জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

কুমারজিৎ মণ্ডল 

অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির যোগ নিয়ে জনসমাজে যথেষ্ঠ আগ্রহ আছে। রাজনীতির বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে অর্থনৈতিক কারণের কতটা ইন্ধন থাকে — তা বিদ্যালয়ের ছাত্র যেমন তার ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে পড়ে তেমনি আবার অর্থনীতিবিদ তাঁর গবেষণার নিরিখে ওই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেন। যে বিষয়টি বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য সেটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নয়। এর একটা তত্ত্বগত নির্মাণ আছে, আবার ফলিত রূপও আছে। সেই ফলিত রূপ অনেক দেশ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক পরিচয়ের যেমন জন্ম দিয়েছে, আবার অনেক দেশভাগ, অনেক যুদ্ধ এবং দাঙ্গার সাক্ষী থেকেছে। সেই বিষয়টি জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদের সংগঠনে অর্থনীতির যে ভূমিকা থাকে তার আলোচনাই এই প্রবন্ধের সারবস্তু।

এক

অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট ব্রেটন ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে অর্থনীতির ভূমিকার কথা আলোচনা করেছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদের চর্চাকে এক ধরনের বিনিয়োগ হিসেবেই দেখেছিলেন। যে সমাজে জাতীয়তাবাদ বিরাজ করে সেই সমাজ এই রাজনৈতিক ভাবনার চর্চায় যথেষ্ট পরিমাণে মূলধন বিনিয়োগ করে। সেই সমাজ তাদের এই মূলধনের বিনিয়োগ থেকে যথোপযুক্ত লাভ অর্জন করে। তবে এই লাভের অংশীদারিত্ব সেই দেশের জনগোষ্ঠীর সব অংশের জন্য সমান নয়। কোনও কোনও বিশেষ গোষ্ঠীভুক্তরা বেশিরভাগ লাভ তাদের ঘরে তোলে। এক কথায় বলতে গেলে, জাতীয়তাবাদে বিনিয়োগ ততটা আয় উৎপাদন করে না, যতটা আয়ের পুনর্বন্টন করে। 

জাতীয়তাবাদের একাধিক মাত্রা আছে। দুটি মাত্রা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য —  সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ মূলত পিতৃভূমি বা মাতৃভূমির গরিমাগাথা কবিতা, গান বা নাটকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। দেশের গৌরবজ্জ্বোল অতীতের চর্চায় নিয়োজিত থাকে। ব্রেটনের কথায় এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ জনমানসে একধরনের মননের অনুশাসন জারি রাখে যার নিরিখে যেকোনও অনুশীলন শুধুমাত্র ‘জাতীয়তাবাদী’ তকমার জন্য প্রশংসিত হয়। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব বলতে মূলত জাতীয় পতাকা তৈরির কাজ, দেশাত্মবোধক গান রচনার জন্য কিছু বাড়তি কাগজ ছাপানো — এরকম গৌণ অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপেই আটকে থাকে। 

অন্যদিকে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। এই ক্রিয়াকলাপের মূল লক্ষ্য থাকে দেশভুক্ত কোনও বিশেষ ক্ষমতাশালী জনগোষ্ঠীর দাবি পূরণ করা। সেই দাবি অন্য কোনও জাতি (যারা দেশের বাইরে আছে) বা দেশের ভেতরে থাকা অন্য জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী হলেও কোনও পরোয়া নেই। কারণ উদ্দিষ্ট ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নির্ভর করে এই দাবিজনিত প্রত্যাশাগুলির বাস্তবায়নের মধ্যে। তবে এটা বুঝতে হবে যে বাস্তবজগতে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ এত সহজে পৃথক করা যায় না। দুটোর মধ্যে মিথোজীবীতার সম্পর্ক আছে। 

জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিহিত থাকে কোনও একটা ভৌগোলিক অঞ্চলে বা তার সন্নিহিত অঞ্চলে — যেখানে জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেয় — সেখানে বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পত্তিগুলির পুনর্বণ্টনের দাবির প্রশ্নে। কিন্তু এই পুনর্বণ্টন সাধিত হতে পারে কেবলমাত্র বর্তমান সম্পদের মূল্যে। যে গোষ্ঠী এই মূল্য দিতে রাজি থাকবে তারা আসলে একধরনের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জাতীয়তাবাদে বিনিয়োগ। সহজ করে বলতে গেলে জাতীয়তাবাদ একধরনের মূলধন — যা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মোট সম্পদের একটা অংশ এবং এর মালিকানা সাধারণত থাকে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর হাতে। জাতীয়তাবাদকে এইভাবে মূলধন হিসাবে বিচার করলে এই মূলধন নতুন বিনিয়োগ দ্বারা বর্ধিত হবে আর উপভোগ এবং ডেপ্রিশিয়েশন দ্বারা ক্ষয়িষ্ণু হবে— এটাই অর্থনীতির নিদান। এটাই জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার তাত্ত্বিক নির্যাস। 

জাতীয়তাবাদ নামক মূলধন একপ্রকারের সামাজিক মূলধন। সুতরাং একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপভোগ অন্যান্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপভোগ কমাবে না। অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীরা জানে যে সামাজিক মূলধনের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি তার সঠিক চাহিদা প্রকাশ করে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ থেকে কার কী লাভ হচ্ছে সেটা নিরূপণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। 

জাতীয়তাবাদে বিনিযোগের মুনাফা দুভাবে আসে— অর্থকরী মুনাফা এবং অনর্থকরী মুনাফা। জাতীয়তাবাদের সফল প্রয়োগের ফলে যারা ক্ষমতার কাঠামোর উচ্চস্তরে পৌঁছাল তারা সমাজের সামগ্রিক সম্পদের ওপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার সুযোগ পায়। তাই বিভিন্ন উপায়ে তারা খাজনা আদায় করার একটা সুবিধা পায়। যদি জাতীয়তাবাদের জাগরণ কোনও দেশের স্বাধীনতা এনে দেয় তাহলে স্বাধীন দেশে যারা ক্ষমতা দখল করল তারা সরকারি পদগুলিতে আসীন হবে। এতে তাদের আয় পূর্বের তুলনায় যথেষ্ঠ পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এটাকে জাতীয়তাবাদ থেকে প্রাপ্ত অর্থকরী মুনাফা হিসাবে ধরা যায়। অনর্থকরী মুনাফা পরিমাপ করা কঠিন। মূলত জাতীয়তাবাদী কাজকর্মের সাফল্যলাভে জনমানসে যে গর্বের সঞ্চার হয় এবং নিজস্ব পরিচিতির যে সন্তুষ্টি তৈরি হয় — সেগুলোই এখানে বিবেচ্য। তবে জাতীয়তাবাদের এই ভাবাবেগ — যাকে আমরা জাতীয়তাবাদের অনর্থকরী মুনাফা বলব — তা কিন্তু মানুষকে জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

তবে অর্থকরী মুনাফার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখের দাবি রাখে। এই মুনাফা বা আয় যেসব পেশা থেকে আসে বা অধিক পরিমাণে আসে— সেগুলি বেশিরভাগ দখল করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বাদবাকি পেশাগুলি স্বল্প আয়ের পেশা যাদের আমরা বলতে পারি শ্রমিক শ্রেণির পেশা। এমন শ্রমিক শ্রেণির পেশা পড়ে থাকে তথাকথিত সামাজিক মর্যাদায় যাদের অবস্থান মধ্যবিত্ত শ্রেণির নীচে অবস্থিত তাদের জন্য। এই পেশাগুলি জাতীয় স্বার্থের মাপকাঠিতে গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

তবে জাতীয়তাবাদের সাফল্য আর অর্থনীতির সূত্র সবসময় মেলে না। অনেক সময় ‘বাড়তি’ সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমন নতুন ব্যবস্থায় যে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করে তা অর্থনীতির সূত্র মোতাবেক যা হওয়া উচিত তার থেকে অনেক বেশি। এই বাড়তি উপার্জন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকতর কর্মদক্ষতার পরিচায়ক নয়। বরং তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তির ফল। এইভাবে সামাজিক মূলধনের পুনর্বন্টনে এক জনগোষ্ঠী লাভবান হয় আর-এক জনগোষ্ঠীর মূল্যে। তাই সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থার পিরামিডে যাদের অবস্থান মধ্যবিত্তের নীচে তারা স্বাভাবিকভাবেই জাতীয়তাবাদে বেশি আকৃষ্ট হয় না। জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে বেশি উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ তারাই বেশি লাভবান হয়।

দুই

উপরে উল্লেখিত আলোচনা মূলত জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পর নতুন প্রাপ্ত ক্ষমতা কীভাবে দুই ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন হবে তাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়। অর্থনৈতিক কারণসমূহ কীভাবে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়? এবিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে ইহুদিদের জাতিসত্তার বিকাশ কীভাবে হয়েছিল তার দিকে লক্ষ করলে। যদিও আজ তারা পরাক্রমশালী জাতি। কিন্তু তাদের উত্থানের গল্পটা অন্যরকম।  

ইহুদি বিদ্বেষ ইউরোপের ইতিহাসে এক অভিশপ্ত অধ্যায়। আমরা শেক্সপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব্‌ ভেনিস’-এ এই বিদ্বেষের একটা আভাস পাই। ওই নাটকে শাইলক একজন ইহুদি ব্যবসায়ী। সে মহাজনি কারবার করে। সে ধার দেয় এবং চড়া সুদে ধারের পরিশোধ চায়। সময়মতো সেই ধার শোধ করতে না পারলে ঋণগ্রহীতার অঙ্গহানি করতে সে পিছপা নয়। আজকের সভ্য সমাজের নিরিখে এই বিধান নারকীয় মনে হলেও শেক্সপিয়রের সময়ে এরকম শাস্তির বহুল চল ছিল। এখানে যেটা বলার বিষয় সেটা হল শাইলক নেহাত একটা নাটকের চরিত্র নয়। শেক্সপিয়র শাইলককে একভাবে ইহুদি জাতির প্রতিভূ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। ইহুদিদের জাত ব্যবসা ছিল মহাজনি কারবার। সেই কারবারকে লাভজনক রাখার জন্য তাদের অনাদায়ী ঋণের ব্যাপারে নৃশংস হতে হত। এই নৃশংসতাকে ভিত্তি করেই ইহুদি বিদ্বেষের বীজ বপন হয়েছিল। আজও নাটকটা দেখবার সময় বা পড়বার সময় দর্শকের বা পাঠকের মনে শাইলক সম্বন্ধে যে বিদ্বেষ জন্মায় সেটা শেক্সপিয়রের সময়কালে ইউরোপে গোটা ইহুদি জাতির বিরুদ্ধেই ছিল। সুতরাং একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে ইতিহাসে হিটলারই একমাত্র ইহুদি বিদ্বেষী ছিলেন। তবে হিটলার ইহুদি বিদ্বেষকে যে অমানবিক নিষ্ঠুরতায় পরিণত করেছিলেন তার তুলনা মেলা ভার। 

সম্প্রতি ব্যাকার এবং প্যাস্কেলি এই বিষয়ের ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করেছেন। তাঁরা জার্মানির ইতিহাসে ১৩০০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত সময়কালে কীভাবে এই ইহুদি বিদ্বেষ প্রসার লাভ করল তার প্রায়োগিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন তাঁদের বিশ্লেষণে যে ইহুদিদের মহাজনি কারবারে তুলনামূলক সুবিধা ছিল। এর কারণ সম্ভবত দুটো। প্রথমত, ক্যাথলিক সমাজে সুদের কারবার নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু ইহুদিদের তেমন কোনও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল না। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘু ইহুদিরা শিক্ষার হারে, গণনার পারদর্শিতায় এবং মানবিক সম্পদে অগ্রবর্তী ছিল সংখ্যাগুরু খ্রিস্টানদের চেয়ে। তার সঙ্গে আরও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক কারণের সংযোগে মহাজনি কারবারের পেশাতে তারা নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে। 

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত খ্রিস্টানদের জন্য সুদের কারবারের ওপর নিষেধাজ্ঞার কোনও হদিস পাওয়া যায় না। তারপর ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে নাইকায় অনুষ্ঠিত প্রথম ইকিউমেনিক্যাল কাউন্সিলে চার্চের ধর্মসূত্রে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। প্রথমদিকে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল পাদরিদের মধ্যে এবং মাত্রাতিরিক্ত সুদ ধার্য করার ক্ষেত্রে। পরবর্তীকালে সম্রাট শার্লেমানের সময় যে কোনও ব্যক্তির দ্বারা যে কোনও সুদ ধার্য করার বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইনদ অব্‌ পাভিয়া এই শার্লেমানের বিধানকে চার্চের ধর্মসূত্র হিসাবে লিপিবদ্ধ করে। তারপর দ্বিতীয় (১১৩৯) এবং তৃতীয় (১১৭৯) ল্যাটেরান কাউন্সিল এই বিধানের আবশ্যকতার ওপর জোর দেয়। সর্বোপরি সেন্ট থমাস আকুনাস — যাকে ক্যাথলিক ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা হিসাবে গণ্য করা হয় — এই বিধানকে খ্রিস্টীয় সামাজের জন্য অপরিহার্য বলে পরিগণিত করেন। 

খ্রিস্টীয় ধর্মসূত্র মেনে চলা ক্যাথলিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ইহুদিদের কাছে এর মান্যতা ছিল না। তাই তারা সুদের ব্যবসা নির্দ্বিধায় চালিয়ে যেতে লাগল। চতুর্থ ল্যাটেরান কাউন্সিল তাকে এক ভাবে বৈধতা দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ক্যাথলিক চার্চ কেন ইহুদিদের সুদের ব্যবসা মেনে নিয়েছিল। একটা জুতসই জবাব পাওয়া যায় সেন্ট থমাস আকুনাসের লেখায় — ইহুদিদের সম্মতি না দিলে আরও বড়ো বিপদ হতে পারে। সেটা হল খ্রিস্টানরা তখন সুদের ব্যবসা শুরু করবে। ফলত সেই ত্রয়োদশ শতক থেকে ইউরোপে ইহুদিদের প্রধান পেশা হয়ে উঠল সুদের কারবার। ঊনবিংশ শতকেও দেখা যায় যে ব্যাংকিং এবং ফিনান্সের ক্ষেত্রে ইহুদিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। 

এরপর ষোড়শ শতকে রিফর্মেশন আন্দোলনের শুরু খ্রিস্টান জগতে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মার্টিন লুথার। তিনি যদিও সুদের ব্যবসাকে ভালো চোখে দেখতেন না, কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনও বিধান দেননি। তাই প্রটেস্টান্টরা সুদের ব্যবসা করতে শুরু করল। প্রটেস্টান্টদের মধ্যে শিক্ষিতের হার বেশি ছিল, তাদের মানবিক সম্পদ বেশি ছিল। তাই সুদের ব্যবসার জটিলতা তাদের কাছে বাধা হতে পারেনি। তাড়াতাড়ি তারা সুদের ব্যবসায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করল। 

কিন্তু এর ফলে সুদের কারবারের বাজারে ইহুদি এবং প্রটেস্টান্টদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল। ইহুদিদের এই বাজারে একাধিপত্যর দিন শেষ হল। এই প্রতিযোগিতা ক্রমে আর্থিক ক্ষেত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করল। ব্যাকার এবং প্যাস্কেলি তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে জার্মানির যে সব শহর প্রটেস্টান্ট অধ্যুষিত ছিল সেখানে ইহুদি বিদ্বেষ বেশি ছিল। তুলনায় ক্যাথলিক অধ্যুষিত শহরগুলিতে ইহুদি বিদ্বেষ অনেক কম ছিল। আমরা ইউরোপের ইতিহাস খুঁজলে দেখব যে সব দেশে প্রটেস্টান্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সে সব দেশে ইহুদি বিদ্বেষ তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। এর কারণ মূলত সুদের ব্যবসা নিয়ে প্রটেস্টান্ট মহাজন এবং ইহুদি মহাজনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এই ইহুদি বিদ্বেষ কালক্রমে ইহুদি নিধনে রূপান্তরিত হয়। যার চরম অমানবিক রূপ দেখা গেছিল নাৎসি জার্মানিতে। এই ইহুদি নিধনের পেছনে একটা আর্থিক হিসাবনিকাশ ছিল বলে অনেকের ধারণা। ইহুদিদের নিধন করতে পারলে তাদের থেকে নেওয়া ঋণ আর শোধ করতে হবে না। ইহুদি বিদ্বেষের এই আগুন থেকে পরিত্রাণ পেতেই ইহুদিরা তাদের জন্য পিতৃভূমি দাবি করেছিল। ইজরায়েল তৈরি হল। 

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদি বিদ্বেষ কমে গেল। তার কারণ সুদের কারবার ব্যক্তি মহাজনদের  হাত থেকে ব্যাংক এবং বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার হাতে চলে যায়। ইউরোপে ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রথম দিকে ইহুদিদের প্রাধান্য বজায় থাকলেও ধীরে ধীরে ব্যাংকের অংশীদারিত্ব যখন বাজারে কেনাবেচা হতে শুরু করল তখন স্বাভাবিকভাবে এই প্রাধান্য ক্ষীয়মাণ হয়ে গেল। 

কিন্তু পরবর্তীকালে পশ্চিমি ইহুদি পুঁজির মদতে এবং ইহুদিদের উন্নত মানব সম্পদের কল্যাণে ইজরায়েলে যে আর্থিক অগ্রগতি হল তাতে ইজরায়েলবাসী ইহুদিরা তাদের আরব প্রতিবেশীদের তুলনায় বলশালী হয়ে উঠল। তখন ইজরায়েলের ইহুদিরা তাদের আরব প্রতিবেশীদের আক্রমণ শুরু করল। অর্থনীতির উসকানি সেখানেও হাজির। কিন্তু সে আর এক কাহিনি।  

তিন

এক ইতিহাসবিদ বলেছেন, “যুদ্ধই রাষ্ট্র তৈরী করে”। কিন্তু যুদ্ধ লড়তে গেলে শুধু গোলাগুলি হলেই চলে না। অনুগত সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন। 

মধ্যযুগের ইউরোপে এবং অন্যান্য জায়গায় যুদ্ধ লড়ার জন্য ছোটো সৈন্যবাহিনী ব্যবহার করা হত। এই সৈন্যবাহিনী মূলত ভাড়াটে সৈনিকদের দিয়ে তৈরি হত। এই ভাড়াটে সৈন্যদের পারিশ্রমিক হিসাবে বরাদ্দ ছিল লুঠের বখরা। ক্রমে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন হল। সৈন্যবাহিনীর বহর বাড়ল। প্রচুর সংখ্যায় দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হতে লাগল। পেশাদারি সৈনিক নিয়োগ শুরু হল। উনিশ শতকের গোড়ায় ‘যুদ্ধের শিল্পকরণ’ সম্পন্ন হল। আমূল বদলে গেল যুদ্ধের অস্ত্র, সংযোগ ব্যবস্থা, যানবাহন। প্রয়োজন হল যুদ্ধক্ষেত্রে বিরাট সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করার। একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে ১৮৭৫ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপের দেশগুলিতে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে সৈন্যবাহিনীর আয়তন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। 

আলিসিনা, রিখ এবং রিবনি তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখেছেন এই বিশাল সৈন্যবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রকে বিভিন্ন কৌশল নিতে হয়েছে। এই সৈনিকদের কাছে রাষ্ট্রকে বাঞ্ছিত এবং আকাঙ্ক্ষিত করে তোলার চেষ্টা সবসময় জারি থেকেছে। রাষ্ট্র মূলত সর্বজনীন ব্যবহার্য সামগ্রীর জোগান দিয়ে এবং জাতীয়তাবোধ সঞ্চারের বিভিন্ন পন্থা নিয়ে রাষ্ট্রকে সৈন্যদের কাছে বাঞ্ছিত করে তোলার চেষ্টা করেছে। এই জাতীয়তাবোধ সঞ্চারের চেষ্টা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে এক সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধে অভিষিক্ত করার চেষ্টার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র সৈনিকদের জন্য নয়, দেশের সাধারণ জনগণের সবার জন্য। দেখা গেছে যে উনিশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সরকারি ব্যয়ের বহর তেমন বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু ব্যয়ের বিন্যাসে পরিবর্তন দেখা গেছে। সরকারি ব্যয়ের সিংহভাগ প্রতিরক্ষা খাত থেকে সর্বজনীন ব্যবহার্য সামগ্রীর খাতে খরচ হয়েছে। যুদ্ধের সময় দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের সরকার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এগুলির লক্ষ্য ছিল জনসাধারণকে তুষ্ট করে তাদের আনুগত্য আদায় করা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ গণ-আবাস নির্মাণ এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঢালাও ঘোষণা করেছিলেন। এক জননায়কের ঘোষণা শোনা যায় যে, যদি না আপামর ব্রিটিশ জনসাধারণকে বোঝান যায় যে ব্রিটিশ সরকার শত্রুদেশের সরকারের থেকে বেশি কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখে—  যুদ্ধের সময়ে এবং যুদ্ধের পরেও — ব্রিটেনের জয়ের আশা ক্ষীণ হয়ে যাবে। নাৎসিরা প্রচার করত যে জার্মানি সর্ব বৃহৎ কল্যাণময় রাষ্ট্র হবে। 

এই অকাতরে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি সুফল দিয়েছিল। দেখা গেছে আমেরিকার যে সব অঞ্চলে ১৯৩০-এর দশকে সরকারি কল্যাণকর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল সেই সব অঞ্চলের জনগণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে বেশি সমর্থন করেছিল।

চার

জাতীয়তাবাদ নির্মাণ এবং পরিপোষণে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখানে সেই ভূমিকার কতকগুলি দিক সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে আলোচনা করা হল। কিন্তু আরও অনেক দিক আছে। তবে মূল কথা হল, অর্থনীতির লোকজন জাতীয়তাবাদকে এক ধরনের বিনিয়োগ হিসাবে দেখে। জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন সমস্যা তাঁরা বিশ্লেষণ করেন এই বিনিয়োগের মুনাফার বণ্টনের সমস্যা হিসাবে। সেটাই জাতীয়তাবাদের গূঢ় বাস্তবতা।       

ঋণস্বীকার :

১) ব্রেটন, এ : ‘ইকনমিক্স অফ ন্যাশনালিজম’, জার্নাল অফ পলিটিকাল ইকনমি, অগস্ট, ১৯৬৪। 

২) ব্যাকার, এস এবং প্যাস্কেলি, ল : ‘রিলিজিয়ন, ডিভিশন অফ লেবার এন্ড কনফ্লিক্ট : আন্টি-সেমিটিজম ইন জার্মানি ওভার ৬০০ ইয়ার’, আমেরিকান ইকনমিক রিভিউ, ১০৯ (৫), ২০১৯।

৩) এলিসিনা, এ, রিখ, বি এবং রিবনি, এ : ‘নেশন-বিল্ডিং, ন্যাশনালিজম এন্ড ওয়ার’, জার্নাল অফ ইকনমিক গ্রোথ, ২৫, ২০২০।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান