গৌতম কুমার দে
লাতিন শব্দ ‘nasci’ থেকে ‘nation’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যায় অর্থ হল race বা জাতি। কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী একই ভাষা, ধর্ম ও ঐতিহ্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে জাতি বলা হয়। ডেভিড টমসন-র মতে, জাতি হল একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী, যারা নিজেদের সীমাবদ্ধ করতে চায় এই ভেবে যে, তারা একই বাসভূমি ও সাধারণ প্রথা-ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক অগ্রগতির অধিকারী (‘Europe Since Napoleon’, pg: 119)। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘জাতি’ শব্দটিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তাঁর ‘নেশন কী?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “নেশন একটি সজীব সত্তা, একটি মানস পদার্থ। দুটি জিনিস এই পদার্থের অন্তঃপ্রকৃতি গঠিত করিয়াছে। সেই দুটি জিনিস বস্তুত একই। তাহার মধ্যে একটি অতীতে অবস্থিত, আর একটি বর্তমানে। একটি হইতেছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতিসম্পদ আর একটি পরস্পর সম্মতি, একত্রে বাস করিবার ইচ্ছা — যে অখণ্ড উত্তরাধিকার হস্তগত হইয়াছে তাহাকে উপযুক্তভাবে রক্ষা করিবার ইচ্ছা।”
জাতি শব্দ থেকেই জাতীয়তাবাদ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। জাতীয়তাবাদ প্রধানত মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতির বিষয়। এটি একটি ভাবগত ও অনুভূতিমূলক আদর্শ। এটি একটি মানসিক শক্তি এবং সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি। শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিকেরা ‘জাতীয়তাবাদ’-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। এপ্রসঙ্গে কয়েকজনের বক্তব্য উপস্থাপিত করা হল।
শিক্ষাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, কোনও বিশেষ অঞ্চলে একটি সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভৌগোলিক, বংশগত, ভাষাগত, আচরণগত, ধর্মগত, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রভাবে যে সামগ্রিক ঐক্যবোধ জাগ্রত হয় তাকে জাতীয়তাবাদ বলে।
পি টি মুন তাঁর ‘Imperialism and World Politics’ গ্রন্থে জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, জাতীয়তাবাদ বলতে বোঝায়, যে-সকল মানুষেরা নিজেদের একই ভাষা, জাতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক প্রথা-ঐতিহ্যসম্পন্ন হিসাবে বিবেচনা করে, তাদের একটি পৃথক বা স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রস্থাপনের ভাবনা।
অধ্যাপক হান্স কোন (Hans Kohn) লিখেছেন যে, জাতীয়তাবাদ হল চিন্তা বা ভাবনার স্তর, যার মধ্যে ব্যক্তির চরম আনুগত্য, জাতিরাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে অনুভূত হয় ।
The Cambridge Encyclopedia-তেও জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে জাতীয়তাবাদ হল একটি রাজনৈতিক মতবাদ যা জাতিকে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান একক হিসেবে উপস্থিত করে।
এডওয়ার্ড ম্যাকনাল বার্নস ও অন্যান্যদের লেখা ‘World Civilisation’ গ্রন্থে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “…nationalism is a sentimental rooted in broad historical, geographical, linguistic, or cultural circumstances. It is characterized by a consciousness of belonging, in a group, to a tradition derived from those circumstances, which differs from the traditions of other groups.”
আধুনিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা ও ভাবনার মধ্যে কয়েকটি উপাদান বা বিশেষত্ব নিহিত।
জাতীয়তাবাদী আদর্শে একটি বিশেষ জাতিসত্তার বিষয় বা ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, একটি বিশেষ সংস্কৃতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মানুষ এধরনের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর অন্যতম বিশেষত্ব হল নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ভূখণ্ড। কোনও দেশ বা ভূখণ্ডের মানুষ এধরনের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা এই ধারণায় বিশ্বাসী যে, ঐ নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে তাদের নিজেদের একটা বিশেষ অধিকার আছে। জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। কোনও বিশেষ এলাকার মানুষ নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করে স্বাধীনভাবে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের মধ্যে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। (এপ্রসঙ্গে অশোক কুমার সেন তাঁর ‘The Educated Middle Class and Indian Nationalism’ গ্রন্থে লিখেছেন, “The trend in European nationalism was to discover a common rallying factor and to work upon it to solve the problem of disunity and accelerate the process of creation of nation state.”)
এখন জাতীয়তাবাদের উন্মেষ সম্পর্কিত আলোচনায় আসা যাক। প্রাচীন গ্রিসে নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠে। তারা অলিম্পিক খেলার মাধ্যমে নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে। তবে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবনা ছিল না। মধ্যযুগে জাতীয়তাবাদী ভাবনার অস্তিত্ব ছিল না, মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়। মূলত বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অথবা বিদেশি আধিপত্যর আশঙ্কার বিরুদ্ধে এই ভাবনার উৎপত্তি হয়। ফ্রান্সে জোয়ান অব আর্ক-এর ইংরেজ বিরোধী প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী ভাবনার সূচনা হয়। ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে টিউডর শাসনকালে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ইংল্যান্ড স্পেনীয় আর্মাডার বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তা থেকে এর সূচনা হয় এবং শেক্সপিয়রের সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এর প্রকাশ ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ফরাসি বিপ্লব যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ বপন করে, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ ও সংস্কারমূলক নীতি সেই জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। ডেভিড টমসন লিখেছেন, “It was first launched upon its course of triumphant development throughout Europe by the French Revolution and Napoleonic Empire.” (পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৯) যদিও নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের ফলশ্রুতি হিসেবে ইওরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটে, তথাপি জার্মানি ও ইতালিতে জাতীয়তাবাদ অনুভূত হয়। প্রথমে এটা ছিল বিদেশি প্রবল আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক অভিব্যক্তি।
উনিশ শতকে ইওরোপে আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রকৃত উন্মেষ ঘটে। নেপোলিয়নের পতন ও ভিয়েনা সম্মেলনের পরবর্তীকালে ইওরোপে জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এপ্রসঙ্গে ইওরোপের কয়েকটি দেশের জাতীয়তাবাদী ভাবনা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোকপাত করা যেতে পারে।
জাতীয়তাবাদ উন্মেষের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল জার্মানি। সেখানে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে। এই পর্বে সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁদের কার্যকলাপে জার্মান জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটে। লেসিং জার্মান জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন। ইয়োহান ভোলফগাং ফন গ্যেটে জার্মান সাহিত্যকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে পরিণত করেন। জোহান ভন হার্ডার তাঁর ‘Ideas for a Philosophy of Human History’ গ্রন্থে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিবর্তে সাধারণ জনগণের শক্তির ওপর জোর দেন এবং Volksgeist অর্থাৎ এক বিশেষ ধরনের জাতীয় চরিত্রের ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি এর মাধ্যমে জার্মান জাতির প্রকৃত সংস্কৃতি ব্যক্ত করেন। জে জি ফিক্টে হার্ডারের ধারণাকে গ্রহণ করেন এবং জার্মান জাতির রীতি-নীতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘An Address to German Nation’-তে কেবল জার্মান জাতির উৎসাহ-উদ্দীপনাকে তুলে ধরেন তাই নয়, তিনি জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ঘোষণা করেন। এছাড়া কান্ট, হেগেল প্রমুখ দার্শনিক জার্মানির জাতীয় চরিত্র ও সংস্কৃতি তুলে ধরেন। ফলে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে ওঠে এবং জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ও প্রসারণ ঘটে। সেখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়।
ঊনবিংশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগরণের অন্যতম পীঠস্থান ছিল ইতালি। ফরাসি বিপ্লব ইতালির জাতিসত্তা জাগিয়ে তোলে। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ইতালি পুনর্গঠন দ্বারা সেখানে জাতীয় ঐক্যের ধারণা গড়ে ওঠে। ইতালির নাট্যকার, কবি ও ঔপন্যাসিকরা সেখানে ‘The Risorgomento’ অর্থাৎ ইতালীয় সাহিত্যর পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং শিক্ষিত ইতালীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধক ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে। ইতালীয় জাতীয়তাবাদী সিলিভা পেলিক্কোর দিনলিপি ‘My Prison’ ইতালির যুবশক্তির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটায়। ভিনসেন্ট জিওবার্টির প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘Moral and Civil Primacy of the Italians’ ইতালিবাসীদের প্রভাবিত করে। ইতালির বৈপ্লবিক সমিতি ‘কার্বোনারি’-র কার্যকলাপ সেখানে জাতীয়তাবাদের জাগরণে সহায়ক হয়েছিল। ইতালিতে জাতীয়তাবাদের জাগরণে জোসেফ ম্যাৎসিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইয়ং ইতালি দল’ (১৮৩১) অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছিল। তিনি ইতালির যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশাত্মবোধক ও জাতীয়তাবাদী ধারণাকে প্রসারিত করেন।
ইউরোপের অন্যান্য স্থানেও জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটে। অস্ট্রিয়া বা হ্যাপসবুর্গ সাম্রাজ্যেভুক্ত বিভিন্ন জাতি, যেমন — ম্যাগিয়ার বা হাঙ্গেরিয়ান, চেক, শ্লোভাক, ক্রোট প্রভৃতি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। লুই কসুথ ও ফ্রান্সিস ডেয়াক হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বলিষ্ঠ করে তোলেন। ফ্রান্সিস পালাকি (Francis Palacky)-র ‘History of the Bohemian People’ এবং পোল অ্যাডাম মিকিওয়েজ (Pole Adam Mickiewiez)-এর বৈপ্লবিক কবিতা চেক জাতীয়তাবাদের জাগরণে সহায়ক হয়। (Edward MacNall Burns, Philip Ralph, et al.; ‘World Civilisation’, pg: 1038)। কোলার (Kollar)-এর জাতীয়তাবাদী কবিতা শ্লোভাক জাতীয়তাবাদের জাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল (E. Lipson, ‘Europe in the 19th & 20th Centuries’, pg: 145)। লুই গাজ (Gaj) সম্পাদিত ‘Illyrian National Gazette’ ক্রোয়েশীয় জাতীয়তাবাদের জাগরণ ও সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল (ibid, pg: 147)। তুরস্ক সাম্রাজ্যভুক্ত অ-তুর্কি জাতিগুলির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটে। এছাড়া, আয়ারল্যান্ড ও রাশিয়াতেও জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠে।
জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ কেবলমাত্র ইউরোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ক্রমশ এর সমপ্রসারণ ঘটে। বেনেডিক্ট আন্ডারসনের বক্তব্য অনুযায়ী, এশিয়া-আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব পাশ্চাত্যের কোনও না কোনও আদর্শ অনুসরণ করেই হয়েছিল। এই মতবাদ, যা এশীয়দের নিজস্ব ইতিহাস সৃষ্টিতে তাদের বৌদ্ধিক অবদানকে অস্বীকার করে, তা সম্প্রতি বিভিন্ন ভাবাদর্শের দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘পলাশি থেকে পার্টিশন’, পৃ: ২৪৯)। ঊনবিংশ শতকে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটেছিল সে ব্যাপারে আলোকপাত করা যেতে পারে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগরণের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল।
(১) ভারতে জাতীয়তাবাদ জাগরণের পশ্চাতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার প্রভাব পড়েছিল। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে এদেশে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার শুরু হয়। ফলে ভারতীয়রা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে ইওরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একাধিক দার্শনিক, যেমন — রূশো, মন্তেস্কু, বেন্থাম, টমাস পেইন, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখের চিন্তাধারা ও রচনা ভারতীয়দের প্রভাবিত করে। ভারতীয়রা রক্ষণশীল ও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার পরিবর্তে মানবতা, উদারনীতিবাদ, উপযোগবাদ, যুক্তিবাদ ইত্যাদি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। তাদের এই পরিবর্তনশীল মানসিকতা থেকে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটে।
(২) ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ও প্রসার ঘটে। জাতীয়তাবাদের প্রভাবে পাশ্চাত্য জগতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুরু হয়। এ ধরনের ঘটনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আমেরিকান বিপ্লব (১৭৭৬-৮৩খ্রি:), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি:) জার্মানি ও ইতালি ঐক্য (১৮৭০ খ্রি:), ইংল্যান্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন (১৮৩১ খ্রি:), রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলন ইত্যাদি। এই সকল ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ জাগরণে সাহায্য করে।
(৩) ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ জাগরণের ক্ষেত্রে সংস্কার আন্দোলনের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। ঐতিহাসিক এ আর দেশাই মন্তব্য করেন, বিভিন্ন সমাজ-ধর্মীয় আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রকাশ ঘটে। ঊনবিংশ শতকে ভারতে বিভিন্ন সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ব্রাহ্ম আন্দোলন, ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন, আর্য সমাজ, প্রার্থনা সমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলির প্রভাবে মানুষ ক্রমশ আত্মসচেতন, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল হয়ে ওঠে। তারা একদিকে যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হয়ে ওঠে, অপরদিকে তেমনি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগরিত হয়।
(৪) ব্রিটিশ সরকারের বর্ণবৈষম্য ও জাতি বিদ্বেষমূলক নীতি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে পরিপক্ক করে তোলে। ড. এন বোস-এর মতে, “ঊনবিংশ শতকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জাগরণে জাতিগত বৈষম্য ছিল একটি মুখ্য কারণ।” প্রকৃতপক্ষে শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা জাতিগত কারণে ভারতীয়দের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত। ব্রিটিশ শাসক ভারতীয়দের কালা আদমি, অসভ্য, অনুন্নত জাতি বলে ঘৃণা করত। এছাড়া ভারতীয়রা বাস, ট্রেন, পার্ক, হোটেল ইত্যাদিতে জাতিগত কারণে বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়। ইংরেজদের এধরনের আচার-আচরণ ভারতীয়দের ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ক্ষুব্ধ করে তোলে।
(৫) ইংরেজের এদেশে ক্ষমতা লাভের সময় থেকে অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হয়। তারা এদেশের ধন-সম্পদ লুন্ঠন করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। তারা ভারতের শিল্প ধ্বংস করে ও বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয়রা ক্রমশ দারিদ্র্য ও সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়। দাদাভাই নৌরাজি ‘Poverty and Un-British Rule in India’, রমেশচন্দ্র দত্ত ‘The Economic History of India’ ও মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ‘Indian Economy’ গ্রন্থে ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র তুলে ধরেছেন। ভারতীয়রা এই সকল গ্রন্থ থেকে ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং জাতীয় স্বার্থরক্ষার তাগিদে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা পায়।
(৬) জাতীয়তাবোধের জাগরণে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঊনবিংশ শতকের ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত ও সম্পাদিত বহু পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাগুলির মধ্যে ইংরেজি ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’, ‘বেঙ্গলি’, ‘অমৃতবাজার’, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ এবং বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘বঙ্গবাসী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এইসব সংবাদপত্র সরকারি অর্থনৈতিক শোষণ ও বহুভ্রান্তনীতি নিয়ে আলোচনা করে। ফলে ভারতীয়রা এসব পত্রিকা থেকে শিক্ষালাভ করে এবং তাদের মধ্যে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়চেতনা জাগ্রত হয়।
(৭) দেশাত্মবোধক সাহিত্য ভারতীয়দের মধ্যে জনমত ও জাতীয়তাবাদ গঠনে সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে আশোক কুমার সেন মন্তব্য করেন, “সাময়িক বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে রঙ্গলাল ও হেমচন্দ্র ব্যানার্জী, নবীনচন্দ্র সেন ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা বাংলার উদীয়মান শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে” (‘The Educated Middle Class and Indian Nationalism’, পৃ: ৮৬) । নরহরি কবিরাজ লিখেছেন, “কাব্যের মাধ্যমে স্বাদেশিকতার প্রচার করলেন তিনজন প্রধান কবি। তাঁরা হলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেন।” (‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা’, পৃ: ১৪৪)। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রঙ্গলাল ও হেমচন্দ্রের কাব্য কীর্তি স্মরণ করে লিখেছেন, “রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’, আর তারপরে হেমচন্দ্রর ‘বিংশতি কোটি মানবের বাস’ কবিতায় দেশ মুক্তি কামনার সুর ভোরের পাখির কাকলীর মত”। প্রকৃতপক্ষে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’, ‘রৈবতক’, ‘কুরুক্ষেত্র’ ও ‘প্রভাস’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘আনন্দমঠ’ ও ‘সাম্য’, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ ইত্যাদি রচনা ভারতীয়দের স্বাদেশিকতা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করে।
(৮) ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সিভিল সার্ভিস আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। অশোক কুমার সেন লিখেছেন, “The Civil Service agitation had a special significance in the history of emergence of Indian Nationalism”. ( ‘The Educated Middle Class and Indian Nationalism’, পৃ: ১২৭)। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার ঊর্ধ্বসীমা ২১ বছর থেকে ১৯ বছর নামিয়ে আনায় ভারতীয়রা অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ভারতসভা ও একাধিক প্রতিষ্ঠান ঐ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষিত ও সচেতন ভারতীয়রা এধরনের জাতীয় সমস্যা প্রতিবিধানের জন্য যে আন্দোলন শুরু করে তা থেকেই ভারত ইতিহাসে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় বিক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং জাতীয়তাবাদী ধারণা বিকশিত হয়।
(৯) ভারতে ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে বিভিন্ন বিক্ষোভ-বিদ্রোহ দেখা যায়। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে সংঘটিত বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম হল ওয়াহাবি আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬) ও মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭)। এগুলির মধ্যে বেশির ভাগই ইংরেজ সরকার দমন করে ও সেগুলি ব্যর্থ হয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্বেষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়।
(১০) পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভ জাতীয়তাবাদী চেতনা পুষ্ট হতে সাহায্য করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি আশা করেছিলেন যে তাঁরা সরকারের অধীনে উপযুক্ত চাকরি পাবেন, কিন্তু তাঁদের সেই আশা পূরণ হয়নি। কেননা, সরকারের সকল উচ্চপদ ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ফলে তাঁদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ব্রিটিশ-বিরোধী ক্ষোভ ক্রমশ জাগ্রত হয়। শুধু তাই নয়, তাঁরা জনসাধারণের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী চেতনার বিকাশ ঘটাতে তৎপর হয়ে ওঠেন।
(১১) ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এই শতককে ‘সভা সমিতির যুগ’ বলা হয়। রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (১৮৩৬), জমিদার সভা (১৮৩৮), বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৩৯), ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫১), ইন্ডিয়ালিগ (১৮৭৫), ভারতসভা (১৮৭৬), ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫) ইত্যাদি। এই সব রাজনৈতিক সংগঠনগুলি সরকারের নীতি ও কার্যকলাপের সমালোচনা করে এবং ভারতীয়দের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে। ফলে এগুলির প্রভাবে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ হল মানব প্রকৃতির ভাবাবেগ বা ভাবাদর্শ। জাতীয়তাবাদী ভাবনার জাগরণ ও উদ্ভবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইউরোপ। পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে প্রথম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী ভাবনা ক্রমশ বলিষ্ঠ হতে থাকে। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে জার্মানি, ইতালি ও মধ্য ইউরোপে আধুনিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে এবং এটি একটি সাধারণ আন্দোলনে পরিণত হয় — সেখানে জার্মানি, ইতালি সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। পরে এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদ ক্রমশ বিশ্বের ক্ষুদ্র-বৃহৎ বিভিন্ন জাতির মধ্যে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদ সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ঠিক ততটাই সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলির জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা সংশ্লিষ্ট দেশগুলির রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ইউরোপে তুরস্ক সাম্রাজ্যভুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বলকান জাতিগুলির রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা থেকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যার পরিণতি হিসেবে ইউরোপ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে এবং চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়। ঠিক একইভাবে ভারতের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বা জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম হয়। এর পরিণতি হিসেবে ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ বা জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা কোনও দেশের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের পক্ষে যথেষ্ট অর্থবহ, কিন্তু কোনও দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলির এ ধরনের মনোবাসনা সেই দেশের ঐক্য-সংহতি ও অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বিভেদাত্মক।