ার ইত্যাদি। বিলিয়নেয়ারের চাই উপভোক্তা, কনজিউমার। ক্রেতার মস্তিষ্ক থেকে ক্রেতার পুঁজিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার একচ্ছত্র দখলদারি। আমাদের বুঝতে হবে এই পুঁজির কোনও ‘নৈতিক’ চরিত্র হয় না। পুঁজিবাদের নৈতিক অবস্থানই হল মুনাফার পাহাড় তৈরি করা। এই কর্পোরেট পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একটি জাতিবিদ্বেষী দাঙ্গা এবং তার ফলে কিছু অঞ্চলের ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীদের দোকানপাট লুঠ বা আগুন লাগানোর ঘটনা কর্পোরেট পুঁজির কোনও ব্যবসায়িক বিঘ্ন ঘটায় না। অথচ জাতিবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য প্রযুক্তি, মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেটের ব্যবহার, দক্ষিণপন্থী প্রোপাগান্ডার চলচ্চিত্র প্রযোজনা সব কিছুর সাথে জড়িয়ে থাকে মুনাফা। ‘মানবিক’ দায়ভারমুক্ত একরোখা কর্পোরেট পুঁজি তাই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সাথে সাযুজ্য রেখেই করে চলে নতুন পরিচিতি নির্মাণ যা রূপ নেয় পরিচিতিজনিত বিদ্বেষে। কর্পোরেট-পুঁজিবাদী-সর্বস্ব গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিভিন্ন উপকরণগুলি ব্যবহার করেই আধিপত্য তৈরি করতে পারে ‘ফ্যাসিস্টিক’ শক্তি। তাহলে ‘কী করিতে হইবে?’       

পয়েন্ট ১ — theory, practice, organization ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, ফ্যাসিস্টিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে চাই কাউন্টার কালচার। ফ্যাসিস্ট হেজিমনির প্রতিরোধে চাই কাউন্টার হেজিমনি। ফ্যাসিবাদী প্রবণতার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের  দ্বৈত-আধিপত্য ভাঙতে চাই  দ্বিমুখী কর্মসূচি। একদিকে গড়তে হবে কাউন্টার ন্যারেটিভ অন্যদিকে দখল নিতে হবে রাস্তার। একদিকে বিজ্ঞান, যুক্তিবাদের বীজ রোপণ আরেকদিকে ফ্যাসিবাদের, উগ্র জাতীয়তাবাদের, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিকল্প নির্মাণের লড়াই। ছোটো ছোটো এলাকায় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে হবে। তৈরি করতে হবে ছোটো ছোটো সোভিয়েত। ছোটো ছোটো কমিউনে জুড়তে হবে মানুষকে। একলা মানুষকে পৌঁছে দিতে হবে বিকল্প ভাবনা। একলা মানুষকে সংঘবদ্ধ ফ্যাসিবাদী সিরিয়ালিটির বিপরীতে পালটা জুড়তে হবে শ্রেণিচেতনার আঙ্গিকে। বিকল্প নির্মাণের থিওরি শুরু করতে হবে সামাজিক বৈষম্যের গভীরে, সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা অনুযায়ী। তথ্য-প্রযুক্তির নান্দনিকতা ব্যবহার পৌঁছে যেতে হবে গৃহকোণে। ধর্মীয়, জাতিগত পরিচিতি সত্তায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু শ্রেণিচেতনা জাগিয়ে তুলতে চাই শক্তিশালী সংগঠন। সেই সংগঠনের সঙ্গে জুড়ে থাকুক অজস্র স্থানীয় সংগঠন। শ্রেণিচেতনায় উদ্বুদ্ধ ছোটো ছোটো অজস্র স্থানীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনই থিওরি ও প্র্যাকটিসের মাঝের সেতুবন্ধন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে আরও ছড়িয়ে পড়ুক সংগঠিত হবার খিদে।

পয়েন্ট ২ — স্পর্ধা ও প্রতিরোধ — আমরা বউম গ্রুপের কথা মনে করব। ১৯৪০-৪২। সর্বত্র নাৎসি জার্মানির গেস্টাপো এবং এসএস বাহিনীর নির্মম, পাশবিক রাজনৈতিক অবদমন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। তার মধ্যেই নাৎসি বিরোধী প্রচার চলছে বিভিন্ন লিফলেট, প্যাম্ফলেট গোপনে টাইপ করে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে। ছোটো ছোটো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কর্মসূচী নিচ্ছে এই কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি। ১৮ মে, ১৯৪২। জার্মান মিনিস্টার অফ প্রোপাগান্ডার পক্ষ থেকে একটি সোভিয়েত-বিরোধী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় বার্লিনে। প্রদর্শনী চলাকালীন বউম গ্রুপের সদস্যরা প্রদর্শনীতে প্রবেশ করে। একাধিক প্রদর্শিত ছবিতে আগুন জ্বলে। প্রতিরোধের আগুন। স্পর্ধার আগুন।           

পয়েন্ট ৩ — Be tough, tough, tough! 

নাৎসি বিরোধী কমিউনিস্ট বিপ্লবী ওয়াল্টার হুস্ম্যান নাৎসি বাহিনীর হাতে খুন হবার আগে তাঁর বাবা কে শেষ চিঠি লেখেন। 

“Be Strong! I am dying as I lived; as a fighter in the class war! It is easy to call yourself a communist as long as you don’t have to shed blood for it……

We are merely the fertilizer which has to be in the earth for a new and finer seed to grow for the shake of humanity…….. 

Be tough, tough, tough!”

আমরা মনে রাখব ‘বি টাফ, টাফ, টাফ’। 

(৯) স্টেরয়েড এবং প্রত্যাঘাত  

এক্সক্লুসিভ জাতীয়তাবাদকে বানাতে হবে ইনক্লুসিভ। বহুমাত্রিকতায়, সংহতিতে সেই ইনক্লুসিভ জাতীয়তার দোসর হবে আন্তর্জাতিকতা। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মানবিকতার বিভাজনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক সংহতি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংহতি তৈরি বা আন্তর্জাতিক ধনসম্পদের বৈষম্য মেটানোর প্রশ্নে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ কোনোভাবেই মৈত্রী চুক্তি করবে না। পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, ফ্যাসিবাদী গঠনতন্ত্রের নিজস্ব দ্বন্দ্বের জন্যই করতে পারবে না। তাই নিরন্তর লড়াই। অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই।  মানুষকে সঙ্গে নিয়েই সেই লড়াই। মানুষকে সঙ্গে পেতে তার দৈনন্দিন যন্ত্রণার লড়াইয়ে পাশে থাকা। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক জড়তার বিরুদ্ধে লড়াই। খুব কঠিন লড়াই। কিন্তু অসম্ভব নয়।   

Fascism is on steroid. Nationalism is on steroid. এই steroid-এর বিরুদ্ধেই মিছিল। মিছিলের মানববন্ধন। ভালবাসার বিকল্পভাষ্য। জুড়ে থাকার জঙ্গি মেজাজ। আমরা তারকভ্স্কির ছোট্ট ইভানের কথা মনে করব। মনে করব স্পার্টাকাস লিগের রুখে দাঁড়ানোর জেদ। জেনোসাইড জুড়ে দেয় প্রবণতা। জুড়ে দেয় ভিক্টিমহুড। অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি-তে লেগে থাকা রক্ত গড়িয়ে এসে পড়ে আখলাকের ফ্রিজে। ইতিহাস মিলিয়ে দেয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিবর্তন। ইয়াস পগ্রমের বর্বরতার ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি ঘটে দিল্লিতে। ১৯৩৫-এর ন্যুরেমবার্গ আইনের রাইখ সিটিজেনশিপ আইনের সামান্য অন্য গড়নে পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৯-এর ভারতবর্ষে, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের চোখরাঙানিতে। এএফডির ‘জার্মান ফর জার্মানস’ অভিবাসী-বিরোধী স্লোগান ডয়েশল্যান্ডে ফিরিয়ে আনে নাৎসি হিংস্রতা। ধর্ম-রাষ্ট্র জুড়ে গিয়ে মৌলবাদী আগ্রাসনে খুন হন বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগার, ভারতবর্ষের মুক্তমনা চিন্তক নরেন্দ্র দাভোলকর, এম এম কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ-রা। আবার একই ইতিহাসে থাকে উন্মত্ত ঘৃণার-রাজনীতি জারিত নাৎসি দখলদারিদের বুক কাঁপানো রেড আর্মির প্রত্যাঘাত। স্তালিনগ্রাদের স্পর্ধিত কাউন্টারস্ট্রাইক। শাহিন বাগের নাছোড়বান্দা জেদ। বার্লিনের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রচারিত কেপিডির প্যাম্ফলেট, লিফলেটে লেগে থাকা রোজা লুক্সেমবুর্গের স্বপ্ন। সেই সময় আর এই সময়। সময় একমুখী। কিন্তু ইতিহাসে বারবার ফিরে আসে ‘সময়’। মহাফেজখানায় জমে থাকা ইতিহাসের পাতা উলটে আজ আরেকবার শপথ নেব আমরা। 

