মেকলের দীর্ঘ ছায়া

পার্থ সারথি বণিক 

“Great Britain will delude herself if she does not recognise that, beneath all the distinctions of community, class and social circumstances, there is a growing intellectual consciousness, or more truly self-consciousness, which is very closely akin to what we generally term nationalism.”                                                                             — লর্ড আরউইন [১] 

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আসার আগে থেকেই ভারত ভূখণ্ডের সমাজমনে অন্তর্লীন হয়ে ছিল এক ঐক্য চেতনা। তাকে ছাপিয়ে এই উপনিবেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটল ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদের লুঠেরা শাসন নীতির প্রতিরোধের তাগিদ থেকে। [২] ঔপনিবেশিক শাসক ভারতবর্ষে এক বিভাজনকামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে উদ্যোগী হয়েছিল। তার ছায়া আজও আমাদের ছেড়ে যায়নি।    

জাতীয়তাবাদ মানুষের সভ্যতাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই সভ্যতার অবনমনও ঘটিয়েছে। জাতীয়তাবাদের চরিত্রই তো ঠিক করে দেয় শিক্ষার অভিমুখ! আবার একই ভাবে শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয়তার স্বাস্থ্যকে। এইভাবে শিক্ষা আর জাতীয়তাবাদী চেতনা একে অপরের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে। জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে দিয়ে যদি একটা রাষ্ট্রে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, চামড়ার রং-কে একাত্ম করতে চাওয়া হয় তবে রাষ্ট্রপরিচালকেরা এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন যা বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে শেখাবে। আর, বিভাজনকামী জাতীয়তাবাদীরা অন্য ভাষা, ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভালবাসার ভিন্ন ভাষা, এমনকি অন্য দৃষ্টিভঙ্গিকেও ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু করে তুলতে শেখাবেন; আক্রমণ করতে, এড়িয়ে যেতে মদত দেবেন; শিক্ষাকে যে কোনও অজুহাতে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন। আর এইভাবে ‘অপর’ যিনি, তাঁকে রাষ্ট্র এবং সমাজের কেন্দ্র থেকে উচ্ছেদ করা হবে। 

ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের সময় থেকে শুরু করে উপনিবেশের রাজনৈতিক অবসান পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, গান্ধিজি, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এবং আরও অনেকে উদার জাতীয়তাবাদের পক্ষে সওয়াল করে বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। তবু দ্বিজাতি তত্ত্ব আমল পেয়েছে, ভারত ভাগ হয়েছে, গান্ধিজিকে হত্যা করা হয়েছে, নেতাজীর জীবনকে রহস্যে মুড়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে। 

তা সত্ত্বেও, দেশভাগ, দাঙ্গা, পাক যুদ্ধ, শরণার্থী সমস্যা নিয়েও আমরা এক খোলামেলা জাতীয়তাবাদ চর্চার পরিবেশে বড়ো হয়েছি। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে প্রজাতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিবসে শিক্ষক শিক্ষিকারা সকাল সকাল উপস্থিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাগজের তেরঙা পতাকা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল করতেন, সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজত, হিন্দু ছাত্রটি তার হিন্দুত্ব নিয়ে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন বোধ করত না। তারপরে বিশ শতকের আশির দশকের পরে [৩] এই নিরুদ্বিগ্ন জাতীয় পরিবেশ পালটে যেতে লাগল। ধর্মীয় মেরুকরণের প্রবণতা যদি রাজনীতির মূল স্রোতে প্রবল হতে থাকে তবে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যে  সমধর্মী নৈতিকতার ছাপ পড়বে তা তো বলাই যায়। আজ দেখছি বহু মানুষের চিন্তায় চেতনায় এক উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতা; সময়ের চাকা যেন ফিরে যেতে চাইছে ঊনবিংশ শতকের সেই ব্রিটিশ উপনিবেশে বিচ্ছিন্নতাকামী ইউরোপীয় উগ্র জাতীয়তাবাদের সম মানসিকতায়। এই প্রবন্ধের ছোটো পরিসরে আমরা এই বিভাজনকামী জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে ভাষা, পাঠ্যপুস্তক এবং নৈতিকতার বিষয়গুলিকে ছুঁয়ে যাব। 

সহজাত শিক্ষা 

‘জাতি’ সত্তার প্রতি মানুষ সংবেদনশীল হবে সেটা স্বাভাবিক। এক সাধারণ খাদ্যাভ্যাস-পোশাক-ভাষার বন্ধন, চিন্তা-চেতনার একটা সাধারণ কাঠামো, ‘জাত’ হওয়ার সাধারণ ভূমি আমাদের এক জাতি-আত্মীয়তায় বেঁধে রাখে; হয়তো অনুমান করা ভুল হবে না গোষ্ঠী-জীবনের জলহাওয়াই এই জাতি সত্তাকে আমাদের অবচেতনে প্রোথিত করে রেখেছে। আর জন-স্মৃতিতে ছড়িয়ে আছে উত্তরধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের যত প্রাচীন বৌদ্ধিক সম্পদ।[৪] নিজের জাতি-আবেগের প্রতি অনুগত হওয়ার জন্য মানুষকে নিশ্চয়ই বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে গড়েপিটে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না! আবার, এই আবেগই কেমন অনায়াসে আমার জাতিকে আপনার জাতির থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়! ‘আমি বনাম তুমি’-র দ্বান্দ্বিক অবস্থানে মানবতা ভাগাভাগি হয়ে যায়। 

ভারতবর্ষীয় সমাজের বহু কোণ, বহু মাত্রা; একের মধ্যে বহু সমাজ, বহুতর  টানাপোড়েন, খাদ্যাভ্যাস পোশাক ভাষায় বৈচিত্র্য, অথচ প্রাচীন বৌদ্ধিক সম্পদে একই আবেগের উত্তরাধিকার। এই ‘বহু’ তাই কখনও ‘এক’ আবেগে মিশে থাকে, আবার কখনও ‘অস্মিতা’র তাড়নায়, অথবা স্বার্থের কারণে ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে যায়। তাই ভারতবর্ষীয় সমাজে ‘এক-জাতি’ চেতনাকে জাগিয়ে তুলে একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐক্য বজায় রাখার রাজনীতির প্রয়োজন বারবার হয়েছে, এখনও হয়। আর এ কাজ করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ব্যবহার করতেই হয়। 

শিক্ষায় দাদাগিরি

এর ঠিক উলটো কাজটা করতে চাইলেও ঐ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই তো ব্যবহার করতে হয়! অর্থাৎ, ঐক্যের চেতনাকে পঙ্গু করতে চাইলেও ওই এক-জাতি চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে হয়, স্মৃতিসম্পদের উত্তরাধিকার বোধকে তছনছ করে দেওয়ার কৌশল নিতে হয়। আর তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাহায্য দরকার হয়ে পড়ে। শিক্ষার বাহন যে ভাষা, মাধ্যম যে পাঠ্যপুস্তক, উদ্দেশ্য যে নৈতিকতা, সে সব কিছুর মধ্যে যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় বিচ্ছিন্নতাকামী শাসকের সাংস্কৃতিক দাদাগিরির বার্তা, অথবা শাসিতের সাংস্কৃতিক হীনম্মন্যতার বার্তা, তবে শাসিতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক একতা বোধকে নষ্ট করে তাদের উপর ক্ষমতা কায়েম রাখা সহজ হয়ে যায়। এ দেশে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির মস্তিষ্ক এই কাজটা অত্যন্ত সচেতন ভাবে হাসিল করতে চেয়েছিল। সেই অষ্টাদশ শতক থেকেই। 

ইউরোপীয় মিশনারিরা তাদের ভারতীয় উপনিবেশে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বেশ উৎসাহের সঙ্গে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেছিল, এ কথা ঐতিহাসিক সত্য। এ দেশের তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষকে ঘষামাজা করতে চেয়ে তাদের শিক্ষাদানের উৎসাহকে, বিশেষ করে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা, বর্ণ পরিচয়ের বই লেখা ও ছাপানো, বাংলা ব্যাকরণ বই লেখার উদ্যোগকে, কুর্নিশ করতেই হয়।[৫] তা সত্ত্বেও, বলতেই হয়, মিশনারিদের শিক্ষা-উদ্যোগের মূল লক্ষ্য যেহেতু ছিল ভারতের নিজের অধিবাসীদের ধর্মসমূহ ও তাদের চর্চাকে নাকচ করে ঔপনিবেশিক দখলদারদের ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা, তাই মিশনারিদের শিক্ষা প্রয়াস আসলে ছিল দেশজ সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঐক্য চেতনার  ফল্গু ধারাকে থামিয়ে দেওয়ার এক সচেতন প্রচেষ্টা; শিক্ষায় দাদাগিরির প্রথম সচেতন ধাপ।

ঐতিহ্যের টুটি টিপে  

একটা জাতির, অথবা, জাতি-পুঞ্জের সাধারণ (common) প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার মানুষের অবচেতনে যে  “এক জাতি এক প্রাণ”-সুলভ চেতনাকে প্রোথিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি ওই ঐতিহ্যকে নিকৃষ্ট প্রমাণ করতে চায়। উপনিবেশকারীরা যাদের জমি আর বাজার দখল করলেন তাদের সাংস্কৃতিক ঐক্য চেতনাকে ধ্বংস করা কতটা জরুরি তা টমাস ব্যাবিংটন মেকলের বহুচর্চিত ‘মিনিট’-টি পড়লেই বোঝা যায়। শিক্ষার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক বুঝবার জন্য মেকলের ১৮৩৫ সালের মিনিটটিতে আর একবার ফিরে যাওয়া জরুরি।  

ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্যকে ভাঙতে গেলে প্রথমেই দরকার সংস্কৃত আর আরবি চর্চার টুটি টিপে ধরা। মেকলে ঠিক সেই কাজটাই করতে চাইলেন ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জনসমক্ষে আনা কুযুক্তিতে সাজানো তাঁর শিক্ষা প্রস্তাবটিতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮১৩ সালের চার্টারে ভারতবর্ষের শিক্ষার জন্য যে এক লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়েছিল তা যাতে সংস্কৃত ও আরবি শেখানোর জন্য কিছুতেই ব্যয় না করা হয় তার জন্য সে সময়ের ‘কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকসন’-এর চেয়ারম্যান মেকলে জোরালো সওয়াল করলেন। মেকলে লিখলেন, জনগণের টাকা অন্যান্য খাতে ব্যয় করার সময় যেমন বাস্তব কার্যকারিতা (utility) মাথায় রাখতে হয়, তেমনই কোনও ভাষা সাহিত্যকে উৎসাহিত করতে সরকারি কোষাগারের টাকা ব্যবহার করার সময় ভাষাটির বাস্তব কার্যকারিতাকে মাথায় রাখা উচিত। [৬] বাস্তব কার্যকারিতার প্রেক্ষিতে বিচার করার যুক্তি সাজিয়ে মেকলে সংস্কৃত আর আরবিকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দিলেন! 

মেকলে সংস্কৃত ও আরবি ভাষা সাহিত্য নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত করলেন কীসের ভিত্তিতে? তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, ভাষা দুটি তিনি মোটেই জানেন না! এদেশের আর ওদেশের নামকরা প্রাচ্যবিদদের সঙ্গে কথা বলে এবং এই দুই ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখাগুলোর ‘অনুবাদ’ পড়ে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত করেছেন! আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে সেই সময় ইংরেজের সঙ্গে সরকারি কাজকর্ম আর ব্যবসা চালানোর জন্য সেইসব ভারতীয়রা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি সফল হচ্ছিলেন যারা শাসকের ভাষা ইংরেজি ব্যবহার করতে শিখছিলেন। ইংরেজি ভাষাটিকে করায়ত্ত করার জন্য ভারতীয়দের মধ্যে সচেতনতা ইতিমধ্যেই বেড়ে গিয়েছিল। [৭] কিন্তু মেকলে যে যুক্তির উপর নিজের বক্তব্যকে দাঁড় করাচ্ছেন তা যে কতটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত, তা নীচের উদ্ধৃতি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় :  

“It is, I believe, no exaggeration to say that all the historical information which has been collected from all the books written in the Sanskrit language is less valuable than what may be found in the most paltry abridgments used at preparatory schools in England. In every branch of physical or moral philosophy, the relative position of the two nations is nearly the same.” 

এমন বালখিল্য যুক্তির  উদ্দেশ্য যে আসলে যে কোনও ছুতোয় ভারতীয় ঐতিহ্যকে নিকৃষ্ট প্রমাণ করে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের দাদাগিরি প্রতিষ্ঠিত করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদীর জাতীয়তাবাদের গোঁড়ামি কিপলিংএর মতো লেখকের আগেই মেকলের কলম থেকে বেরিয়ে এল।  

বিচ্ছিন্নতাকামী জাতীয়তাবাদীর স্পর্ধা 

পশ্চিমি জাতীয়তাবাদীর দাদাগিরির এই বিচ্ছিন্নতাবাদী স্পর্ধা আকাশ ছুঁল যখন মেকলে অবলীলায় ঘোষণা করলেন, ভারতবর্ষে যে ভাষাগুলো ব্যবহার হয় সে সবগুলোই নাকি অত্যন্ত নীচু স্তরের উপভাষা (dialect) এবং এতটাই অসংস্কৃত যে তাদের কোনোটারই কোনও সাহিত্যমূল্য নেই, কোনও বিজ্ঞানসম্মত তথ্যসমৃদ্ধি নেই!  এদের ঘষামাজা করে জাতে না তুললে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোকে এইসব ভাষায় অনুবাদই করা যাবে না! তাই মেকলের সিদ্ধান্ত হল, শাসক শিক্ষিত করে তুলতে চাইছেন এমন একটা জাতকে (people) যাদের নিজেদের মাতৃভাষাকে ব্যবহার করে শিক্ষা দিতে গেলে তাদের এখন শিক্ষিত করে তোলা সম্ভবই নয়। 

এইবার সাম্রাজ্যবাদী মেকলের নিজের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ কোনও রাখঢাক না করে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপের ভাষার স্তুতি শুরু করল। রাশিয়াকে সভ্য করল কে? করল, পশ্চিম ইউরোপের ভাষা! ভারতবর্ষের মানুষকে কেন শিক্ষা দিতে হবে ইংরেজি ভাষায়? কারণ, ইংরেজি এ দেশে শুধুই শাসকের ভাষা নয়; এ দেশের উচ্চ শ্রেণির লোকজন এই ভাষা ব্যবহার করেন তা-ই শুধু নয়; কারণ, ইংরেজিই ইউরোপের অগ্রগণ্য ভাষা; কারণ, ইংরেজি সাহিত্য প্রাচীন চিরায়ত সাহিত্যের থেকে ‘এখন’ বেশি মূল্যবান! মেকলের উগ্র জাতীয়তাবাদী শিক্ষানীতি এ দেশে এমন এক ইংরেজি শিক্ষিত দোভাষী শ্রেণিকে তৈরি করতে চেয়েছিল যারা রক্তে আর চামড়ার রং-এ হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায় আর বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ।  

মেকলের শিক্ষাপ্রস্তাবের পুরোটা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেননি ঠিকই, কিন্তু যে বাদামিসাহেব সুলভ মানসিকতা [৮] সেই ঔপনিবেশিক সময় থেকে শুরু করে আজও আমাদের অনেককে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার প্রভাবে সংযোগকারী ভাষা ইংরেজির আশ্রয়ে ‘বাঙালি অস্মিতা’ কিন্তু আজও শ্লাঘা অনুভব করে। 

ইংরেজি মাধ্যম ও স্বাধীন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ

আবার, উলটো দিকে, জাতীয়তাবাদের নামে শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমের বিরোধিতার একটা জন-আকর্ষণী প্রবণতাও বারবার মাথা চাড়া দেয়। নিজেদের জাতীয়তাবাদের প্রমাণ দিতে চাওয়া এক দল  মানুষ বলছেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমে’ শিক্ষা এ দেশে এক উচ্চকোটির শ্রেণিকে তৈরি করেছে [৯] — এ কথার মধ্যে কোথায় যেন মেকলেই প্রতিধ্বনিত হন। মেকলে ইংরেজির পক্ষে তাঁর যুক্তি সাজাতে গিয়ে বলেছিলেন : ‘এদেশের উচ্চশ্রেণির লোক ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেন…’। 

উচ্চশ্রেণির সঙ্গে ইংরেজি ভাষাকে সমার্থক করে তুলে স্বাধীন ভারতে শিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমের অবসান ঘটানোর রাজনীতিকে কখনও জাতীয়তাবাদের চেহারা, কখনও বা শ্রেণি সংগ্রামের চেহারা দেওয়া হয়ে থাকে। দেশজ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা অবশ্যই একটা উদার জাতীয়তাবাদে পৌঁছুতে পারব, কিন্তু ঔপনিবেশিক কারণেই ইংরেজির যে উত্তরাধিকার আমাদের ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে আজকে তাকে অস্বীকার করতে চেয়ে ইংরেজিকে বা ইংরেজি মাধ্যমকে বাদ দিয়ে দিলে সেই উদারতার কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে?  ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০’, শিক্ষার ‘মাধ্যম’ সম্বন্ধে মন্তব্য করছে যে একটা ভাষাকে ভালোভাবে শেখার জন্য বা শেখানোর জন্য ভাষাটিকে শিক্ষার মাধ্যম হওয়ার প্রয়োজন নেই। [১০] ‘ভালোভাবে শেখা’-র মতো একটা অস্বচ্ছ শব্দ ব্যবহার করে ঠিক কী বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে তা যদিও জানানো হয়নি তবু পঞ্চম স্তর, বা অষ্টম স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে শিক্ষা-মাধ্যম হিসেবে আঞ্চলিক বা মাতৃভাষার ব্যবহারের  গুরুত্ব তো অস্বীকার করা যায় না। এর পরের স্তরের শিক্ষণ-শিখনে জাতীয় শিক্ষা নীতি দ্বিভাষিক পদ্ধতি ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু, ভারতের সংবিধান কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে ১৫ বছরের সময়সীমা [১১] তো কেটে গেছেই, তার পরেও চলে গেল আরও সাতান্ন বছর, তবু  ইংরেজিকে সমাজ- অর্থনীতির কোনও স্তরেই বিন্দুমাত্র অস্বীকার করা তো গেলই না, বরঞ্চ তার গুরুত্ব অন্তর্জালে বাঁধা পড়া এই পৃথিবীতে দিন দিন বাড়ছে; এই ভাষাকে শেখানোর পদ্ধতি হিসেবে ইংরেজি মাধ্যমকে আজ নাকচ করতে চাইছি; শুধুই ‘অনুবাদ পদ্ধতি’-র নামান্তর ‘দ্বিভাষিক পদ্ধতি’-তে [১২] পাঠ্যবই পড়িয়ে আমরা দেশের তাবৎ শিক্ষার্থীকুলকে ‘ভালোভাবে’ ইংরেজি শিখিয়ে দিতে চাইছি; আর ইংরেজি মাধ্যম তুলে দিয়ে ‘উচ্চশ্রেণি’-র অবসান ঘটিয়ে ভাষা-সাম্য  আনতে চাইছি! হীরক রাজের পাঠশালায় এভাবেই এক বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের চর্চা হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। 

ইংরেজি ভাষার একটা স্বীকৃত ভারতীয় রূপ যে এ দেশে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে, এবং ইংরেজি যে তার একসময়কার ঔপনিবেশিক বিস্তৃতির কারণে আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী আন্তর্জাতিক ভাষাগুলোর মধ্যে অগ্রগন্য তা হয়তো এ দেশের অর্থনৈতিকভাবে সমর্থ শ্রেণিটি বিলক্ষণ বোঝে বলেই ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। সেই সুবিধাগুলো কেন দেশের সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছেই সহজলভ্য হবে না? এই আন্তর্জাতিক ভাষাটিকে করায়ত্ত করার বাস্তবসম্মত কার্যকরী পদ্ধতি, এবং তা কাজে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষণ সারা দেশের ‘সাধারণ’ বিদ্যালয় স্তরে যতক্ষণ না সম্ভব হবে ততক্ষণ যে ইংরেজি মাধ্যমের  শিক্ষালয়গুলোর  প্রতি সব শ্রেণির মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকবেন সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না! আজকের বিশ্বায়িত অর্থ ব্যবস্থা বসুধাকে যদি বস্তুগতভাবেও আমাদের কুটুম্ব করে থাকে তবে যে ভাষাটি একদিন বাংলায় তথাকথিত রেনেসাঁস আনতে উদ্দীপকের ভূমিকা নিয়েছিল তার ‘শিক্ষা মাধ্যম’-টিকে জাতীয়তাবাদের নামে নাকচ করে দিয়ে আমরা ভারতীয়রা বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন হতে থাকব; গ্লোবাল ভিলেজের মধ্যে কোনও এক জাতীয়তাবাদী কুয়োয় আমাদের ভাষা শিক্ষার্থীদের পা পিছলে যাবে! আর শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত না হয়ে থাকলে এভাবেই বিদ্যালয় শিক্ষায় একদিন প্রথম ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্ব নাকচ হয়ে যাবে; প্রতিস্পর্ধীর চেহারা নিয়ে মেকলে আবার ফিরে আসবেন।

চেতনার পুনর্গঠন

ভারতীয় শিক্ষার্থীর এমনতর জাতীয়তাবাদী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চাইলে তার চেতনার পুনর্গঠন জরুরি। তাই, নৈতিকতার শিক্ষায় আমাদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয় সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মের বিপুল ভান্ডার থেকে ততটুকুই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করবে যতটুকু তার উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগে। মধ্য বা আধুনিক ভারত নয়, প্রাচীন ভারতের নির্বাচিত পাঠ চাই। সেখান থেকেই হিন্দুত্বের সংজ্ঞাকে গড়েপিটে নেওয়া যাবে, সেই নতুন সংজ্ঞায় ভগবদ্গীতা বা রামকৃষ্ণদেবকে জনতার কাছে পরিবেশন করে সংখ্যাগুরুর সেন্টিমেন্টকে এককাট্টা করা যাবে; যিনি বিচ্ছিন্ন হবেন তিনি সংখ্যালঘু, যিনি পুড়ে মরবেন তিনি গ্রাহাম স্টেইন্স। 

সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে যদি আমরা পাশ কাটাতে পারি তবে পাঠ্যসূচিতে প্রয়োজনীয় একমুখিতা আনা যেতেই পারে। তাই পাঠ্যসূচীর আগেই  আমরা শিক্ষার্থীদের গণ-চেতনায় গান্ধির মুখোমুখি গডসেকে বসিয়ে দেব। আজকের প্রজন্ম তো কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন (KFC) আর নীল জিনস এ নৈতিকতাকে খোঁজে! তাই অতিমারিতে সিলেবাসের বোঝা কমানোর অছিলায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের পাঠ্যঅংশ থেকে আমেরিকার সাংস্কৃতিক দাদাগিরির অধ্যায়কে, মানবাধিকারের অধ্যায়কে বাদ দেব! মানবাধিকারের চেতনাকে বাদ দিয়ে অথবা, সিলেবাস থেকে সমতা (equality) সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনা বাদ দিয়ে [১৩] আমরা আয়নায় মেকলের মুখোমুখি দাঁড়াব; শিক্ষাক্ষেত্রে এক প্রতিস্পর্ধী জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেবে! 

এমন সময়ে একজন  শিক্ষকই তো পারেন পাঠ্যপুস্তকের সীমানা পেরিয়ে শিক্ষার্থীর মনে কার্য-কারণ সম্পর্কের বিজ্ঞানসম্মত চেতনা জাগিয়ে দিতে! অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বিদ্যার শ্রেণিবিভাগ করে আণ্বীক্ষিকী বিদ্যা (হেতু বিদ্যা, তর্ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতির (নীতিশাস্ত্র) আলোচনায় আমাদের চিন্তার পদ্ধতি, সুনীতি দুর্নীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছিলেন, আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।[১৪] আজকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কৌটিল্যকে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চেতনায় প্রোথিত করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। 

নিজস্বতার বিকাশ

শিক্ষকদের এমন ভূমিকায় আমরা কিন্তু বহু কাল আগে থেকেই দেখে আসছি। মেকলের সমসময়েই বাঙালি লেখকের লেখা বাংলা ভাষা শিক্ষার বই প্রকাশিত হচ্ছিল; বাঙালির ছাপাখানায় বাংলা বই মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ হচ্ছিল। এই সমস্ত উদ্যোগ নিশ্চয়ই জাতীয়চেতনার বীজ বুনতে শুরু করেছিল একটু একটু করে! সেই সময়কার আধুনিক প্রযুক্তি ‘ছাপার  যন্ত্র’ হুগলি, চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, কলকাতায় এসে গিয়েছিল পঞ্চাশটিরও বেশি। সেই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে মিশনারিদের পাশাপাশি এই বঙ্গের লেখকেরাও বাংলা বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। এ সবের মধ্যে বাংলা ভাষা শেখানোর অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতির ব্যবহার করলেন মদনমোহন তর্কালংকার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মদনমোহন তর্কালংকার তাঁর লেখা ‘শিশুশিক্ষা’য় (১৮৪৯) ভাষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাব্যিক ছন্দের দোলায় যেমন  বিজ্ঞানচেতনা আর প্রাণীজগতের প্রতি সচেতনতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তেমনই চেয়েছিলেন তাদের নীতিবোধের উন্মেষ ঘটাতে। শিশুশিক্ষার প্রথম দ্বিতীয় আর তৃতীয় ভাগ [১৫] পড়লেই বোঝা যায় লেখক কতটা সচেতনভাবে যুক্তিবোধ আর ধর্মনিরপেক্ষ নীতিবোধের [১৬] চর্চায় শিশু শিক্ষার্থীর মনকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের আলোচনা আরও কিছুকাল পরে শুরু হলেও এই বঙ্গের শিক্ষার্থীদের চিন্তা চেতনায় প্রথম থেকেই মাতৃভাষার সুশৃঙ্খল চর্চার মাধ্যমে নিজস্বতার বিকাশে মদনমোহন ও তাঁর সময়কার শিশু পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। 

এই নিজস্বতার বিকাশই তো উদার জাতীয়তাবাদের ভিত তৈরি করতে সাহায্য করে। এমন বিকাশ প্রক্রিয়া ভারতসভা বা হিন্দুমেলার আগে থেকেই এই বঙ্গ প্রদেশে সক্রিয় ছিল ভাষা চর্চার মধ্যে দিয়ে। দেশজ ভাষার ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টায় জননেতৃত্ব সচেষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও ভাষা এবং ভাষানীতিকে উদার জাতীয়তাবোধের বিকাশের পথে চালিয়ে নিয়ে যেতে চাওয়া হয়েছিল। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঘোষণা করা হয়েছিল ভারতীয় ভাষাসমূহ এবং তাদের সাহিত্যের বিকাশ ঘটানো এতটাই জরুরি যে এ ছাড়া শিক্ষা এবং সংস্কৃতির মান উন্নয়ন সম্ভব নয় (sine qua non)। [১৭] শুধু তাই নয়, সাধারণ জনতা আর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তৈরি হওয়া দুস্তর ব্যবধান মেটাতে হলেও এ কাজ করতে হবে; যদিও প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তরে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও এই পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। আরও বলা হয়েছিল, শিশুস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়স্তর পর্যন্ত পাঠ্যবই আঞ্চলিক ভাষায় প্রণয়ন করতে হবে।  

জাতীয়তাবাদের ঘূর্ণিপাকে

এই সব লক্ষ্যে পৌঁছতে আমরা কিছুটা তো সফল হয়েছি! যদিও আজকের দিনে এসে দেখছি জনতা আর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্যবধান মেটে তো নি, বরঞ্চ বেড়েছে, তবু আঞ্চলিক ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি, সাহিত্য অকাদেমির মতো সংস্থা দেশের সংবিধান স্বীকৃত ভাষাগুলিতে রচিত সাহিত্যের উন্নতি আর সমন্বয় করার চেষ্টা করছে। তবু তার সাথে তীব্র হয়েছে সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষার গায়ে রাজনীতির গন্ধ। [১৮] ভাষা রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে আমাদের জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপগুলো তলিয়ে যেতে চায়, নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সচেতন হই না, শেখার কথা তো স্কুল কলেজ স্তরের শিক্ষার্থীদের এখনও ভাবাতেই পারি না! 

একমাত্র হিন্দি ভাষাটিকেই দেখা যাচ্ছে কিছুটা রেখে ঢেকে জনপ্রিয় গণমাধ্যমের সাহায্যে এবং সরকারি নীতির অছিলায় সংযোগকারী ভাষার সীমানা অতিক্রম করিয়ে রাষ্ট্রের মূল ভাষার পোশাক পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এর মধ্যে নিন্দুকেরা হয়তো একটা ভাষা-রাজনীতির সন্ধান পেতে পারেন। অথচ বিদ্যালয় স্তর থেকেই অন্যান্য ভারতীয় ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ পেতাম। এই উদ্বোধনের প্রয়োজন আজকের দিনে জরুরি কারণ আমাদের রাজনীতি জাতীয়তাবাদের রাজপথ ছেড়ে সংকীর্ণতার দিকে ক্রমশ এগোনোর প্রবণতা দেখাচ্ছে। 

হিন্দিভাষী শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমে আজও তামিল বা তেলুগু ভাষা শেখার ব্যবস্থা হয় না। অথচ, স্বাধীনতার পরে সেই ১৯৬৮ সালেই জাতীয় শিক্ষানীতি কিন্তু তিন ভাষার ফর্মুলা দিয়ে বলেছিল হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হিন্দি আর ইংরেজি ছাড়াও একটা দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা শেখার ব্যবস্থা রাখা শ্রেয়। ভাষার অর্থকরী কার্যকারিতা আর বাজারি সাফল্যের পরিসংখ্যান হয়তো আমাদের মধ্যবিত্ত দৃষ্টিকে প্রভাবিত করে; তাই বাংলা-ইংরেজি-হিন্দির পরিচিত ছকের বাইরে আমরা বাঙালিরা যেমন বেরোতে পারি না, তেমনই অন্য প্রদেশের ভারতীয়রাও নিশ্চয়ই বাংলা শেখার প্রয়োজন বোধ করেন না; করলে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও বাংলা বইএর বাজারের দুর্দশা নিয়ে আমাদের হা হুতাশ করতে হত না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মাতৃভাষার প্রতি বাঙালির সামগ্রিক দায়বদ্ধতা যেমন কিছু দিশাহীন লোকদেখানো স্তুতির পৌনঃপুনিকতায় আটকে থাকে, তেমনই আমাদের ভাষা-প্রতিবেশীকেও আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখি না। 

