সাহাবুদ্দিন
এই ভারতের মাটিতেই, বিশেষত বাম-শাসিত রাজ্যগুলির অলিগলিতে একটা সময় প্রায়ই স্লোগান শোনা যেত — “তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম”, কিংবা “চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”। বলা বাহুল্য, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ ধরনের স্লোগান জাতীয়তাবাদীদের চোখে চূড়ান্ত দেশদ্রোহিতা বা জাতীয়তাবাদ-বিরোধিতার শামিল। অথচ মজার ব্যাপার, ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এ দেশের জাতীয় আন্দোলন যে জাতির জনকের ছত্রছায়ায় হয়ে উঠল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, সেই মহাত্মা নিজেই সমর্থন করেছিলেন এ দেশের প্যান-ইসলামিদের পাশ্চাত্য-বিরোধী খিলাফতি স্লোগান — “তুরস্কের খলিফা আমাদের খলিফা”।
আবার দেশপ্রেম তথা জাতীয়তাবাদের জীবন্ত বিগ্রহ সুভাষ চন্দ্র আজাদ হিন্দ বাহিনী তথা কোটি কোটি সাধারণ ভারতীয়র চোখে নেতাজি হয়ে ওঠার আগে চিনের চেয়ারম্যানকে নিজেদের চেয়ারম্যান বলতে অভ্যস্ত মানুষগুলোর চোখের কাঁটা ফ্যাসিস্ট ইতালি আর নাৎসি জার্মানির দোসর জাপানের সমর্থন নিতে দ্বিধা করেননি। আরও আশ্চর্যের, যে ঋষিপ্রবর কবি বিশ শতকের ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্র (nation-state)-এর উদ্ভবের মধ্যে দেখতে পান উগ্র জাতীয়তাবাদের দাঁত-নখ, তিনিই আবার হিটলার-মুসোলিনি-তোজোর অক্ষে আশ্রিত সুভাষ চন্দ্রকে “তাসের দেশ” উৎসর্গ করে লেখেন “স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার জন্য পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ”।
প্রতিটি বিষয়ের প্রেক্ষিত ও দ্যোতনা অবশ্যই আলাদা, কিন্তু এইসব ঐতিহাসিক প্যারাডক্স থেকে একটা কথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, জাতীয়তাবাদ বিষয়টি আদৌ কোনও সহজ সরল একমাত্রিক বিষয় নয়, বরং বেশ গোলমেলে। আর তার সঙ্গে যদি মিশে যায় ইসলামের মতো একটা ব্যাপ্ত ও স্পর্শকাতর বিষয় তাহলে তো কথাই নেই। তাই জাতীয়তাবাদ নিয়ে অসংখ্য চিন্তক যতই গবেষণা-ঋদ্ধ তত্ত্ব দিন না কেন, তথ্য বলছে জাতীয়তাবাদের কোনও প্রথাসিদ্ধ প্যারামিটার হয় না। তাই জাতীয়তাবাদের আগে সংকীর্ণ, উগ্র, বিকৃত, প্রকৃত ইত্যাদি যে বিশেষণই ব্যবহার করা হোক না কেন, বিশ্বৈকতাবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক দ্বান্দ্বিকতার না কি পরিপূরকতার — এই চিরায়ত প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ ও একরৈখিক নয়। তাই চিরায়ত তাত্ত্বিকতার বাইরে সরাসরি ইতিহাস থেকে তুলে আনা জটপাকানো অসংখ্য স্ব-বিরোধের বেশকিছু হাতে-গরম নমুনা চলে এল আলোচনার শুরুতেই, এবং সেইসঙ্গে বলে রাখা ভালো সমগ্র আলোচনা জুড়েই এমন আরও অনেক দৃষ্টান্ত অনিবার্যভাবেই আসবে, এবং কিছু কিছু প্রসঙ্গ আলোচনার স্বার্থে একাধিকবার আসবে। আশা করি সুধী পাঠক তাকে পুনরাবৃত্তি দোষ হিসেবে দেখবেন না।
আসলে জাতীয়তাবাদ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে যেমন একাডেমিক পরিসরে তাত্ত্বিকতার শেষ নেই, তেমনি তত্ত্বের পরিসর ছাপিয়ে এমন অনেক ঐতিহাসিক তথ্য আছে যা সামনে আনে আশ্চর্য সব প্যারাডক্স। আর তখন তত্ত্ব, তথ্য, আর সত্য যেন তালগোল পাকিয়ে আমদের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী চেতনার উঠোনকে ঢেকে দেয় বিভ্রান্তি আর বিবদমানতার ঘন কুয়াশায়। সত্যি বলতে কী, সেই কুয়াশা-ঢাকা পৃথিবীটা আরও ছোট হতে হতে যতই আমাদের হাতের মুঠোর গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে উঠুক না কেন, তত্ত্বকে পেরিয়ে তথ্য যে সত্যকে সামনে আনে তা বিশ্বভ্রাতৃত্ব তথা বিশ্বৈকতাবাদ তো দূরের কথা, অনেক সময় তা যথার্থ হিতকর জাতীয়তাবাদও নয়। তাই এ আলোচনায় প্রয়োজন মতো তত্ত্বকে ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা থাকলেও, সত্যের খাতিরে অপরিহার্যভাবে মাঝে মাঝেই সামনে আনতে হয়েছে বেশকিছু অপ্রিয় তথ্য, যা পাঠক নিরপেক্ষ ও বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণে বিচার করবেন বলেই বিশ্বাস। আর বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু যুক্ত রয়েছে ইসলামের মতো একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এই নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ভীষণভাবেই কাম্য।
এক
ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেক স্বপ্ন, অনেক আত্মত্যাগ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তৎকালীন অখণ্ড ভারতের মাটিতে তথাকথিত প্যান-ইসলামিজম (যা পৃথিবীর সব মুসলমানকে অভিন্ন ‘উম্মাহ’ হিসেবে এক ছাতার তলায় আনতে চায়)-এর গর্ভ থেকে যখন বেরিয়ে এল খিলাফত আন্দোলন কিংবা তারও আগে মুসলিম লিগ (অনেকের মতে, জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই বেড়ে ওঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ), তখন এক দেশের মধেই হিন্দু ও মুসলমান নামক দুই পৃথক জাতিসত্তার ধারণাকে বৈধতা দিতে এগিয়ে এল দুই সম্প্রদায়েরই একটা রক্ষণশীল অংশ। তখন ধর্ম ও কৃষ্টি-কেন্দ্রিক উগ্র জাতীয়তাবাদকে সঙ্গে নিয়ে দেশভাগ ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। আর যে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্যান-ইসলামিজমের উত্থান, সেই ঔপনিবেশিক শক্তিই শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতীয়তাবাদকেই বেড়ে ওঠার রসদ জোগাল। আবার ইতিহাসের অত্যাশ্চর্য প্যারাডক্স, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর ভর করে ভারত ভেঙে দু-টুকরো হওয়ার দু-দশক যেতে না যেতেই প্রমাণিত হল তথাকথিত প্যান-ইসলামিজম আসলে কাঁঠালের আমসত্ত্ব। কারণ প্যান-ইসলামের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করে পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নিল তৎকালীন গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (যদিও তার বর্তমান সত্তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দানা বাঁধছে, যা ভিন্ন আলোচনার পরিসর দাবি করে)।
আবার গত শতাব্দীর এই উপমহাদেশীয় প্রেক্ষিত ও ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত থেকে সহস্র যোজন দূরে নীল নদের দেশে, যেখানে ফাতেমীয় খলিফাতন্ত্রের হাত ধরে (অষ্টম শতকের শেষেই) পৌঁছে গিয়েছিল ইসলাম, সেই মিশরের মরু-মৃত্তিকা কাঁপিয়ে মাত্র কয়েক বছর আগে (২০১২) মুহম্মদ মোরসির নেতৃত্বে যখন নতুন করে শোনা গেল তথাকথিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের ডাক, তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই (২০১৩) তাঁর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে পৌঁছাবে, এবং লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষই (এক বছর আগে যারা তাঁরই সপক্ষে রাস্তায় নেমেছিল) প্রমাণ করে দেবে তথাকথিত মুসলিম ব্রাদারহুড আসলে অন্তঃসারশূন্য সোনার পাথরবাটি? কিংবা খোদ মক্কা-মদিনার দেশ সৌদি আরবের হাতে এ শতাব্দীতেও যখন নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণ যায় লক্ষ লক্ষ ইয়েমেনি নাগরিকের, কিংবা স্ব-দেশ সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে আস্তিত্ত্বিক স্বদেশের খোঁজে যখন ভূমধ্যসাগরের তটভূমিতে পড়ে থাকে অপাপবিদ্ধ সিরিয়ান শিশু, তখন কোথায় থাকে ইসলামিক ব্রাদারহুডের গালভরা তত্ত্ব? তাহলে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক ব্রাদারহুড, প্যান-ইসলামিজম, ইসলামি রাষ্ট্র-তত্ত্ব — এ সব কি নেহাত কথার কথা? তত্ত্ব, আর তথ্যের ভিড়ে সত্য তাহলে কী?
বলা বাহুল্য, তত্ত্ব আর তথ্যের ভিড়ে উবে যাওয়া সত্যের খোঁজ করার সৎপ্রয়াস থেকেই এ আলোচনা। আর সত্যের খোঁজে সৎ থাকার দায় কোনও বর্ধিত দায় নয়, তা মৌলিক দায়। এই মৌলিক দায় থেকেই আলোচনার শুরুতেই আমাদের বুঝে নিতে হবে হজরত মহম্মদ (সঃ) ইসলামে কোনও বিভাজন অনুমোদন করেননি, কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর আশঙ্কা ছিলই। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। আজ বিশ্বজুড়ে যতই ইসলামি ভ্রাতৃত্বের তত্ত্বকথা শোনানো হোক, যতই সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে অভিন্ন উম্মাহ হিসেবে সংগঠিত করে তথাকথিত প্যান-ইসলামিজমের ছত্রছায়ায় মুসলিম রাষ্ট্র তথা নব্য-খিলাফতের খোয়াব দেখা হোক, নানান তথ্য যে সত্যকে সামনে আনছে তা হল, মুসলিম ব্রাদারহুডের নামে যা বলা হচ্ছে তা আসলে ফাঁকা আওয়াজ। আজকের বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে অসংখ্য দল, উপদলে বিভাজিত মহম্মদ (সঃ)-পরবর্তী ইসলামের পঙ্কিল পথ, যা মহম্মদীয় তথা কোরানীয় ইসলাম আদৌ অনুমোদন করে না।
দুই
আলোচনার সুবিধার্থে আমরা প্রথমেই ইসলামকে দু’ভাগে ভাগ করে নেব— ১) মহম্মদীয় বা কোরানীয় ইসলাম বা প্রকৃত ইসলাম এবং ২) মহম্মদ-পরবর্তী বিভাজিত ইসলাম। বলা বাহুল্য, মহম্মদীয় ইসলাম হল সেই ইসলাম যা কোরানীয় নির্দেশকে শিরোধার্য করে। মহম্মদ(সঃ)-এর দেহান্তরের প্রায় এক শতাব্দী পর সংকলিত অসংখ্য হাদিস (যার উপর ভিত্তি করে নানা দেশে শরিয়তি আইন, এবং ইসলামের অসংখ্য দল-উপদল ও মতভেদ, এমনকি ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত)-কে এই ইসলাম আবশ্য-পালনীয় মনে করে না। সেইসব হাদিসকেই (সহি হাদিস) এই ইসলাম মান্যতা দেয় যেগুলি কোরানের আয়াত (নিদর্শন)-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, মহম্মদ(সঃ)-এর দেহান্তরের প্রায় একশো বছর পর দামেস্কে (অধুনা দামাস্কাস)-এর উমাইয়া খলিফাদের তত্ত্বাবধানে অর্থাৎ শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় শাসকের সুবিধা মতো শুরু হয় এই হাদিস সংকলনের প্রক্রিয়া। পরবর্তীতে একই পথে হাঁটেন বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফারাও। নানান ইসলামি তাত্ত্বিকদের দিয়ে খলিফাদের হাতে নির্মিত হাদিস বা সুন্নাহ-র মান্যতা থেকে তৈরি হল সুন্নি সম্প্রদায়, যা পরবর্তীতে সুন্নাহ বা হাদিস সংকলকদের নামানুসারে বিভাজিত হয়ে গেল আরও বিভিন্ন মজহব বা ভাগ-উপভাগে। যেমন, আবু হানিফার নামানুসারে হানাফি, আব্দুল মালিকের নামানুসারে মালিকি, শাফেয়ির নামানুসারে শাফায়ি এবং ইবনে হাম্বলের নামানুসারে হাম্বলি মজহব। অথচ আশ্চর্য, মহম্মদ(সঃ)-এর জীবদ্দশায় তো বটেই, তাঁর দেহান্তরের বহু বছর পরেও এসব তথাকথিত মজহবের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। এমনকি, শিয়া (যার অর্থ ‘দল’)-শব্দেরও কোনও জায়গা ইসলামে ছিল না। হজরত আলি(রাঃ)-র অনুগামীদেরকে প্রথম বলা শুরু হল ‘শিয়া-এ আলি’ বা ‘আলির দল’। শিয়াদের মধ্যে সুন্নাহ বা হাদিস সংকলনের রীতি সুন্নিদের মতো ব্যাপক হারে না থাকলেও তাদের মধ্যেও পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে অসংখ্য দল-উপদল। যেমন — জায়েদিয়া, ইসনা আশারিয়া, ইসমায়ইলি, উসুলি, আকবারি ইত্যাদি। এমনকি, আলির দলে যারা ছিল তাদেরও একাংশ বিরোধী শত্রুপক্ষের প্রতি (সিফিনের যুদ্ধে) নরম মনোভাব দেখালে ক্ষুব্ধ হয়ে সরে আসেন, যাদেরকে বলা হল চরমপন্থী খারেজী গোষ্ঠী।
শিয়ারা নিজেদেরকে মহম্মদ (সঃ)-এর কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-র স্বামী হজরত আলি (রাঃ)-কে মহম্মদ (সঃ)-এর বৈধ উত্তরাধিকারী এবং ইমাম হিসেবে মান্যতা দেন। কিন্তু সুন্নিরা বংশগত উত্তরাধিকারের বাইরে বেরিয়ে নির্বাচিত খলিফাকে মান্যতা দেন। এর বাইরে অবশ্য রয়েছেন নরমপন্থী কিছু মুরজিয়া মুসলমান যারা ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব থেকে দূরে ইসলামের আধ্যাত্মদর্শন নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন, যাঁদের নির্বিবাদী মরমি পরম্পরার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ সুফি সম্প্রদায়। সবশেষে বলব যুক্তিবাদী, অনুসন্ধিৎসু, মুক্তমনা মুতাজিলাদের কথা, যাঁরা কোরান-নির্দেশিত জ্ঞান তথা বৌদ্ধিক চর্চাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। এই মুতাজিলাদেরকেই অবিশ্বাসী, অমুসলমান বলে দেগে দিয়ে এল মরমি অন্তর্জ্যোতিবাদ, যা তর্কের চেয়ে বিশ্বাস ও ভক্তিকে গুরুত্ব দিল, এবং সেই সঙ্গে শরিয়তকেও সঙ্গে নিল। মুতাজিলাদের বিপ্রতীপের এই তরঙ্গ বেশি করে অনুভূত হল মূলত দ্বাদশ শতকে প্রখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ (একদা মুতাজিলাপন্থী) ইমাম গাজ্জালি (মৃত্যু ১১১১ খ্রীঃ)-র প্রভাবে। মজার কথা, উপরোক্ত প্রত্যেক গোষ্ঠীই নিজেদেরকে মহম্মদ (সঃ)-এর প্রকৃত উম্মত বা অনুসারী তথা যথার্থ মুসলমান বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে রাজিউদ্দিন আকিল তাঁর অসামান্য গবেষণা-গ্রন্থ “In the Name of Allah”-তে লিখছেন :
“The contestations for power led to schisms, often violent, and there emerged the legitimist Shias, extremist Khwarajis, quietist Murjias, rationalist Mutajilas and the sharia-minded literalist Sunnis— all of whom claimed to be the most righteious Muslims, the most truthful members of the community of Prophet Mohammad, proverbially divided into as many as seventy-two sects (as reportedly prophesied by the Prophet himself)…The matrix of difference between these frqas was political to start with, but later took the form of rigid doctrinal positions and sectarianism.”[১]
প্রশ্ন উঠতেই পারে, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনায় এসব প্রসঙ্গ তোলা কেন? এতকিছু বলার উদ্দেশ্য হল, মহম্মদীয় ইসলাম আর মহম্মদ (সঃ)-পরবর্তী বিভাজিত ইসলাম কতটা আলাদা সেটা বুঝে নেওয়া, যা ছাড়া এ আলোচনার গভীরে প্রবেশ সম্ভব নয়। আসল কথা হল, সমস্ত মজহবই নিজেদেরকে প্রকৃত মহম্মদীয় ইসলাম বলে দাবি করে, আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করার এই রীতির জন্যই অভিন্ন ইসলামি ভ্রাতৃত্ব আজ নেহাতই তত্ত্ব। নিখিল ইসলামি জাতীয়তাবাদ বা প্যান-ইসলামিজম সারা বিশ্বজুড়ে মাঝে মাঝেই মাথা তুললেও তা তত্ত্বের ফানুস ছাড়া আর কিছু হয়ে ওঠেনি।
অবশ্য, তা হওয়ার কথাও নয়। কারণ, ইসলামি ভ্রাতৃত্ব আর তথাকথিত প্যান-ইসলামিজম এক জিনিস নয়। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব (যা সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও তার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী)-এর কথা কোরানে বলা হলেও তথাকথিত প্যান-ইসলামিজম নামক যে তত্ত্বের কথা মাঝে মাঝেই শোনানো হয়, তা আসলে হাল আমলের তৈরি করা তত্ত্ব। এবং এর জন্ম মূলত পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ। এই তত্ত্ব আসলে এক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বস্তাপচা গল্প, যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা নানান ভাষা, কৃষ্টি ও আঞ্চলিক প্রথাকে অ-ইসলামীয় বলে উপেক্ষা করে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একমাত্রিকতায় বেঁধে রাখতে চায়।
মহম্মদ (সঃ) সৃষ্টির বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করেননি, যদিও তিনি বিভাজনের পঙ্কিলতাকে সর্বতোভাবে বর্জন করেছেন। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য বৈচিত্র্যকে স্রষ্টার বিচিত্রমুখী প্রকাশের নিদর্শন রূপে মহম্মদীয় ইসলাম মান্যতা দেয়। আর সেই বৈচিত্র্যের বৈভবের মধ্যেই সংহতির সুর হিসেবে বাজে প্রকৃত ইসলামি ভ্রাতৃত্ব। বলা বাহুল্য, পবিত্র কোরানে এ কথার সমর্থনে অসংখ্য আয়াত (নিদর্শন) রয়েছে। মানুষের বিচিত্র চেহারা, গায়ের রং, খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া-জলবায়ুর সঙ্গে মানানসই শালীন পোশাকরীতি — এসবকে অস্বীকারের মূঢ়তা তথাকথিত প্যান- ইসলামিজমের উদ্গাতাদের, ইসলামের নয়। কোরানের ৩০ নং সুরা (সুরা রূম)-র ২২ নং আয়াতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে :
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতা। নিঃসন্দেহে এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।”[২]
শুধু মানুষের মধ্যেই নয়, জীব জগতের সার্বিক বৈচিত্র্য নিয়েও রয়েছে চিন্তাশীল জ্ঞানীগুণীদের জন্য নিদর্শন। ৩৫ নম্বর সুরা(সুরা ফাতির)-র ২৭-২৮ নং আয়াতে বলা হচ্ছে :
“তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। অতঃপর তার সাহায্যে আমরা বিভিন্ন বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করেছি। আর পর্বতেও রয়েছে সাদা, লাল এবং বিভিন্ন বর্ণের টুকরো। এবং গাঢ় কালো বর্ণেরও। এমনিভাবে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, জীব-জন্তু ও চতুষ্পদ পশুও আছে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল।”[৩]
প্রশ্ন হল, বৈচিত্র্যকে মান্যতা দিতে জ্ঞানীগুণীদের জন্য এমন অসংখ্য নিদর্শন কোরানে আছে জেনেও যাঁরা বাংলা ভাষা ও কৃষ্টির মর্যাদাকে শিকেয় তুলে উর্দুকে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্যান-ইসলামিজমের ধ্বজা উড়িয়ে পাকিস্তানে একমাত্রিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল, তারা কি মহম্মদীয় ইসলামের অনুসারী? কিংবা আফগানিস্তানের যুগান্তলালিত কাবুলি কৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যারা দক্ষিণ আফগানিস্তানের পাস্তুন এলাকা থেকে উঠে আসা তালিবানি ফতোয়ার একমাত্রিকতায় সমগ্র আফগান জনগোষ্ঠীকে ঢেকে দিতে চায়, আর তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই চালায় নৃশংস নির্যাতন, তারা কতটা কোরান-অনুসারী মুসলমান? আর যদি তাদের পথই ইসলামের পথ হবে, তাহলে পার্শ্ববর্তী শিয়া-অধ্যুষিত ইরানে ঢোকার তাদের হিম্মত নেই কেন?
অবশ্য প্রশ্নটা হিম্মতের নয়। প্রশ্নটা বিভিন্ন মজহবের ঘোষিত এজেন্ডার, যা পরস্পর-বিরোধীই শুধু নয়, রীতিমতো অ-ইসলামীয়। কোরান-নির্দেশিত বৈচিত্র্যের সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতা থেকে আলোকবর্ষ দূরে এই বিকৃত মজহবি এজেন্ডা থেকেই জন্ম এ শতাব্দীর তথাকথিত ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর নানান শাখার, যার সঙ্গে মহম্মদীয় ইসলামের কোনও যোগ নেই। নিজেদের সুবিধা মতো শরিয়তের ব্যাখ্যা ও তার বলপূর্বক আরোপ তথা কায়েমি স্বার্থই সেখানে শেষ কথা। আর সেজন্যই আইসিস ও তালিবানের সম্পর্ক যেমন সাপে-নেউলে, তেমনি বোকোহারাম, হিজবুল মুজাহিদিন, লস্কর-ই তৈবা, জৈশ-ই মহম্মদ ইত্যাদি জঙ্গি গোষ্ঠীও ইসলামকে শিখণ্ডী করে যে যার তালে চলে। তবে একটা জায়গায় তাদের তাল কাটে না, বরং সেখানে তাদের সবার মধ্যে ভীষণ মিল। আর সেটা হল নিরীহ মানুষ খতম করে দায় শিকারের কাপুরুষোচিত বাহাদুরি।
অথচ পবিত্র কোরানের ৫ নং সুরা (সুরা মায়েদা)-র ৩২ নং আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা :
“…যে ব্যক্তি কোনও মানুষ হত্যার প্রতিশোধ ছাড়া কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগ ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল, আবার কেউ যদি কারোর জীবন রক্ষা করে সে যেন সব মানুষেরই জীবন রক্ষা করল। আমাদের বার্তাবাহক তো তাদের নিকট স্পষ্ট নির্দেশ নিয়ে এসেছে। তা সত্বেও তাদের অনেকেই পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করে চলেছে।”[৪]
বলা বাহুল্য, এখানে বার্তাবাহক বলতে পয়গম্বর মহম্মদ (সঃ), আর জগৎজুড়ে সীমালঙ্ঘন চলছে তাঁর তরফে নিয়ে আসা স্পষ্ট নির্দেশ সত্বেও। আশ্চর্যের এটাই যে যারা সীমালঙ্ঘন করছে তারাও নিজেদের মহম্মদ (সঃ)-এর উম্মত বা অনুসারী হিসেবে দাবি করছে। শুধু তাই নয়, তারা তাদের বিকৃত পথে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনার প্যান ইসলামীয় তত্ত্ব নিয়ে শুনিয়ে যাচ্ছে অভিন্ন উম্মাহ বা মুসলিম ব্রাদারহুডের ফাঁকা আওয়াজ।
তিন
তাই একবার ফিরে যাওয়া যাক প্যান-ইসলামিজমের একমাত্রিকতার গোড়ার কথায়। আগেই বলেছি প্যান ইসলামিজম মূলত পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ একটি ভাবাদর্শ, যা সমগ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীকে অভিন্ন সত্তা (উম্মাহ) হিসেবে নিয়ে বিশ্বব্যাপী খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। অর্থাৎ এর সঙ্গে কোরানীয় আদর্শের যত না যোগ তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ রাজনীতির। আর সে রাজনীতির উত্থান তুরস্কের উসমানিয়া (অটোমান) এবং ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনাপর্বে, যখন পশ্চিমের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিশ্বব্যাপী মাথা তুলছে।নামিক কামাল (১৮৪০-৮৮), মুহম্মদ আব্দুহ (১৮৪৯-১৯০৫), জালালউদ্দিন আফাগানি ( ১৮৩৯-৯৭), সইদ রশিদ (১৮৬৫-৩৫)-এর মতো ইসলামি চিন্তাবিদেরা ইসলামের শরিয়ত-আশ্রিত যাপনের সঙ্গে বিশ শতকীয় রাজনৈতিক সমীকরণের মিশেলে নতুন করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বললেন। প্যান-ইসলামিজম ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন মতো কিছু শরিয়তি অনুশাসনকে যেমন ছেঁটে ফেলতেও রাজি, তেমনি আবার পশ্চিমি সেকিউলারিজম তথা কৃষ্টি থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যও বজায় রাখতে চায়।আর এখানেই ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্যান- ইসলামিজমের সূক্ষ্ম তফাত। সূক্ষ্ম এই কারণেই বলছি যে উভয় মতাদর্শই সাবেকি শরিয়তি ফতোয়া ও মজহব-ভিত্তিক অনুশাসন থেকে অনেকটাই সরে এসে প্রগতিশীলতার কথা বললেও প্যান-ইসলামিজম পুরোনো খিলাফতি শাসন-ব্যবস্থার গৌরবকে সামনে আনতে চায় এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইসলামের অভ্যুদয়ের যুগে যে অঞ্চল তার অধীনে আসে তাদেরকে তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্রের অংশ মনে করে (যা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদের মাথা ব্যথা নেই)।
এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে সিপাহি বিদ্রোহের পর উদ্ভূত ব্রিটিশ-বিরোধী মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্যান-ইসলামিজমের অনুসারীরা সমালোচনা করলেন। কারণ, তাঁদের চোখে ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই মুসলমানদের বেঁধে রাখতে চায়। আবুল আলা মাউদুদির মতো প্রথম সারির প্যান-ইসলামিস্টরা আবার ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের অতিমাত্রায় পাশ্চাত্য -ঘেঁষা হিসেবে চিহ্নিত করলেন। অথচ উভয় মতবাদের অনুসারীরাই পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে যুঝতে গিয়ে প্রকারান্তরে পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের উগ্রতাকে গ্রহণ করলেন। কী অত্যাশ্চর্য সব প্যারাডক্স!
ভারতে এই উগ্রতা এমন স্তরে পোঁছোল যে মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা পরিষ্কার বলেই দিলেন যে হিন্দুদের থেকে সবক্ষেত্রেই মুসলমানরা একটা পৃথক জাতিসত্তার দ্যোতনা বহন করে। নিজেদেরকে হিন্দুদের প্রতিস্পর্ধী শক্তিরূপে তুলে ধরতে প্রয়োজনে ব্রিটিশের সাহায্যও তাঁরা নিলেন। এতে অবশ্য খুশিই হলেন ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, কারণ একই পথের পথিক তাঁরাও, এবং তাঁদেরই কথা প্রকারান্তরে মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা বলে দিলেন। মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হল ব্রিটিশ-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, যে ক্ষতি আজও পূরণ হয়নি। স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও তাঁর অনুসারীদের মুসলিম জাতীয়তাবাদ একদিকে, অন্যদিকে রাজনারায়ণ বসু, সাভারকর, মদনমোহন মালব্য প্রমুখের হিন্দু জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক সংঘাত ও সেই আবহে সুযোগ বুঝে ঘোলাজলে মাছ ধরার ব্রিটিশ চাতুর্য ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যে ক্ষতি করল তার ঘা তো শুকোয়ইনি, উলটে নব্য-হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের স্লোগানে সে আজ রীতিমতো বিপন্ন। ভারতীয় সভ্যতার বহুত্ববাদী আত্মপরিচিতি তথা বৈচিত্র্যের বৈভবকে অস্বীকার করে আজ নতুন উদ্যমে একমাত্রিক ভারত তৈরির জোগাড়পাতি চলছে। এ যেন প্যান- ইসলামিজমের বিপ্রতীপে প্যান-হিন্দুত্বের নবতর আস্ফালন, যা পৃথিবীর সব হিন্দুকে একসূত্রে বাঁধতে চায়। হিন্দু-অধ্যুষিত প্রতিবেশী নেপাল ও ভুটানকে দিতে চায় বিশেষ প্রতিবশীর মর্যাদা। এ যেন পাকিস্তান তথা মুসলমান ভারতের পাশে হিন্দু পাকিস্তান তৈরির হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রয়াস। আর এ ক্ষেত্রে যে কথা না বললেই নয় তা হল, এই তথাকথিত হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ উভয়েই আসলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে দূরে বুর্জোয়া-পোষিত অভিজাত নাগরিক ধারণা। আর এই বুর্জোয়া-ঘেঁষা সাযুজ্যের কারণেই পাকিস্তান জিন্নাহর প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ ভাষণ সত্বেও (যা তিনি সদ্যোজাত পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দিয়েছিলেন) মুসলিম জাতীয়তাবাদকে সঙ্গে নিয়ে প্যান-ইসলামিজমের বিশ্বজনীন ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়ল। গত শতাব্দীর আশির দশকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের দক্ষিণমুখী বাঁক সম্পূর্ণ হল। পাকিস্তান একটা জাতীয়তাবাদী মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র থেকে ক্রমেই হয়ে পড়ল তথাকথিত ‘উম্মাহ’-দের অবাধ সঞ্চরণক্ষেত্র। তথাকথিত ‘উম্মাহ’ বলছি এই কারণেই যে, মহম্মদীয় ইসলাম যে আদর্শ ‘উম্মাহ’-র কথা বলে তার সঙ্গে এদের ভাবাদর্শ ও যাপনের কোনও সম্পর্ক নেই। এরা মূলত আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগের ফসল, যাকে সোভিয়েতের পতন পর্যন্ত রসদ জুগিয়েছে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও সৌদি আরবের অনুপন্থী তেলসমৃদ্ধ আরব দুনিয়া (ইরান ছাড়া)।
সবচেয়ে আশ্চর্যের প্যারাডক্স এই তথাকথিত ‘উম্মাহ’-দেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল যে সৌদি আরব তা নবরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল পশ্চিমি শক্তি (ব্রিটেন)-র সাহায্য ও সমর্থনে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে চেয়ে। সৌদি আরবের নবরূপে আত্মপ্রকাশ সৌদ পরিবারের বড়ো কর্তা ইবন সৌদ (অষ্টম শতকের ইসলামি পণ্ডিত আব্দুল আল-ওয়াহাবের অনুগামী)-এর হাত ধরে। সৌদ রাজতন্ত্রের ধাঁচে আরব ভূখণ্ড সঙ্গে নিল অষ্টম শতকের রক্ষণশীল ইমাম (ধর্মগুরু) ইবন হাম্বলের শরিয়তি ব্যাখ্যা আর চতুর্দশ শতকের ধর্মতাত্ত্বিক তেম্মিয়ার মতবাদকে।
এই সময়েই পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে ইসলামিজম সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ইসলামি পণ্ডিতদের দেখানো পথে ডালপালা ছড়াল। মিশরের হাসান আল-বান্না বা সায়িদ কুতব দক্ষিণ এশিয়ায় আবুল আলা-মাউদুদি আধুনিক রাজনীতির পরিভাষায় ইসলামি পুঁথিকে সামনে আনলেন, এবং বললেন সমাজের ইসলামিকরণ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি (প্রয়োজনে জেহাদের মাধ্যমে) রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কথা। সায়িদ কুতুব সরাসরি বলে দিলেন যে বিশ শতকের মুসলমানরা রয়েছে প্রাক্-মহম্মদীয় ‘জাহিলিয়া’ বা অন্ধকারাচ্ছন্ন দশায়। আর এর মূলে রয়েছে পশ্চিমি বস্তুবাদ ও কৃষ্টির প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং মার্কসবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ। অথচ মহম্মদ(সঃ)-এর মদিনা সনদ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার মহত্তম নিদর্শন (যার কথা পরে বিস্তারিত বলেছি)। যাই হোক, নিজেদের সুবিধামতো আত্মস্বার্থ-বিরোধী বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে শরিয়তকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূল করে নিয়ে ইসলামিজম একটা নতুন পরিভাষা তথা তত্ত্ব হিসেবে মাথা তুলল বিশ শতকের শুরুতে। প্রখ্যাত গবেষক অলিভার রয় সর্বপ্রথম ইসলামিজমকে একটা পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করলেন। তাঁর তত্ত্বের নির্যাস নিয়ে ইতিহাসের প্রখ্যাত গবেষক রাজিউদ্দিন আকিল “In the Name of Allah” গ্রন্থে লিখছেন :
“… ‘Islamism’ is a brand of modern political Islamic fundamentalism that claims to recreate a true Islamic society not simply by imposing the shariat, but by establishing first an Islamic state through political action. Islamists see Islam not as a mere religion, but as a political ideology, which should be integrated into all aspects of society (politics, law, economy, social justice, foreign policy, etc). To Islamists, an Islamic State should unite the umma, or the community of Islam as much as possible, without being restricted to a specific nation within a geographical boundary.”[৫]
শুনতে যতই ইউটোপিয়ান মনে হোক, এটাই এ যুগের ইসলামিজমের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যপূরণে ইসলামিস্টরা বিশ্বজুড়ে তৈরি করছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক, যেখানে বহুজাতিক সংস্থার ধাঁচে নিয়োগ করা হচ্ছে নানান দেশের অসংখ্য যুবককে, যারা আন্তর্জাতিক ভাষা, সফটওয়্যার তৈরি ও ওয়েবসাইট ব্যবহার থেকে শুরু করে নানান প্রযুক্তিগত বিষয়ে পারদর্শী। এইসব যুবকেরা নিজেদেরকে বিশেষ কোনও দেশের নাগরিক বলে ভাবে না। আর যে সব ওয়েবসাইট তারা ব্যবহার করে সেগুলি মূলত বিভিন্ন মৌলবাদীদের মর্জি মতো চালনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে “In the Name of Allah” গ্রন্থে রাজিউদ্দিন আকিল লিখছেন :
“Many of these websites are maintained by fundamentalist Islamic groups and individuals presenting their version of the faith, countering those uploaded by the ‘enemies’ of Islam, particularly in the Christian West.”[৬]
অর্থাৎ পশ্চিমি বিশ্বকে প্রতিপক্ষ তথা শত্রু ভাবার একটা রক্ষণশীল ধারা ইসলামিস্টদের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে, এবং এমন ভাবনার পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক কারণ তথা বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পাখির চোখ। আর তার জন্য সে অসংখ্য অনৈতিক ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের নজির রেখেছে, যা বৃহত্তর আলোচনার পরিসর দাবি করে। তবু সংক্ষেপে যেটুকু উল্লেখ করতেই হবে তা হল, ১) সৌদি আরবকে হাতে রেখে তুর্কি খিলাফতের উচ্ছেদ ও আরব-তুর্কি-ইরানি বৈরিতায় ইন্ধন, ২) আরবদের ঐক্যে সুকৌশলে ফাটল ধরিয়ে তাদের মধ্যে কুড়িটিরও বেশি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম, ৩) ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অথচ প্যালেস্টাইনের হামাসকে অস্বীকৃতি। পশ্চিমি আগ্রাসী শক্তির এই কায়েমি রাজনীতি আহত করেছে নিখিল মুসলিম মনস্তত্ত্বকে। স্বভাবতই তথাকথিত ইসলামিস্ট এবং জেহাদি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি খ্রিস্টান-অধ্যুষিত পশ্চিমি দুনিয়াকে জাতশত্রু ভাবে। তারা ইতিমধ্যেই তাদের শত্রু শিবিররের তিনটি ক্যাটেগরি বানিয়ে ফেলেছে: এক) সাদা চামড়ার পশ্চিমি অমুসলিম, দুই) পশ্চিমি বিশ্বের সঙ্গে হাত মেলানো এবং পশ্চিমি কৃষ্টিকে গ্রহণ করার ‘অপরাধে’ অভিযুক্ত উদারপন্থী মুসলিম। আর বিশ্বের বেশ কিছু দেশকে বেছে নিয়ে তাদেরকে টার্গেট করতে তাদেরকে ভাগ করে নিয়েছে তিনটি ভাগে : ১) ওয়েস্টার্ন বা পশ্চিমি শক্তি (আমেরিকা সহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন); ২) প্রো-ওয়েস্টার্ন পশ্চিমি শক্তির তাঁবেদার মধ্যপ্রাচ্য (জর্ডন, মিশর, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইউএই, বাহরিন, ওমান, পাকিস্তান); ৩) অমুসলিম দেশ ইজরায়েল (কারণ, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন বৈরিতা), সার্বিয়া (কারণ বসনিয়ার হত্যাকাণ্ড), রাশিয়া (কারণ, চেচেন-রাইয়ান দ্বন্দ্ব), ভারত (কারণ, কাশ্মীর সমস্যা) এবং সাম্প্রতিক সংযোজন চিন (কারণ, শিনজিয়াং তথা উইঘুর সমস্যা)। ইসলামিজম এবং নব্য-মৌলবাদ মুসলিম জনমানসে এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত তৈরি করেছে যে তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসের বিপ্রতীপে পশ্চিমের রাষ্ট্রীয় ‘শ্বেত সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে কাউন্টার ডিকশন চালু হয়ে গেছে, যাকে বলা হয় ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ (conspiracy theory)। এই তত্ত্ব এতটাই শক্তিশালী যে সারা পৃথিবীর অসংখ্য মুসলমান বিশ্বাস করেন আইসিস প্রধান আবুবকর আল বাগদাদি জন্মসূত্রে একজন ইহুদি, এবং ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর এজেন্ট, যার আসল নাম এলিয়ট শিমন। তারা আরও বিশ্বাস করে মার্কিন ও ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সিগুলো বিশ্বব্যাপী ইসলামকে কোনঠাসা করতে বাগদাদি তথা আইসিস-এর মাধ্যমে মারণ-সন্ত্রাসের জাল বিস্তারে অর্থ ও সামরিক সাহায্য করে। এই আইসিস তালিবানদের শত্রু মনে করে, কারণ তাঁদের মতে তালিবান আমেরিকার হাতের পুতুল।
এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু যে আহত মনস্তত্ত্ব এমন তত্ত্বের জন্ম দেয় তার অভিঘাত অস্বীকার করবে কে? আহত মনস্তত্ত্ব জন্ম দেয় যে জিঘাংসা, তার অভিঘাত কাগুজে তত্ত্বকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে মর্মান্তিক সত্য। আর সে কারণেই পৃথিবীর তিন সেমিটিক ধর্মীয় সম্প্রদায় (ইহুদী, খ্রিষ্টান ইসলাম)-এর শাস্ত্রীয় উৎস অভিন্ন হলেও (কোরান তথা ইসলামি মত অনুযায়ী) তারা আজ পরস্পরের প্রতি সবচেয়ে বেশি সন্দেহপ্রবণ। সন্দেহ থেকে আসে বিদ্বেষ, যা তীব্রতা পায় যখন তাতে ইন্ধন জোগায় বিকৃত বৌদ্ধিক চর্চা। এক্ষেত্রে সেটাই ঘটল। স্যামুয়েল পিটার হান্টিংটন লিখলেন (মতান্তরে লেখানো হল) “The Clash of Civilizations and the Remarkable world”(1996), যা পশ্চিমি দুনিয়ায় মুসলিম-বিদ্বেষীদের কাছে নব্য-বাইবেল, ক্রুসেডের নতুনতর নিদান। আর এর ঠিক বিপ্রতীপে গর্জে উঠছে পশ্চিমি-বিদ্বেষ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য মানুষ, হাতে নিয়ে অধ্যাপক খালিদি ও ফররুখের গ্রন্থ “আত তারশির ওয়াল ইস্তিমা” (“Missionaries and Imperialism”), যার বিষয়বস্ত আমাদেরকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা পৃথিবীতে খ্রিস্টান মৌলবাদ ও পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুসলমানদেরকে মহম্মদীয় ইসলামের মানবতাবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত করে আরব তথা ইসলামি দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক ও বৌদ্ধিক কাঠামোর ক্রমিক ধ্বংসের মাধ্যমে মুসলমানদের কীভাবে মেরুদণ্ডহীন করার ষড়যন্ত্র করছে, তারই বয়ান হল এই গ্রন্থ। এভাবে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ ও খ্রিস্টান মৌলবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত ইসলামি তত্ত্ব খাড়া করে মানুষকে খ্যাপিয়ে তোলার বৌদ্ধিক বিকৃতি চলছে, যা ইন্ধন জোগাচ্ছে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও মারণ জিঘাংসা। আর এসব প্রত্যক্ষ করে নানা বিদ্বেষী তত্ত্ব, সেইসব তত্ত্বের বিরুদ্ধে আবার তত্ত্ব, আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তথ্য যেন প্রকৃত সত্যের চেহারাকে তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু যতই তালগোল পাকিয়ে যাক, শেষপর্যন্ত তথ্যই তো আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আর সে সত্য অপ্রিয় হলেও সত্য। তাই মুসলিম-অধ্যুষিত বিশ্ব পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ ও খ্রিস্টান মৌলবাদের শিকার হলেও সে কি তার নিজস্ব দায় অস্বীকার করতে পারে? আজ কেন ইসলামি বিশ্ব একা একদিকে, আর অবশিষ্ট বিশ্ব অন্যদিকে? এমনকি, তথাকথিত ইসলামি দেশগুলিও কেন এই তথাকথিত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-কে মান্যতা দিতে এককাট্টা নয়? কেনই বা প্যান-ইসলাম তথা মুসলিম ব্রাদারহুড বিপুল দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে সোনার পাথরবাটি? তথ্য যে সত্যকে সামনে আনছে তা হল, একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-দীর্ণ তথাকথিত ইসলামি জেহাদি জঙ্গিগোষ্ঠীই শুধু নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের আঞ্চলিক কৃষ্টি তথা জাতিসত্তাকে সঙ্গে নিয়ে একটা ভোগোলিক সীমানার মধ্যে তৈরি মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক বিবদমানতা আজ প্রমাণিত। এদিকে চিন উইঘুর মুসলিমদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালালেও পাকিস্তান আর হাল আমলের তালিবানি আফগানিস্তান তার সঙ্গে মিত্রতা রেখে চলে, আর তা দেখে হুঁশিয়ারি দেয় আইসিস। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র সব প্যারাডক্স!
তাই ইসলামিজমের তত্ত্ব (যার সঙ্গে মহম্মদীয় ইসলামি তত্ত্বের কোনও সম্পর্ক নেই) আর ঐতিহাসিক তথ্য যে এক নয় তা বলাই বাহুল্য। আর তথ্য সামনে আনে যে সত্য তা আত্মধ্বংসী, রক্তক্ষয়ী, মর্মান্তিক। এই মর্মান্তিক সত্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় অবশ্যই নিরপেক্ষ আত্মসমালোচনা, যার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাজিউদ্দিন আকিল “In the Name of Allah” গ্রন্থে “Reason and Faith” শিরোনামে লিখছেন—
“…widespread violence within Islamic societies, including cases where America and West are not involved, requires investigation”.[৭]
কারণ তাঁর মতে —
“… blaming ‘Islamic terrorism on America and contemporary global politics is not enough for understanding the complexities of the Muslim situation. What we need to recognize is that there is a long historical struggle within Muslim societies between the moderates/liberals/progressives and Islamist hardliners over the form of Islam that must prevail and how it can be implemented”.[৮]
শুধু তাই নয়, কায়েমি স্বার্থে কোনও কোনও মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্রের আধিপত্যকে ভেঙে দিতেও দ্বিধা করে না। যেমন সৌদি আরব পশ্চিমি শক্তির সমর্থনে বিশ শতকের শেষের দিকে কুয়েতের তৈলখনিকে কেন্দ্র করে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আবার পাকিস্তানে সে স্বঘোষিত তথাকথিত ‘উম্মাহ’-দের সোভিয়েত-বিরোধী অবস্থানে সাহায্য করতে শুরু করলেও বিশ শতকের শুরুতে তার লক্ষ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, যা ছিল মূলত তৎকালীন পশ্চিমি বিশ্বের মাথাব্যথা। এভাবে ওয়াহাবি আরব সেন্টিমেন্ট নিয়ে আরব ভূখণ্ড আশ্চর্যজনকভাবে হাত মিলিয়েছে পশ্চিমি বিশ্বের সঙ্গে। অথচ ইসলামিসজম মুখে বলে অভিন্ন খিলাফতের প্রতিষ্ঠার কথা। কী আশ্চর্য স্ব-বিরোধ!
চার
অষ্টম শতকের ওয়াহাবি বিশুদ্ধবাদের অনুসারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে সৌদি আরব কেন চাইল অটোমান সাম্রাজ্যের পতন? এর উত্তর বিস্তৃত আলোচনার ক্ষেত্র দাবি করে। এখানে খুব সংক্ষেপে যেটা না বললেই নয় তা হল, আরব জাতিসত্তা ও তুর্কি জাতিসত্তার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। ঠিক যেমন দ্বন্দ্ব ছিল খিলাফতের প্রথম যুগে উমাইয়াদের শাসনে আরব ও পারসিক জাতিসত্তার মধ্যে। একই কথা খাটে তথাকথিত মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের পূর্বাংশে (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে উর্দুভাষী মুসলমানদের দ্বন্দ্বে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির এর চেয়ে ভালো নজির আর কী হতে পারে!
ইতিহাস ঘেঁটে Perry Anderson-এর “Lineages of the Abosolutist States” (London,1947, p.361) থেকে প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে বিশিষ্ট গবেষক, ঐতিহাসিক মুসা আনসারী ‘উসমানী সমাজ-কাঠামোর রূপান্তর ধারা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখছেন — “ক্ষুদে এশিয়া এবং ইউরোপের বল্কান অঞ্চলে ইসলামি বিশ্বের সম্প্রসারণের গৌরব মধ্য-এশিয়ার তুর্কি জনগোষ্ঠীর; আরব মরু সন্তানদের নয়”।[৯] আর যে আরব জাতিসত্তার সঙ্গে তুর্কি জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব সেই আরব জাতিও আত্মপ্রকাশ করে নানান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে মুসা আনসারী আরও বলছেন :
“ইসলামের অভ্যুদয় ও বিকাশ-ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সপ্তম শতাব্দীতে আরবের হেজাজ প্রদেশে দ্রুত বিকাশমান বেদুঈন সমাজের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, শহুরে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আবার বেদুঈন ও শহুরে সমাজের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আরব জাতি আত্মপ্রকাশ করে। তাদের মধ্য থেকে কৌম সমাজের পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটার পূর্বেই নানা ভাষাভাষী ও নানা জাতিসত্তা নিয়ে অতি দ্রুত গড়ে ওঠে বিশাল আরব সাম্রাজ্য। উন্নত বিজিত জাতি-সত্তার সাথে অনুন্নত বিজয়ী জাতি-সত্তার সমন্বয়ে এমন এক উৎপাদন পদ্ধতি ও সমাজ-কাঠামো গড়ে উঠে যার ফলে বিজয়ী ও বিজিত জাতিসত্তাসমূহের সামাজিক বিকাশ ধারায় স্বাভাবিকতা বাধাগ্রস্ত হয়। সর্বত্র অসম সমাজ বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকে।”[১০]
বিজয়ী ও বিজিত জাতিসত্তার মধ্যে এই অসম বিকাশই বৃহত্তর মুসলিম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ আরব-অনারব জাতিসত্তার দ্বন্দ্বের মূলে। এখানেই ইসলামি হয়েও আরব-তুরানি-ইরানি-মিশরীয় জাতিসত্তার সংঘাত। উমাইয়ারা কখনোই ইরানিদের জাতিসত্তার মর্যাদা দেয়নি। আরবদের কাছে তারা সত্যিকার মর্যাদা পায় হজরত আলি (রাঃ) ও তার অনুগামীদের কাছ থেকে। ফলে ইরান মূলত শিয়া-অধ্যুষিত, যাকে সুন্নিরা আজও ভালো চোখে দেখেন না। আসলে ইরানি জাতিসত্তার বিকাশে মূলত তিনটি পর্ব : ১) প্রাক্-মহম্মদীয় আবেস্তা-বিশ্বাসী সাসানীয় কৃষ্টি, ২) সুন্নি আব্বাসীয় খলিফাতন্ত্রের প্রভাব, এবং ৩) শিয়া ফাতেমীয় খলিফাতন্ত্রের প্রভাব। পরবর্তীতে অটোমান তুর্কিরা এলেও জাতীয় জীবনে নানান কৃষ্টির স্রোতে পুষ্ট পারসি পরম্পরা স্বমহিমায় জীবন্ত ছিল।
যে উমাইয়া খলিফাতন্ত্রের যুগে ইসলাম সিরিয়ার দামাস্কাসকে কেন্দ্রে রেখে ও পরবর্তীতে স্পেনের কর্ডোভাকে কেন্দ্রে রেখে ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছায়, সেই উমাইয়ারা নিজেদেরকে প্রথমত ভাবত আরব, তারপর মুসলমান। আসলে উমাইয়াদের প্রথম খলিফা মুয়াবিয়া ছিলেন আবু সুফিয়ানের বংশধর, আর আবু সুফিয়ান ছিলেন মহম্মদ (সঃ)-এর মক্কা বিজয়ের আগে পর্যন্ত ইসলামের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। ইসলাম গ্রহণের পরেও আবু সুফিয়ানের বংশধরদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল প্রাক্-মহম্মদীয় অনেক আরব রীতিনীতি, যা আরব জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। উমাইয়াদের মধ্যে আরববোধ (উরুবিয়ত) প্রাথমিক পর্যায়ে এতটাই তীব্র ছিল যে অনারবদেরকে, বিশেষত পারসিকদেরকে তারা মুসলমানই ভাবতে চাইত না। প্রাক্-ইসলামি সাসানীয় শাসকদের সময় থেকেই আরব-পারসিক সাংস্কৃতিক সংঘাত ছিলই।আসলে ইরানি সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক পরম্পরা তথা জীবনচর্যার মান বরাবরই যাযাবর আরবদের তুলনায় উন্নত হলেও দাম্ভিক আরবরা ইরানিদের ‘আযম’ বলে ঘৃণা করত। সাসানীয়দের পতনের পর পারস্য উমাইয়াদের দখলে চলে গেলে একদিকে সাম্রাজ্যজয়ের অন্তঃসারশূন্য দম্ভ, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক হীনম্মন্যতা নিয়ে উমাইয়া খলিফাতন্ত্র ‘আযম’ ইরানিদের উপর চাপিয়ে দিল আরবি ভাষা। উমাইয়াদের পঞ্চম খলিফা আব্দুল মালিক (৬৬৫-৭০৫ খ্রীঃ) পারসি, গ্রিক, কপটিক ইত্যাদি ভাষাকে সরিয়ে শাসনকার্যে পাকাপাকিভাবে নিয়ে এলেন আরবি ভাষাকে। ইসলামের ইতিহাসে সেই প্রথম শুরু হল কোরান-প্রদর্শিত ভাষা ও কৃষ্টিগত বৈচিত্র্য (সুরা রূম, আয়াত নং ৩২)-কে অবমাননার প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার। এই স্বেচ্ছাচারকেই পরবর্তীকালে এ পৃথিবী দেখল বিশ্বের নানা প্রান্তে। সুন্নি সাদ্দামের হাতে ইরাকের কুর্দ-নিধন, কিংবা আফগানিস্তানে নানান আঞ্চলিক সংস্কৃতির কন্ঠরোধ, ইত্যাদি এক্ষেত্রে মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত। দক্ষিণ আফগানিস্তান-ঘেঁষা পাকিস্তানের উত্তরভাগ ছুঁয়ে চিত্রাল জেলাতে প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক Magnus Marsden ক্ষেত্র-সমীক্ষা করে দেখিয়েছেন তালিবানদের একরোখা শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতা (যার সঙ্গে কোরানীয় সারল্য ও সহজ যাপনের কোনও সম্পর্ক নেই)-র সঙ্গে কী চূড়ান্ত লড়াই করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মুসলমানেরা তাঁদের আঞ্চলিক কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর পাকিস্তানি রাজাকার বাহিনীর বাঙালি-নিধন (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) তো ইতিহাস।
এ কথা ঠিক, মহম্মদ(সঃ) স্বয়ং ইসলামে আরব কৃষ্টির প্রভাব বর্জন করেননি, নিয়েছিলেন আব্রাহামীয় সেমিটিক রীতিনীতি। কাবা, কুরবানি, হজ এসব তো প্রাক্-মহম্মদীয় বিষয়। আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কারণ মহম্মদ (সঃ) পয়গম্বর হলেও রক্তমাংসের মানুষ, যিনি তাঁর জাতিসত্তা ও কৃষ্টির শ্রেয়তর দিকগুলিকে বিসর্জন দিতে পারেন না, এবং দেওয়ার কথা বলতেও পারেন না। পবিত্র কোরানে আপন ভাষা ও কৃষ্টিগত বৈচিত্রকে মান্যতা দেওয়ার পক্ষে রয়েছে স্পষ্ট সওয়াল, যার কথা আগেই বলেছি। যারা তা মানে না এবং একমাত্রিক প্যান-ইসলামিজমের নামে তার টুঁটি টিপে ধরে তারাই বরং ইসলাম থেকে বিচ্যুত।
আসলে আরব ভূখণ্ডে আরববোধ (উরুবিয়ত) আর ইসলাম সমার্থক, যা কোরান-সম্মত। হজরত মহম্মদ (সঃ)-এর চাচা আব্বাসের পুত্র আবদুল্লাহ আব্বাস (যিনি আবুল আব্বাস আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত এবং আব্বাসীয় খলিফাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা) প্রাক্-ইসলামি আরবি সাহিত্য এবং আরবদের ইতিহাসের চর্চা ও তার সংসক্ষণে উৎসাহী ছিলেন। এমনকি, কোরানের কোনও কোনও আয়াত সহজ করে ব্যাখ্যা করতে প্রাচীন আরব সাহিত্য থেকে তিনি উদ্ধৃতিও দিতেন। অর্থাৎ সেখানে ধর্ম আর জাতিসত্তার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু আরব ভূখণ্ড ছাড়িয়ে ইসলাম যত বাইরে বেরিয়েছে, এই দ্বন্দ্ব ততই তীব্র হয়েছে। কারণ কোরানে শুধু আরব নয়, পৃথিবীর সব ভাষা, কৃষ্টি তথা জাতিসত্তার বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি দেওয়ার নিদর্শন থাকলেও মুসলমান শাসকেরা বহুক্ষেত্রেই যখন বিজয়ীর ভূমিকায় বিজিতের উপর খবরদারি করতে চেয়েছেন তখনই তৈরি হয়েছে এই দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই অনারব মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম প্রধান সংকট, যা থেকে আজও তার মুক্তি অধরা। শিয়া-অধ্যুষিত ইরান তার জাতিসত্তার গভীরে প্রোথিত প্রাক্-ইসলামি কৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে বহু যুগ ধরে এই দ্বন্দ্ব নিয়ে লড়েছে, কিন্তু অনেক রক্তপাত, অনেক নিরীক্ষার পর বর্তমানে তার প্রাক্-ইসলামি জাতিসত্তা ধর্মের কাছে নতজানু হয়েও এই দ্বৈত সত্তার সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পেরেছে কি? আর দক্ষিণ এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে এই সংকট আরও তীব্র। অবশ্য আরব ভূখণ্ডের লাগোয়া পশ্চিম এশিয়াতে এই সংকট ততটা তীব্র নয়। যদিও উনিশ শতকে পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের প্রভাব তুরস্ক ও মিশরে একটা ঝড় তুলেছিল, তবু গণতন্ত্রের বিপন্নতা, সামরিক শাসনের একরোখা অবস্থান ও ধর্মতাত্ত্বিকদের প্যান-ইসলামিজম তাকে টিকতে দেয়নি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দ্বান্দ্বিকতা ছেড়ে মিশর শেষপর্যন্ত আরব কৃষ্টির অন্তঃস্রোতকেই শিরোধার্য করেছে। শুধু ইউরোপ-ঘেঁষা তুরস্ক ইসলামকে গ্রহণ করলেও এখনও ‘উরুবিয়ত’-কে পুরোপুরি মেনে নেয়নি। তাই বিশ শতকের প্রথম ভাগে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও উসমানবাদের অন্তিমদশা স্পষ্ট হলে এক শ্রেণির ইসলামি বুদ্ধিজীবী প্যান-ইসলামিজমের প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এলে অনেকে প্যান-তুরানবাদের প্রচারে এগিয়ে এলেন, যা ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদের সঙ্গে অনেকটা সাজুয্যপূর্ণ।
পাঁচ
বিজিত জাতির জাতিসত্তা ও কৃষ্টিকে অস্বীকার করে ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতির শুরু উমাইয়াদের পঞ্চম খলিফা আব্দুল মালিকের সময়ে হলেও এই প্রবণতা চূড়ান্ত রূপ পেল উমাইয়াদের অষ্টম খলিফা দ্বিতীয় ওমর (৭১৭-৭২০ খ্রীঃ)-এর হাতে, যখন তিনি শাস্ত্রকারদের হাত করে সর্বপ্রথম প্রশাসনিক উদ্যোগে শাস্ত্রকার আর রাষ্ট্রব্যবস্থার যোগ ঘটালেন। তার আগে পর্যন্ত শাস্ত্রকারদের মোটের উপর একটা নিরপেক্ষ অবস্থান ছিল, যা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে একটা মর্যাদাপূর্ণ দূরত্ব বজায় রাখত। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় ওমরের সময় থেকে শাস্ত্রকারদেরকে রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার শুরু করল, এবং কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া শাস্ত্রকাররা মাথা নোয়ালেন রাষ্ট্রের কাছে। আর এই মাথা নোয়ানোর ধারা অব্যাহত থাকল পরবর্তীতে আব্বাসীয় এবং ফাতেমীয় খলিফাতন্ত্রের অনেক শাসকের সময়েও। তাই অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইসলামের বৌদ্ধিক চর্চার স্বর্ণযুগেও একমাত্র আল ফারাবি ছাড়া আলকিন্দি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে তুফাইল প্রমুখ দিকপাল দার্শনিক ও চিন্তাবিদরাও রাষ্ট্রের বিন্যাস, উত্তরণ তথা রাষ্ট্র জিজ্ঞাসা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে আরব চিন্তাবিদদের এই অনীহা বিস্ময়কর। আদি ইসলামের আধা ধর্মীয় গণতন্ত্র, গোত্র শাসিত সাম্যবাদ ও জনপ্রতিনিধির শাসন থাকলেও পরবর্তীতে রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু রাষ্ট্রজিজ্ঞাসার পথ রুদ্ধ করে দিল। চিন্তাবিদদের ভয় ছিল নিজেদের দর্শনচিন্তার ফসল এই বুঝি রাষ্ট্রীয় ফতোয়ার শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে। তার নমুনাও তো কম ছিল না। যেমন, ইবনে সিনা রাষ্ট্রশক্তির অত্যন্ত কাছাকাছি থেকে শাসনতন্ত্র নিয়ে কখনো প্রশ্ন না তোলা সত্ত্বেও শুধু স্বাধীন দার্শনিক চিন্তা তথা মুক্তবুদ্ধির জন্য ইমামদের চাপে রাজদরবার থেকে বিতাড়িত হয়ে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন সমগ্র আরব ভূখণ্ডে। আর আলকিন্দির দর্শনকে আরব দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। মূলত লাতিন তর্জমাতে তা বেঁচে ছিল বলে পরবর্তী পৃথিবী তা হাতে পেয়েছে, যা লাতিন থেকে পরে নতুন করে আরবিতে অনূদিত হয়। বৌদ্ধিক চর্চার স্বর্ণযুগেও শাস্ত্রকার আর রাষ্ট্রের এই ফতোয়া আরব দুনিয়ার লজ্জা।
এত কিছু সত্ত্বেও ব্যতিক্রম কি নেই? আগেই বলেছি ব্যতিক্রমী আল ফারাবির কথা। জন্মসূত্রে তুর্ক এই চিন্তাবিদ প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তায় প্রভাবিত হলেও স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন বিজিত-বিজেতার সম্পর্ক ব্যাখ্যায়। আরব জাতিসত্তা ও সম্প্রসারণবাদের নজির দেখে ধর্মাশ্রয়ী জাতিগঠন তথা জাতীয়তাবাদকে তিনিই প্রথম সমাজতত্ত্বের আলোয় বিচারের প্রয়াস দেখালেন। এখানেই আল ফারাবি যুগের তুলনায় এগিয়ে।পরবর্তীতে ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রচিন্তাকে ফারাবির চিন্তা প্রভাবিত করল। কী সেই চিন্তা? ভাবতে অবাক লাগবে আজ থেকে হাজার বছর আগে তাঁর চিন্তাতে ধরা পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদের করাল চেহারা। তিনি অনুভব করেছিলেন যে শক্তিশালী রাষ্ট্র সবসময় অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের উপর খবরদারি করতে চায়, মুছে দিতে চায় বিজিতের ধর্ম, সংস্কৃতি ও পরম্পরা। আর বিজিত এক সময় বাধ্য হয় বিজয়ীর চাপিয়ে দেওয়া আধিপত্য মেনে নিতে।
যাইহোক, শাসকের আধিপত্য তথা রক্তচক্ষু সত্ত্বেও মুসলিম দুনিয়ায় যেটুকু ব্যতিক্রমী চিন্তা রাষ্ট্রজিজ্ঞাসার আঙিনায় এ যাবৎ সাড়া ফেলেছে তা মূলত ত্রিমুখী :
“এক) ইসলামের আদি গণতন্ত্রে ফিরে যেতে চাইছেন কিছু কিছু গোষ্ঠী। যেমন, পাক-ভারত উপমহাদেশের জামাত-এ-ইসলামি, আরব ভূখণ্ডের ইখোয়ানুল মুসলিমিন এবং ইরানের বিপ্লবী পরিষদ। দুই) স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশকে ঘিরে, ধর্মের সঙ্গে যথাসম্ভব আপস করে পশ্চিমি ধাঁচের গণতন্ত্র গড়ে তুলতে চাইছেন আর-এক দল। তিন) বৈজ্ঞানিক কিংবা মিশ্রিত সমাজবাদের ভিতের ওপর রাষ্ট্র কাঠামোকে দাঁড় করাতে চান পরস্পর বিরোধী আরও দুটি গোষ্ঠী। যেমন পশ্চিম এশিয়ার বাথ সমাজবাদী ও বহু দলে বিভক্ত কমিউনিস্টরা। রাষ্ট্র জিজ্ঞাসার এই তিন স্রোত অবশ্য কোথাও খুব একটা প্রবল নয়। হ্যাঁ, খানিকটা জমি খুঁজে পেয়েছেন ইরানিরা। আরও কিছু জমি স্থায়ী হয়েছে সিরিয়া-ইরাকের বাথ সমাজবাদীদের দখলে। ইয়েমেন এবং আলজিরিয়ায় কমিউনিস্টদের আসন এখনও পাকাপোক্ত হবার দিন গুনছে। মুসলিম দেশগুলিতে রাষ্ট্র জিজ্ঞাসার দারিদ্র্য এবং রাষ্ট্রের স্থিতিহীনতা কি রুদ্ধ করেনি তার যুক্তিবাদকে? সংকটে পড়লে, ইসলামি শাসনকাঠামো উপহার দেয় যে ক্ষমতা-কাঙাল সামরিকতন্ত্র কিংবা কম্পমান রাজতন্ত্র, সেই কিন্তু মোক্ষম সময়ে পিছিয়ে যায়।জোরে, কৌশলে অ-ইসলামিয় স্বৈরাচার চাপিয়ে দেয় রাষ্ট্রের ওপর। উমাইয়া আমল থেকেই কার্যত এটা একটি সাধারণ লক্ষ্মণ।”[১১]
বাহারউদ্দিনের অসামান্য প্রবন্ধ “আফলাতুনের পৃথিবী” থেকে নেওয়া এই সুচিন্তিত বিশ্লেষণকে অত্যন্ত যথাযথ মনে হয়। আসলে ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার এই ত্রিমুখী স্রোত তৈরি করেছে ইসলামি জাতীয়তাবাদের দক্ষিণবাদী, বামবাদী এবং বাম-ডানের মধ্যবর্তী প্রবণতা। এ প্রসঙ্গে নাদিম পারাচা লিখছেন :
“দক্ষিণবাদীদের প্রবণতা যেমন ‘ইসলামি মৌলবাদ’ ‘ইসলামবাদ’ আর ‘নব্য-মৌলবাদ’-এর দিকে, বামবাদীদের ধারা তেমনি ‘ইসলামি সমাজবাদ’, ‘বাথ সমাজবাদ’ আর ‘আরব জাতীয়তাবাদ’ বা ‘আরব সমাজবাদ’-এর দিকে। এঁদের সকলের কেন্দ্রে অবস্থান করে মুসলিম জাতীয়তাবাদ।”[১২]
প্রথমেই বলি বামপন্থীদের কথা। বামপন্থীদের লক্ষ্য ইসলামি সমাজতন্ত্র। রাশিয়ার কাজানের সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠী ১৯১৭-এর রুশ বিপ্লবের আগেই ইসলামি সমাজতন্ত্রকে পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। এরা উলেমাতন্ত্র ও গোঁড়া শরিয়তপন্থীদের বিরোধী এবং কম্যুনিস্টদের প্রতি নরমভাবাপন্ন হলেও ইসলামি প্রতীক ব্যবহার করে ও নিজেদের মুসলমান পরিচিতি বজায় রাখে। কোরানীয় সাম্যের ধারণা ও সার্বিক কল্যাণকে এরা আধুনিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে মিলিয়ে মুসলিম দুনিয়ায় আনতে চায় বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ। আরবে একেই বলে ‘আরব সমাজতন্ত্র’ আর ইরাক, সিরিয়া ও মিশরে ‘বাথ সমাজতন্ত্র’ বা বাথ সমাজবাদ। আরবিতে ‘বাথ’ বলতে বোঝায় নবজাগরণ। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আরব বা বাথ সমাজতন্ত্র যখন পায়ের তলায় শক্ত মাটি পেল তখন ইসলামি সমাজতন্ত্রের আদর্শ ইন্দোনেশিয়া, আলজিরিয়া, সুদান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করল। ষাটের দশকের শুরুতে (১৯৬২) আলজিরিয়ার ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পর নিজেদেরকে বলল ইসলামি সমাজতন্ত্রের অনুসারী। এদিকে লিবিয়ার রাজপরিবারকে সরিয়ে গদ্দাফি ক্ষমতায় এলেন নিজেকে ইসলামি সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে। একই পরিচিতিতে সামনে এল ইয়াসের আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট ও পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, যারা ষাট ও সত্তরের দশকে ক্ষমতায় এল। কবি ও চিত্রশিল্পী হানিফ রামে ছিলেন পাকিস্তানে আধুনিক ইসলামি সমাজতন্ত্রের অন্যতম উদ্গাতা। আর মিশরের গামাল আবদুল নাসের হলেন আরব সমাজতন্ত্রের মুখ্য প্রবক্তা, যাদের পরোক্ষ প্রভাবে ষাট ও সত্তরের দশকে সুদান ও সোমালিয়াতেও ক্ষমতায় এল ইসলামি সমাজতন্ত্রীরা। ইরানে ১৯৭৯ সালের অভ্যুত্থানে বাথ সমাজতন্ত্রীরা অংশ নিল, যাদের নেতা বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আলী শরিয়তী, যিনি ইসলামি সাম্যের ধারণার সঙ্গে মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারণার মেলবন্ধন ঘটালেন।অবশ্য শাহের অনুগামীরা ১৯৭৯-তে অভ্যুত্থান সংঘটিত হাবার আগেই তাঁকে হত্যা করে (১৯৭৫)। পরবর্তীতে দক্ষিণপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসে আলি শরিয়তির অনুগামীদের উচ্ছেদ করল। আসলে গোঁড়া দক্ষিণপন্থী মুসলিম রাজশক্তিগুলির চোখে ইসলামি সমাজতন্ত্রীরা পরিচিত ছিল ইসলামের শত্রু হিসেবে, কারণ তাদের চোখে এরা সোভিয়েত বা চিনের মতো ঈশ্বর-অবিশ্বাসী নাস্তিক শক্তির হাতে তৈরি।
ছয়
দক্ষিণপন্থী ইসলামিরা সেই অর্থে পায়ের তলায় মাটি পেতে শুরু করল ১৯৭০-এ মিশরের জনপ্রিয় নেতা ‘আরব সোশ্যালিস্ট’ গামাল আবদুল নাসেরের দেহান্তরের পর থেকে। আর এই মাটি আরও শক্ত হল ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে পশ্চিমি শক্তি ও তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতন্ত্রগুলির সমর্থনে। কারণ, ১৯৭৩-৭৪-এ আন্তর্জাতিক তেলসংকট শুরু হলে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত ইসলামি সমাজতন্ত্রী দেশগুলির সাধারণ মানুষ সমাজতন্ত্রের উপর আস্থা হারাল। এত কিছুর পরেও ১৯৭৮-এ আফগানিস্তানে ঘটল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির উদ্যোগে সোভিয়েত-সমর্থিত ‘সর বিপ্লব’। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সত্তরের দশকের শেষের দিকে ইসলামি সমাজতন্ত্র দক্ষিণপন্থী ইসলামি শক্তি ও পশ্চিমি শক্তির মদতে প্রায় ধুয়ে মুছে গেল। আর সেই অশান্ত সময়ে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বামপন্থীরা সমর্থন করল সোভিয়েত ইউনিয়নকে।
ইতিহাস শূন্যতা পছন্দ করে না। ইতিহাসের কালচক্রে সামনে এল দক্ষিণপন্থী ইসলামি শক্তি। কিন্তু বামপন্থী সমাজতন্ত্র মুছে গেলেও তার প্রভাব রেখে গেল বৃহত্তর সমাজ-শরীরে। উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলন ও প্রগতিশীল মুসলিম জাতীয়তাবাদ যে উদারচিন্তার ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল তার সঙ্গে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে মুসলিম-অধ্যুষিত নানান দেশে যে ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কার্যকলাপ চলেছিল তার যৌথ প্রভাবে তৈরি হল উদারবাদী ইসলামি জাতীয়তাবাদের অঙ্কুর। অবশ্য বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এই উদারবাদের যাত্রা শুরু অষ্টম-নবম শতকে মুতাজিলাপন্থী মুক্তচিন্তকদের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে। কোরানে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বৌদ্ধিক চর্চার প্রতি নির্দেশ তথা উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তাকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এই মুতাজিলা গোষ্ঠী। জীবন-জিজ্ঞাসা, মুক্তচিন্তা বা ইজতিহাদ এবং যৌক্তিক বিশ্বাসকে এই উদারবাদী ইসলামি চিন্তকরা সঙ্গে নিয়েছিলেন। মহম্মদ(সঃ)-এর দেহান্তরের বহু পরে একনায়ক শাসকের সুবিধা মতো তৈরি শরিয়ত ও তার অনুসারী গোঁড়া উলেমাদের বিরোধী এই উদারবাদী মতাদর্শ বহুত্ত্বের সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ মুতাজিলাদের চিন্তাধারা, উনিশ শতকের প্রগতিশীল মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থী ইসলামি সমাজতন্ত্রের সম্মিলিত প্রভাবে তৈরি হল যে উদারবাদী ইসলামি পরম্পরা তা স্বভাবতই তথাকথিত প্যান-ইসলামিজমের একমাত্রিকতা এবং নব্য-মৌলবাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা ও নৈরাজ্যকে একেবারেই সমর্থন করে না। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক এই পথে হেঁটেই আধুনিক ইসলামি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে প্যান-ইসলামিজম, প্যান-তুরানবাদ, উনিশ শতকীয় প্রগতিশীল মুসুলিম জাতীয়তাবাদ, নব্য-মৌলবাদাশ্রিত জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, কিংবা মধ্যপন্থী উদারবাদী গণতান্ত্রিক ধারা — সবকিছুর মধ্যেই পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা থাকলেও সামন্তবাদের বিরোধিতা তেমন ছিল না। আর ছিল না বলেই এদের কারোর মধ্যেই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির কোনো দিশা নেই, নেই সত্যিকার প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তির হদিস। এমনকি, মহম্মদ (সঃ)-প্রদর্শিত ইসলামি আদর্শ ও ভ্রাতৃত্বের সঙ্গেও এদের কোনও যোগ নেই। আর নেই বলেই সোভিয়েতের পতনের পর যখন পশ্চিমি ও আরব দুনিয়া থেকে অর্থের জোগান বন্ধ হয়ে গেল তখন তথাকথিত ইসলামিস্টদের কার্যকলাপের সমীকরণও গেল পালটে।
পশ্চিমি শক্তি ও তেলসমৃদ্ধ আরব দুনিয়া সোভিয়েত-বিরোধী দক্ষিণপন্থীদের পালে হাওয়া লাগিয়ে তৈরি করল আফগানি জেহাদ। এই তথাকথিত জেহাদি শক্তিই পরে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হতে সময় নেয়নি। বহিরাগত শক্তির মদতে আশির দশকে রণংদেহী মনোভাব নিয়ে যাদের বাড়বাড়ন্ত, তারা নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েতের আফগানিস্তান থেকে পিছু হটার পর এতটাই আত্মবিশ্বাসী ও লাগামহীন হয়ে উঠল যে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের ঠিক করে দেওয়া রাস্তা ও নীতি থেকে সরে এসে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করতে লাগল। শুরু হল বিভিন্ন মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে ‘ইসলামি বিপ্লববাদ’-এর প্রস্তুতি। কেমন তার চেহারা? তা হল, তথাকথিত গণ-অভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বেছে বেছে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান কি এতই সোজা? এতই সহজ বিপ্লব সংঘটন? বলা বাহুল্য, তা হল না, কিন্তু দগদগে ঘায়ের মতো রয়ে গেল হতাশ জঙ্গিপনার কাপুরুষোচিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। মরতে লাগল হাজার হাজার সৈন্য ও নিরীহ মানুষ — পাকিস্তান, আলজিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, নাইজিরিয়া, সোমালিয়া, সিরিয়া, লেবাননের বিভিন্ন প্রান্ত হয়ে পড়ল যেন বারুদের স্তূপ। তৈরি হল পরকালে বেহেস্তের ছাড়পত্র প্রত্যাশী আত্মঘাতী ফিদায়েঁ বাহিনী। আজও কান পাতলেই শোনা যায় মানব-বিধ্বংসী বিস্ফোরণের শব্দ। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের হোতারা হারাতে লাগল জনসমর্থন, এমনকি তাদের সাবেক সঙ্গীরাও তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করল। এতে আরও বেড়ে গেল তাদের জেদ ও প্রতিহিংসা। একুশ শতকের আল কায়দা, তালিবান, আইসিস, বোকোহারেম, হিজবুল মুজাহিদিন, লস্কর-ই-তৈবা, জৈশ-ই-মহম্মদ ইত্যাদি আসলে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেরই ফলশ্রুতি (by-product)।
আসলে ইতিহাস চলে তার নিজস্ব নিয়মে। একটা প্রেক্ষিত জন্ম দেয় আর একটা প্রেক্ষিতকে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। অতিদক্ষিণপন্থী জঙ্গিগোষ্টীগুলি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলিতে যে নৈরাজ্য ও ক্ষতি ডেকে আনল তা মেরামত করতে এগিয়ে এল ইসলামি রাজনীতির এক ধ্রুপদী সংস্করণ, যাকে সঙ্গে নিয়ে অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে (পাকিস্তান, মিশর, তিউনিসিয়া, সুদান ইত্যাদি) শুরু করলেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। যাঁরা এই পথে ক্ষমতা দখলে এগিয়ে এলেন তাঁরাই আসলে বাম-ডানের মাঝখানে মধ্যপন্থী।
এ কথা ঠিক যে এই মধ্যপন্থা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি কোনও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতে। আর এই ব্যর্থতার কারণ হল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের প্রয়াসকে গিলে ফেলল স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, মেরুকরণ ও প্রশাসনিক অরাজকতা। ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন বিষয়কেও ধর্মাশ্রয়ী পথে সমাধানের চেষ্টা কার্যত তাদেরকে আরও পিছনের দিকে ঠেলে দিল, ব্যাহত হল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ। তাই ঠান্ডা লড়াই-পরবর্তী যুগে ইসলামি জাতীয়তাবাদ ভোটের ময়দানে সফল হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মোরসির বিপুল ভোটে জেতার পরেও বছর ঘুরতেই তার যে পতনের কথা আগেই বলেছি, তা এই ব্যর্থতারই নমুনা। নির্বাচনের একবছর যেতে না যেতেই সেখানে ঘটল সামরিক বিদ্রোহ।
পাকিস্তানের তথাকথিত গণতন্ত্র নিয়েও একই কথা খাটে, যেখানে প্রায়ই সামরিক শক্তি পার্লামেন্টের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। মুসলিম জাতীয়তাবাদে মধ্যপন্থীদের এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা হল চরমপন্থী তথাকথিত ‘বিপ্লববাদী’ আধুনিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে কোনও দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারা। অনেক সময় নির্বাচিত সরকার প্রতিবেশী দেশগুলিকে ত্রস্ত রাখতে এদেরকে মদত দিতেও দ্বিধা করে না। বিশেষত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রায়ই ওঠে।
সাত
মধ্যপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদী শক্তি যে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে চটাতে সাহস করে না তারা আসলে নব্য-মৌলবাদী। এরা দ্বাদশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি মৌলবাদ ও মরমিবাদ (যার জন্ম হয়েছিল মুতাজিলাপন্থী দার্শনিক ও মুক্তচিন্তকদের সঙ্গে প্রখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম গাজ্জালীর বৌদ্ধিক সংঘর্ষে) থেকে প্রকৃতিগতভাবে আলাদা। বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্রুপদী মৌলবাদ তো বটেই, সেইসঙ্গে মরমিয়াবাদ থেকে সরে এসে এই নব্য-মৌলবাদীরা হিংসা, ঘৃণা ও বলপ্রয়োগকে হাতিয়ার করল। ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার চূড়ান্ত প্রকাশ এই নব্য-মৌলবাদ। এদের তথাকথিত ইসলামিজম, কৃষ্টিগত বৈচিত্র্য, যুক্তিবাদ, পারস্পরিক সহাবস্থান ইত্যাদির পরোয়া না করে কসমোপলিটানিজমের একেবারে বিপ্রতীপে অবস্থান করে। আল কাইদা, তালিবান, আইসিস ইত্যাদি যেসব জঙ্গিগোষ্ঠীর কথা আগেই উল্লেখ করেছি তারা এই পথের পথিক, যদিও কায়েমি স্বার্থে ও আদর্শের বিকৃতির কারণে তাদেরও নিজেদের মধ্যে কোনও ঐক্য নেই। ঐক্য যে নেই তা একুশ শতকের শুরু থেকেই এক নাগাড়ে দেখা যাচ্ছে। সব জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যকলাপ নিয়ে এখানে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়, আবশ্যকও নয়। শুধু এদের বিবদমান কর্মসূচি নিয়ে প্রাথমিক ধারণার স্বার্থে তালিবান ও আইসিসদের মধ্যের শত্রুতা থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের দিকে একটু নজর রাখা যাক।
১৯৯৬-এর পর থেকে দীর্ঘ প্রায় দু-দশক আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন রাখার পর আমেরিকা যখন আফগানিস্তানকে তালিবানদের হাতে নতুন করে ছেড়ে চলে গেল তখন থেকে তো বটেই, তার বহু আগে থেকেই তালিবান-আইসিস লড়াই আজও চলছে। বিশ শতকের শেষ দিকে উত্তর পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফগানিস্তানের পাস্তুন এলাকাতে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে সুন্নি ওয়াহাবি মজহবের নেতা মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তৈরি এই তালিবান গোষ্ঠী, যার অর্থ ছাত্র। শুরুতে এরা পাস্তুন এলাকাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে সমগ্র আফগানিস্তান দখল করে কান্দাহারকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি করে ইসলামিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান। শুধুমাত্র ২০২১-এর প্রথম চার মাসেই ৭৭ টি সংঘর্ষ হয়েছে তালিবান ও আইসিস (খোরাসান)-এর মধ্যে। তালিবানদের মধ্যে থেকেই বিক্ষুব্ধ অংশকে নিয়ে আইসিস উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে তৈরি করল আইসিস (খোরাসান)। তালিবান নেতা মোল্লা আখতার মহম্মদ মনসুর আইসিস কম্যান্ডার আবুবকর আল বাগদাদিকে যদিও তালিবানদের ছাতার তলায় এসে মিলে যেতে আহবান জানান, তবু এই মিলন সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি? এর পিছনে ক্ষমতালিপ্সা ছাড়াও কিছু শরিয়তি বিশ্বাসগত বৈসাদৃশ্যও আছে। একথা ঠিক, উভয় গোষ্ঠীই নিজেদেরকে কট্টর সুন্নি মুসলমান বলে মনে করে এবং ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা চায়। কিন্তু চরমপন্থী ওয়াহাবি ও সালাফি (যার উদ্ভব সৌদি আরবে) মতের পথিক আইসিস অপেক্ষাকৃত বেশি কট্টরপন্থী। ১৯৯৯-এ মাথা তুললেও ২০১৪-তে ইরাকের মসুল দখলের পর নিজেদের শক্তি জাহির করে এই কট্টর জঙ্গিগোষ্ঠী। এরা তালিবানদের মতো শুধু একটি বিশেষ দেশে নিজেদের বেঁধে রাখতে চায় না। এদের চোখে তালিবান হল আমেরিকার হাতের পুতুল বা “stooge of the US”।[১৩] সম্প্রতি বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজের বিশ্লেষক Mina Al-Lamina এমনই বলছেন। আর প্রখ্যাত ‘The Guardian’ পত্রিকার বিদেশ-বিষয়ক প্রতিনিধি Jason Burke বলছেন, তালিবানদের চেয়ে অনেক বেশি কট্টর এই আইসিস গোষ্ঠীর লক্ষ্য “unmitigated violence, extreme commitment to doctrinal purity and apocalyptic predictions”[১৪]-এর প্রতি।
তালিবানরা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে পরিবর্তিত বিশ্বের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে কিছুটা হলেও মানিয়ে নিতে চায়, কিন্তু আইসিস গোষ্ঠীর ধাতে সেসব নেই। মহিলাদের প্রতি রক্ষণশীল শরিয়তি মনোভাব উভয় গোষ্ঠীর থাকলেও আইসিস গোষ্ঠী নারীকে মূলত যৌনতা চরিতার্থের সামগ্রী মনে করে। আর শিয়াদের প্রতি আইসিসের মনোভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। শিয়াদেরকে এরা মুসলমানই মনে করে না। শিয়ারা সবসময়ই এদের আক্রমণের লক্ষ্য। আর যে কোনও আক্রমণে আইসিস লড়ে প্রথাসিদ্ধ সেনার মতো, কিন্তু তালিবানদের যুদ্ধরীতি অনেকটা গেরিলাদের মতো। সর্বোপরি, আইসিস সোশ্যাল মিডিয়াতে দারুণ সক্রিয় ও দক্ষ। এই প্রজন্মের দক্ষ যুবকদের মগজ ধোলাইয়ে পারদর্শী এই গোষ্ঠী শুধু ২০১৬-তেই ৮৫০ জন ব্রিটিশ যুবককে (যারা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবরার দক্ষ) দলে টেনেছে, যারা কট্টরভাবে পশ্চিম-বিদ্বেষী।
বলা বাহুল্য, নব্য-হিন্দুত্ববাদ তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যেমন ভারতীয় সনাতন কৃষ্টির সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যের কোনও সম্পর্ক নেই, তেমনি প্যান-ইসলামিজম তো বটেই, তথাকথিত প্রগতিশীল মুসলিম জাতীয়তাবাদের সঙ্গেও মহম্মদীয় ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। আর নব্য-মৌলবাদের প্রতিনিধি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে তো কোনও অর্থেই মেলানো যায় না মহম্মদীয় ইসলামের সঙ্গে। এ কথা ঠিক, মহম্মদ স্বয়ং স্বভূমি মক্কা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আত্মরক্ষা তথা মদিনার নিরাপত্তা ও সুস্থিতির স্বার্থে বেশকিছু যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের অনুমোদন কোরান দিয়েছে তা এইসব জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি আদৌ মনে রাখেনা। পবিত্র কোরানের ২২নং সুরা (সুরা আল হজ্জ্ব)-র ৩৯ নং আয়াতে বলা হচ্ছে :
“যুদ্ধাক্রান্তগণে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হইল যেহেতু তারা নির্যাতিত; আল্লাহ তাদিগে সাহায্য করিতে সক্ষম”[১৫]
অর্থাৎ আক্রান্ত না হলে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধের অনুমোদন ইসলামে নেই। কোরানের ৪ নং সুরা (সুরা নিসা)-র ৭৪-৭৫ নং আয়াতে দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র নিপীড়িতদের স্বার্থে যুদ্ধের অনুমোদন :
“তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের পক্ষে সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এ অত্যাচারী শাসকের দেশ থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও, এবং তোমার নিকট হতে কেউ আমাদের সাহায্য করো’।”[১৬]
কিন্তু বিপন্নকে রক্ষা করার স্বার্থে যে ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদ তারও সীমারেখা বেধে দিয়েছে ইসলাম। যতবারই কোরান জেহাদের অনুমোদন দিয়েছে ততবারই সতর্ক করে দিয়েছে যে যাদের বিরুদ্ধে জেহাদ, তারা যদি যুদ্ধ থেকে বিরত হয় তাহলে সেই যুদ্ধ থেকে বিরত হতে হবে। কারণ, “আল্লাহ বাড়াবাড়িকারীদের পছন্দ করেন না”।[১৭]
আসলে মহম্মদীয় ইসলামের ভাষায় জেহাদ হল ‘জিহাদ-ফি-সাবিল-আল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ-নির্দেশিত পথে যুদ্ধ, যা অধর্ম, অনৈতিকতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। সাধারণ অর্থে যে যুদ্ধ তা হল ‘কিতাল’ বা ‘হারব’। কিন্তু ‘জিহাদ’ আর ‘হারব’-কে গুলিয়ে ফেলে ধর্মান্ধরা তথাকথিত জেহাদের ডাক দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করছে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। কোরান একে অনুমোদন দেওয়া দূরে থাক, একে ঘৃণ্য, বর্বরোচিত ও পরিত্যাজ্য মনে করে।
আট
এ কথা ঠিক যে মহম্মদ (সঃ) মদিনার পুনর্গঠন ও মক্কা বিজয় করলেও প্রাচীন গ্রিসে ‘পলিস’, প্রাক্-মহম্মদীয় পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্য, কিংবা বাইজান্টাই সাম্রাজ্য যে অর্থে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা বা শাসনতন্ত্রের হদিস দেয়, সেই অর্থে মহম্মদ (সঃ) কোনও প্রথাগত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেননি । বলা বাহুল্য, সেটাই স্বাভাবিক, কারণ মূলত তিনি একজন পয়গম্বর, যাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য কোরান-নির্দেশিত ধর্মাদর্শ প্রচার। কিন্তু প্রথাগত রাষ্ট্রনায়ক না হয়েও তিনি রাজনৈতিক আদর্শের যে সমুন্নত পরাকাষ্ঠা (বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সহাবস্থান)-র নজির রেখে গেছেন তা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে অনুসরণযোগ্য দিকনির্দেশ। প্লেটোর ‘Politics’, কিংবা কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ মূলত রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার রেসিপি সরবরাহের গ্রন্থ। কৌটিল্যের গ্রন্থে তো রাজ্যের স্বার্থে ভেদনীতির কৌশল (যা কোরান অনুযায়ী অনৈতিক)-কে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তাই কোরান তথা মহম্মদীয় রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে এসবের তুলনা চলে না। কোরান হল মূলত ধর্মগ্রন্থ, যার মধ্যে নিহিত সামগ্রিক জীবন যাপনের সার্বিক দর্শন তথা দিকনির্দেশ। রাষ্ট্রনীতি তার একটি দিক মাত্র, যার প্রচ্ছন্ন পথনির্দেশ সেভাবেই দেওয়া আছে, যেভাবে একটি ধর্মগ্রন্থ বলতে চায়। আর তাকে অনুসরণ করে ইসলামি রাজনৈতিক আদর্শের যে মহার্ঘ দৃষ্টান্ত মহম্মদ (সঃ) ইসলাম প্রতিষ্ঠার সূত্রে রেখে গেছেন, তা কোনও প্রকার ভেদনীতি তথা অনৈতিকতাকে অনুমোদন দিতে পারে না। তথাকথিত ইসলামি জাতীয়তাবাদ কিংবা বিশ্বব্যাপী খিলাফতের স্বপ্নদেখা প্যান-ইসলামিজমের সঙ্গে তাকে মেলাতে গেলে হোঁচট খেতে হবে।
স্বভূমি মক্কা থেকে অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হয়ে মহম্মদ (সঃ) যখন মদিনায় স্থিত হলেন তখন তাঁর প্রধানতম কাজ ছিল মদিনাবাসীর আস্থা অর্জন ও সেখানকার বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বার্থে একটি সংহতিসূচক সন্ধি স্থাপন করা, যা মদিনার সনদ নামে পরিচিত। তৎকালীন মদিনার অমুসলিম জনগোষ্ঠী (ইহুদি ও খ্রিস্টান)-র কাছে প্রেরিত এই সনদ সন্দেহাতীতভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সনদ, যা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের অঙ্কুর। বলা বাহুল্য, মহম্মদ (সঃ)-প্রেরিত এই সনদ তথাকথিত প্যান-ইসলামিজমের একমাত্রিকতা, কিংবা তথাকথিত মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের ইসলামি রাষ্ট্রের সঙ্গে আদৌ খাপ খায় না। আর তালিবান তথা বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কথা তো এই মহম্মদীয় সনদের সাপেক্ষে ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। একমাত্রিক ইসলামি জাতীয়তাবাদীদেরকেই শুধু নয়, যে কোনও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তির চোখে আঙুল দিয়ে এই সনদ দেখিয়ে দিতে পারে শাসকের নৈতিক ভিত্তি কেমন হওয়া উচিত। প্রখ্যাত মদিনা-সনদের প্রাসঙ্গিক অংশের কিছুটা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা জরুরি। প্রথমেই সামনে আনি ইহুদিদের উদ্দেশে প্রেরিত সনদের কথা, যা ইহুদিদের অভ্যন্তরস্থ সমস্ত গোত্রের সবার প্রতি মিত্রতা ও সহাবস্থানের অবারিত আহবান :
“বানু আওফ গোত্রের ইয়াহুদীরা মুসলমানদের সাথে একটা সন্ধিবদ্ধ মিত্রজাতি গঠন করবে এবং তারা উভয়েই (ইয়াহুদী ও মুসলমান) নিজ নিজ কর্ম অতি নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাবে। বানু নাজ্জার, বানু হারিস, বানু সাইদা, বানু জুশাম, বানু আউস এবং বানু সা’লাবা প্রমুখ গোত্রের ইয়াহুদীরা বানু আওফের ন্যায় সমান অধিকার ও সুযোগ সুবিধে ভোগ করবে। আর সন্ধিবদ্ধ জাতির এই স্বাক্ষরিত সনদকে ভঙ্গ বা অস্বীকার করে কেউ যদি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তাহলে তা প্রতিহত করার জন্য ইয়াহুদী মুসলমান উভয়ে মিলে একে অপরকে পরস্পর সক্রিয় সাহায্য করবে আর তারা পরস্পরের সঙ্গে অকপট মধুর ব্যবহার প্রদর্শন করবে। যারা এই চুক্তি সনদকে উপেক্ষা না করে মনে-প্রাণে গ্রহণ করবে তাদের জন্য ইয়াসরিবের (মদীনা) মধ্যস্থিত সকল স্থানই পাক-পবিত্র বলে গণ্য হবে। আর এই ইয়াসরিব শহর কখনও দুশমন দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা তার প্রতিরক্ষাকল্পে নিজেদের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করে পরস্পর পরস্পরের জন্য অকুন্ঠ সাহায্য ও সহায়তার হাত প্রসারিত করবে।”[১৮]
এখানেই শেষ নয়, নজরান গোত্রের খ্রিস্টানদের প্রতিও তিনি প্রেরণ করলেন ধর্মনিরপেক্ষ সনদ, যার কিয়দংশ নিম্নরূপ :
“…ইতিপূর্বে খ্রিস্টানরা যে অবস্থায় ছিল তার কোন পরিবর্তন বা নড়চড় হবে না। আর তাদের কোন ধর্মীয় খিদমত বা দেব প্রতিমাকেও পরিবর্তিত পরিমার্জিত হতে দেয়া হবে না। খ্রিস্টান ধর্মাধ্যক্ষকে তাঁর পদাধিকার থেকে, সাধু-সন্ন্যাসীকে তাঁর আশ্রম থেকে, ধর্মালয়ের পরিচালককে তাঁর কার্যালয় থেকে কোন নির্ধারিত নীতির মাধ্যমে কোনক্রমেই অপসারিত করা হবে না, তাঁদের সে পদ ছোট কিংবা বড় যাই হোক না কেন। ইসলাম-পূর্ব যুগের কোন বিভ্রান্তকর কার্যকলাপ, অন্যায় আচরণ অথবা রক্তক্ষয়ের জন্য তারা কোনদিনই দায়ী হবে না। সামরিক খিদমাতের জন্যও তাদেরকে কোন দিন আহবান করা হবে না; আর তাদের কাছে ওশর বা ফসলের দশমাংশও কোন দিন চাওয়া হবে না। মুসলিম সেনাবাহিনী স্বীয় এগিয়ে চলার পথে কোনদিন তাদের ভূমিও মাড়াবে না।”[১৯]
এই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের মহম্মদীয় পরম্পরাকে সঙ্গে করেই মহম্মদ (সঃ)-এর দেহান্তরের পর প্রথম চারজন খলিফা আবুবকর (রাঃ), ওমর (রাঃ), ওসমান (রাঃ) এবং আলি (রাঃ) ইসলামি রাজনৈতিক দর্শন তথা রাষ্ট্রভাবনার ভিত্তি গড়ে দেন। খলিফা ওমর (রাঃ) (যাঁর সময়ে ইসলাম সর্বাপেক্ষা দ্রুত প্রসারলাভ করে) জেরুজালেম জয় করার পর জেরুজালেমের অধিবাসীদের সঙ্গে যে সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করেন তা মহম্মদ (সঃ)-এর মদিনা-সনদেরই পরম্পরা। T.W. Arnold তাঁর ‘The Preaching of Islam’-এ এই সন্ধিপত্র নিয়ে যা লিখছেন তাঁর অনূদিত রূপ হল :
“পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহর প্রতিনিধি ও বিশ্বাসীদের নেতা খলীফা উমরের তরফ থেকে এতদ্বারা আলেয়ার জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা হচ্ছে।সন্ধি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সুস্থ-অসুস্থ বাসিন্দাদের জান-মাল, গির্জাসমূহ, ক্রুশ্চিহ্ন এবং অন্যান্য সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির সার্বিক হেফাজত করা হবে। তাদের গির্জাসমূহ কখনও বাসগৃহে রূপান্তরিত হবে না। তাদের গির্জা প্রাঙ্গণ বা তার সংশ্লিষ্ট পদার্থ ও সংযোজিত বস্তু কোন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্রুশচিহ্ন ও বিষয়-সম্পত্তির কোনই ক্ষতি সাধন করা হবে না। তাদের ধর্মমত ও বিশ্বাসের ব্যাপারে কোনদিন কোন বলপ্রয়োগ করা হবে না। তাদের ধর্মকে বিনষ্ট করতে দেয়া হবেনা অথবা তাদের কাউকেও কষ্ট দেয়া হবেনা।”[২০]
প্রশ্ন হল, এমন অনন্য ধর্মনিরপেক্ষ পরম্পরা থাকতেও আজ কেন মুসলিম দুনিয়ার অবনমন? যে পশ্চিমি সভ্যতা মধ্যযুগে (যখন ইসলামের স্বর্ণযুগ) ছিল অন্ধকারে ডুবে, সে আজ সামনের সারিতে, আর মুসলিম বিশ্ব কেন গেল পিছিয়ে? কেন তাকে নতুন করে পশ্চিমি সভ্যতার বিপ্রতীপে প্রতিস্পর্ধী শক্তিরূপে বিশ্বব্যাপী খিলাফতের স্বপ্ন ফিরি করে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, প্যান-ইসলামিজম ইত্যাদির কথা বলতে হচ্ছে? উত্তর খুব সহজ। কিন্তু সেই সহজ উত্তরকে সহজে গ্রহণ না করে অবাস্তব পথে হেঁটে (কখনো হিংসাকে মদত দিয়ে) ইউটোপিয়ান খিলাফত বা ইসলামিক ব্রাদারহুডের স্বপ্ন দেখে আর যায় হোক আসল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাহলে সমাধানের সহজ উত্তরটা কী? একটু ইতিহাসমুখী হতে হবে সে উত্তর পেতে।
নয়
অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইসলামের স্বর্ণযুগে কোরানীয় বিশ্ববীক্ষার সমুন্নত নিদর্শনের সঙ্গে সিরিয়া, মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়ার বৌদ্ধিক চর্চায় বিধৃত গ্রিক, ল্যাটিন ও নেস্টোরীয় খ্রিস্টান বুদ্ধিবৃত্তিক পরম্পরা এবং পারস্যের সাসানীয় বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বয়ে মুতাজিলা দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান শাখায় অবদান রেখে তৈরি করেছিলেন ইসলামের ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চার সমুন্নত পরম্পরা (আব্বাসীয় খলিফাতন্ত্রে বাগদাদে, ফাতিমীয় খলিফাতন্ত্রে মিশরে এবং উমাইয়া খলিফাতন্ত্রে দামাস্কাস ও কর্ডোভাতে)। এই পরম্পরা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক একাডেমিক বিদ্যাচর্চার ইতিহাসে চির প্রোজ্জ্বল। ইউরোপে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ধারণাই ছিল না। প্রাচীন গ্রিস জ্ঞানচর্চার উঠোনে কিছুটা আলো জ্বালালেও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা ছিল নিরীক্ষার স্তর থেকে দূরে (hypothetical)। যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষার মাধ্যমে তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে শক্ত জমি খুঁজে দেওয়ার কৃতিত্ব আরব দুনিয়া তথা ইসলামি মধ্যপ্রাচ্যের। এ বিষয়ে George Sarton তাঁর ‘The History of Science’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন — “The main, as well as the least obvious, achievement of the Middle Ages was the creation of the experimental spirit and this was primarily due to the Muslims down to the 12th century”.[২১] আর ইসলামি রেনেসাঁর সেই উজ্জ্বল সময়ে ইউরোপের অবস্থা নিয়ে Donald Campbell তাঁর অসামান্য গ্রন্থ ‘Arabian Medicine and Its Influence on the Middle Ages’-এ লিখছেন — “Europe was in the dungeons of darkness during the scientific era of Islam and fanaticism, tyranny, blind faiths, magic and spells ruled the roost.”[২২] ইউরোপের কৃতিত্ব এটাই যে সেই অন্ধকার সরিয়ে পরবর্তী কালে মধ্যপ্রাচ্যের নিরীক্ষা-নির্ভর জ্ঞানচর্চার পরম্পরাকে মুক্ত মনে গ্রহণ করতে পশ্চিমি চিন্তাবিদদের বাধেনি। ধ্রুপদী ইসলামের মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানচর্চার এই সমুন্নত পরম্পরা তৈরি হয়েছিল মহম্মদীয় নির্দেশকে মনে রেখে। কী সেই নির্দেশ? তা হল — “জ্ঞানান্বেষণের জন্য প্রয়োজনে চিনদেশ পর্যন্ত যাও”।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘরের বিদ্যাকে ‘পর’ (তথাকথিত ইসলামিস্টদের ভাষায়) গ্রহণ করলেও এবং গ্রহণ করে তরতরিয়ে এগিয়ে গেলেও মুসলিম বিশ্ব মৌলবাদী, রক্ষণশীল, শাস্ত্রীয় আচার-স্বর্বস্ব, ঘরানাকেই ক্রমে শিরোধার্য করল। যদিও ইমাম গাজ্জালি (একদা মুতাজিলা)-র রেখে যাওয়া মরমি অন্তর্জ্যোতিবাদ (যা ধর্ম, দর্শন ও মরমিয়াবাদের মিশ্রণ) সুফিবাদকে দিল নবতর মাত্রা, তবু রাষ্ট্রশক্তি তথা বৃহত্তর মুসলিম সমাজ মরমিবাদের উচ্চতর বীক্ষণকে উপলব্ধি করতে না পারায় ধ্রুপদী ইসলামের মুক্তিচিন্তা ও বৌদ্ধিক চর্চা থেকে দূরে শরিয়ত-নির্ভর ইসলামকেই গ্রহণ করল। ফলে দ্বাদশ শতকের পর থেকে মাত্র দু-তিন শতকের মধ্যেই ইসলাম হারাল তার জৌলুস। ইসলামি বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৌদ্ধিক অবনমনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পোঁছানো যখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, ততদিনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (মধ্যপ্রাচ্যের দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চার কাছে যার প্রত্যক্ষ ঋণ)-র সাহায্যে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতাবাদ পৃথিবী শাসন করতে হাজির। আসলে পশ্চিমি বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্ম স্বমহিমায় বহাল থাকলেও সে ব্রুনো, গ্যালিলিও প্রমুখের সঙ্গে যে ভুল করেছিল, সে ভুলের পুনরাবৃত্তি থেকে ক্রমেই সরে এল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য তার উলটো পথে হাঁটল। এ প্রসঙ্গে রাজিউদ্দিন আকিলের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত যথাযথ মনে হয় :
“The proponents of shariat-bound Islam would like to capture power once again, in order to establish what is, in their opinion, the correct form of Islam that invokes a particular reading of the Quran and the prophetic Tradition. Liberal interpretations of Islam and Muslims who have resisted the totalizing nature of Islamic orthodoxy (of whatever school) would be the immediate victims…Faith prevails over reason.”[২৩]
প্রশ্ন হল, মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদের উপর তথাকথিত শরিয়তি বিশ্বাসের এই আধিপত্য (যা দ্বাদশ শতকের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বাগদাদের রাজপ্রাসাদ থেকে ইবনে রুশদের বিতাড়নের মধ্য দিয়ে) কেন বার বার মূলত মুসলিম বিশ্বকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে? মসজিদ ও রাজপ্রাসাদের মিলিত কোরাসে কেন ইসলামি বিশ্বে মাথা তুলতে পারে না স্বতন্ত্র কোনও রাষ্ট্রজিজ্ঞাসা? ইসলামের মতো খ্রিষ্টান ধর্মও তো সম্প্রসারণবাদী। কিন্তু পশ্চিমি বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্ম থাকলেও সে ক্রমেই সরে গেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র থেকে চার্চের চারদেওয়ালের ভিতরে ধর্মজিজ্ঞাসার পরিসরে। তাই বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের মধ্যেও খ্রিস্টান মিশনারিরা কাজ করে গেছেন নিজস্ব পরিসরে, প্রত্যক্ষভাবে নাক গলাননি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। কিন্তু ইসলামি বিশ্বে দেখি তার বিপরীত ঘটনা-প্রবাহ। কোরানে বিভিন্ন জাতিসত্তার বিকাশের সমর্থন থাকলেও সেখানে আরব জাতিসত্তার বিকাশ ও সম্প্রসারণে রাষ্ট্রশক্তি ইসলামকে কৌশলে ব্যবহার করেছে, শাস্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অজুহাতে। আর এখান থেকেই তৈরি হয়েছে তার আধিপত্যকামী ক্ষমতার দম্ভ। আর এই দম্ভ নিয়েই সে টিকে থাকতে চায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে যখনই সংকট আসে তখন সে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক ব্রাদারহুড ইত্যাদির গালভরা গল্প শোনায়, ফিরতে চায় অতীত গৌরবে, দেখাতে চায় ইসলামি স্বর্ণযুগের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৌদ্ধিক চর্চার পরাকাষ্ঠা। ইউরোপীয় রেনেসাঁর নবলব্ধ জ্ঞানবিজ্ঞানের ফসলকে যদিও সে সংগতভাবেই দাবি করে ইসলামি রেনেসাঁর বৌদ্ধিক চর্চার পরোক্ষ ফলরূপে, তবু সে ভুলে যায় যে ইসলামের স্বর্ণযুগেও রাষ্ট্রশক্তি আর উলেমাতন্ত্রের যৌথখড়্গ নেমে এসেছিল মুক্তচিন্তার উঠানে।
তাই জ্ঞানবিজ্ঞানের নানান শাখা বিস্তৃত হলেও রাষ্ট্রজিজ্ঞাসাতে বিশেষ কোনও মৌলিকত্ব দেখা গেল না ইসলামি বিশ্বে। প্রাচীন গ্রিস কিংবা পরবর্তীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁ পর্বের মুক্তচিন্তার সঙ্গে ইসলামি দুনিয়ার রেনেসাঁ পর্বের এখানেই মৌলিক তফাত। শাস্ত্রীয় ও রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আত্ম-জিজ্ঞাসার মুক্ত পরিসরে পশ্চিমি বিশ্ব যে সৎসাহস দেখিয়েছে, তা ইসলামি রেনেসাঁর যুগেও দেখা যায়নি। যুক্তিবাদ আর শাস্ত্রীয় অনুমোদন-ভীরুতার দ্বন্দ্ব থেকে মুসলিম বিশ্ব আজও মুক্ত নয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক, বরিষ্ঠ লেখক বাহারুদ্দিনের পর্যববেক্ষণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয় যখন তিনি বলেন :
“এখনও, রাষ্ট্রের লোকায়ত ও সহনশীল চরিত্র থাকা উচিত কিনা, এই প্রশ্নের বিধিসম্মত উত্তর খুঁজতে জেরবার হতে হয় রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনায়কদের। যাঁরা লোকায়ত রাষ্ট্রের ওকালতি করেন, অবাক হয়ে দেখি তাঁরাও দ্বিধাগ্রস্ত, তাঁরাও দ্বারস্থ হন ইসলামি শংকরাচার্যদের দরজায়, সুপারিশ খোঁজেন কোরান হাদিসে। আর এর বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁরা তো এক কথায় ‘না জায়েজ কুফরি’, বলে উড়িয়ে দেন নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা। আরও বিস্মিত হয়ে লক্ষ করি অভিন্ন সামাজিক আইনের উকিলরাও শাস্ত্রের বন্দীশালায় বসে ব্যস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে।”[২৪]
মুশকিল হল, শাস্ত্র বলতে তাঁরা মূলত বোঝেন মহম্মদ (সঃ)-পরবর্তী যুগের শাসক ও উলেমাতন্ত্রের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হাদিস বা শরিয়তকে। এক্ষেত্রে অনেক দূরে পড়ে থাকে কোরানীয় বিশ্ববীক্ষার উদার মানবিক পরম্পরা। কিন্তু নাটকীয়ভাবে তাঁরাই যখন রাষ্ট্রজিজ্ঞাসা থেকে দূরে ধর্মভাবে স্থিত থাকেন, তখন দেখা যায় তাদের ভিন্ন চেহারা।শান্ত স্বভাবে তখন তাঁরা বলেন ইসলামের অর্থ হল শান্তি। ধর্মপালনে সকল প্রকার জবরদস্তির বিরুদ্ধে কোরানের আয়াতকে সামনে এনে তাঁরা বলেন —“লা ইক্রাহা ফি-দ্বীন” অর্থাৎ “ধর্মে কোনও জবরদস্তি নেই”[২৫] — ইসলামি সাম্য ও গণতন্ত্রের এই পরাকাষ্ঠা হঠাৎই উবে যায় যখন তাকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে প্রয়োগের প্রশ্ন ওঠে।
আর ওঠে বলেই শুধু তুর্কি-আরব-ইরানি দ্বন্দ্ব নয়, মধ্যপ্রাচ্যেই জন্ম হয় কুড়িটির বেশি সংঘর্ষপ্রবণ মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্রের। পাকিস্তানের পেট চিরে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। আবার সেই বাংলাদেশকেও বার বার ধর্মীয় মৌলবাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। আর পাকিস্তানে সেই প্রবল ধর্মীয় মৌলবাদের চাপের কাছেই মাথা নোয়াতে হয় অক্সফোর্ডের প্রাক্তনী তথা তথাকথিত উদারবাদী পিপলস পার্টি-র নেত্রী বেনজির ভুট্টোকে। আর আদিপত্যবাদী সাদ্দাম হোসেন, কিংবা গদ্দাফিদের কার্যকলাপে অতিষ্ট হয়ে দিশেহারা লাগে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে।
দশ
তাই কোরান-নির্দেশিত প্রকৃত মুসলিম ভ্রাতৃত্ব (যা সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও তার সংহত সহাবস্থানের কথা বলে) আজও অধরা। ঠিক যেমন প্রকৃত গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র সেই অর্থে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যদিও তার প্রয়াস দেখা গেছে বহুবার। তত্ত্ব বাস্তবায়নের প্রয়াস ব্যর্থ হওয়া মানে কি তত্ত্বই ভুল? একজন অমনোযোগী ছাত্র একটি সহজ অঙ্ক যদি একাধিকবার ভুল করে তাহলে কি অঙ্কটিকেই ভুল বলে দেগে দেওয়া যায়? হয়তো কোনও মনোযোগী ছাত্র এসে যথাযথ সূত্র ও পদ্ধতি মেনে সেই একই অঙ্কের উত্তর খুব সহজেই মিলিয়ে দেবে!
কোরানে এমনই সূত্র তথা নিদর্শন-সংবলিত অসংখ্য (বিশেষজ্ঞদের মতে ৭৫০-এর বেশি) আয়াত আছে যা বিশ্ব-চরাচর জুড়ে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে বিধৃত মহাজাগতিক নিয়ম তথা ভারসাম্যকে অনুধাবন করার যৌক্তিক সমীক্ষা ও বিশ্বাসের কথা বলে, যেখানে গোঁড়ামির কোনও স্থান নেই। তাই পশ্চিমি সভ্যতা আর মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি সভ্যতার মধ্যে বৌদ্ধিক চর্চার কোনও সাংঘর্ষিক ব্যাপার থাকা সমীচীন নয়। বস্তুত, মানব সভ্যতার প্রগতির পথে সভ্যাতার সংঘর্ষ (Clash of Civilizations) বলে কিছু হয় না।যেটা হয়, এবং হওয়া উচিত সেটা হল সভ্যতার সংশ্লেষ তথা সমন্বয়। আধুনিক পশ্চিমি সভ্যতার যেটুকু অসভ্যতা সেটা তার আগ্রাসী, সাম্রাজ্যবাদী মামসিকতায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বৌদ্ধিক চর্চার ক্ষেত্রে অপরকে নিরীক্ষণ ও আত্মীকরণে তার কোনও শুচিবাই ছিল না, আজও নেই। তথাকথিত ইসলামিজমের তত্ত্ব নিয়ে যারা মুসলিম জাতীয়তাবাদ তথা ইসলামিক ব্রাদারহুডের স্বপ্ন দেখে, কিংবা জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে হিংসাকে ছাড়পত্র দিতে বদ্ধপরিকর, তাঁরা তাঁদের বিচ্ছিন্নতাকামী তত্ত্ব ছেড়ে এই তথ্য ও সত্যকে যত দ্রুত বুঝবেন ততই ইসলাম তথা মানব সভ্যতার মঙ্গল।
তথ্যসূত্র :
১) Rajiuddin Aquil, ‘In the Name of Allah’, Penguin Viking, 2009, pp199-200
২) আলকুরআন, সুরা রূম, আয়াত ২২
৩) আলকুরআন, সুরা ফাতির, আয়াত ২৭-২৮
৪) সুরামায়েদা, আয়াত ৩২
৫) Rajiuddin Aquil, Ibid, p.195
৬) Ibid, p.196
৭) Ibid, p.194
৮) Ibid, p.195
৯) মুসা আনসারী, ‘ইতিহাস : সমাজওসংস্কৃতি–ভাবনা’, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, পৃ: ৭১
১০) তদেব, পৃঃ ৮২
১১) বাহারউদ্দিন, ‘আফলাতুনের পৃথিবী’, ইদেরআরম্ভ, সম্পাদনা : বাহারউদ্দিন, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বি১০/২ পয়মন্তী আবাসন লিমিটেড, ২০০২, পৃ: ৩১৯
১২) ৪নম্বরপ্ল্যাটফর্ম, ‘রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান’, নাদীম পারাচা https:// www.4nuberplatform.com August 1,2017
১৪) Ibid
১৫) আলকুরআন, সুরা আল-হজ্জ্ব, আয়াত ৩৯
১৬) আলকুরআন, সুরা নিসা, আয়াত ৭৪-৭৫
১৭) আলকুরআন, সুরা বাকারাহ, আয়াত ১৯০
১৮) ডঃ গোলাম মকসূদ হিলালী, ‘ইসলামেধর্মনিরপেক্ষতা’, জি.এম. হিলালী রোড, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ১৯৭৪,পৃ: ১৮, ইবনু হিশাম কৃত সীরাতু রাসুলিল্লাহ, মিসরীয় সংস্করণ, ২য় খণ্ড, পৃ: ৯৪-৯৮ সংক্ষিপ্তসার থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি
১৯) তদেব, পৃ: ১৯, আল্লামা বালাযুরী কৃত ফুতুহুল বুলদান, পৃ: ৭২, ‘The origins of the Islamic State’, প্রফেসর হিট্টী, পৃ: ১০০-১০১ থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি
২০) তদেব, পৃ: ৩২ তারীখুল উমাম আল-মুলুক, ‘জারীর তাবারী’, পৃ: ২৪৯৭, এবং শিবলী, আল-ফারূক, ২য় খণ্ড, পৃ: ১৬৭ থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি
২১) Mohammad Aslam Parvaiz, ‘The Scientific Muslim’, Konark Publishers International, 2021, p.97,George Sarton, ‘An Introduction to the History of Science’ (Washington, Carnegie Institution,1927) থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি
২২) Ibid, p.100, Donald Campbell, ‘Arabian Medicine and Its Influence on Middle Ages’, Vol 1 (London, Rutledge,Trench, Trubner&Co Ltd, 1926) থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি
২৩) Rajiuddin Aquil, ‘In the Name of Allah’, p.213
২৪) বাহারউদ্দিন, তদেব, পৃ: ৩৩১
২৫) আলকুরআন, সুরা বাকারাহ, আয়াত ২৫৬