            “অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর                                                                                                    
             কঠিন পাথরের মতো, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।                                                                             
             মাথার উপর একটা ভয়ঙ্কর কালো আকাশ                                                                                            
             এখনো বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।                                                                                                         
             তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও                                                                                          
             আর আকাশের ভয়ংকরকে শান্ত গলায় এই কথাটি জানিয়ে দাও                                                                    
                      তুমি ভয় পাওনি। 
                মাটি তো আগুনের মতো হবেই                                                                                                                   
                যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো                                                                                                      
                যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও                                                                                                 
                তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি”। 

এখনই প্রতিরোধের সময়। বারুদ, বিষবাষ্পে ঝাপসা হয়ে আসা ক্যানভাসে ফুল ফোটানোর সময়। শীতের ঝরে যাওয়া, অবক্ষয়িত, সজীর্ণ কাঠামোয় বসন্ত আনার সময়। একটু পা চালিয়ে কমরেড!

তথ্যসূত্র : 

১) সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ফ্যাসিজম’, কলকাতা, ছাড়পত্র প্রকাশন, ISBN: 978-81-938609-4-6

২) Giovanni Sale (2009), ‘Le leggi razziali in Italia e il Vaticano’, Editoriale Jaca Book. p. 72. ISBN 9788816409071

৩) Ina R. Friedman (1990), ‘The other victims’, Houghton Mifflin company Boston  

৪) Frank McDonough (2001), ‘Opposition and resistance in Nazi Germany’, Cambridge University Press, ISBN-13 978-0-521-00358-2

৫) The Weiner holocaust Library-www.theholocaustexplained.org

৬) Edited by Jeremy Noakes, ‘NAZISM 1919-1945’ : A documentary Reader, Volume 4

৭) Nehru Memorial Museum and Library (NMML), Moonje papers, microfilm, rn 1

৮) Marzia Casolari (2000), ‘Hindutva’s Foreign Tie-up in the 1930s Archival Evidence’, Economic and Political Weekly, January 22, 2000

৯) MSA, Home Special Department, 60 D(g) Pt III, 1938, ‘Translation of the verbatim speech made by V D Savarkar at Malegaon on October 14, 1938’

১০) Patrick Merziger et al., ‘Crises, Rise of Fascism and the Establishment of Authoritarian Media Systems’, The Handbook of European Communication History, First Edition. Edited by Klaus Arnold, Paschal Preston, and Susanne Kinnebrock. Published 2020 by John Wiley & Sons, Inc

১১) Maria Stone (1999) : ‘Challenging cultural categories : The transformation of the Venice Biennale under Fascism’, Journal of Modern Italian Studies, 4:2, 184-208

১২) R. Palme Dutt (1974), ‘Fascism and Social revolution’, Proletarian Publishers Edition 1974, Protetarian publishers P.O. Box 3566, Chicago IL 60654

১৩) Federico Finchelstein (2008), ‘On Fascist Ideology’, Constellations Volume 15, (3)

১৪) F. T. Marinetti (1909), ‘Manifeste du futurisme’ [Manifesto of Futurism], February 20, 1909

১৫) Georgi Dimitrov (1972), ‘Selected Works’, Sofia Press, Sofia, Volume 2

১৬) Wilhelm Reich, ‘The Mass psychology of Fascism’

১৭) Jean-Paul Sartre, ‘Critique de la Raison dialectique’

১৮) Roger Eatwell (2006), ‘Explaining Fascism and Ethnic Cleansing’, Political Studies review : , vol 4, 263-278

১৯) Antonio Gramsci, ‘Prison Notebooks’

২০) ‘Marx/Engels Selected Works’, Volume Three, p. 13-30; Publisher : Progress Publishers, Moscow, 1970

২১) লেনিন, ‘নির্বাচিত রচনাবলী বারো খণ্ডে’, খণ্ড ৬, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, মস্কো, প্রগতি প্রকাশন, ১৯৮০।

২২) শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘প্রসঙ্গ পশ্চিমী মার্ক্সবাদ : বক্তৃতামালা’, কলকাতা, সেরিবান, ২০২০।  

২৩) David Held (1980), ‘Introduction to Critical theory : Horkheimer to Habermas’, California : University of California Press  

২৪) Noam Chomsky and Ilan Pappe (2015), ‘On Palestine’, Penguin Books

২৫) অনিল বিশ্বাস, ‘ফ্যাসিবাদ’, কলকাতা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯৫।  

২৬) বুক বার্নিং ফটোগ্রাফ — লেখক, বার্লিন ২০১৮, প্রদর্শনী — ‘1933 Berlin : The path to dictatorship’  

২৭) https://www.oxfam.org/en/research/inequality-kills

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান