অমৃতেশ বিশ্বাস
কিছুদিন আগেই ল্যাপটপে ‘যা ইচ্ছে তাই’ খুঁজতে খুঁজতে একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা চোখে পড়ল। কবেকার সেই প্রস্তর যুগে Neanderthal আর Homo-Sapien-দের মধ্যে প্রায় লাখখানেক বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল! কারণ হিসেবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন নৃতত্ত্ব-কেন্দ্রিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পত্র-পত্রিকায় একাধিক ব্যাখ্যা থাকলেও এই মারাত্মক সংঘর্ষের ব্যাপারে সবাই একমত, এমন কি, বিভিন্ন শতকের চিত্রশিল্পীদের তুলিতে এই যুদ্ধের কাল্পনিক চিত্ররূপসমূহ ঠাঁই পেয়েছে নানা মিউজিয়ামে! প্রথম ধাক্কায় এই তথ্য হজম না হলেও কিছুক্ষণ পরেই আর কোনও অস্বস্তি হয়নি। অতি স্বাভাবিক ঘটনা। পৃথিবীর জীবজগতের পশু-পাখিদের মধ্যে এরকম দৃশ্য কখোনোই দুর্লভ নয়। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ইকো-সিস্টেম আর ‘Survival of the fittest’ তত্ত্বের মতোই এটাও খুবই স্বাভাবিক। এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখলের লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই, খাবার লড়াই ঊনবিংশ শতকের বহু বহু বহু আগের থেকেই এই গ্রহে ছিল, আছে আর থাকবে।
তবে, বাংলা ভাষায় যাদেরকে আমরা এককথায় ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করে থাকি, তারা ‘পশু’ হলেও পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী অন্যান্য পশু, পাখি, জীবজগতের তুলনায় একটু অন্যরকম। তারা ‘সামাজিক’। আর এই সামাজিক হওয়ার সুবাদেই মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি, অর্থাৎ, লড়াই, ঝগড়া, মারামারি কেবলমাত্র অপরিহার্য প্রয়োজনে সংঘটিত হয় না, অন্যান্য আরও অনেক কারণেই হয়। ব্যাঘ্রাচার্য বৃহলাঙ্গুল আগেই এই নিয়ে বেশ কিছু বক্তব্য পেশ করেছেন। মানুষ নামক পশুদের মধ্যে প্রাণ টিকিয়ে রাখার জন্য survival strategy আর নেই। ‘মুদ্রাদেবী’ আবির্ভাবের পরে কোনও না কোনও ছুতোয় গ্রহজোড়া মারামারি আর কাটাকাটির রমরমা ব্যবসা! এই ব্যবসা কখনও ধর্ম নিয়ে, আবার কখনও লোকনীতি নিয়ে। এখন তো আবার বেশ কিছু জায়গায় দেখি দুই-ই এক, আলাদা করে বোঝার উপায় নেই!
বেশ কিছুদিন আগে Instagram-এ একটা সিনেমা সংক্রান্ত পোস্টার দেখেছিলাম যেখানে প্রদর্শিত উদ্ধৃতির বাংলা করলে অনেকটা এমন দাড়াঁয়, “ধর্ম না থাকলে আমরা এমন কিছু উপায় বের করে নিতাম যেখানে সাম্প্রদায়িক মারামারিটা বজায় থাকত”।
ডাহা সত্যি কথা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই! কাল্পনিক সীমারেখা প্রদত্ত বিশেষ বিশেষ ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী ‘মানুষ’ নামক জাতিকে আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত করার প্রথা বহু পুরোনো, প্রথমটায় বোধহয় এই প্রথা ছিল কেবল পরিচয় নির্মাণের তাগিদ। ঠিক যেমন জার্সি গাই, তিব্বতি কুকুর, বাংলার বাঘ বা royal bengal tiger ইত্যাদি। তার মানে তো এই নয় যে তমুক প্রজাতির বাঘ বা অমুক প্রজাতির ছাগল নির্দিষ্ট নামের সেই নির্দিষ্ট সীমার ভূখণ্ডেই মিলবে! সারা গ্রহ জুড়েই তো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব। তবে হ্যাঁ, বৃক্ষজগতে উচ্চতা, স্থান ইত্যাদি অনুযায়ী সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। গুটিকয়েক ছাড়া আর সব বৃক্ষই চলনে অক্ষম।
তারও পরে মানুষদের পরিচয় নির্মিত হল ‘ধর্ম’-কে কেন্দ্র করে। কবে, কোথায়, কীভাবে এই ‘ধর্ম’ জন্ম নেয় তা নিয়ে বহুরকম, বহুধরনের আলোচনা আর লেখা আছে। তবে, এ নিয়ে বোধহয় মতপার্থক্য নেই যে, এই ধর্ম আসলে মানুষের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেরই অঙ্গ এবং কোনোরকম সহজাত প্রবৃত্তি, জন্মলগ্নের কবচকুণ্ডল ইত্যাদি এর সঙ্গে জড়িত নয়। যাই হোক, মানুষদের পরিচয় নির্মিত হতে শুরু করলো এই একাধিক ধর্মের নিরিখে। এর সঙ্গে আবার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত বাহ্যিক বৈসাদৃশ্য অন্যান্য প্রাণীদের মতোই মানুষদেরও আছে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই।
সামাজিক মানুষ এখন চিহ্নিত আরবি, ফার্সি, আমেরিকি, ফরাসি, মগ, কেচুয়া, ইনকা, জারোয়া, ইহুদি, সিন্ধি ইত্যাদি ছাড়াও পাহাড়ি, আর্কটিক, নিয়েনডারথাল, হোমো স্যাপিয়েন, দ্য হবিট, হোমো ইরেকটাস আরও যে কত কি নামে তা বলে শেষ করা যাবে না! ‘প্রজাতি’ থেকে ‘জাতি’– সর্বত্রই এদের অবাধ বিচরণ। বাহ্যিক আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যর ভিন্নতা, তার উপরে আবার স্থাননিরিখে, কালনিরিখে, ধর্মনিরিখে জাতিগত অপরত্ব। কিন্তু অপরত্বের সন্ধান পাওয়া মানেই যে তাকে কেবল বৈসাদৃশ্যের কারণে নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠে পড়ে লাগা, তা বোধহয় নয়, অপর সম্পর্কে মগজে-মননে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা জেগে ওঠাও অন্যতম কারণ! কাজেই উক্ত সহজাত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগাতে পারলে লাভের গুড় আর কখোনোই পিঁপড়ে খেয়ে যেতে পারবে না। ‘ঘরোয়া’-য় পড়া সেই লাইনটাগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে —
“… কলকাতায় প্লেগ, মহামারী, তার পরে এল স্বদেশী হুজুগ।”
এবং,
“তখন একসময়ে দেখি সবাই স্বদেশী হুজুগে মেতে উঠেছে। এই স্বদেশী হুজুগটা যে কোথা থেকে এল কেউ আমরা তা বলতে পারি নে। এল এইমাত্র জানি, আর তাতে ছেলে বুড়ো মেয়ে, বড়লোক মুটে মজুর, সবাই মেতে উঠেছিল। সবার ভিতরেই যেন একটা তাগিদ এসেছিল। কিন্তু কে দিলে এই তাগিদ। সবাই বলে, হুকুম আয়া। আরে এই হুকুমই বা দিলে কে, কেন। তা জানে না কেউ, জানে কেবল– হুকুম আয়া। তাই মনে হয় এটা সবার ভিতর থেকে এসেছিল— রবিকাকাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, তিনিও বোধ হয় বলতে পারবেন না। কে দিলে এই তাগিদ, কোত্থেকে এলো এই স্বদেশী হুজুগ! আমি এখোনো ভাবি, এ একটা রহস্য। বোধহয় ভূমিকম্পের পরে একটা বিষম নাড়াচাড়া — সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। বড়ো-ছোটো মুটে-মজুর সব যেন এক ধাক্কায় জেগে উঠল। তখনকার স্বদেশী যুগে এখনকার মতো মারামারি ঝগড়াঝাঁটি ছিলো না।”
খানিকটা disclaimer এর কাজ করছে বলেই মনে হয় এই অনুচ্ছেদ। একটা ‘হুকুম’ আসে। যদি জিগেস করা হয়, “ …কোথা হইতে আসিয়াছ?” উত্তর নানারকম জানা-অজানার মাঝে ঘোরাফেরা করে। ‘মারামারি ঝগড়াঝাঁটি’ ছিল কি ছিল না, তার উত্তরও বোধহয় না-হ্যাঁ, হ্যাঁ-না–র মধ্যেই অবস্থিত। দীর্ঘকালীন সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ঔপনিবেশিক জনসমাজের কাজকর্মকে ‘হুজুগ’ যখন বলা হচ্ছে, তখন, হিটলারের ভাষণ বা মুজিবর রহমান-এর রেডিও ভাষণের পরবর্তী ঘটনাক্রমসমূহই বা কম যায় কীসে? এই ‘হুজুগ’ কার্যসিদ্ধির অব্যর্থ ঔষধ, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে হ্যাঁ, অমুক হুজুগ ভালোর জন্য, তমুক হুজুগ ফ্যাসিজম, এই হুজুগ নাজিবাদ, সেই হুজুগ তালিবানি বা উগ্র হেঁদুয়ানির প্রতীক— এসব ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করার অধিকার বা বোধ আমার নেই। আসলে, সেইভাবে mind set up বা point of view তৈরি করার জন্য যথাযথ শিক্ষা আর দীক্ষা প্রয়োজন, তার যথেষ্ট অভাব প্রতিপদে অনুভব করি।
যাই হোক, জাতি থাকলেই জাতীয়তাবাদ থাকবে একথা যেমন অনস্বীকার্য, ঠিক তেমনই একটা ‘হুজুগ’ কোথাও না কোথাও কাজ করে, সেই যুক্তিও অকাট্য। আগেই বলেছি, ‘জাতি’-র রকমফের আছে। কোনও বিশেষ স্থানভিত্তিক জাতি বলতে যেমন বোঝায় Arctic people, আবার দেশভিত্তিক জাতি বলতে বুঝি ‘ব্রিটিশ’। সেইরকমই ধর্মভিত্তিক জাতি বলতে পরিচয় পাই ‘খ্রিস্টান’, ‘ইহুদি’ ইত্যাদির। প্রয়োজন অনুযায়ী কে কোন্ জাতির অন্তর্ভুক্ত তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। কোনও নৃ-তাত্ত্বিক আমায় যে জাতির অধীনে রেখে সম্বোধন করবেন, সেই সম্বোধনই কোনও ধর্মগুরু বা একাধারে ধর্মগুরু ও রাজনীতিবিদ নিশ্চয়ই করবেন না। ভৌগোলিক অবস্থানের অধীনে আমি আবার আলাদা নামের, জাতির পরিচয়ে পরিচিত। কে আমায় কী ভাবে ‘ইস্তেমাল’ করছেন, বা আমি-ই নিজেকে কীভাবে ‘ইস্তেমাল’ করছি, সেটাই মুখ্য বিষয়। ‘সামাজিক’ তকমা আঁটা এই ‘আমি’ কখনও হুজুগে হচ্ছি দেশ স্বাধীন নিয়ে, মেতে উঠছি ধর্মরক্ষা নিয়ে, আবার কখনও পরিবেশরক্ষার জন্য। মানবজাতি ও পরিবেশের স্বার্থে আমি কখনও গ্রেটা থুনবার্গ-এর সঙ্গী, দেশের স্বার্থে সেই আমি ‘ভারতীয়’, আবার নিজধর্ম নিয়ে আমি ‘গর্বিত’। কাল এবং স্থানসাপেক্ষে আমার প্রয়োজনও বদলে বদলে যায়।
ঠিক এইভাবেই বেশ কয়েক দশক আগেই ইউরোপের বেশ কিছু দেশে সরকার তার যাবতীয় ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দিয়েছিলো single mother-দের ওপর, নির্দ্বিধায়। চাকরি হচ্ছে না? পাবে কোথা থেকে, সমস্ত টাকাই তো বেরিয়ে যাচ্ছে ঐ একলা মায়েদের সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণে! খাবার নেই? পাবে কোথা থেকে, সমস্ত টাকাই তো বেরিয়ে যাচ্ছে ঐ একলা মায়েদের সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণে! আমরা ব্যবহৃত হলাম সেই মায়েদের প্রতি ক্ষেপে ওঠার ‘হুজুগ’-এ।
উগান্ডায় ইদি আমিন এইভাবেই যাবতীয় ব্যর্থতার দোষ চাপিয়েছিলেন সেই দেশে বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয়দের ওপর। উগান্ডার জনসাধারণ সেই দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের প্রতি রুষ্ট হওয়ার ‘হুজুগ’-এ মেতেছিলেন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন উগান্ডার বহু বৈধ নাগরিক, ভারতীয় বংশোদ্ভূত হবার কারণে! পৃথিবী জুড়ে “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে”। সহজাত প্রবৃত্তি কাটিয়ে ওঠা অসাধ্য। সহজাত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা আবার দুঃসাধ্য। যিনি বা যাঁরা এই বিষয়ে সাফল্য লাভ করেছেন, তিনি বা তাঁরা অসাধারণ! তথাকথিত ভালো-মন্দের মাপকাঠিতে ভালো হলেও অসাধারণ, খারাপ হলেও অসাধারণ!
‘মানুষ’ নামক প্রত্যেক প্রাণীর ‘আত্ম’ সম্পর্কে এক/একাধিক বোধ কাজ করে। এরই সঙ্গে আর-একটা ব্যাপারও লক্ষ করা যায় যে অধিকাংশ মানুষ যা বলছেন, বা ভাবছেন, ভাবতে শুরু করেছেন, সেই ভাবনা-চিন্তাকেই আপন করে নেওয়া। উত্তর-সত্য যুগে এই প্রবণতা আরও ভালো করে উপলব্ধ হচ্ছে।
আরেকটু পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করলে বোধহয় সুবিধে হয়। এই তো কিছুদিন আগেই দেশের গুটিকয়েক রাজ্যের ভোটাভুটির ফলপ্রকাশ ও এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাফল্য নিয়ে মাতোয়ারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু, এমনটা ভাবা উচিত হবে না যে, কেবলমাত্র ঐ বিশেষ ‘রাজনৈতিক’ দলটাই সব জায়গায় একচেটিয়া ব্যবসা চালিয়েছে। একটা রাজ্যে তো কোনোরকমে হালখাতার মলাট উলটোতে পেরেছে মাত্র! কিন্তু সেই বিষয়ে কোনও বাক্যালাপই নেই সংবাদ মাধ্যমগুলোয়। বিপরীতে, বরং, যে রাজ্যে ঐ বিশেষ ‘রাজনৈতিক’ দল ‘সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জ্জন’ করেছে তাই নিয়ে মাধ্যমগুলো প্রসংশায় এমন পঞ্চমুখ, যেন মনে হচ্ছে সমগ্র দেশে তারাই একমাত্র আসীন! জনগণকে বারে বারে বারে বারে একই কথা, [খানিকটা hype বলা যায়] বলে বলে, repeat করে করে, সেই দলের ‘মহানতা’-কে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। [প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে যে, কোনও দেশ মানে কি সেই দেশের মধ্যাংশ, নাকি সীমারেখা অনুযায়ী সমস্ত ভূখণ্ড? প্রসঙ্গ : খোদ রাজধানীতে অরুণাচলের যুবক হত্যা!]
দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘বিনোদন’ মাধ্যমের কথাও তোলা যেতে পারে। সম্প্রতি এমন একটা সিনেমা তৈরি করা হয়েছে যেখানে বিশেষ একটা জাতির তথাকথিত exodus, কিছু গাল-গল্প এবং এমন একটা ভূ-খণ্ডের বিষয় উত্থাপিত যা আদৌ দেশের অংশ কিনা, তা নিয়ে অনেকের যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ রয়েছে! অথচ, একাধিক ‘জনপ্রিয়’ নেতা, অভি‘নেতা’ সোচ্চার হয়েছেন এবং এও বলছেন প্রকৃত দেশবাসী হলে অবশ্যই এই সিনেমাটা দেখা উচিত! অসংখ্য গোয়েব্ল্ চারিপাশে। কোনও সুপরিকল্পিত সাজানো ধারণাকে এইভাবেই মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আসলে ঐ জাতীয়তাবাদ নামক হুজুগ-কেই জাগিয়ে তোলার চেষ্টা। ষাটের দশকে এইভাবেই আমাদের দেশের এক বিশেষ কমিকস পত্রিকা বিভিন্ন বিপ্লবীর জীবন নিয়ে, নানান পুরাণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে অজস্র ঘটনার, গল্পের কথা, লেখা ও ছবিতে প্রকাশ করে বটে, কিন্তু সেগুলোকে কখোনোই উত্তর-সত্য স্থাপনের চেষ্টা বলা যায় না। সেগুলো আসলে ঘটনা এবং মিথের সংকলন। পাঠ করলে বিভিন্ন বিষয়ে একটা সম্যক ধারণা তৈরি হলেও হতে পারে।
কিন্তু, এখানে আমি যা বলার চেষ্টা করছি, তা একটু আলাদা। ‘সোভিয়েত দেশে টিনটিন’-এ সেই একটা দৃশ্য আছে না যেখানে অচল কলকারখানার ভিতরে খড়ের আঁটি পুড়িয়ে ধোঁয়া বের করে আর লোহা পিটিয়ে কৃত্রিম আওয়াজ-এর মাধ্যমে বিদেশি সাংবাদিকদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে দেশের অর্থনীতির ভিত কতটা মজবুত? এখন দেশের অবস্থা প্রায় তাই-ই। কোন্ জাতি কতটা ‘খত্রে মে হ্যায়’, তার চশমা পরিয়ে কিছু কৃত্রিমতা তৈরি আর তার সঙ্গে সঙ্গে সবই আপাদমস্তক অচল হতে থাকা [প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে] ব্যবস্থার ভিতরে নকল সফলতার ধোঁয়া, আওয়াজ সৃষ্টি করার পদক্ষেপই এই উত্তর-সত্যতা।
‘মানো ইয়া না মানো’, গান চালু হলেই উঠে দাঁড়াতে হবে, তাও আবার বিনোদন ক্ষেত্রে! এর চাইতে বড়ো জাতীয়তাবাদ প্রতিস্থাপন আর কি হতে পারে? অবশ্য, সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে গানের প্রতি যে দেশবাসীর সম্মান কতটা মারাত্মক, তা ইউটিউবেই আছে! ফলাফল খুব একটা সুখকর নয়! কিন্তু বিশ্বাস করানোর প্রক্রিয়াটা থামালে তো চলবে না।
কিন্তু যাই বলি না কেন, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানাগুলোকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই। এবং যদি কোনোদিন সমগ্র মানবজাতি [‘সামাজিক’ পশু] যদি সীমানাগুলোকে অস্বীকার করেন, তাহলে এই সময়ে দাঁড়িয়ে বলা সম্ভব নয় যে, হিত হবে, না বিপরীত হবে। নৈরাজ্যেরও একটা নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিন, নির্দিষ্ট অর্ডার আছে। যে ঘরে বাস করছি, সেই ঘরে যদি কিছু লোক ঢুকে ডাকাতি বা চুরি করার চেষ্টা করে, তাহলে বাধা দেবার প্রবৃত্তিটাও সহজাত। আমি যদি নিষ্ঠুর অত্যাচারী তৃতীয় ভ্লাদ হই অথবা কালোবাজারি করা জমিদার-ব্যবসায়ী হই তাহলেও বাধা দেব, যদি কুঁড়ে ঘরে মাধুকরী অবলম্বনে বেঁচে থাকা কোনও ব্যক্তি হই, তাহলেও দেব। অপরদিকে যাঁরা ছিনিয়ে নিতে আসছেন, তাঁরা যে সবসময়েই অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসছেন তা নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে। কিন্তু সংঘর্ষ হতে বাধ্য। যে যেমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে চান। ঔপনিবেশিক কোনও দেশে স্বাধীনতাকামী জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে সেই দেশের মানুষ পুজো করেন, অন্যদিকে উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশের চোখে ও লেখমালায় সেই যোদ্ধা হয়ে ওঠেন উগ্রপন্থী, ডাকাত, বদমায়েশ ইত্যাদি। দেশের মধ্যেও, আঞ্চলিক ক্ষেত্রবিশেষে, তথাকথিত উপদ্রুত এলাকায় ব্যক্তিপরিচয় নির্মিত হয় এইভাবেই। রাষ্ট্রের প্ররোচনায় শেষে রাস্তায় গুলি খেয়ে পড়ে থাকতে হয় সেইসব ব্যক্তিদের। বাঁচার উপায়ও অবশ্য আছে একাধিক। লম্বা দাড়ি রেখে আধ্যাত্মিক জগত নিয়ে মগ্ন রাজসাক্ষী হতে পারলেই দেশের মানুষ মাথায় তুলে নাচবে। চুপচাপ সব কার্যকলাপ ফাঁস করে দিয়ে ভোটের টিকিট হস্তগত করলেই দেশের মানুষ সব ভুলে তোমায়, তথাকথিত মূল স্রোতে, আপন করে নিতে দেরি করবে না।
যুদ্ধ-বিগ্রহ-জাতীয়তাবাদ সহজাত কবচকুণ্ডল। বর্তমানে ইউরোপের যে দুই দেশে এখন যুদ্ধ চলছে, তা ঠিক না বেঠিক, ভালো না মন্দ ইত্যাদি হিসেব-নিকেশে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সামাজিক পশুরাই দুই দলে বিভক্ত। অনেকে তো আবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল বলে আশা-আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন!
এরই মাঝে জাতীয়তাবাদের ডুগ্ডুগি, লাগ্ লাগ্ লাগ্ ভেল্কি… আর লেগে যা, নারদ, নারদ!