জাতীয়তাবাদের দ্বৈত ধারণা

প্রভাত পট্টনায়েক

(অনুবাদ : সাহাবুদ্দিন)

[জেএনইউ আয়োজিত জাতীয়তাবাদ বক্তৃতামালায় ৯ মার্চ, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রদত্ত বক্তৃতা ‘Two Concepts of Nationalism’ শিরোনামে প্রবন্ধাকারে প্রকাশ হয়। অনূদিত প্রবন্ধ ইংরাজি প্রবন্ধের ভাষান্তরিত রূপ।]

ইদানীং নানান স্থানে পরিভ্রমণ আমার বেশ বেড়ে গেছে। তবে যেখানেই যাচ্ছি সর্বত্রই আমার প্রতি মানুষের দৃষ্টি পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ আমার জেএনইউ-সংযোগ। এর নেপথ্য-কারণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর এনডিএ সরকারের আক্রমণের বিরুদ্ধে জেএনইউ-এর লাগাতার প্রতিবাদ। আজকের সভা অবশ্যই সেই প্রতিবাদ তথা প্রতিরোধের স্বপক্ষে এক উজ্জ্বল নজির, যার শরিক হিসেবে একজন আমন্ত্রিত বক্তার আসনে বসে জাতীয়তাবাদ নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতার্থ। জেএনইউ-তে দীর্ঘ সময়-পরিক্রমায় আমি চার হাজার ক্লাসরুম লেকচার দিলেও আজকের এই বক্তৃতার অভিজ্ঞতা আমার কাছে ব্যতিক্রমী ও অনন্য।  

সাধারণত ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটিকে একরৈখিকভাবে দেখার একটা রীতি আছে, যা অবশ্যই একটা ভ্রান্ত আঙ্গিক। হিটলারের চোখে যা জাতীয়তাবাদ, আর গান্ধির দেখানো জাতীয়তাবাদ এক নয়, এবং তাদের মধ্যের পার্থক্যের দিকটা আমরা বিভিন্ন লেখালেখিতে তুলে ধরলেও ব্যবহারিক পরিসরে তা অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ একটা আমল পায় না। বস্তুত, ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী আন্দোলনের ধারা বেয়ে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের ধারণা আর ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা পৃথক আদল খুঁজে নিয়েছিল। ইউরোপে ‘জাতি’, ‘জাতি-রাষ্ট্র’, আর ‘জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে চর্চার শুরু হল সপ্তদশ শতকে, ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তির মধ্য দিয়ে স্পেনীয় ও ডাচদের মধ্যে আশি বছরের যুদ্ধ এবং জার্মানদের সঙ্গে তিরিশ বছরের যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের অন্ততপক্ষে তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে বলে আমার মনে হয়। 

প্রথমত, এই জাতীয়তাবাদ সবসময় একটি প্রতিপক্ষ খাড়া করে তাকে শত্রু হিসেবে দেগে দিতে চায়। যেমন, ইহুদি সর্বত্রই তার শত্রু, প্রোটেস্টান্ট-অধ্যুষিত উত্তর ইউরোপের কাছে শত্রু ক্যাথলিকরা, আবার ক্যাথলিক-অধ্যুষিত দক্ষিণ ইউরোপের চোখে শত্রু প্রোটেস্টান্টরা। স্বভাবতই এই জাতীয়তাবাদ সর্বগ্রাহী (‘inclusive’) নয় , বরং সে দাঁড়িয়ে থাকে অপরত্বের ধারণার উপর।  

দ্বিতীয়ত, এই জাতীয়তাবাদের অঙ্কুর সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতায়। ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তির সময়ে অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে আয়ারল্যান্ড আক্রমণ এই সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতার প্রথম পদক্ষেপ। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও প্রভাব বিস্তারে ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ছিল প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এমনকি, ইউরোপীয় জাতিগুলি যখন নিজেদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে, তখনও সারা বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ স্থাপনে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত ছিল। যেমন, দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকি লড়াই ছিল ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে। আসলে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তার উদ্ভবের গোড়া থেকেই।  

তৃতীয়ত, আমার মনে হয়, এই জাতীয়তাবাদ জাতিকে রাখে জনতার ঊর্ধ্বে। জনগণের জীবন যাপনের মান তথা জনতার সার্বিক অবস্থা অপেক্ষা তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় জাতীয় সম্মান ও সম্পদ। এই দর্শনের মূলে আছে একটি বাণিজ্যমুখী প্রবণতা, যা যেকোনও মূল্যে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে সম্পদ কুক্ষিগত করাকে নৈতিকভাবে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস তার কাছে ধ্রুপদী অর্থনীতির পাঠ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই জাতীয়তাবাদ বিভিন্নপ্রকার বুর্জোয়া চিন্তাকাঠামোর সঙ্গে সাযুজ্য রাখে ।  

আডাম স্মিথের স্বনামখ্যাত তত্ত্ব (যার পোশাকি নাম ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’)-তে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে, কিন্তু যেটা বলা হয়নি তা হল, সেই বর্ধিত সম্পদকে জনগণের (বিশেষত মেহনতি মানুষের) কল্যাণে কাজে লাগানোর কথা। অর্থাৎ জনতার ঊর্ধ্বে সেখানে স্থান পেয়েছে জাতি। স্মিথ ‘জাতি’-সংক্রান্ত বাণিজ্যিক ধারণা নিয়ে দ্বিমত পোষণ না করলেও দ্বিমত পোষণ করেন ‘সম্পদ’-এর ধারণা নিয়ে। প্রথাগত বাণিজ্যিক প্রবণতা ‘সম্পদ’ বলতে বোঝে সোনা-রুপো গচ্ছিত করাকে, কিন্তু স্মিথ সেই গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে মনে করেন জাতীয় সম্পদ হল জাতীয় পুঁজি (‘capital stock of the nation’)। কিন্তু সেই পুঁজি কোনোভাবেই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কল্যাণের স্বার্থে কাজে লাগানোর কোনও দাবি স্মিথের তত্ত্বে ওঠেনি। অপর একজন প্রখ্যাত ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর তত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষেরা থেকে যায় ন্যূনতম পারিশ্রমিকের কোটায়। তাতে অবশ্য জাতীয় পুঁজির বর্ধিতকরণে কোনও কমতি হয় না। বরং সেই বর্ধিতকরণ চলতেই থাকে, যা কাঙ্ক্ষিত হিসেবেই গণ্য হয়।  

প্রকৃতপক্ষে, উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে করে তুলেছে উগ্রতা ও অতিরঞ্জনে আচ্ছন্ন। আসলে যে সমস্ত দেশ ইতিহাসে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে অপেক্ষাকৃত দেরিতে আত্মপ্রকাশ করেছে, জার্মানি তার অন্যতম ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত। স্বভাবতই সারা পৃথিবী যখন ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ, ইত্যাদি জাতিগুলির ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকার তখন জার্মানি অনেকটাই সেই বিশ্বব্যাপী আগ্রাসনের ইঁদুর দৌড় থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। কাজেই জার্মানরা যে জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরল তা হল  আগ্রাসী, উগ্র জাতীয়তাবাদ। এই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ (যার উপর ভর করে জার্মানি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল) অর্থনৈতিক স্বার্থ তথা লগ্নিকৃত পুঁজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর সেই অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ন্ত্রিত হয় লগ্নির দৌড়ে এগিয়ে থাকা কতিপয় গোষ্ঠীর (‘financial oligarchy’) হাতে, যা পুঁজিবাদে প্রকটভাবে দেখা যায়। ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এই অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের দখলদার গোষ্ঠীগুলির আগ্রাসী প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।  

অর্থনৈতিক পুঁজির উপর আলোকপাতকারী প্রখ্যাত গণতান্ত্রিক সমাজবাদী লেখক রুডলফ হিলফার্ডিং বলছেন, লগ্নি-সংক্রান্ত পুঁজিতত্ত্ব প্রকারান্তরে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকেই বাড়তি অক্সিজেন জোগায়, এবং তার গৌরব-গাথা রচনা করে। জাতীয়তাবাদের এই গৌরব-গাথাকে সুচারুভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস ‘All Quiet on the Western Front’-এ, যা হয়তো আপনারা পড়ে থাকতে পারেন। এই ফোলানো-ফাঁপানো, জাতীয়তাবাদের উগ্র আতিশয্য তীব্ররূপে গৌরবান্বিত হয় যুদ্ধের মাধ্যমে, এবং ফ্যাসিবাদের ছত্রছায়ায় তা ডালপালা ছড়ায়। এক কথায়, ফ্যাসিবাদ এই ফোলানো-ফাঁপানো জাতীয়তাবাদের প্রশ্রয়দাতা। 

ফোলানো-ফাঁপানো আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ বুর্জোয়া চরিত্রের অধিকারী (আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে অলিভার ক্রমওয়েল ব্রিটিশ বুর্জোয়া বিপ্লবেরই নেতা ছিলেন।)। আর এই প্রকার জাতীয়তাবাদ প্রথম পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ছিল বাণিজ্যিক পুঁজি (‘mercantile capitalism’)-এর সঙ্গে, দ্বিতীয় পর্যায়ে শিল্পায়নাশ্রিত পুঁজি (‘industrial capitalism’)-এর সঙ্গে, এবং বিশ শতকে ফ্যাসিবাদের ছত্রছায়ায় (যখন সে তার আগ্রাসনের শিখর স্পর্শ করল), তখন সে সংযুক্ত হল লগ্নিকৃত পুঁজি (‘finance capitalism’)-র সঙ্গে। বিশ শতকে এসে অবশ্য ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ গভীর প্রভাব ফেলল প্রগতিশীল চিন্তাধারার উপরেও। মূলত এই কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে প্রগতিশীল মতামত জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শুরু করল, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটি জাতীয়তাবাদ-অতিক্রমকারী সংঘ হিসেবে সমর্থন করতে লাগল, যদিও এই সংঘের উপরেও কর্তৃত্ব করেছে লগ্নিকৃত পুঁজি (‘finance capital’), যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সমগ্র ইউরোপে কঠোরভাবে কর্তৃত্ব কায়েম করতে সর্বদা ব্যগ্র থেকেছে। লগ্নিকৃত পুঁজি-কেন্দ্রিক এই চিন্তাকাঠামো  জাতীয়তাবাদ বলতে কর্তৃত্ববাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদকেই বোঝে এবং ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ এই কর্তৃত্ববাদী, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর।  

এই প্রবণতা তথা অভিমত অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ। ভারতের মতো দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে জাতীয়তাবাদ সর্বগ্রাহী চরিত্রের, কারণ তার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তিরূপে।  

এই সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের বিকাশ তখনই সম্ভব যখন সারা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকে। এই জাতীয়চেতনার নেপথ্যে থাকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য, আর তা হল এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি, যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষ নিজেকে তার অংশ মনে করে। এই জাতীয় চেতনায় ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের মতো অপরত্বের বোধ থেকে শত্রু খাড়া করার প্রবণতা নেই। আর এই কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে প্রগতিশীল চিন্তার পরিসরে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটিকে দক্ষিণপন্থী মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে একটি কদর্য শব্দরূপে দেখা হলেও ভারতের মতো দেশে তা হয় না। বস্তুত, আমাদের জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী একটি সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদ।  

একইসঙ্গে আমাদের জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদের প্রতিও সহানুভূতিশীল। ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রামে শামিল পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে চরিত্রগতভাবে সংহতির সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে বর্জন তো করেই না, বরং মর্যাদার সঙ্গে বৈধতা ও মান্যতা দেয়। বস্তুত, বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিতা-বিরোধী সংগ্রামের অংশ রূপে তাদেরকে গণ্য করা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।  

আমার চোখে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল, এই জাতীয়তাবাদ দেশকে দেশের মানুষের ঊর্ধ্বে রাখে না। এ ক্ষেত্রে যে ধ্রুপদী বক্তব্য মনে পড়ে তা অবশ্যই গান্ধির, যিনি স্বাধীনতার সারবত্তা বলতে বুঝতেন তাকেই যা দেশের প্রতিটি মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দেয়। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূল অভিমুখ মানুষ তথা মানুষের কল্যাণ। সেখানে দেশের মানুষের ঊর্ধ্বে দেশ বলে কিছু নেই, বরং দেশের মানুষকে নিয়েই দেশ।  

ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ে ইউরোপীয় আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বাড়বাড়ন্ত,  যার ফোলানো-ফাঁপানো রূপের সঙ্গে আমাদের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদের আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক তফাত আছে। শুধু ভারত নয়, তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের ধারণা বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বগ্রাহী হবার লক্ষ্যে দেশের মানুষকে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ছাতার তলায় আনতে এই জাতীয়তাবাদের তরফে একটি সামাজিক চুক্তির প্রয়োজন অনুভূত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রিডম চার্টার, ভারতে করাচি কংগ্রেসে নেওয়া সিদ্ধান্ত — এমনই সামাজিক চুক্তির উদাহরণ। এই প্রকার সামাজিকচুক্তির নমুনা পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতেও প্রচ্ছন্ন বা প্রকটভাবে আছে, যেখানে ঔপনিবেশিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নজির রয়েছে। 

এই আঙ্গিকের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল সর্বগ্রাহিতা, গণতন্ত্র ও নাগরিক সাম্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সরকার গঠনে প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের এজেন্ডা গৃহীত হল; আর সেই এজেন্ডাতে থাকল আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন — বিচারবিভাগীয় সাম্য প্রতিষ্ঠা, সেকিউলারিজমের আদর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠন (যেখানে কোনও রাষ্ট্রীয় ধর্ম থাকবে না), মৃত্যুদণ্ডের মতো চরম শাস্তির উচ্ছেদ ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, এগুলির অনেক কিছুই আজও এ দেশ পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। যেমন, মৃত্যুদণ্ড আজও এ দেশে উচ্ছেদ না হওয়ায় আফজল গুরু এবং ইয়াকুব মেমনের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে জেএন ইউ-এর ছাত্র আন্দোলনের উপর আক্রমণ বৈধতা পেয়ে যায়। করাচি কংগ্রেসে সবার জন্য অবৈতনিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হয়। অর্থাৎ সবদিক থেকেই করাচি কংগ্রেস ছিল একটি চার্টার, একটি সামাজিক চুক্তির ভিত্তি। আর সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় চেতনা তথা জাতীয়তাবোধ, যা বিকাশের নিজস্ব পথ খুঁজে পেয়েছে আমাদের সংবিধানে।  

সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা পেলাম সেই জনগণকে যারা জাতীয় চেতনায় দীক্ষিত হয়ে ‘ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র’ (‘colonial state’)-এর পরিবর্তে এমন একটি ‘নেশন-স্টেট’ বা ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর জন্ম দিতে চাইল, যা ইউরোপীয় আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ‘নেশন স্টেট’ থেকে আলাদা (যার কথা আগেই বলেছি)।  

অবশ্য তার মানে এই নয় যে আমি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গৌরব-গাথা রচনা করতে চাইছি। এমন নয় যে আমাদের জাতীয়তাবাদ গ্রিকদেবতা জিউস (zeus)-এর মাথা থেকে যেমন প্রজ্ঞার ঝরনার মতো গ্রিকদেবী মিনার্ভা (Minerva) বেরিয়ে এসেছিলেন, সেভাবে হঠাৎ করে অপাপবিদ্ধভাবে জন্মলাভ করেছিল। এ কথা মানতেই হবে, আমাদের জাতীয়তাবাদে বুর্জোয়া মতাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তার জন্মলগ্ন থেকেই। ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়আন্দোলনে নানান শ্রেণির অংশগ্রহণেই তা পরিষ্কার। এবং কখনও কখনও তা উগ্র জাতীয়তাবাদের উপাদানে সংক্রমিতও হয়েছে। তা সত্ত্বেও বলব, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তার চরিত্রগত দিক থেকে ইউরোপীয় উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে আলাদা।  

অবশ্য, সূচনা পর্ব থেকেই এই সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের অন্দরেই অনেক বিচ্যুতি ছিল, যা তার শত্রু হিসেবে কাজ করেছে। ধরা যাক সাম্যের কথা। আইনের চোখে সাম্য কিংবা ভোটাধিকারে সর্বজনীন সাম্যের ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই মুখোমুখি হব এ দেশের যুগান্তলালিত জাতিভেদের অভিশাপের। হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশে যে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য বিরাজ করছে তার আবহে দাঁড়িয়ে একজন দলিতের তরফে একজন ব্রাহ্মণের সমান অধিকারের কথা বলা রীতিমতো বিপ্লবাত্মক  হিসেবে চিহ্নিত হত। উল্লেখ্য, এমন সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছিল ১৯৩১-এ। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে ফ্রান্সে সর্বজনীন ভোটাধিকারের কথা প্রথম বলা হয় ১৯৪৫-এ, আর ভারতে তা ১৯৫২-তে বলবৎ হলেও তার স্বপ্ন দেখা হয় ১৯৩১-এ। নারীর ভোটাধিকারের কথা মাথায় রেখে সর্বজনীন ভোটাধিকারের পথে ব্রিটেন ১৯২৮-এ এগোলেও কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থেকেই যায় ।   

সর্বজনীন সাম্য ও ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে সরকার গঠনের ধারণা ভারতীয় পরম্পরায় অবশ্যই এক বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। আমি ওড়িশার এমন এক গ্রামে জন্মেছি যেখানে ব্রাহ্মণ জমিদারদের আধিপত্য ছিল, এবং আমার মনে আছে ১৯৫২ সালে যখন একজন দলিত তার ভোটাধিকারের প্রশ্নে একজন ব্রাহ্মণের সমান হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেল, তখন ব্রাহ্মণ জমিদারেরা কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। সুতরাং এটা একটি সত্তাগত পরিবর্তন, যার শুরু এ দেশের প্রথাসিদ্ধ রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের নিজেরই অন্দরে প্রোথিত জাতিভেদ নামক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে।  

জেএনইউ-এ ইতিহাস বিভাগে আমার অন্যতম সহকর্মী অধ্যাপক সুবিরা জয়সওয়াল তার্কিকতার পরিসরে আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর মতে হিন্দু ধর্মের ভিত্তিই হল জাতিভেদ। যতই পরিবর্তন আসুক, জাতিভেদ তার মূলে প্রোথিত রয়ে গেছে একইরকম ভাবে। এবং এটা ঘটনা যে আধুনিক ভারত জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করে উঠে এলেও রক্ষণশীল হিন্দু ভারত এই লড়াইকে অভিসম্পাতরূপেই দেখেছে।  

অনেকে অবশ্য ভারতের একটি সমতাবাদী প্রগতিশীল পরম্পরার কথাও বলেন। তেমন একটি ধারার অন্তঃস্রোত ছিল ঠিকই, কিন্তু মূল ধারা অবশ্যই জাতিভেদকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়েছে, যা আসলে বৈষম্যমূলক। তাই আধুনিক ভারত যে মূলত চিরায়ত বৈষম্যমূলক রক্ষণশীল ভারতেরই এক প্রলম্বিত ছায়া — এই স্বতঃসিদ্ধ কথাটা বলার জন্য আমি এই বক্তৃতা দিচ্ছি না। বরং আধুনিক ভারতকে দেখা উচিত এমন একটি দেশ হিসেবে যেখানে মানুষ ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আপন শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়েছে এক জাতি গঠনের মহতী লক্ষ্যে।  

এই সর্বগ্রাহী, সমতাবাদী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল একটি বিশেষ শত্রু, যার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ তার অন্তর্লীন বৈষম্যের প্রবণতাতেই সমতাবাদী জাতীয়তাবাদ-দীপ্ত জাতি গঠনের প্রক্রিয়ার এক বিপ্রতীপ শক্তি। আদর্শ যদি হয় প্রগতিশীল, তাহলে পুঁজিবাদ স্পষ্টতই তার অনুকূল পথ নয়। গান্ধি, আম্বেদকর, নেহেরু — সকলেই অর্থনৈতিক সমাধানসূত্র খোঁজার ভিন্ন ভিন্ন অভিমত পোষণ করলেও একটি ব্যাপারে একমত যে পুঁজিবাদ কখনও ভারতবর্ষের সার্বিক সমস্যার সমাধান নয়। তাঁদের দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল যে পুঁজিবাদের বৈষম্যমূলক প্রবণতা নবজাগ্রত ভারতীয় জাতীয়চেতনার অন্তরায়।  

নেহেরুর যুগে এ দেশের পুঁজিবাদ নিয়ে একটি কথা বলা হয় যে সেই পুঁজিবাদ হল নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ, যেখানে পুঁজিবাদীদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে সেই সংযত পুঁজি না পারে দেশের ক্ষতি করতে, না পারে যথেচ্ছভাবে তার আগ্রাসী থাবা বসাতে।  

কিন্তু এই ধারণা ভ্রান্ত; এবং নব্য-উদারীকরণের খোলা হাওয়ায় পুঁজিবাদের উপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ আজ উড়ে গেছে। আমরা জানি গত কয়েক বছরে বৈষম্য নাটকীয়ভাবে বেড়েছে  এবং কর্পোরেট লগ্নির গোষ্ঠীগত আধিপত্য তৈরি হয়েছে, যা অর্থনৈতিক লগ্নির বিশ্বায়নের সঙ্গে অনেক বেশি করে সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতি একটি সংহত এককরূপে অনেকটাই উদাসীন। আমাদের দেশের কর্পোরেট গোষ্ঠী অন্যদেশে  কোম্পানি কিনছে, ঠিক যেমন উন্নত দেশগুলির কর্পোরেট গোষ্ঠী আমাদের দেশের এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক কোম্পানিকে কিনে নিচ্ছে। এই কর্পোরেট লগ্নির গোষ্ঠীগত আধিপত্য ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রধান বিরুদ্ধ শক্তি। কারণ, এই প্রকার জাতীয়তাবাদ নব্য-উদারীকরণের সমার্থক যা কিছু, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।  

দুটি বিষয় সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের বিরোধী। একদিকে গতানুগতিক হিন্দু সমাজের অন্তর্লীন শক্তি (তা সে স্বীকার করুক বা না করুক) জাতিভেদকে প্রশ্রয় দেয়, অন্যদিকে কর্পোরেট গোষ্ঠীগত আধিপত্য নিয়ে সে সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের মূলে আঘাত করে। এক্ষেত্রে একটি সহজ কৌশল অবলম্বন করে সে সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের ধারণাকেই মুছে দিতে চায়। কৌশলটি হল, গণতান্ত্রিক সমতাবাদী জাতীয়তাবাদের জায়গায় একটি ফোলানো-ফাঁপানো, উগ্র আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে আমদানি করা এবং সমতাবাদী জাতীয়তাবাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। আর এই কারণেই আমি বলছি যে জাতীয়তাবাদের বিকল্প ধারণাগুলির মধ্যে পার্থক্য করাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। গতকাল আমি কাগজে দেখলাম অরুণ জেটলি রাহুল গান্ধিকে অভিযুক্ত করেছেন এই যুক্তিতে যে তাঁর পিতা ও পিতামহ জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি জেএনইউ-এর তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদ বিরোধী’-দের সঙ্গে মাখামাখি করছেন। কিন্তু বাস্তব হল, নেহেরু জাতীয়তাবাদ বলতে যা বুঝতেন আর যে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে রাহুল গান্ধিকে জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বলা হচ্ছে তা সমার্থক নয়।  

অন্যভাবে বললে বলতে হয়, একটি প্রতারণার আবহ তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সর্বগ্রাহী, সমতাবাদী, গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের স্থলে সুকৌশলে উগ্র জাতীয়তাবাদকে আমদানি করা যায়। এখানে যেটা নৈতিকতার প্রশ্ন তা হল, প্রথম প্রকার জাতীয়তাবাদ জনমানসে প্রোথিত থাকলেও আগ্রাসী উগ্র জাতীয়তাবাদ তাকে হাইজ্যাক করতে দ্বিধা করে না। এবং তখন দাবি করা হয় সরকার যে জাতীয়তাবাদকে হাজির করছে সেটাই যেন গান্ধির দেখানো জাতীয়তাবাদ, আর জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা যে জাতীয়তাবাদের কথা বলছে তা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।  

বস্তুত আপনাদের মনে পড়তে পারে, সদ্য-স্বাধীন ভারতের তরফে (এমনকি কংগ্রেসের অভ্যন্তর থেকেও) মারাত্মক চাপের বিরুদ্ধে গিয়ে গান্ধি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রাপ্য পঞ্চান্ন কোটি টাকা মিটিয়ে দিতে। সুতরাং গান্ধির জাতীয়তাবাদের ধারণা আর সরকারের হাজির করা জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কথার জাদু এখন সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যেতে। আমাদের উচিত এ বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়া।  

দ্বিতীয় যে বিষয়ের প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হল, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যখন সমতাবাদী সামাজিক চুক্তি তখন তার যথাযথ মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা কোথায়? কীভাবে নিশ্চিত হব যে সমতাবাদী সামাজিক চুক্তি সমাজের কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে কিংবা দেশের কর্তৃত্ববাদী এলাকার মানুষের হাতে লঙ্ঘিত হবে না? এর একটি সহজ উত্তর দিয়েছেন লেনিন। সেটা হল, নানা ভাষা নানা গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে কোনও জাতিগোষ্ঠী বঞ্চিত বোধ করলে তার অধিকার থাকা প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার। যদি কোনও জাতি বা ভাষাগোষ্ঠী মনে করে যে সমতাবাদী চুক্তি লঙ্ঘিত হচ্ছে কর্তৃত্ববাদীদের হাতে, তাহলে সংযুক্ত ইউনিয়ন থেকে তার বেরিয়ে যাবার অধিকার থাকলে কর্তৃত্ববাদীরা সেই চুক্তি-লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে।  

বর্তমানে ভারতে অবশ্য এই ধরনের অধিকারের কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া হয়নি। আর সে কারণেই সমতাবাদী চুক্তি লঙ্ঘনের প্রশ্ন উঠলে সে বিষয়ে আলোচনার পরিসর খোলা থাকা জরুরি। অন্য কথায়, মত প্রকাশের একটি উন্মুক্ত পরিসর থাকা দরকার যার মাধ্যমে দেশের মানুষ খোলাখুলিভাবে সমতাবাদী চুক্তি (যার উপর ভিত্তি করে  দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর) লঙ্ঘন নিয়ে আলোচনা করতে পারে।  

এবং এমতাবস্থায় এসব বিষয়কে তুলে ধরাকে যদি জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বলা হয়, তাহলে তা হবে সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যাওয়া। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের একটি বৈশিষ্ট্যই হল, কোনও বঞ্চিত গোষ্ঠীর প্রতি নিপীড়ন কিংবা এই নিপীড়নের কারণে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়া নিয়ে কথা বলাকে জাতীয়তাবাদ-বিরোধী হিসেবে দেগে না দেওয়া। এই ধরনের বিষয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ না-থাকাটা (যা সামরিক কার্যকলাপ অথবা সেই কার্যকলাপে প্ররোচনা দান থেকে আলাদা) অবশ্যই সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদের চোখে  আপত্তিকর।  

বস্তুত, এটা কোনও অন্তঃসারশূন্য আদর্শ নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইনগত সীমালঙ্ঘন সত্ত্বেও (যেমন, আমার মতে শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লার গ্রেপ্তারি) অতীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি সহিষ্ণুতা ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,  বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতির ব্যাপারটা এ দেশের সর্ববৃহৎ কম্যুনিস্ট পার্টি সিপিআই(এম)-এর কর্মসূচির মধ্যেই ছিল দীর্ঘকাল ব্যাপী। এই ধরনের কর্মসূচির পরিবর্তন হয়েছে অনেক পরে সত্তরের দশকে এসে। এবং সেটাও হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কায়, জাতীয়তাবাদ-বিরোধী দাবি হিসেবে তাকে দেখার প্রবণতা থেকে নয়। এই কারণেই জ্যোতি বসু যখন পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী হলেন ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯-এ, তখন বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তাঁর দল। তবু তখন কেউ বলেনি তাঁর দল জাতীয়তাবাদ-বিরোধী, এমনকি কেউ বলেনি যে তিনি জাতীয়তাবাদ-বিরোধী তাই উপমুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না।  

সমতাবাদী সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে জনতা থেকে জাতিতে পরিণত হবার প্রক্রিয়ায় সেই চুক্তি লঙ্ঘিত হলে যেমন অনেকেই তখন আওয়াজ তুলত, তেমনি সহিষ্ণুতার সঙ্গে সেই চুক্তির স্বীকৃতি ও তার গৃহীত হওয়া নিয়েও আওয়াজ তুলত। মোটের উপর ভারতে এই সব বিষয়ে একটা সহিষ্ণুতার বাতাবরণ ছিল। আর আজকের ভারতে সেখান থেকে সরে এসে আমরা নানান ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছি। কারণ, আমরা ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী, সর্বগ্রাহী জাতীয়তাবাদ থেকে সরে এসে ফোলানো-ফাঁপানো, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ নামক বিকল্প ধারণার দিকে ঝুঁকছি।  

ফোলানো-ফাঁপানো, উগ্র জাতীয়তাবাদের ধারণা আমার কাছে আসলে কর্পোরেট শক্তি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাত, যা বর্তমানে এ দেশকে শাসন করছে। এই আঁতাত ব্যবহারিক দিক থেকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ, কারণ, একবার যদি ‘জাতি’-র ধারণাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, উগ্রতার সঙ্গে সংজ্ঞায়িত করা যায় তাহলে জনমানসে তার একটি বাসস্তবতা-বর্জিত, অধিবিদ্যাগত শিকড় গেড়ে দেওয়া যায়, যা জনতার ঊর্ধ্বে জায়গা করে নেয়। আর তখন ‘জাতীয়’ ধারণা বলতে সেটাই বোঝায় যা সরকার ঠিক করে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তখন বিবাহিতার তরফে স্বামীর মঙ্গলকামনায় কিংবা অবিবাহিতার তরফে মনের মতো স্বামীকামনায় সারাদিন উপোস থেকে চৌথ ব্রত পালন (karva chauth) হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদের চিহ্ন, আর গোমাংস ভক্ষণ হয়ে পড়ে জাতীয়তাবাদ-বিরোধী। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিষয়টিকে তখন নিজেদের সুবিধা মতো এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয় যে ‘জাতীয়তাবাদ’ আর হিন্দুধর্মাশ্রিত প্রথা হয়ে ওঠে সমার্থক। একইভাবে ধরে নেওয়া হয়, যারা ভারতকে মহান করার নামে যে তথাকথিত ‘ভারত নির্মাণ’ (‘Make in India’)-অভিযান তার বিরোধিতা করে, তারা সাচ্চা ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’। এক্ষেত্রে কর্পোরেট গোষ্ঠীর আধিপত্যের প্রতি আনুকূল্য দেখানো যেকোনও কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করাকেও ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, জনতার ঊর্ধ্বে জাতিকে রেখে ফোলানো-ফাঁপানো জাতীয়তাবাদের উগ্র আতিশয্য প্রকারান্তরে হয়ে ওঠে হিন্দুত্বের উপাদান ও কর্পোরেট স্বার্থের অনুকূল। আর এরই ফলশ্রুতিতে তা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে কর্পোরেট ও  সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্রমবর্ধমান আঁতাতের মারণ-আদর্শ হয়ে।  

এটা আমাদের নিয়ে যায় চিন্তার বন্ধ্যাত্বের দিকে। যেকোনও চিন্তা প্রশ্ন উত্থাপনের পরিসরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর সেই প্রশ্নগুলির উত্তর হবে বহুমাত্রিক। কাজেই, স্থান-কাল ব্যতিরেকে যেকোনও সমাজে, মানুষের বহুমাত্রিক মতপ্রকাশ তথা ভিন্নস্বরের সহাবস্থান জরুরি। সরকারের তরফে যা ‘গ্রহণযোগ্য’ মত হিসেবে মান্যতা পায়, তার বিরুদ্ধ-মতকে ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’-এর অজুহাত খাড়া করে তাকে খর্ব করার অর্থ মানবজমিনে এমন নুড়ি-পাথর বিছিয়ে দেওয়া যাতে তার স্বকীয় চিন্তার উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। 

চিন্তা করার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার এই অপচেষ্টা অত্যন্ত সিরিয়াস একটি বিষয়, এবং এটা এখন আর আশ্চর্যের নয় যে এ দেশের সর্বাপেক্ষা অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠানগুলি (তা সে ফিল্ম বা টেলিভিশন ইন্সটিটিউট হোক, কিংবা বরোদার এম এস ইউনিভার্সিটি হোক, কিংবা জেএনইউ, বা হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, কিংবা যাদবপুর ইউনিভার্সিটি হোক) বর্তমানে আক্রমণের শিকার।  

এই প্রতিষ্ঠানগুলির আর একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেটি হল, এগুলি সবই জনগণের অর্থানুকূল্যে চলে। আপনারা কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী কন্ঠস্বর শুনতে পাবেন না। আমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের দোষ দিচ্ছি না, কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপচ্ছন্দকে বন্ধক রেখে যেহেতু তারা সীমাবদ্ধ থাকে শুধু পণ্যায়িত (comoditized) হবার পরিসরে, সেহেতু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিন্তনের ধ্বংসসাধনও একটি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়ে যায়। জনগণের অর্থানুকূল্যে চালিত হওয়ার ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান এখনও এই বাণিজ্যিকীকরণের সর্বনাশা গ্রাস থেকে দূরে আছে, যেখানে এখনও মুক্তচিন্তার পরিসরে নানান আলোচনা-সমালোচনার সঙ্গে বৌদ্ধিক উৎকর্ষের অনুরণন শোনা যায়। আর সেগুলিই এখন আক্রমণের লক্ষ্য।  

যে সরকার চিন্তনকে ধ্বংস করে চিন্তার বন্ধ্যাত্ব আনতে দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলিকেই ধ্বংস করে দেয়, সে সরকার প্রকারান্তরে নতুন নতুন চিন্তাসূত্র তথা মৌলিক ধ্যান-ধারণার জন্য দেশকে বিদেশের উপর নির্ভরশীল এক পরজীবী দেশে পরিণত করে। এটা এক চূড়ান্ত পরিহাস যে এই সরকার (যার নেপথ্য-শক্তি হিন্দুত্ব) জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলে! বস্তুত, সে উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে জাতীয়তাবাদের ধারণা ধার করার নামে পরজীবী হওয়াকেই বৈধতা দেয়। নতুন ধ্যান-ধারণার জন্য দেশের তরফে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরতাকে এই সরকার বৈধতা দেয় জাতীয়তাবাদের নামে!  

সুতরাং, জেএনইউ-তে আপনারা যে কাজে ব্রতী তা হল ফোলানো-ফাঁপানো উগ্র জাতীয়তাবাদের আতিশয্যের মুখোশ খুলে দেওয়া, চিন্তার স্বকীয়তাকে অক্ষুণ্ণ রাখা, তার্কিকতার যে পরম্পরা এখানে বহুদিন ধরে রয়েছে তাকে ধরে রাখা, এবং উৎকর্ষের সাধনায় নিয়োজিত থাকা। এগুলি সেই প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করে দেয় যা আমাদের জাতিসত্তা নির্মাণের ধারক যে সামাজিক চুক্তি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। আপনাদের সকলের সার্বিক সাফল্য কামনা করি। 

উল্লেখপঞ্জি ও টীকা : 

আকিল বিল্গ্রামি, ২০১৪, ‘সেকুলারিজম, আইডেন্টিটি এন্ড এনহান্সমেন্ট’, কেম্ব্রিজ, মাস : হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। 

প্রভাত পট্টনায়েক,  ‘ন্যাশনালিজম, হিন্দুত্ব, এন্ড দ্য এসল্ট অন থট’, দ্য মার্ক্সিস্ট, খণ্ড ৩২, নং ১, জানুয়ারি-মার্চ, ২০১৬।  

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান