দেবাশিস মল্লিক
জাতি বা Nation-এর ধারণাটা এসেছে উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে। তার আগে বর্ণবিভক্ত ভারতীয় সমাজে জাতি বলতে একমাত্র জাতপাত বা Race-কেই বোঝাত। ফলে জাতীয়তাবাদ বা Nationalism-এর ধারণা আরও অর্বাচীন কালের। Nationalism বলতে Oxford Advanced Learners Dictionary জানাচ্ছে — “the desire by a group of people who share the same race, culture, language etc. to form an independent country. A feeling of love for and pride in your country, a feeling that your country is better than any other country.”[১] এর মধ্যে তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি যাবতীয় বিবাদ বিসংবাদের গোড়া, যা উগ্র জাত্যভিমান, অন্ধ দেশভক্তি নির্মাণ করে। কবি আবেগপ্রবণ হয়ে স্বদেশকে সকল দেশের সেরা বললে বা ভাবলে কোনও প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয়তো হয় না। কিন্তু কোনও রাষ্ট্রের বহু সংখ্যক নাগরিক বিশেষত ক্ষমতাসীন শক্তি যখন একথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন তখন পরদেশ আক্রমণও তাঁদের চোখে পরহিতকর ব্রত বলে মনে হতে থাকে। বিশ শতকে দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ পরিভ্রমণকালে ইউরোপে সর্বত্র এই উৎকট ন্যাশনালিজমের মধ্যে ঘোরতর বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতা উপলব্ধি করেছিলেন।
আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে উনিশ শতকে নগরায়ন ও আধুনিকতার যুগ্ম অভিঘাতে কৃষিভিত্তিক যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছিল, পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে গড়ে উঠছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। এর ফলে সমাজজীবনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছিল, তা পূরণের জন্য অন্যরকম যৌথতার প্রয়োজন অনুভূত হল। এছাড়াও পরাধীনতার কারণে শাসিতের মনে যে হীনম্মন্যতা, যে গ্লানিবোধ তার থেকে উত্তরণে, হৃত আত্মমর্যাদা ফিরে পেতে আশ্রয় নিতে হল ইতিহাসের ধূসর জগতে, অতীত গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি উদ্ধারে। যদিও এই আত্মমর্যাদাবোধ তখনও অবধি যে স্বাধীনতা স্পৃহায় রূপান্তরিত হয়ে যায়নি তা স্পষ্টতা পায় ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহের ব্যাখ্যায় — “… The Self-respect at issue here was the Self-respect of a subject people reconciled to its subjection. Its loss was not ascribed to want of political independence, but to want of recognition within the framework of Colonial dependence.”[২]
জাতিসত্তার পরিচিতি একটি কল্পিত ধারণা হলেও এর সাথে বহুমানুষের আবেগ মিশে এমন সংহতি তৈরি হয়, যে জাতিসত্তার সম্মানরক্ষায় অবলীলায় প্রাণ দেওয়া ও নেওয়া যায়। যে ক-টি উপাদানের ভিত্তিতে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষার বন্ধন। তবে এই বিশালায়তন ও বহুভাষিক দেশে কোনও একক ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয় আবেগ সংহত করা অসম্ভব। বিকল্প হিসাবে পাওয়া গেল হিন্দু ও আর্য সভ্যতার সুপ্রাচীন গরিমা — যার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া গেল ভারতীয়ত্বের ধারণাটি। যদিও হিন্দু বলে কোনও গোষ্ঠী যে প্রাচীন ভারতে ছিল তার প্রমাণ মেলে না। অন্যদিকে আর্য ধারণাটিকে নৃতত্ত্ব অতিকথনের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয় না। তবে কে না জানে অতিকথা গণমানসে প্রকৃত সত্যের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। এইভাবে ঔপনিবেশিক শাসকের মোকাবিলায় গর্বোদ্ধত ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদের সামনে খাড়া করা গেল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, শুধু তাই নয় রীতিমত শ্লাঘার সঙ্গে প্রমাণ করে দেওয়া গেল শাসকের তুলনায় শাসিতের জাতিসত্তার পরিচিতি আকারে বৃহত্তর এবং প্রাচীনতর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ফলে জাতীয়তাবাদের স্বরূপসন্ধান করতে গিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর কাছে নির্মিত জাতিসত্তার দুটি অভিমুখ তৈরি হচ্ছে — ভারতীয় জাতি ও বাঙালি জাতি। ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক জাতিসত্তার ধারণাটি যেহেতু সহজতর, তুলনায় ভারতীয়ত্বের ধারণাটি বিমূর্তপ্রায়, বাঙালি কবি সাহিত্যিকেরা কবিতা-গান-নাটকে দেশাত্মবোধ ফুটিয়ে তুলতে ভারতমাতার তুলনায় বঙ্গমাতায় অনেক বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেছেন। এমনকি যে বঙ্কিমচন্দ্রের অভিমত ভারতবাসী কোনোদিনই ইতিহাস-সচেতন ছিল না, তাই ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস কোনোদিন লেখা হয় নি বলে তাঁর আক্ষেপ ; তিনিও আনন্দমঠ উপন্যাসে ভবানন্দ-কণ্ঠের “সপ্তকোটীকণ্ঠ-কল-কল-নিনাদকরালে!/ দ্বিসপ্তকোটীভূজৈর্ধৃতখরকরবালে/ অবলা কেন মা এত বলে”[৩] — এই গানে যে জাতির উত্থান কল্পনা করেছিলেন, সে জাতি হল বাঙালি জাতি। মাইকেল মধুসূদন প্রবাসে থাকাকালীন দেশভক্তিমূলক যে চতুর্দশপদী কবিতাগুলি লিখেছিলেন, তার কোনোটি বঙ্গভূমি আবার কোনোটি বঙ্গভাষার প্রতি নিবেদিত। রবীন্দ্রনাথের কিছু দেশাত্মবোধক কবিতায় ভারতভাবনা থাকলেও বেশির ভাগ কবিতা বঙ্গবিষয়ক। কখনও সেখানে বঙ্গপ্রকৃতির সৌন্দর্য বন্দনা, কখনও আবার সাতকোটি সন্তানকে মানুষ হিসাবে স্বাবলম্বী না করে নিছক পরনির্ভর বাঙালি করে রাখার জন্য বঙ্গমাতাকে গঞ্জনাদান। এভাবে উনিশ শতকে অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের মনে বঙ্গভাবনা ও ভারতভাবনা সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হলেও বাঙালির জাতীয়তাবাদী আবেগের মূল ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা আর বাঙালি সংস্কৃতি। দেখা যায় যখন তাঁরা জাতির প্রাচীন গৌরবের কথা স্মরণ করছেন, তখন তাঁদের চিন্তায় হিন্দুত্ব, আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির পথ বেয়ে এসেছে ভারতভাবনা। অথচ জাতীয় ঐক্যের চিন্তায় মানসপটে ভেসে উঠেছে বাঙালি জাতির কথা।
বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম পুরুষ বঙ্কিম তাঁর আখ্যানে অনুসন্ধান করছিলেন স্বজাতির আত্ম-অভিজ্ঞানটিকে। ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে তাঁর ইংরাজি শিক্ষিত তরুণ চিত্তে এ তাঁর নিজস্ব দায় বলে মনে হয়েছিল। আত্মপরিচয়লাভের জন্য ব্যাকুল স্বজাতি আর দ্বন্দ্বমুখর সেই কালপর্বে বঙ্কিমের উপন্যাসে কখনও কখনও রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ব্যক্তি এসে দাঁড়িয়েছে পরস্পরের প্রতিস্পর্ধী রূপে। ফলে জেবউন্নিসা ও মবারক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, শৈবলিনী কখনও তার ঈপ্সিত মানুষকে পায়নি, প্রফুল্লর সংসারজীবনের ছবি কেমন যেন আরোপিত বলে মনে হয়, আনন্দমঠের সন্তানদলের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গেছে, ক্ষণিকের বিচ্যুতিতে সীতারামের হিন্দুসাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন ভেসে গেছে! আসলে ইতিহাস ও রোমান্সের ধূলিজাল থেকে সমকালকে বঙ্কিম উদ্ধার করে আনতে পারেননি। তবে দেশ তাঁর কাছে মাতৃমূর্তিতে প্রতিভাত হয়েছে। যেমন আনন্দমঠ উপন্যাসে ব্রহ্মচারী মহেন্দ্রকে মাতৃমূর্তি দর্শন করালেন। প্রথমে দেখালেন সর্বাভরণভূষিতা ঐশ্বর্যশালিনী জগদ্ধাত্রীমূর্তি, ব্রহ্মচারী পরিচয় দিলেন “মা — যা ছিলেন।” এরপর দেখালেন হৃতসর্বস্বা, মুণ্ডমালিনী নগ্নিকা কালী — “মা যা হইয়াছেন।” সব শেষে সুবর্ণনির্মিত জ্যোতির্ময়ী দশভুজা — “মা যা হইবেন।”[৪]
রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের বাস্তব প্রেক্ষিতে রচনা করেছিলেন ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬) উপন্যাস। আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, নেতৃত্বের সংকীর্ণ অনুদারতা, স্বার্থপরায়ণতা এখানে স্পষ্ট রূপ পেল। ঘরে এবং বাইরে বিপর্যয় চূড়ান্ত হল যখন নিখিলেশের আত্মবিসর্জনে নারীজীবনের চরম সর্বনাশের শেষে বিমলা আত্মস্থ হওয়ার মধ্যে দিয়ে। ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৮) প্রতীয়মান করে তুলেছিল চরমপন্থী আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে, যার মধ্যে পড়ে অতীন ও এলা না খুঁজে পেল দেশকে, না লাভ করল তাদের প্রেমের সার্থকতা। তবে পূর্ববর্তী ‘গোরা’ (১৯১০) উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকীয় বাঙালি তথা ভারতীয়ের আত্মপরিচিতির অনুসন্ধানকে প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন। গোরা উপন্যাসের প্রথম থেকে গোরা এতটাই রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদে আচ্ছন্ন ছিল যে ব্রাহ্মণত্বের অহংকারে সে একসময় অবধি শুদ্ধতা রক্ষার জন্য দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ পরিহার করে চলতে চেয়েছে।[৫] অথচ একথা ভোলার নয় যে গোরা নিছক পুণ্য অর্জনের জন্য কিংবা ধর্মীয় আচার পালনের উদ্দেশে ত্রিবেণীতে স্নান করার পরিকল্পনা করেনি, দেশের হৃদয়ের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অবকাশ মিলবে এই আশায় সে ত্রিবেণী গিয়েছে।[৬]
আসলে রবীন্দ্রনাথের সামনে বিশাল ভারতবর্ষের উদার প্রেক্ষাপট। মানব আমার জাতি, বিশ্ব আমাদের স্বদেশ — শেষত এই হল গোরার বক্তব্য। ভিন্ন একটি পথ বেঁকে গেছে জাতীয়তাবাদের দিকে। এই পথটি সংকীর্ণ, অন্ধকার, হানাহানি ও বিদ্বেষের পথ বলে রবীন্দ্রনাথ পরিহার্য বিবেচনা করেন। গোরা উপন্যাস লিখে ফেলার দু-তিন মাসের মধ্যেই গীতাঞ্জলি কাব্যের অন্তর্গত ‘হে মোর চিত্ত’, ‘পুণ্যতীর্থে জাগ রে ধীরে’, ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন’, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ ইত্যাদি কবিতাগুলি লেখা হয়, যেগুলি রবীন্দ্রনাথের ভারতভাবনার পরিচায়ক।
ঔপনিবেশিক পরিবেশে স্বদেশভাবনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সামাজিক সংস্কার ইত্যাদি বাস্তব উপাদান। অথচ সাহিত্যক্ষেত্রে স্বাদেশিকতার মূল ভিত্তি বিশুদ্ধ ভাবাবেগ। সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পে-উপন্যাসে ভারতভাবনা আলোচনায় অবশ্যই স্মরণে রাখতে হয় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৮ সাল, মাত্র নয় বছরের রাজনৈতিক জীবনে অর্জিত তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিন-তিনবার তাঁর কারাবরণের কথা। জেলে বসেই প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ লিখছেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে একই পরিবারের চারজন সদস্য একটা রাত কীভাবে উদ্বেগে বিনিদ্র কাটাচ্ছেন, তাঁদের চিন্তাভাবনায়, অতীতচারণায় ফুটে উঠছে ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান! একটি পরিবারের পারিবারিক বিপর্যয়চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের এক বিশেষ সন্ধিপর্বের ইতিকথা।
ভারতীয় জনচেতনায় ভক্তিভাবনার পরম্পরায় প্রিয়জন বা শ্রদ্ধেয়জনকে অহৈতুকী ভক্তিধারায় ধৌত করে, অলৌকিকত্ব আরোপ করে তাঁকে পরম পূজ্য বানিয়ে তোলা হয়। রামচরিতের আদলে ঢোঁড়াই-এর বিকশিত হয়ে ওঠার পর্বে রামায়ণকে বাদ দিলে তার চেতনায় সবচেয়ে বড়ো প্রভাব গানহী বাওয়া বা মহাৎমাজীর। এদেশের লাখো নিরক্ষর মানুষের বিশ্বাসে গান্ধিজি স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্রের অবতার। ১৯৩৪ সালে বিহারে ভূমিকম্পের পর গান্ধিজি যখন ‘হাওয়াগাড়ি’ করে গিয়েছিলেন, তখন অত লোকের ভিড়েও বাদর বাহরগামিয়া নাকি মহাৎমাজীর ‘বদনসে জিয়োতী’ নির্গত হতে দেখেছিল। আর তার মার কাছে মহাৎমাজী তাহার “গোঁসাই (গৃহদেবতা) অপেক্ষা জাগ্রত দেবতা।” [৭] আবার একই সময়কালের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে রচিত ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসে সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে দেখানো হল নিম্নবর্গীয় জনতার দৃষ্টিতে। এই প্রান্তিক মানুষজনের বিশ্বাসে জননায়ক গান্ধিজি হয়ে যান সংসারত্যাগী নাঙ্গা সন্ন্যাসী ‘গানহী বাওয়া’, আর তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় ‘সতিয়াগিরির তামাসা’। দেশের স্বাধীনতার এই লড়াইয়ে নিজেদের যুক্ত করতে অসমর্থ এই মানুষগুলো পুরো বিষয়টাকে দেখে একটা অলঙ্ঘ্য দূরত্ব থেকে “বাবুভাইয়াদের কাংগ্রিস আর দারোগা হাকিমদের সরকার! এদের মধ্যে লেগেছে টক্কর।” [৮]
আইন অমান্য আন্দোলনের অভিঘাত সারা দেশের সঙ্গে এসে পড়েছে ধাঙ্গড়টোলী ও তাৎমাটোলীতে। যেখানে নিমক তৈরি হবে সেটি মহাৎমাজীর থান, তাই মেয়েরা সেখানে সন্ধেবেলায় গিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে এল। আবার ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় আপামর জনসাধারণের বিপুল উৎসাহ, সীমাহীন অজ্ঞতা, বিশ্বাস আর বিভ্রান্তির ইতিহাস সমর্থিত বিবরণ দিয়েছেন সতীনাথ। সরলমনে তারা বিশ্বাস করেছে ব্যালট পেপার হল মহাৎমাজীর চিঠি আর ব্যালট বক্স হল মহাৎমাজীর বাক্স, তাই খাদির মত তারও রঙ সাদা। “ভোট দেওয়ার আগে পিঠো সাঁওতাল ভক্তিভরে বাক্সের গায়ে সিঁদুর লাগায়, ঢোঁড়াই বাক্সটাকে কয়েকবার প্রণাম করে নেয়।” [৯]
আবার ১৯৪২ সালে আগস্ট আন্দোলনের প্রাক্কালে গান্ধিজি সমেত কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করল। এর ফলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এই আন্দোলন প্রথম থেকেই দিশাহীন বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। যদিও উৎসাহী মানুষজনের ভাবনায় এবার আর আগের মতো “নিমক তৈরির ফিস্স্স্ আর সতিয়াগিরির ফুস্স্স নয়। সে সব ছিল খোঁড়া-নুলোর ‘নৌটাঙ্কী’। এবার মরদের লড়াই রেললাইন তুলবার, তার কাটবার আরও অনেক! অনেক!” [১০]
স্বাধীনোত্তর পর্বে প্রশাসনিক ক্ষমতালাভের সুযোগ যখন এল, তখন নিস্পৃহ চিত্তে সতীনাথ এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। আসলে জেলে থাকাকালীনই সতীনাথ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন রাজনীতির ধূলিধূসর পরিসর তাঁকে তাঁর ঈপ্সিত মুক্তি দেবে না! সদ্য স্বাধীন ভারতে সাধারণ মানুষের অসহায় মুহূর্তে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ মুনিমজীর যে কুৎসিত লোলুপ চেহারা তিনি ‘গণনায়ক’ গল্পে প্রত্যক্ষ করালেন, তা তাঁর নির্ভুল অনুধাবন ক্ষমতা ও দূরদর্শিতা প্রমাণ করে। ‘চরণদাস এম-এল-এ’ গল্পে স্বাধীন দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মেরুদণ্ডহীন অন্তঃসারশূন্য ক্ষমতালোভী চরিত্র সুতীব্র বিদ্রূপের কশাঘাতে বেআব্রু হয়েছে। সাহেবি আমলের দুর্নীতি, উৎকোচ ব্যবস্থা নিয়ে সরস ভঙ্গিতে লেখা গল্প ‘জোড়-কলম’ কিংবা ‘সাঁঝের শীতল’ কিংবা স্বাধীন ভারতে উৎকোচ ব্যবস্থা নিয়ে ‘এক ঘন্টার রাজা’ অথবা সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে ‘মা আম্রফলেষু’ প্রমাণ করে ভারত আছে ভারতেই! আবার অযোগ্য মানুষ প্রশাসনের মাথায় বসে গেলে যে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয় তারই ব্যঙ্গশানিত রূপ ‘পরকীয় সন-ইন-ল’ গল্প। ব্যবসায়ীদের নীতিহীনতার প্রকাশ ঘটেছে ‘মুনাফা ঠাকরুন’ গল্পে। এরা জানে প্রত্যেক মানুষের নির্দিষ্ট ক্রয়মূল্য আছে, তাই শিক্ষিত প্রতিবাদী মানুষকে এরা কিনে ফেলে অবলীলায় নিজেদের স্বার্থে লাগাতে পারে। ভারতবর্ষ যে ক্রমশই মূল্যবোধহীন অন্ধকারে ডুবছে তারজন্য এদের সবার সম্মিলিত অবদান রয়ে গেছে। এদেরই কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায় ‘করদাতা সংঘ জিন্দাবাদ’ কিংবা ‘তিলোত্তমা সংস্কৃতি সংঘ’ ইত্যাদি একাধিক গল্পে।
উত্তর ভারতীয় সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে ঘৃণা ও সন্দেহের কারণে এতটাই বিষিয়ে দিয়েছিল যে ‘মুসলমান মানেই বিপজ্জনক’ এমন গভীর বিশ্বাস ভূত গল্পের সুরজকুঁয়রীকে আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার ভূত তো শুধু সুরজকুঁয়রীর মনে নেই, আরও অনেকের মধ্যেই বাসা বেঁধেছে। ভূত তাড়াতে রুস্তম রোজাকে ডাকার কথা হলে সুরজকুঁয়রীর পিসি আপত্তি করেন এই ভেবে যে আইবুড়ো মেয়েকে মুসলমান ছোঁবে, বাবা ইন্দর পরসাদের মনে সন্দেহ হিন্দুর মেয়েকে মুসলমান ভূতে ধরেছে, তাই রুস্তম হয়তো ইচ্ছে করেই ভূতটাকে তাড়ায়নি। অথচ ইতিহাসে পাই অসহযোগ আন্দোলনের সময় খিলাফতের দাবিকে সংযুক্ত করে গান্ধিজি মুসলিম সমাজের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসে দেখি মহরমের শোকপালনের প্রথা লোকপরম্পরায় সম্প্রীতির মিলনোৎসবে পরিণত হয় তার সার্থক দৃষ্টান্ত দুলদুল ঘোড়ার মেলা। ইমামবাড়া থেকে দুলদুল ঘোড়ার মিছিল আসে কবরস্থান পর্যন্ত। হিন্দু হয়েও তাৎমাটুলির ছেলেরা মহরমে লাঠি খেলে। আবার “হিন্দু মুসলমান ভাইয়া, জোরহুঁ রে পীরিতিয়া রে ভাই, হায় রে হায়!” [১১] — এই মাতুম গান বা মহরমের শোকগীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা সঞ্চারিত হয়ে যায় গানহী বাওয়ার পরোক্ষ প্রভাবে। আর শুধু ধর্মীয় কারণে সাম্প্রদায়িক বিভেদ নয়, অনেকযুগ আগে থেকেই এদেশের বহুস্তরিক সমাজ বহুধাবিভক্ত। ‘বন্যা’ গল্পে কুশীনদীর ভয়াবহ বন্যায় বানভাসি মানুষ সমস্ত ভেদাভেদ দূরে সরিয়ে রেখে কয়েকদিন পরম আত্মীয়জ্ঞানে সহমর্মিতায় একসঙ্গে বসবাস করেছে। কিন্তু বন্যার জল সরে যেতেই জাতপাতের দ্বন্দ্ব, সংকীর্ণ মনের ঈর্ষা, জবরদখল করে নেওয়ার মতো উর্বর জমি সব আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথার উল্লেখ করতে হয়। গ্রামাঞ্চলে অসহায় বিধবার নামে জমিজমা থাকলে তা গ্রাস করার সহজতম উপায় ওই মহিলাকে ডাইনি বলে প্রচার করে তাকে মেরেধরে জমি থেকে উৎখাত করা। ‘জাগরী’ উপন্যাসে নীলুর জবানিতে জানা যাচ্ছে তেলী বৌকে ‘ডাইন’ ঘোষণা করে তার বাড়ি পুড়িয়ে, মিথ্যে মামলায় ডিক্রিজারি করিয়ে তার পঞ্চাশ বিঘা জমি গ্রাস করেছে জোতদার কপিলদেও। আর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসের দ্বিতীয় চরণে বিসকান্ধায় বুড়ি মোসম্মতকে তার জমি, স্বামীর ভিটে থেকে উৎখাত করতে বাবুসাহেব আর গিধর মণ্ডল মিলে তাকে ডাইনি বলে প্রচার করেছে।
গান্ধিজি বারবার অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আমাদের সমাজে বহুকাল ধরে প্রচলিত অত্যন্ত অমানবিক এই কুপ্রথাটিকে তিনি সমাজের অভিশাপ বলে আখ্যা দিয়েছেন। স্রষ্টা সতীনাথ স্বয়ং যে উদার মানবতায় বিশ্বাসী ছিলেন, সেই মানবতার অংশীদার হিসেবে ‘জাগরী’ উপন্যাসে বিলু অস্পৃশ্য বাদর বাহরগমিয়ার মার কাছে জল চেয়ে তার দেওয়া জলপান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেছে। তারপর এতদিনের বাধা ঘুচিয়ে সমবেত জনতা যেন কাড়াকাড়ি করে বাহরগামিয়ার ছোঁয়া লাগা জলপান করেছে দারুণ উৎসাহে —“হরেশ্বর বলে, ‘বাদরমাই, আমাকেও জল খাওয়াও’। বালতিতে করিয়া জল আসে। সকলে কাড়াকাড়ি করিয়া, বাহরগামিয়ার ছোঁয়া জল খাইতেছে।”[১২] হয়তো এর মধ্যে প্রদর্শনকামিতা আছে, নাটকীয়তার সন্ধানও পাওয়া যেতে পারে, আছে মহৎ হওয়ার লোভ। বহুযুগের সংস্কার থেকে এমন রাতারাতি মুক্ত হওয়া সম্ভব কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে! তবু সেযুগে তো বটেই, আজকের জাতপাতে দীর্ণ বিহার তথা সমগ্র উত্তর ভারতের প্রেক্ষাপটেও এ নিঃশব্দে ঘটে যাওয়া সমাজবিপ্লব, এর গুরুত্ব কিন্তু কম নয়।
বিশ শতকে দ্রুত পরিবর্তমান ভারতীয় সমাজে একের পর এক অভিঘাত এসে পড়ছিল। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসের শুরুতে রেললাইন বসানোর কথা পাই, রেলপথের সংযোগ একইসঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিল, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। তবে অনড়, স্থবিরপ্রায় তাৎমাটোলীতে প্রথম বদল নিয়ে এল ঢোঁড়াই। সে পঞ্চের নিষেধ অমান্য করে ধাঙড়দের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করল, তাদের সঙ্গে পাক্কীতে মাটিকাটার কাজে নাম লেখাল, তন্ত্রিমাছত্রী নাম নিয়ে সদলবলে উপবীত ধারণ করল। কিন্তু একটা সময়ের পর সেও এই দ্রুত পরিবর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে যেন নিজেকে আর কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। “দুনিয়াটা ঠিক বদলাচ্ছে না, ভেঙে পড়ছে হুড়মুড় দুমদাম করে। … ‘পাক্কী’ আর পাটের দামের রাজা, কাপড় আর কেরোসিনের রাজা, মাটিতে জমিদার হাকিম দারোগা ফৌজের রাজা, আকাশে ‘হাওয়াই জাহাজের’ রাজা, বাতাসে ফৌজী হাওয়াগাড়ির গন্ধর রাজা। রামায়ণে এ-রকম রাজার কথা লেখা নেই। … পুরোনো রামায়ণ আর নতুন রামায়ণে জট পাকিয়ে যায়।”[১৩] এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে বিপন্ন ঢোঁড়াই নিজের মতো করে আত্মরক্ষার বর্ম তৈরি করে নেয়, আঁকড়ে ধরে রামায়ণটাকেই “রামায়ণজী দিন দিন নিজেকে বেশি করে গুটিয়ে নেয়, রামায়ণখানার মধ্যে।” [১৪] একইরকম বিপন্নতা গ্রাস করছিল ‘রথের তলে’ গল্পের ভৈরো নাট-কেও। দীর্ঘ চোদ্দো বছর জেলে কাটিয়ে বাইরে এসে সে দেখছে এ কটি বছরে তার জগৎ তছনছ হয়ে গেছে। দেশভাগ প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবিকায় এমন আঘাত হেনেছে, যে তাদের নাট-নট্টিন সমাজ রোজগারের আশায় ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূরে। এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না বৃদ্ধ ভৈরো, সে ফিরে যেতে চায় জেলের ভেতর। আবার ক্ষমতা কীভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে আরও দূরে ঠেলে দেয়, তার বর্ণনা আছে ক্রান্তিদলে যোগ দিতে আসা এন্টনির কথায়, “ধাঙড়টুলি জানেন? ঐ পাক্কীর ধারে যেদিকে ফৌজী হাওয়াগাড়ির কারখানা আর টমি অফিসরদের ঘর হয়েছে, সেইদিকে ছিল আমাদের বাড়ি! ধাঙড়টুলির সকলকে উঠে যেতে হয়েছিল সেইসময়।” [১৫] এমন নিরাসক্ত ভঙ্গিমায় দ্বন্দ্বমুখর সমকালের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন সতীনাথ।
কিন্তু ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজে যে ক-টি বিষয় প্রায় অনড়, অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল এই সমাজে নারীর অবস্থান। অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীলতার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় নারীকে আজও তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। সমস্ত সাধারণত্ব নিয়ে একরাশ ক্ষোভ আর অভিমান বুকে বসে আছেন জাগরীর মা। তাঁর কোনও মতাদর্শগত স্বপ্নপূরণের দায় ছিল না, চিরদিন স্বামীর ছায়েবনুগতা হয়ে চলার সংস্কারে তিনি কখন যেন পারিবারিক নিভৃতি ছেড়ে এসে পড়েছেন এই রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে। এখানেই মিলে যাচ্ছে ভারতীয় পরম্পরাগত পতিব্রতা আদর্শ স্ত্রীর Archetype-টি। মা নিরুপায়ভাবে দেখছেন তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জানছেন এক সন্তানের সাক্ষ্যে অন্যজনের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথা। তাঁর সাধের সংসার এভাবে ছারখার হয়ে যেতে দেখে মনে মনে তিনি তাঁর স্বামী মাষ্টারসাবকে অভিযুক্ত করছেন, কখনও গান্ধিজিকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন। চিরটাকাল স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা ও অসম্মানে মনে জমেছে যে ক্ষোভ, অভিমান, তা মায়ের আত্মকথনে স্পষ্টরূপ পাচ্ছে — “চাবিটা থাকবে নিজের কাছে — ইস্কুলে যাবার সময় একটা টাকা আমাকে দেওয়া হল বাজার-খরচের। আমার কাছে চাবি রাখলে কি আমি সব টাকাকড়ি নিজের পেটে পুরতাম নাকি? না তোমার ভাণ্ডার উজাড় করে আমার বাপের বাড়ি পাঠাতাম? কী ভাবতেন কে জানে। … তুমি দেশের স্বাধীনতার জন্য সব ছেড়েছ সত্যি – কিন্তু আমাকে তো একটুও স্বাধীনতা দাও নি।”[১৬]
যে কোনও সংসারে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা যে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে তাৎমাসমাজের প্রেক্ষিতে এ বিষয়টি দেখানো হয়েছে। তাৎমা মেয়েরা কায়িক শ্রম দেয়। বর্ষার পর ঘাস, মাঘ মাসে বুনো কুল, ফাল্গুন-চৈত্রে শিমুল তুলো আর কচি আম বিক্রি করে। তবে তাদের সবচেয়ে স্বচ্ছলতা আসে অঘ্রাণ মাসে পুবে ধান কেটে আসার পর। একটা কথা তাদের সমাজে প্রচলিত আছে “দশ মাস পুরুষ রাজা, তো দুমাস মেয়েরাও রাজা।” [১৭] অথচ বচ্চন সিং বাবুসাহেবের যত প্রতাপ থাকুক না কেন, তাঁর অন্তঃপুরে গৃহিণীর কোনও স্বাধীনতা নেই, বাড়ির এলাচও তালাবন্দি থাকে, দরকার পড়লে বাবুসাহেব তালা খুলে গৃহিণীকে গুনে গুনে এলাচ দেন। বাড়ির কর্তার আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নারী স্বাধীনতার সম্পর্ক যে ব্যস্তানুপাতিক তা আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় সরকারি কর্মচারি বাবুলাল চাপরাশি যেমন দুখিয়ার মাকে অন্তঃপুরিকা করেই রাখতে চায়, পাক্কীতে গাড়ি ও বলদ ছোটানো ঢোঁড়াই নিজেও পশ্চিমা উচ্ছলা রামিয়াকে ঘরের বৌ করেই রাখতে চেয়েছে। সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পে-উপন্যাসে শাশ্বত ভারতবর্ষের মূর্তি দেখতে পাই, যেখানে ঘরের নিভৃত আশ্রয় ছেড়ে পথে বেরিয়েছে যে পথিক, পথের ধারে তার জন্য রয়েছে ঘরের আমন্ত্রণ। সদ্যপরিচিত বা সম্পূর্ণ অচেনা মানুষও আত্মীয়তার উষ্ণ বন্ধনে জড়িয়ে ধরতে চায় অতিথিকে। ‘জাগরী’ উপন্যাসে প্রোটাগনিস্ট বিলু তার অনতিদীর্ঘ জীবনে বারেবারে এমনটা অনুভব করেছে। রক্তের সম্বন্ধ ছাড়াই জিতেনের মা জ্যাঠাইমাকে বিলুর প্রতি মাতৃস্নেহে উদ্বেল হতে দেখি, যিনি একাধিক সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও বিলুর মুখ থেকে মা ডাক শোনবার জন্য লালায়িত ছিলেন। এছাড়াও বিলুর স্মৃতিচারণায় পাই সহদেওর মা, দুবেজীর স্ত্রী, ছোটো ঠাকুমার মা বাদর বাহরগামিয়ার বৃদ্ধা মা-র কথা, যারা পরম স্নেহে বিলুকে খাওয়াতে ভালোবাসত। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসের ঢোঁড়াই ছোটোবেলা থেকেই ঘরের বাইরে গোঁসাইথানে নিঃসম্পর্কীয় বৌকা বাওয়ার কাছে, তার অপত্য স্নেহে-ভালোবাসায় বড়ো হয়ে উঠেছে। ধাঙড়টুলির শুকরা ধাঙড় তাকে সনবেটা বলে ডেকেছে, আবার ডাইনি বলে পরিচিত আকলুর বুড়ি মা তাকে আদর করে একটা প্রকাণ্ড শাঁকালু খেতে দিয়েছে। ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’ উপন্যাসে অভিমন্যু এমনই এক সর্বজনপ্রিয় চরিত্র, তার খোলামেলা, সহৃদয় আচরণের জন্য আপামর জনসাধারণের কাছে সে খুব প্রিয়। বহু মানুষের সঙ্গে এমনই সহজ প্রীতির সম্পর্ক অচিনরাগিণী-র নতুনদিদিমা, ‘সংকট’ উপন্যাসে দাড়িওলা মহাত্মা, ‘রথের তলে’ গল্পে ভৈরো নাট ও ভুটনী নাটিনের মধ্যেও রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই, তবু তাদের একটি আত্মিক বন্ধন রয়েছে। পরকে আপন করে নেবার যে ভারতীয় পরম্পরা, তা এখানেও দেখতে পাওয়া যায়। জাতীয়তাবাদ-ই বলি বা ভারতীয়ত্ব সন্ধান তা এভাবেই সতীনাথের বিভিন্ন গল্পে-উপন্যাসে নানা মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়ে চলে।
তথ্যসূত্র :
১) Hornby A S, OXFORD Advanced Learners Dictionary, Edited by Sally Wehmeier 6th Edition 6th impression, Oxford University Press, 2001, Page 847
২) Guha Ranajit, ‘An Indian Historiography of India, A Nineteenth Century Agenda and Its Implications’ (S.G.Denskar Lectures on Indian History), Kolkata, K.P.Bagchi & Co.,1987
৩) চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র, ‘আনন্দমঠ’, প্রথম খণ্ড বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড (সমগ্র উপন্যাস) কলকাতা, সাহিত্য সংসদ, চৈত্র ১৩৭৬, দশম পরিচ্ছেদ, পৃ-৭২৭
৪) তদেব, একাদশ পরিচ্ছেদ, পৃ-৭২৯
৫) “আমাকে নিরতিশয় শুচি হইতে হইবে। আমি সকলের সঙ্গে সমান ভূমিতে দাঁড়াইয়া নাই। বন্ধুত্ব আমার পক্ষে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নহে, নারীর সঙ্গ যাহাদের পক্ষে একান্ত উপাদেয় আমি সেই সামান্যশ্রেণীর মানুষ নই, দেশের ইতরসাধারণের ঘনিষ্ঠ সহবাস আমার পক্ষে সম্পূর্ণ বর্জনীয়”। ‘গোরা’ (পরিচ্ছেদ-৭১), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তম খণ্ড উপন্যাস, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আশ্বিন ১৩৯২, পৃ-৯০৯
৬) “গোরা যে ত্রিবেণীতে স্নান করিতে সংকল্প করিয়াছে তাহার কারণ এই যে, সেখানে অনেক তীর্থযাত্রী একত্র হইবে। সেই জনসাধারণের সঙ্গে গোরা নিজেকে এক করিয়া মিলাইয়া দেশের একটি বৃহৎ প্রবাহের মধ্যে আপনাকে সমর্পণ করিতে ও দেশের হৃদয়ের আন্দোলনকে আপনার হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে চায়। যেখানে গোরা একটুমাত্র অবকাশ পায় সেখানেই সে তাহার সমস্ত সংকোচ, সমস্ত পূর্বসংস্কার সবলে পরিত্যাগ করিয়া দেশের সাধারণের সঙ্গে সমান ক্ষেত্রে নামিয়া দাঁড়াইয়া মনের সঙ্গে বলিতে চায়, আমি তোমাদের, তোমরা আমার”। তদেব, পরিচ্ছেদ ৬,পৃ-৬৪৬
৭) জাগরী : ‘ফাঁসি সেল’, সতীনাথ গ্রন্থাবলী ১, সম্পাদনা : শঙ্খ ঘোষ ও নির্মাল্য আচার্য, কলকাতা, অরুণা প্রকাশনী, বৈশাখ ১৪০৫, পৃ-৪৬
৮) ঢোঁড়াই চরিত মানস : ‘প্রথম চরণ’, সতীনাথ গ্রন্থাবলী ২, সম্পাদনা : শঙ্খ ঘোষ ও নির্মাল্য আচার্য, কলকাতা, অরুণা প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, বৈশাখ ১৪০৬,পৃ- ১৩২-১৩৩
৯) তদেব, ‘রামরাজ্য আনয়নার্থে যজ্ঞ’, পৃ-২৩৮
১০) তদেব, ‘দিব্যদৃষ্টি লাভ’, পৃ-২৭১
১১) তদেব, ‘সামুয়রের ভৎর্সনা’, পৃ-৪১
১২) প্রাগুক্ত, পৃ-৪৬
১৩) প্রাগুক্ত, পৃ-২৬৯
১৪) তদেব, পৃ-৩০১
১৫) তদেব, পৃ-৩০৩
১৬) প্রাগুক্ত, পৃ-১৩
১৭) প্রাগুক্ত, পৃ-৮৩