কথায়-সুরে জাতীয়তাবাদ

শুভাশিস ভট্টাচার্য

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে — জাতির মধ্যে যে ঐক্যভাব বর্তমান থাকে তাকে জাতীয়তাবাদ (Nationalism) বলে। একে ভাবগত ঐক্য বলা যায়; যে ঐক্যবোধ জনসমাজকে একই রাষ্ট্রের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করে, জাতির মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করে। জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেছেন, সংজ্ঞায়িত করেছেন বহুবিধ শব্দবিন্যাসে। কিন্তু সেই সকলের মূল সুরটি লুকিয়ে আছে ওই একই জায়গায়, এটি একটি এমন মানসিক অনুভূতি, যার প্রভাবে একটি নির্দিষ্ট জনসমাজের অন্তর্ভুক্ত সকল মানুষই নিজেদের, পৃথিবীর অপরাপর জনসমাজ বা জনগোষ্ঠীর থেকে স্বতন্ত্র পৃথক মনে করে। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি যা পরস্পরকে ভালোবাসতে শেখায় (“Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity”)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লয়েড জাতীয়তাবাদকে আধুনিক বিশ্বের ধর্ম বলে বর্ণনা করেছেন (“Nationalism may be called a religion because it is rooted in the deepest instincts of man”)। অপরদিকে লেনিন নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত ও নির্যাতিত জাতির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে জাতীয়তাবাদকে দেখেছেন। আবার জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব, যেখানে কোনোরকম সংকীর্ণতার স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ (Nationalism) গ্রন্থে (১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা দেন, সেগুলি নিয়েই তার ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়) জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়ো। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। 

জাতীয়তাবাদী চেতনা বারবার প্রভাবিত করেছে মানব সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে। এই বাংলা বা ভারতবর্ষও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতেও জাতীয়তাবাদের প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে অনিবার্যভাবেই, জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সাথে সাথেই। আবার জাতীয়তাবাদী সংগীত বা স্বদেশপ্রেমের গানের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। 

বাংলা গানের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তবে, বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতে স্বদেশভাবনা বা জাতীয়তাবোধের আগমণ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে। এর আগে চর্যাপদ থেকে সাধক রামপ্রসাদের গান পর্যন্ত প্রায় সাতশো বছরের বাংলা সাহিত্যে স্বদেশ সম্পর্কিত গান বা কাব্যের উদাহরণ নেই। কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, এদেশে ইংরেজ শক্তির আগমণের আগে স্বদেশ চেতনার প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। দেশের শাসনভার ব্রিটিশ রাজশক্তির হস্তগত হলে, পরাধীনতার বোধ জন্ম নেয় এবং পরিপুষ্ট করে আমাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনাকে। প্রকৃতপক্ষে সব ভাষাতেই স্বদেশি গান রচনার সাথে দেশের বিপর্যয় বা বিপন্নতার এক নিবিড় যোগাযোগ আছে। 

বাংলা গানে জাতীয়তাবোধ বা স্বদেশপ্রেমের প্রবেশ এই মাটিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সাথে সাথেই। এই ধরনের গানগুলির উপজীব্য বিষয় স্বদেশপ্রেম, দেশকে মাতৃজ্ঞানে বন্দনা করে মাতৃভূমির প্রাকৃতিক রূপ এবং ঐশ্বর্যের মহিমা বর্ণনা, দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা অটুট রাখার সংকল্প, জন্মভূমির আত্মিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের গৌরবগাথা এবং স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও একাত্মবোধ। 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আমেরিকা, ইউরোপ এবং বহির্বিশ্বের নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা বাঙালি শিক্ষিত সমাজকে ভাবিয়েছিল, প্রভাব বিস্তার করেছিল তাঁদের চিন্তায় এবং মননে। তাঁরা ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্যের স্বদেশপ্রেমের উদ্দীপনামূলক সাহিত্য থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। তাঁরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন স্কট, বায়রন প্রমুখের কবিতায়। এ সবের সমাহারই উনিশ শতকে বাঙালির মনে স্বদেশচেতনার সঞ্চার করেছিল, যা প্রতিফলিত হয়েছে কাব্যে বা গানে। অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর আদর্শে অনুপ্রাণিত, হিন্দু কলেজের ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের লেখা ইংরাজি কবিতা ও গল্পের মধ্যে পাওয়া গেল স্বদেশপ্রেমের স্পর্শ। জাতীয়তাবাদী চিন্তার সেই উষালগ্নে, প্রগতিশীল বাঙালির নয়নের মণি, ডিরোজিও লিখলেন স্বদেশপ্রেমের কবিতা, ভারতবর্ষকে নিয়ে। ভারতবর্ষকে নিয়ে লেখা এটিই প্রথম দেশাত্মবোধক কবিতা। কবিতায় তিনি বন্দনা করলেন লুপ্তগৌরব, বেদনামলিন এই দেশের। ‘To My Native-Land’ শীর্ষক কবিতায় লিখলেন — 

‘My country! in the days of glory past                                                                                             A beautious halo circled around thy brow,                                                                                   And worshipped as a deity thou wast—                                                                                    Where is the glory, where the reverence now?                                                                            Thy eagle pinion is chained down at last,                                                                                      And grovelling in the lowly dust art thou,                                                                                   Thy minstrel hath no wreath to weave for thee,                                                                            Save the sad story of the misery! 
Well — Let me dive into the depths of time,                                                                                 And bring from out of the ages that have rolled                                                                            A few small fragments of these wrecks sublime                                                                        Which human eye may never more behold;                                                                                And let the guerdon of my life labour be,                                                                                    My fallen country! One kind wish for thee!’ 

পরবর্তীতে কবিতাটির বঙ্গানুবাদ করলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাম দিলেন ‘জন্মভূমির প্রতি’। কয়েকটি পঙক্তি এইরকম — 

‘স্বদেশ আমার, কিংবা জ্যোতির মণ্ডলী                                                                                              ভূষিত ললাট তব; অস্তে গেছে চলি                                                                                                  সেদিন তোমার; হায় সেই দিন যবে                                                                                                     দেবতা সমান পূজ্য ছিলে এই ভবে!                                                                                                  কোথায় সে বন্দ্যপদ! মহিমা কোথায়                                                                                        গগনবিহারী পক্ষী ভূমিতে লুটায়!                                                                                                   বন্দীগণ বিরচিত গীত উপহার                                                                                                          দুঃখের কাহিনী বিনা কিবা আছে আর?’ 

কাব্যে জাতীয়তাবোধ বা স্বদেশপ্রেমের প্রবেশ লক্ষ্য করা যায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায়। পরবর্তীকালে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় (‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে’), হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (‘বিংশতি কোটি মানবের বাস’), মধুসূদন দত্ত, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখের কাব্যেও জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশপ্রেমের উপস্থিতি সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে কবি এবং গীতিকারেরা জাতীয়তাবাদী গান রচনায় অনুপ্রাণিত হলে বাংলা সংগীতে এক নতুন ধারার সংযোজন ঘটে। 

সিপাহি বিদ্রোহ এবং সমকালীন আরও বেশ কিছু ঘটনা যেমন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বিধবা বিবাহ’-আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এবং স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের আন্দোলন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ‘ব্রাহ্মধর্ম’ প্রচার ইত্যাদি বাঙালি সমাজকে আলোড়িত করেছিল, জাগৃতির সহায়ক হয়েছিল। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে পীড়িত আন্দোলনরত গ্রামবাংলার চাষিদের চরম দুঃখ, বেদনা ভাষা খুঁজে পেল। সামাজিক চিন্তা দেশবাসীকে দেশাত্মবোধের দিকে পরিচালিত করতে, দেশ সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি, নব চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সমর্থ হল। মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষার জন্য গর্ববোধ সিঞ্চিত হল জনমানসে, স্থান পেল কাব্যে, গানে। মাতৃভাষার গৌরবগাথা স্থান পেল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘স্বদেশ’, ‘মাতৃভাষা’, মাইকেল মধুসূদন দওের ‘ভারত-ভূমি’, ‘বঙ্গভাষা’, ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ ইত্যাদি কবিতায়। বাংলা ভাষায় ‘টপ্পা’ গানের জনক নিধুবাবু (রামনিধি গুপ্ত) মাতৃভাষার জয়ধ্বনি করতে লিখলেন গান — 

‘নানান দেশে নানান ভাষা                                                                                                               বিনে স্বদেশীয় ভাষা পূরে কি আশা?                                                                                                     কত নদী সরোবর,                                                                                                                             কি বা ফল চাতকীর।                                                                                                                   ধরাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?’

বাংলা গানে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে মূলত ‘চৈত্রমেলা’ বা ‘হিন্দুমেলা’-র প্রবর্তনে। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু মহাশয় শিক্ষিত বাঙালি মননে জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে ‘Prospectus for the Promotion of National Feeling Among the Educated Natives of Bengal’ নামে একটি অনুষ্ঠানপত্র রচনা করেন। সম্পাদক নবগোপাল মিত্র এটি তাঁর ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেন এবং এই রচনা পাঠ করে তাঁর মনে একটি জাতীয় সভা প্রতিষ্ঠার অভিলাষ জন্মায়। এরই ফলশ্রুতিতে নবগোপাল মিত্রের আন্তরিক উদ্যোগে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির গণ্যমান্য সদস্যবৃন্দ, (এঁদের মধ্যে গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) রাজনারায়ণ বসু এবং মনমোহন বসু প্রমুখের সহযোগিতায় ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল (চৈত্র সংক্রান্তি, ১২৭৩ বঙ্গাব্দ) ‘হিন্দুমেলা’-র প্রতিষ্ঠা হয়। এই মেলার পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা কমলকৃষ্ণ, রমানাথ ঠাকুর, কাশীশ্বর মিত্র, দুর্গাচরণ লাহা, প্যারীচরণ সরকার, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণদাস পাল, পণ্ডিত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, পণ্ডিত ভারতচন্দ্র শিরোমণি, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। প্রথম তিন বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাই একে ‘চৈত্রমেলা’ বলা হত। পরবর্তীকালে ওই একই মেলা ‘হিন্দুমেলা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। 

হিন্দু মেলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন নবগোপাল মিত্র। মেলা উপলক্ষ্যে গণেন্দ্রনাথ (গিরীন্দ্রনাথ ও যোগমায়া দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, জন্ম ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দ এবং মৃত্যু ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখলেন স্বদেশভাবনার গান — ‘লজ্জায় ভারতযশ গাইবো কী করে/ লুটিতেছে পরে এই রত্নের আকরে’। গানটি হিন্দু মেলায় বহুবার গীত হয়। 

হিন্দুমেলার মোট চতুর্দশটি অধিবেশন হয়। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে এই মেলা উপলক্ষ্যে বহু জাতীয়তাবাদী, স্বদেশ সংগীত রচিত ও গীত হয়েছিল। সবকটি গানের বিস্তারিত তথ্য এবং গীতিকারের নাম পাওয়া সম্ভব না হলেও, তৎকালীন ইতিহাস এবং বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, হিন্দুমেলার বিভিন্ন অধিবেশনে গীত গানগুলির মধ্যে বেশ কিছু গান অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই সকল গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল — নাট্যকার, কবি, ‘মধ্যস্থ’ পত্রের সম্পাদক কবি মনমোহন বসুর লেখা গান ‘দিনের দিন সবে দীন হয়ে পরাধীন/ অন্নাভাবে শীর্ণ চিন্তাজ্বরে জীর্ণ অপমানে তনু ক্ষীণ’, গোবিন্দচন্দ্র রায়ের  বিখ্যাত ‘ভারত বিলাপ’ কাব্যগীতিতে উল্লেখিত — ‘কতকাল পরে, বল ভারত রে/ দুঃখ সাগর সাঁতারি পার হবে’; দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের বড়দা) রচিত ‘মলিন মুখচন্দ্ৰমা ভারত তোমারি রাত্রি দিবা ঝরিছে লোচন বারি’ এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের মেজদা) রচিত গান — ‘জয় ভারতের জয়’। শেষোক্ত গানটি হিন্দুমেলায় গীত গানগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গানটি মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে গাওয়া হয়েছিল। এ গানের প্রথম কয়েকটি পঙক্তি এইরকম — 

                           ‘মিলে সবে ভারতসন্তান                                                                                                                
                              একতান মন-প্রাণ                                                                                                                           
                            গাও ভারতের যশোগান।                                                                                                         
                        ভারতভূমির তুল্য আছে কোন্ স্থান?                                                                                                   
                        কোন্‌ অদ্রি অভ্রভেদী হিমাদ্রি সমান?                                                                                             
                  ফলবতী বসুমতী              স্রোতস্বতী পুণ্যবতী                                                                                     
                            শতখনি রত্নের নিধান!                                                                                                                            
                     হোক ভারতের জয়, জয় ভারতের জয়, গাও                                                                                        
                               ভারতের জয়’। 

গানটিকে সেই সময়ে জাতীয়সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই গানের প্রশস্তিতে বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় (‘বঙ্গদর্শন’, চৈত্র ১২৭৯ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৫৭১-৭৬) লিখেছিলেন— “এই মহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক। হিমালয়কন্দরে প্রতিধ্বনিত হউক! গঙ্গা যমুনা সিন্ধু নর্মদা গোদাবরী তটে বৃক্ষে বৃক্ষে মর্মরিত হউক‌! পূর্ব পশ্চিম সাগরের গম্ভীর গর্জনে মন্দীভূত হউক! এই বিংশতি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়যন্ত্র ইহার সহিত বাজিতে থাকুক”। এই গানই সম্ভবত তাঁকে পরবর্তীকালে 

‘বন্দেমাতরম্‌’ লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথের এই গানের প্রভাবে সরলা দেবী চৌধুরাণীও ‘নমো হিন্দুস্থান’ নামে একটি গান রচনা করেছিলেন। এই গানটি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় গাওয়া হয়েছিল। এই গানের কথাগুলিতে চোখ রাখলেই সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব ধরা পড়ে — 

‘অতীত-গৌরববাহিনী মম বাণী! গাহ আজি হিন্দুস্থান।                                                                      মহাসভা উন্মাদিনী মম বাণী! গাহ আজি হিন্দুস্থান।                                                                               কর বিক্রম-বিভব-যশ-সৌরভ পূরিত সেই নামগান।                                                                                বঙ্গ, বিহার, উত্‌কল, মাদ্রাজ, মারাঠ, গুর্জর, পঞ্জাব, রাজপুতান                                                                     হিন্দু, পার্শি, জৈন, ইশাই, শিখ, মুসলমান                                                                                             গাও সকল কণ্ঠে, সকল ভাষে — ‘নমো হিন্দুস্থান’।                                                                                     জয় জয় জয় হিন্দুস্থান — নমো হিন্দুস্থান।।’ 

হিন্দুমেলার মধ্যে দিয়ে ভারতের জাতীয়তাবোধের প্রাণসঞ্চার হয়েছিল এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর সাতের দশক থেকে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক অধিকারবোধ। সে অধিকার পেতে গঠিত হয় ‘ভারতসভা’(১৮৭৬)। পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয় মহাসভা স্থাপন, ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা, ‘আনন্দমঠ’ প্রকাশ, ইলবার্ট বিল নিয়ে আন্দোলন এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারাদণ্ড ইত্যাদি ঘটনা দেশবাসীকে আরও গভীরভাবে রাজনীতি সচেতন করে তুলল, অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল সর্বভারতীয় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন বা ‘ভারত সভা’ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে যে বীজ প্রোথিত হয়েছেল, তা ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণতা পেল। 

সর্বভারতীয় একতাই ছিল কংগ্রেসের আদর্শ। সে আদর্শের কথা মাথায় রেখে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেন এবং রামপ্রসাদি সুরে গাইলেন সে গান, কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে, ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় ১৫ বছর পর (১৮৯৬) কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে, কলকাতার বিডন স্কোয়্যারে সুরারোপ করে গাইলেন সেই গান, যা পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মূলমন্ত্র — ‘বন্দেমাতরম্‌’! ওই অধিবেশন চলাকালীন সময়েই প্রতিনিধিদের ঠাকুরবাড়িতে অভ্যর্থনা করেন সদ্য রচিত দেশমাতৃকার স্তবগীত ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’ গানটি শুনিয়ে। সেদিন আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা ব্যারিস্টার মি. মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। 

কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং সেখানে দেশের সকল শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব স্বীকৃতি লাভ করায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তাও স্পষ্ট হল স্বদেশপ্রেমের চিন্তায়। জাতীয়তাবোধের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক জনজাগরণ ঘটেছিল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তা পূর্ণ বিকাশ লাভ করল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। আপামর বাঙালির কাছে এই আন্দোলন হয়ে উঠল এক চরম পরীক্ষা। বঙ্গভঙ্গের পটভূমিকায় জাতীয়তাবাদী আবেগ জন্ম দিল অগণিত গানের। একে গানের প্লাবন বললেও অত্যুক্তি হবে না। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মুকুন্দ দাস প্রমুখের কলম সৃষ্টি করল কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের। 

১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ, সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনটিকে জাতির দুর্ভাগ্যের দিন হিসাবে চিহ্নিত করে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হল। রাখিবন্ধন উৎসবের পুরোভাগে রইলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। গান লিখলেন, রাজপথে মিছিল করে সকলকে রাখি পরিয়ে দিতে দিতে গাইলেন সেই গান — 

           ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—                                                                              
                পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’। 

সেদিনের রাখিবন্ধন উৎসবের শোভাযাত্রার কথা স্মরণ করে পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘এই রাখী উৎসবে বীরু মল্লিকের আস্তাবলের মুসলমান সহিস থেকে চিৎপুরের বড় মসজিদের মৌলবী পর্যন্ত কাউকে রাখী পরাতে বাকি রইল না’। সেদিন বিকেলে অপর এক শোভাযাত্রায় সমবেত কন্ঠে গীত হল রবীন্দ্রনাথের আরও একটি গান — 

                   ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান                                                                                           
                          তুমি কি এমন শক্তিমান!                                                                                                             
                 আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান                                                                            
                         তোমাদের এমনি অভিমান’। 

বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ২৬টি দেশাত্মবোধক গান রচনা করলেন। সমগ্র বাঙালি জাতি আলোড়িত হল সেই গানে। কালোত্তীর্ণ সেই গানগুলির মধ্যে একটি গান ছিল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ — যা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। 

সমগ্র বাঙলা তখন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল। পাশাপাশি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিদেশি শাসকের দমনমূলক অত্যাচারও হয়ে উঠল মাত্রাছাড়া। মাত্র ১৫ বছর বয়সী কিশোর সুশীল সেনকে, জনৈক পুলিশ ইনস্পেকটরকে আঘাত করার অপরাধে বেত্রাঘাতের আদেশ দিলেন কিংসফোর্ড। বেত্রাঘাত সহ্য করেও কিশোর রইলেন অনমনীয়। প্রতিটি আঘাতের পরেই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল স্বদেশপ্রেমের মহামন্ত্র— ‘বন্দেমাতরম’! এই ঘটনার অভিঘাতে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ লিখলেন গান — 

                       ‘মাগো, যায় যেন জীবন চলে                                                                                                                          
                        শুধু জগৎমাঝে তোমার কাজে                                                                                                  
                           ‘বন্দেমাতরম’ বলে।                                                                                                                         
                        আমার যায় যেন জীবন চলে।                                                                                                                 
                        - - - - - - - - - -                                                                                                                            
                        - - - - - - - - - -                                                                                                                              
                       আমায় বেত মেরে কি মা ভুলাবে                                                                                                       
                         আমি কি মার সেই ছেলে?                                                                                                                
                        দেখে রক্তারক্তি বাড়বে শক্তি                                                                                                                
                          কে পালাবে মা ফেলে?                                                                                                                            
                        আমার যায় যাবে জীবন চলে’। 

কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদের লেখা আরও দুটি গান সে সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল— একটি ‘ভাইসব চেয়ে দ্যাখ্‌ বাজার ছেয়ে’ এবং অপরটি হিন্দিতে লেখা গান — ‘দেশ্‌কা এ ক্যা হাল’। 

অপরাপর গীতিকার ও কবিদের কলম রচনা করল দেশাত্মবোধক গানের স্বর্ণ-অধ্যায়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখলেন — 

‘বঙ্গ আমার জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ!                                                                                  কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য, কিসের লজ্জা, কিসের ক্লেশ                                                                       সপ্তকোটি মিলিত কণ্ঠে ডাকে যখন — আমার দেশ…’ 

বাংলা গানে পাশ্চাত্য সুররীতির সঙ্গে ভারতীয় রাগ-রাগিণীর মিশেল ঘটিয়ে অপূর্ব মিশ্রধারা তৈরি করলেন অসাধারণ মুন্সিয়ানায়। বাংলার মানুষ আবিষ্ট হল সেই গানে। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘প্রতাপসিংহ’ নাটকের ‘ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে’, ‘সাজাহান’ নাটকের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা… সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ ইত্যাদি গানগুলি তাঁর একান্ত নিজস্ব, স্বতন্ত্র শৈলীর উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’ গানটি প্রায় জাতীয় সংগীত পর্যায়ের হয়ে উঠেছিল। 

রজনীকান্ত সেনের গানে চিত্রিত হল দেশবন্দনা, দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, দেশের তৎকালীন বেদনাবিধুর মুখচ্ছবি। ফুটে উঠল ‘বয়কট’ আন্দোলনের মর্মবাণী —

                          ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়                                                                                                             
                            মাথায় তুলে নে রে ভাই;                                                                                                                       
                           দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের                                                                                                                 
                           তার বেশি আর সাধ্য নাই’। 

প্রায় একই অনুভূতির ছবি ধরা পড়ল আরও একটি গানে — 

                      ‘আমরা নেহাত্‌ গরীব আমরা নেহাত্ ছোট;                                                                                               
                       তবু আজি সাত কোটি ভাই জেগে ওঠো।                                                                                               
                         জুড়ে দে ঘরের তাঁত সাজা দোকান;                                                                                                    
                         বিদেশে না যায় ভাই গোলারই ধান;                                                                                                
                       আমরা মোটা খাব, ভাই রে পরবো মোটা;                                                                                         
                        মাখবো না ল্যাভেন্ডার, চাই নে ‘অটো’।’ 

দেশমাতৃকার বর্ণনায় কথা এবং সুর উভয়ের কোমলতার মেলবন্ধনে যথাযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছিল কান্তকবির দেশের প্রতি আবেগ এবং প্রেম। দুটি গানের কথা না উল্লেখ করলে অন্যায় হবে। প্রথমটি — 

                               ‘ভারতকাব্যনিকুঞ্জে                                                                                                                                   
                              জাগো সুমঙ্গলময়ী মা!                                                                                                                  
                              মুঞ্জরি তরু, পিক গাহি,                                                                                                                  
                              করুক প্রচারিত মহিমা!’                                                                                                          
                              ................                                                                                                                                 
                            ‘নীতি-ধর্ম-ময় দীপক মন্দ্রে,                                                                                                           
                              জীবিত কর সঞ্জীবনমন্ত্রে,                                                                                                                      
                             জাগিবে রাতুল-চরণ-তলে,                                                                                                                
                             যত, লুপ্ত পুরাতন গরিমা’। 

এবং অপরটি — 

                             ‘তব চরণ নিম্নে উৎসবময়ী                                                                                                          
                                 শ্যামধরণী সরসা,                                                                                                                                   
                               ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত মণি                                                                                                                   
                               রঞ্জিত নভোনীলাঞ্চলা,                                                                                                                                                                              
                               সৌম্য মধুর দিব্যাঙ্গনা                                                                                                                     
                                শান্ত-কুশল-দরশা’। 

অতুলপ্রসাদ সেনের গানে দেশের অতীত গৌরবগাথা ধ্বনিত হবার পাশাপাশি চিত্রিত হল স্বদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নের ছবি — 

                     ‘বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে,                                                                                                                 
                     ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।                                                                                         
                         ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে,                                                                                                           
                     নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পুরবে’! 

ভারতমাতাকে দেবীলক্ষ্মীরূপে বর্ণনা করে আহ্বান জানালেন জনজাগরণের — 

                 ‘উঠ গো, ভারত লক্ষ্মী! উঠ আদি জগত-জন-পূজ্যা!                                                                             
                    দুঃখ দৈন সব নাশি’, কর দূরিত ভারত লজ্জা।                                                                                  
                       ছাড়গো, ছাড় শোক-শয্যা, কর সজ্জা                                                                                                       
                          পুনঃ কমল-কনক-ধন-ধান্যে’! 

বয়কট আন্দোলনের সঙ্গে যে গানটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, যে গান অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল তৎকালীন বঙ্গসমাজে সেই গানটির রচয়িতা, দেশাত্মবোধক গান রচনার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য একটি নাম — চারণকবি মুকুন্দ দাস। গানটি হল — 

                         ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী;                                                                                                                  
                            কভু হাতে আর পোরোনা!                                                                                                                
                          জাগো গো ও জননী ও ভগিনী                                                                                                          
                           মোহের ঘুমে আর থেকোনা’! 

মুকুন্দ দাসের গানের উত্তাপ আগুন ধরিয়ে দিল মানুষের রক্তে, হৃদয়ে দিল দোলা। দেশকে জড় না ভেবে চৈতন্যময়ী শক্তিমূর্তি জ্ঞান করে, সেই মাতৃমন্ত্রের দীক্ষা এবং আত্মবলিদানের সংকল্প নিয়ে একজন যোদ্ধার মতো তিনি বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার আহ্বান জানালেন তাঁর গানে — 

                         ‘দশ হাজার প্রাণ আমি যদি পেতাম                                                                                                         
                          তবে ফিরিঙ্গী বণিকের গৌরব-রবি —                                                                                                 
                            অতল জলে ডুবিয়ে দিতাম। 
                              শোন ভাই সব স্বদেশী,                                                                                                                      
                             হিন্দু মোছলেম ভারতবাসী —                                                                                                                        
                             পারি কিনা ধরতে অসি,                                                                                                                  
                             জগৎ কে তা দেখাইতাম’। 

উল্লেখনীয় আরও একটি গান — 

                          ‘বন্দে মাতরম্‌ বলে নাচরে সকলে                                                                                                       
                                কৃপাণ লইয়া হাতে।                                                                                                                      
                             দেখুক বিদেশী হাস অট্টহাসি                                                                                                           
                            কাঁপুক মেদিনী ভীম পদাঘাতে’। 

অত্যন্ত স্পষ্ট এবং চাঁছাছোলা ভাষায় মুকুন্দ দাস তাঁর গানে বললেন সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা পরিহারের কথা। গাইলেন — 

                            ‘রাম রহিম না জুদা কর ভাই                                                                                                                  
                                মনটা খাঁটি রাখ জী।                                                                                                                      
                               দেশের কথা ভাব ভাইরে                                                                                                                   
                               দেশ আমাদের মাতাজী।।                                                                                                                
                            হিন্দু মুসলমান এক মায়ের ছেলে                                                                                                         
                                তফাৎ কেন কর জী;                                                                                                                   
                               দু’ভাইয়েতে দু’ঘর বেঁধে,                                                                                                                       
                               করি একই দেশে বসতি’। 

অপর একটি বহুশ্রুত গানেও পাই মাতৃভূমির সাথে রণরঙ্গিণী মাতঙ্গীর তুলনা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর — 

                             ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে                                                                                                           
                             মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।                                                                                                
                                  ............                                                                                                                                         
                              সাজরে সন্তান হিন্দু মুসলমান                                                                                                              
                           থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ’। 

বঙ্গভঙ্গ যুগের গীতিকারদের মধ্যে মুকুন্দ দাসের গানেই স্বদেশপ্রেমের উত্তেজনা সর্বাধিক প্রকাশ পেয়েছিল। সহজ সরল কথা, গভীর আবেদন এবং মাটির সুরের স্পর্শে গানগুলি প্রাণ পেয়েছিল, জনমানসে স্বদেশপ্রেমের আদর্শ এবং আবেগ সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এখানেই স্রষ্টার সার্থকতা, ভূষিত হলেন চারণকবি আখ্যায়। 

বঙ্গভঙ্গ যুগের স্বদেশি গানগুলির সঙ্গে হিন্দুমেলার সময়কার গানগুলির মধ্যে মূলগত কিছু তফাত ধরা পড়ে। বঙ্গভঙ্গ যুগের গানগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট ছিল সংগ্রামী মনোভাব, শাসকের অন্যায় আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের উদ্যোগ এবং সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, মুকুন্দ দাস প্রমুখের পাশাপাশি স্বল্পখ্যাত, অখ্যাত, অজ্ঞাত বহু কবি, গীতিকার, পল্লিকবি রচনা করেছিলেন অসামান্য জাতীয়তাবোধে উদ্দীপিত গান। সেগুলির অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও কিছু গান আজও খুঁজে পাওয়া যায়। এমনই কয়েকটি গান — কামিনী কুমার ভট্টাচার্যের ‘অবনত ভারত চাহে তোমারে/ এসো সুদর্শনধারী মুরারি/ নবীন তন্ত্রে নবীন মন্ত্রে/ কর দীক্ষিত ভারত নরনারী’, বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ‘হবে পরীক্ষা তোমার দীক্ষা অগ্নিমন্ত্রে কি না’ ইত্যাদি। অনেকে হয়তো বিশেষ কোনও কারণ বা ঘটনাকে অবলম্বন করে গান রচনা করেছিলেন, কিন্তু তা প্রকাশিত না হওয়ায় পরবর্তীকালে হারিয়ে যায়। অথচ যাঁরা এই গান শুনেছিলেন, তাঁদের কারও কারও স্মৃতিতে সেই গান জাগরুক হয়ে রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ একটি গানের উল্লেখ করা যেতে পারে যে গানের উল্লেখ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাগনি সাহানা দেবী তাঁর স্মৃতিচারণায় করেছেন — 

              ‘ক্ষুদিরাম গেল হাসিতে হাসিতে ফাঁসীতে করিতে জীবন শেষ                                                                  
                পাপিষ্ঠ নরেনে বধিল কানাই, সত্যেন ধন্য করিল দেশ’। 

১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর, বঙ্গভঙ্গ রদ হল। ওই বছরেই ২৬-২৮ ডিসেম্বর কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশন বসেছিল উত্তর কলকাতার গ্রিয়ার পার্কে, (বর্তমান সাধনা সরকার উদ্যান)। ২৬ ডিসেম্বর যথারীতি ‘বন্দেমাতরম’ উদ্বোধনী সংগীতে সভা শুরু হল। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর অধিবেশন বসল বেলা বারোটায়। শুরুতেই সরলা দেবীচৌধুরাণীর নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়েছিল ‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা’। 

রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশ সংগীতগুলিই এই যুগের অন্যতম প্রাপ্তি। তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলিকে সময়ের হিসাবে প্রাক্‌বঙ্গভঙ্গ যুগের গান (১৮৮৬-১৯০৪), বঙ্গভঙ্গ যুগের গান (১৯০৫-১৯১১) এবং বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী যুগের গান, মোটামুটি এই তিনটি ভাগে ভাগ করলে দেখা যাবে মাঝের পর্বেই তিনি সবথেকে বেশি স্বদেশগীতি রচনা করেছেন। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথের এই গানগুলিতে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলির থেকেও স্বাদেশিকতার ভাবই অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ১৯০৫-১৯১১ এই সময়কালের আলোড়ন ও উন্মাদনায় অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলি রচনা করেছিলেন সেগুলি আজও স্বমহিমায়, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, যে কোন মানদণ্ডের বিচারেই সর্বশ্রেষ্ঠ।  

বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী যুগে বাংলা কাব্য ও সংগীত রচনার ক্ষেত্রে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন দুখু মিয়াঁ, যিনি পরবর্তীকালে ‘বিদ্রোহী কবি’ পরিচিতি লাভ করেন, সেই কাজী নজরুল ইসলাম। দেশমাতৃকার বন্দনায়, পরাধীনতার বিরুদ্ধে, শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন তাঁর গান ও কবিতায়। স্বদেশ বন্দনার কয়েকটি উল্লেখনীয় গান, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’, ‘নমো নমো নমো বাংলাদেশ মম চির-মনোরম চির মধুর’, ‘আমার দেশের মাটি/ ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’ ইত্যাদি। স্বদেশি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণদল উদ্দীপিত হল তাঁর আগুন ঝরানো গানে। সমবেত কণ্ঠে উঠল নবদিনের তূর্যবাদক এই কবির গান — 

                  ‘কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,                                                                                         
                       রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।                                                                                               
                              ওরে ও তরুণ ঈশান!                                                                                                                     
                             বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!                                                                                                                  
                        ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি’। 

কিম্বা — 

                    ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল                                                                                                
                     এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।                                                                              
                      তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়                                                                                    
                      ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন ভয়                                                                                      
                       এই বাঁধন পরেই বাঁধন ভয়কে করব মোরা জয়                                                                                         
                       এই শিকল বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙ্গা কল’। 

স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী সেনানী এবং সেনাপতিদের সতর্ক করে গাইলেন — 

‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার                                                                                         লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!                                                                                  দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,                                                                       ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?                                                                                 কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।                                                                                   এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার’। 

লিখলেন কিষানের গান (‘ওঠ্‌রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙ্গল’), শ্রমিকের গান (‘ওরে ধ্বংসপথের যাত্রীদল, ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল’), রক্ত পতাকার গান (‘ওড়াও ওড়াও লাল নিশান’) এবং ‘অন্তরন্যাশনাল সংগীত’। এই গানটি সম্পর্কে কিছু তথ্য বোধহয় জরুরি হয়েই পড়ে। ১৯২৬ সালে মুজফফর আহমেদ ‘ইন্টারন্যাশনাল সংগীত’-এর বাংলায় অনুবাদ করার জন্য নজরুলকে বলেন। নজরুল তখন এই গানের একটি ইংরাজি অনুবাদ চেয়েছিলেন। বহু চেষ্টা করেও মুজফফর আহমেদ ইংরাজি সেই অনুবাদটি জোগাড় করতে ব্যর্থ হলেন। কোনও উপায় না দেখে শেষে মুজফফর আহমেদের ৩৭, হ্যারিসন রোডের বাড়িতে বসেই নজরুল এই গানটির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গানের নামকরন করলেন ‘অন্তরন্যাশনাল সংগীত’।  

                       ‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত                                                                                                         
                           জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!                                                                                                                
                         যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি’                                                                                                       
                       হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী,                                                                                                    
                   নব জনম লভি’ অভিনব ধরণী ওরে ওই আগত’। 

হিন্দুমেলার সময় থেকে স্বদেশি যুগ পর্যন্ত সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময়ে (১৮৬৭ – ১৯১১) অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান রচিত হলেও অসহযোগ আন্দোলনের সময় তেমন গান বিশেষ রচিত হয়নি। মুকুন্দদাসের স্বদেশি যাত্রা-র কাহিনিতে অসহযোগ আদর্শের খানিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে গান্ধিজির অসহযোগ আদর্শে, চরকার শব্দে কাজী নজরুল খুঁজে পেলেন স্বরাজের আগমন বার্তা। তিনি তাঁর চরকার গানে বললেন — 

                  ‘ঘোর রে ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর                                                                                         
                   ওই স্বরাজ-রথের আগমনি শুনি চাকার শব্দে তোর                                                                               
                             তোর ঘোরার শব্দে ভাই                                                                                                                       
                             সদাই শুনতে যেন পাই                                                                                                                     
                   ওই খুলল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই।                                                                                           
                 ঘুরে আসল ভারত-ভাগ্য-রবি, কাটল দুখের রাত্রি ঘোর’। 

বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী অসহযোগ পর্যায়ে নতুন স্বদেশি গান অনুপস্থিত ছিল ঠিকই কিন্তু, ততদিনে বাঙালির স্বদেশি গানের একটি ঐতিহ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বন্দেমাতরম্‌ গানটিও সেই সময়কালে সর্বভারতীয় প্রসিদ্ধি এবং জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করেছিল। ‘বন্দেমাতরম্‌’ শব্দবন্ধ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের মহামন্ত্র। হিন্দুমেলার সময় থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়া পর্যন্ত সময়কালে সৃষ্ট অগণিত দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে অসহযোগ পর্যায়ের ভাবগত একাত্মতা থাকায় সেই গানগুলিই বারবার গাওয়া হচ্ছিল। এই গানগুলির মর্যাদা এবং ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।    

স্বদেশি গানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে যে কয়েকটি গানের কথা অনিবার্যভাবে এসে পড়ে সেগুলির মধ্যে অন্যতম একটি গান — 

                        ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,                                                                                                         
                      হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী’ 

শহিদ ক্ষুদিরামের স্মরণে এই গান রচিত হয়েছিল এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই গানটির স্রষ্টা কে তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই বাংলা দেশাত্মবোধক গানটি রচনা ও সুর করেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস আবার কারও কারও মতে এ গানের স্রষ্টা মুকুন্দ দাস। 

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ, স্বাধীনতা লাভের পরের বছরে গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর কথায় সুরারোপ করে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দে রেকর্ড করলেন দু-খানি গান। যার একটি গানের কথাগুলি — 

                        ‘আজ কাশ্মীর হ’তে কন্যাকুমারী                                                                                                        
                              ইম্ফল হ’তে সিন্ধু                                                                                                                            
                           চঞ্চল হ’ল প্রতিটি প্রাণের                                                                                                                       
                               প্রতিটি রক্তবিন্দু।                                                                                                                     
                             ...............                                                                                                                                     
                             শত বরষের শৃঙ্খলগুলি                                                                                                                  
                         একটি আঘাতে যাবে আজ খুলি                                                                                                            
                          যদি ভুলে যাই কে বা মুসলিম                                                                                                                  
                            কে বা শিখ, কে বা হিন্দু’। 

অপরটি আর এক কালজয়ী গান — 

                    ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান                                                                                   
                              লেখা আছে অশ্রুজলে                                                                                                                      
                   কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা বন্দিশালার ওই শিকল ভাঙা                                                                        
                           তারা কী ফিরিবে আর সুপ্রভাতে,                                                                                                          
                          যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে’। 

বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময় থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ, এই সময়কালের মধ্যে ভারত তথা বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটে গিয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ইতালির মুসোলিনি এবং জার্মানির হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ওই দুই দেশে। এ দেশের রাজনীতিও যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির থেকে পৃথক নয় এই উপলব্ধি থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক মঞ্চ গঠনের উদ্যোগ শুরু হল। ১৯৩৬ সালে ভারতবর্ষের প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকরা, পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, লেখকদের সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন থেকে গঠন করলেন ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্ণৌ-তে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল মুন্সি প্রেমচাঁদের সভাপতিত্বে। প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী, নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা সংগঠিত হচ্ছিলেন ফ্যাসিবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, তৈরি হচ্ছিল নতুন নতুন সাংস্কৃতিক সংগঠন। অবশেষে, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে (অধুনা মুম্বাই) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের অধিবেশনে ফ্যাসিবিরোধী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য একটি সাধারণ সংঘ তৈরি করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ বা সংক্ষেপে ‘আইপিটিএ’। বাংলার প্রায় সকল প্রগতিশীল শিল্পীরাই এর সঙ্গে যুক্ত হন। এঁদের ভিতরে ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র,  হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, উৎপল দত্ত, সুচিত্রা মিত্র, কলিম শরাফী, তৃপ্তি মিত্র, শোভা সেন, শম্ভু ভট্টাচার্য-সহ শিল্পের সকল শাখার কৃতী মানুষেরা। 

গণনাট্যের গানের মূল উপজীব্য বিষয় ছিল শ্রমজীবী মানুষকে সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত ও সংগ্রামী হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার আদায়ের মাধ্যমে একটি শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জোগানো। শুধুমাত্র স্বদেশের কথাই নয়, সারা বিশ্বের শোষিত মানুষের বঞ্চনা এবং ক্ষোভের কাহিনি চিত্রিত হয়েছিল গণনাট্যের গানে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কলম রচনা করে চলল একের পর এক কালজয়ী গান। গানগুলিকে আখ্যায়িত করা হল ‘গণসংগীত’ নামে। 

জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের গানগুলির মধ্যে থেকে উল্লেখনীয় দুটি গান — 

                          ‘ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই                                                                                                           
                        মরণের পাল তুলে জীবন তো আসবেই                                                                                             
                         ভাঙ্গা গড়া দ্বন্দ্বের ঢেউ তুলে আসবেই                                                                                                              
                                   ভয় নেই’। 

এবং 

                            ‘এসো মুক্ত করো মুক্ত করো,                                                                                                       
                                অন্ধকারের এই দ্বার,                                                                                                                        
                        এসো শিল্পী, এসো বিশ্বকর্মা, এসো স্রষ্টা,                                                                                                 
                                 রস রূপ মন্ত্র দ্রষ্টা,                                                                                                                            
                               ছিন্ন করো, ছিন্ন করো,                                                                                                                     
                                বন্ধনের এ অন্ধকার। 
                             দিকে দিকে ভেঙ্গেছে যে শৃঙ্খল,                                                                                                            
                               দুর্গত দলিতেরা পায় বল                                                                                                                    
                                 এ শুভলগনে তাই                                                                                                                           
                             তোমার স্মরণ করি রূপকার,                                                                                                             
                             এসো মুক্ত কর হে এই দ্বার’। 

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ এবং অনবদ্য লেখনীর মেলবন্ধনে গানের পর গান সৃষ্টি করে চললেন একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ সলিল চৌধুরী। সাধারণ মানুষ আলোড়িত হলেন সেই গানে। দীর্ঘ হতে থাকল তালিকা। কিছু গানের কথা না বললেই নয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনে সারা ভারতব্যাপী যে ধর্মঘট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শবাধারে শেষ পেরেক ঠুকেছিল সেই অত্যুজ্জ্বল দিনে রচনা করলেন গান — 

                     ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে                                                                                 
                  গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বর পিনাকী বেজেছে বেজেছে বেজেছে                                                                  
               মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠছে।                                                  
                         শোষণের চাকা আর ঘুরবে না ঘুরবে না                                                                                        
                        চিমনিতে কালো ধোঁয়া উঠবে না উঠবে না।                                                                                                 
                        বয়লারে চিতা আর জ্বলবে না জ্বলবে না                                                                                              
                    চাকা ঘুরবে না, চিতা জ্বলবে না, ধোঁয়া উঠবে না                                                                                   
               লাখে লাখ করতাল হরতাল হেঁকেছে, হরতাল, হরতাল, হরতাল।                                                                 
                           আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ’। 

প্রাক্‌স্বাধীনতা যুগে দেশি-বিদেশি পুলিশি অত্যাচার এবং ব্রিটিশ আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন গান। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে রংপুরে ছাত্র সম্মেলনে প্রথমবার গীত হল — 

                         ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা                                                                                                  
                              আজ জেগেছে এই জনতা।                                                                                                            
                            তোমার গুলির, তোমার ফাঁসির,                                                                                                    
                          তোমার কারাগারের পেষণ শুধবে তারা                                                                                             
                               ওজনে তা এই জনতা ’। 

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আগুনকে তীব্রতর করতে লিখলেন — 

                              ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা                                                                                                             
                              আমার প্রতিরোধের আগুন                                                                                                               
                                 দ্বিগুণ জ্বলে যেন                                                                                                                           
                               দ্বিগুণ দারুণ প্রতিশোধে                                                                                                                   
                                 করে চূর্ণ ছিন্ন-ভিন্ন                                                                                                                            
                               শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন                                                                                                                
                               আনে মুক্তি আলো আনে                                                                                                               
                                আনে লক্ষ শত প্রাণে।’ 

পরের বছর, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঙ্গার বিরুদ্ধে মিলনের সেতু বাঁধার আহ্বান জানালেন তাঁর গানে — 

                                ‘ও মোদের দেশবাসীরে —                                                                                                              
                            আয়রে পরাণ ভাই আয়রে রহিম ভাই                                                                                                
                                কালো নদী কে হবি পার।                                                                                                                   
                             এই দেশের মাঝেরে পিশাচ আনেরে                                                                                                 
                                  কালো বিভেদের বান,                                                                                                                      
                            সেই বানে ভাসেরে মোদের দেশের মান।                                                                                                  
                              এই ফারাক নদীরে বাঁধবি যদিরে                                                                                                                    
                                 ধর গাঁইতি আর হাতিয়ার                                                                                                                 
                        হেঁইয়া হেঁই হেঁইয়া মার, জোয়ান বাঁধ সেতু এবার’। 

সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে সকলকে একই পথে পা মেলানোর ডাক দিলেন — 

                         ‘পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে পথ চেনা                                                                                
                           জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা                                                                                           
                                 হবে চেনা, হবে জানা।                                                                                                                         
                            অনেক তো দিন গেল বৃথাই সংশয়ে,                                                                                                            
                             এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে                                                                                                   
                                তোমার আমার সবার স্বপন                                                                                                          
                                  মিলাই প্রাণের মোহনায়                                                                                                                   
                                     কিসের মানা’।

আবার চিরপরিচিত দেশাত্মবোধক গানের সুরভি ঢেলে লিখলেন — 

                           ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে,                                                                                              
                            আমার জীবন-মরণে তোমায় চাই না ভুলিতে।                                                                                    
                            আমি তোমার তরে স্বপ্ন রচি আমার যত গান,                                                                                    
                            তোমার কারণেই দেব জীবন বলিদান                                                                                                  
                            ওগো জন্মভূমি মা গো মা —’ 

গণনাট্যের গান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম অবধারিতভাবেই এসে পড়ে। তাঁর একটি গানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে — 

                              ‘আমি যে দেখেছি সেই দেশ                                                                                                              
                               দেশ উজ্জ্বল সূর্য রঙিন।                                                                                                                 
                               আমি যে দেখেছি শত ফুল বাগিচায়                                                                                               
                               পুবালি বাতাসে কি সুবাস ছড়ায়।                                                                                                  
                               ভ্রমরের গুঞ্জনে শুনেছি প্রকাশ                                                                                                          
                               বিষাক্ত আগাছা হয়েছে বিলীন’। 

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসককে সে আইন রদ করতে। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জিত হল ঠিকই, দেশভাগ এড়ানো গেল না। জন্ম হল স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের। বংলাও বিভক্ত হল দুটি ভাগে— পশ্চিম অংশ ভারতের অংশ হিসাবে রয়ে গেলেও পূর্ববঙ্গ হল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার ফলে পূর্ববাংলার বাংলাভাষী অধিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে, সমমর্যাদার দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। রাজপথে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলেন রফিক, সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বার ও আরও অনেকে। শহিদদের স্মরণে ওই দিনেই গান লিখলেন সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘একুশের গান’ — 

                      ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি                                                                                              
                       আমি কি ভুলিতে পারি                                                                                                                            
                       ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া — এ ফেব্রুয়ারি                                                                                       
                       আমি কি ভুলিতে পারি                                                                                                                
                       আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি                                                                                 
                       আমি কি ভুলিতে পারি’। 

১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে প্রথম গাওয়া হল এই গান আলতাফ মাহমুদের সুরে। পরবর্তীকালে ভাষা দিবস বা অমর একুশে স্মরণে একাধিক গান রচিত হয়েছে। তবে, বাংলা এবং বাংলা ভাষাকে নিয়ে এমন একটি গান রচিত হল গত শতাব্দীর নয়-এর দশকে (১৯৯৪) যা দুই বাংলার সকল বাংলাভাষী মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হল অনায়াসেই। গানটির গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী একজনই, প্রতুল মুখোপাধ্যায়। আর গানটি — 

‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই                                                                               আমি আমার আমিকে চিরদিন— এই বাংলায় খুঁজে পাই।                                                                      আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর                                                                               আমি এই বাংলার মায়া ভরা পথে, হেঁটেছি এতটা দূর,                                                                         বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ                                                                                 আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ’। 

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের পর সরকারি ভাষার বিতর্ক সম্পন্ন হলেও পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের সাথে পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি আরও বড়ো অধিকার আদায় ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই যে গীতিকারের নাম সর্বাগ্রে স্মরণে আসে তিনি আর কেউ নন, এই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। তারিখটা ১৩ অথবা ১৫। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে রাতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’-য় বাজানো হয়েছিল একটি গান। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মাঝে মাঝে বেজেছিল গানটি — 

‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে                                                                                                         লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি                                                                                         আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।                                                                                                         বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।                                                                                                        সেই সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে,                                                                                                       আবার এসে ফিরে যাবো আমার                                                                                                      হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো।                                                                                        শিল্পে কাব্যে কোথায় আছে হায় রে                                                                                                     এমন সোনার দেশ’।

গানটি গৌরীপ্রসন্ন লিখেছিলেন একটা চায়ের দোকানে বসে, সিগারেটের প্যাকেটের ভিতরে থাকা কাগজের সাদা অংশে। লেখার পর কাগজটি তুলে দিয়েছিলেন বন্ধু, বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী ও সুরকার অংশুমান রায়ের হাতে। তিনি সুরারোপ করে গাইলেন এই গান। আরও একটি গান উদ্বেলিত করেছিল, উদ্দীপ্ত করেছিল মুক্তিকামী বাংলাকে — 

‘মাগো ভাবনা কেন                                                                                                                         আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে                                                                                                        তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি                                                                                           তোমার ভয় নেই মা                                                                                                                     আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।                                                                                                          আমরা হারব না, হারব না                                                                                                          তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়ব না                                                                                              আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ ঘাঁটি গড়তে জানি                                                                                        তোমার ভয় নেই মা                                                                                                                      আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’। 

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, নিজের সুরে গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। 

বাংলা স্বদেশ পর্যায়ের গানের আলোচনায় অবধারিতভাবে উঠবে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। তাঁর লেখা গানগুলির মধ্যে বহুশ্রুত একটি গান — 

‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম                                                                                                                          আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে                                                                                                        লীলা চঞ্চল সমুদ্রে অবিরাম                                                                                                             গঙ্গা যমুনা ভাগীরথী যেথা মেশে।                                                                                               ভারতবর্ষ মানবতার এক নাম                                                                                                      মানুষের লাগি মানুষের ভালবাসা                                                                                                  প্রেমের জোয়ারে এ-ভারত ভাসমান                                                                                                     যুগে যুগে তাই বিশ্বের যাওয়া-আসা                                                                                                      সব তীর্থের আঁকা-বাঁকা পথ ঘুরে                                                                                                     প্রেমের তীর্থ ভারততীর্থে মেশে’। 

শিবদাসবাবুর লেখা অপর একটি গান, যা আজও অনেকে ভুল করেন দ্বিজেন্দ্রগীতি বলে, বাঙালির স্বাধীনতা দিবস পালনের অনুষ্ঠানে অনিবার্যভাবে গীত হয়। মান্না দে-র অননুকরণীয় কন্ঠে গীত, বহুশ্রুত গান — 

                            ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ                                                                                                                
                             স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো                                                                                                               
                           তোমাতে আমরা লভিয়া জনম                                                                                                            
                              ধন্য হয়েছি ধন্য গো’। 

গানটি রচনার প্রেক্ষাপটও চিত্তাকর্ষক। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পায় বাংলা হাস্যরসাত্মক ছবি ‘চারমূর্তি’। ছবির নির্মাণকালে এই গানটি মোটেই দেশাত্মবোধক গান হিসাবে তৈরি করার কথা ভাবা হয়নি, বরং এটিকে খানিকটা প্যারোডি গানের আদলে তৈরি করা হয়েছিল। গান রচনার সময় এ গানের গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুরকার অজয় দাস কেউই ভাবতে পারেননি যে তাঁদের জীবদ্দশাতেই একদিন এই গান প্রায় আড়াইশো বিদ্যালয়ের প্রার্থনা সংগীত হয়ে উঠবে। 

ছায়াছবিতে স্বদেশ পর্যায়ের গান বা দেশভক্তির গান বারেবারে এসেছে কাহিনির হাত ধরে। বাংলা ছবিতে মূলত বঙ্গভঙ্গ এবং স্বদেশি পর্যায়ের গানগুলিই ঘুরেফিরে ব্যবহৃত হয়েছে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যেহেতু হিন্দি ছবিতে ব্যবহৃত গানগুলির আবেদন অনেক বেশি, তাই এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সীমাবদ্ধ রইল হিন্দি চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত এবং ছবির জন্য নতুন করে তৈরি করা কিছু গানকে নিয়েই। 

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নতুন করে সুরারোপ করলেন ‘বন্দেমাতরম’ গানের। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয়তা পেল সেই গান। বলিউডের দেশাত্মবোধক গানের ভাণ্ডার সংখ্যায় এবং গুণমানে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, জনপ্রিয়ও। গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সেই ট্র্যাডিশন বর্তমান। ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে বন্দেমাতরম গানের পর থেকে পাওয়া গেল বহু সুপারহিট দেশাত্মবোধক গান, যেগুলি আজও সমান জনপ্রিয়। কিছু গানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। 

‘জাগৃতি’ (১৯৫৪) ছবির গান — ‘হম্‌ লায়ে হ্যায় তুফান সে কস্তি নিকাল কে/ ইস্‌ দেশ কো রাখনা মেরে বচ্চে সম্‌ভাল কে’, গীতিকার প্রদীপ এর কথায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানটি গেয়েছিলেন মহম্মদ রফি। এই মহম্মদ রফির কণ্ঠেই প্রাণ পেল আরও একটি গান তিন বছর পর (১৯৫৭)। ‘নয়া দৌড়’ ছবির গান — ‘ইয়ে দেশ হ্যায় বীর জবানোঁকা, আলবেলোঁ কা, মস্তানোঁ কা’, কথা ও সুর যথাক্রমে সাহির লুধিয়ানভি এবং ওপি নাইয়ার সাহেবের। 

দেশের মাটির অমোঘ টানের গভীর আবেগ মূর্ত হল ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৬১) ছবির ‘অ্যায় মেরে প্যারে বতন, অ্যায় মেরে বিছড়ে চমন/ তুঝপে দিল কুরবান/ তু হি মেরি আরজু, তু হি মেরি আবরু তু হি মেরি জান’ গানে মান্না দের কণ্ঠে। গানটি লিখেছিলেন প্রেম ধাওয়ান এবং সুর দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। 

১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ভারত-চিন যুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হল কবি প্রদীপ রচিত এবং সি রামচন্দ্র সুরারোপিত গানে। ১৯৬৩-র প্রজাতন্ত্র দিবসে (২৬ জানুয়ারি) দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন ও জওহরলাল নেহেরুর উপস্থিতিতে কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর হৃদয় উজাড় করে গাইলেন — ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো/ জরা আঁখ মে ভর লো পানি/ যো শহিদ হুয়ে হ্যায় উনকি/ জরা ইয়াদ করো কুরবানি’। যদিও এই গানটি কোনও হিন্দি চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়নি, তথাপি এই গানটির উল্লেখ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। হিন্দি দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রে এই গানটি একটি মাইলফলক। আরও একটি গানের উল্লেখ না করা অপরাধের সমতুল — কবি ইকবাল রচিত এবং পণ্ডিত রবিশংকর সুরারোপিত গান, ‘সারে জাহাঁ সে অচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা/ হম্‌ বুলবুলেঁ হ্যায় ইসকি/ ইয়ে গুলিস্তাঁ হমারা’। 

সময়টা ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। মুক্তি পেল হিন্দি ছবি ‘হকিকত্‌’। কবি কায়ফি আজমির কথায় এবং মদনমোহনের সুরে মহম্মদ রফি গাইলেন, ‘কর্‌ চলে হম ফিদা/ জান-ও-তন সাথিয়োঁ/ অব্‌ তুম্‌হারে হাওয়ালে বতন সাথিয়োঁ’। আজও যে গানের জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ে নি। 

‘সিকন্দর-ই-আজম’ (১৯৬৫) ছবিতে রাজেন্দ্রকৃষ্ণের কথা ও হংসরাজ বহ্‌লের সুরে মহম্মদ রফির কন্ঠে গীত হল ভারতবন্দনা, জয়ধ্বনি উঠল ভারতের নামে, ‘যাঁহা ডাল ডাল পর সোনে কি চিড়িয়া করতি হ্যায় বসেরা/ ও ভারত দেশ হ্যায় মেরা/ যাঁহা সত্য, অহিংসা, অওর ধরম কা/ পগ্‌ পগ্‌ লাগতা ডেরা/ ও ভারত দেশ হ্যায় মেরা/ জয় ভারতী, জয় ভারতী’। 

মহেন্দ্র কাপুরের কন্ঠে আজও অমর হয়ে আছে ‘উপকার’ (১৯৬৭) ছবির বিখ্যাত সেই গান, ‘মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে/ উগলে হিরে মোতি/ মেরে দেশ কি ধরতি’। গানটি লিখেছিলেন গুলশন বাওরা এবং সুর দিয়েছিলেন কল্যাণজি-আনন্দজি। 

‘দুনিয়া’ (১৯৬৮) ছবিতে আশা ভোঁসলে গাইলেন— ‘ইয়ে ধরতি হিন্দুস্তান কি/ ইয়ে ধরতি হিন্দুস্তান কি/ না মেরি হ্যায় না তেরি হ্যায়/ বেটি কিসি কিষাণ কি/ গুজরাটি ইয়া শিখ, মারাঠি/ বাংগালি ইয়া মাদ্‌রাসি/ যো ভি হো তুম্‌ বাদ মে হো/ পহলে হো ভারতবাসী’। বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে, দেশের সার্বিক ঐক্যের পক্ষে রচিত গান। 

মহেন্দ্র কাপুরের গাওয়া আরও একটি অতি জনপ্রিয় গান আমরা পাই ‘পূরব অর্‌ পশ্চিম’ (১৯৭০) ছবিতে। কল্যাণজী-আনন্দজী সুরারোপিত এই গানের কথাগুলি লিখেছিলেন ইন্দিবর, ‘হ্যাঁয় প্রীত যাঁহা কি রীত সদা/ ম্যায় গীত ওয়াহাঁ কে গাতা হুঁ/ভারত কা রহনেবালা হুঁ/ ভারত কি বাত শুনাতা হুঁ’। 

মঙ্গেশ কুলকার্নির কথায়, লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের সুরে, মান্না দের কণ্ঠে পাওয়া গেল ভিন্ন স্বাদের গান ‘প্রহার’ (১৯৯১) ছবিতে। ‘হামারি হি মুট্‌ঠি মে আকাশ সারা/ যব্‌ ভি খুলেগি চমকেগা তারা/ কভি না ঢলে যো ওহি সিতারা/ দিশা জিস্‌সে পহচানে সন্‌সার সারা’। গানের শেষ স্তবকের কথাগুলি এইরকম — ‘হামারে পিছে কোই আয়ে না আয়ে/ হমেঁ হি তো পহলে পহুচনা ওয়াহাঁ হ্যাঁয় … জো ভি সাথ আয়ে উন্‌হে সাথ লে লে/ আগর না কোই সাথ দে তো অকেলে’। মনে করিয়ে দেয় — ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। 

পরের বছর  মুক্তি পেল ‘রোজা’ (১৯৯২)। ভারতীয় সংগীতের আকাশে জন্ম হল এক নতুন তারকার, এ আর রহমান। সুর সংযোজনায় সম্পূর্ণ নিজস্ব, স্বতন্ত্র শৈলী দৃষ্টি কেড়ে নিল, শুরু হল এক নতুন অধ্যায়ের। পি কে মিশ্রের কথায় সুর দিলেন এ আর রহমান, গাইলেন হরিহরণ — ‘ভারত হামকো জান সে প্যারা হ্যায়/ সবসে ন্যারা গুলিস্তাঁ হামারা হ্যায়/ উজড়ে নহিঁ আপনা চমন/ টুটে নেহিঁ আপনা ওয়াতন/ গুমরাহ না কর দে কোই/ বরবাদ না কর দে কোই/ মন্দির য়ঁহা/ মসজিদ য়ঁহা/ হিন্দু য়ঁহা/ মিলকে রহেঁ হাম প্যার সে/ জাগো…’। 

২০০২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ‘দ্য লিজেন্ড অফ ভগত সিং’ ছবিতে গীতিকার সমীরের কথায় অনবদ্য সুর সংযোজন করলেন এবং সুখবিন্দর সিং-এর সাথে দ্বৈতকন্ঠে গাইলেন, ‘দেশ মেরে, দেশ মেরে মেরি জান হ্যায় তু/ দেশ মেরে, দেশ মেরে মেরি শান হ্যায় তু/ মিটানে সে নহি মিটিতে/ ডরানে সে নহি ডরতে/ বতন কে নাম পে হম শর কাটানে সে নহি ডরতে’। ‘স্বদেশ’ (২০০৪) ছবিতেও কাজ করল এ আর রহমানের সুরের জাদু। জাভেদ আখতারের কথায় গানটি গাইলেন এ আর রহমান স্বয়ং — ‘ইয়ে যো দেশ হ্যায় তেরা/ স্বদেশ হ্যায় তেরা, তুঝে হ্যায় পুকারা/ ইয়ে ও বন্ধন হ্যায়, যো কভি টুট নহি সকতা’। ‘রঙ্গ্‌ দে বসন্তি’ (২০০৬) ছবির গানগুলিও পেল তুমুল জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে ছবির টাইটেল সঙ্, ‘থোড়িসি ধুল মেরি ধরতি কি মেরে বতন কি/ থোড়িসি খুশবু বৌরাই সি মস্ত্‌ পবন কি/ থোড়ি সি ধৌকনে বালি ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌ সাঁসে/ জিনমে হো জুনুন জুনুন বো বুন্দে লাল লহু কি’। 

সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু ছবি নির্মিত হয়েছে বলিউডে, যেমন, ‘রাজি’ (২০১৮), ‘উরি; দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ (২০১৯), ‘গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্য কার্গিল গার্ল’ (২০২০), ‘তানাজি; দ্য আনসাং ওয়ারিয়র’ (২০২০), ‘শের শাহ্‌’ (২০২১), ‘ভুজ: দ্য প্রাইড অফ ইন্ডিয়া’ (২০২১) যেখানে জাতীয়তাবাদী বা দেশাত্মবোধক সংগীত রচনার সুযোগ ছিল। এই ছবিগুলিতে ব্যবহৃত গানগুলির মধ্যে দুটি গান শ্রোতাকে মনযোগী হতে বাধ্য করে। একটি ‘রাজি’ ছবিতে গুলজার সাহেবের কথায়, শংকর এহসান লয়-এর সুরে, অরিজিৎ সিং-এর কণ্ঠে গাওয়া গান, ‘অ্যায় বতন, বতন মেরে আবাদ রহে তু/ ম্যায় জহা রহুঁ জঁহা মে ইয়াদ রহে তু/ তু হি মেরি মঞ্জিল হ্যায়, পহচান তুঝি সে/ পহঁচু ম্যায় জহাঁ ভি, মেরি বুনিয়াদ রহে তু’। দ্বিতীয় পঙক্তিতে ‘জহা’ এবং ‘জঁহা’ শব্দের প্রয়োগ পাঠকের নজর এড়িয়ে যাবে না বলেই আশা রাখি। অপর গানটিও অরিজিৎ সিং-এর গাওয়া ‘ভুজ; দ্য প্রাইড অফ ইন্ডিয়া’ ছবির গান, ‘ও দেশ মেরে তেরি শান পে সদকে/ কোই ধন হ্যায় ক্যা তেরি ধুল সে বঢ়কে/ তেরি ধুপ পে রৌশন, তেরি হাওয়া পে জিন্দা/ তু বাগ হ্যায় মেরা, ম্যায় তেরা পরিন্দা’। মনোজ মুন্‌তাশিরের কথায় সুর দিয়েছেন অর্ক। 

সাম্প্রতিক অতীতে নির্মিত বলিউডি ছবিগুলির নামকরণই সেই সিনেমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে দেয়। ছবিগুলিতে ব্যবহৃত গান রচিত হয়েছে ছবির বিষয়ভাবনার কথা মাথায় রেখেই। বিগত বছরগুলিতে জাতীয়তাবাদী বা দেশপ্রেমের কাহিনি নির্ভর ছবির ক্ষেত্রে নির্মাতাদের বিষয়ভাবনার মধ্যে যে একমুখী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাচ্ছে তা যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। শাসকের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। 

ক্ষমতালাভ এবং তা টিকিয়ে রাখতে আজকের শাসকের সবথেকে বড়ো মূলধন ধর্ম। আরও স্পষ্ট করে বললে হিন্দুত্ব, উগ্র হিন্দুত্ব। জাতীয়তাবাদের মোড়কে হিন্দুত্বের প্রচার তাই কাম্য। আর ক্রমাগত প্রচারে দেশের মানুষের মাথায় শাসকের এই ভাবনাকে গেঁথে দিতে সবথেকে বড়ো হাতিয়ার হতে পারে চলচ্চিত্র, শাসক তা বিলক্ষণ বোঝেন। চলচ্চিত্রনির্মাতারাও বোঝেন শাসকের কী ইচ্ছে। তাই ইসলামি জেহাদি, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদতে জঙ্গি অনুপ্রবেশ, আতঙ্কবাদী হামলা-নাশকতা, এমনকি অতীতের মুঘল বা খিলজি আমলের মুসলমান শাসকরাও হয়ে উঠছেন ছবির উপজীব্য বিষয়। ছবিই যদি প্রচারণামূলক হয় তবে সে ছবির গানও যে সেই সুরেই পোঁ ধরবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ ছবি এবং ছবিতে ব্যবহৃত গান একে অপরের পরিপূরক, পরস্পরের সাথে বিষয়ভিত্তিকভাবে সম্পৃক্ত, ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর আশঙ্কার কারণ লুকিয়ে থাকে এখানেই। ছবির গান অনুপ্রেরণার উৎস না হয়ে যখন প্ররোচনা ছড়ানোর শস্ত্র হয়। 

দেশাত্মবোধক গান রচনার যে সুমহান ঐতিহ্য বহন করে এসেছেন এ দেশের গীতিকার এবং সংগীত স্রষ্টাগণ, তাঁদের মশালবাহক উত্তরসূরিরা নিশ্চয়ই জাতীয়তাবাদী, স্বদেশপ্রেমের গান তৈরি করার সময় অতীতের সমন্বয়ী সংস্কৃতির আবহমান সুর ভুলে যাবেন না কোনও ভয় তথা লোভের বশবর্তী হয়ে, আপাতত এই আশা।

ঋণস্বীকার : 

১) ‘বাংলা স্বদেশী গান’ : গীতা চট্টোপাধ্যায়। প্রকাশক : দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী, জানুয়ারি ১৯৮৩।

২) ‘পৌরবিজ্ঞানের রূপরেখা’ : অধ্যাপক অলক ঘোষ এবং কানাইলাল চট্টোপাধ্যায় : দি নিউ বুক স্টল, কলকাতা, ১৯৮৪।

৩) ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’ : ডক্টর জয়গুরু গোস্বামী : বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮৭।

৪) ‘গীতবিতান’ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, বৈশাখ ১৩৮৯।

৫) ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’ : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ভাদ্র, ১৩৬৬।

৬) ‘বাণী : রজনীকান্ত সেন’ : হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, কলকাতা, ফাল্গুন ১৩২৫।

৭) ‘দ্বিজেন্দ্র-গীতি’ : শ্রী দিলীপকুমার রায় : জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,  কলকাতা, বৈশাখ ১৩৭২।

8) ‘নজরুল গীতি’ (অখণ্ড) : হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৭ জুলাই, ১৯৮১। 

৯) ‘সলিল চৌধুরী রচনা সংগ্রহ’ (প্রথম খণ্ড) : দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৩।  

১০) চায়ের আড্ডায় সিগারেটের কাগজে যেভাবে জন্ম হয় ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটির https://www.bbc.com/bengali/news-47601176

১১) Wikipedia

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান