গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
জাতীয়তাবাদের ভেতরে আমি আছি, আমরা আছি, আমার প্রজাতিও, আমার ভাষা-মাটি, আমার চারপাশ, আমার দুঃখ-কান্না, আমার উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা। আবার আমার ক্ষমতাও আছে, তার আধিপত্য এবং তার প্রসারণ। জাতীয়তার ভেতরে আছে দেশপ্রেম, কখনও বা জাতীয়তা আর দেশপ্রেম একাকার। আবার আছে অন্য জাতিকে অস্বীকার, তার ক্ষমতা, তার শ্রেয়তাকে। আর ঠিক তখনই জাতীয়তার দেশপ্রেম দেশের সীমানা ভেঙে বিশ্ব আধিপত্যের দিকে পা বাড়ায়। কখনও দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠে অন্য দেশের গণহত্যাকারী। জাতীয়তাবাদকে আমরা কীভাবে দেখব তাহলে?
দেশাত্মবোধ প্রাণিত কৈশোরের আবেগপ্রবণ দিনগুলোর কথা ভাবলে বেশ বুঝতে পারি দেশাত্মবোধ কতখানি পবিত্র ও মহান। দেশাত্মবোধক সংগীতের সুর যখন ঢেউ তোলে হৃদয়ে, চোখে জল আনে, গায়ে কাঁটা দেয়, কখনও বা চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। আমারই ভারতবাসীর ওপর ব্রিটিশ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রাণিত হতাম। দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের জীবন উৎসর্গে মাথা নীচু হয়ে আসত। জাতীয়তাবোধ এখানে মহান ও পবিত্র। কারণ গোষ্ঠী, জাতি বা দেশবাসীর সমগ্রের মধ্যে ব্যক্তি একাত্ম হয়ে বিলীন হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে — এর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের আরও বেশি করে ব্যক্তির গণ্ডি থেকে বার করে আনে দেশের অঙ্গনে। এ হল তীব্র একাত্মতা ও ভালোবাসার উপলব্ধি।
সৃষ্টির বুকে মানুষের প্রধান প্রবৃত্তি বা instinct হল তার বেঁচে থাকা। অর্থাৎ অস্তিত্ব। আর প্রশ্নের অনুসারী হয়ে চলে আসে অস্তিত্বের সুরক্ষা। তার বিকাশ, তার আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠা এই সৃষ্টির বুকে। আর আমরা তখন সুরক্ষা খুঁজে পাই নিজেরই গোষ্ঠী বা জাতির ভেতরে, জাতি থেকে দেশ, রাষ্ট্র। দেশের সঙ্গে একাত্মতায় তার অস্তিত্বের পরিচয়, পরিচয়ের গৌরব। রাষ্ট্র তার জাতির সুরক্ষা, তাই তারও সুরক্ষা।
কিন্তু অস্তিত্ব যে শুধু সুরক্ষার উপরই নির্ভরশীল নয়। তার স্বীকৃতি? ব্যক্তি তার গোষ্ঠী বা জাতির সাথে একাত্মতায় জাতির সামগ্রিক পরিচয়ে বিলীন হয়ে সুরক্ষিত। কিন্তু ব্যক্তির একক স্বীকৃতি বা পরিচয় তখন বিপন্ন হয়ে পড়ে সামগ্রিকতায় হারিয়ে। তখন নিজের গোষ্ঠী বা জাতির ভেতরেই তার অস্তিত্বের বিপন্নতা। সে তখন নিজের গোষ্ঠীর আর-একজনকে অতিক্রম করে যেতে চায় ক্ষমতায়, আধিপত্যে। নইলে সমগ্রতায় হারিয়ে সে অস্তিত্বহীন। সমগ্রে বিলীন হয়ে নিজেকে প্রজাতিবৎ, আর সমগ্রকে অতিক্রম করে একক স্বীকৃতি — এই দ্বন্দ্বেই বিশ্বজগতব্যাপী ইতিহাসের ওঠানামা চলছে কালের বুকে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের ভেতরে খুঁজে পেয়েছিলাম দেশপ্রেমের আদর্শ ও প্রতিরোধের শৌর্য। পৃথিবীর বুকে দেশের গৌরবময় উপস্থিতির ভেতরে খুঁজে পেয়েছিলাম নিজেরও অর্থপূর্ণ অস্তিত্ব। আবার সেই আমরাই কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিকে অন্যায় আবদার মনে করে বিষনজরে দেখছি। তাদের স্বাধীনতাকে আমরা নিজেদের অঙ্গহানি তথা ক্ষমতা হ্রাস হিসেবে দেখছি। আর তাই কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দিকে আঙুল তুলেছি — বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে। অথচ দেশের প্রতি আবেগের প্রশ্নে তারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরই সমগোত্রীয়। সম্ভ্রম তো নয়ই, তাদের মুখ আমাদের মধ্যে ঘৃণার উপলব্ধি উদ্রেক করে। এভাবেই যে জাতীয়তাবোধের ভেতরে যেমন নিহিত থাকে দেশপ্রেম, তেমনি মিশে থাকে আধিপত্যের বাসনাসঞ্জাত সাম্রাজ্যবাদী সত্তা। সেই সত্তাই যেন উঁকি দেয় আমাদের ভেতর, কাশ্মীর প্রশ্নে। তাই জাতীয়তাবাদ ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষণ সে অন্য জাতির উপর আধিপত্যের বাসনা পোষণ করে না।
আমরা আমাদের অস্তিত্বকে খুঁজে পাই অন্যের সাথে তথা জাতির সাথে একাত্মতায় আর অন্যের উপর তথা অন্য জাতির উপর আধিপত্যের বোধে। অস্তিত্বের এই দ্বান্দ্বিক রূপ দ্বান্দ্বিক বিশ্বেরই অংশ। জাতীয়তাবাদ তার আবেগ নিয়ে জেগে ওঠে, যখন বাইরের অন্য জাতি বা প্রতিপক্ষের সাথে তুলনা বা প্রতিযোগিতার প্রশ্ন চলে আসে। নইলে সে তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেই মগ্ন হয়ে থাকে। আর তাইতো যে কোনও নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলের কৌশলে সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। জাতীয়তাবাদের মহত্বের দিক হল ব্যক্তিস্বার্থ জাতীয় স্বার্থের সমগ্রতায় বিলীন হয়ে পরার্থপর হয়ে ওঠে। কিন্তু জাতীয়তার মধ্যেই যে নিহিত যে ক্ষমতার তুলনা ও প্রতিযোগিতা — তা সেই আকাঙ্ক্ষার সামগ্রিক রূপে পরিণত উগ্রজাতীয়তাবাদে, যার জ্বলন্ত উদাহরণ নাৎসি জাতীয়তাবাদ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও চিনের ওপর জাপানি সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণ।
জাতীয়তাবাদ তার এলোমেলো চেহারায় ইতিহাসের নানা দিকে ছড়িয়ে থাকলেও তা সংহত রূপ পেল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ফরাসি বিপ্লবের পর আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্র (Nation State) গঠনের মধ্যে দিয়ে ইউরোপে। আর তারপরেই পথ চলা শুরু উগ্রজাতীয়তা থেকে সম্প্রসারণ, উপনিবেশ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের দিকে। জাতীয়তাবাদী ক্ষমতা ও আগ্রাসনের ভেতরে পথ চলতে থাকে ব্যক্তির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বাসনা। ক্ষমতার সামগ্রিক রূপে সে বাসনা চরিতার্থ হয়।
সম্মোহনের (Hypnosis) বিজ্ঞান অনুযায়ী আমরা জানি ব্যক্তি চেতনা যখন গোষ্ঠী চেতনার (Mass psychology) অংশ হয়ে ওঠে, তখন তার মনোজগতে ঘটে যায় গণ-সম্মোহনের (Mass Hypnosis) আবেশ। ব্যক্তির যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ সমগ্রের আবেগে ভেসে যায়। সমগ্রের আবেগই হয়ে দাঁড়ায় মস্তিষ্কের একমাত্র জেগে থাকা উদ্দীপনা, আড়ালে চলে যায় নিরপেক্ষ মানবিক বিচারবোধ। সমগ্রের অভিমুখই তার কাছে একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। এভাবেই জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম কিংবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে গণ-সম্মোহন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হিটলার যখন জার্মানির ক্ষমতায় আসেন, দেশে তখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য। হিটলার সুচতুরভাবে জাতির সামনে তুলে ধরলেন তার শ্রেষ্ঠত্ব, তার ঐতিহ্য। জার্মান জাতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, তারই হাতে আসা প্রয়োজন পৃথিবীর দায়িত্বভার। আকাশে ওড়ালেন জার্মান জাতীয়তাবাদের পতাকা। একদিকে মধ্যবিত্ত জার্মান, অন্যদিকে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থকে যে দড়িতে বাঁধলেন তা হল National Socialism। জাতীয়তাবাদের সম্মোহনী আবেশে এমনি ডুব দিল জার্মান জাতি যে লক্ষ লক্ষ ইহুদি, পোল, রাশিয়ান হত্যা করে মনে হয়েছিল এটাই যথাযথ। তীব্র জাতীয়তাবোধের সামগ্রিক আবেগ এভাবেই গ্রাস করে নেয় ব্যক্তির মানবিকতা। আর তাই পৃথিবীর দিকে দিকে তার জাতীয়তাবাদের চরম পরিণতি সাম্রাজ্যবাদ। ইউরোপের জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো — স্পেন, পর্তুগাল, ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান ছুটে গিয়েছিল পৃথিবীর দিকে দিকে উপনিবেশ স্থাপনে, আমেরিকা মহাদেশে, অস্ট্রেলিয়ায়, আফ্রিকায়। লক্ষ লক্ষ গণহত্যার পথে পৃথিবীর এক একটি নেটিভ জাতিকে এ গ্রহ থেকে নিশ্চিহ্ন করেও মনে হয়নি তাদের কোনও অপরাধ হয়েছে।
আমরা জানি Mass Psychology কোনও একটি বিশেষ দিকে ধাবিত হয়, বিশেষ কোনও একটি যুক্তিতে সম্মোহিত হয়ে। অন্যান্য বিরোধী যুক্তি আবেগে চাপা পড়ে অকেজো হয়ে পড়ে। Wilhelm Reich তাঁর ‘Mass Psychology of Fascism’ গ্রন্থে বলছেন, “… The mass psychological function in both world wars can be comprehended only by understanding that the imperialistic ideology changed the structure of the working masses concretely in the direction of imperialism”.
হিটলারের জাতীয়তাবাদী সাফল্যের কারণ হিসেবে তিনি বলছেন :
“Hitler … emphasized repeatedly that the only correct mass-psychological technique was that of avoiding arguments and of keeping the ‘big final goal’ before the masses.”
হিটলারের এই National Socialism-ই পরিণত হল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ও নৃশংসতম ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদে।
জাতীয়তা বনাম বিশ্বমানবতা
বিষয় দুটি আপাতভাবে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও একে অপরের পরিপূরকও। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয়দের কাছে প্রায় সমস্ত পাকিস্তানি হয়ে ওঠে শত্রু, আবার উলটোটাও। পাকিস্তানের যেকোনও বিপদেই আমরা হাততালি দিয়ে উঠি। কিন্তু ঠিক তখনই যখন পাকিস্তানের কোনও হিন্দু মন্দিরকে মৌলবাদীদের হাত থেকে মুসলিম পাকিস্তানিরাই রক্ষা করার জন্যে উঠে দাঁড়ায় তখন আমরা বড়ো মুশকিলে পড়ে যাই। মুশকিলে পড়ে যায় আমাদের ভেতরের ভারতীয় নয়, মানবসত্তা, যে আরও বেশি আদি ও প্রাচীন আরও বেশি গভীর ও সত্য। তাই জাতীয়তাবাদ যখন মানবিকতা তথা বিশ্ব মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখন সে আর মহৎ বা পবিত্র থাকে না। জাতীয়তাবাদের আবেগ গড়ে না উঠলে দেশ সমগ্রতায় এসে দাঁড়াতে পারে না, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর হয়ে ওঠে। দেশের উন্নতি, বিকাশ এবং বিদেশি আক্রমণের প্রতিরোধে অসমর্থ হয়ে পড়ে। তাই জাতীয়তাবাদ শিরোধার্য, যদি না সে বিশ্ব মানবতা বিরোধী হয়ে পড়ে। আবার জাতীয়তাবোধের আবেগকে ডিঙিয়ে বিশ্বমানবতাবোধে উত্তরণ সম্ভব নয়। কারণ সে অনেক বেশি বিমূর্ত। জাতীয়তাবোধের যে মূল সুর — “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া”, সেই সুরই আরও প্রসারিত বিশ্বমানবতায়। প্রতিটি বিশ্বমানবিক মানুষের ভেতরেই বাস করে এক জাতীয়তাবাদী হৃদয়। নিজের জাতির সাথে একাত্ম হওয়ার মধ্যে দিয়েই বিশ্বমানবের সাথে একাত্মতার পথ খুলে যায়। সেখানে প্রতিযোগিতা নয়, সহমর্মিতাই হয়ে ওঠে চলার পথের মূল আবেগ।
আজ ভারতবর্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদ যে আগ্রাসী রূপ নিতে চলেছে, তা কখনোই জাতির জন্য নয়, জাতির নামে ক্ষমতার পথ তৈরি করতে। নিরাপরাধ অ-হিন্দুদের যারা ভালোবাসতে পারে না, তারা মানুষকেই ভালোবাসতে পারে না। আর তাই তারা হিন্দুদেরও ভালোবাসতে পারে না। ব্রাহ্মণ হিন্দুরা যেমন নিম্নবর্ণের হিন্দুকে কোনও দিন ভালোবাসতে পারেনি, ভালোবেসে ছিল তাদের ওপর আধিপত্যকে। তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল বড়ো। সেই তাগিদেই আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে হিন্দুরাষ্ট্রের। এই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতেই এর ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে আগামী ইতিহাসের অনেক সম্ভাব্য গণহত্যা।
পৃথিবীজুড়ে জাতীয়তাবাদের গভীরে যে আলিঙ্গন আর আগ্রাসন, সেই দ্বন্দ্বের শেষ অভিমুখ হোক বিশ্বমানবতা, যার ছায়ায় বিকশিত হতে পারবে পৃথিবীর সমস্ত জাতীয়তাই। আর সেই হবে মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ শৌর্য।