ঔপনিবেশিক আমলে সংবাদপত্রে জাতীয়তাবাদী ভাবনা : একটি পর্যবেক্ষণ

সুমন পাত্র 

‘ন্যাশনালিজম’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’ কী তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে। জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব ও স্বরূপ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রয়াস লক্ষ করা যায় ইলি কেডৌরি, আলফ্রেড কোবান, এফ ও ইটার্জ ও ই এইচ কারের রচনায়। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক পর্যালোচনার নিদর্শন হিসাবে হ্যানস কন্, এইচ এম চ্যাডউইক ও এল স্নাইডারের রচনার কথা উল্লেখ করা যায়। ইউরোপীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয়তাবাদ ধারণাটির জন্ম।[১] যদিও ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক থেকেই রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ধারণাটি অস্পষ্টভাবে ধরা দিতে থাকে। জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক বিতর্ক সত্ত্বেও সাধারণভাবে বলা যায় যে জাতীয়তাবাদ মূলত একত্রিত হবার এবং একত্রে বসবাস করার একধরনের মানসিক প্রবণতা। এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে একটি সামাজিক, অন্যটি রাজনৈতিক। সামাজিক দিক থেকে একটি জনসমাজ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব খুঁজে পায় এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’-এর ভিত্তিতে সংগঠিত সমাজ সৃষ্টির প্রয়াস পায়। তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে ইউরোপের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী চিন্তার পার্থক্য রয়েছে। শাসন-শোষণের প্রয়োজনে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশগুলিতে আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যন্ত্র সৃষ্টি করেছিল। কোনও কোনও উপনিবেশে একই কারণে আধুনিক সংযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ ঘটেছিল এবং উপনিবেশগুলির ভৌগোলিক সীমানা নিশ্চিত রূপে চিহ্নিত হয়েছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত স্বদেশি সমাজ থেকে কিছুটা বিছিন্ন, বিদেশি শাসনাধীন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশি শাসন প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তাঁরা জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন।[২] ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপট তৈরিতে যেসব উপাদান সক্রিয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল সংবাদপত্রের ভূমিকা। এই প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী ভাবনা কতখানি প্রতিফলিত হয়েছিল তা তুলে ধরা হবে। 

এক   

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রে জাতীয়তাবাদী ভাবনা আলোচনা করার পূর্বে সংবাদপত্রের প্রচলন এবং সেই সংক্রান্ত ইতিহাস প্রথমে আলোচনা করা যাক। সভ্যতার আদিতে ছাপাখানা ছিল না। কিন্তু সংবাদপত্র সম্পর্কে সভ্য মানুষের মনে একটা ধারণা ছিল। মানুষের জানার অদম্য আগ্রহ থেকেই এই ধারণার জন্ম। রাজ্যশাসনের প্রয়োজনে রাজাকে জানতে হত রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে, প্রজারা রাজার সম্পর্কে কী ভাবছে, কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনও বিদ্রোহ দান বাঁধছে কিনা। গুপ্তচররাই রাজাদের সেই সংবাদ সংগ্রহ করে দিত। হাল আমলের দেওয়াল পত্রিকার মত হাতে লিখে রাস্তার মোড়ে  তা টাঙিয়ে দেওয়া হত। পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীন সংবাদপত্রের পরিচয় পাওয়া যায় প্রাচীন রোমে (খ্রিস্টপূর্ব ৫৯ অব্দ) যার নাম ছিল ‘Acta Diurna’ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Daily Doings। পরবর্তীকালে চিন কাঠের ছাপাখানা তৈরি করে। ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে চিনা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ হীরকসূত্র  কাঠের ব্লকে ছাপা হয়েছিল। তবে আধুনিক ছাপাখানার জন্ম অনেক পরবর্তীকালে। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দশকেই ছেনি দিয়ে ইস্পাত কেটে গতিশীল টাইপ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন জার্মানির মেইনজ শহরের এক স্বর্ণকার জোহান গুটেনবার্গ।[৩] 

গুটেনবার্গেরর মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ঘটনা ইউরোপের রেনেসাঁর বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। ভিক্টর হুগো একে বলেছেন ‘greatest invention of all times’। তবে ছাপাখানা আবিষ্কৃত হলেও সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে সময় লাগে আরো দুশো বছর। এই অন্তর্বর্তী সময়ে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হতে লাগল প্রচুর নিউজ বুক। এক একটি খবরকে কেন্দ্র করে এক একটি পুস্তিকা। সংবাদপত্রের সেই উষালগ্নে এই নিউজ বুকই ছিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার প্রথম পদধ্বনি। শুধু নিউজ বুক নয়, প্রকাশিত হতে শুরু করে নিউজ লেটার। একটি পাতায় একটি বা দু-টি করে খবর। এইসব খবর সংগ্রহের জন্য পেশাদার খবর সংগ্রাহক দল গড়ে ওঠে। ১৬২২ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।[৪] 

সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সপ্তদশ-অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে জাতীয় জাগরণে, প্রগতিশীল আদর্শ আত্মস্থ করার ব্যাপারে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ফ্রান্সের নতুন সামাজিক ব্যবস্থা ও তার উন্নত সামাজিক ধ্যান-ধারণার অগ্রদূত ও প্রচারক বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী সামন্তশ্রেণির নৈতিক অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক দৈন্য এবং তাদের প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক তাৎপর্য উন্মোচন করার ব্যাপারে সংবাদপত্রকে একটি কার্যকারী আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই ভলতেয়ার, দিদেরো, হলব্যাক্ হেলভিটাস এবং অন্যান্যরা জনসাধারণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সামাজিক ধারণা প্রচার করেছিলেন এবং তৎকালীন ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। শুধু ফ্রান্স নয়, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ধারণায় উদ্বুদ্ধ জনসাধারণের প্রাগ্রসর অংশ সংবাদপত্র তথা মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে জনসাধারণের মধ্যে সেই ধারণা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল।[৫] এইভাবে ইউরোপে ছাপাখানা আবিষ্কার এবং সংবাদপত্র প্রচলন জাতীয় জাগরণে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছিল। 

দুই

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে ভারতবর্ষে ছাপাখানা তথা সংবাদপত্রের প্রচলন কখন হয়েছিল এবং তা কীভাবে জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহায্য করেছিল? এ প্রসঙ্গে বলা যায়, প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে ভারতে সংবাদপত্র বা ছাপাখানা ছিল না। একমাত্র অশোকের শিলালিপি ছাড়া রোম ও ভেনিসের  আদলে ভারতে সর্বসাধারণের জন্য কোনও সংবাদপত্র প্রকাশিত হত না। রাজা ও সম্রাটদের পেশাদার গুপ্তচর বাহিনী থাকত। জমিদার ও নবাবরাও পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়োগ করতেন। মোগল আমলে বাদশাহরা প্রতি প্রদেশ এবং বড়ো বড়ো শহরে চর রাখতেন। এই চরেরা স্থানীয় সংবাদ সংগ্রহ করত। এই প্রথার অনুকরণে সেনাপতি, শাসনকর্তা এবং করদ রাজারাও রাজ দরবারের ঘটনা, রাজধানীর ও অন্যান্য প্রদেশের সংবাদ জানার জন্য সম্রাটের সভায় নিজ নিজ সংবাদ লেখক ‘ওয়াকেয়া-নবিস’ রাখতেন। এমনকি ধনী ব্যবসায়ীরাও ব্যক্তিগত সংবাদ লেখক নিযুক্ত করতেন — যারা বাণিজ্যিক ও অন্যান্য খবর সংগ্রহ করতেন। তবে যেহেতু সেইসময় ছাপাখানা আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত সংবাদ হাতে লেখা হত।[৬] 

ইউরোপে ছাপাখানা আবিষ্কারের প্রায় একশো বছর পর পর্তুগিজ মিশনারিরা ভারতের গোয়াতে প্রথম ছাপাখানা নিয়ে আসেন। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে গোয়ার ওই প্রেস থেকে পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম যে বইটি প্রকাশিত হয় তার নাম These and Other Things । এরপর ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ উপকূলের ট্রাঙ্কোবারে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে ওই ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় তামিল বাইবেলের অনুবাদ। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর-জেনারেল হেস্টিংসের উদ্যোগে কলকাতায় সরকারি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দু-বছর পরে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জেমস অগাস্টাস হিকি নিজের ছাপাখানা থেকে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট  বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার প্রকাশ করেন। হিকির সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি বড়ো বড়ো শহর থেকে সংবাদপত্র প্রকাশের তৎপরতা শুরু হয়। 

তিন

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের ইতিহাসকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। যথা — (১) ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ, (২) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ এবং (৩) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতা থেকে নয়টি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি হল — বেঙ্গল গেজেট (১৭৮০), ইন্ডিয়া গেজেট (১৭৮০), দি ক্যালকাটা গেজেট (১৭৮৪), বেঙ্গল জার্নাল (১৭৮৫), দি ক্যালকাটা ক্রনিকল (১৭৮৬), ক্যালকাটা কুরিয়ার (১৭৯৫), ইন্ডিয়া অ্যাপলো (১৭৯৫), বেঙ্গল হরকরা (১৭৯৮), দি রিলেটর (১৭৯৯)। এছাড়াও মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয় ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর মাদ্রাজ কুরিয়ার এবং বোম্বাই থেকে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বোম্বে হেরাল্ড। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রথম পর্বের এই সমস্ত সংবাদপত্রগুলি ছিল ইংরেজি ভাষায় লেখা এবং সংবাদপত্রগুলির মালিকানা, পরিচালনা ও সম্পাদনা সবই ছিল বিদেশিদের হাতে। এদেশীয় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবি-দাওয়া সংবাদপত্রগুলিতে উঠে আসেনি। এরফলে ঐ সময়কার সংবাদপত্রগুলি চটকদার খবর বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের বাহন হয়েছিল; না হয় বণিক সমাজের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।[৭]

চার 

ভারতবর্ষের সংবাদপত্রের প্রবর্তন বিদেশিদের হাত ধরে হলেও পরবর্তীকালে তা ভারতীয় জনগণের জাতীয় চেতনার জাগরণ ও প্রসারের ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। সংবাদপত্রের ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে দিগদর্শন, সমাচার দর্পণ  পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ভাষায় সংবাদ প্রকাশ শুরু হয়েছিল। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের সম্পাদনায় সংবাদ কৌমুদী-র প্রকাশ ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। কারণ এই প্রথম ভারতীয়দের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এরপর থেকেই ভারতীয়দের উদ্যোগে আঞ্চলিক ও ইংরেজি ভাষায় একের পর এক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে কলকাতা ছিল ভারতীয় সংবাদপত্রের পীঠস্থান। প্রসঙ্গত বলা যায়, উনিশ শতকে বাংলায় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ দেশবাসীর মনে স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। রামমোহন সর্বপ্রথম জাতির স্বাধিকার চেতনাকে উজ্জীবিত করেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সাফল্য তাঁকে উদ্দীপিত করেছিল। তাঁর অন্তরেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার চিন্তা সুপ্ত ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতার আগে দেশবাসীর মানসিক প্রস্তুতি তিনি চেয়েছিলেন। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় পার্শি সংবাদপত্র মিরাৎ-উল-আকবর। এটি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সংবাদপত্র।[৮] মিরাৎ-উল-আকবর-এর প্রথম সংখ্যাতেই রামমোহন বলেছিলেন, সত্যের প্রতি তাঁর যেমন শ্রদ্ধা আছে তেমনি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও তিনি শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তিনি ব্রিটিশ সরকারের ভারত ও আয়ারল্যান্ড নীতি পর্যালোচনা করে যেখানে সমালোচনা দরকার তা তিনি করবেনই। তিনি শাসকদের জানাবেন দেশের প্রকৃত অবস্থা কী? আর এজন্য তাঁকে সমস্যার মুখোমুখিও হতে হয়। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের নয়া প্রেস আইনের প্রেক্ষিতে গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের সদস্যরা পত্রিকাটির অনেক লেখা আপত্তিকর বলে মনে করেন ও পত্রিকাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে অভিমত দেন।[৯] যার ফলে রামমোহন মিরাৎ-উল-আকবর  প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি অ্যাডামের প্রেস অর্ডিন্যান্স বাতিল করতে না পারলেও বিদেশি শাসকদের অন্যায় ও দমন নীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতাব্দীর সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব জন উইলকিসের [১০] সঙ্গে তুলনা করা যায়।

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের মৃত্যুর পর তাঁর দেখানো পথে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে — যেগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয় উদার তথা মুক্ত চিন্তাভাবনা। সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে সংবাদপত্রগুলিতে — যার মধ্য দিয়ে স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদী ভাবনা জাগরিত হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, উনিশ শতকে বাংলাতে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সামাজিক সংগঠনের মধ্যে গৌড়ীয় সমাজ, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা; আর রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে জমিদার অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সংবাদপত্রের সম্পাদকরা বেশিরভাগই এই সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংগঠনের মুখপত্র হিসেবেও অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, যেমন সমাচার চন্দ্রিকা-র  সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত ছিলেন গৌড়ীয় সমাজের সঙ্গে। জ্ঞানান্বেষণ-এর দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক ছিলেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বদেশপ্রেম। ডিরোজিও ভারতবর্ষকে নিজের দেশ বলে মনে করতেন এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে স্বাদেশিকতার চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন পার্থেনন নামে যে ইংরাজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে তাতে আদালতের দুর্নীতি ও অবিচার প্রভৃতি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখা হত। যার ফলস্বরুপ হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই পত্রিকাটি প্রকাশ বন্ধ করে দেন। ১৮৩০-এর দশক থেকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলি প্রধানত শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য সচেষ্ট হলেও ব্রিটিশ সরকারের যেসব আইন জনস্বার্থবিরোধী ছিল, তার বিরুদ্ধে এই সংগঠনগুলি আবেদন-নিবেদন নীতির মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রতিকারের দাবি জানাত। এভাবে জনগণের মধ্যেও ধীরে ধীরে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি পায় যা পরবর্তীকালে স্বাধিকার চিন্তা ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহায্য করে। 

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কয়েকটি সংবাদপত্র ইংরেজ শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে সমালোচনায় মুখর হয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ বাংলা ভাষায় সোমপ্রকাশ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই সংবাদপত্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে চালিত হত এবং রাজনৈতিক সাংবাদিকতার একটা উচ্চমান বজায় রেখে চলত। ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে নীল বিদ্রোহের সময় সোমপ্রকাশ কৃষকদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিল।[১১] স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কথাও উচ্চারিত হয়েছিল সোমপ্রকাশ-এ । ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ১৫ পৌষ ‘ভারতবর্ষের আত্মশাসন’ নামে সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সোমপ্রকাশ প্রস্তাব করেছিল, “এদেশে একটি জাতীয় সাধারণ সভা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। আমরা বারম্বার ইহার প্রস্তাব করিয়াছি…যতদিন ইহা না হইতেছে, ততদিন আমাদিগের যথার্থ স্বাধীনতা ও যথার্থ উন্নতি হইতেছে না।”  যথার্থ স্বাধীনতা বলতে সোমপ্রকাশ কী বলতে চেয়েছিল তা স্পষ্ট না হলেও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের কথা যে বলেছিলেন, একথা স্পষ্ট বোঝা যায়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সোমপ্রকাশ  জাতীয় সভা প্রতিষ্ঠার জন্য বলেছিলেন। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার (১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ) তেইশ বছর আগে এই ধরনের সংগঠন গড়ার দাবি বাংলা সংবাদপত্রের পক্ষ থেকেই এসেছিল।[১২] বলাবাহুল্য সোমপ্রকাশ অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন ছিল। আগ্রার দরবার, প্রেস সংক্রান্ত আইন, ইলবার্ট বিল, বেঙ্গল ন্যাশনাল লিগ, ভারত সভা, জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি সববিষয়ে আলোচনা হত এই পত্রিকায়। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘ইংরেজ অধিকারে ভারত সুখী না অসুখী’, ‘ব্রিটিশ শাসনপ্রণালীর মহাদোষ’, ‘ভারতবর্ষকে হস্তে রাখিয়া ইংল্যান্ডের লাভ কী’ ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ। 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ধীরে ধীরে ভারতীয় জনমানসে স্বাধীন রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটতে থাকে। সেইসময় তিনটি বিদ্রোহ (সাঁওতাল বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ) ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল। তবে বেশিরভাগ সংবাদপত্রই সাঁওতাল বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। কিন্তু নীল বিদ্রোহের সময় সংবাদপত্রগুলি বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিল। বাংলা ভাষার সংবাদপত্রগুলির মধ্যে সংবাদ প্রভাকর, সম্বাদ ভাস্কর  ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশিত হত। তবে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট  পত্রিকাটি ছিল এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। হরিশচন্দ্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এর সূচনা কাল থেকেই নীলচাষীদের স্বার্থরক্ষায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি লেখেন যে বর্তমানে বাংলায় যেভাবে নীলচাষ প্রচলিত আছে তা একটা সুসংগঠিত জুয়াচুরি ও নিপীড়ন ব্যবস্থামাত্র। যাঁরা এর প্রতিবিধানে সক্ষম তাঁরা সব জেনেশুনেও নিষ্ক্রিয় থাকেন। ব্যবস্থাপক সভা এই অত্যাচারের বিষয় স্বীকার করেন না। সরকারি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদাসীন। ইংল্যান্ডের জনগণ এ বিষয়ে অজ্ঞ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেরও এই অত্যাচারের বৃত্তান্ত জানা নেই। বিশ্বের সভ্যসমাজেও এই অত্যাচার কাহিনি অশ্রুত।[১৩] এভাবেই হরিশচন্দ্র সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনমত গঠনের চেষ্টা করতেন। ‘Anarchy in Bengal’ নামে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ হিন্দু প্যাট্রিয়ট প্রকাশ করে। এমনই এক প্রবন্ধে হরিশচন্দ্র লেখেন যে, বাংলার কয়েকটি জেলায় এখন অরাজকতা বিরাজমান। মুষ্টিমেয় মানুষ যখন শুধুমাত্র অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তাদের সুবিচার প্রাপ্তিতেও বাধা দেয়, সে অবস্থাকেই অরাজকতা বলা হয়ে থাকে। আদালত, পুলিশ, সরকারি কর্মচারী — এসব বাহ্যিক আড়ম্বরের কোনও ত্রুটি দেশে নেই। কিন্তু এমনই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে অত্যাচারীর বিনা সম্মতিতে অত্যাচারিতের আইনের সাহায্য পাওয়ার কোনও উপায় নেই। সেখানে লাঠিবাজই শেষ কথা, আইনকানুন অস্তিত্বহীন, তাকেও অরাজকতাই বলা চলে। আমাদের প্রশ্ন কেন এই অবস্থা?… হরিশচন্দ্রের এই প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে একদিকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তীব্র ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে, অন্যদিকে তিনি দেশবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, হিন্দু প্যাট্রিয়ট কখনোই টিকে থাকার স্বার্থে সরকারের পদলেহন করেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই পত্রিকা স্বদেশবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও নীতি অবলম্বন করেছিল। 

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট প্রণীত হয়। এই আইন প্রনয়ণের ফলে ভারতীয়গণ প্রথম আইন পরিষদ সংক্রান্ত কাজে সরকারের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিল। এতে ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছিল ভারতীয় ও অ-ভারতীয়  উভয় জাতীয় সংবাদপত্রের সংখ্যা। সেইসময় বাঙালির সামাজিক আন্দোলন ক্রমশ জাতীয় চেতনার মধ্যে পরিব্যাপ্তি লাভ করে। তবে এই জাতীয় চেতনা হল — জাতীয় সংহতি। ওইসময় জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা প্রচার ও জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলির মধ্যে হরিনাথ মজুমদারের (যিনি কাঙাল হরিনাথ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন) এক পয়সার সংবাদপত্র গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত) অন্যতম। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় এবং অমানুষিক অত্যাচার বিষয়ে জনমত জাগ্রত করার জন্যই কাঙাল হরিনাথ পত্রিকাটি চালু করেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ জারি হলে ওই বছর ১৩ মার্চ কাঙাল হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা–য় লেখেন, “সংবাদপত্র আমাদিগের ব্যবসা নহে। তবে প্রজা কাঁদে, সেই ক্রন্দন লইয়া রাজদ্বারে ক্রন্দন করি, ভাবি রাজপুরুষগণ শুনিলে প্রজা আর কাঁদিবে না। তাহাদের কাঁদিবার কারণ দূর হইবে। এই জন্য প্রতি বৎসর ক্ষতি স্বীকার করিয়াছি এবং উৎকট রোগের আধার হইয়া যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। যার জন্য, যার প্রজার জন্য কাঁদি তিনি তার বিলক্ষণ পুরষ্কার প্রদান করিলেন। অতএব আর কাঁদিব না”। এই পত্রিকা জাতীয়তাবাদ জাগরণে অনুপ্রেরণা সঞ্চার করে বাঙালির মনে দেশপ্রেমের ফল্গুধারা সৃষ্টি করেছিল।

১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে শিশির কুমার, মতিলাল ঘোষের যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত হয় অমৃতবাজার পত্রিকা। শিশির কুমার সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শিক্ষা হরিশচন্দ্রের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তিনি অত্যাচারিতদের মুখপত্র হিসাবে এই পত্রিকাকে তুলে ধরেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বরোদার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কর্নেল ফারেরে-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার ঘটনাটিকে অমৃতবাজার পত্রিকা  সমর্থন করায় নিপীড়নের মুখে পড়তে হয়েছিল। সরকার দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির কণ্ঠরোধ করার জন্য ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। শিশির কুমার ঘোষ এই আইনের হাত থেকে রেহাই পাবার উদ্দেশ্যে ইংরাজি ভাষায় অমৃতবাজার প্রকাশ করতে শুরু করেন।  

কলকাতা থেকে ইংরাজি ভাষায় প্রকাশিত এই সময়কার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ছিল দি বেঙ্গলি। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন। প্রকাশনার শুরু থেকেই দি বেঙ্গলি  ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের বাড়াবাড়ি, ইলবার্ট বিল, জাতিগত সমাজসমূহের সংরক্ষণ, ভূমি সম্বন্ধীয় সম্পর্কাবলি, দুর্ভিক্ষ ও সমকালীন সামাজিক আন্দোলনগুলি সম্পর্কে এই পত্রিকার সুস্পষ্ট মতামত ওই সময়কার জনমতকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির পরামর্শেই স্যার দয়াল সিং মাজিঠিয়া ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে দ্য ট্রিবিউন  নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর একটা উদার জাতীয়তাবাদী চরিত্র ছিল।[১৪] 

ইতিমধ্যেই জাতীয়তাবাদের এক ভিন্ন চরিত্র ভারতবর্ষে পরিলক্ষিত হতে থাকে। এই নবলব্ধ জাতীয়তাবাদের মধ্যে যোগসূত্র ছিল ধর্ম — হিন্দু ধর্ম। হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা সেই সময় নেতৃবৃন্দের পক্ষেও একপ্রকার অসম্ভব ছিল। কারণ বহুধাবিভক্ত পরাধীন জাতির কাছে হিন্দু ধর্মই ছিল সবচেয়ে বড়ো ঐক্যবিধায়ক শক্তি। এই সময়েই বঙ্গবাসী (সাপ্তাহিক) ও বসুমতি (দৈনিক/সাপ্তাহিক) নামে দু-টি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এই দুই সংবাদপত্র সনাতন হিন্দু ধর্মের মুখপত্ররূপে কাজ করেছিল। তবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে উত্তীর্ণ করে তোলার এই আদর্শকে অনেকেই সমর্থন করতে পারেননি। তাই হিন্দু জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সেকিউলার জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় — যা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করেছিল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেকিউলার জাতীয়তাবাদের কথা সেই সময় দৃপ্তভাবে ঘোষিত হয়েছিল বেশ কিছু সংবাদপত্রে। এগুলির মধ্যে এডুকেশন গেজেট, সোমপ্রকাশ, সংবাদ প্রভাকর, অমৃতবাজার পত্রিকা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে এডুকেশন গেজেট ১২৮১ বঙ্গাব্দের ২৮ কার্তিক ‘জাতীয় সঞ্জীবতা’ শিরোনামে লিখেছিল, “আমরা পরস্পর মিলিব — না মিলিলে আর বাঁচিবার যো নাই — যাহারা এইরূপ ভাবিতে পারে তাহাদিগের মধ্যে জাতীয় সজীবতা আছে। তাহার বিনাশ সহজে সম্পন্ন হইবার নহে।” 

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সর্বভারতীয় ভিত্তিতে একটা সাংগঠনিক রূপ পায়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে উদার জাতীয়তাবাদীভাবাপন্ন নেতাদের পাশাপাশি চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। বাংলায় বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ; পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায়; মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক ছিলেন চরমপন্থী নেতাদের মধ্যে অন্যতম। দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের যে নতুন ধারণা ও পদ্ধতি উনিশ শতকের শেষদিক থেকে লক্ষ করা যায়, তা আরও প্রসারিত হয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে। তিলক দ্য কেশরী (মারাঠি সাপ্তাহিক) এবং দ্য মারাঠা (ইংরেজি সাপ্তাহিক) নামে দু-টি পত্রিকা প্রকাশ করে জনসাধারণের মধ্যে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার ও প্রসারে কার্যকারী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিলক মনে করতেন, ভারতবর্ষ বহু ধর্মের দেশ। ধর্মের ভিত্তিতেও দেশে অনৈক্য রয়েছে। আবার হিন্দুধর্মের ভিতরেও নানা গোঁড়ামি, কুসংস্কার আছে। তাই ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গঠন করতে হবে। এই জাতীয় ঐক্যের কথা তুলে ধরত ঐ দুটি পত্রিকা। কেশরী-তে  প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য তিলককে দু-বার বন্দিও হতে হয়েছিল।

পাঁচ 

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের ইতিহাসের তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৯০০-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল নিয়ে এখন আলোচনা করা হবে। বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই ভারতবর্ষে রাজনৈতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। এই শতাব্দী ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কাল হিসাবে চিহ্নিত এবং এই সময়ে সংবাদপত্রের ইতিহাসও গভীরভাবে এর দ্বারাই প্রভাবিত। প্রসঙ্গত বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ঔপনিবেশিক সরকারের নেতিবাচক নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলা তথা ভারতবাসীর মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কার্জনের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষিত হলে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব, কংগ্রেসের মধ্যে নীতিগত টানাপোড়েন-দ্বন্দ্ব, নরমপন্থী ও চরমপন্থী দুই শিবিরে ভাগ, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে স্বাধিকার, সাম্য ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার প্রয়াস, দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে মাতৃমুক্তির সংকল্প গ্রহণ, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন — এই সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই সময়কাল মূলত ডন, নিউ ইন্ডিয়া, সন্ধ্যা, যুগান্তর, বন্দেমাতরম্  পত্রিকার যুগ।[১৫] প্রসঙ্গত বলা যায়, স্বদেশি আন্দোলনের সূত্রপাত ও সফলতায় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে থেকেই সতীশচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ডন সোসাইটি স্বদেশি শিল্পায়নের জাগরণে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। ওইসময় সতীশচন্দ্রের সম্পাদনায় মাসিক ডন  জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বিপিনচন্দ্র পালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল নিউ ইন্ডিয়া  পত্রিকাটি, যার মধ্য দিয়ে তিনি স্বদেশি ও স্বরাজের ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। এছাড়াও চিনসহ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্পর্কে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। জাতিকে আত্মস্থ করা, স্বদেশ-পথে পরিচালিত করা, পরানুকরণের পরিবর্তে স্বদেশি সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে দৈনিক সন্ধ্যা  পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন। যুগান্তর, বন্দেমাতরম্  ছিল ঘোষ ভ্রাতৃদ্বয় কর্তৃক পরিচালিত। এই পত্রিকা দু-টি বাঙালি সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর মুখপত্রে পরিণত হয়। জাতীয় স্বাধীনতা ও পুনর্গঠনের বিষয়ে এই দুই পত্রিকা তাঁদের মতবাদ প্রচার করত। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের পূর্ণ সহযোগিতালাভের আশায় যুদ্ধের শেষে এদেশীয় জনসাধারণের দাবি মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের উদারপন্থী অংশ ব্রিটিশ সরকারের এই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু তিলক, অ্যানি বেসান্তের মতো চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধশেষে ভারতীয়দের দাবি মেটানোর প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না রেখে অবিলম্বে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে হোমরুল আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেইসময় অ্যানি বেসান্তের সম্পাদনায় নিউ ইন্ডিয়া পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়— যা হোমরুল আন্দোলনের মুখপত্র হয়ে ওঠে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার পূর্ব-প্রতিশ্রুতি মতো ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া মেটানোর ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেয়নি, তাছাড়া যুদ্ধজনিত কারণে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস জনসাধারণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে — যা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করেছিল। মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল গণআন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, সেসময় প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্র বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু তার মাঝেও সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার করে সমান্তরাল সাংবাদিকতা চলতে থাকে। এই সমান্তরাল অবাণিজ্যিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গান্ধিজি ছিলেন অন্যতম। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়া প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা হয়ে ওঠে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, কর্মসূচি ও নীতির মুখপত্র। রামমোহনের মতো গান্ধিজিও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে তিনি ‘The Immediate Issue’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হরিজন পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে তিনি হরিজন অর্থাৎ সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রকৃত স্বাধীনতা লাভের জন্য সবশ্রেণির সার্বিক উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ যে প্রয়োজন তা গান্ধিজি মনে করতেন। 

গান্ধিজি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে জাতীয় কংগ্রেসের একটি গোষ্ঠী ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ্য পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন। মতিলাল নেহেরু ছিলেন এই দলের সম্পাদক। এই দলের নেতা কে এম পানিক্কর নিজেদের কর্মসূচি প্রচার করার জন্য জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে হিন্দুস্তান টাইমস প্রকাশ করেন। এই সময়ের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে মতিলাল নেহেরু এই ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। লালা লাজপত রায়ের প্রচেষ্টায় লাহোরে দ্য পিপল  নামে একটি ইংরাজি সাপ্তাহিক জাতীয়তাবাদী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। 

অন্যদিকে ১৯২০-এর দশকে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে আর একটি নতুন ধারা লক্ষ করা যায়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রসারে সাহায্য করেছিল। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতবর্ষে ওয়ার্কস অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির মুখপত্র হিসেবে ক্রান্তি  নামে একটি মারাঠি সাপ্তাহিক এবং স্পার্ক  ও নিউ স্পার্ক  নামে দু-টি ইংরাজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এম জি দেশাই এবং লেস্টার হুচিনসন ছিলেন এই পত্রিকা দু-টির সম্পাদক। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার সঙ্গে এই দুই সম্পাদকই যুক্ত ছিলেন। এঁরা যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন তা হল ভারতবর্ষে মার্কসবাদের ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া, শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলন এবং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সমর্থন করা। ১৯৩০-এর দশকে জাতীয় কংগ্রেসে যুব সমাজের মধ্যেও কমিউনিস্ট মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এইভাবে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির সূচনা হয় এবং এই দলের প্রধান মুখপত্র হিসাবে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট নামে এক ইংরাজি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। কমিউনিস্টরাও দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং পিপলস ওয়ার  নামে দুটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় দেশে সতেরোটি ভাষায় ৪০০০ সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হত।[১৬] 

ছয়

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে জনসাধারণকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে সংবাদপত্র যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও একাধিক প্রেস আইন প্রণয়ন করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, প্রথমদিকে কোম্পানির প্রতিনিধিরা চাননি যে উপনিবেশে ছাপাখানা আসুক বা সংবাদপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের প্রসার ঘটুক। সেই কারণে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির জনৈক জার্মান কর্মচারী উইলিয়াম বোলটস সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য ছাপাখানার প্রয়োজনীয়তার কথা বললে কোম্পানির কুনজরে পড়েন এবং তার ওপর বহিষ্কারের আদেশ জারি করা হয়। পরবর্তীকালে জেমস অগাস্টাস হিকি সংবাদপত্র প্রকাশ করে কোম্পানির বিরাগভাজন হন। আসলে সংবাদপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে সরকার বিরোধী কোনও বার্তা উপনিবেশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক তা কখনোই কোম্পানি চায়নি। এতৎসত্ত্বেও ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

ঔপনিবেশিক আমলে কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রথম সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ চাপান মার্কুইস অফ ওয়েলেসলি। তিনি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে কোনও কিছু প্রকাশনার পূর্বে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য একজন সরকারি অনুমোদনকারী নিযুক্ত করেন। এই সরকারি পদাধিকারী যদি মনে করতেন কোম্পানি বিরোধী কোনও সংবাদ পরিবেশন হতে যাচ্ছে তাহলে সেই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতাও তার ছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সেন্সর ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। ওই বছর হেস্টিংস প্রেস সেন্সর প্রথা তুলে দিলে ভারতীয়দের মধ্যে সংবাদপত্র প্রকাশের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। অবশ্য সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে এই উদার পরিস্থিতি খুব বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল অ্যাডাম সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর পুনরায় নিপীড়নমূলক নীতি নেন। সেইসময় রাজা রামমোহন রায় অ্যাডামের এই নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। মিস সোফিয়া কোলেট এই আবেদনপত্রকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘Areopagitica’[১৭] বলে উচ্চপ্রশংসা করেছেন। যদিও সেই আবেদন সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দিয়েছিল। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে চার্লস মেটকাফ গভর্নর জেনারেল হয়ে এলে অ্যাডামের সংবাদপত্রের ওপর ওই নিয়ন্ত্রণমূলক আইন প্রত্যাহার করে নেন। তাই তাঁকে ‘ভারতীয় সংবাদপত্রের মুক্তিদাতা’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এরফলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কলকাতাসহ অন্যান্য বড়ো বড়ো শহরগুলি থেকে সংবাদপত্র প্রকাশের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। 

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ভারতবর্ষে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে তীব্র আঘাত করে। সেই সময় গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ করেন (এই আইন ‘কন্ঠোরোধী আইন’ নামে পরিচিত)। এই আইন অনুযায়ী সরকার মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এবং প্রয়োজনে সংবাদপত্রের প্রচারও বন্ধ করতে পারত। অবশ্য এক বছরের জন্যই এই আইনটি কার্যকর থাকবে বলা হয়। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ‘দ্য প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ বুকস অ্যাক্ট’-এর মধ্য দিয়ে পুনরায় বই ও সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়। 

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার ক্ষেত্রে যে আইনটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেটি হল ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ জারি করা ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিতে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা ও জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলে লর্ড লিটন এই আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের বিভিন্ন ধারায় বলা হয় — (১) সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মুদ্রাকর এমন কিছু সংবাদ ছাপাবেন না যাতে পাঠক সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে, (২) ব্রিটিশ ও ভারতবাসীর  মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, এমন কিছু সংবাদপত্রে ছাপানো যাবে না, (৩) কোনও দেশীয় সংবাদপত্র এই নিয়মগুলি না মানলে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের অর্থ এবং প্রয়োজনে মুদ্রণযন্ত্র সরকার বাজেয়াপ্ত করবে। এই আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য অমৃতবাজার পত্রিকা  রাতারাতি ইংরাজি ভাষাতে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে উদার মতাবলম্বী বড়োলাট লর্ড রিপন ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ বাতিল করেন। পরবর্তী প্রায় তিন দশক ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিকে খুব বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। 

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। শুরু হয়েছিল স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যেও চরমপন্থী মনোভাবাপন্ন কিছু নেতার আবির্ভাব হয় — যাঁদের লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বরাজ। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্রুত প্রসারের ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘নিউজ পেপার অ্যাক্ট’  এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের প্রেস অ্যাক্টই সবথেকে কঠোর। এই আইনে বলা হয় মুদ্রাকরকে সরকারের কাছে নগদ টাকা জমা রাখতে হবে জামিন বা জামানত হিসাবে। সংবাদপত্রে আপত্তিকর কিছু প্রকাশিত হলে দশহাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। তারপরেও কোনও অপরাধ করলে ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই আইনের ফলে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৩৫০ মুদ্রণযন্ত্র ৩০০ সংবাদপত্র ও ৫০০ বই বাজেয়াপ্ত হয়।[১৮] এই আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের ফলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রেস ল রিপিল এন্ড আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে পূর্বের আইনটি প্রত্যাহৃত হয়। 

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা, গান্ধিজির কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে কিছুটা স্তিমিত করে দিয়েছিল। কিন্তু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে যখন পুনরায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে গণআন্দোলনের পথ প্রশস্ত হচ্ছিল, তখন ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত করার জন্য ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস এমার্জেন্সি পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। পরে এই আইনটি বারবার সংশোধিত হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ‘ইমার্জেন্সি পাওয়ার্স অর্ডিন্যান্স’-এর অন্তর্ভুক্তির ফলে আইনটি আরও জোরদার ও ব্যাপক হয়। ওই বছরই ‘ক্রিমিনাল ল আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’-এর 14, 15 ও 16 নম্বর ধারা অনুযায়ী এই আইনকে সংশোধিত করা হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের সংশোধনী আইন প্রেস আইনকে কঠোর করে তোলে। এই আইন অনুসারে সরকার নির্দিষ্ট কতকগুলি প্রদেশের জন্য কিছু খবর প্রকাশ নিষিদ্ধ করে, তবে অন্য প্রদেশের খবরের কাগজে সেই সংবাদ প্রকাশিত হত। এছাড়া দুই  কলামব্যাপী শিরোনাম, সংবাদ বিন্যাস এমনকি একটা সংবাদ কীভাবে এবং কাগজের কোন্ জায়গায় ছাপানো হবে, কোন্ কোন্ রাজনৈতিক নেতার ছবি ছাপানো হবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে আরো দু-টি আইন এই নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠোর করে তোলে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ‘ফরেন রিলেশনস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন হয়েছিল। এই আইনে বলা হয়েছিল কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতিসাধন করতে পারে এরকম কোনও রচনা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এরপর ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান স্টেটস (প্রোটেকশন) অ্যাক্ট’-এর প্রণয়ন ভারতীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে আরও সংকুচিত করে। এই আইনে বলা হয় ভারতের যে কোনও দেশীয় রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা কোনও প্ররোচনামূলক রচনা প্রকাশও দণ্ডনীয় অপরাধ। এই সব আইনগুলিই জাতীয়চেতনা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশে সংবাদপত্রের নিশ্চিত ভূমিকার জ্বলন্ত প্রমাণ। 

সাত

এখানে আর-একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে যে, ঔপনিবেশিক আমলে সংবাদ পরিবেশনকারী সংস্থাগুলির ভূমিকা কী ছিল? এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতবর্ষে জাতীয় জাগরণের সূচনা থেকেই সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের কাজ আরম্ভ হয়। ‘রয়টার’ এবং ইংরেজ-মালিকানার সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের মারফত বিদেশি সংবাদ পাওয়া যেত। আর ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ ছিল রয়টারের অধীনস্থ এবং আধা সরকারি সংস্থা। অন্যদিকে ভারতীয় সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯২৭ সালে এস সদানন্দ ‘ফ্রি প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের মতো আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের জাতীয় আন্দোলনের সংবাদ প্রচারের অসম্পূর্ণতা তাঁকে এই কাজে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। তিনি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রি প্রেস’-এর মাধ্যমে জাতীয় ঘটনাবলির পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রচারে খুবই আগ্রহ দেখান। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ফ্রি প্রেস’-ও বন্ধ হয়ে যায়। ‘ফ্রি প্রেস’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভূত হলে বিধুভূষণ সেনগুপ্ত ‘ইউনাইটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি ভারতীয় সংবাদ সরবরাহ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই সংস্থা সংবাদ সরবরাহের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। 

শেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আধুনিক কালের ঘটনা। ব্রিটিশের নির্লজ্জ শাসন ও শোষণের মধ্য থেকেই এই জাতীয়তাবাদের জন্ম। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সামাজিক পটভূমিকায় যেসব উপাদান সক্রিয় ছিল তার মধ্যে সংবাদপত্রের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমদিকে সংবাদপত্রগুলি ভারতীয়দের ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করত। যার মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে জন্ম নেয় স্বাধিকারবোধ। এই স্বাধিকারবোধ ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসারে সাহায্য করেছিল — যা জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বহুধাবিভক্ত ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশের জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি তাদের নিজ নিজ কর্মসূচি, নীতিসমূহ, সংগ্রামপদ্ধতি জনপ্রিয় করে তুলতে সংবাদপত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাছাড়া সংবাদপত্র ভারতীয় জনসাধারণকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলি সম্পর্কে অবহিত করেছিল — যা ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় আবেগ ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল। সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে জাতীয় আবেগ ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকলে ব্রিটিশ সরকারের নগ্নরূপ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন সংবাদপত্রগুলির কণ্ঠরোধ করার জন্য একের পর এক আইন প্রণয়ন করতে থাকে। শুরু হয়েছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন যা  জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছিলেন। আর এসবের মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসার ও অগ্রগতিতে সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রতীয়মান হয়। 

তথ্যসূত্র : 

১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাতীয়তাবাদ’ (অনুবাদ ও সম্পাদনা অশোককুমার মুখোপাধ্যায়, কৃত্যপ্রিয় ঘোষ), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ১ 

২) কেশব চৌধুরী, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ও স্বরূপ’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ১২ 

৩) পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারতীয় সংবাদপত্রের রূপরেখা’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, ২০২১, পৃ. ১৫

৪) তদেব, পৃ. ১৫

৫) এ. আর. দেশাই, ‘সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনালাজিম’, মুম্বাই, ২০১৩, পৃ. ২০৬

৬) তদেব, পৃ. ২০৬ 

৭) পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালির নবজাগরণ (১৮১৮-১৮৭৮)’, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ. ১৮-১৯

৮) এ. আর. দেশাই, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৮

৯) পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারতীয় সংবাদপত্রের রূপরেখা’, পৃ.৭৮

১০) উইলকিস ছিলেন ইংল্যান্ডের নর্থ ব্রিটেন পত্রিকার সম্পাদক। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন,  সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাঁর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রিপোর্টারদের প্রবেশের অধিকার কর্তৃপক্ষ মেনে নেন।

১১) এ. আর. দেশাই, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৯

১২) পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালির নবজাগরণ (১৮১৮-১৮৭৮)’, পৃ. ২২৫

১৩) গৌরাঙ্গ গোপাল সেনগুপ্ত, ‘হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু পেট্রিয়ট’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি, কলকাতা, ২০০৩, পৃ. ১২১

১৪) এ. আর. দেশাই, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৯-২১০।

১৫) তারাপদ পাল, ‘ভারতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস’, পত্রভারতী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ২১৬

১৬) এ. আর. দেশাই, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১২-২১৩

১৭) ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে জন মিলটন লাইসেন্সিং ও সেন্সরশিপের বিরোধিতা করে যে বক্তব্য রাখেন তা অ্যারিওপ্যাজিটিকা নামে পরিচিত। বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষার ইতিহাসে এটি সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং আবেগপ্রবণ দার্শনিক বক্তব্য।

১৮) তারাপদ পাল, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৬

গ্রন্থপঞ্জি :

এ. আর. দেশাই, ‘সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনালাজিম’, মুম্বাই, ২০১৩।

কেশব চৌধুরী, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ও স্বরূপ’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৮৪।

গৌরাঙ্গ গোপাল সেনগুপ্ত, ‘হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু পেট্রিয়ট’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি, কলকাতা, ২০০৩।

তারাপদ পাল, ‘ভারতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস’, পত্রভারতী, কলকাতা, ২০১০।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালির নবজাগরণ (১৮১৮-১৮৭৮)’, কলকাতা, ১৯৭৭।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারতীয় সংবাদপত্রের রূপরেখা’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, ২০২১।

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা (১৮১৮-১৮৩০)’, প্রথম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ২০০১। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাতীয়তাবাদ’ (অনুবাদ ও সম্পাদনা অশোককুমার মুখোপাধ্যায়, কৃত্যপ্রিয় ঘোষ), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা।

সন্দীপ দত্ত, ‘বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিবৃত্ত (১৯০০-১৯৫০)’, গাঙচিল, কলকাতা, ২০১৬।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান