জাতীয়তাবাদী চেতনার নিরিখে রাজনারায়ণ বসুর অবস্থান অথবা একটি অবান্তর টাইম ট্র্যাভেল

নীলাদ্রি নিয়োগী 

ধরুন আপনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন। কোয়াড্রিতে বসে সবান্ধব এবং স-সিগারেট রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করছেন। হঠাৎ কোনও এক অদৃশ্য টাইম মেশিনে চড়ে একেবারে উনিশ শতকে পৌঁছে গেলেন। দেখলেন, যেখানটায় বসে আছেন, সেটা লোকে হিন্দু কলেজ নামে চেনে। চারপাশে চোবা-চাপকান পরা কিছু মানুষ, যাদের দেখে আদৌ ছাত্র বলে মনে হচ্ছে না; বসে সিরিয়াস মুখ করে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভালো-মন্দ নিয়ে বহেস করছে। আর্টস লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে কোনও শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক মেইন বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির দিকে যখন যাচ্ছেন, তখনই আবার দলটা আচমকা হিন্দু আর ব্রাহ্ম দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে তীব্র বাদানুবাদ শুরু করে দিচ্ছে! ওই দেখতে পাচ্ছেন মধুসূদন দত্ত আস্তে-ধীরে কলেজ চত্বর ছেড়ে, পৈতৃক ধর্ম ছেড়ে, বিশপ কলেজপানে চলে যাচ্ছেন! দেখতে পেলেন সবার প্রিয় ডিরোজিও, নেশার ঘোরে অল্প টলায়মান, তদানীন্তন কিছু বুদ্ধিজীবীর সুমধুর ব্যবহারে ঈষৎ বিষণ্ণ মনে ছেড়ে যাচ্ছেন অতিপ্রিয় শিক্ষাঙ্গন… সুধী পাঠক, ধৈর্য হারাবেন না। সময়যান এখন আর আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। সে তার ইচ্ছামতো এগিয়ে-পিছিয়ে আপনার সামনে তুলে ধরতে চাইছে একটু অন্যরকম একটা ন্যারেটিভ। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলেন আপনি একটা জনসভায় (পরে জানবেন সেটা জাতীয় সভা ছিল) দাঁড়িয়ে আছেন! সভায় উপস্থিত সবাই খুব উদ্গ্রীব। ঘোষণা হল, এরপর বক্তৃতা দেবেনবিখ্যাত বাগ্মী শ্রী রাজনারায়ণ বসু। বক্তব্য বিষয় — ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’! ‘হাফ নকশাল’ পুরন্দর ভাটের মতো আপনিও যদি হাফ কিংবা ফুল এমনকি কোয়ার্টার বামমনস্কও হন, তাহলে নির্ঘাত নাক-চোখ-ভ্রূ কুঁচকে তৎক্ষণাৎ হিসাব করতে বসবেন — রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যেন কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? যখন মনে পড়বে, প্রতিষ্ঠার সালটা আপনার পৌঁছে যাওয়া কাল-এর চেয়ে কয়েক দশক দেরিতে, তখন আপনি হয়তো খানিকটা আগ্রহ বোধ করবেন।

বক্তৃতা শুরু হলে আপনি শুনবেন, শানিত যুক্তি পরম্পরা সাজিয়ে কীভাবে একটা দৃঢ় ভিত্তির ইমারত গড়ে তোলা যায়! হয়তো তাঁর অনেক পয়েন্টে আপনি মনে মনে কাউন্টার করবেন, কিন্তু তখনই আপনার এটাও মনে পড়ে যেতে বাধ্য যে আপনি এই মুহূর্তে একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নেই। ফলকথা, আপনার মাইন্ডসেট একটু ফ্লেক্সিবেল করে নিতেই হবে। ‘পরব্রহ্মের উপাসনাই হিন্দুধর্ম’ — এমন বাক্য দিয়ে যে বক্তৃতা শুরু, সেখানে উনিশ শতক সম্পর্কে মিনিমাম ধারণা থাকলেও আপনার মনে হতেই পারে যে ভদ্রলোক শুরুতেই এমন একটা সেলফ্ কন্ট্রাডিক্টারি কথা বলে ফেললেন! কিন্তু মন দিয়ে খানিকক্ষণ শোনার পর আপনি দেখবেন, মনের বেশ কিছু দ্বন্দ্ব, বক্তা-ভদ্রলোক নিপুণ ভাবে দূর করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথমে তিনি হিন্দু ধর্ম নিয়ে ‘অমূলক’ কিছু প্রচার খণ্ডন করবেন এক এক করে। যেমন — হিন্দুধর্ম পৌত্তলিকতা প্রধান ধর্ম, অদ্বৈতবাদাত্মক ধর্ম, হিন্দুধর্ম সন্ন্যাসধর্মের পোষকতা করে, কৃচ্ছ্রসাধনের সাহায্যে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেয় কিন্তু অনুতাপ সম্পর্কে এই ধর্ম নীরব, এমনকি ঈশ্বরকে পিতামাতার মর্যাদা দেয় না এই ধর্ম, সর্বোপরি নীরস ও জাতিভেদপ্রথা মান্য করে চলে হিন্দুধর্ম! প্রতিটি অপপ্রচারের উল্লেখ করে তিনি বেদ, পুরাণ ও নানান শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি কিংবা দৃষ্টান্ত তুলে এনে প্রতিযুক্তির সাহায্যে সেগুলিকে ধূলিসাৎ করবেন। প্রতিপক্ষের যাবতীয় অভিযোগ খণ্ডন করার পর তিনি এবার হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কিছু বলবেন। একুশ শতকের আপনি অবাক হয়ে শুনবেন, দেশ জুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলগুলো স্বীয় ধর্ম নিয়ে যে সকল আস্ফালন করে থাকে, তার চেয়ে কতটা আলাদা, সহনশীল এবং র‍্যাশনাল এই ভদ্রলোকের উত্থাপিত পয়েন্টগুলি। আপনি তাঁর সব যুক্তি মানতে নাও পারেন, কিন্তু সবটা শোনার পর আপনার একটিবারের জন্যও মনে হবে না যে একজন গোঁড়া ধর্মপ্রচারক খামোখা একটা প্রোপাগান্ডা বক্তৃতা দিয়ে আপনার সময় ও মন নষ্ট করে দিয়ে গেল।

বরং অনুকরণপ্রিয় বাঙালির ক্রমশ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলা দেখতে দেখতে এবং ধর্মান্ধ কিছু কিছু সংঘ-লিগ-সম্প্রদায়ের সেবকদের নির্বিচারে সব মানুষের ওপর ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস ইত্যাদিতে জারি করা ফতোয়া মানতে মানতে যুগপৎ ক্লান্ত ও বিরক্ত আপনি যখন শুনবেন প্রায় দুশো বছর আগে দাঁড়িয়ে রাজনারায়ণ বলছেন —

“আমরা ত রাজ্য বিষয়ে স্বাধীনতা ভ্রষ্ট হইয়াছি, আবার কি সামাজিক রীতি নীতি বিষয়েও কি স্বাধীনতা হারাইতে হইবে?… যদি আমরা এই রূপে সর্ব্ব প্রকারে পরাধীন হইয়া পড়ি, আর কি আমাদের উঠিবার শক্তি থাকিবে?… হিন্দুজাতি এইরূপে সর্ব্ব প্রকারে পরহস্তগত হইয়া কি একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যাবে?” (‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’, পৃষ্ঠা- ৫৭) 

তখন আপনার প্রথম মনে হবে যে তিনি শুধু নিজের ধর্মের মানুষের সংকটের কথা বলছেন না। আসলে তিনি সর্বভারতীয় একটা ক্রাইসিস উপলব্ধি করে তাঁর নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা থেকে প্রশ্নগুলি তুলছেন। যা তদানীন্তন পরাধীন ভারতে যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল, বর্তমানে প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণত বদলে গেলেও একই রকম প্রাসঙ্গিক। 

সময়যান এরপর আপনাকে নিয়ে যাবে ১৮৭৫ সালে। আপনি পৌঁছে গেলেন একটা আজব মেলায়। দেখলেন চারপাশে খুব জাঁকজমক। কলকাতার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তি সেখানে এসেছেন। শুধু তাই না, তাদের বাড়ির বিভিন্ন জিনিস ওই মেলায় প্রদর্শনের জন্য এনেছেন। নানারকম ফুল, ফল ও শিল্পকার্যও সেই মেলায় প্রদর্শিত হচ্ছে। কোথাও কবিতা পাঠ হচ্ছে তো কোথাও চলছে বক্তৃতা। আবার ব্যায়াম বা লাঠিখেলাও দেখতে পেলেন দিব্যি লোক টানছে! খোঁজ নিয়ে জানলেন এর নাম ‘হিন্দু মেলা’। কৌতূহলী হয়ে লোকমুখে এও জেনে নিলেন যে এই বছর মেলার সভাপতিত্ব করছেন আপনার পূর্বপরিচিত রাজনারায়ণবাবু। এতক্ষণে আপনি যথার্থই মানুষটির প্রতি আগ্রহ বোধ করছেন। আপনার মনোভাব বুঝে টাইম মেশিন আপনাকে ফের খানিকটা অতীতের এক সভায় নিয়ে যাবে। ফ্ল্যাশব্যাকে আপনি দেখবেন সেই একই ভদ্রলোক একটি বেশ খটোমটো শিরোনামে বক্তৃতা শুরু করেছেন। বিষয়টি হল — ‘শিক্ষিত বঙ্গবাসীগণের মধ্যে জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা সংস্থাপনের প্রস্তাব’। শুনতে শুনতে বুঝবেন, কতটা প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বলতে এসেছেন। পরে জানবেন, এই বক্তৃতায় যেসব প্রস্তাবনা তিনি দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই ‘হিন্দু মেলা’-র উৎপত্তি। কী কারণে এই সভার আয়োজন — বলে তিনি সলতে পাকানো শুরু করে এরপর চলে যাবেন প্রস্তাবিত মেলায় কী কী বিষয় থাকবে এবং কেন থাকবে, সেই আলোচনায়। সেখানে ব্যায়ামের উপযোগিতা যেমন তিনি ব্যাখ্যা করবেন, তেমনই আয়ুর্বেদিক ওষুধের উপকারিতাও যুক্তি সহকারে তুলে ধরবেন। মাতৃভাষার হয়ে সওয়ালের সপক্ষে বাংলায় চিঠি লেখা আর ভাষণ দেওয়ার জন্যও উৎসাহিত করবেন বঙ্গবাসীকে। এ ছাড়াও বাংলার নিজস্ব কিছু উৎসব (পয়লা বৈশাখ, ভাইফোঁটা), বাঙালি খাবার, বাংলা নাটক নিয়েও সুচিন্তিত মতামত দেবেন সেই ভাষণে। তবে ভাষণের শেষ পর্যায়ে এসে আপনি আবার অবাক হয়ে যেতে পারেন এটা শুনে, যখন বক্তা নিজের মুখেই বলবেন — এই প্রস্তাবনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল করা যেতে পারে। আপনার এতদিনের অভিজ্ঞতা তো আপনাকে শিখিয়েছে যে এই ধরনের ইস্তেহার, ডান-বাম নির্বিশেষে কতটা পাষাণপ্রতিম অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। সেখানে দুই শতক আগের একজন মানুষ, তাঁর ড্রিম প্রোজেক্ট নিয়েও কী চূড়ান্ত রকমের ফ্লেক্সিবল! আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নেশনের যে নানাবিধ পরিবর্তন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাতে করে আধুনিকমনস্ক একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি গোঁড়া থাকতে পারেন কীভাবে?

তবে এইরকম কিছু ভাষণ শুনেই রাজনারায়ণ বসু সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে চাইলে আপনি কিছুটা কনফিউজড হয়ে যেতে পারেন। একবার তাঁকে মনে হবে নিষ্ঠাবান, এমনকি গোঁড়া হিন্দু; পরক্ষণেই অন্য কোনও লেখা পড়ে বা বক্তৃতা শুনে মনে হতে পারে তিনি একজন প্রতিনিধিস্থানীয় ব্রাহ্ম! তাঁর কথায়, আচরণে এবং যাপনের মধ্যে রয়েছে আধুনিকতা আর রক্ষণশীলতার অদ্ভুত মেলবন্ধন। ইংরেজদের কিছু ভালো গুণাবলির উল্লেখ করে তিনি যেমন তাদের স্তুতি করেছেন আবার ক্ষেত্র বিশেষে কঠোর সমালোচনাও করতে ছাড়েননি। তবে তৎকালীন কর্মবিমুখ, অন্ধ অনুকরণপ্রিয় ও আত্মপ্রচারে সদাব্যস্ত বাঙালি নিয়ে তাঁর ক্ষোভ এবং অভিমান বোধহয় সবচেয়ে বেশি। ফলত বাঙালির চিরকালীন প্রথা অনুযায়ী মানুষটিকে নির্দিষ্ট কোনও ট্যাগ লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইলে আপনাকে ঠকতে হবে। বাঙালি জাতি নিয়ে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিয়ে, সর্বোপরি পরাধীন ভারতবর্ষের জনগণ সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন জানতে হলে আপনাকে তাঁর আরও কিছু উল্লেখযোগ্য বই অবশ্যই পড়ে ফেলতে হবে। ধীরে ধীরে আপনি বুঝতে শুরু করবেন, উনিশ শতকের বিস্মৃতপ্রায় এই জাতীয় মহানায়ককে নিয়ে আপনার জানবার ইচ্ছা প্রবলতর হয়ে উঠছে।

আগ্রহ চরম পর্যায়ে গেলে সময়যান আপনাকে প্রেসিডেন্সির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে এনে পৌঁছে দেবে। উইয়ে কাটা ‘সেকাল আর একাল’ হাতে পেয়ে এক নিশ্বাসে পড়তে শুরু করলে অচিরেই আপনি বুঝতে পারবেন যে; ‘সেকাল’-টা এখনও ঠিক সেকালের জায়গায় থাকলেও, ‘একাল’-টা আপনি যতটা বদলে গেছে ভেবে আহ্লাদে আমোদিত ছিলেন, দেখবেন, একালটাও যেন খুব বেশি বদলায়নি! মাঝে সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন; দেশভাগ পরবর্তী প্রাপ্ত খণ্ডিত স্বাধীনতা, নকশাল আমল, এমার্জেন্সি; মায় বিশ্বায়ন পেরিয়েও একাল যেন দুশো বছর আগেকার ‘একাল’ থেকে নিজেকে আমূল বদলে নিতে এখনও পারেনি। বিষয়টাকে লেখকের দূরদৃষ্টি নাকি বাঙালির অপরিবর্তনীয় ডিএনএ — কোন্ খোপে রাখবেন ভাবতে ভাবতেই আপনার চোখ বইটার একটা বিশেষ পাতায় আটকে যাবেই — 

“বাঙ্গালী জাতি অত্যন্ত অনুকরণ-প্রিয়; আমরা সকল বিষয়েই সাহেবদের অনুকরণ করিতে ভালবাসি। কিন্তু বিবেচনা করি না যে সে অনুকরণ আমাদের দেশের উপযোগী কি না, আর তদ্দ্বারা আমাদিগের দেশের প্রকৃত উপকার সাধিত হইবে কি না?” (‘সেকালআরএকাল, পৃষ্ঠা- ৫৭) 

নিজের পানে আর আপনার চারপাশে মনে মনে একবার চোখ বুলিয়ে যখনই আপনি লজ্জিত হবেন কিনা ভাবছেন, তখনই উপলব্ধি করবেন, অপ্রস্তুত হবার বিশেষ কোনও কারণ নেই। সেকালের এমত হ্যাংওভার আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছেন।

প্রায় গবেষকের নিষ্ঠায় এই গ্রন্থে রাজনারায়ণ সেকালেরও নিরিখে যে সেকাল, অর্থাৎ ইংরেজ আমলের শুরু থেকে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় পর্যন্ত যে কালপর্ব, তার সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন তৎপরবর্তী সময়ের। এই যে খুব অল্প সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও দুটি বা তিনটি প্রজন্মের মধ্যে মানসিকতার, আচার-ব্যবহারের অসেতুসম্ভব মেরুদূর পার্থক্য, তার পশ্চাতে রেনেসাঁসের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে — তা আপনি একুশ শতকে এসে জেনে গেছেন। সুতরাং খেলা ঘোরার খেলাটা আপনি যখন একটা দীর্ঘকালীন দূরত্বের সুবাদে অনায়াসেই পড়তে পারছেন, তখনও বইটির দুয়েকটি বিষয়ে আপনার খটকা লাগতে পারে। কী সেই বিষয়? 

আপনি জানেন পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিটি বড়ো ঘটনার অভিঘাত সাধারণত দ্বিমুখী হয়ে থাকে। সেখানে সদর্থক নানান পরিবর্তন যেমন পরিলক্ষিত হয়, নেতিবাচক দৃষ্টান্তও যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। আমাদের দেশে, বিশেষত বাংলায়, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে তদানীন্তন সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতায় নবজাগরণের উপজাত হিসেবে কিছু অপ্রতিবিধেয় প্রবণতার সূত্রপাত হয়েছিল। আপনার মনে হতে পারে, রেনেসাঁসের আবহে শিক্ষাপ্রাপ্ত, উদার ও আধুনিকমনস্ক ব্যক্তিত্বদের মনে স্বদেশপ্রেম ও স্বাজাত্যপ্রীতি যেমন জাগ্রত হয়েছিল, একইসঙ্গে কি সাম্প্রদায়িকতার বীজও বপন হয়েছিল সেই সময়? নাহলে রাজনারায়ণ বসুর মতো আলোকপ্রাপ্ত একজন, কীভাবে বাঙালির স্বাস্থ্যের ক্রমিক অবনতির কারণ হিসেবে গোদুগ্ধের অভাব এবং সেই অভাবের কারণ হিসেবে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের যথেচ্ছ গোমাংস ভক্ষণকে দায়ী করতে পারেন! অবশ্য পাশাপাশি তিনি খাদ্যে ভেজালের উল্লেখ এবং বাঙালির ক্রমবর্ধমান পানাসক্তির অভ্যাসকে দায়ী করেছেন। 

তবে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ নিয়মমাফিক মাতৃভাষা নিয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে করতে ও শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত আপনার নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে তাঁর ভাষা সম্পর্কিত আর্গুমেন্ট পড়ে। সাহিত্যে পাশ্চাত্যের হীনঅনুবাদ এবং কথোপকথনে বাংলার ভেতর ইংরাজি গুঁজে দেওয়ার প্রয়াসকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন তিনি। বস্তুত বঙ্কিম যে ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের কাছা খুলে দিয়েছিলেন, হুতোম যাদের মুখের সামনে আয়না ধরতে চেয়েছিলেন; রাজনারায়ণ বসুর নিশানাও ছিল সেই বকচ্ছপ বাঙালিই। শুধু কথোপকথনে হাস্যস্পদ ‘বাংরেজি’-ই নয়; তিনি ইংরাজিতে চিঠি লেখা ও ভাষণ দেবার যাথার্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। একজন বাঙালি আর এক বাঙালিকে কেন বাংলায় চিঠি লিখবে না কিংবা বাঙালি শ্রোতার সামনে কেন একজন বাঙালি বক্তা ইংরাজিতে বক্তৃতা দেবেন — এই ছিল তাঁর আপত্তির মূল জায়গা। আপনার মনে পড়বে, বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ দেখেছেন, শুনেছেন ঢের। তবে এখানে কিন্তু অন্য কোনও ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ নেই। তিনি যে সময়ের কথা লিখেছেন, সেই সময়ে বঙ্কিমী ‘বাবু’-রা স্বেচ্ছায় ইংরাজির গোঁজামিল দেওয়া বাংলায় কথা বলে নিজেদের অর্ধ-শিক্ষা জাহির করত। 

পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তন’-এর সাক্ষী আপনি। তাই ভালো করেই জানেন একটা কারখানার হওয়া-না হওয়ার গোপন পিচ্ছিল পথে একটা সরকারের পতনও ঘটে যেতে পারে। দেশীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং সরকারি, বেসরকারি চাকরির দুর্লভ বাজারে শিল্প কতটা প্রয়োজন — তাও আপনার অজানা নয়। ফলে যখন দেখবেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব আমাদের নিজস্ব শিল্প গড়ে তোলার জন্য সওয়াল করছেন, তখন চমৎকৃত হবেন বই-কি। পৃথিবীতে কোনও বিশুদ্ধ চাকুরি থাক বা না থাক, চাকুরি-প্রিয় গড়পড়তা বাঙালি সেকালেও এর বাইরে কিছু ভাবতে চাইতেন না, একালেও তাই। এখন নাহয় বিশ্বায়ন গোটা পৃথিবীকে একটা খোলা বাজারে পরিণত করেছে। দু-শতক আগে শিল্প ও বাণিজ্য তো সম্পূর্ণই আলাদা ছিল। ‘চপ’ এবং ‘কাশফুলের পাশবালিশ’-ও যে উৎকৃষ্ট শিল্প হতে পারে — এই ধারণা ছিল না বলেই সম্ভবত সেই সময় শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে এত মন্দা দেখা যায়। শিল্প বিপ্লব-উত্তর ইউরোপে অর্থনীতির এত উন্নতি, পক্ষান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশে কেবলমাত্র চাকরি নির্ভরতা — এই ফ্যালাসি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। হতাশা প্রকাশ করে তিনি লিখেছিলেন — 

“অনেকে বারিষ্টার অথবা সিবিলিয়ান হইবার জন্য বিলাতে যাইতেছেন, কিন্তু কয় জন সেখানে শিল্প অথবা যন্ত্রবিদ্যা শিখিতে যান? শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতি অমনোযোগ জন্য দিন দিন আমরা দীন হইয়া পড়িতেছি। ইংলন্ডের উপর আমাদিগের নির্ভর দিন দিন বাড়িতেছে। কাপড় পরিতে হইবে, ইংলন্ড হইতে কাপড় না আইলে আমরা পরিতে পাই না। ছুরি কাঁচি ব্যবহার করিতে হইবে, বিলাত হইতে প্রস্তুত না হইয়া আসিলে আমরা তাহা ব্যবহার করিতে পাই না। এমন কি, বিলাত হইতে লবণ না আসিলে আমরা আহার করিতে পাই না, দেশলাইটি পর্য্যন্ত বিলাত হইতে প্রস্তুত হইয়া না আসিলে, আমরা আগুন জ্বালিতে পাই না। দেশ হইতে কিছুই হইতেছে না। … এই সকল ভারি গভীর বিষয়, এ সকল বিষয়ে অতি প্রগাঢ় চিন্তা আবশ্যক। কিসে আমাদের জাতিত্ব থাকে, কিসে যায়, তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আমাদের চলা আবশ্যক, নতুবা অত্যন্ত অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা।” (‘সেকালআরএকাল, পৃষ্ঠা- ৫৫-৫৬) 

বইটি পড়তে পড়তে আপনি ইতিমধ্যে দেশ নিয়ে, জাতি নিয়ে লেখকের ‘প্রগাঢ় চিন্তা’-র পরিচয় পেয়ে গেছেন। বাস্তবিকই, তাঁর প্রাগুক্ত আশঙ্কা-সকল যে অমূলক ছিল না, টাইম মেশিনের কল্যাণে আজ তা আপনার জানা। জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার মূল যে প্যারামিটারগুলি, অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানান বিষয়ে রাজনারায়ণ বসুর সুচিন্তিত মূল্যায়ন, মতামত ও পরামর্শ ছিল। দেশের মানুষের নানান সংকীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা যেমন তিনি দেখিয়েছেন, তেমনই আমাদের মধ্যে যে প্রভূত সম্ভাবনা ছিল, সেটাও একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান থাকার কারণে এবং এনলাইটেনমেন্টের প্রত্যক্ষ প্রসাদ প্রাপ্তির সৌজন্যে তাঁর কথায় ও কাজে যথেষ্ট ভারসাম্য ছিল। একজন অনিয়োরোপীয় ব্যক্তিত্ব, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে বাস করেও যে সব অতিমানবীয় কর্মকাণ্ড করেছিলেন, তাকে কুর্নিশ জানিয়ে, বিভিন্ন টাইমলাইন ঘুরে আপনি যখন বর্তমানে এসে পৌঁছোবেন, তখন প্রেসিডেন্সির ছাদের বিরাট ঘড়িতে সাড়ে ন-টা বেজে গেছে। আপনি দক্ষিণগামী শেষ মেট্রো ধরার জন্য সেন্ট্রালের দিকে পড়িমরি ছুটবেন হেয়ার স্কুলকে ডাইনে রেখে…

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান