রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতা : জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রদ্রোহ

চিত্রিতা বসু

১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি ব্যক্তি ও নাগরিক অধিকারপত্রে (French Declaration of the Rights of Man) বলা হয়েছিল “Each people is independent and sovereign” [১]। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সমষ্টির স্বাধিকারের ক্ষেত্রটিকে নির্দিষ্টভাবে স্পষ্ট করা হয়নি। এটি তিন শতক আগে ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের সময়কার কথা, যখন গণতন্ত্রের ধারণাটিই সদ্যোজাত। রাজতন্ত্র, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ নেতিবাচক সময়পর্ব পার হওয়ার পরও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রে ব্যক্তি ও সমষ্টির নাগরিক অধিকারের সীমানা রাষ্ট্রীয় (পড়ুন দলীয়) রক্তচক্ষুর বাইরে যেতে অক্ষম। অন্ধ ন্যাশনালিজম এর অবাধ্য সন্তানদের ধরে ধরে জেলে পুরে শিক্ষা দেওয়ার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এখনও অক্ষুণ্ন রেখে চলেছে দেশভক্ত শাসকেরা। সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলে বিনা আয়াসেই জুটে যায় মাওবাদী কিংবা ‘আর্বান নকশাল’ — এর তকমা। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাল গঙ্গাধর তিলককে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের বিচার চলাকালীন বিচারপতি আর্থার স্ট্রেচির বক্তব্য ছিল ঘৃণা, শত্রুতা, অপছন্দ, বৈরিতা, অবমাননা এবং সরকারের প্রতি যে কোনও অসাধু উদ্দেশ্যমূলক মনোভাবই দেশদ্রোহিতার আওতায় পড়ে। প্রশ্নটা হল দ্রোহটুকু যার বিরুদ্ধে সেই ‘রাষ্ট্র’-এর সংজ্ঞার ভেতর কি কেবল ঔপনিবেশিক বা দলতান্ত্রিক সরকার পড়ে? নাকি, তার ভেতর জনগণও ছিটেফোঁটার মতো অস্তিত্ব রক্ষা করেন? বর্তমানে, ব্রিটেনে সিডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহের আইনি ধারাকে লুপ্ত করে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু ব্রিটিশ-ভারতীয় উক্ত আইনি ধারার প্রতি স্বাধীন ভারত সরকারের একনিষ্ঠতা বেড়েই চলেছে। বছর দুই আগে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইনের দ্বারস্থ হওয়া অশীতিপর মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীকে দীর্ঘ আটমাস বন্দি রাখা হয়, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় — এই ঘটনার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছিল বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ। এক্ষেত্রেও অজুহাত ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তত্ত্বগত দিক থেকে জাতীয়তাবাদ জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নীতির কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে জাতীয়তাবাদের ধারণাটি ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে প্যান জার্মানিজমের বর্ণবিদ্বেষমূলক মতাদর্শ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল — এই মতাদর্শকে হাতিয়ার করে হিটলার জার্মানিতে প্রচুর জনসমর্থন পেয়েছিলেন, যা জার্মানিকে আত্মধ্বংসী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। একইরকমভাবে এদেশেও নির্বাচনের আগে যুদ্ধের জিগির তুলে জনসমর্থন আদায় করে নেওয়ার ঘটনা আমাদের অজ্ঞাত নয়, অস্ত্র সেই ‘জাতীয়তাবাদ’। 

দুই

মাটির বাড়ি, তার উপর খড়ের ছাউনি, গোয়াল ঘর। ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কিছু পাকা বাড়ি, অট্টালিকা। যতদূর দেখা যায়, মাইলের পর মাইল জুড়ে ক্ষেত, সবুজের মনোটোন। এরই মধ্যে রোদে পোড়া অস্থিচর্মসার কিছু মানুষ মাথায় গামছা বেঁধে গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ার সঙ্গে যুঝে চলেছে নিরন্তর। তাদের ভাষায় লেগে রয়েছে স্থানিক ছাপ আর মুখে পান দোক্তা খাওয়া হাসি। মেঠো পথ ধরে খানিক দূর গেলেই উঠতে পারা যায় চওড়া পিচের রাস্তায়, যেখানে সশব্দে এগিয়ে চলেছে বিচিত্র হর্নের যানবাহন। জীবনের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগের মেলবন্ধন মানুষকে তড়িৎ-গতিতে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে আধুনিকতর সভ্যতার দিকে। পশ্চিমবঙ্গে বসে ‘দেশ’ বলতে আমাদের চোখের সামনে এই ছবিই ভেসে আসে। 

তত্ত্বগত দিক থেকে ‘নেশন’ কী? এর উত্তরে জোসেফ স্টালিন এর বক্তব্য : “Nation is a historically constituted stable community of people, formed on the basis of a common language, territory, economic life and psychological makeup manifested in a common of culture।” [২] 

‘নেশন’ শব্দটির অর্থ ‘রাষ্ট্র’ না ধরে যদি ‘জাতি’ অর্থে গ্রহণ করি, তাহলে ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক অধিকারকে বাদ দিয়ে মানুষের ভাষাগত, ঐতিহ্যগত, সমমানসিকতার ঐক্যসূত্রে একটি জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। যে কোনও কেন্দ্রীয় স্বার্থে সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে ‘জাতি’ বলা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবে, নির্দিষ্ট জাতিভুক্ত ব্যক্তির শারীরিক কাঠামো, জীবন-যাপন ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে জাতিভিত্তিক কিছু সাধারণ ধর্ম থেকে যায়। এবার যদি ‘নেশন’ শব্দটিকে রাষ্ট্র অর্থে গ্রহণ করি, তাহলে ব্যক্তির আঞ্চলিক এবং বিশ্ববাজারে তার অর্থনৈতিক অবস্থানটিও রাষ্ট্রিক পরিচিতি হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে চলে আসে। রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থ এবং জাতিগত স্বার্থ — সব সময় এক নাও থাকতে পারে। তাই জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রপ্রীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। 

জাতিত্ববোধ থেকে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যচেতনার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, সমতলকেন্দ্রিক শাসকদলের পাহাড়ের প্রতি অবহেলার বিরুদ্ধে সরব হয়ে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন হয়েছে। এর পিছনে মূল কারণ বাঙালি সংস্কৃতি কখনোই দার্জিলিংসহ পার্বত্য অঞ্চলগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল না, তাদের পৃথক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বর বরাবর বজায় ছিল। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে বাংলা ভাষাকে উত্তরবঙ্গে বাধ্যতামূলক করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিপুল প্রতিবাদ হয়েছিল, যার ফলে হিমালয়ান ডিভিশনে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পায় নেপালি ভাষা। এরপর জ্যোতি বসুর সময়ে সুভাষ ঘিসিং-এর নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলন এবং সরকারি দমননীতির ঘটনা অতীত হয়ে গেলেও উত্তরবঙ্গের গোর্খা আবেগের সঙ্গে বঙ্গসংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এখনও সমানভাবে বিরাজমান। কিংবা, উপকূলীয় অন্ধ্রপ্রদেশের, তুলনামূলকভাবে আর্থসামাজিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তেলেগু ভাষাভাষী মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিরোধ শেষ করতে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে পৃথক রাজ্যের স্বীকৃতি দিতে হয়। সুতরাং, স্বাজাত্যবোধ থেকে সৃষ্ট এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদ, যা প্রান্তিকতার প্রতিবাদ করে। ভাষাকেন্দ্রিক প্রান্তিকায়ন রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের একটি বিশেষ অঙ্গ। ভারত বিভাগের পর নবগঠিত পাকিস্তান, পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল, যার ফলস্বরূপ জন্ম হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবলমাত্র একটি পৃথক নেশনের জন্ম দেয়নি, প্রতিরোধ-বিদ্রোহের ক্ষেত্রে সাহিত্যের, যে সামাজিক অঙ্গীকার এবং কলমের বিপুল শক্তি সমগ্র বিশ্বের কাছে, তা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কবি শামসুর রহমানের ‘স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার/ তৃপ্তি পেতে চাই’ কিংবা ‘বর্ণমালা আমার দুখিনি বর্ণমালা’ — এই পঙ্‌ক্তিগুলো নিশ্চিতভাবেই মুক্তিকামী চেতনাকে প্রেরণা ও দৃঢ়তা জুগিয়েছিল।  

মূল স্রোতের ইতিহাসচর্চায় ‘জাতীয়তাবাদী ইতিহাস’ মানে যুদ্ধ এবং শাসকের পালাবদলের ফ্রেমে সময়কে বিশ্লেষণ করা, কিন্তু সেখানে ‘জাতি’ তথা মানুষের নিত্যনৈমিত্তিকতার গল্প বেমালুম বাদ পড়ে যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘একটি ঐতিহাসিক চিত্র’ নামক এক দীর্ঘ কবিতায় ভারতবর্ষের নিরবচ্ছিন্ন চলমান ইতিহাসটিকে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে সমাজবদ্ধ মানুষের চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা নেই। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মুখে জল তুলে দেয় ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী। তবু, বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্ররোচনায় পা দিয়ে দাঙ্গার সময়ে বেরিয়ে আসে ধারালো ইস্পাত। সারা বছরই কম বেশি চলতে থাকে জমি দখলের লড়াই, চাষিদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল তুলে নিয়ে যায় জোতদার। এইরকম বৈষম্যে মোড়া সমাজের ভেতরেও বহির্পৃথিবীর খোলা হাওয়া এসে পৌঁছায় মানুষের কাছে। রাষ্ট্রের কাছে কিছু-না-পাওয়া মানুষটিও সুনীল গাভাস্কার সেঞ্চুরি করলে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেন, কোনও গণ্যমান্য ভিন্নভাষী ব্যক্তিত্ব নিজেদের বক্তৃতায় দুই লাইন বাংলায় বললে এক মুহুর্তে তাঁকে আপন মনে করতে দ্বিধা করেন না। নেতা-মন্ত্রী-শাসকের গড়ে দেওয়া ‘দেশে’র ভেতরে আসল হৃদয়টি এমনই সহজ। তাই জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে ‘জাতীয়তা’-কে খুঁজলে কেবল শাসককে পাওয়া যায়, সাহিত্য তথা কবিতার অন্দরে ডুব দিলে জাতির স্পন্দনটিকে জানা গেলেও যেতে পারে। 

তিন

বাংলা কবিতা মোটামুটিভাবে তিনের দশক থেকেই সমাজের দর্পণ হয়ে ওঠার গুরুদায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে অন্তর্মুখী হতে শুরু করে। কিন্তু বিভাব-অনুভাবের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ অস্বীকার করে সমাজ রাজনীতিকে এড়িয়ে কেবল নিজের ভেতর ডুব দেওয়া সম্ভবপর ছিল না, তাই রবীন্দ্রত্তোর কবিতার কেন্দ্রীয় থিম রাজনীতি বা সমাজচেতনা না হলেও কবিদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং তৎকালীন সমাজে রাজনৈতিক প্রতিবেশের প্রভাব উঠে এসেছে ঐতিহাসিক নথির মতোই। দেশ বা মাতৃভূমি নিয়ে আবেগ যেমন কবিতায় ঠাঁই পেয়েছে, তার চেয়েও ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেশের যন্ত্রণায় নীল হয়েছে বাংলা কবিতা। পরাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম যেভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন সেই ধারা অব্যাহত রেখে স্বাধীনতার পরও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরকার বিরোধী প্রতিস্পর্ধা দেখিয়েছেন বাংলার কবিরা। সময়ে সময়ে নেমে এসেছে সেন্সরশিপের আঘাত এবং রাষ্ট্র বিরোধিতার চার্জ। গরাদের ওপারে বসেও প্রতিবাদী কলম থামেনি।  

দেড়শো বছর ধরে কল্পিত ‘আচ্ছে দিন’-এর আশায় স্বাধীনতা-সংগ্রাম করেছে যে ভারতবাসী, স্বাধীনতার কাছে সমস্ত শাসনতান্ত্রিক বঞ্চনার প্রত্যাশা চাপিয়ে দিয়ে দিন গুনতে থাকা সেই সমস্ত ভারতীয়দের একাংশ ’৪৭–এ এক ধাক্কায় কেবল অন্য দেশের বাসিন্দাই হল না, র‍্যাডক্লিফের কলমের আঁচড় তাদের জীবনে দারিদ্র্যের ঢেউ আছড়ে ফেলল। কাগজে কলমে ক্ষমতা হস্তান্তর আর উপনিবেশ থেকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পরিণত হওয়া—এই দুই এর মাঝখানে আশমান জমিন ফারাক। শুধু দেশভাগজনিত সমস্যা নয়, সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা, শিল্পের অভাব, বেকারত্ব — এই বিষয়গুলোর মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে সুগঠিত পরিকল্পনা ছিল না, বা থাকলেও সেগুলোর যথাযথ প্রণয়ন হয়নি। এর ফলস্বরূপ তরুণ সম্প্রদায়ের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ শিশুরাষ্ট্রের মতোই দিশাহীন হয়ে উঠেছিল।  

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় নিবিড়ভাবে বামপন্থার স্পর্শ থাকলেও তাঁর সমাজবীক্ষণ একদেশদর্শী নয়, বস্তুত তিনি সমাজবিপ্লবের পথ খুঁজেছেন বামপন্থার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে লেখা বহুপঠিত ‘স্বাগত’ কবিতাটির দুর্ভিক্ষ-শোষিত গ্রামগুলোর খাদ্যের সন্ধানে শহরে উঠে আসার ইতিহাস বাস্তবসম্মত। মার্কসবাদের পার্টি লাইন অনুসরণ করে তাঁকে আশার বাণী শোনাতে হয়েছে কবিতার শেষে—এইটুকু অতিরেক বাদ দিলে সমগ্র কবিতাটিই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সমগ্র ভারত জুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি দেখা দেয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বুর্জোয়া শিল্পপতিদের মুনাফার অঙ্ক এবং কালোবাজারি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অসহযোগী’ বা ‘দুঃশাসনীয়’ —এর মতো ছোটগল্প থেকে যে ভয়ংকর সময়ের কথা উত্তরকালের পাঠক অবগত হয় সেই একই ইতিহাস সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলমেও উঠে এসেছে —

                          “তিন সন্ধ্যা উপোস দিলাম                                                                                                                 
                            আজ খাচ্ছি বুনো শাক                                                                                                                  
                            পরনে যা আছে তাতে                                                                                                                     
                             ঢাকা যায় না লজ্জা                                                                                                                         
                             ঘটি বাটি বেচেছি সব                                                                                                                      
                             আছে বলতে ছিল যা”

ব্রিটিশ বিরোধী জনবিক্ষোভ ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের শিকড়গত সমস্যা ছিল ফসলের ওপর কৃষকদের অধিকার থেকে বঞ্চনা ও মহাজনি অত্যাচার। ‘চিরকুট’ কবিতাটির শেষ দুই পঙ্‌ক্তিতে শ্রেণিসংগ্রামের ইঙ্গিতও সুভাষ মুখোপাধ্যায় রেখে দেন — “পেট জ্বলছে ক্ষেত জ্বলছে/ হুজুর, জেনে রাখুন/ খাজনা এবার মাপ না হলে/ জ্বলে উঠবে আগুন।” চিরকুট কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো লেখা হয় ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, আর তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ থেকে। সহজেই অনুমান করা যায় কবিতায় উঠে আসা এই রোষ, ভূমিহীন কৃষকদের, ভাগচাষীদের তথা সমস্ত কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের। 

স্বাধীনতার প্রাক্কালে নৌবিদ্রোহ (১৯৪৬) এবং সমগ্র দেশে দলমত নির্বিশেষে জনসাধারণ ধর্মঘট, হরতালসহ সহিংস এবং অহিংস উভয় পথেই ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল সেই সময় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ কেউই এই জনতার স্বাধীন প্রতিস্পর্ধাকে সমর্থন করেনি। এ আর দেশাই ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক প্রবণতা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন : 

“এই সময়কার আর একটা বৈশিষ্ট্য হল এই যে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েরই নেতৃত্ব স্বাধীনতার আকাংঙ্ক্ষায় জনগণের সংগ্রামী পদ্ধতিগুলোকে নিন্দা করেছে…মহত্মা গান্ধি জ্বালাময়ী ভাষায় জনগণের ক্রমবর্ধমান সংগ্রামকে এইভাবে নিন্দা করেন : ‘যদি তারা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত মিলতে পারত তবে আমি তা বুঝতে পারতাম। অবশ্য তার অর্থ হত ইতর জনগণের হাতে ভারতবর্ষকে তুলে দেওয়া। এর পরিণতি দেখবার জন্য আমি ১২৫ বছর বাঁচতে রাজি নই; বরং আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়াও তার থেকে ভালো।’ ” (‘হরিজন’, ৭ই এপ্রিল, ১৯৪৬) [৩]

বলা বাহুল্য, জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা রাজনৈতিক দলগুলো গূঢ় রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকেই গণআন্দোলনের দায় নিতে অস্বীকার করেছিল। সেই সময় একজন সমাজকর্মী ও সাহিত্যিকের পক্ষে নেতৃত্বহীন জনতার নার্ভটিকে নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করা কঠিন ছিল না। তাঁর ‘অগ্নিকোণ’ কবিতাটিতে দেখি, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, এবং সামন্ততন্ত্র এক আসনে উপবিষ্ট, “অগ্নিকোণের পোড় খাওয়া যত মানুষ” তাদের লড়াই এই তিন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে :

“দেশটাকে ভালোবেসে                                                                                                               বাপদাদা যার প্রাণ দিল ফাঁসিকাঠে।                                                                                                          সে দৃশ্য দেখে —                                                                                                                            সাদা ছেলে পেটে ধ’রে                                                                                                                      যার কচি মেয়ে দিয়েছে গলায় দড়ি                                                                                                            সে দৃশ্য দেখে —                                                                                                                              যার বংশের বাতি                                                                                                                          নিভে গেছে মারীমড়কের হাওয়া লেগে।                                                                                              দেশের মাটিতে গড়াগড়ি যায়                                                                                                       সুলতান, রাজারাজড়া, উজির, শিখণ্ডীদের মাথা।” 

অন্যদিকে, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশকে দেখেছেন দারিদ্র্যের ভাঙা আয়নায়। স্বাধীনতার আগে যে ভারতবর্ষকে তিনি দেখেছিলেন, স্বাধীনতার পর যে অবস্থার খুব একটা বদল এসেছে তা নয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ গ্রহচ্যুত প্রকাশিত হয় এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রাণুর জন্য প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। ইতিমধ্যে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৯৪৩-এর মন্বন্তর, ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা। এক্সোডাসের অব্যবহিত পর যে যন্ত্রণা ও জীবনসংগ্রাম কয়েক প্রজন্মকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রায় নীরব করে দিয়েছিল সেই যন্ত্রণা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ভোকাল হয়েছে। এ যেন অভিজাত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে স্বাধীনতালব্ধ প্রকৃত ‘দেশ’ সম্পর্কে সচেতন করার প্রচেষ্টা। রাণুর জন্য কাব্যগ্রন্থের ‘মুখোশ’ কবিতাটিতে দেখি এমনই এক চিত্র :

“কান্নাকে শরীরে নিয়ে যারা রাত জাগে,                                                                                               রাত্রির লেপের নিচে কান্নার শরীর নিয়ে করে যারা খেলা                                                                                        পৃথিবীর সেই সব যুবক যুবতী                                                                                                               রোজ ভোরবেলা                                                                                                                             ঘরে কিংবা রেস্তোরাঁয় চা দিয়ে বিস্কুট খেতে-খেতে                                                                                             হঠাৎ আকাশে ছোঁড়ে দু’চারটি কল্পনার ঢেলা; 
এবং হাজারে কয় রান করে আউট হয়ে গেছে                                                                                       ভুলে গিয়ে তারা হয় হঠাৎ অদ্ভুত…”

রান-আউট হয়ে যাওয়া অগণিত মানুষের ভবিষ্যৎ যেমন অন্ধকার, বর্তমান তেমনই অসহনীয়। তথ্য বলছে, পূর্ববাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু মানুষের কারণে আকস্মিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অবিভক্ত বাংলার অর্ধেকের বেশি কৃষিজমি পার্টিশনের সূত্রে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি — এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের আয়বৃদ্ধির জন্য খাদ্যশস্যের পরিবর্তে পাটচাষ — এই সমস্ত কারণে খাদ্যসংকট তৈরি হয়। কিন্তু এর মধ্যেও পুঁজিবাদী শ্রেণি নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির চোরাই পথ আবিষ্কার করে নিতে পেরেছিল। অথচ শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি চলতি সমস্যা চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে গিয়ে মন দিত বিশ্বরাজনীতির খোশগল্পে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন —

“হঠাৎ পড়লো চোখে কাগজের এডিটোরিয়াল,                                                                                  আমেরিকা ভালো, চীন ভালো                                                                                                           ট্রুম্যান পাঠাবে অন্ন আমাদের কাল                                                                                                             হে যুবক, হে যুবতী পৃথিবীতে তোমাদের কতটুকু দাম?                                                                          কান্নাকে শরীরে নিয়ে কার ঘরে কয় ফোঁটা দিয়ে গেলে আলো?" 

এক টুকরো রুটির দাম যে দেশে জীবনের থেকে বড়ো হয়ে গেছে, সেখানে তথাকথিত জাতীয়তাবোধ নেহাতই স্বপ্নকল্পনামাত্র। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আমার বাংলা গ্রন্থটিতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাই যেখানে তিনি বারো তেরো বছরের উলঙ্গ কিশোরকে দেখেছিলেন, খাদ্যের অভাবে যার চেহারা হয়েছে অজানা জন্তুর মতো, বাজারের রাস্তা থেকে খুঁটে খুঁটে চাল আর ছোলা মুখে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু, স্বাধীনতার পর তো এমন হওয়ার কথা ছিল না! কিন্তু পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি। ‘রুটি দাও’ কবিতাটিতে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন —

“রুটি দাও রুটি দাও                                                                                                                     বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে নাও                                                                                                      সমরখন্দ বা বোখারা তুচ্ছ কথা                                                                                                         হেসে দিতে পারি স্বদেশের স্বাধীনতা”

আসলে ‘স্বদেশ’ — এর সংজ্ঞাটি যে ঠিক কী দেশভাগের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটাই মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। ক্ষুধার্ত শরীরে দেশপ্রেম নয়, বুকে থাকে কেবল খাদ্যের জন্য আর্তি, “রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি” —এইটাই সারসত্য। সর্বগ্রাসী একটা ‘নেই নেই’ চিৎকার এই দেশের মাটিতে লেগে থাকে। “পাথরও চৌচির হতো ভারতবর্ষের বন্ধ্যা পাথর না হলে/ জঠরের অসহ্য ক্ষুধায়/ ধূমাবতী জন্মভূমি সন্তানের দুর্ভিক্ষের ভাত কেড়ে খায়।” (নচিকেতা) আপাত দেশবিরোধী এই ক্ষোভ বস্তুত আধা-সামন্ততান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ। সাধারণ কৃষিজীবী শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে গড়া দেশ যখন শাসকের অবহেলায় বিপন্ন হয়ে ওঠে বুদ্ধিজীবী হিসেবে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্তুতি না করে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, এরূপ সমালোচনা বা প্রতিবাদ কিন্তু সর্বাত্মক ছিল না, শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার থেকে প্রশস্তি করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার উদাহরণ কোনও সময়েই দুর্লভ নয়। এদের মধ্যে কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ বা রাজনীতিবিদ কেউ বা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বা নেহাতই সাধারণ মানুষ। ‘চলচ্চিত্র’ কবিতাটিতে দেখি সমাজে কিছু অভিনেতা অভিনেত্রীদের ভিড় যারা রাষ্ট্রকে প্রশ্রয় দিয়ে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছেন: 

“জন্ম থেকে বধির যে জন                                                                                                              আঁতুড় থেকে বোবা                                                                                                                        কেউ শ্রোতা। কী সভায় ভাষণ দেয়;                                                                                                          আগে পাছে মিছিলে হাঁটে…                                                                                                         জন্মভূমি মুখ ঢেকেছে ঢাকুক।                                                                                                           ঘৃণা লজ্জা ভয়                                                                                                                                 এ তিন থাকতে নয়…”

জাতীয়তাবোধের এইরূপ বিপজ্জনক ধারা, যেখানে ভয়ে বা সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির আশায় রাষ্ট্রের কাছে মাথা বিকিয়ে দেওয়া হয়, তা এই শতকেও একইভাবে বিদ্যমান। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত আগে কবিতায় যেভাবে ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান শোনা যেত, প্রতিবাদের অনুরূপ স্বর স্বাধীনতার পরও শোনা গেছে। জাতির কল্যাণ যে রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, ক্ষমতার দংশন যেখানে জাতীয়জীবনকে ধ্বস্ত করে তোলে বাংলা কবিতার গর্জন সেই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। মাতৃভূমির প্রতি তীব্র ভালোবাসা রয়েছে বলেই কবিরা অন্যায়ের প্রতি সহনশীলতা দেখাননি বরং, ‘জনম দুখিনি মা’-এর ভাঙাচোরা মুখ স্পর্ধার সঙ্গে তুলে এনেছেন নিজেদের লেখনীতে।    

চার

স্বাধীনতার দুই দশক পরে সদ্যোজাত গণতন্ত্র খানিকটা স্থৈর্য লাভ করলেও রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের গতিপ্রকৃতি ধীরে ধীরে দলতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের অন্দরে দলাদলি এবং নেতাদের ক্ষমতালিপ্সা স্বাধীনতার খুব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল এমনটা একেবারেই না। ছয়ের দশকে ‘দেশ’কেন্দ্রিক বিরক্তি কোন্ পর্যায়ে গিয়েছিল তার পরিচয় পাই জোয়ার ভাঁটায় ষাট সত্তর বইটিতে : 

“মধ্যবিত্ত বাড়ির তরুণরা পালাতে চায় এ দেশের আশাহীন, দম আটকানো পরিবেশ থেকে। কোনও আবেগ অনুভূতির বাঁধন তাদের ঠেকাতে পারে না, তারা উত্তরাধিকার ত্যাগ করতে চায়। দেশ থাকুক পড়ে তার দুর্গতির মধ্যে উদ্ধারবিহীন, ভারতে থাকার মানেই হলো তার দৈনন্দিন হাঁড়িকাঠে মাথা গোঁজা।”[৪] 

১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ভারত-চিন যুদ্ধ দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে দেয়, একইসঙ্গে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টির নৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নাগরিক বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং দৈনিক পত্র পত্রিকা অন্ধ কমিউনিস্ট বিরোধিতায় শামিল হয়। শুধু তাই নয় সস্তা দেশপ্রেমের আবেগকে হাতিয়ার করে বিরোধী রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা থেকেই দিকে দিকে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতানেত্রীদের দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে নানাবিধ অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়। সরকারের স্তাবকতা গণমাধ্যমগুলোর কাছে ব্যবসা করার নিরাপদ ও সহজ উপায় হয়ে ওঠে। কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ কবিতাটি এই প্রসঙ্গে উদ্ধারযোগ্য :

“মনে হয় সংবাদপত্রের যুগ এইভাবে বিবেকের দৈনিক হত্যার                                                                  বিবরণ বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠে, ক্রমে                                                                                               লাভজনক এক ব্যবসা দাঁড়িয়ে গিয়েছে বলে                                                                                       কবির সংবাদদাতা নিজস্ব সংকেতে                                                                                         বিদ্যুৎবিক্ষোভ ছেড়ে, আকাশের কাছে ফের ফেরৎ পাঠায়” 

সরকারের তরফে ‘জাতীয়তা’ তখন দলতন্ত্রের নামান্তর মাত্র। সেই সময়কার রাজনীতিমনস্ক কবিরা ক্ষয়িষ্ণু জাতীয়তাবাদের চেহারাটিকে এড়িয়ে যাননি বা অন্ধ দেশপ্রেমের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাননি। মাতৃভূমির প্রকৃত মূর্তিটি কবি কমলেশ সেনের ‘ভারতবর্ষে এসব নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে’ কবিতায় নিখুঁত ভাবে ধরা পড়েছে: 

“এ সবই এখানে স্বাভাবিক                                                                                                        স্বাভাবিক, পঞ্চাশ কোটি মানুষের                                                                                                          না খেয়ে থাকা।                                                                                                                       স্বাভাবিক, জেলখানায় লোহার ডাণ্ডা দিয়ে                                                                                           হাজার হাজার তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা”

এই কবিতায় প্রায় সংবাদ পরিবেশনের ঢঙে উঠে আসে কাশীপুর বরাহনগরে ‘দেড়শ যুবকের গায়ে/ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারার’ ঘটনার কথা। স্বৈরাচারী শাসকের চোখের ওপর চোখ নির্ভীকভাবে রেখে সোচ্চার হওয়ার সাহস বাংলা কবিতা সেই সময়ে দেখিয়েছে। 

এই পর্বে, গ্রামগুলোর দিকে নজর ফেরালে দেখা যেত, কৃষিক্ষেত্রে আধা-সামন্ততন্ত্র তখনও অটুট ছিল। উৎপাদনের পুঁজির জন্য মহাজন এবং ফসল বিক্রির জন্য আড়তদার-মজুতদারদের ওপর নির্ভরশীলতা চাষিদের অবস্থা সঙ্গিন করে তুলেছিল। সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেছিল যে, নকশাল আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস এড়ানো যেত না। এই সময়ে কবিদের কাছে সাহিত্যিক শুদ্ধতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সামাজিক দায়। শিল্পে সাময়িকতার ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কবিতার শব্দে শব্দে উগড়ে দিয়েছিলেন জ্বলন্ত ক্ষোভ। মণিভূষণ ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে সাতের দশকের গতিপ্রকৃতি সামান্য আঁচ করা যায় : 

“ওর নাতিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ওর কাছে পাওয়া গেছে—                                                                গাঁজা কোকেন চোরাই সোনা এল এস ডি আন্তমহাদেশীয়                                                                ক্ষেপনাস্ত্র হাইড্রোজেন বোমা প্রভৃতি কিছুই নয়,                                                                                         মাও সেতুং ও চারু বাবুর কয়েকখানা চটি বই” 

             (‘দেওয়াল লিপি’: “উৎকণ্ঠ শর্বরী”) 

বিনা প্রমাণে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে ঢুকে গ্রেফতার, প্রকাশ্যে হত্যা দৈনন্দিনের ঘটনা হয় উঠেছিল ’৭০-’৭১ সালে। এই প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় ‘বাবরের প্রার্থনা’র মতো কাব্যগ্রন্থ, ‘ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’-এর মতো অমোঘ পঙ্‌ক্তি। নকশাল আন্দোলনকে সমর্থন বা অসমর্থনের প্রশ্নে দ্বিধা থাকলেও স্বাধীন সরকারের শাসনতান্ত্রিক অকর্মণ্যতা ও ভয়াবহতা সাতের দশকের কবি-শিল্পীদের এতোটাই প্রভাবিত করেছিল যে পরবর্তী কয়েক দশকের কবিতায় প্রায়শই এই সময়কার অস্থিরতা ও ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়। 

১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধির নির্দেশে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করলে শিল্প সাহিত্য সংবাদপত্র — সব কিছুর ওপরই সেন্সরশিপ নেমে আসে। ‘এক দেশ এক নেত্রী’ বা ‘জরুরি অবস্থা হল অনুশাসন পর্ব’ — প্রোপাগান্ডার স্রেফ স্লোগানগুলোই শ্রীমতী গান্ধির নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বৈরাচারী রূপটি প্রকাশ্যে এনে দেয়। এই সময়ে কালো টাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশি ঋণের ঝুলি ক্রমাগত ভারী হয়ে জনগণের ওপর চাপতে থাকে। ইন্দিরা গান্ধির দুঃশাসনীয় কালপর্বই কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতাটির জন্মলগ্ন যা গণতন্ত্রে প্রত্যয়ী মানুষের কাছে প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। জাতির যখন দুঃসময়, ‘দেশ যখন জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’-এ পর্যবসিত শিল্পীরা মুখ খুলেছেন জাতির সপক্ষে। এর জন্য তাঁদের শাস্তিও কম পেতে হয়নি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিদের কবিতায় চালানো হয়েছে সেন্সরের কাঁচি, তাছাড়া, জেল-জরিমানা তো আছেই। তবু, শাসককে তাঁদের স্বরূপটিকে স্মরণ করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব থেকে তাঁরা বিরত হননি। 

চল্লিশ থেকে সত্তর অবধি সময়কালে যাঁরা রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন, তাঁরা কেবল হাওয়ায় ওঠা স্লোগান রচনা করেননি। যাঁদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হল তাঁদের অনেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু সমাজ-রাজনীতিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার প্রয়াস ছিল। ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও কবিতায় রাষ্ট্রনৈতিক অন্যায়ের বিরোধিতা সমান মাত্রায় বজায় ছিল। প্রতিবাদে মুখর কবিদের অনেকেই বামমনস্ক ছিলেন, তাই বামপন্থার মুখোশের অন্তরালে শুরু হওয়া পূর্বসূরিদের অনুবর্তনকে তাঁরা মানতে পারেননি। যেমন নকশাল অন্দোলন পরবর্তী সময়ে বহু নেতার আখের গুছিয়ে নেওয়া দেখে স্তম্ভিত হয়ে কবি পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন : ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্দিরা গান্ধির নির্দেশে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করলে শিল্প সাহিত্য সংবাদপত্র —সব কিছুর ওপরই সেন্সরশিপ নেমে আসে। এই সময় কবিদের ধিকৃত প্রতিবাদ ছিল দৃষ্টান্তমূলক। মণিভূষণ ভট্টাচার্য এই সময়ে লিখছেন : 

“খুলে যাচ্ছে সংসদের সিঁড়ি                                                                                                               দিন জ্বলে পেট জ্বলে                                                                                                                আমাদের ঠোঁটে জ্বলে আধপোড়া বিড়ি…                                                                                         শপথ সংকল্প সব জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছি                                                                                           —ভুলেছি শ্রেণির ভাষা                                                                                                                      —ভুলেছি কব্জির জোর                                                                                                                        —ভুলেছি লড়াই করে বাঁচা।”

                    (‘বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ভাবনা’, “কাকেরা আশ্চর্য পাখি”) 

কবি জয়দেব বসু নিজে তৎকালীন শাসকদলের সমর্থক হয়েও রাষ্ট্রশক্তির ভঙ্গুর কঙ্কালটিকে আড়াল করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। তাঁর ‘জনগণতান্ত্রিক ইশতেহার : পাঁচ’ কবিতাটিতে দেখি, শাসক দলে নাম লেখালে জুটিয়ে নেওয়া যায় ‘মঞ্চ, মাৎসর্য এবং বিনি পয়সার মদ’। আক্ষরিকভাবেই, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে পারার নেশা জীবনে বস্তুগত সাফল্যই এনে দেয় না, পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকেও সোনার চামচে করে মুখের কাছে ধরে দেয়। অর্থাৎ, পার্টিতে থাকা মানে বংশ পরম্পরায় নিশ্চয়তায় বাঁচা, পাশাপাশি অবশ্যই সামাজিক ও নৈতিক দায় দায়িত্ব থেকে গা বাঁচিয়ে চলা। বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরের শেষ পর্বে, প্রোমোটারি ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত, পার্টির ভেতরে দল-উপদলে বিভক্ত অসংখ্য গোষ্ঠী, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সমাজবিরোধীদের ভোটের স্বার্থে প্রশ্রয়দান ইত্যাদি অগণিত সমস্যা ক্রমশ সহ্যের ঊর্ধ্বে চলে যেতে থাকে। তাঁর ‘পুলিশ’ কবিতাটিতে অনিয়ন্ত্রিত পার্টিবাজির বাস্তবোচিত চিত্র পাই :

“যখন তোমাকে রাস্তার কোনো মাস্তান                                                                                                 পথ আটকিয়ে শোনায় আজিব দাস্তান,                                                                                                                                         আপত্তি দেখে মুখ ঠেসে ধরে কাদায়,                                                                                                        ধরতেই পারে, সেই তো পাড়ার দাদা…                                                                                                তখন তোমার অবস্থা দেখে কারা                                                                                                          হে-হে করে হাসে, কারা বিশ্বাস হারায়?”

নিজেদের ‘কমিউনিস্ট’ বলে দাবি করা বুদ্ধিজীবীদের একাংশের একদেশদর্শী পড়াশোনা এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রেও একচোখামিকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখছেন : 

“মার্কস পড়ো, সাংখ্যও পড়ো,                                                                                                         ঝান্ডাকবিদের মতো সরিয়ে রেখো না পাশে হিমেনেথ, তবু                                                                                   সযত্নে বর্জন কোরো প্লাতেরোর নাম। ঐ আগামী শতক থেকে                                                                     উঠে আসছো টাটকা তরুণ, তুমি এইভাবে কবিতা লিখবে?”

একপাক্ষিক ও খণ্ডিত জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়েই তরুণদের রাজনৈতিক গোঁড়ামি শুরু হয়। বলা বাহুল্য, এই একপাক্ষিকতার মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষণা পাওয়ার একটি সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য অবশ্যই নিহিত থাকে। এতক্ষণের আলোচনা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে চারের দশক থেকে প্রায় গত দশকের শেষ অবধি, কবিতায় জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিস্তৃত অংশ অধিকার করে রয়েছে রাষ্ট্রবিরোধিতা। বাক্‌স্বাধীনতা হরণ করার প্রচেষ্টা যত তীব্র হয়েছে, ততই তীক্ষ্ণ রয়েছে প্রতিবাদের ভাষা, সমালোচনার ভাষ্য।

পাঁচ

রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক কালে সাহিত্যে তথা কবিতায়, ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তির প্রণোদনা থেকে ‘স্বদেশ’ বা ‘জন্মভূমি’ সম্পর্কে আবেগের উৎসারণ ঘটানো হত। স্বাধীনতার পর, যে সময়ে, পরাধীনতা সংক্রান্ত প্রচার কাজের আর প্রয়োজন রইল না, সেই সময়েও বাংলা কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার সহজ সরল প্রকাশের মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবাদ ধরা দিয়েছে। যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কাল মধুমাস’ কাব্যগ্রন্থের ‘জননী জন্মভূমি’ কবিতাটিতে মা-কে ঘিরে শৈশবের স্মৃতিতে ‘দেশ’ ধারণাটি একাকার হয়ে গেছে। কবি বলছেন তাঁর দশ আঙুলে লেগে রয়েছে দেশের মাটির স্পর্শ। এখানে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রোপাগান্ডা বা অপ্রাপ্তির শোক নেই, আছে কেবল দেশের জন্য নিঃশর্ত ভালোবাসা। এ কবিতার সময়কাল ছয়ের দশক, হৃদয়ে টাটকা স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি। কবি লিখছেন: 

“হে জননী                                                                                                                                   আমরা ভয় পাইনি।                                                                                                                       যারা তোমার মাটিতে নিষ্ঠুর থাবা বাড়িয়েছে                                                                                      আমরা তাদের ঘাড় ধরে                                                                                                               সীমান্ত পার করে দেব। …                                                                                                                   মুখ বন্ধ করে।                                                                                                                             অক্লান্ত হাতে—                                                                                                                                  হে জননী,                                                                                                                                   আমরা ভালোবাসার কথা বলে যাব।”

ভারতবর্ষ হল এমন এক দেশ, যেখানে জাতির কোনও নির্দিষ্ট পরিচায়ক চিহ্ন নেই, কারণ বিচিত্র জনগোষ্ঠীর জীবন-অভ্যাস ও সংস্কৃতি এতে মিশে আছে। রাজনৈতিক রক্ষণশীলতার মধ্যে প্রবেশ না করে বাংলা কবিতা জাতীয়তাবাদকে, জাতি অর্থাৎ অখণ্ড ভারতবর্ষীয় সাধারণ মানুষের দিন যাপন, সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার চিত্রকে নিত্যকালীন চশমায় চোখ রেখে দেখেছিলেন, সেই কারণে বাংলার কবিরা মানুষের সুস্থ জীবনের পথে আসা অসংখ্য রাষ্ট্রিক প্রতিবন্ধকতা লক্ষ করা মাত্রেই তার প্রতিবাদ করেছেন। রাষ্ট্রের অন্ধ সমালোচনা নয়, সমাজে ঘটে চলা অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খুব যথাযথভাবেই তাঁরা তাঁদের শব্দাস্ত্র সাজিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রোত্তর কবির কাছে স্বদেশ ঠিক কতখানি কমলেশ সেনের এই পঙ্‌ক্তিটি পাঠ করলে অনুভব করা যায়:

“এই হচ্ছে তোমার দেশ ভারতবর্ষ                                                                                                      দেশ বলতেই                                                                                                                              তোমার বুকের মধ্যে এক গভীর বেদনা                                                                                             মৌমাছির মতো গুণগুণ করে ওঠে” 

                            (‘এই হচ্ছে তোমার দেশ’)

এমন বেদনাময় ঝঙ্কারে হৃদয় কেঁপে ওঠে যে নাম উচ্চারণ করলে, তার অবমাননার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অনিবার্য। জাতীয়তার সেন্টিমেন্ট অনেক সময়েই যুক্তি-বিবেচনা-দূরদৃষ্টি অতিক্রম করে অনির্দিষ্ট পথে ছুটে যায়, যে কারণে বিদ্রোহের উত্তেজক আগুন অনেক সময়েই জাতিগত কল্যাণকে অস্বীকার করে। যে কারণে বঙ্গভঙ্গের সময়ে বয়কট আন্দোলনের ধ্বংসাত্মক দিকটির প্রতি রাবীন্দ্রিক বিরোধিতাকে অন্ধ জাতীয়তাবাদীরা মানতে পারেননি। 

পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতেবিচার করলে সমাজের পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিকদের ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাইকাণ্ডে শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতিবাদ জনমানসে সাড়া ফেলেছিল। এখন, শাসকের কাছে মেরুদণ্ড বিকিয়ে নীরবতা অবলম্বন করে থাকার দৃষ্টান্ত আখছাড় দেখা যাচ্ছে। সদ্য ঘটে যাওয়া রামপুরহাট গণহত্যার পর সার্বিক সোচ্চার প্রতিবাদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ইতস্তত কিছু কবিতা বা কাব্য সংকলন প্রকাশ করে বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি খাটিয়ে পিঠ বাঁচিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী চিন্তন গণতন্ত্রমুখী ও দলমত নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে পুরস্কার আর উচ্চপদের হাতছানি, বর্তমানে যে ভাবে শিক্ষিত সমাজকে আনত করে তুলতে সক্ষম হয়েছে, তাতে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা এখন বিপদসীমার প্রান্তে অবস্থান করছে। আশা রাখা যায়, সময়ের বিপন্নতা কাটিয়ে জাতীয়তাবাদের যথাযথ গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারব।  

তথ্যসূত্র :

১) E.J.Hobsbawm, ‘Nations and Nationalism since 1780’, Cambridge University Press, Delhi, First Published 1990, First South Asian edition 2013, Page-19

২) Joseph Stalin, ‘Marxism and the National and Colonial Question’, Paris 2021, Foreign Language Press, Page-7.

৩) এ আর দেশাই, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক প্রবণতা’, কলকাতা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, পৃষ্ঠা-৫০।

৪) অমলেন্দু সেনগুপ্ত, ‘জোয়ার ভাঁটায় ষাট সত্তর’, কলকাতা, পার্ল পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭, পৃষ্ঠা-৩।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান