জাতীয়তাবাদ এবং বাংলা নাটক : প্রেক্ষিতে প্রাক্-স্বাধীনতা পর্ব

শর্মিলা ঘোষ

[ অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি এই প্রবন্ধ উৎসর্গীকৃত।]

এক

বাংলা মৌলিক নাটক প্রায় সূচনা পর্ব থেকেই সামাজিক সমস্যার কথা বলেছে। রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) তার প্রমাণ। এর পরবর্তীতে উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবাবিবাহ নাটক’ (১৮৫৬) এবং মধুসূদন দীনবন্ধুর নাটক প্রহসনে সমকালীন সমাজের নানা বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। কিন্তু শুধু সামাজিক বিষয় নয়, বাংলা সাহিত্যে ক্রমশ দেখা দিল নবজাগ্রত এক দেশপ্রেমের বোধ। যা সামগ্রিকভাবে বাংলা নাটক ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল।

অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ ১৮৮৫ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত সময়সীমায় ভারতীয় সাহিত্যের যে বৈশিষ্ট্যগুলি  উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে আমাদের এই আলোচনায় নীচে উল্লিখিত কয়েকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। [১]

1. The growth of political consciousness and nationalism and its relation with the literature of this period.

2. Re-interpretation of our post Heritage and creation of new heroes out of our history and legends.

3. Contemporary social religious movements and their impact on literature.

অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ উনিশ শতকের শেষ পর্ব থেকে ভারতীয় সাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ হিসেবে যে জাতীয়তাবাদের প্রকাশ লক্ষ করেছিলেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ সন্দেহ নেই, তবে বাংলায় তার সূচনা হয়েছিল কিছুটা আগেই এমনটাই মনে হয়েছে আমাদের। বস্তুত ১৮৬০ সালে ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা এবং ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা ও সেখানে সূচনাকারী নাটক হিসেবে ‘নীলদর্পণ’ অভিনয় এই আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাইলস্টোন। সমকালীন অন্যান্য নাটকের তুলনায় ‘নীলদর্পণ’ সর্ব অর্থেই ব্যতিক্রমী এবং এর মধ্যে দিয়ে বৃহৎ বাংলার একটি পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমনটা বলা যেতে পারে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের যে বর্ণনা দীনবন্ধু দিয়েছেন তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই আলোচনায়। যদিও এই নাটক পাঠ করে নীলকর সাহেবদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে এবং “এক্ষণে তাহারা নিজে নিজে মুখ সন্দর্শন পূর্বক তাহাদের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা কলঙ্কতিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার শ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখরক্ষা হয়।”[২] এমন আশা নীলদর্পণকার করেছিলেন এ কথা সত্য, তবু বাংলা নাটকে জাতীয়তাবাদ প্রকাশের নান্দীমুখটুকু ‘নীলদর্পণ’-এর মাধ্যমে ঘটেছিল এমনটা বলা যেতে পারে। বস্তুত “পরাধীন দেশের বিপন্ন আত্মমর্যাদার প্রথম প্রতিবাদী আত্মপ্রকাশ দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’।”[৩]

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা বরং এর প্রেক্ষাপট দেখে নিতে পারি। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সময় থেকে স্বদেশীভাব মানুষের মনে অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছিল। এরপর সিপাহি বিদ্রোহ এবং নীলচাষীদের সংগ্রাম সেই স্বদেশি ভাবকে জাগ্রত করেছিল সন্দেহ নেই। অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় নীলকরদের অত্যাচারের কথা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “ভূস্বামীদিগের বিষম অত্যাচারের বিবরণ পাঠ করিলে বিস্ময়াপন্ন ও ব্যাকুল চিত্ত হইতে হয়। কিন্তু এক্ষণে চতুর্দিক হইতে এই কথাই শ্রুত হওয়া যাইতেছে যে নীলকরদের অত্যাচার তদাপেক্ষা ভয়ানক, তাহাদের দৌরাত্ম্যে প্রজাকুল নির্মূল হইবার উপক্রম হইয়াছে।” [৪] ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকার প্রতি সংখ্যায়  নীলকরদের অত্যাচারের জ্বলন্ত বিবরণ প্রকাশ করতেন এবং এইভাবে তৎকালীন শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি তিনি সেদিকে আকর্ষন করাতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাপরে বাপ! নীলকরের কি অত্যাচার’ নামক ১৬ পৃষ্ঠার একটি প্রচার পুস্তিকা। এমন কি প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থেও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা লেখা হয়েছিল। প্যারীচাঁদ লিখেছেন “নীলকরের জুলুম অতিশয় বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রজারা নীল বুনিতে ইচ্ছুক নহে, কারণ, ধান্যাদি বোনাতে অধিক লাভ, আর যিনি নীলকরের কুঠিতে যাইয়া একবার দাদন লইয়াছেন তাহার দফা একেবারে রফা হয়। ….নীলকর ব্যাটাদের জুলুমে মূলক খাক হইয়া গেল। প্রজারা ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। হাকিমরা স্বজাতির অনুরোধে তাহাদিগের বশ হইয়া পড়ে আর আইনের যেরূপ গতিক তাহাতে নীলকরদের পলাইবার পথও বিলক্ষণ আছে।” [৫]

এইরকম একটা সময়ে যখন বাংলার সমসাময়িক সাহিত্যে ও সংবাদপত্রে  নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা বারবার নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, তখনই ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ রচনা। যা সর্ব অর্থেই বাংলা নাট্যক্ষেত্রে একটি দিকচিহ্ন।

এরপরেই  বিশেষ উল্লেখযোগ্য হিন্দুমেলার প্রসঙ্গটি। নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  সহযোগিতায় ১৮৬৭ সালে হিন্দু মেলা শুরু হয়। স্বদেশের উন্নতি সাধনই  এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। বিশিষ্ট নাট্য সমালোচক লিখেছেন, “বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় ইতিহাসের বর্ণময় চিত্র ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের কবিতায় স্বদেশী ভাবের উচ্ছ্বাস এবং হিন্দুমেলার সর্বাত্মক স্বদেশী ভাবোদ্রেক কর্মপ্রণালী জনগণের মধ্যে অতীতের গৌরববোধ এবং বর্তমান হীন অবস্থার জন্য যে বেদনা ও ক্ষোভ জমে উঠেছিলো তারই প্রতিফলন ঘটেছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর সমসাময়িক নাট্ককারদের নাটকে।” [৬] 

এই পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেই হরলাল রায়ের নাটকেও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ লক্ষ করতে পারি। ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন, “হরলালের ‘হেমলতা’ নাটকে এযুগের পরাধীনতার বেদনাবোধ প্রথম প্রকট হয়েছে।” [৭] তাঁর পরবর্তী  নাটক ‘বঙ্গের সুখাবসান’ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় ও তার পরবর্তী ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে হিন্দুমেলার জাতীয় ভাবাবেগের প্রকাশ ঘটেছিল। তাঁর ‘পুরুবিক্রম’, ‘সরোজিনী’ বা ‘চিতোর আক্রমণ’ নাটক, ‘অশ্রুমতি’ এবং ‘স্বপ্নময়ী’ প্রতিটি ঐতিহাসিক নাটকেই জাতীয়তাবোধের আবেগ লক্ষণীয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অতীতের গৌরবগাথাকে ভবিষ্যৎ ভারতের রোমান্টিক কল্পনার সূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেছেন। ভারতের নবজাগ্রত স্বদেশপ্রেমের একটা রূপ তিনি তাঁর নাটকের মধ্যে দিয়ে তৈরি করে দিতে চাইছিলেন এমনটা বলা যেতে পারে। হিন্দুমেলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আরেকজন নাটককার উপেন্দ্রনাথ দাস।

দুই

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইতিমধ্যেই ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটার বা জাতীয় নাট্যশালার উদ্বোধন হয়েছে এবং সেখানে প্রথম নাটক হিসেবে  ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় আমাদের এই আলোচনার অভিমুখকে আরও প্রামাণ্যতা দেয়। ‘নীলদর্পণ’ ছাড়াও ন্যাশনাল থিয়েটার এবং পরবর্তীতে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’, ‘সরোজিনী’, হরলাল রায়ের ‘হেমলতা’ ‘বঙ্গের সুখাবসান’, অমৃতলাল বসুর ‘হীরকচূর্ণ’ প্রভৃতি নাটক অভিনীত হচ্ছে এই পর্বে এবং এগুলির মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটছে। ইতিমধ্যে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৫ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে পশ্চিম ভারতের লাহোর, মিরাট, লখনউ ইত্যাদি স্থানে নাটক অভিনয় করতে যায় এবং লখনউতে ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনয় করার সময় এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। নটী বিনোদিনীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ক্ষেত্রমণিকে রোগ সাহেবের অত্যাচার এবং তোরাপের এসে রোগ সাহেবকে গলা টিপে ধরে মারার দৃশ্যে দর্শক হিসেবে উপস্থিত সাহেবরা খুব খেপে গিয়েছিল। বিনোদিনী লিখেছেন — “ক্রমে সেই দৃশ্যটা এল রোগ সাহেব ক্ষেত্রমণিকে ধরে পীড়ন করছে আর ক্ষেত্রমণি নিজের ধর্ম রক্ষার জন্য কাতর প্রাণে চিৎকার করে বলছে ‘ও সাহেব তুমি আমার বাবা, মুই তোর মেয়ে ছেড়ে দে আমায় ছেড়ে দে।’ তারপর তোরাব এসে রোগ সাহেবের গলা টিপে ধরে হাঁটুর গুতো দিয়ে কিল মারতে আরম্ভ করেছে অমনি সাহেব দর্শকদের মধ্যে একটা হৈ চৈ পড়ে গেল। সব সাহেবরা উঠে দাঁড়াল পেছন থেকে সব লোক ছুটে এসে ফুট লাইটের কাছে জমা হতে লাগল — সে একটা কি কাণ্ড! কতকগুলো লালমুখো গোরা তরোয়াল না খুলে স্টেজের ওপর লাফিয়ে পড়তে এল। আর পাঁচজনে তাদের ধরে রাখতে পারে না। সে কি হুড়োহুড়ি, কি ছুটোছুটি! ড্রপ তো  তখনই ফেলে দেওয়া হল, — আর আমাদের সেকি কাঁপুনি আর কান্না! ভাবলাম আর রক্ষে নেই এইবার ঠিক আমাদের কেটে ফেলবে।” [৮] বিনোদিনী আরও লিখেছেন যে, ম্যাজিস্ট্রেট কেল্লা থেকে সৈন্য নিয়ে গোলমাল বন্ধ করেছিলেন। বলাবাহুল্য সেদিনকার অভিনয় তখনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশি প্রহরায় মহিলা অভিনেত্রীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে রাত্রেও পুলিশ পাহারা দেওয়া হয়েছিল। তির যে ঠিক জায়গাতেই লাগছে এবং এর ফলশ্রুতিতে বাংলা নাটক যে শাসকশ্রেণির দিক থেকে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হবে সে কথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

এই পর্বে হিন্দুমেলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আর একজন নাটককার  উপেন্দ্রনাথ দাস। আমরা পূর্বে তাঁর কথা উল্লেখ করেছিলাম তাঁর  ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’  নাটকে পরাধীনতার ক্ষোভ প্রকাশিত। এই নাটকের অভিনয় প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং সরকারি আদেশে এই নাটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৮৭৫-এর শেষ এবং ১৮৭৬ সালের শুরুতে ঘটেছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বরে মহারানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস বা সপ্তম এডওয়ার্ড এদেশে আসেন। তাঁর এই  আগমন নিয়ে কলকাতা শহরে  বিশেষ ধুমধাম পড়ে গিয়েছিল। হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকিল ভবানীপুর নিবাসী জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে প্রিন্স অব ওয়েলস-কে অভ্যর্থনা জানান এবং সেই ঘটনা নিয়ে কলকাতা শহরে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এর বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশিত হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলা রঙ্গমঞ্চ এ বিষয়ে পিছিয়ে রইল না। ১৮৭৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটকের সঙ্গে অভিনীত হল ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ নামক একটি ফার্স। ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে পুনরায় এটির অভিনয় হয়। ফার্সটি সম্ভবত উপেন্দ্রনাথ দাস এর লেখা। দ্বিতীয় অভিনয়ের পরই পুলিশ নাটকটির অভিনয় বন্ধ করে দিলে ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘হনুমান চরিত্র’ নাম দিয়ে একই নাটকের অভিনয় হয়। এই নাটকে প্রত্যক্ষত নাটককার রূপে উপেন্দ্রনাথ দাসের নাম না থাকলেও মনে করা হয় এটি তাঁরই লেখা। এই অভিনয়ও স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ করে দেওয়া হয় পুলিশের তরফ থেকে। ‘হনুমান চরিত্র’ অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া হলে উপেন্দ্রনাথ তৎকালীন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ল্যাম্ব এবং পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ-কে বিদ্রুপ করে ‘The Police of Pig and Sheep’ নামে একটি ফার্স রচনা করেন এবং ১৮৭৬ সালের ১ মার্চ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ নাটকের সঙ্গে এটি অভিনীত হয়। এর আগেই সম্ভবত ২৯ ফেব্রুয়ারি বড়লাট লর্ড নর্থব্রুক বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যাভিনয়কে দমন ও সংযত করার জন্য একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন এবং এ সম্পর্কে একটি আইন প্রণয়ন করতে চাইলেন। অর্থাৎ গোপনে এই ধরনের নাটক নিষিদ্ধ করার তোড়জোড় তাঁরা চালাচ্ছিলেন। অর্ডিন্যান্সে বলা হয়, যে কোনও নাটক যা “Scandalous, Defamatory, Seditious, Obscene or otherwise Prejudicial to the public interest” — তা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারের আছে। [৯] নানা পত্র-পত্রিকায় এই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে সমালোচনা হলেও সরকার তা তুলে নেননি। এই সূত্রেই ১ মার্চ অভিনয় চলাকালীন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে পুলিশ হানা দেয় এবং উপেন্দ্রনাথ দাসের অনুপস্থিতিতে ম্যানেজার অমৃতলাল বসুর হাতে সরকারি আদেশের প্রতিলিপি তুলে দেয় এবং এই ধরনের নাটকের অভিনয় করতে নিষেধ করে : “… asking the authorities not to play the farce ‘Gajadananda’, ‘Hanuman Charitra’ or ‘Police of Pig and Sheep’ in the night and similar other farces that were Libellous and Obscene, anymore on their stage, on pain of plants under the ordinance.” [১০]

এরপর ৪ মার্চ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘সতী কী কলঙ্কিনী’ নাটকের অভিনয় চলাকালীন পুলিশ হানা দেয় এবং পরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস, ম্যানেজার অমৃতলাল বসু, ভুবনমোহন নিয়োগী, রামতরণ সান্যাল প্রমুখ অনেককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ৬ মার্চ থেকে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় বিচারে ডিরেক্টর উপেন্দ্রনাথ দাস এবং ম্যানেজার অমৃতলাল বসুর এক মাসের কারাদণ্ড হয়। পরের দিনই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। এঁদের দুজনের পক্ষ থেকে উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি আপিল করেন এবং এঁদের হয়ে সওয়াল করেন মনমোহন ঘোষ, তারকনাথ পালিত এবং ব্রানসন। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিচারপতি এঁদের মুক্তি দিলেন ২০ মার্চ ১৮৭৬ তারিখে। শাসকের কাছে এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই ছিল চূড়ান্ত অপমানকর। তারা এতটুকু সময় নষ্ট না করে ২০ মার্চ তারিখেই নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলটি লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে উপস্থাপন করেন। বাংলার নাট্যমোদী মানুষ এর বিরুদ্ধে চুপ করেছিলেন না। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এর বিরুদ্ধে জনমত প্রকাশিত হয়। অমৃতবাজার পত্রিকা-সাধারণী পত্রিকা-বসন্তক পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু কলকাতার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও Dramatic Performances Control Bill-এর খসড়া প্রস্তুত হল এবং ১৮৭৬ সালের শেষে প্রস্তাবিত বিলটি পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়। মজার কথা হল ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ নাটকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অশ্লীলতার। নাটকটি যে অশ্লীল নয় সে কথা সেদিন অনেক বিশিষ্ট মানুষই বলেছিলেন, কিন্তু তাতে কোনও ফল হয়নি।

এই Dramatic Performances Control Bill-এর খসড়া করেছিলেন হব হাউস। তিনি দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘চা-কর দর্পণ’ নাটকটির কথাও উল্লেখ করেছিলেন। কারণ সেখানে চা-কর সাহেবদের প্রতি আক্রমণ করা হয়েছে। বিশিষ্ট অধ্যাপক গবেষক [১১] আরও জানিয়েছেন এই আইনের জেরে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয়ও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে কোর্ট দৃশ্যটি বর্জন করে এটি পুনরায় অভিনয়ের অনুমতি পায়। বিশিষ্ট অধ্যাপক [১২] সঠিক ভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ইংরেজ সরকার বহু পূর্ব থেকেই গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতি বিরাগ ভাজন ছিলেন। কারণ এদের অভিনীত নাটকগুলিতে বারবার সরকার বিরোধী মনোভাব ফুটে উঠতে দেখা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’ প্রমুখ নাটকে স্বাধীনতা ও গৌরবময় ভারতবর্ষের কথা আছে। হরলাল রায়ের পূর্বোক্ত নাটক দুটিতেও জাতীয়তাবোধের প্রকাশ স্পষ্ট। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে নটী বিনোদিনীর বর্ণনায় লখনৌ শহরের ঘটনাটির উল্লেখ পূর্বেই করা করা হয়েছে। আবার ‘ভারতমাতা’ নাটকটিতে মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও ভারতীয়দের যে দুরবস্থা, অন্নের জন্য হাহাকার, বিদ্রোহী সন্তানদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের ব্যবহার প্রভৃতি দৃশ্যে সরকার খুব খুশি হতে পারেননি। উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎ সরোজিনী’ নাটকে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য পুনরুদয় ইত্যাদি বাক্য তাদের বিশেষ মনঃপুত হয়নি। ‘হীরকচূর্ণ’ নাটকেও গায়কোয়ারের গদিচ্যুতি ও নর্থব্রুকের সরকার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য আছে। দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘চা-কর দর্পণ’ নাটকেও চা-কর সাহেবদের অত্যাচারের বর্ণনা আছে। সুতরাং বলা যেতে পারে ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। সেই অবস্থায় প্রথমে ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ তারপর ‘জগদানন্দ ও যুবরাজ’, ‘হনুমান চরিত্র’ এবং ‘The Police of Pig and Sheep’ আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল বলা যায়। অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় [১৩] দেখিয়েছেন নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ত্রয়ী হলেন উপেন্দ্রনাথ দাস, দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায় এবং অমৃতলাল বসু। ‘এঁরা ছিলেন একাধারে নট, নাট্যকার এবং নাট্য আন্দোলক।’

নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া উপস্থাপিত হবার পর নানাদিক থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতায় সমকালীন সময়ের জনমত খুঁজে পাওয়া যায়। অমৃতবাজার পত্রিকা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় (১৪ ডিসেম্বর, ১৮৭৬)। ‘সাধারণী’ পত্রিকার ৩রা পৌষ, ১২৮৩ সংখ্যায় এই বিল পাস হওয়ার কথা উল্লেখ করে জনমতকে অগ্রাহ্য করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছিল। ‘বসন্ত’ পত্রিকায় কার্টুন চিত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন কার্টুনটির নীচে লেখা ছিল “মশা মারিতে কামান।” আর কার্টুনটির ছবিতে আছে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের উপর একটি মশা  বসে আছে এবং অন্যদিকে দুজন বিদেশি ইংরেজের মধ্যে একজন  কামানে আগুন দেবার চেষ্টা করছে আর অন্যজন ভয়ে দুই হাতে কান চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যঙ্গচিত্রটি থেকে বোঝা যায় সামান্য নাটক নিয়ে সরকার কতটা ভীত ছিল। অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত গ্রন্থটিতে [১৪] এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আগ্রহী পাঠককে বইটি দেখে নিতে অনুরোধ করি।

নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ফলে বাংলা নাটক এবং তার অভিনয়ের দিশা অনেকটাই বদলে গেল এমনটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। একেবারে প্রথম থেকেই সমাজের বাস্তব চিত্র এবং তার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং তার পরবর্তীতে স্বদেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক বোধের যে প্রকাশ নাটকে ঘটছিল তা ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করল। ভক্তি রসাত্মক পৌরাণিক নাটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন বাঙালি নাট্যজনকে যেন কিছুটা আড়ষ্ট করে রেখেছিল। দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছিল। বাংলা নাটক ও নাট্যমঞ্চ তখন যেন কোনও সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এই সময় থেকে বাংলা নাট্য ক্ষেত্রে প্রধানত পৌরাণিক ভক্তিরসাত্মক নাটকের রচনা ও অভিনয় শুরু হয়। দেশাত্মবোধ সরিয়ে রেখে বাংলা নাটক বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল উনিশ শতকের শেষপর্বে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের ভাবধারা থেকে গড়ে ওঠা হিন্দু পুনর্জাগরণের আদর্শ। এর ফলে বাংলা নাট্যক্ষেত্রে অধোগতি হল, বাংলা নাটকের অন্ধকার নেমে এল এমন মন্তব্য খুব সহজেই করে থাকেন সমালোচকরা কিন্তু প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র এর একটি অসামান্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথায় রামকৃষ্ণের গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদার চিন্তাধারা একদিকে যেমন কেশব সেন স্বামী বিবেকানন্দের মতো বুদ্ধিজীবীদের আকর্ষণ করল, অন্যদিকে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করল। তেমনি “থিয়েটারও সঙ্গে সঙ্গে একটা কেন্দ্র পেল — তৎকালীন সমাজের ঘূর্ণিঝড়ে সেও ছিল অস্থির। এই কেন্দ্রের, সমাজের এই অন্তঃকরণের বোধ যে কোন মহৎ শিল্পসৃষ্টির পক্ষে অপরিহার্য। …বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে আমাদের আলোচ্য পর্বে এই সাযুজ্য এনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লেখা নাটক শুধু  জনপ্রিয় হলো তাই নয়, দর্শকদের মনের মধ্যে প্রচন্ড আলোড়ন তুলল।” [১৫] 

আবার এই একই ঘটনাকে এক রকম করে জাতীয়তাবাদের একটি মধ্যযুগীয় প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন পরবর্তী যুগের এক বিশিষ্ট নাট্য সমালোচক প্রাবন্ধিক। তাঁর কথায়, “মধ্যযুগের ইতিহাসে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে ধর্মের মধ্যে দিয়ে, চর্যাপদ মঙ্গলকাব্য চৈতন্যদেবে যার রুপ দেখতে পাই, তেমনি করেই হয়তো উনিশ শতকের বাঙালিও পৌরাণিক ধর্মের মধ্যেই তার আত্ম পরিচয়ের খোঁজ করছিল।” [১৬] তবে শম্ভু মিত্রের এই ব্যাখ্যাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, “সে যুগটা ধর্মীয় আন্দোলনের সময় বোধহয় ছিল না। দেশে তখন আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার এবং আর্থিক উন্নয়নের।… শ্রীচৈতন্য বা কবীরের সময়ে ধর্মীয় নাট্য হয়তো বৈপ্লবিক হতে পারত, কিন্তু উনিশ শতকের শেষার্ধে তার এই প্রভাব আংশিক হতে বাধ্য।[১৭] এই আড়ষ্টতা বাংলা নাটক এবং নাট্যমঞ্চ কাটিয়ে উঠল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। 

নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ফলে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাকে আঘাত করে নাটক লেখার যে প্রচলন শুরু হয়েছিল তা বন্ধ হয়ে গেল। উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে বাংলা নাটক রচনা ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে পৌরাণিক ও ভক্তি রসাত্মক নাটকের প্রাধান্যই আশ্চর্যজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন এর প্রধান কারণ বলে মনে হয়। 

অধ্যাপক শিশির কুমার দাশ উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের সূচনাপর্বে ভারতীয় সাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ হিসেবে যে জাতীয়তাবাদের প্রকাশের কথা বলেছিলেন তা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি পর্যবেক্ষণ। কিন্তু বাংলা নাটকে তা এসেছিল আরও খানিক আগে, এমনটা দেখানোর চেষ্টা করলাম আমরা। বস্তুত ‘নীলদর্পণ’ বা তারও আগে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ থেকে শুরু করে বাংলা নাটক বারবার সমকালীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাকে নাটক লেখা এবং অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিষয় করেছে। সেই গৌরবের ইতিহাসই ফিরে দেখার চেষ্টা করলাম আমরা। নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল আইনে পরিণত হবার পর বাঙালি যেন কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল,  দেশাত্মবোধ বা জাতীয়তা থেকে সরে এসে বাংলা নাটক এবং নাট্যমঞ্চ পুরাণ এবং ভক্তিরসকে আশ্রয় করেছিল। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের ভাবধারা থেকে গড়ে ওঠা হিন্দু পুনর্জাগরণের আদর্শকে গ্রহণ করেছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কিন্তু জাতীয়তাবাদী ভাবনার প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলা নাটকে আবার একটা প্রবল বিস্ফার ঘটাল।    

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করলেও বহু আগে থেকেই এর বীজ পোঁতা শুরু হয়েছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কয়েকবার বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার নানা প্রস্তাব [১৮] ইংরেজ শাসকের পক্ষ থেকে এসেছিল যদিও কোনও ক্ষেত্রেই তারা সফল হননি। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার তৎকালীন ছোটোলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজার বাংলা ভাগের জন্য নতুন একটি খসড়া প্রস্তাব আনেন। বাংলার শক্তি খর্ব করার চক্রান্ত এই প্রস্তাবে ছিল। যদিও প্রস্তাবটি পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে যায় এবং সরকার বাধ্য হয়ে পিছিয়ে যান। লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রস্তাবটি রচনা করেন এবং সেটি অনুমোদনের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে ক্রমশ ভারতীয়দের মনে বিক্ষোভ জমা হচ্ছিল। ১৯০৩ সালে মাদ্রাজ কংগ্রেসের এবং ১৯০৪ সালে বোম্বাই কংগ্রেসের অধিবেশনে এর বিরুদ্ধে রেসোলিউশন নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯০৫ সালের ৯ জুন তারিখের ডেসপ্যাচে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করলেন তদানীন্তন ভারতসচিব ব্রডরিক। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “বিলেতের সম্মতি পাবার পর কার্জন এবং অ্যান্ড্রু ফ্রেজার অবিলম্বে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা কাজে পরিণত করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। কার্জন স্বয়ং রচনা করেছিলেন সরকারি আদেশনামা। সেটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই। এর সামান্য কিছু পরেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে।” [১৯] আন্দোলনের অন্য কোনও দিক নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই কিন্তু বাংলা নাটক এবং নাট্যমঞ্চ যে এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে প্রবলভাবে সাড়া দিয়েছিল সেটাই এখানে আমাদের মূল আলোচ্য। ফলে, ‘ বিশ শতকের প্রথম ১০ বছরে বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের সংক্ষিপ্ত উজ্জীবন ঘটেছিল ওই বঙ্গভঙ্গের আবহেই’ এমনটা মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট সমালোচক। [২০]

ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এর লেখা ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ (১৯০৩) সম্ভবত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে লেখা প্রথম বাংলা নাটক। বিশিষ্ট সমালোচক জানিয়েছেন, “বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের প্রারম্ভ হইতেই বাংলার ঐতিহাসিক চরিত্র অবলম্বন করিয়া নাটক রচনায় যে প্রেরণা দেখা দিয়াছিল প্রতাপাদিত্য নাটক ক্ষীরোদপ্রসাদের সেই বিষয়ক প্রথম প্রয়াস।”[২১] বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সেই প্রেক্ষিতে স্বদেশি যুগে নাটকটির প্রভাব স্বীকার করে নিয়ে নাটকটির ভূমিকায় মন্মথ মোহন বসু লিখেছিলেন, “প্রতাপাদিত্য নাটকখানি এক হিসেবে আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাস।” বস্তুত স্বদেশি আন্দোলনের সেই পর্বে ব্রিটিশ শাসক যখন দমননীতি-বিভেদনীতি অবলম্বন করে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে জাতীয় জাগরণকে স্তব্ধ করতে চাইছিল, সেই সময় পর্বেই ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ নাটকটি রচনা। এই নাটক তাই শুধু ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে নয়, দেশপ্রেমের বা জাতীয়তাবোধের নাটক হিসেবেই চিহ্নিত। ক্ষীরোদপ্রসাদ এর ‘পদ্মিনী’ (১৯০৬), ‘নন্দকুমার’ (১৯০৭), ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০৭), ‘বাংলার মসনদ’ (১৯১০) প্রভৃতি নাটকেও স্বাদেশিকতার বোধ স্পষ্ট। ‘নন্দকুমার’ নাটকে নাটককার ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকের মতোই জাতীয়তাবাদের প্রকাশ করতে চেয়েছেন। নন্দকুমারের সততা সাহসিকতা এবং সত্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মবিসর্জনের আদর্শ নাটকে প্রচার করতে চেয়েছিলেন। বিশিষ্ট সাহিত্যের ঐতিহাসিক [২২] জানাচ্ছেন যে, এই নাটকটির প্রচার এত বেড়ে গিয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার এর প্রচার বন্ধ করে দেন। ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘পদ্মিনী’ নাটকেও স্বদেশপ্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এই নাটকের একটি চরিত্রের মুখ দিয়েই নাটককার বলিয়েছিলেন — “মাতৃভূমি রক্ষাই প্রত্যেক সন্তানের একমাত্র উদ্দেশ্য।” [২৩]

প্রধানত পৌরাণিক ভক্তি রসাত্মক নাটকে কৃতিত্ব দেখালেও বঙ্গভঙ্গের এই আবহে গিরিশচন্দ্র রচনা করলেন ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘মিরকাসিম’ এবং ‘ছত্রপতি’ নাটক। প্রতিটি নাটকেই অতীতের কোনও বীর চরিত্রের অনুষঙ্গে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা। এই তিনটি নাটকেই গিরিশচন্দ্র যথাক্রমে সিরাজদ্দৌলা, মির কাশেম এবং ছত্রপতি শিবাজীকে জাতীয়বীর চরিত্র রূপে তুলে ধরতে চেয়েছেন। জাতীয়তাবাদী প্রচারের জন্য ইংরেজ সরকার এই নাটকগুলির অভিনয় ও প্রচার  নিষিদ্ধ করে দেন। এর থেকে বোঝা যায় এই নাটকগুলি বিশেষত সিরাজদ্দৌলা জনমানসে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটল ‘রাণা প্রতাপসিংহ’, ‘দুর্গাদাস’, ‘মেবার পতন’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘সিংহল বিজয়’, ‘সাজাহান’, ‘নূরজাহান’ প্রমুখ নাটকে। রানা প্রতাপসিংহ দেশপ্রেম আর বীরত্বের এক উল্লেখযোগ্য নাটক। দেশের জন্য, আক্রান্ত জাতির জন্য এক মরণপণ লড়াই এ নাটকে দেখিয়েছেন নাটককার। ‘মেবার পতন’ নাটকেও দেশপ্রেমের অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে তবে শেষ পর্যন্ত এই নাটকে বিশ্বপ্রেমে উত্তরণের কথা আছে। বস্তুত দেশাত্মবোধক নাটক লিখলেও দ্বিজেন্দ্রলাল শেষ পর্যন্ত অনুভব করেছিলেন যে, “শুধু দেশপ্রেম, জাত্যাভিমান কিংবা প্রচলিত স্বদেশী ধ্যান-ধারণার প্রচার এর বাইরেও নাটক ও নাট্যকারের সাধনা একটি স্বাভাবিক উত্তরণের অপেক্ষায় থাকে — এবং সেই উত্তরণ হচ্ছে সংকীর্ণতা থেকে অসীমতায় উত্তরণ,…” [২৪] 

এই পর্বে অমৃতলাল বসু রচনা করলেন ‘নবজীবন’ ও ‘সাবাস বাঙালি’। বঙ্গভঙ্গের এই রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি নাটককাররা যখন নাটক রচনা করছেন তখন তারা বারবার জোর দিচ্ছেন সাম্প্রদায়িক মিলনের উপর। তারই সঙ্গে রয়েছে “স্বদেশ হিতবাদ এবং সর্বার্থেই একটি সর্বাঙ্গীণ জাতিত্ব বোধ।” [২৫] অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এই পর্বে লিখেছিলেন ‘বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ’ (১৯০৫)। অধ্যাপক পবিত্র সরকার [২৬] জানিয়েছেন সতীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিস্মৃত নাট্যকারের লেখা ‘বাঙ্গালী পল্টন’-ও (১৯১৭) এই দলে পড়বে।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের এই পর্বে বাংলা নাটক জাতীয়তাবাদের কথা বলছে। স্বাদেশিকতার বোধ জাগিয়ে তুলতে চাইছে। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইতিহাসের কোনও সূত্র ধরে ঐতিহাসিক কোনও ঘটনা বা ঐতিহাসিক চরিত্রের অবলম্বনে যেন খানিকটা পরোক্ষভাবে সমকালীন জীবন এবং রাজনীতিকে স্পর্শ করছে। বাংলা নাটক একেবারে প্রথম পর্বে যেভাবে সমকালের কথা বলত, সমসময়কে নাটকে তুলে ধরত,  “যে চরিত্র নিয়ে উনিশ শতকের প্রথমে বাংলা নাটক জনপ্রিয় ও গৃহীত হয়েছিল সেই বর্তমানের সঙ্গে আদান-প্রদান আর বাংলা নাটকে বজায় থাকেনি। …এমনকি বঙ্গভঙ্গের যুগে দীনবন্ধু উপেন্দ্রনাথ দাস এর রাজনৈতিক বাস্তবতার নাটকেরও তেমন পুনরভ্যুদয়  দেখা গেল না, এই বিস্ময়কর ঘটনার পিছনে সম্ভবত আছে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অনতিপ্রকট  রক্তচক্ষু।” [২৬] “আর তাই দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ কিংবা উপেন্দ্রনাথ দাস-এর ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটক যে অর্থে সমকালীন প্রশাসন ব্যবস্থার কোনো বিশেষ অন্যায় বা সাধারণ বীভৎসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ…” [২৭] তেমনটা কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে লেখা নাটকগুলোর ক্ষেত্রে ঘটেনি। আবার “গিরিশচন্দ্র অমৃত লাল থেকে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই নাটক লিখেছিলেন এ কথা ভাবলে ভুল হবে।”[২৮] — এমনটা মনে করেছেন কোনও বিশিষ্ট নাট্য-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সমালোচক। তিনি বলতে চেয়েছেন সেই সময়কার দর্শক দেশপ্রেমের আবেগে ভেসে যেতে চাইছেন বলেই এই ধরনের নাটক লেখা অর্থাৎ কোথাও জনপ্রিয়তাই প্রধান মাপকাঠি, দেশপ্রেমের আবেগ নয়। এর সপক্ষে তিনি অমরেন্দ্র নাথ দত্তের নাটকের কথা বলেছেন। অমরেন্দ্রনাথ  বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ (১৯০৫)  নাটকটি লিখেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে, সে কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। আবার সেই একই বছরে তিনি ইংল্যান্ডের যুবরাজের আগমন উপলক্ষে ‘এস যুবরাজ’ নাটকটি লিখেছেন। অর্থাৎ কোথাও জনমনোরঞ্জনই প্রধান হয়ে উঠছে এমনটাই বলতে চেয়েছেন বিশিষ্ট অধ্যাপক সমালোচক। বর্তমানের এক বিশিষ্ট নাট্যকার পরিচালক এ প্রসঙ্গে বলেছেন — “যে সমাজে আর সময়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল নাটক রচনা করেছিলেন, দেশপ্রেমকে এমন সার্বভৌম ব্যাপ্তিতে ভাবার প্রয়োজন বা প্রশ্ন তাঁদের তখন তাড়িত করে নি। মূলত পুরাণ আর ইতিহাস আশ্রয়ী জনপ্রিয় নাটক লেখার দায় ছিল তাঁদের, ক্ষুধার্ত মঞ্চকে একটু ভিন্ন স্বাদের খাদ্য সরবরাহের দায়। যেহেতু ইতিহাসের অনুধ্যানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে দেশভাবনা আর কালচেতনা, দেশপ্রেম তাই তাঁদের নাটকে বুদ্ধিদীপ্ত অনুঘটক হিসেবে এসেছে এবং বহু ক্ষেত্রেই পরাধীন দেশের সাধারণ দর্শক মনকে আলোড়িত করেছে।” [২৯] বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ফলে স্বাদেশিকতার বোধ থেকে জাত ঐতিহাসিক নাটক রচনার ধারা বিশ শতকের প্রথম দশক জুড়ে চলেছিল, তার পরবর্তীতে প্রধানত সামাজিক পারিবারিক এবং পৌরাণিক নাটকের রচনা এবং অভিনয় লক্ষ করা যায়। সমকালীন জীবনের কথা সেখানে প্রায় অনুপস্থিত।

বাংলা নাটকে স্বদেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের আলোচনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তালিকাভুক্ত হন না। কারণ সে অর্থে কোনও স্বদেশপ্রেম মূলক নাটক তিনি লেখেননি। স্বাদেশিকতা বোধসম্পন্ন নাটক কিন্তু তিনি তাঁর বাড়ির পরিমণ্ডলের মধ্যেই পেয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন নাটকে প্রকাশিত এই স্বাদেশিকতা বোধ নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। ‘সরোজিনী’ (১৮৭৫) নাটকের একটি অংশে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শমতো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটি বক্তৃতা অংশ বাদ দিয়ে গান ব্যবহার করেন এবং এই গানটি অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গানটি হল ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’। নাটকের মধ্যে গানটি অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত এবং জনপ্রিয় হয়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ১৪ বছর। কিন্তু তারপর ১৮৮১ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ যখন নিজে নাটক রচনা করতে শুরু করলেন তখন সে অর্থে জাতীয়তাবাদী নাটক তিনি লেখেননি। কিন্তু বহিরঙ্গে সে ধরনের নাটক না লিখলেও রবীন্দ্রনাথের নাটক কিন্তু প্রথম থেকেই সমকালীন অন্যান্য নাটককারদের থেকে স্বতন্ত্র। একেবারে প্রথম পর্বের ‘রুদ্রচণ্ড’, ‘কালমৃগয়া’ ইত্যাদি তার প্রমাণ। পরবর্তীকালে ‘রাজা ও রানী’ (১৮৮৯) ও ‘বিসর্জন’ (১৮৯০) লেখার পর্বে তিনি প্রথানুগ নাটক রচনা করেছেন এ কথা সত্য। কিন্তু সে একেবারেই অল্প কিছু সময়ের জন্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকে আরও পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে এই সময়টা কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কালপর্ব। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অনেকগুলি গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু পরে যে কোনও কারণেই হোক তাঁর মোহভঙ্গ হয় এবং তিনি এই আন্দোলন থেকে সরে আসেন। বাইরের আড়ম্বরের তুলনায় ভেতরের গভীর থেকে নিজের দেশকে জানা এবং প্রকাশ করা তাঁর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। তাঁর সৃজন এবং জীবন সবদিক থেকেই সে কথা সত্য এবং স্বাভাবিক ভাবেই নাটকের ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই একই কালপর্বে ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রঙ্গমঞ্চ’ [৩০] প্রবন্ধটি যেখানে তিনি বারবার ইউরোপের তথাকথিত বাস্তববাদী নাটকের যে ধরন তাকে অস্বীকার করতে চাইছেন এবং প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত নাটকের কথা এবং লোকায়ত যাত্রাপালার কথা বলছেন। এই পর্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় নাটকের অনুসরণকে প্রত্যাখ্যান করছেন এবং নিজস্ব একটি দেশজ নাট্যরীতি গড়ে তুলতে চাইছেন। ‘শারোদৎসব’ (১৯০৮) থেকে শুরু করে একেবারে অন্তিম পর্ব পর্যন্ত এই দেশীয় নাট্যরীতির খোঁজ চলছিল এমনটা বলা যেতে পারে। ফলে বহিরঙ্গে না হলেও অন্তরঙ্গে তাঁর নাটক গভীরভাবে স্বাদেশিকতা বোধসম্পন্ন এবং গভীরতর অর্থে আন্তর্জাতিকতার বৈশিষ্ট্যে প্রাণিত।

এর পরবর্তী পর্বে আবার তিরিশের দশকের শুরু থেকে আমরা এমন কয়েকজন নাটককারকে পেলাম যারা তাদের লেখায় সমকালীন রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে ধারণ করার চেষ্টা করছেন। তাদের মধ্যে প্রধান দুজন নাটককার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং মন্মথ রায়। মন্মথ রায় তাঁর নাটকে সমসময়ের কথা বলতে, পরাধীনতার গ্লানি প্রকাশ করতে পুরাণ ইতিহাসের সাহায্য নিয়েছেন। মনে রাখতে হবে তখনও এ দেশ পরাধীন এবং ইংরেজ শাসকরা যে কোনও সময় যে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে অতীত ইতিহাস তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই সমকালীন পরাধীনতার কথা বলার জন্য, স্বাদেশিকতা বোধকে তুলে ধরতে পুরাণ ইতিহাসের ছদ্মবেশ ধারণ করার প্রয়োজন ছিল। মন্মথ রায়ের পৌরাণিক নাটকগুলি অনেক অর্থেই রূপকধর্মী নাটক। তিনি সমকালীন রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে ধরবার চেষ্টা করেছেন এসব নাটকে। ‘দেবাসুর’ (১৯২৮) মন্মথ রায়ের প্রথম দেশাত্মবোধক নাটক। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ এবং তারই বিপরীতে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং অসহায়তা এ নাটকে পরিস্ফুট হয়েছে। ‘কারাগার’ (১৯৩০) মন্মথ রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক। এই নাটক প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছিলেন — “দেশে তখন রাজশক্তির বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল। দলে দলে লোক কারাবরণ করছিল। মহাত্মাজীর নির্দেশও ছিল তাই। এই পটভূমিকায় মহাভারত বর্ণিত কংসের কারাগারের কথা আমার মনে এসেছিল। যে কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল, সেই কারাগারে আজও উদিত হবে আমাদের জাতীয় জীবনের স্বাধীনতার সূর্য। চলো সব সেই মহাতীর্থে — এই ভাব থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল আমার এই কারাগার নাটক।” (‘অমৃত-বিনোদন সংখ্যা’, ১৩৭৯)। [৩১] অর্থাৎ, কংসের কারাগার এখানে যেন পরাধীন ভারতবর্ষের বিস্তৃত এক কারাগারে পরিণত হয়েছে। সমকালীন প্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাটক হয়ে উঠেছে। এই নাটকে পরাধীন এক জাতির মনে মুক্তির আবেগ সঞ্চারিত করা হয়েছে। অপর নাটককার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রথম থেকেই বিদ্রোহী মানসিকতার। তাঁর দেশাত্মবোধক নাটক ‘গৈরিক পতাকা’ এবং ‘সিরাজদ্দৌলা’। মহারাষ্ট্রের একচ্ছত্র বীর শিবাজীর গৌরবময় উত্থান নিয়ে রচিত হয়েছিল ‘গৈরিক পতাকা’ নাটকটি। জাতীয়তাবাদের উদ্দীপনে এ নাটক বিশেষভাবে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। নাটককার নিজেই লিখেছিলেন, “মহারাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজীর স্মৃতি আজও তরুণ বাঙালির প্রাণে যে প্রেরণা এনে দেয়, তাই অবলম্বন করে আমি ‘গৈরিক পতাকা’ রচনা করলুম।” আর এই নাটকটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। স্পষ্টতই এক জাতীয় ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন নাটককার। জাতীয় ভাবাবেগ সৃষ্টিকারী শচীন্দ্রনাথের অপর একটি নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’। পরাধীন সেই সময়পর্বে দেশ ও জাতির মনে ইংরেজ বিরোধী তীব্র মানসিকতার সঞ্চার করেছিল ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটক। এই নাটকে  সিরাজকে তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির প্রতিনিধি স্বাধীনতা সংগ্রামের পরাজিত ট্রাজিক নায়ক রূপেই দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি গিরিশচন্দ্র ঘোষকেই অনুসরণ করেছিলেন। এ নাটকে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা গভীরভাবে বলা হয়েছে। “বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, মুসলমানেরও নয়। মিলিত হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভূমি গুলবাগ এই বাংলা।” [৩২]  এছাড়া ‘কামাল আতাতুর্ক’, ‘বাংলার প্রতাপ’ তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নাটক।  

মহেন্দ্র গুপ্ত আর-একজন ঐতিহাসিক নাটককার। ‘টিপু সুলতান’, ‘রানীভবানী’, ‘রানী দুর্গাবতী’, ‘মহারাজা নন্দকুমার’, ‘পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিং’ তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। নাটকগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি স্বাদেশিকতা বোধ, ইংরেজবিদ্বেষ, হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

বস্তুত বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মন্মথ রায়, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর পরে আবার বাংলা নাটক তার নতুন একটা দিশা খুঁজে পেল পঞ্চাশের মন্বন্তরের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ/ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) ফলে। পঞ্চাশের মন্বন্তর একটা প্রবল অভিঘাত তৈরি করল। গ্রাম ছেড়ে বহু মানুষ বহু কৃষক শহরে আসছে দু-মুঠো ভাতের আশায়। কিন্তু শহর কলকাতার ফুটপাতে তাদের না খেতে পেয়ে মৃত্যু ঘটল। ফ্যান দাও ফ্যান দাও আর্তস্বরে ভরে উঠত এই শহরের আকাশ বাতাস। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব লিখেছেন, “সারা প্রদেশ এক হয়ে এই মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে ধিক্কার দিয়ে উঠলো। এই চেতনা থিয়েটারকে দিল একটি কেন্দ্র, যেখান থেকে সে সবার সঙ্গে শিল্পের ভাষায় কথা বলতে পারে। আমাদের গভীর বেদনা এবং দুঃখই হল এই ঐক্যসূত্র। আর এ থেকে জন্ম নিল আর এক নতুন থিয়েটার যা কাঁধে তুলে নিল এই সামাজিক দায়িত্ব।” [৩৩] এই সময় পর্বেই তৈরি হল গণনাট্য সংঘ। সাধারণ রঙ্গালয় কোথাও যেন গৌণ হতে শুরু করল।

প্রথম যে নাটকটি জনসাধারণের মনে সাড়া জাগিয়েছিল চেতনা এনেছিল সেই নাটকটি বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’। বিজন ভট্টাচার্যের লেখা এবং শম্ভু মিত্র বিজন ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ‘নবান্ন’ গ্রামের সাধারণ কৃষকদের কথা বলল। বস্তুত তারা নিজেরাই নিজেদের কথা তুলে ধরল। গ্রাম ও শহরের বাস্তবতা তার সমস্ত ক্ষতচিহ্ন নিয়ে প্রকাশ পেল ওই নাটকে। বিজন ভট্টাচার্য নিজেই এই নাটকের ভূমিকায় ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলনের উল্লেখ করেছেন। বাংলা নাটক এক অন্য কেন্দ্র খুঁজে পেল। এই সময়পর্বে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গেই আমরা পেলাম দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী প্রমুখ নাটককারকে। আর পেলাম শম্ভু মিত্র-কে যিনি পরবর্তীতে গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত অর্থে মঞ্চে আবিষ্কার করে বাংলা নাট্যের নতুন এক কেন্দ্র আবিষ্কার করলেন।

বাংলা নাটক এবং নাট্যমঞ্চ একেবারে প্রথম থেকেই সমকালকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে। সমকালীন রাজনৈতিক পরাধীনতাকে বারবার নাটকে নিয়ে এসেছে। বাংলা নাটকের সূচনালগ্ন থেকে প্রাক্-স্বাধীনতা পর্ব পর্যন্ত জাতীয়তাবোধ এবং স্বাদেশিকতার অনুষঙ্গ খুঁজে দেখলাম আমরা। ‘নীলদর্পণ’ থেকে ‘নবান্ন’ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম এক অসামান্য বিস্তার। এর পরবর্তী পর্বে স্বাধীনতা-উত্তর দেশভাগ-উত্তর বাংলা তথা ভারতবর্ষে বাংলা নাটক নিশ্চয়ই নতুন করে তার কেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে। নতুন এক দৃশ্য উপস্থাপন করেছে। শুধু বহিরঙ্গে নয় অন্তরঙ্গে প্রকৃত অর্থে স্বদেশীয় হয়ে ওঠার সাধনা করে চলেছে। সে আলোচনার পরিসর এখানে নয়, ভবিষ্যতে অন্য কোনও ক্ষেত্রে সে আলোচনা করা যাবে। 

তথ্যসূত্র :

১। Sisir Kumar Das, ‘The History of Indian Literature’. উদ্ধৃত, সৌমিত্র বসু, বিশ শতকের বাংলা নাটক : একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন, ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকা’, শারদ, ২০১৩, বাংলা নাটক ও নাট্যমঞ্চ, পৃষ্ঠা ১৭।

২। দীনবন্ধু মিত্র, ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ভূমিকা অংশে ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে লেখা থেকে গৃহীত। ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), ‘দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম দে’জ সংস্করণ, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৭১। 

৩। চন্দন সেন, ‘দেশপ্রেমের নাটক : ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘বাংলা নাট্যচর্চা ঐতিহ্য উত্তরাধিকার’ সম্পাদনা দেবব্রত বিশ্বাস, বাংলার মুখ, প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০১২, পৃষ্ঠা ১৭০।

৪। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৮৫৭, সম্পাদনা অক্ষয়কুমার দত্ত, উদ্ধৃত, আশুতোষ ভট্টাচার্য, ‘দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ’, পটভূমি অংশ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা  প্রথম দে’জ সংস্করণ, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১৭।

৫। প্যারীচাঁদ মিত্র, ‘আলালের ঘরের দুলাল’, উদ্ধৃত, ৪এর ন্যায়, পৃষ্ঠা ১৮।

৬। অজিতকুমার ঘোষ, ‘প্রাক্-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা নাটক রচনার ধারা’, নাট্য আকাডেমী পত্রিকা ৬, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি প্রকাশিত, মার্চ ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১০৬।

৭। ভূদেব চৌধুরী, ‘বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা  প্রথম দে’জ সংস্করণ অক্টোবর ১৯৮২, নতুন মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০০০, পৃষ্ঠা ১৯৯।

৮। বিনোদিনী দাসী, ‘আমার কথা ও অন্যান্য রচনা’, সুবর্ণরেখা, প্রথম প্রকাশ ১৩১৯,পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ, ১৩৯৪, পুনর্মুদ্রণ ১৪১৬, পৃষ্ঠা ৮২-৮৩।

৯। দুর্গাশংকর মুখোপাধ্যায়, ‘বাংলা নাট্যমঞ্চের রূপরেখা’, প্রথম খণ্ড (১৭৯৫-১৯২০), মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। প্রথম প্রকাশ বুদ্ধ পূর্ণিমা, ১৩৯৪, পুনর্মুদ্রণ ১৪০১, পৃষ্ঠা ৮৫।

১০। Hemendranath Dasgupta, ‘The Indian Stage’ volume 2 1946. উদ্ধৃত, রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ ও বাংলা নাটকের ১০০ বছর’, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ মে, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ৩১।

১১। ৯ এর মতো, পৃষ্ঠা ৮৬।

১২। ঐ, পৃষ্ঠা ৮৬।

১৩। রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬।

১৪। রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত,পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬।

১৫। শম্ভু মিত্র, ‘বাংলা মঞ্চ ও অভিনয়ের বিবর্তন রেখা’, ‘সন্মার্গ সপর্যা’, এম সি সরকার, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ , মাঘ, ১৩৯৬, চতুর্থ সংস্করণ, বৈশাখ, ১৪২৮, পৃষ্ঠা ১৭১।

১৬। সৌমিত্র বসু, ‘বিশ শতকের বাংলা নাটক : একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৮।

১৭। শম্ভু মিত্র, ‘সন্মার্গ সপর্যা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭১-১৭২।

১৮। বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ভারত ইতিহাসের মাল্যবান অধ্যায়’, ‘বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ’, ‘নাট্যচিন্তা’, রথীন চক্রবর্তী সম্পাদিত, প্রথম প্রকাশ বইমেলা জানুয়ারি ২০০৬।

১৯। অমলেশ ত্রিপাঠী, ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব’, উদ্ধৃত, বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত। ‘বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ’, ‘নাট্যচিন্তা’, রথীন চক্রবর্তী সম্পাদিত, প্রথম প্রকাশ বইমেলা জনুয়ারি ২০০৬। পৃষ্ঠা ১৩।

২০। পবিত্র সরকার, ‘নাট্যমঞ্চ নাট্যরূপ’, ‘বাংলা নাটক : বিশ শতক’, প্রমা প্রকাশনী , কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ কলিকাতা পুস্তক মেলা জানুয়ারি ২০০১। পৃষ্ঠা ১৪।

২১। হেমেন্দ্রকুমার রায়, ‘যাদের দেখেছি — ক্ষীরোদপ্রসাদ’, উদ্ধৃত, চন্দন সেন, ‘দেশপ্রেমের নাটক : ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘বাংলা নাট্যচর্চা ঐতিহ্য উত্তরাধিকার’, সম্পাদনা দেবব্রত বিশ্বাস, ‘বাংলার মুখ’, প্রথম প্রকাশ : মার্চ ২০১২, পৃষ্ঠা ১৭০।

২২। দেবেশ আচার্য, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ইউনাইটেড বুক এজেন্সি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ আগস্ট, ২০০৪, ষষ্ঠ মুদ্রণ আগস্ট, ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪২৭।

২৩। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, ‘পদ্মিনী’, উদ্ধৃত চন্দন সেন, ‘দেশপ্রেমের নাটক : ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭২।

২৪। চন্দন সেন, ‘দেশপ্রেমের নাটক : ক্ষীরোদপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘বাংলা নাট্যচর্চা : ঐতিহ্য উত্তরাধিকার’ সম্পাদনা দেবব্রত বিশ্বাস, বাংলার মুখ, প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০১২, পৃষ্ঠা ১৮২।

২৫। ময়ূরী ঘোষ, ‘বঙ্গভঙ্গে রঙ্গনাট্য’, ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, বার্ষিক নাট্য পত্র ১৪১৭/২০১০, পৃষ্ঠা ১৩৪।

২৬। পবিত্র সরকার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫।

২৭। চন্দন সেন, ‘দেশপ্রেমের নাটক : ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল’ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৭।

২৮। সৌমিত্র বসু, ‘বিশ শতকের বাংলা নাটক : একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯।

২৯। চন্দন সেন, ‘দেশপ্রেমের নাটক : ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৭।

৩০। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘রঙ্গমঞ্চ’, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ তৃতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, চৈত্র ১৩৯৩, পৃষ্ঠা ৬৭৯-৬৮১।

৩১। মন্মথ রায়, ‘অমৃত’, বিনোদন সংখ্যা, ১৩৭৯, নাট্যশোধ সংস্থার সৌজন্যে প্রাপ্ত।

৩২। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, উদ্ধৃত, দীপক চন্দ্র, ‘দুই মেরুর এক আকাশ মন্মথ রায় ও শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত’, ‘বাংলা নাট্যচর্চা ঐতিহ্য উত্তরাধিকার’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২০।

৩৩। শম্ভু মিত্র, ‘বাংলা মঞ্চ অভিনয়ের বিবর্তন রেখা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৯।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান