জাইরাস বানাজি
(ভাষান্তর : গৈরিক বসু )
[ জাইরাস বানাজি ফ্যাসিবাদ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ তিনজন বাম-মতাদর্শিক চিন্তাবিদ আর্থার রজেনবার্গ (Arthur Rosenberg), ভিলহেল্ম্ রাইখ (Wilhelm Reich) এবং জাঁ-পল সার্ত্র্ (Jean-Paul Sartre)-কে নিয়ে আলোচনা করেছেন। ]
[ এই রচনাটি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশে ১১ মার্চ, ২০১৬-তে দেওয়া একটি বক্তৃতার লিখিত রূপ। জাইরাস বানাজি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-এশিয়া চর্চা বিভাগের অধ্যাপক। ২০১৫-য় তাঁর বই ‘Exploring the Economy of Late Antiquity : Selected Essays’ প্রকাশ হয়েছে এবং ২০২০-তে প্রকাশ পেয়েছে ‘A Brief History of Commercial Capitalism’। ]
প্রথমে আমি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে একেবারে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বলব। ভারতের সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য আপনাদের মনে কীভাবে অনুরণন তুলবে, সাদৃশ্য কিছু পাবেন কিনা, তা বিচারের ভার আপনাদের ওপরেই তুলে দিচ্ছি। ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল তিনটি প্রতিপাদ্য আমার কাছে এই রকম …
প্রথমত, জাতীয়তাবাদ মূলত একটা বানিয়ে তোলা চেহারা, যাকে আপনারা ‘ফ্যাসিবাদ ও জাতির মিথ’ রূপে চিহ্নিত করতে পারেন। দ্বিতীয় মতবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ভিলহেল্ম্ রাইখ, একজন মনোবিশ্লেষক। বার্লিনে কাজ করতেন এবং যুদ্ধোত্তর নারীবাদ বিষয়ে তাঁর বহু মূল্যবান কাজ আছে। রাইখের প্রতিপাদ্য ছিল এই যে — পিতৃতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদী পরিবার কাঠামোই হল পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি। এই তত্ত্ব নারীবাদ এবং বিপ্লববাদী মার্কসবাদকে এমন ভাবে মিলিয়ে দেয় যা খুবই বিরল। আবার বলছি এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য। রাইখ দেখিয়েছেন কর্তৃত্ববাদী পরিবারই হল প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বের আঁতুড়ঘর এবং একই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মূল শক্তি। ফ্যাসিবাদে এই দুই বিপরীত ধারার মধ্যে টানাপোড়েন লক্ষ করা যায়। তৃতীয় বিষয়টি হল সার্ত্র্-এর ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’ (manipulated seriality) বিষয়ক ভাবনা চিন্তা। আমি আমার বক্তব্যকে বিস্তারিত করব। ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’ হচ্ছে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একেবারের ভেতরের কথা। যেকোনও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের রাজনীতি বুঝতে গেলে এই ‘ধারাবাহিকতা’ বিষয়টি আপনাদের বিশেষভাবে বুঝতে হবে।
সুতরাং উপরোক্ত এই তিনটি বিষয়ের মধ্যেই মূলত আমি আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখব। প্রথমে ফ্যাসিবাদের বানানো চেহারা যাকে আমি ‘Fascism and the Myth of the Nation’ বলেছি সে বিষয়ে জার্মান মার্কসবাদী আর্থার রজেনবার্গ, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটি বইতে কী বলেছিলেন বলছি। বইটি বেরোনোর এক বছর আগে তিনি জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। রজেনবার্গ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির তরফে রাইখস্ট্যাগে ডেপুটি (ভারতের ক্ষেত্রে লোকসভার সদস্য)। তিনি শুধু যে কমিউনিস্ট ছিলেন তাই নয়, ছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি KPD-র অতিবাম অংশের একজন প্রধান ব্যক্তি, যাঁদের দার্শনিক কার্ল কশ্ (Karl Korsch) ‘Berlin Left’ বলতেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে KPD থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল সোভিয়েত রাশিয়া পার্টির ব্যাপারে অত্যধিক নাক গলাচ্ছে। রজেনবার্গের রচনার শিরোনামই বুঝিয়ে দিচ্ছে বামপন্থীদের ফ্যাসিবাদ চর্চায় তাঁর অবদান কত মৌলিক ছিল। শিরোনামটি হল — ‘Fascism as a Mass Movement’। কমিনটার্ন ফ্যাসিবাদকে দেখেছিল পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্র হিসেবে — যেন একদল ব্যাংক মালিক কোথাও বসে ফ্যাসিবাদ তৈরি করছেন এবং হিটলার তাঁদের পুতুল ছাড়া কিছুই নয়। ১৯২০ বা ৩০-এর দশকে নাৎসি পার্টি যে গণ-উন্মাদনা তৈরি করেছিল, তা স্রেফ পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্র — এই ধারণা অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই ধরনের দক্ষিণপন্থী আন্দোলনের মূল উপকরণগুলি এই ব্যাখ্যায় বাদ পড়ে গেছে। সুতরাং ‘Fascism as a Mass Movement’ কমিনটার্নের ফ্যাসিবাদ ব্যাখ্যার প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ, মূলত যা ছিল ফ্যাসিবাদের সোভিয়েত ব্যাখ্যা। ফ্যাসিবাদের চরিত্র বুঝতে এই ব্যাখ্যা মোটেই গভীরে যায়নি। ফ্যাসিবাদের সংস্কৃতি এবং গণ-উন্মাদনা সৃষ্টির কোনও ব্যাখ্যাই এই আলোচনায় নেই। সেক্ষেত্রে রজেনবার্গ কী বলছেন? রজেনবার্গ, রাইখ এবং সার্ত্র্-এর যে তত্ত্বগুলি আমি আলোচনা করব, তাদের অনেক জায়গাতেই মিল আছে। এঁরা তিনজনই হলেন বামপন্থী ফ্যাসিবাদ চর্চার তিন প্রধান স্তম্ভ।
রজেনবার্গের বক্তব্য হল — ফ্যাসিবাদ শুধু গণ-আন্দোলন রূপেই সফল হতে পারে এবং ফ্যাসিবাদ সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরেই অবস্থান করে। কিন্তু, যতক্ষণ না তার গণভিত্তি মজবুত হচ্ছে, তার প্রভাব থাকে প্রান্তিক (আমি ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলব না, কিন্তু গত আশির দশকে ভারত এই সংঘটন প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৮৪-র গণ-হিংসা যেভাবে সরকারি মদত পেয়েছিল, সেটাই ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির আরও ঘোরতর দক্ষিণপন্থী হয়ে ওঠার মূল কারণ।)। সুতরাং ফ্যাসিবাদ গণআন্দোলন হিসাবেই সফল হতে পারে, এটাই রজেনবার্গের মূল প্রতিপাদ্য। কিন্তু এরপর প্রশ্ন আসে, ফ্যাসিবাদ বা অন্যান্য অতি দক্ষিণপন্থী আন্দোলনগুলি গণভিত্তি কীভাবে গড়ে তোলে? বিষয়টি ভারতের প্রেক্ষিতে আমাদের মূলত অনুধাবন করতে হবে। রজেনবার্গ এর একটি চমকপ্রদ উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলছেন, যে মতবাদকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলছি তা ১৯১৪ থেকেই ইউরোপে ছিল। ভেবে দেখুন, নাৎসি পার্টি ১৯২০-র আগে তৈরি হয়নি। হিটলার এবং তাঁর নাৎসি পার্টি ১৯২০-র শেষাশেষি পর্যন্ত, যতক্ষণ না জার্মানির অর্থসংকট চরমে উঠছে, ততক্ষণ তাঁদের বিশেষ গুরুত্ব ছিল না।
তাহলে কি রজেনবার্গ বলতে চাইছেন, যে মতবাদকে আমরা ‘ফ্যাসিস্ট’ বলি তা ইউরোপীয় সমাজে ১৯১৪ সালেই ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল? তিনি রাজনীতি আর মতবাদের সম্পর্কটা উলটে দিতে চাইছেন। বলছেন, মতবাদ কোনও রাজনৈতিক দল তৈরি করে না, বরং রাজনৈতিক দল বা আন্দোলন মতবাদ থেকে উঠে আসে। তিনি সমাজ এবং রাজনীতিতে ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়ার ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যা ১৮৭০ এবং ১৮৮০ থেকেই চলছিল। প্রক্রিয়াটি কী? সংসদীয় গণতন্ত্র যখন ইউরোপে তার শিকড় ছড়াচ্ছিল, তখন থেকেই ইউরোপীয় অভিজাতবর্গ চিন্তায় পড়ল — নির্বাচন কীভাবে জেতা যায়? অভিজাতদের তো কোনও রকম গণভিত্তি ছিল না। একেবারেই না। যেহেতু তারা প্রধানত বড় ব্যবসায়ী বা জমিদার, তাই সাধারণ মানুষের কাছে তাদের কোনও আবেদনই নেই। তারা মূলত সাধারণ মানুষের শোষক। বস্তুত, ১৮৭০ বা ১৮৮০-তে যে ধরনের রাজনীতি প্রাধান্য পেল, সেখানে শোষকের মতবাদ-ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। রজেনবার্গ একেই বলছেন, ‘নব-কর্তৃত্ববাদী রক্ষণশীলতা’। এই রক্ষণশীলতা ক্রমে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতকীয় এই রক্ষণশীলতাই বিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদের পূর্বপুরুষ।
ফ্যাসিবাদ প্রকৃতপক্ষে পূর্ববর্তী বিভিন্ন মতবাদের একটি সংমিশ্রণ। বিশেষ নিজস্বতা এর নেই। ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ধরা পড়বে। যেমন ধরুন, ইহুদি ও অন্যান্য জাতিবিদ্বেষ, সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন, শ্রমিক বা চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তকে শত্রু ভাবা, শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা ইত্যাদি। জার্মান অভিজাতরা চেয়েছিলেন জার্মান পুঁজিকে জার্মান সাম্রাজ্য বিস্তারে কাজে লাগানো, যাতে তারা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। তারপর ধরুন কর্তৃত্ববাদ ও পিতৃতন্ত্র, এবং সব থেকে জরুরি, এমন একটা ধূম্রজাল তৈরি করা যাতে ফ্যাসিবাদ আর জাতীয়তাবাদ গুলিয়ে যায়। ১৮৭০ সাল থেকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের সাফল্যের অন্যতম কারণ হল এই নব্য জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, পূর্বে যা অজানা ছিল। এমন আগ্রাসী হিংস্র জাতীয়তাবাদ ১৮৪৮-এ তো ছিলই না, এমনকি ১৮৬০ সালে মার্কস যখন ‘ক্যাপিটাল’ লিখছেন, তখন লক্ষণ দেখা দিলেও, স্পষ্টভাবে ছিল না। এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদী দলগুলি বিদেশে সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। আফ্রিকাতে টুকরো টুকরো জমি দখলের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার সূত্রপাত হয়।
সেক্ষেত্রে আমি এই তৈরি করা জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝাচ্ছি আর কেন তাকে ফ্যাসিবাদ ও অলীক জাতিসত্তার স্বপ্ন বলছি? জাতি বলে সত্যিই কি কিছু আছে? সহজ প্রশ্ন, যে অর্থে শ্রেণি আছে, জাতি কি আছে? আপনাদেরই জিজ্ঞাসা করছি? আমি শ্রেণি কী বুঝতে পারি, তাকে দেখতে পাই। মুম্বাই শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কী আমি জানি, এবং জানি আজকের ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কৃতি কী ধরনের। সুতরাং, আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে দেখতে পাই, তার রাজনীতি, সংস্কৃতি, সবই দেখতে পাই। যদি আমি অন্য কোনও জায়গায় থাকি, যেমন ধরুন ভারতের গ্রামে, সেখানে আমি অন্য ধরনের শ্রেণি দেখতে পাব। আমি জানি, শ্রমিক শ্রেণি কেমন দেখতে হয়, কীভাবে তারা কাজ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কলকারখানায় কাজ করে, কেউ নিজের বাড়িতেই কাজ করে। স্বভাবতই শ্রেণি হল এক বাস্তব গোষ্ঠী, যারা প্রকৃতপক্ষে বিরাজমান। অবশ্য তাদের নিজেদের মধ্যে সেই বোধ নাও থাকতে পারে। তাহলে জাতিসত্তা আর শ্রেণিসত্তা কীভাবে এক হয়? যে অর্থে শ্রেণির অস্তিত্ব আছে সে অর্থে জাতির অস্তিত্ব থাকা কী সম্ভব?
যেহেতু জাতীয়তাবাদ এই বক্তৃতামালার প্রধান বিষয়বস্তু, তাই বর্তমানে জাতীয়তাবাদের প্রধান যে দুটি ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, সেগুলো নিয়ে বলছি। প্রথম ব্যাখ্যাটি আর্নেস্ট গেলনার (Arnest Gellner)-এর। গেলনারের বক্তব্যকে এরিক হবসবম (Eric Hobsbawm) পুরোপুরি সমর্থন করেছেন। আর-একটি ব্যাখ্যা বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (Benedict Anderson) কৃত ‘Imagined Communities’ বইতে আছে, যা আশির দশক থেকে জনপ্রিয় হয়। অ্যান্ডারসন জাতিকে একটি ‘কাল্পনিক গোষ্ঠী’ রূপে বর্ণনা করেছেন। গেলনার যেভাবে জাতি ও জাতীয়তাবাদ ব্যাখ্যা করেছেন এই ব্যাখ্যা তার থেকে একেবারেই অন্যরকম। ‘তৈরি করা জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে হবসবম বলছেন, “With Gellner, I would stress the element of artefact, invention and social engineering which enters into the making of nations.” তারপর তিনি গেলনারকে উদ্ধৃত করেছেন, “Nations as a natural, God-given way of classifying people, as an inherent political destiny is a myth.” এই কারণে আমি বলছি — ফ্যাসিবাদ হল জাতীয়তাবাদের এক অলীক রূপ। “Nationalism, which sometimes takes pre-existing cultures and turns them into nations, sometimes invents them and often obliterates pre-existing cultures, that is a reality.” এখানে একটি বৈসাদৃশ্য আছে, জাতি অলীক, কিন্তু জাতীয়তাবাদ বাস্তব। সমর্থন করে হবসবম বলছেন, “In short, for the purposes of analysis, nationalism comes before nations. Nations do not make states and nationalism but the other way around.” গেলনার ও হবসবম-এর এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
বিপরীতে অ্যান্ডারসন বলছেন, “Gellner makes a comparable point when he rules that nationalism is not the awakening of nations to self-consciousness.” [কারণ, জাতীয়তাবাদ জাতির আগে তৈরি হয় না।] “He (Gellner) invents nations where they do not exist. The drawback to this formulation is that Gellner is so anxious to show that nationalism masquerades under false pretenees, that he assimilates invention to fabrication and to falsity rather than to imagining and creation.” এখানে বিভাজন রেখাটি লক্ষ করুন। একজন বলছেন জাতি স্রেফ বানানো, আর অন্যজন বলছেন তা না, ওটা কল্পনা। অ্যান্ডারসন জাতিকে সৃষ্টি ও কল্পনা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, গেলনার যে গোষ্ঠীর কথা বলছেন, তার প্রকৃত অস্তিত্ব আছে এবং তাকে এক অর্থে জাতি বলা যেতে পারে। তাহলে অ্যান্ডারসন শ্রেণিকেই জাতি বলে কল্পনা করছেন। তিনি কি কল্পনা করছেন — জাতি হল একটি গোষ্ঠী যারা গভীর ভ্রাতৃত্ববোধ দ্বারা চালিত। আশ্চর্য! তাহলে কল্পনা করছেন কে? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় জাতি একটি কাল্পনিক গোষ্ঠী, তাহলে কল্পনা করছে কারা? আমি যা বুঝেছি, অ্যান্ডারসন এর উত্তর দেননি। আর ভীষণ ভাবে বিভক্ত মানুষদের কীভাবে গভীর ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হতে পারবে, যে তারাই জাতি সৃষ্টি করবে! শ্রেণিকে এইভাবে বোঝা সম্ভব, জাতিকে নয়।
এবার আমরা আরও একজন চিন্তাবিদকে আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করব। তিনি লিয়া গ্রিনফেল্ড (Liah Greenfeld)। তাঁর ‘Nationalism : Five Roads to Modernity’ বইতে তিনি জাতীয়তাবাদকে ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি ইত্যাদি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে তিনি ভারতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত একটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, “Much more often a nation is defined not as a composite entity”, তাদের ব্যক্তিসত্তায় এমন কিছু একটা থাকে “but as a collective individual [সাংঘাতিক ব্যাপার অর্ণব গোস্বামীর কথা মনে আসে] endowed with a will and interest of its own, which are independent of and take priority over the wills and interests of human individuals within the nation.” এই ব্যক্তিবিশেষ হল আপনি, আমি, বাস্তবে যাদের অস্তিত্ব আছে। নিজেদের মধ্যে যারা মেলামেশা করে, কথা বলে ইত্যাদি। কিন্তু অর্ণব তো তা বলবে না, তার কাছে “the nation : the nation demands to know!” — এটাই শেষ কথা। এই কথাটাই প্রতি সন্ধ্যায় সে চিৎকার করে আমাদের বলে। গ্রিনফেল্ড এই ধরনের জাতীয়তাবাদের কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন? “Such a definition of the nation results in collectivistic nationalism. Collectivistic nationalism tend to be authoritarian and imply a fundamental inequality between a small group of self-appointed interpreters of the will of the nation — the leaders — and the masses, who have to adapt to the elite’s interpretations.” এই স্বঘোষিত ব্যাখ্যাকারদের ইচ্ছাই সর্বদা জনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে জাতির কণ্ঠস্বর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। গ্রিনফেল্ড দেখিয়েছেন, এই ধরনের জাতীয়তাবাদ সর্বদাই কর্তৃত্ববাদী। এই কর্তৃত্ববাদী সমষ্টিগত জাতীয়তাবাদ ভারতে এখন গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং জেএনইউ ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
রজেনবার্গ এই প্রসঙ্গের ব্যাখ্যায় জাতীয়তাবাদকে কৃত্রিমভাবে নির্মাণ করার কথা উল্লেখ করেছেন। অপর দিকে তিনি বলছেন, ফ্যাসিবাদ যদিও ১৯১৪ সালের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল, সুতরাং নাৎসিবাদকে আমরা এই ফ্যাসিবাদ থেকেই উদ্ভূত বলে ধরে নিতে পারি। রজেনবার্গ আরও একটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে আধুনিক ফ্যাসিবাদ হল ‘stormtrooper’-দের কৌশল। সাম্প্রতিক ভারতে ‘stormtrooper’-দের বিষয়ে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু যেহেতু আমি কথা দিয়েছি ভারতের বিষয়ে কিছু বলব না, তাই আপনারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে বুঝে নিন।
এই ‘stormtrooper’-দের ধারণা মূলত যুদ্ধবিদ্যা থেকে ধার করা। এরা একটা বিশেষ বাহিনী যারা বিপক্ষের ট্রেঞ্চ-এর ওপর ঝড়ের গতিতে আক্রমণ করে। ট্রেঞ্চ যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক প্রধান রণকৌশল ছিল। ‘War Horse’ নামে ট্রেঞ্চ যুদ্ধের ওপর একটি অসাধারণ সিনেমা আছে। ট্রেঞ্চ যুদ্ধ সবথেকে রক্তক্ষয়ী, নৃশংস, আদিম যুদ্ধ। যদিও তখন যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র ছিল, তবুও ট্রেঞ্চ যুদ্ধেই প্রাণ গিয়েছিল সবথেকে বেশি সৈন্য। একে অপরের ট্রেঞ্চের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল যুদ্ধের প্রধান কৌশল।
এবার দেখা যাক রাজনীতিতে ‘stormtroopers’ কী ভূমিকা পালন করে। ‘stormtrooper’-দের ধারণাটি বামপন্থীরা আবিষ্কার করেননি, এটা দক্ষিণপন্থীদের দান। ‘stormtrooper’-দের অস্তিত্ব একদা ইতালিতে ছিল, তাদের বলা হত ‘squadristi’। তারা দক্ষিণ ইতালির জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ভাগচাষীদের বিক্ষোভ দমনে সাহায্য করত। উত্তর ইতালির শিল্পপতিরা যখন দেখলেন দক্ষিণে ‘stormtrooper’-রা কী করছে, তখন তাঁরা ওদের ডেকে আনলেন শ্রমিক বিক্ষোভকে যেনতেন প্রকারে ধ্বংস করতে।
‘stormtrooper’-দের বিষয়ে রজেনবার্গের বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরে। তিনি বলছেন —
“The activities of the stormtroopers of the fascist type are in complete violation of laws. Legally, the stormtroopers should be tried and sentenced to prison, but in fact nothing of that sort happens. Their conviction in the courts is pure show, either they do not serve their sentence or they are soon pardoned. In this way the ruling class shows its stormtrooper heroes how grateful and sympathetic it is.”
প্রকৃতপক্ষে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত এবং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় ফ্যাসিবাদের বীজ বোনা হয়। ‘stormtrooper’-দের খোলা ছাড় দেওয়া হয়। সেইজন্যে ফ্যাসিস্ট দলগুলিকে তাড়ানো এত সহজ হয় না, পিছনের দরজা দিয়ে সরকারি প্রসাদ তারা সব সময়ই পায়, সে শাসক সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র মেনে চললেও। উদাহরণ জার্মানির হুইমার রিপাবলিক বা আমাদের গণতান্ত্রিক ভারত। রজেনবার্গ বিষয়ে এবার থামলাম, কিন্তু ওনার দু-তিনটি ব্যাখ্যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব ভিলহেল্ম রাইখের দিকে। রজেনবার্গ ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে বিষাক্ত জাতীয়তাবাদের যে ছবি এঁকেছেন, একেবারে তার অন্য দিকে। রাইখের প্রধান বক্তব্য হচ্ছে পিতৃতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদী পারিবারিক কাঠামো রাষ্ট্রশক্তির মূল অবলম্বন। জাতীয়তাবাদের ধারণাকে তিনি দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি আমাদের নজরে আনতে চাইছেন — কীভাবে কমবয়সীদের মাথায় জাতীয়তাবাদের এই রূপ ধারণা প্রবেশ করানো হয় সেই পদ্ধতির দিকে।
রাইখের বই ‘The Mass Psychology of Fascism’ প্রকাশ হয় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে, রজেনবার্গের বইয়ের এক বছর আগে। রাইখ বই লেখা শুরু করেন ১৯১৩-তে। তিনি বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণি ঠিক কোন্ কারণে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে? এ এক ধাঁধার মতো — কেন শ্রমিকরা দক্ষিণপন্থী দলের প্রতি আকৃষ্ট হয়? কেননা, এই আন্দোলন থেকে শ্রমিকদের তো পাওয়ার কিছুই নেই। রাইখ বলেছেন, এই ধাঁধা অর্থনৈতিক যুক্তি দিয়ে সমাধান করা যাবে না। এই ধাঁধার সমাধান লুকিয়ে আছে পরিবার কাঠামো ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে, যেখানে লুকিয়ে আছে ফ্যাসিবাদের বীজ।
মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই দৃষ্টিভঙ্গিই ফ্যাসিবাদকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। কীভাবে কাজ করে এই মানসক্রিয়া? ‘Mass Psychology of Fascism’ বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে (বইটির থিয়োডোর উল্ফ্ কৃত একটি চমৎকার অনুবাদ পাওয়া যায়)। রাইখের প্রতিপাদ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হল — এই বিশেষ মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি বস্তুগত শক্তি হিসাবে দেখা। এই মতবাদ কোনও বস্তুনিরপেক্ষ মতবাদ মাত্র নয়। এক বিশেষ মানসিক গঠন, যার শিকড় অতি গভীরে প্রোথিত। পরিবারে একে ‘ঐতিহ্য’ বলে চিহ্নিত করা হয় এবং অবদমিত হিংসা এর বিশেষত্ব। সুতরাং এই মতবাদ একটি বস্তুগত শক্তি যার শিকড় পরিবার কাঠামোর মধ্যে নিহিত।
রাইখের দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য হল — পিতৃত্ববাদ রাষ্ট্রশক্তির মূল চালিকাশক্তি। রাইখের দাবি অনুযায়ী তৃতীয় প্রতিপাদ্য হল — কর্তৃত্ববাদ, যা পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের বৈশিষ্ট্য, তাঁর সঙ্গে ফুয়েরার (Fuhrer)-এর মতবাদের গভীর যোগ। ফুয়েরারের মতবাদ সব দক্ষিণপন্থী আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি। ফুয়েরার মতবাদের কেন্দ্রে থাকেন একজন গণনায়ক — তাঁর দৃঢ় এবং প্রবল ব্যক্তিত্ব জনগণকে চালনা করে। তাহলে কি ফুয়েরার এবং ইন্দিরা গান্ধিকে আমরা একই সারিতে রাখব? মোটেও তা নয়। ইন্দিরা ছিলেন দৃঢ় এবং কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি সারা দেশের ওপর জরুরি অবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান ভারতে কোনও রাজনৈতিক নেতাকে আপনার ফুয়েরারের কাছাকাছি মনে হয়? এক নেতা, তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তি, প্রসারমান বক্ষ ইত্যাদি। কিন্তু ফুয়েরারদের কি তৈরি করা যায়? জনতা, ফুয়েরারের সমর্থক জনতা — গণসমর্থন ছাড়া ফুয়েরারদের কোনও অস্তিত্ব আছে কি? রাইখ আমাদের নেতা এবং জনতার দ্বান্দ্বিকতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কর্তৃত্ববাদী পরিবার কাঠামো এক বিশেষ ধরনের জনতা তৈরি করে, যারা নিজেরাও হয়ে ওঠে সর্বদাই কর্তৃত্ববাদী; তাদের চরিত্র ফুয়েরারের মতোই। এরা একে অপরকে সৃষ্টি করে এবং একে অপরের পথ সুগম করে।
এখানে আবার কার্যকারণ সম্পর্ক উলটে গেল, উলটে গেল প্রভাব বিস্তারের অভিমুখ। এক্ষেত্রে জনতা ও তার বিশেষ সংস্কৃতি প্রথমে আসে, রাজনীতি আসে তার পেছনে পেছনে। রাজনীতি তো জনতার বিশেষ সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। রাইখ বিষয়ে আর বিস্তারিত বলছি না। রাইখের মূল প্রতিপাদ্যই হল, পরিবার প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদের আঁতুড়ঘর। অবশ্য সব পরিবার নয়, এখানে কর্তৃত্ববাদী পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের কথাই বলা হচ্ছে। এই পরিবারগুলি যেন শিশুদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্র; তারা স্বাধীন মানুষ হিসাবে ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কিনা বা তাদের শৈশব ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা, তার নিষ্পত্তি হয় এই পারিবারিকবৃত্তে। থিয়োডোর কটুল্লা (Theodore Kotulla)-র এই বিষয়ে একটি অনবদ্য সিনেমা, ‘Aus einem deutschen Leben’ (Death is My Trade, ১৯৭৭) আছে। সিনেমার নায়ক এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রধান। সিনেমা তারই জীবনবৃত্তান্ত। লোকটি ক্যাম্পে ক্রমেই এক মানুষ মারার যন্ত্রে পরিণত হয়। কোন্ পরিবেশ পরিস্থিতি এমন মানুষ নিধনের মানবকল তৈরি করে, সিনেমায় তাই দেখানো হয়েছে। সিনেমা শুরু হয় নায়কের শৈশব থেকে। ভয়ংকর শৈশব। নিম্নমধ্যবিত্ত গ্রামের এক প্রুশিয়ান পরিবার। পরিবারের মধ্যমণি নায়কের পিতা। পিতার মধ্যেই শিশুটি রাষ্ট্রশক্তির নিষ্ঠুর রূপ দেখতে পায়। ছোটো বয়স থেকেই তুমি যদি মায়ের পক্ষ নিয়ে বাবার আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারো, বাবার অত্যাচার প্রতিরোধ করতে না পারো, তুমি যুদ্ধে হেরে গেলে। বড়ো হয়ে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তুমি মালিকের পা-চাটা কুকুর হবে, মালিকের একান্ত বশংবদ ভৃত্য হবে। রাষ্ট্রের কর্তাদের পুজো করবে, তাঁদের শক্তির সামনে কুঁকড়ে থাকবে। এই বিশেষ কাঠামোকে বিস্তৃত করে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির পরিসরে রাখলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে — ফুয়েরাররা কোথা থেকে কীভাবে আবির্ভূত হন।
রাইখের বইতে গণমনস্তত্ত্ব নিয়ে অসাধারণ একটি অনুচ্ছেদ আছে। সেখানে তিনি দেখাচ্ছেন ফুয়েরারকে যারা সমর্থন ও পুজো করেন তারা শৈশবে অত্যন্ত অসহায় ছিলেন। রাইখ এই অসহায়তার ওপর জোর দিয়েছেন। কারণ এইসব শিশুরা যখন বড়ো হয় তারা তাদের উপর ঘটা অন্যায়-অবিচারগুলির প্রতিশোধ নিতে চায়। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, গভীর চিন্তা করতে পারে না। নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের নেই। এ তো ভেবে দেখার বিষয়। চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে হবে। কী ধরনের সাবেকি পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে ভারতে তথা অন্য কোথাও এমন প্রতিক্রিয়া ঘটে। এখানে নারীবাদের বড়ো ভূমিকা আছে। নারীবাদ ও বামপন্থী রাজনীতি এখানে সেতুর কাজ করতে পারে। অতএব পারিবারিক পরিসরেই শ্রেণিসংগ্রাম, কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ইত্যাদির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। প্রথম যুদ্ধক্ষেত্র পরিবার-ই।
সবশেষে পুনরায় সার্ত্র্-এর শরণাপন্ন হব। তিনি দেখিয়েছেন যে, ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মূলে আছে ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’ বজায় রাখার পদ্ধতি। সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব নিয়ে সার্ত্র্ কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেননি। কিন্তু তিনি সমাজকে দু-টি ভাগে ভাগ করেছেন। একদল যারা সংগঠিত (অর্থাৎ গোষ্ঠী) এবং যারা সংগঠিত নয় (অর্থাৎ দল)। এ একেবারেই প্রাথমিক স্তরের সমাজতত্ত্ব। যদি তোমরা সংগঠিত, তাহলে কিছু করতে পারবে, ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে, দর-কষাকষি করতে পারবে। যদি নও, পারবে না, তোমাকে স্থিতাবস্থা মেনে নিতে হবে। আমার সমগ্র বক্তৃতার নির্যাস হল — সংগঠিত গোষ্ঠী ও অসংগঠিত জনতার মধ্যে কীভাবে বিভাজন টিকিয়ে রাখা হয়। সার্ত্র্ দেখিয়েছেন ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’-র মাধ্যমে এই বিভাজনকে কায়েম করে রাখা হয়। ধরুন, আপনি বাস ধরার জন্য কোথাও দাঁড়িয়ে আছেন। অন্য যারা সেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের মধ্যে আলাদাভাবে কোনও যোগসূত্র নেই। যোগসূত্র একটাই, বাস। বাসই সেখানে সকলকে একত্রিত করছে। সার্ত্র্ এই বাসের উদাহরণকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে প্রসারিত করেছেন। এইভাবে কিছু লোকের এক জায়গায় আসাকে তিনি ‘দল’ বলছেন। কিন্তু সংগঠিত গোষ্ঠীগুলি ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’ বজায় রেখে এই ‘দল’-কে কখনোই সংগঠিত হতে দেয় না।
গোষ্ঠীগুলি দলের ওপর কর্তৃত্ব করে। কারণ, তাদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা আছে। আধুনিক সমাজের এই অসংগঠিত বিশাল জড়ীভূত জনতাই হল সার্ত্র্ কথিত দল। এখানে ‘জড়ীভূত’-র অর্থ, যারা ক্ষমতাহীন, নিজেরা কিছু করতে অক্ষম। সার্ত্র্ -এর মতে, রাষ্ট্র হল এই সকল সংগঠিত গোষ্ঠীগুলির একটি ঘননিবদ্ধ পুঞ্জ, যাদের অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে। যেমন — আমলাতন্ত্র, সৈন্যবাহিনী, সংবাদ মাধ্যম বা রাজনৈতিক দলগুলি। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি এরা কাদের প্রতিনিধি? এরা বৃহৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ সিস্টেমের একটা অংশ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, এরা অসংগঠিত দলদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে এবং সংগঠিত গোষ্ঠীগুলির মতো এরা নিজেদের কাজ করে চলে। বিবিধ সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীগুলি জনতাকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে পারে বলেই শাসকশ্রেণি তার শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখতে পারে। এই কারণেই ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি। ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের সংঘবদ্ধতা ও নিজেদের শক্তির প্রাথমিক পাঠ দেয়। সম্মিলিত শক্তি হিসাবে অন্যান্য অসংগঠিত শক্তিগুলির মোকাবিলা করতে শেখায়। অবশ্য মালিকপক্ষ অনেক বেশি সংগঠিত ও যূথবদ্ধ। সংগঠিত মালিকপক্ষ, সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীগুলিই আসলে রাষ্ট্রশক্তির মূল উৎস।
সুতরাং ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’-র অর্থ কী দাঁড়াল? সার্ত্র্ দেখাচ্ছেন, সংগঠিত গোষ্ঠীগুলি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সদা সচেষ্ট। ধারাবাহিকতা বজায় রাখার এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টাকে তিনি বলছেন ‘বহির্ভূত অনুবর্তন’ (extra conditioning), শব্দটা উনি পেয়েছেন আমেরিকান সমাজতত্ত্ববিদ ডেভিড রিজম্যানের ‘The Lonely Crowd’ বই থেকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, লক্ষ লক্ষ দর্শক একই টিভি চ্যানেলের খবর শোনেন, আপাতভাবে যদিও তাদের মধ্যে কোনও মিল নেই; তবে মিল একটাই যে তারা একই খবর শোনেন ও খবরের উপস্থাপককে দেখেন। তারা এই খবর ও তার উপস্থাপককে বিশ্বাস করেন। এভাবেই ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’ ধারাবাহিকভাবে তার কাজ করে চলে। সামাজিক মাধ্যমগুলিকেও এই একই লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়। এমনভাবে করা হয় যার ফলে জনতার ওপর গোষ্ঠীগুলির নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। ‘বহির্ভূত অনুবর্তন’ (Extra conditioning) কাজ করে চলে বলেই ঘটানো হয় দাঙ্গা, গণপ্রহার ও অন্যান্য কর্মসূচি সফল হয় — অসংগঠিত জনতাকে ব্যবহার করা হয় নিজেদের প্রয়োজনে। সার্ত্র্ যখন বলেন, ‘সুচতুর ধারাবাহিকতা’ ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মূল কথা, তখন তিনি এই গোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের কথাই বলেন। সরকারি বা বেসরকারি মদতপুষ্ট সংগঠিত গোষ্ঠীগুলি নিজেদের মতে জনতাকে চলতে বাধ্য করে। জনতার নিজস্ব কর্মসূচির মতো স্বতঃস্ফূর্ততা প্রায় থাকেই না। সবই বাইরে থেকে প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করা হয় — কিন্তু দেখানো হয় সবই যেন জনতারই কর্মসূচি। ফৌজদারি আদালতে গেলে ঘটনার সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, পর্দার আড়ালে থেকে যারা অপকর্মটিকে পরিচালনা করছিলেন তাঁদের কিছুই হয় না। ভারতে হিংসার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সরাসরি সরকারি মদতপুষ্ট ‘stormtroopers’-রা ছাত্রছাত্রীদের ওপর হিংস্র আক্রমণ শানাচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে ‘stormtroopers’-রা জ্বলন্ত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। যে দেশপ্রেম সযত্নে নির্মাণ করা হয়েছে (রজেনবার্গের অভিমত)। এই হিংসার পরিবেশ বিষাক্ত জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েই তৈরি করা হয়। বলা হয় — তুমি দেশকে অপমান করছো, তুমি দেশবিরোধী, ইত্যাদি। আরও অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু আপাতত এখানেই থামছি।