সৌম্য মুখোপাধ্যায়
এক
1980-এর দশকে এরিক হবসবম যখন জাতীয়তাবাদের উপর তাঁর মূল গবেষণা [১] লিখছিলেন, তখন জাতীয়তাবাদকে একটি বিলুপ্তপ্রায় বিষয় রূপে দেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমান শতকে ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান, কর্তৃত্ববাদের বিস্তার, বামপন্থার অবনমনের প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদের নবজীবন প্রাপ্তি ঘটেছে। এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে বলছেন, যুগটা জনমোহিনীবাদের, যার অন্য নাম লোকরঞ্জনবাদ। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, আসলে এই যুগে কর্তৃত্ববাদ, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ আর জাতীয়তাবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এখানে দৃষ্টিভ্রম হওয়া স্বাভাবিক, ঘোলাটে হবেই বাছবিচার, মোটা দাগে সবই লাগবে একই রকম। তবু এমন গোলমেলে সময়ে একটা দিক মোটামুটি পরিষ্কার, বলছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মূল্যায়নে : ডানপন্থী রাজনীতির লোকরঞ্জনবাদ, বর্ণবাদ, কর্তৃত্ববাদ আর সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের রাজনীতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে সদম্ভে এগিয়ে চলেছে জাতীয়তাবাদ, আর সেইসঙ্গে ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আয়ু।
বিশ্বের নানা প্রান্তের উদাহরণ টেনে বলা যায়, ডানপন্থী রাজনীতি আর তার দ্বারা লালিত জাতীয়তাবাদের কদর আজ ভুবন-জোড়া। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপের ফ্রান্স, ব্রিটেন সহ কয়েকটি দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ, এর সপক্ষে জাজ্বল্য উদাহরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, চিনে শি জিংপিং, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন, ব্রাজিলে জাইর বলসোনারো, তুরস্কে এরদোগান, ফিলিপাইনে দুতের্তে, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবান, ইজরায়েলে নেতানিয়াহু এবং অবশ্যই ভারতে নরেন্দ্র মোদি — এঁরা সকলেই জাতীয়তাবাদের মোড়কে নিজেদের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করেছে। একই অবস্থা ব্রিটেনেও। ব্রেক্সিট রাজনীতির দোলাচলের মধ্যে বরিস জনসনকে ঘিরে কট্টর রক্ষণশীল, উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিসর গড়ে উঠেছে। ইতালিতে উগ্র ডানপন্থীদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। অস্ট্রিয়া, সুইডেনেও মাথা চাড়া দিচ্ছে বর্ণবাদী প্রবণতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপট।
দুই
বিশ্বরাজনীতির এই ডানপন্থী মোচড়ের গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমরা শুরুতেই অর্জুন আপ্পাদুরাই-এর বিশ্লেষণের [২] শরণ নেব। তাঁর মতে, যে ডানপন্থী শাসক বা নেতৃত্ব বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এঁরা সকলেই ভিন্নতার প্রতি চরম বিদ্বেষপরায়ণ, সেইসঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক আর কর্তৃত্ববাদী। এঁদের সকলের রয়েছে এক নিজস্ব অনুসারী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ককে অবশ্য পরম্পরাগত ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। পরম্পরাগত ব্যাখ্যায় নেতা ও অনুসারীর মিলন ঘটে নেতার সাহস, ক্যারিশমা, প্রচার এবং অনুসারীর নীতিগত ও আদর্শগত আনুগত্যের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নেতা-অনুসারীর উত্থান ও বিকাশ ঘটে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বকীয় ভাবে। অর্থাৎ নেতার আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রতিশ্রুতি ও কৌশলের প্রতি উদাসীন, অনাগ্রহী থেকে সম্পূর্ণ নিজের বাসনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কৌশলের বশীভূত থাকতে পারে নেতার অনুসারীরা। নেতার প্রতি অনুসারীদের আনুগত্য জেগে ওঠে তাদের সমাজ তাদের জন্য এযাবৎকাল যা করেছে বা যা করেনি সেই সংক্রান্ত ক্ষোভ, অসহায়তা, হতাশা, ক্রোধ ও প্রতিশোধ-পরায়ণতা থেকে।
এই অনুসারী গোষ্ঠীর প্রকৃত চরিত্র বোঝা সম্ভব আপ্পাদুরাই-এর অন্য আর-একটি বিশ্লেষণ [৩] থেকে, যেখানে তিনি নয়া-এলিটতন্ত্রের ‘অভ্যুত্থান’ তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, এই উদীয়মান এলিটরাই নব্য ডানপন্থী নেতাদের আবরণ হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের সমর্থন আর তোষামোদ করে, তাঁদের পক্ষে প্রচার চালান। এইসব নব্য এলিটদের উপর ভর করে আজকের নেতারা এমন এক ব্যবস্থা কায়েম করেছেন, যাকে বলা যেতে পারে ‘উপর থেকে আরোপিত লোকরঞ্জনবাদ’। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমজনতা কেবল গণতন্ত্র থেকে ব্যাপকমাত্রায় নিষ্ক্রমণের উপকরণ মাত্র। আপ্পাদুরাই-এর এই কথার ব্যাখ্যায় আমরা পরে আসব; তার আগে জানব, এই নব্য এলিট কারা? তাদের অভ্যুত্থানই বা কিসের বিরুদ্ধে?
নব্য এলিট সম্প্রদায়ের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে : প্রথমত, চিরাচরিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এলিটদের প্রতি এঁদের রয়েছে সীমাহীন অবজ্ঞা। দ্বিতীয়ত, এঁরা মনে করেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী-গবেষক-শিল্পী-অ্যাক্টিভিস্ট-সমাজতন্ত্রী-নারীবাদী নামক ‘দখলদার’ কিংবা ‘ভুয়ো’ এলিটদের বিপরীতে তাঁরাই ‘প্রকৃত’ এলিট। তৃতীয়ত, নব্য এলিটদের এই প্রতি-উত্থান লিবারেল গণতন্ত্রের যুগে নির্ণীত মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও। কেবলমাত্র নিজেদের জন্য ব্যতিরেকে তাঁরা স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বকে স্রেফ ঘৃণা করেন। কোনও রকম বাধা ছাড়াই যা খুশি করার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যকে (চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স) তাঁরা ‘অবৈধ’ জ্ঞান করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ রক্ষিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত পুঁজিবাদকে তাঁরা বন্দনা করেন এবং জনগণ নয় বরং নিজেদের ভোটারদের কাল্ট বা গোষ্ঠীতন্ত্র অনুসরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগায়। সর্বোপরি, তাঁরা বিবেচনা এবং পদ্ধতিগত যুক্তিবোধের বিরোধিতা করেন। কারণ এগুলো অন্যের বক্তব্য শোনার ধৈর্য এবং সম্মিলিত যুক্তিবোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। কেবলমাত্র তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও সমমনস্কদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে, এমনকি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেও তাঁদের গভীর অনাস্থা। এর ভিত্তিতে আপ্পাদুরাই বলছেন, ‘অ্যান্টি-এলিট’ ডিসকোর্সের ছদ্মবেশে এটা আসলে নতুন এক এলিটিজম-এর অভ্যুত্থান।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নেতা ও অনুসারীর নিজ নিজ স্বার্থের সংযোগ ঘটে কোথায় বা কীসের মাধ্যমে। আপ্পাদুরাই এর উত্তরে বলছেন, নির্বাচন। নির্বাচন হল সেই মোড় যেখানে নেতা ও অনুসারীর ইচ্ছা ও অভিলাষের মিলন ঘটে। আবার নির্বাচন হচ্ছে সেই ঘটনা যার মাধ্যমে নেতা ও অনুসারী পরস্পরকে আশ্রয় করে নিজ নিজ এজেন্ডা চরিতার্থ করে। এই ডানপন্থী শাসকেরা আবেগ-অনুভূতির (প্রেম, ক্ষত, ত্যাগ, ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ) গুরুত্ব বোঝে এবং এগুলোকে নির্বাচনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে তাঁদের প্রতিপক্ষরা এমন সব তত্ত্ব, মূল্যবোধ, যুক্তি বিষয়ক আধা-বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কে ডুবে থাকে, যেগুলোর গণ-আবেদন আজ প্রায় তলানিতে ঠেকেছে।
তিন
এভাবেই আজকের ডানপন্থী নেতাদের দ্বারা উত্থাপিত হয় জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ। কারণ, এর আবেদন অগ্রাহ্য করার নয়। মোটা দাগে বললে, আধুনিক রাষ্ট্র, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও ‘বিশুদ্ধ’ জাতি কল্পনা থেকে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ। এই বিশুদ্ধজাতি কল্পনা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আত্মশ্লাঘা দেয় এবং নির্দিষ্ট ‘পরিচয়’-এর জন্ম দিতে সাহায্য করে। আবার এই ‘পরিচয়’-কে ভিত্তি করে জনগোষ্ঠীকে ‘আপন’ আর ‘অপর’-এ বিভাজন করে। যেহেতু ডানপন্থী নেতারা আবেগ-অনুভূতির গুরুত্ব বোঝে, সেহেতু তারা এই পরিচয়কেই স্থায়ী রূপ দিতে সচেষ্ট হয়, সেইসঙ্গে জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে মর্জি-মাফিক সংখ্যালঘু খুঁজে নিতে সাহায্য করে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, মানুষের সত্তা ও পরিচয় পরিস্থিতি-সাপেক্ষ এবং সতত পরিবর্তনশীল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাপিত জীবনের পরিচয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকে। ফলে একে সময় বিশেষে বের করে আনা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। এখানে দীপেশ চক্রবর্তী বলছেন, মানুষের হরেক পরিচয়ের মধ্যে কোনও একটিকে স্থায়ী রূপ দেবার মধ্যে একটা দুরভিসন্ধি থাকে। [৪] বলা বাহুল্য, বিশ্বের ডানপন্থী শাসকেরা এই দুরভিসন্ধিকে প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়েছে।
বিশ্বের ডানপন্থী নেতৃত্ব আবার একথা আজ ভালোভাবেই জানে যে, এমন এক সময়ে তাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন যখন জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা নিশ্চিহ্ন হবার মুখে। আজকের কোনও জাতিরাষ্ট্রই জাতীয় সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন জাতীয় অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক নয়। একথা আজ ধনী বা গরিব, সব রাষ্ট্রের জন্যই সমানভাবে খাটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চিন মুখাপেক্ষী, আবার চিন কাঁচামালের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর উপর ভরসা করে; অন্যদিকে, পৃথিবীর আজ সকল দেশই মধ্যপ্রাচ্যের উপর তেলের কারণে নির্ভরশীল। ফলে, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের ধারণা বলে আজ আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেদের অর্থনীতির উপর দেশগুলোর কোনও বাস্তবিক লাগাম না থাকায় পৃথিবীতে জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা আজ একপ্রকার সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ববাদের হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
বিশ্ব ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলা যায়, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় পুতিন এক ডিক্রি জারি করে বলেছিলেন যে রাশিয়া ইউরোপ নয়। পুতিন রাশিয়াকে এক ‘ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক স্থান’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। এই ডিক্রি জারির পরেপরেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হয়, পুতিনবিরোধী শিল্পীর কনসার্টে বাধা দেওয়া হয়, রাশিয়ার অভ্যন্তরে সমস্ত বিরুদ্ধ স্বরের কণ্ঠরোধ করা হয়। এভাবেই পুতিনের রাশিয়া দেশ ও দেশের বাইরে সমস্ত শত্রুদের দমন করে বজায় রাখছে নিজের ‘সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব’। একইভাবে এরদোগান সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের ধারণাকে তুরস্কে জনপ্রিয় করতে সচেষ্ট। তিনি একদিকে নব্য অটোমানবাদী মোড়কে ‘নয়া তুরস্ক’ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, আবার অন্যদিকে মুসলিম দুনিয়ার ত্রাতা হওয়ার সাম্রাজ্যবাদী বাসনা পোষণ করেন। সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ধ্বংস করতে এরদোগান বরাবরই নির্মম। পাশাপাশি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘America First’ বা ভারতে নরেন্দ্র মোদির ‘হিন্দুত্ব’ স্লোগান সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এখন এ প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে যে, ডানপন্থী নেতাদের জাতীয়তাবাদের জিগিরকে এলিট ব্যতীত আমজনতা কীভাবে দেখে। এই আমজনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকেই আজ ‘ক্ষুদ্র মানব’ শব্দবন্ধের মধ্যে ফেলা হয়। বস্তুত ডানপন্থী রাজনীতির গণমনস্তত্ত্ব বুঝতে হলে ‘ক্ষুদ্র মানব’ সংক্রান্ত বোঝাপড়ার কোনও বিকল্প নেই। আদিত্য নিগম [৫] জানাচ্ছেন, ‘ক্ষুদ্র মানব’ শব্দবন্ধটির প্রবক্তা মার্কসবাদী সাইকোএনালিস্ট উইলহেম রিখ। এই ‘ক্ষুদ্র মানব’ আকারে ছোটো নয় বা তারা সনাতনী ‘প্রলেতারিয়েত’ও নয়। এরা হচ্ছে সেই সব প্রান্তিক, ক্রুদ্ধ মানুষ যারা মনে করে ভুবনায়ন, আধুনিকতা সহ লিবারেল মূল্যবোধ আসলে ফাঁকা বুলি। আধুনিক জনপরিসর আর তার নানাবিধ প্রতিশ্রুতি থেকে সে কিছুই পায়নি। বরং প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হয়েছে। এই ‘ক্ষুদ্র মানব’ দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রথমত, তাদের প্রায় দাসোচিত জীবন এবং অতুলনীয় তাদের প্রভুভক্তি। তাদের এই প্রভুভক্তি যে কেবল লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের প্রতি তাই নয়, সেইসঙ্গে ডানপন্থী মতাদর্শের প্রতিও বটে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র মানবেরা বিদ্রোহী।
বস্তুত, আকাঙ্ক্ষার প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী উত্থানের (বিজ্ঞাপন, ভোক্তা পণ্য, সেলেব্রিটি কাল্ট, কর্পোরেট সংস্কৃতি) দৌলতে ‘ক্ষুদ্র মানব’ এখন সমৃদ্ধি ও মর্যাদা চায় এবং এই লোকরঞ্জনবাদী নেতারা তাদেরকে সেগুলো নিশ্চিত করার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিও দেয়। আরও একটি যুক্তি হল — ক্রমাগত বাদ পড়া, দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এবং অপমানের শিকার হওয়া ক্ষুদ্র মানবদের এতটাই বিদ্বেষপরায়ণ করে তুলেছে যে তারা এখন এইসব নেতাদের মধ্যেই নিজেদের পরিচয়কে জুড়ে দিতে চায়। এরা নেতাদের ‘সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবাদ’-এর দাবিকে সমাজের নীচুতলা পর্যন্ত ব্যাপ্ত করে — জাতীয়তাবাদকে গণহিস্টেরিয়ায় পরিণত করতে ভূমিকা নেয়। এভাবেই বিশ্বজুড়ে মুসলিম, শরণার্থী, চৈনিক, জিপসি, ইহুদি, অভিবাসী এবং এমন নানান ‘অপর’-এর প্রতি ক্ষুদ্র মানবের বিদ্রোহ দেখা যায়।
চার
আলোচনার এই পর্যায়ে এসে এবারে আমাদের ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে ডানপন্থী রাজনীতির অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। বুঝে নিতে হবে, নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে এই ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদী লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি আমাদের দেশের সমাজ-কাঠামোর কতটা গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে নরেন্দ্র মোদি যখন দিল্লির মসনদের উপর দৃষ্টি দিচ্ছিলেন তখন থেকেই এই রাজনৈতিক প্রকল্পের সূচনা। এখানে শুরুতেই প্রথাগত এলিট-তন্ত্রের সঙ্গে নয়া এলিট-তন্ত্রের এক দ্বন্দ্বকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। কংগ্রেসমুক্ত ভারত অর্জনের মোদির উদ্দেশ্যকে চিত্রিত করা হয়েছিল বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দুর্নীতিগ্রস্ত প্রথাগত এলিটদের থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে। বাস্তবিকপক্ষে, মনমোহন সিং-এর শাসনের শেষ দিকে ভারত অতিমাত্রায় দুর্নীতি-বিদ্ধ হয়েছিল এবং ২০১১-তে আন্না হাজারের জনলোকপাল আন্দোলন এই দুর্নীতি বিরোধী জেহাদকে জনচেতনায় প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল। আন্নার আন্দোলন ও প্রচারকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের পক্ষে নিতে পেরেছিলেন মোদি। [৬]
পাশাপাশি, মনমোহন সরকারের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার নীতিগুলি যেমন দেশের ২৭% বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণ বা ‘মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ রোজগার সুনিশ্চিত আইন’ প্রণয়ন দেশের অভ্যন্তরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং এক ‘এলিট প্রতিশোধের’ [৭] পটভূমিও প্রস্তুত করেছিল। সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তবর্গ এই ধারণার বশবর্তী হয়েছিল যে, দশকের পর দশক ধরে জাতিগত সংরক্ষণের রাজনীতি তাদের কেবল বঞ্চিতই করে চলেছে। সংরক্ষণের রাজনীতির বিপরীতে তাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল রক্ষণশীল সামাজিক স্থিতাবস্থা। লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির উপস্থাপনের এর থেকে ভালো পূর্বশর্ত আর কী বা হতে পারে! এই পটভূমি থেকেই ২০১৪-এর নির্বাচনে শুরু হয়েছিল নরেন্দ্র মোদির ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রচার।
২০১৪-এর নির্বাচনি প্রচারে মোদি এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন যে, সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয় একক নির্দিষ্ট কোন শ্রেণি বা জাতি নয় বরং একটি জাতিসত্তা — যা সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। নরেন্দ্র মোদির এই ‘ক্রস ক্লাস’ এবং ‘ক্রস কাস্ট’ ভাবমূর্তি রক্ষণশীল উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের নিয়ে তৈরি এলিট সম্প্রদায়কে আপ্লুত করেছিল। পাশাপাশি প্রভাবিত করেছিল দেশের নব্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে। এঁরা হল সেই নতুন সামাজিক বর্গ যাঁরা গত দুই দশকের আর্থিক উন্নয়নের কিছুটা অংশীদারিত্ব পেয়েছিল। গ্রাম থেকে শহরে সদ্য অভিবাসিত হওয়া এই জনগোষ্ঠী দেশে সংরক্ষণের চূড়ান্ত আওতাভুক্ত সরকারি চাকরির আশা ত্যাগ করে দেশের বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাথা গলানোর স্বপ্ন দেখছিল। এঁরা প্রভাবিত হয়েছিল গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদির বেসরকারি শিল্প টেনে আনার ‘সাফল্য’-তে। এখানে লক্ষণীয় যে, ভারতের এলিট সম্প্রদায় তার পছন্দমাফিক ‘বিকাশ পুরুষ’ সংক্রান্ত মোদির ভাবমূর্তিকেই গ্রহণ করল, গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গে লেপটে থাকা মোদির কলঙ্ককে পরোয়া করল না।
মোদির উত্থানের এই ভাষ্য পড়তে পড়তে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠবে যে এখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের ভূমিকা কোথায়। তাঁরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন যে ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে হিন্দুত্বই তো ছিল বিজেপির দল হিসেবে বেড়ে ওঠার মূল রসদ। আমি তাঁদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বিনীতভাবে বলব, ২০১৪ এর নির্বাচনে ভারতে ডানপন্থী রাজনীতির সাফল্যের কারিগর ছিল ‘উন্নয়ন’-এর আখ্যান, এখানে হিন্দুত্ব ‘সাব টেক্সট’-এর বেশি কিছু ছিল না। একে আড়ালে লালন করা হচ্ছিল পরবর্তী পর্যায়ে বৃহত্তর ভাবে উপস্থাপনের জন্য। সামনে রাখা হয়েছিল, নব্য এলিটের সুদিনের অন্বেষাকে, যাকে সুহাস পালশিকর ‘Middle class’s search for sanitized politics’ বলছেন। [৮]
সুহাস পালশিকর তাঁর অন্য একটি প্রবন্ধেও [৯] দেখিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীত্বের সূচনাপর্বে মোদি হিন্দুত্ব সম্পর্কে যত না বলছিলেন তার থেকে বেশি বলছিলেন একটি শক্তিশালী দেশ গড়ার প্রয়োজন ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে। এই কৌশল একদিকে মোদিকে বিপুল জনপ্রিয় করল, সেইসঙ্গে সামগ্রিক জাতীয়তাবাদী ভাষ্য, যেখানে একই সঙ্গে উন্নয়ন, জাতীয় শক্তি ও হিন্দুত্বকে সংশ্লিষ্ট করা যায়, তার প্রতিও সংখ্যাগরিষ্ঠের অপার সমর্থন এনে দিল। এরপর ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমার্থক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দুত্ব মোদির এজেন্ডায় আরও স্পষ্টভাবে কেন্দ্রীভূত হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকে ‘ভারতমাতার’ জয়ধ্বনি, গোরক্ষা, আন্তঃধর্মীয় প্রেমের সম্পর্কে সাম্প্রদায়িক পুলিশিং, নারীর যৌনতা, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ‘ঘরে ফেরার’ প্রচারকে সামনে রেখে। পাশাপাশি ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর সাফল্যের বিপুল প্রচার করে শক্তিশালী ভারতে শক্তিশালী মোদির অপরিহার্যতাকে প্রমাণ করার তাগিদ দেখা যায়। এভাবেই এদেশে কর্তৃত্ববাদী লোকরঞ্জনবাদকে ভিত্তি করে জাতি ও জাতীয় সংস্কৃতির একক ধারণা তৈরি এবং সেখানে মোদিকে ঠিকঠাকভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয়তাবাদের এই সমস্ত উদ্যোগগুলিকে আবার ‘প্রকৃত ভারতীয়’ ও তার শত্রুদের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজনরেখা টানার এবং সেই শত্রুদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য জনসমর্থন একত্রিত করার একটি জুতসই প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। এখানে প্রকৃত শত্রু কেবল মুসলিম, দলিত বা জেএনইউ-এর ছাত্ররা নয়, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরাও যাঁরা সরকারকে বারবার প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করার সাহস দেখান। ফলে, এই সমস্ত ‘অপর’-দের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে দেগে দেওয়া হয়, অনলাইন ট্রোলের দ্বারা হেনস্তা করা হয়, আবার কখনও কখনও পুরোপুরি চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। এম এম কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসরে, নরেন্দ্র দাভোলকর বা গৌরী লঙ্কেশের মতো পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা ডানপন্থী রাজনীতির নির্মমতাকে স্পষ্ট করে। [১০]
আবার কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ ‘ক্ষুদ্র মানব’-এর হাতে পড়ে বিচারবহির্ভূত পদ্ধতি অনুসরণ করে, ফলে নিরীহ ‘অপর’-দের উপর লিঞ্চিং আর হিংস্রতা দৈনন্দিন হয়ে ওঠে। এই ‘অপর’ কখনও হন মুসলিম পশু ব্যবসায়ী, কখনও ফেজ টুপি পরিহিত মাদ্রাসার ছাত্র, আবার কখনও বা হাথরসের হতভাগী দলিত মেয়েটি। দেশের আইন বা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মূল্যবোধের প্রতি কোনও আনুগত্য ছাড়াই ক্ষুদ্র মানব সমষ্টিগত ভাবে মুহুর্তের মধ্যে ক্রোধোন্মত্ত ‘মব’-এ পরিণত হয় এবং পছন্দমাফিক ‘অপর’-এর প্রতি হিংসা নামিয়ে আনে। ভারতে এই ‘মব’ তৈরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র মানবের নিজস্ব মানসিকতা যেমন দায়ী তেমনি দায়ী মিডিয়া এবং নিউ ইনফরমেশন সোসাইটি, যা নিয়ে পৃথকে বিশদে আলোচনার অবকাশ রইল। যাই হোক, ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে এই ভয়াবহ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে ২০১৮-র ১৭ জুলাইতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে [১১] এই অসহিষ্ণুতার পরিবেশের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং সরকারকে এবিষয়ে “প্রতিরোধমূলক, প্রতিকারমূলক এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা” অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ক্ষুদ্র মানবের অন্তর্ভুক্তি ভারতের ডানপন্থী রাজনীতিকে একদিকে হিংসাশ্রয়ী করেছে, অন্যদিকে অভূতপূর্ব নির্বাচনি সাফল্যও এনে দিয়েছে। ২০১৪-১৯ পর্বে দেশে বেকারত্ব, অসাম্য বা কৃষি সংকট তীব্র হলেও, মোদির দেওয়া প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ থাকলেও ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, সেইসঙ্গে দেশে অভূতপূর্ব মেরুকরণকেও স্পষ্ট করেছে। শুধু তাই নয়, ২০১৪-এর তুলনায় ২০১৯ এ বিজেপি নিম্নবর্ণের গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ৩৪% থেকে ৪৪%, দলিতদের মধ্যে ২৪% থেকে ৩৪% এবং আদিবাসীদের মধ্যে ৩৭% থেকে ৪৬% ভোটের ভাগ বাড়িয়েছে। আবার দরিদ্র ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ভোটের ভাগ বেড়েছে ২৪% থেকে ৪৭%। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে যেখানে সমগ্র হিন্দু জনগোষ্ঠীর ৩৬% ভোট বিজেপি পেয়েছিল, সেখানে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে তার ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৪৪%। [১২] ভারতীয় আমজনতা আজ আর নরেন্দ্র মোদিকে শুধুমাত্র ‘বিকাশ পুরুষ’ বা ‘উন্নয়ন পুরুষ’ হিসেবে দেখে না, তারা মনে করে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ মোদি বহিঃশত্রু এবং অভ্যন্তরীণ শত্রুর হাত থেকে দেশকে এক শক্তিশালী অতন্দ্র প্রহরীর মতো রক্ষা করছেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির এই সাফল্য ২০১৯-এর পর আরও হিন্দুত্ব ঘেঁষা করে তুলেছে মোদির রাজনীতিকে। আগস্ট ২০১৯-এ, তাঁর নতুন মেয়াদ শুরুর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মোদি সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে, যা এতদিন ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদার গ্যারান্টি দিয়ে এসেছে। উপরন্তু, সরকার ‘তিন তালাক’-এর বিরুদ্ধে আইন পাস করেছে। মনে রাখতে হবে, এযাবৎকাল ভারতের সংবিধান অনুযায়ী মুসলিম ব্যক্তিগত আইনই বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়গুলি পরিচালনা করার অধিকারী ছিল। মোদি সরকারের মেরুকরণের সর্ববৃহৎ সিদ্ধান্তটি ছিল ডিসেম্বর ২০১৯-এ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বিধিবদ্ধকরণ যা ধর্মকে প্রথমবারের মতো নাগরিকত্বের ভিত্তিরূপে গণ্য করেছে। এর সঙ্গেই সরকার নাগরিকদের একটি দেশব্যাপী রেজিস্টার (NRC) সংকলনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, যার জন্য সমস্ত ভারতীয়কে তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। যে সমস্ত মুসলমান প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেশ করতে অক্ষম তারা বিদেশি বলে গণ্য হবে এবং CAA-এর অধীনে তাদের নাগরিকত্বের পথ থেকে বঞ্চিত করা হবে। [১৩] বলা বাহুল্য, এই সমস্ত পদক্ষেপ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয়তাবাদের সর্ববৃহৎ ‘অপর’-দের আরও কোণঠাসা করল, তবে স্পষ্ট করল ডানপন্থী রাজনীতির শক্তপোক্ত ভাবমূর্তি, সেইসঙ্গে পরবর্তী অগ্রগমন।
পাঁচ
এই পর্যায়ে এসে বের্টোল্ট ব্রেখটের নাটক ‘লাইফ অফ গ্যালিলিও’-র [১৪] সেই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপগুলো একবার আমরা স্মরণ করব। নাটকের বিশেষ সন্ধিক্ষণে আন্দ্রেয়া বিলাপ করে বলছেন, “অসুখী সেই দেশ যেখানে কোনও নায়কের জন্ম হয় না”। ক্রমাগত হয়রানির শিকার গ্যালিলিও এর উত্তরে বললেন, “অসুখী সেই দেশ যেখানে কোনও নায়কের প্রয়োজন হয়”। চার্চ ও রাষ্ট্রশক্তির সম্মিলিত কর্তৃত্ববাদের মুখোমুখি হওয়া গ্যালিলিওর এই উপলব্ধিকে আজকের লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদের কষ্টিপাথরে বিচার করার সময় এসেছে। বোঝা দরকার, ডানপন্থী নায়ক তথা সুপারলিডারদের শক্তিশালী উপস্থিতি সত্ত্বেও তাদের দেশগুলোর বাস্তবিক পরিস্থিতি কী? সমীক্ষা বলছে, দেশগুলো সত্যিই অসুখী কারণ গণতন্ত্র সেখানে বিপন্ন। ‘দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচক-২০২১’ [১৫] অনুযায়ী, লোকরঞ্জনবাদের চাপে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন– এই চার ক্যাটাগরির মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্রের অবস্থাই আজ সবচেয়ে নড়বড়ে। ইকোনমিস্ট-এর সমীক্ষায় নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যক্রম, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা — এই পাঁচটি বিষয় ভিত্তি স্বরূপ রূপে গ্রহণ করায় সাধারণের চোখেও বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতির গ্রাফ সহজেই ধরা পড়ে।
বাস্তবিকই, পূর্ণ গণতন্ত্র আজ নড়বড়ে, কারণ এর প্রধান ভিত্তি জনগণের ধারণাটিই বেদখল হয়ে গেছে। আপ্পাদুরাই-এর অন্তর্দৃষ্টি অনুসরণ করে বলতে পারি, আজকের ডানপন্থী শাসন, সুপারলিডার ও এলিটদের সহযোগিতায় ‘জনগণ’-এর নামে মূলত এক অনুসারী গোষ্ঠী, এক ক্রোধোন্মত্ত মব তৈরিতে সক্ষম হয়েছে, যাঁরা লিবারেল গণতান্ত্রিক জনপরিসরে নিজেদের বাস্তব পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনও পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে শেষমেশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, কোনও এক ‘অতি-মানব’ সুপারলিডারে আস্থা রাখা ছাড়া, যুদ্ধের উন্মাদনা সম্বলিত কোনও মতাদর্শের খরিদ্দার হওয়া ছাড়া তাঁদের জাগতিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। এদের প্রবল দাপাদাপিই গণতন্ত্রের ভিতকে নড়িয়ে দিয়েছে, ডেমোক্রেসিকে ধীরে ধীরে মবোক্রেসি হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। আপ্পাদুরাই এজন্যই বলছেন, এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমজনতা কেবল গণতন্ত্র থেকে ব্যাপকমাত্রায় নিষ্ক্রমণের উপকরণ মাত্র। [১৬]
আমরা আগেই দেখেছি, বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী নায়কেরা ‘আপন’ এবং ‘অপর’-এর বিভাজনের খেলায় সিদ্ধহস্ত। তাঁদের এই খেলার উপকরণ জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আবার কখনও বা পরিচয় কেন্দ্রিক রাজনীতি। এই উপকরণগুলোকে ব্যবহার করে তাঁরা হামেশাই তাঁদের ঘোষিত জাতীয়তাবাদের ‘অপর’-দের নাগরিক অধিকারকেই হরণ করতে চায়, পিষে দিতে চায় তাদের মানবিক চাহিদাকে। এতে লঙ্ঘিত হয় গণতন্ত্রে বহু মত, বহু স্বর এর গুরুত্ব। পাশাপাশি, একই কায়দায় তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দুর্বলতা, ব্যর্থতা, কিংবা জনগণের প্রতিদিনের সমস্যাগুলোকে জনগণের কাছ থেকেই লুকিয়ে রাখেন। ফলে গণতান্ত্রিক পরিসরে জবাবদিহিতার প্রয়োজন আর থাকে না। এইভাবে, লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে অকেজো করে সার্বিক ভাবে জনগণের ক্ষমতায়নকে সংকুচিত করে। তাদের রাজনৈতিক পছন্দগুলোকে স্বাধীনভাবে সংগঠিত ও প্রকাশ করার জন্য নাগরিক স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেয়। তারা বহুত্ববাদী ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আলিঙ্গন করে নেয় সাংস্কৃতিক বর্জনের তত্ত্বকে। [১৭]
সর্বোপরি, ‘গণ ইচ্ছা’-র দোহাই দিয়ে তাঁরা বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ করতে চায়। বিরোধী দলের সমালোচনাকে তাঁরা ষড়যন্ত্র বলে সাব্যস্ত করে। সংবাদমাধ্যম সমূহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভয়ভীতি, হামলা-মামলা ইত্যাদির আশ্রয় নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা সরকারি বিজ্ঞাপনের টোপকেও ব্যবহার করেন। এসব পদক্ষেপের কারণে কর্তৃত্ববাদ বিরোধী সংবাদমাধ্যমগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায় বা স্ব-সেন্সরশিপের আওতায় থমকে যায় — গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মুখ থুবড়ে পড়ে। আবার ক্ষমতায় আসার পর লোকরঞ্জনবাদী শাসকেরা হামেশাই আইনবিভাগের উপর নির্বাহীবিভাগের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বব্যাপী সুপার লিডারদের ‘অর্ডিন্যান্স’ প্রীতি এই বাস্তবতার অমোঘ প্রমাণ। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাহী ক্ষমতার ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ এতে বিনষ্ট হয় [১৮] এবং যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় কর্তৃত্ববাদী নায়কের হাতে। বিভিন্ন জাতীয় বাস্তবতায় এই যুক্তিগুলো কিছুটা হলেও বোধগম্য।
ছয়
সুতরাং, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, কর্তৃত্ববাদ আর জাতীয়তাবাদের শক্তিতে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে লোকরঞ্জনবাদের অশ্বমেধের ঘোড়া আজ টগবগিয়ে ছুটছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে; সেইসঙ্গে প্রভাবিত করতে চাইছে বিশ্বে লিবারেল ডেমোক্রেসির উত্তরাধিকারকে এবং আমাদের এতদিনের তৈরি হওয়া রাজনৈতিক আচরণকে। বুর্জোয়া মানবতাবাদ, উদারতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে যে রাষ্ট্রপ্রণালী প্রচলিত ছিল, যেগুলো অন্তত কিছুটা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় কাজ করত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন ছিল, ক্ষমতার অন্তত লোকদেখানো বিভাজন ছিল, সেগুলোর সবকিছুই আজ পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী রাজনৈতিক পরিসরে নব্য এলিটদের অভ্যুত্থান এবং তাঁদের দ্বারা সুবিধামতো জাতীয়তাবাদের ব্যবহার এই পরিবর্তনের প্রধান সঞ্চালক। যদিও এই সমস্ত পরিবর্তনকে সংঘটিত করা হচ্ছে ‘জনতা’-র নামে, ‘জনতা’-র আপাত বিপুল অংশগ্রহণের নজিরকে সামনে রেখে। এখানেই প্রতি-উত্থিত নব্য এলিটদের সাফল্য, ডানপন্থী রাজনীতির প্রাপ্তি।
এমতাবস্থায় গণমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা যাঁরা বলেন, বিশ্বাস করেন এবং এই রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকেন তাঁদের যেমন নব্য এলিটদের প্রতি-উত্থানকে আমলে নিতে হবে তেমনই সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে লোকরঞ্জনবাদের বীভৎস বিভাজনের রাজনীতির প্রো-অ্যাকটিভ (রি-অ্যাকটিভ নয়) জবাব তৈরি রাখতে হবে। কারণ, যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডানপন্থী রাজনীতি নিজেকে আপডেটেড করছে, প্রতিনিয়ত কৌশল বদলাচ্ছে, তেমন ক্ষিপ্রতা অর্জন করতে না পারলে লোকরঞ্জনবাদের অশ্বমেধের ঘোড়ার গতিরোধ অসম্ভব। নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির কৌশল নির্ধারণের আলাপ শুরু এবার তাই জরুরি।
তথ্যসূত্র :
১) Eric J. Hobsbawm, ‘Nations and Nationalism since 1780. Program, Myth, Reality.’ Cambridge, Cambridge University Press, 1990.
২) A. Appadurai, ‘Democracy Fatigue’, In H. Geiselberger, (ed) The Great Regression, Polity Press, 2017.
৩) A Appadurai, ‘We Are Witnessing the Revolt of the Elites’, The Wire, Apr. 22, 2020.
https://m.thewire.in/article/politics/populism-elite-narendra-modi-donald-trump/amp
এই লেখাটির বাংলা অনুবাদ দেখা যেতে পারে https://www.auraj.net/%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A5%A4%E0%A5%A4-%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%BE/4044/%A6%87%E0%A5%A4%E0%A5%A4-%E0%A6%A8%E0%A7ern.
৪) Dipesh Chakraborty, ‘Ethnicity, Habitations of Modernity : Essays in the Wake of Subaltern Studies’, the University of Chicago Press, Chicago, 2002
৫) Aditya Nigam, ‘Fascism, the Revolt of the ‘Little Man’ and Life after Capitalism – Manifesto of Hope III’, kafila.online, 2020.
৬) Vidya Subrahmaniam, ‘Deconstructing the Anna Hazare Campaign’, The Hindu, 16 April 2011, https://www.thehindu.com/opinion/lead/ Deconstructing-the-Anna-Hazare-campaign/article14687083.ece.
৭) Angana P Chatterji, Thomas Blom Hansen and Christophe Jaffrelot (eds), ‘Majoritarian State : How Hindu Nationalism is Changing India’, Harper Collins, 2019.
৮) Suhas Palshikar, ‘Politics of India’s Middle Class’, in Imtiaz Ahmed and Helmut Reifield (eds), Middle Class Values in India and Western Europe, New York, Routledge, 2018.
৯) Suhas Palshikar, ‘Toward Hegemony: The BJP beyond Electoral Dominance’, in Angana P Chatterji, Thomas Blom Hansen and Christophe Jaffrelot (eds) Majoritarian State, Harper Collins, 2019.
১০) ডানপন্থী রাজনীতির সহিংসতার বিস্তৃত বিবরণের জন্য দেখা যেতে পারে : Maya Mirchandani, ‘Digital hatred, Real Violence: Majoritarian Radicalisation and Social Media in India’, Orf, 29 August 2018 https://www.orfonline.org/research/43665-digital-hatred-real-violence-majoritarian-radicalisation-and-social-media-in-india/.
১৩) ‘Narendra Modi’s Sectarianism Is Eroding India’s Secular Democracy’, Economist, January 23, 2020.
১৪) https://www.arvindguptatoys.com/arvindgupta/lifeofgalileo.pdf
১৬) A Appadurai, ‘We Are Witnessing the Revolt of the Elites’, Op. cit
১৭) Jan-Werner Müller, ‘The People Must Be Extracted from Within the People : Reflections on Populism’, Constellations, Vol. 21, No. 4, December 2014.
১৮) Larry Diamond, ‘When Does Populism Become a Threat to Democracy?’, paper for Freeman Spogli Institute for International Studies Conference on Global Populisms, Stanford University, 3-4 November 2017.