১৯৮৬ এবং ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে যে বয়স্ক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে তার প্রয়োজন কী আজকে ফুরিয়েছে? পরিসংখ্যানে সাক্ষরের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে পারে, কিন্তু শহরেই যে বিপুল সংখ্যায় অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষ আছেন তাদের কাছে সংগঠিত শিক্ষা উদ্যোগ কতটা পৌঁছাবে তা বিলক্ষণ বোঝা যায় যখন দেখি ২০২১-২০২২-এর বাজেটে শিক্ষক-শিক্ষণ আর বয়স্ক-শিক্ষায় বরাদ্দ ২৫০ কোটি টাকা ২০২২-২০২৩ এ হচ্ছে ১২৭ কোটি টাকা! [১৯] এইভাবে শিক্ষার অঙ্গনে তাঁদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হলে শিক্ষার মধ্যে দিয়ে উদার জাতীয়তাবাদী জীবনচর্চা সফল তো হবেই না, বরঞ্চ আমরা সেই মেকলের পথেই শিক্ষার মাধ্যমে এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে আরও পাকাপোক্ত করে তুলব। এইভাবেই ভারতের উদার জাতীয়তাবোধের আকাঙ্ক্ষা কতগুলো দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিলে আজও বিভক্ত হয়ে আছে। আমরাই তা করে রেখেছি। তাই মনে হয়, মেকলে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও আমরা মেকলেকে ছাড়িনি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাঁকে প্রতিবিম্বিত করার চেষ্টা নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছি।  

তথ্যসূত্র :  

১। ‘Speeches By Lord Irwin from 30th October 1929 to 18th April 1931’, Chelmsford Club Dinner, Govt of India Press, Simla, p. 357

২। ‘Indian Nationalism’, The Essential Writings, Irfan Habib, p.3 

৩। Irfan Habib, p. 6

৪। “অতীতের বীর্য, মহত্ব, কীর্তি ইহার উপরেই ন্যাশনাল ভাবের মূলপত্তন” : ‘আত্মশক্তি ও সমূহ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্ররচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পঃ বঃ সরকার, পৃ. ৬৭৭। 

৫। ‘বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ ১৮১৬১৮৫৫, সম্পাদনা, আশিস খাস্তগীর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি 

৬। “The grants which are made from the public purse for the encouragement of literature differ in no respect from the grants which are made from the same purse for other objects of real or supposed utility.” : ‘Macaulay’s Minute on Education’, February 2, 1835 

৭। বালক ঠাকুরদাসকে কলকাতায় নিয়ে এসে বাবা রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আশু অর্থকরী ইংরাজী-বিদ্যা শিক্ষার’ ব্যবস্থা করেছিলেন : ‘বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ, শম্ভু চন্দ্র বিদ্যারত্ন, কলকাতা, চিরায়ত প্রকাশন। 

৮। “We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern, a class of persons Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals and in intellect.” : ‘Macaulay’s Minute’

৯। ‘What’s  wrong with saffronising edu, asks Naidu’, The Times Of India, March 20, 2022

১০। National Education Policy, 2020, Ministry Of Human Resource Development, Govt. Of India, 4:11

১১। The Official Languages Act,1963, Department of Official Language, Govt of India

১২। জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০

১৩। এন সি ই আর টি-র পাঠ্যপুস্তক থেকে অতিমারির কারণ দেখিয়ে সিলেবাস কমানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। 

১৪। ‘কৌটিলীয়ম অর্থশাস্ত্রম, প্রথম খণ্ড, অধ্যাপক ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, পৃষ্ঠা ৭৫ 

১৫। বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ 

১৬। শিশুশিক্ষায় ‘ব্রহ্ম’ শব্দটার উল্লেখ সাকুল্যে একবার পাচ্ছি।

১৭। জাতীয় শিক্ষা নীতি, ১৯৬৮

১৮। জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০-তে লক্ষ্য করবার মতো একটা বাক্য হল : “In addition to high quality offerings in Indian languages and English, foreign languages, such as Korean, Japanese, Thai, French, German, Spanish, Portuguese, and Russian, will also be offered at the secondary level, for students to learn…( 4.20.)”. এই বাক্যে ইংরেজিকে সরাসরি ‘বিদেশি’ ভাষার দলে আর ফেলা গেল না। এ দেশে ইংরেজির এই বিশেষ অবস্থানকে শিক্ষণ বিজ্ঞান অবহেলা করতে পারে না, এবং ‘ইংরেজি মাধ্যমে’ শিক্ষার বিষয়টিও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে বলে আমরা মনে করি। 

১৯। The Indian Express, Sunday April 3, 2022

এ ছাড়াও, Analysis of Budgeted Expenditure on Education, 2017-18 to 2019-20, Govt. of India,  2022, থেকে দেখতে পাচ্ছি দেশের অন্তত পঞ্চাশ ভাগ রাজ্য বয়স্কদের শিক্ষাদানে কোনও বাজেট বরাদ্দই করেনি। 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান