জিষ্ণু দাশগুপ্ত
২০০০ সালে কলকাতার একটি নামী কলেজে ইতিহাসের প্রবেশিকা পরীক্ষার একটি প্রশ্ন নিয়ে বেশ খানিক হইচই বেঁধেছিল। প্রশ্নটি ছিল খানিকটা এরকম — “কুকুর কীভাবে তার এলাকা চিহ্নিত করে? কুকুরের এলাকা বোধের সাথে মানুষের জাতিরাষ্ট্র-বোধের তুলনা করো।” আজ এমন প্রশ্ন করলে হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে বিভাগীয় প্রধানকে জেলে যেতে হত, নিদেন পক্ষে কিছু ‘জাতীয়তাবাদী’ হিংসাত্মক স্লোগান তুলে কলেজটি আক্রমণ করত, সংবাদমাধ্যমে দেশের শত্রুকে চিহ্নিত করে সঞ্চালক চিৎকার করতেন “জাতি জানতে চায়”। কিন্তু তখন এসব না-করে বরং ছাত্রী-ছাত্রমহলে বেশ একটা বৌদ্ধিক নাড়াচাড়ার জন্ম দিয়েছিল। সত্যিই কি মানুষ তার এলাকা বলে যেটাকে মনে করে, সেই এলাকা রক্ষায় (বা বাড়াতে) ‘পাশবিক’ হয়ে ওঠে না? এই লেখার মুহূর্তেও ইউক্রেন, সিরিয়া, প্যালেস্তাইনে কি তাই হচ্ছে না? আর এই হিংসার সাথে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক যদি কোনোভাবেই অস্বীকার না করা যায়, তা হলে কি বলতে হবে যে যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদ একে অন্যের দোসর?
কিন্তু যুদ্ধ ব্যাপারটা তো অতি প্রাচীন। সভ্যতার জন্মলগ্ন, বা তারও আগে থেকে মানুষ একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছে। সভ্যতার শুরুতেই জন্ম নেয় রাষ্ট্র — আর রাষ্ট্র মানেই সংঘাত, লড়াই, যুদ্ধ। প্রাচীন কাল থেকেই যাঁদের ইতিহাসের পাতায় মহান শিরোপা দেওয়া হয়েছে— পারস্যের কুরুস ও দারিয়ুস, গ্রিসের অ্যালেকজান্ডার বা রোমের ইউলিউস কাইজার— তাঁরা প্রায় সকলেই তো যুদ্ধব্যবসাতেই নাম ও সম্পদ কামিয়েছেন (অশোক নিশ্চয় ব্যতিক্রমতাতেই আরও উজ্জ্বল)। রোমক ঐতিহাসিক ট্যাকিটুস লিখে গেছেন “লুঠ ও খুন করাকেই ‘রোমের শাসন’ বলে, মরুভূমি তৈরি করে নাম দেওয়া হয় শান্তি।” প্রাচীন যুগে পরাজিত এলাকা বা নগরের সকল বাসিন্দাকে হত্যা করা বা তাদের দাসে রূপান্তরিত করা মোটেও অবাক করার মতো ঘটনা ছিল না। পৃথিবীর ইতিহাসে সব চেয়ে বড়ো সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মধ্যযুগীয় কাগান চেঙ্গিস খানের রোষানলে একটি গোটা জাতি — কারা খিটাই — নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাঁর আবার শখ (হবি) ছিল পরাজিত শত্রুর খুলির পাহার তৈরি করা, যে শখ তাঁর বংশধর ও মহান শিরোপা পাওয়া আর-এক ভারতীয় শাসক আকবরের যুবাবয়সেও দেখা গিয়েছিল। অতএব বীভৎসা মানুষের অন্যতম প্রবৃত্তি, যা যুদ্ধের মাধ্যমে গোড়া থেকেই মানুষের মধ্যে প্রতিভাত হয়েছে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনও যুগ নেই, যখন মানুষ সম্পদের জন্য, গৌরবের জন্য, ধর্মের নামে, এমনকি প্রেমের দিব্যি দিয়ে, বা অন্য কিছু না কিছু কারণে বা অছিলায় যুদ্ধ করেনি।
তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সাথে সাথে যুদ্ধের চরিত্রে একটা বড়ো পরিবর্তন এসেছে। একথা বললেও জাতীয়তাবাদীরা রে-রে করে উঠতে পারে। তারা তো জানে তাদের জাতি শিবের মতোই অনাদি ও অনন্ত। প্রায় প্রতিটি জাতি-ই সুদূর অতীতে বা তারও ‘আগে’ কোনও কিংবদন্তির কালে তাদের উৎস দেখে — সেটা ভারতে পৌরাণিক সময় হতে পারে, হতে পারে নর্ডিক সাগা, বা অন্য কোনও মনোজ্ঞ, কিন্তু অনৈতিহাসিক কাহিনি। কিন্তু ইতিহাস বলে যে জাতি বা নেশন শব্দগুলির উৎস পুরানো হলেও আধুনিক অর্থে জাতি বা নেশন কিন্তু খুব বেশি বয়স্ক নয়। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তাঁর প্রখ্যাত ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটিস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পুঁজি ও শাসনযন্ত্রের কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ফলে আধুনিক অর্থে জাতির জন্ম হয় একটি “কল্পিত কৌম” হিসেবে। অতএব জাতীয়তাবাদের ইতিহাসও এর থেকে প্রাচীন হতে পারে না। এখানে বলে রাখা ভালো যে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘নেশন’ বা ‘ন্যাশনালিজম’-এর বাংলা পরিভাষা হয় না বলেই মনে করতেন।
সে যাই হোক, এই জাতির জন্মের সাথেই রাষ্ট্রের চরিত্রের একটি মূলগত পরিবর্তন ঘটে। এই সময় থেকেই রাষ্ট্র হয়ে ওঠে জাতির সম্পত্তি, শাসকের নয়। তাই এর আগের শতাব্দীর মতো “আমি-ই রাষ্ট্র” বলা শাসকের জন্য অসম্ভব, বা অন্তত কঠিন হয়ে যায় (যদিও এখনও নিঃসন্দেহে অনেক শাসকের মনের গভীরে এই বিশ্বাস বাস করে)। তাই অগণতান্ত্রিক শাসকদেরও জনতার নামেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হয় — নেপোলিয়নকে হতে হয় “ফরাসিদের সম্রাট”, হিটলারকে দিতে হয় জার্মান ‘ফোক’-এর দোহাই। উলটোদিকে সাইমন শামার কথা অনুযায়ী প্রজা হয়ে ওঠে নাগরিক, রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক।
তো মালিক যখন হয়েছে, তখন সম্পত্তি রক্ষা করা, বা তাকে বাড়ানোর দায়িত্বও স্বাভাবিকভাবে এই নাগরিক প্রজার উপরেই বর্তায়। আধুনিক রাজনৈতিক পরিসরের জন্মের সময়েই এর অভিঘাত স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ফরাসি বিপ্লবের পরেই যে যুদ্ধ হয়, তাতে সমস্ত সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নাগরিকের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। খেয়াল করুন, কোনও স্বৈরাচারী রাজা বা সম্রাট কিন্তু এটা করতে পারেনি। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের জন্মমুহূর্ত থেকেই, এবং এই জন্মের সাথে সম্পত্তি ও পুঁজির সম্পর্কের বলে ‘আধুনিক’ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিন্তু এটা সহজেই করে ফেলতে পারল। সেই ক্ষমতা বলেই আবার প্রতিবিপ্লবের অভিযোগে লিয়ঁ শহর বা ভঁদে প্রদেশকে অক্লেশে আইন পাশ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া গেল। কারণ শত্রুপক্ষ এখন আর রাজার শত্রু বা রাজদ্রোহী নয়, সে সমগ্র জনগণের শত্রু।
আর সেই শত্রু হিসেবে জাতীয়তাবাদ বারবারই নির্মাণ করেছে জাতির অপরকে। এই অপর কখনও জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, কখনও বা বাইরে, কিন্তু তাতে শত্রুতা কিছুমাত্র কমে না। আর এই শত্রুতা চালিয়ে যাওয়া যেমন জাতির পবিত্র কর্তব্য, অন্যদিকে এই এই অপরায়ণ ছাড়া সে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতেও পারে না। তাই শত্রুতা পালন করতে গিয়ে বারংবার জাতিগুলি জড়িয়ে পড়ে বৈদেশিক যুদ্ধে বা গৃহযুদ্ধে, নিদেন পক্ষে ‘কম তীব্রতার সংঘাতে’। এই সমস্ত ধরনের সংঘাতের একটা মূল সূত্র হল এই যে ঐতিহাসিকভাবে কোনও জাতি-ই সম্পূর্ণ তুষ্ট হতে পারে না। একে তো কল্পিত কৌমের সব সদস্য প্রায় কখনোই তার রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে থাকে না, তার উপর থাকে অপরের সাথে বৈরিতার দায়। জাতীয়তাবাদের সাথে যুদ্ধের সম্পর্ক তাই অঙ্গাঙ্গি থেকে গেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীকে অনেক সময়েই জাতীয়তাবাদের শতাব্দী বলা হয়। এই সময়ে দুই আমেরিকার দেশগুলি নিজেদের জাতীয় আত্মপরিচিতি নির্মাণ করেছিল। ইউরোপে কিছু দেশ এই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল আর অন্যদিকে বেশ কিছু অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে। (ভারতবর্ষের মতো ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশগুলিতেও জাতীয়তাবাদ এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই প্রথম পথ চলা শুরু করে।) স্বাভাবিকভাবেই এই লড়াই শান্তিপূর্ণ হয়নি। হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ১৮৪৮ সালে মধ্য-ইউরোপে বিভিন্ন জাতি স্বাধীনতার লড়াই চালায়। অন্যদিকে বল্কান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের সংঘাত হয় অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। মজার কথা হল বেশ কিছু বহুজাতিক সাম্রাজ্য (রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন) কিন্তু নানা সময়ে বল্কানের এই জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়ায়। নিজেরা সাম্রাজ্য চালানো বা সেখানে জাতীয় আন্দোলনকে দমন করার সাথে এই সমর্থনের স্ববিরোধ কিন্তু এদের চোখে ধরা পড়েনি। কখনও সাদা চামড়ার প্রতি ভালোবাসা, কখনও ধর্মপ্রীতি, কখনও বা জাতভাইদের বাঁচানোর মহান দায়িত্ব, আর কোথাও স্রেফ শত্রুর শত্রুকে সাহায্য করার প্রবৃত্তি কাজ করেছিল। বল্কানের এই সংঘাতের চলন কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবধি চলেছিল, এবং গত শতাব্দীর শেষে যুগোস্লাভিয়া ভাঙার সময়ের ভয়াবহ যুদ্ধ এই জাতীয়তাবাদের রক্তাক্ত ফসল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর যে দুটি জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের কাহিনি ইতিহাসের বইয়ে সর্বাধিক স্থান পেয়েছে, তা অবশ্যই ইতালি ও জার্মানির। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এই দুটি দেশই ছিল বহুধাবিভক্ত। ১৮৪৮-এর বিপ্লবের সময় দুটি দেশেই ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। সেই সাফল্য আসে পরের আড়াই দশকে, যুদ্ধের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, দুই জায়গাতেই জাতীয়তাবাদের ভরকেন্দ্র হিসেবে দুটি আঞ্চলিক রাজ্য কাজ করেছিল — ইতালির ক্ষেত্রে পিয়েডমন্ট-সার্ডিনিয়া ও জার্মানির ক্ষেত্রে প্রাশিয়া। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল প্রধানত এদের বাহিনী। জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী অটো ফন বিসমার্কের “রক্ত ও লৌহ” নীতি তো বহুলচর্চিত। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় থেকেই প্রাশিয়া তার ছোটো কলেবর সত্ত্বেও সকল সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নাগরিকের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার মাধ্যমে ইউরোপের একটি প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। বিসমার্কের নেতৃত্বে প্রাশিয়া প্রথমে ডেনমার্ক, তারপর অস্ট্রিয়া ও শেষে ফ্রান্সকে হারিয়ে জার্মান জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে (১৮৭১)। এই সময়েই ইতালির ঐক্যসাধনও সম্পন্ন হয়।
কিন্তু তা করেই ইউরোপে জাতীয়তাবাদের যুদ্ধের স্পৃহা শেষ হয়ে যায়নি। বরং এই ঐক্যসাধনের মধ্য দিয়ে এই দুই দেশের সমস্যারও সমাধান হয়নি। একদিকে এর পরেও বেশ কিছু জার্মান ও ইতালীয় ভাষাভাষী মানুষ ও অঞ্চল এই দুই দেশের বাইরে থেকে যায়। তাই জাতীয়তাবাদী প্রকল্প সম্পন্ন করতে হলে এদের নতুন জাতিরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও এই নতুন জাতিরাষ্ট্র দুটি মনে করে যে দেরি করে তৈরি হওয়ার দরুন বিশ্বের বা ইউরোপের অন্য ‘মহান রাষ্ট্র’-গুলির তুলনায় এরা নিজেদের প্রাপ্য উপনিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পুঁজিবাদের তৎকালীন স্তরে উপনিবেশ দখলের মাধ্যমে কাঁচামাল সরবরাহ ও বাজারের জোগান মজুত রাখার ‘সহজ’ পদ্ধতি তাদেরও আকৃষ্ট করে। কিন্তু তখন আর নতুন উপনিবেশ করার মতো জায়গা বিশেষ অবশিষ্ট নেই। সদ্য আধুনিক হওয়া জাপানও এই একই জায়গায় ছিল। ফলে বল্কান বা অন্যত্র অবদমিত জাতিগুলির মতোই এই দেশগুলিতেও আমরা অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ দেখতে পাই।
প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলিও যে শান্তিতে ছিল, তা নয়। অস্ট্রিয়া, তুর্কি ও রাশিয়ার ছিল ভয় — অবদমিত জাতীয়তাবাদের যদি উত্থান হয়, তা হলে তাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। মনে রাখা প্রয়োজন, বহুজাতিক সাম্রাজ্য হলেও এখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই অবদমিত জাতিগুলির উপর কোনও একটি জাতির প্রাধান্য (যথাক্রমে জার্মান ভাষাভাষী অস্ট্রীয়, তুর্ক ও রুশ) রাজকীয় স্বৈরতন্ত্রের দোসর হিসেবে কাজ করেছিল। ফ্রান্স আবার কখনোই ফ্র্যাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে পরাজয়, ও তার ফলে আলসাশ ও লোরেন প্রদেশ দুটি জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হওয়া মেনে নিতে পারেনি। প্রতিশোধের (revanche) আগুন এখানে অহরহ জ্বলছিল। উপরন্তু ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মতো প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি নতুন জাতিরাষ্ট্রগুলির শক্তি ও উপনিবেশের খিদেকে ভয় পাচ্ছিল। এর সাথে যুক্ত হয় প্রত্যেকটি দেশেই চালু জাত্যভিমান — ইংল্যাণ্ডে পুঁজি ও উপনিবেশের দম্ভের সাথে যুক্ত হয় ‘সাদা মানুষের বোঝা’; ফ্রান্সে ছিল ‘সাংস্কৃতিক মিশন’; জার্মানির নর্ডিক বা আর্য শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসের সাথে তার ‘কু্ল্টুর’। ইউরোপ দুটি সামরিক শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, এই শিবির ভাগ হওয়ার কিন্তু কোনও আদর্শগত ভিত্তি ছিল না। গণতান্ত্রিক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাথে যুক্ত হয় স্বৈরতান্ত্রিক রাশিয়া; জাতীয়তাবাদী জার্মানি ও ইতালির জোটসঙ্গী ছিল বহুজাতিক অস্ট্রীয় সাম্রাজ্য। সব ক্ষেত্রেই আদর্শের উপর টেক্কা দেয় জাতীয়তাবাদের ভূ-রাজনৈতিক ও বাস্তববাদী স্বার্থ। অতএব ইউরোপ কার্যত একটি বারুদের স্তুপে পরিণত হল, যার প্রয়োজন ছিল শুধু একটি স্ফুলিঙ্গের। এর পিছনে নিশ্চয়ই ছিল সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে চলে আসা সম্পদের লড়াই, যা পুঁজিবাদের মাধ্যমে আধুনিক রূপ পেয়েছিল। বিশ্বব্যাপী পুঁজির দাপাদাপির মধ্যে ছিল অর্থ-পুঁজি (finance capital), সামরিক শিল্প ও প্রযুক্তির নিবিড় বিন্যাস। তবে জাতীয়তাবাদ এই সবের মধ্যে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছিল। রাজা বা সরকার তার নিজের ইচ্ছেতে যুদ্ধে যাবে, পুরানো এই রীতি এখন আর চলছিল না। সরকারের ধারণাগত ভিত্তি যদি হয় জনগণ, আর রাষ্ট্র যদি হয় জাতির সম্পত্তি, তা হলে তাদের মতকেও, অন্তত মুখের কথায় গুরুত্ব দিতে হয় বই-কি। তাই বলে আবার ভাববেন না, যে সরকার বা শাসক শ্রেণি আপামর জনসাধারণকে বেকুব বানিয়ে নিজের ইচ্ছায় চালিত করেছিল, আর জনতা ছিল নির্দোষ, যার যুদ্ধে যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। বরং জাতির সম্পত্তি রাষ্ট্রকে রক্ষা করা বা সম্পদ বাড়িয়ে নেওয়ায় তার আগ্রহই যথেষ্ট চোখে পড়ে। অবশ্যই এই জনমত তৈরি করায় পুঁজির, বিশেষত পুজিবাদী সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদের জন্মলগ্নেই তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল (অ্যান্ডারসন যেমন দেখিয়েছেন) মুদ্রণ পুঁজিবাদ। অতএব একটি মতবাদকে মিথ্যা সচেতনতা বললে অন্যটিকেও সত্য বলা যায় না। তার থেকে বরং সুদীপ্ত কবিরাজের কথা ধরে করে বলা যায়, জাতি বা জাতীয় কৌম কল্পিত হলেও সত্য। চমস্কি দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদী সংবাদমাধ্যমের মধ্য দিয়েই আধুনিক সমাজে ঐকমত্য তৈরি হয়। এটা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে সব ক্ষেত্রেই কর্তার কর্তৃত্ব নানা বিষয়ের উপর নির্ভর। অতএব সব কর্তৃত্ব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই শর্তসাপেক্ষ — জাতির ক্ষেত্রেও তাই।
মোদ্দা কথা, যুদ্ধ জিগির শুধু শাসক ব্যক্তি, শ্রেণি বা দলের মধ্যে নয়, জাতীয় কৌমের নানা অংশেই সঞ্চারিত হয়। ফ্রান্সে তাই যুদ্ধের পক্ষে জনপ্রিয় মিছিল বা ইতালিতে রাষ্ট্রবিস্তারের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা ইতিহাসের ছাত্রীছাত্রদের অবাক করে না। বরং তাদের কাছে অনেক স্বাভাবিক মনে হয় জার্মান সম্রাটকে ফাঁসি দেওয়ার ধুয়ো তুলে ইংল্যান্ডের নির্বাচনে শাসক দলের অনায়াস বিজয়। আবার এই যুদ্ধমত্তার মধ্যেও অবশ্যম্ভাবী কিছুই নেই। যুদ্ধের বাস্তব যখন অসহ্য পর্যায়ে পৌঁছায়, তখনই যুদ্ধবিরোধী বৈপ্লবিক পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে, যেমন হয়েছিল ১৯১৭ সালে রাশিয়ায়। অতএব এখানেও কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক ঘটনা ও প্রেক্ষিতের উপর নির্ভরশীল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যে তখন অবধি ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হয়েছিল, তার পিছনে কিন্তু জাতি ও রাষ্ট্রের পূর্বোল্লেখিত সম্পর্ক বা জাতীয়তাবাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই রাষ্ট্র নামের সর্বজনীন সম্পত্তি রক্ষায় সার্বজনীন সেনাবাহিনীর কথা, সেখান আগেই বলেছি। সেই নীতি প্রয়োগ করেই প্রাশিয়ার সামরিক শক্তির উত্থান ঘটে, যার উপর দাঁড়িয়ে সে জার্মানিকে একটি জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিল। এই নীতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সমস্ত দেশই প্রয়োগ করেছিল, যার ফলে এই যুদ্ধ সত্যিই বিভিন্ন জাতির মধ্যে যুদ্ধ হয়ে ওঠে। মারণ প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার এটিও একটি বড়ো কারণ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয়েছিল “সকল যুদ্ধকে শেষ করার যুদ্ধ”। মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের মতো কেউ কেউ হয়তো ভেবেওছিলেন যে এটি স্বৈরতান্ত্রিক বহুজাতিক সাম্রাজ্যগুলির (জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও তুর্কি) সাথে গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক, জাতীয়তাবাদী দেশগুলির (ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) লড়াই। আগেই বলেছি, বাস্তবের সাথে এই ধারণার তেমন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তাও যুদ্ধপরবর্তী শান্তি আলোচনার ভিত্তি হিসেবে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার উইলসনের কথা অনুযায়ী স্থান পায়। কিন্তু এতে যুদ্ধের বিপদ কমেছিল, এমনটা প্রত্যয়ের সাথে বলা যায় না। একদিকে বিজয়ী দেশগুলি বিজিতদের থেকে তাদের জয়ের ফসল তুলতে উদ্গ্রীব ছিল — জার্মানি শুধু আলশাস ও লোরেন হারায়নি, হারিয়েছিল তার উপনিবেশগুলিকে; অস্ট্রিয়া ও তুর্কি হারায় তাদের গোটা সাম্রাজ্য। এর মধ্যে তুর্কির সাম্রাজ্যের অনেকটাই আবার বিজয়ী ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, যদিও নামে এরা হয় এই সব এলাকার অবদমিত জাতিগুলির অছি।
বলা বাহুল্য, বিজয়ীদের বিস্তৃত সাম্রাজ্যে হাত দেওয়ার কথা, সেখানে উপনিবেশগুলিকে স্বাধীন করা বা কালো-বাদামি-হলুদ চামড়ার মানুষের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে শান্তি সম্মেলনে কারোরই মাথাব্যথা ছিল না। তাদের জাতিসত্তাই তো তখনও স্বীকৃত নয় শক্তিধরের চোখে। কিন্তু ইউরোপে স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্র তৈরি এই শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব হয়নি। একদিকে বিজয়ীরা যুদ্ধের চিরাচরিত রীতি মেনে নিজেদের জাতীয় স্বার্থকেই নীতির উপর স্থান দিয়েছিল। অন্যদিকে ইতালি আবার মনে করেছিল যে দল পালটিয়ে বিজয়ীর দিকে এলেও তার থেকে সে যথেষ্ট মুনাফা করতে পারেনি। তৃতীয় সমস্যাটি হয়তো আরও গভীর। আগেই বলা যাবে কোনও জাতিরাষ্ট্রই প্রায় কখনোই তার কল্পিত জাতির সমস্ত সদস্যকে সেই জাতিরাষ্ট্রের ছাতার তলায় আনতে পারে না। তাই ইউরোপের বহু দেশেও থেকেই যায় সংখ্যালঘু জাতীয়তাবাদের সমস্যা।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ইউরোপের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস তাই অনেকাংশেই এই অতৃপ্ত বা শঙ্কিত জাতীয়তাবাদের কাহিনি। বিজয়ী ফ্রান্সের শঙ্কা ছিল তার বিজিত এলাকা ও ইউরোপের প্রধান শক্তি হিসেবে অবস্থান হারানোর। (অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া আর সব দেশের শাসকই বলশেভিক বিপ্লব ছড়ানোর ভয় পেত।) আর জার্মানি বা ইতালির ছিল বাড়বার খিদে। সেই খিদেই এই দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অপরকে চিহ্নিত করতে ও তাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে — জন্ম নিয়েছে জাতীয়তাবাদের উগ্রতম রূপ ফ্যাসিবাদ। অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে তা চিহ্নিত করেছে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা ও এমনকি উদারনৈতিক পুঁজিবাদকে। ইতালি, জার্মানি, স্পেন বা রোমানিয়ায় এই প্রক্রিয়া সহজেই দ্রষ্টব্য। মনে রাখতে হবে, যে ফ্রান্স বা ব্রিটেনেও কিন্তু এই প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রূপে দেখা যায়। আর বিদেশনীতির ক্ষেত্রে জার্মানি বা ইতালির ছিল রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তারের লক্ষ্য — যাতে তারা সঙ্গী পেয়েছিল জাপানকে।
এই প্রত্যেকটি আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রেই অতীতের সাথে বর্তমানকে মিলিয়ে একটা মহত্বের কল্পনা কাজ করেছিল, যা এদের বর্তমান নীতিকে মান্যতা দেওয়ার কাজে এসেছিল। ইতালির মুসোলিনি বারবারই ফিরে তাকিয়েছিলেন প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যের গৌরবের দিকে, যার তুলনায় ইতালির বর্তমান ছিল বড়োই ম্যাড়ম্যাড়ে। জার্মানিতে হিটলার নাৎসি শাসনকে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক দুই জার্মান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করেন। এর সাথে আর্য জাতিগত শ্রেষ্ঠতার নির্মাণ মিশে যে বর্ণবৈষম্য ও জাত্যভিমানের রাজনীতি তৈরি হয়, তাতে ইহুদি ও স্লাভ জাতির মানুষদের মনুষ্যেতর বলে চিহ্নিত করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। আর তার ফলেই এদের উৎখাত করে, ভূমিদাসে/দাসে পরিণত করে বা (গণ) হত্যা করে আর্য জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের সাথে মানানসই ‘বাঁচার জমি’ (lebenstraum) ও অন্যান্য অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শগত ভিত্তি তৈরি হয়। জাপানও তার নিজের ইতিহাসের নির্মাণ থেকে একই আগ্রাসী জাত্যভিমানের শিক্ষা নিয়েছিল, যা তাকে মনে করিয়েছিল যে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপানের আধিপত্য স্থাপনই উচিত। এর সাথে অবশ্যই যুক্ত হয়েছিল পুঁজির বিশ্বব্যাপী সংকট। ১৯২৯ সালের মহামন্দা সম্পদের পুঁজিবাদী সংঘাতকে আরও পুষ্ট করে, যা উগ্র জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিকে আরও বৈধতা জোগায়।
১৯৩০-এর দশক জুড়েই পৃথিবী জুড়ে আগ্রাসনের ছবি স্পষ্ট। ১৯৩১ সালে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে, ১৯৩৫ সালে ইতালি আক্রমণ করে এথিওপিয়া, ও পরের বছর এই দেশ দখল করে নেয়। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল অবধি স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলেছিল। ১৯৩৭ সালে জাপান চিনের বাকি অংশ আক্রমণ করে ও সেই বছরেই জার্মানি, জাপান ও ইতালিকে নিয়ে গঠিত হয় কমিউনিস্ট-বিরোধী অক্ষ। ১৯৩৮ সালে জার্মানি অস্ট্রিয়া অধিকার করে, ও তার কয়েক মাস পরেই মিউনিখে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আত্মসমর্পণের ফলে চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান অধ্যুষিত সুডেটান অঞ্চল তাদের হাতে আসে। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে মিউনিখ চুক্তি অস্বীকার করে বাকি চেকোস্লোভাকিয়ায় জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয় ও এপ্রিলে ইতালি অ্যালবেনিয়া দখল করে। এই গোটা সময়েই ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল মূলত পিছু হটার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন একে “আমাদের সময়ে শান্তি” নামক মোড়কে বাঁধার চেষ্টা করলেও আসলে তাঁরা তাদের জাতীয় (পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী) স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন মাত্র। তাই তাঁরা বারংবার সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্থাব ফিরিয়ে দেন। অবশেষে, সেপ্টেম্বরে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
ভয়াবহতায় (এখন অবধি) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনও তুলনা নেই। আনুমানিক সাত থেকে সাড়ে আট কোটি মানুষ এতে মারা যান। এর মধ্যে অবশ্য অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ও জাতিগত শত্রুর সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। এই সময়ে ঘটা ইহুদি নিধন যজ্ঞ আজও অধিকাংশ মানুষকে নাড়া দেয়। এই প্রেক্ষিতেই জাতিগত বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অন্তত একটি আপাত বিশ্বজনীন ঐকমত্য তৈরি হয়, যার প্রতিফলন ঘটে জাতিসংঘের সংবিধানে। হেরে যাওয়া শক্তিগুলির সাম্রাজ্য হারানো তো নিয়ম ছিলই, বিশ্বযুদ্ধের ফলে দুর্বল হয়ে পড়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও আর তাদের উপনিবেশ ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ দিয়ে শুরু করে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলি একের পর এক স্বাধীন হতে থাকে।
তাতে অবশ্য জাতীয়তাবাদের সমস্যা মিটে গেল, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। জাতিরাষ্ট্রের মডেলের মধ্যে অবশ্যম্ভাবীভাবেই থেকে গেল সংখ্যালঘু, অতৃপ্ত ও প্রতিযোগী জাতীয়তাবাদ। সব জায়গায় যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শান্তিপূর্ণভাবে উপনিবেশ ত্যাগ করেছে, তাও নয়। ইন্দোনেশিয়া। আলজিরিয়া বা ইন্দোচিন থেকে সাম্রাজ্যবাদীদের বিনা যুদ্ধে বিতাড়ন করা যায়নি। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার নব্য-সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের সাথে মানানসই ভূমিকা রেখে নানা আগ্রাসী কাজকর্ম চালিয়ে গেছে। আফ্রিকা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে বড়ো শক্তির কূটনৈতিক দাবা খেলার মহাদেশীয় বোর্ড। অন্যদিকে আরব-ইসরায়েল, ইরাক-ইরান চেনা আন্তর্জাতিক যুদ্ধের উদাহরণ হিসেবে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ সংখ্যালঘুদের বিষয়ে আজও মীমাংসা তো হয়ই নি, বরং সেগুলি রক্তক্ষয়ী সংঘাত হিসেবে ঘটেই চলেছে। কোথাও তাকে বলা হয় যুদ্ধ, কোথাও গৃহযুদ্ধ, কোথাও বিদ্রোহ তো কোথাও সন্ত্রাসবাদ, আর অনেক জায়গাতেই ‘কম তীব্রতার সংঘাত’। এই তালিকায় আছে ইসরায়েল-প্যালেস্তাইন দ্বন্দ্ব, ভারতে কাশ্মীর ও উওর-পূর্বে নানা ‘সমস্যা’, তুর্কি, ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে কুর্দ জাতির লড়াই, ইন্দোনেশিয়ায় তিমোরের সংঘাত, অধুনা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ… এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়।
সমাজবাদী দেশগুলিও এর বাইরে নয়। বরং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ সাম্রাজ্যবাদ ও গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে হান সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব স্পষ্ট। যুগোস্লাভিয়ায় তো সাম্যবাদ ভেঙে পড়ার সাথে সাথেই প্রতিযোগী জাতীয়তাবাবাদের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ লেগে যায়, যার ক্ষত আজও বর্তমান। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার আদর্শের লড়াই আর আন্তর্জাতিক সংঘাত আলাদা করা কঠিন, যেমন ঘটেছিল চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। আবার ইন্দোচিনের তিনটি সাম্যবাদী দেশের মধ্যে যুদ্ধের কোনও আদর্শনৈতিক কারণ মার্কসবাদীরাই খুঁজে পাননি। অ্যান্ডারসনের মতো তাঁদের কেউ কেউ মেনে নিয়েছেন যে এক্ষেত্রে মার্কসবাদী আদর্শের থেকে জাতীয়তাবাদ বেশি শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে। অতেব রাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদ মিলিয়ে তো যায়ইনি, বরং সাম্যবাদ বা বিশ্বায়ন, কোনোটাই তাকে বিশেষ দুর্বল করতে পারেনি।
অনেকে মনে করেন, যে জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী রূপ তার এক নির্দিষ্ট বয়সের ধর্ম। কম বয়সে নিজের স্থান করে নিতে সে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বটে, কিন্তু পরিপক্ক হলে সে সাবধানী হয়, শান্তিপ্রিয় হয়। এই উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী পশ্চিমে জাতিরাষ্ট্রগুলি অনেক দিন আগেই তাদের কম বয়স কাটিয়ে উঠেছে, এখন তারা স্থায়িত্বের পক্ষের শক্তি। যত ঝামেলা হল তৃতীয় বিশ্বে। এমনকি যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধের দায়ও ঠিক পশ্চিমের নয়, বরং তা পূর্বতন কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের। কিন্তু গত দশ-পনেরো বছরের ঘটনাক্রম এই বর্ণবিদ্বেষী ধারণাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
২০০৮-এর মন্দার পর পৃথিবীর নানা দেশেই যে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির (যার অনেকগুলিতেই বেশ কিছু ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখা যায়) শক্তিশালী হয়েছে বা জন্ম নিয়েছে তা কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ বা সাদা-কালোর বিভেদ দেখেনি। মার্কিন মুলুকে ট্রাম্প, রাশিয়ায় পুতিন, হাঙ্গেরির ওরবান, ব্রিটেনে ব্রেক্সিটপন্থীরা, ব্রাজিলে বলসানেরো, পাকিস্তানে ইমরান খান, চিনে লি জিনপিং, ফ্রান্সে লা পেন — এঁদের মধ্যে ক্ষমতার বা সাফল্যের হেরফের থাকতে পারে, তফাত থাকতে পারে প্রেক্ষিতে ও তজ্জনিত কিছু অবস্থানে, কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে এরা সকলেই সহোদর-সহোদরা। তুর্কির এরডোগান ও ভারতে মোদি তো একে অন্যের প্রতিবিম্ব। মনে রাখতে হবে, এঁদের দলের নাম যাই হোক, এঁরা কিন্তু পুরোনো রক্ষণশীল ডানপন্থী রাজনীতিক নন। এঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বায়িত নব্য উদারপন্থার বিরোধী এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী, আগ্রাসী ডানপন্থার ধ্বজাধারী। শেষ এই ধরনের রাজনীতির ব্যাপক বাড়বাড়ন্ত ঘটেছিল ১৯৩০-র দশকে, আর এক অর্থনৈতিক সংকটের ছায়ায়। তখন এই ধারার অবসান কিন্তু ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। প্রশ্ন থেকেই যায়, এটিও যদি পুঁজির ইতিহাসের অনুরূপ একটি স্তরের ফল হয়, তা হলে এই উত্থানের ফলও কি এক হবে। নাকি মানুষ এবার ইতিহাসকে অন্যদিকে চালিত করবে? এর উত্তর ইতিহাস ও মানুষ দেবে, তবে এটা সত্য যে জাতীয়তাবাদের চরিত্র যা, তাতে তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সৌহার্দ সম্ভব নয়।
একটি কথা না বলে শেষ করাটা বর্তমান মুহূর্তের সাথে অপরাধ করা হবে। তা হল ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কথা। এই যুদ্ধ কিন্তু মোটেও অচেনা নয়। পুতিন ও তাঁর সহযোগীরা যা বলছেন, তা বহুবার বলা হয়েছে — ইউক্রেনীয় বলে আসলে কোনও জাতি নেই, ওরা মূলত রূশ; রূশ সভ্যতার জন্মস্থান ইউক্রেনে, তাই ওই অঞ্চল আসলে রাশিয়ার; ইউক্রেন তার দেশে রুশ সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চালায়; ইউক্রেনের সরকার ঐতিহাসিক শত্রুর (নাৎসি) মতো; বা বর্তমান শত্রুর (ন্যাটো) দোসর। এতে কিছু বামপন্থী বা উদারপন্থী মানুষেরও মন গলেছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বহুবার ঘটা মার্কিন আগ্রাসনের দোহাই দিচ্ছেন, কেউ আবার সোভিয়েত ক্ষমতার পুনরুত্থানের আশা দেখছেন। অপরাধ যদি অপরাধই হয়, তা হলে প্রথম যুক্তিটি অবশ্যই ধোপে টেকে না, সব ক্ষেত্রেই আগ্রাসনের বিরোধিতা করাটাই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আর পেটোয়া পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে যারপরনাই দক্ষ পুতিনের মধ্যে সাম্যবাদের উত্থানের দিবাস্বপ্ন দেখা (সংসদীয় ভদ্র ভাষা ব্যবহার করতে হলে) মূর্খামি।
আবার রুশ বিরোধিতায় যারা প্রথম সারিতে, তারাও স্ববিরোধিতায় জর্জরিত। জার্মানি কিছুতেই তার জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী রুশ তেল বয়কটে রাজি নয়, একলা চলোর প্রবক্তা বরিস জনসন বলছেন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কথা। অভিবাসন নিয়ে খড়্গহস্ত পোল্যান্ডের সরকার ইউক্রেন থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য অবাধ ও ঢালাও আয়োজন করছে। আশা নিশ্চয় করা যায়, যে শেষোক্ত দুইয়ের বোধোদয় ঘটেছে, কিন্তু তা দুরাশা হতে পারে। জনসনের এখন নির্বাচনি স্বার্থে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্য বড়ো প্রয়োজন। আর পোল্যান্ড বা অন্য অনেকের কাছেই সাদা চামড়ার মানুষের দাম তো বেশি বটেই। তাই সাংবাদিকরা জনসমক্ষেই শোকার্ত বিস্ময় প্রকাশ করছেন যে সাদা চামড়ার মানুষ আক্রান্ত, পশ্চিমি সভ্য শহরে বোমা পড়ছে, ইউরোপের মাটিতে ফের যুদ্ধ হচ্ছে। ইরাক, আফগানিস্তানে ঘটে যাওয়া বা ঘটমান বর্তমান সিরিয়ার পরিস্থিতিতে এঁদের প্রতিক্রিয়ার সাথে এখনকার ফারাক বড় স্পষ্ট। এবং তা আবারও প্রমাণ করে জাতীয়তাবাদের মতোই বর্ণবিদ্বেষও মরেনি ও তাদের সম্পর্কও বহাল তবিয়তে রয়েছে। তাও যুদ্ধের বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, যেটুকু পাওয়া যায়, তাই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। জাতীয়তাবাদ কখনোই সহজ প্রশ্ন করে না, সহজ সমাধানও দেয় না।