সঞ্জীব দাস
“It is art’s task to make manifest the contradictions of Being” — এ-কথার মধ্য দিয়ে সের্গেই আইজেনস্টাইন যাবতীয় শিল্প-সাহিত্যের আঁতের কথাটা চুম্বকে বলে দিয়েছেন। সত্তার অপরিহার্য লক্ষণ তার স্ববিরোধিতা। সেই স্ববিরোধিতার উন্মোচন করার দিকেই স্রষ্টার সহজাত প্রবণতা। আর সেই স্ববিরোধিতার রূপায়ণেই সৃষ্টি জীবনীয়, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পাশাপাশি যুগের দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধিতাও ডানা মেলে সাহিত্যের আকাশে। এমনটাই ঘটেছে বাংলা জাতীয়তাবাদী কথাসাহিত্যের পরিসরে। সেই দ্বন্দ্ব, সেই স্ববিরোধিতার প্রকৃতি উন্মোচনের লক্ষ্যেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।
একথা আজ কমবেশি সকলেই অবগত যে উনিশ শতকে বাংলার বুকে জেগে ওঠা জাতীয়তাবাদের আলম্বন বিভাব ছিল হিন্দুধর্ম। সেই সময় ব্রাহ্মধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের বিপরীতে হিন্দু-অস্মিতাবোধের উদ্ভব ঘটে। এই অস্মিতাই কালক্রমে জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়। রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন এই নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ। রাজনারায়ণ বসু ১৮৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর (১২৭৯ সনের ৩১ ভাদ্র) ‘জাতীয় সভার’ উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ সম্বন্ধে প্রদত্ত বক্তৃতায় হিন্দুধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে তীক্ষ্ণ অবয়ব দেন। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠে ‘হিন্দু জাতির’ পুনরভ্যুত্থানের আশা ব্যাকুল হয়ে ওঠে :
“আমার এইরূপ আশা হইতেছে, পূর্বে যেমন হিন্দু জাতি বিদ্যা, বুদ্ধি, সভ্যতার জন্য বিখ্যাত হইয়াছিল, তেমনি পুনরায় সে বিদ্যা, বুদ্ধি, সভ্যতা, ধর্মের জন্য সমস্ত পৃথিবীতে বিখ্যাত হইবে।…আমি দেখিতেছি, আবার আমার সম্মুখে মহাবল পরাক্রান্ত হিন্দু জাতি নিদ্রা হইতে উত্থিত হইয়া বীরকুন্ডল পুনরায় স্পন্দন করিতেছে এবং দেববিক্রমে উন্নতির পথে ধাবিত হইতে প্রবৃত্ত হইতেছে। আমি দেখিতেছি যে, এই জাতি পুনরায় নবযৌবনান্বিত হইয়া পুনরায় জ্ঞান, ধর্ম ও সভ্যতাতে উজ্জ্বল হইয়া পৃথিবীকে সুশােভিত করিতেছে, হিন্দু জাতির কীর্তি, হিন্দু জাতির গরিমা পৃথিবীময় পুনরায় বিস্তারিত হইতেছে।”[১]
ভূদেব মুখোপাধ্যায় পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির মোহে গা-ভাসানোর সর্বগ্রাসী প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে আস্থবান হওয়ার কথা বলেন। সকল প্রকার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে ‘জাতীয় ভাব’-কে জাগ্রত করার প্রচেষ্টার কথা তাঁর কণ্ঠেই প্রথম উঠে আসে। তিনি বলেন :
“আমরা বাঁচিয়া থাকিতে চাই, একবারে ইংরাজের জিনিস হইয়া যাইতে চাহি না। বুঝিতে পারিবে না যে, আমরা ইংলন্ড হইতে স্বাতন্ত্রিকতা চাহি না, অন্ততঃ বহুকালের জন্য তাহা চাহি না। তোমাদের মনে যেমন জাতীয়ভাবের উদ্রেক হয়, অমনি তোমরা ইংরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া বৈস। আমাদের মনে জাতীয়ভাবের উদ্রেকে আমরা রাজবিদ্রোহ করিতে চাহি না। আমরা বেশি করিয়া ইংরাজী শিখি, বেশি করিয়া সংস্কৃতের সমাদর করি, কাজ কর্ম এমন যত্ন এবং শ্রম সহকারে নির্বাহ করিবার চেষ্টা করি, যাহাতে ইংরাজ রাজপুরুষেরাও আমাদিগের দ্বারা পরাস্ত হয়েন। স্বজাতীয় কোন মনিবের অধীনে থাকিয়া যদি চাকুরী করিতে হয় তাহা বিশেষ যত্ন এবং পরিশ্রম সহকারে নির্বাহ করি। মুসলমানকে নেড়ে বলিয়া, পশ্চিমের লোককে মেড়ুয়া বলিয়া, দক্ষিণাঞ্চলবাসীদিগকে কদাকার বলিয়া অশ্রদ্ধা করা অতিশয় দূষ্য মনে করি — আর সন্তান-সন্ততিকে দৃঢ়কায়, পরিশ্রমী, বিদ্বান এবং স্বধর্মনিষ্ঠ ও স্বজাতির মুখাপেক্ষী করিবার নিমিত্ত নিরন্তর প্রাণপণে যত্ন করি।”[২]
তিনি মনে করেছিলেন জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের প্রথম পর্বে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিতকর হবে না। এই উপলব্ধি থেকে তিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি সকল প্রকার সংকীর্ণতা মুক্ত হয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে যত্নবান হন। এই মানসিকতা থেকেই তিনি লেখেন :
“ভারতবর্ষের প্রান্তভাগে যে সকল অসভ্য বন্যজাতীয় লোক থাকে, ব্রাহ্মণেরা তাহাদিগের মধ্যে গিয়া বাস করিতেছে, এবং ক্রমে ক্রমে তাহাদিগকে শান্ত, ত্যাগী এবং নম্র স্বভাব করিয়া তুলিতেছে। একটী উদাহরণ দিতেছি। ভারত সাম্রাজ্যের উত্তর-পূর্ব্ব প্রান্ত সীমায় আসাম নামে একটী প্রদেশ আছে। সেই প্রদেশে প্রকৃত ভারতবর্ষীয় ভিন্ন অপর কতকগুলি বন্য জাতীয় লোক বাস করে, তাহাদিগের নাম মিকি, আবর, গারো, নাগা, মিস্মি প্রভৃতি। আমি ঐ প্রদেশে গমন করিয়া দেখি, ঐ সকল জাতীয়দিগের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা পর্ণকুটীর নির্ম্মাণ করিয়া আছেন, এবং নিরন্তর অকৃত্রিম ব্যবহার দ্বারা তাহাদিগের বিলক্ষণ প্রীতিভাজন হইতেছেন।”[৩]
তবে রাজনারায়ণ বা ভূদেব নন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠ ঋত্বিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল স্ফুরণ দেখা গেছে তাঁর উপন্যাসে, প্রবন্ধে। তিনি জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমকে অভিন্ন করে দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ’ বাঙালি তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বাইবেল। এই মহাগ্রন্থের মাধ্যমে বঙ্কিম তুলে ধরেন তাঁর দেশপ্রেমের আদর্শ। তাঁর জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রই হল অকুন্ঠ এবং নিরাসক্ত স্বদেশপ্রীতি। তাই আনন্দমঠ-এর সন্তানদের একমাত্র পূজ্য হলেন জননী জন্মভূমি। তাঁর এই স্বদেশচেতনার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “Bankim chandra converted patriotism into religion and religion into patriotism.”[৪] বাস্তবিকই দেশপ্রেমকে ধর্মের স্তরে উন্নীত করা ভারতের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্রের এক মৌলিক অবদান। তাঁর মতে, “এটা প্রতিবৃত্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুশীলন নয়। দেশপ্রীতি ও সার্বলৌকিক প্রীতি — দুইয়েরই অনুশীলন ও পরস্পর সামঞ্জস্য চাই, এবং তাহলেই ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির আসন গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।”[৫]
বঙ্কিমচন্দ্রের এই ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান। ‘Nationalism’ গ্রন্থে তিনি জাতি এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেখানে ‘নেশন’-এর যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা এরকম :
“A nation, in the sense of the political and economic union of a people, is that aspect which a whole population assumes when organized for a mechanical purpose.”[৬]
রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’ শব্দটির কোনও বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করেননি। কেননা ‘নেশন’-এর ধারণাটি পাশ্চাত্য থেকে আহরিত; রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন —
“ ‘নেশন’ শব্দ আমাদের ভাষায় নাই, আমাদের দেশে ছিল না। সম্প্রতি য়ুরোপীয় শিক্ষাগুণে ন্যাশনাল মহত্বকে আমরা অত্যধিক আদর দিতে শিখিয়াছি। অথচ তাহার আদর্শ আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যে নাই। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ, আমাদের গৃহ, কিছুই নেশন-গঠনের প্রাধান্য স্বীকার করে না।” [৭]
তিনি ‘নেশন’ চেতনার মধ্যে আবিষ্কার করেছেন এক প্রকার নিষ্ঠুরতা —
“পনেরো-ষোলো শতাব্দী খুব দীর্ঘকাল নহে। নেশনই যে সভ্যতার অভিব্যক্তি তাহার চরম পরীক্ষা হয় নাই। কিন্তু ইহা দেখিতেছি, তাহার চারিত্র-আদর্শ উচ্চতম নহে। তাহা অন্যায় অবিচার ও মিথ্যার দ্বারা আকীর্ণ এবং তাহার মজ্জার মধ্যে একটি ভীষণ নিষ্ঠুরতা আছে।” [৮]
তাঁর মতে এই ‘নেশন’ এবং ‘দেশ’ পুরোপুরি স্বতন্ত্র ধারণা। তিনি ‘নেশন’ বা ‘জাতি’-র ওপর আস্থা রাখেননি। সমাজে নানা বিভক্তি বিদ্যমান থাকায় নেশন নির্মাণ সম্ভব নয়, এটাই ছিল তার অনাস্থার মূল কারণ। ন্যাশনালিজমের নাম দিয়েছেন তিনি ‘জিওগ্রাফিক্যাল ডেমন’। প্রথম দিকে তিনি, ‘নেশন’-কে ‘একটি জীবন্ত মানস পদার্থ’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু পরে ‘নেশন’-কে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে দেখেছেন যা জনগণকে ‘যান্ত্রিক প্রয়োজনে’ সংঘবদ্ধ করে। তিনি মনে করেছেন ভারতবর্ষে ন্যাশনালিজম খাটবে না। কারণ, তিনি বুঝেছেন ইউরোপে শাসক-শোষিতের যে ভেদ ঘটেছিল, সেটা জাতিগত বিভেদ নয়, শ্রেণিগত ভেদ। কিন্তু ভারতবর্ষে ভেদ ধর্ম ও জাতির নামে। তাঁর মতে এই মৌলিক পার্থক্যের দিকটি না বুঝে দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাতিগঠনের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
বাংলা কথাসাহিত্যে এই জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে প্রধানত প্রধান চরিত্রকে আশ্রয় করে। লক্ষ করলে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর আচরণে দ্বান্দ্বিকতার সুর প্রবল হয়ে উঠেছে। কখনও তারা লেখকের জীবনদৃষ্টির স্ববিরোধিতার চাপে ভারসাম্য হারিয়েছে। আবার কখনও লেখক তাদের দ্বন্দ্বমুখর করে গড়ে তুলেছেন। কখনও যুগের দ্বন্দ্ব তাদের উপর ছাপ ফেলেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ থেকেই এই প্রবণতা লক্ষণীয়। একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলা জাতীয়তাবাদী উপন্যাসের পথিকৃৎ ‘আনন্দমঠ’। স্ববিরোধিতা এবং তজ্জনিত অসংগতি এর সর্বাঙ্গে পরিব্যাপ্ত। উত্তরবঙ্গে সংঘটিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এই উপন্যাসের পটভূমি। চলুন পাঠক, সর্বাগ্রে উপন্যাসটির আখ্যানের ভিতর মহলে প্রবেশ করা যাক।
এর আখ্যানের সূচনা কোনও এক অরণ্যভূমির রাত্রিকালীন নিস্তব্ধতা ভেঙে অকস্মাৎ জেগে ওঠা মনুষ্য সংলাপের নাটকীয় উপস্থাপনায়। তারপর প্রথম খণ্ড। এই খণ্ডের গ্রন্থিমোচন হয়েছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরগ্রস্ত পদচিহ্ন গ্রামের চিত্রল বর্ণনায় :
“১) ১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না।
২) ১১৭৪ সালে ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ্য হইল — লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল।
৩) মাঠে ধান্যসকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল , রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীর জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তাহার পর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল।”
এই বর্ণনার সূত্রেই আখ্যানে উঠে এসেছে মহেন্দ্র-কল্যাণীর বিপর্যস্ত যাপিত জীবনের ছবি। তারা প্রাণে বাঁচার তাগিদে ঘর ছেড়ে পথে নামে। পথে চটি পড়লে সেখানে স্ত্রী ও কন্যাকে রেখে মহেন্দ্র দুধের সন্ধানে বহির্গত হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে ফিরে স্ত্রী ও কন্যার দেখা পায় না। দস্যুরা তাদের অপহরণ করেছিল। দস্যুদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে কল্যাণী তার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। পথে বনমধ্যে সন্তান দলের হাতে পড়ে। তারাই তাদের আশ্রয় দেয়। একইভাবে মহেন্দ্রকেও তারা উদ্ধার করে। পথে ভবানন্দের কাছে সে জানতে পারে সত্যানন্দের সন্তানদলের কথা। তার মুখে বন্দেমাতরম গান শ্রবণ করে, তাদের সন্তান দলের উদ্দেশ্য জেনে সে মুগ্ধ হয় এবং এই মাতৃমন্ত্রে দীক্ষা নিতে সংকল্পবদ্ধ হয়। এই উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর সে তাদের পদচিহ্ন গ্রামে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। পথিমধ্যে কল্যাণীর সঙ্গে থাকা বিষ তার কন্যা কিছু না বুঝে খেয়ে ফেলে অচেতন হয়ে পড়ে। এই ঘটনায় মহেন্দ্র ও কল্যাণীকে দিশেহারা করে দেয়। সন্তান মারা গেছে ভেবে শোকার্ত কল্যাণীও বিষপান করে। সেইক্ষণে অরণ্য মধ্য থেকে ভেসে আসছিল সন্তান দল কণ্ঠে ‘হরে মুরারে মধুকৈটভারে’ গান। সেই গান মহেন্দ্র ও কল্যাণীকে আবিষ্ট করে দেয়। শোকতাপ ভুলে তারাও একযোগে সেই মহাসংগীত গাইতে থাকে। তারই মাঝে কল্যাণী দেহত্যাগ করে। সত্যানন্দ শোকার্ত মহেন্দ্রকে নিজকোলে আশ্রয় দেন। সেই সময় হঠাৎ করে সেই স্থানে নজরবন্দি জমাদার সিপাহি নিয়ে হাজির হন। তখন বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের দমন করতে ইংরেজ সরকার সক্রিয় হয়ে ওঠে। জমাদার সেই মতো সত্যানন্দ ও মহেন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালের কাছে নিয়ে আসে। কোতোয়াল রাজ সরকারে খবর পাঠায় এবং তাদের কারাগার নিক্ষেপ করে। তবে তাদের কারাগারে রাখা সম্ভব হয় না। সন্তান দলের অন্যান্য সদস্যরা অচিরেই তাদের উদ্ধার করে। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে কাহিনি অনেকটাই সংহত। এখানে পাওয়া যায় সন্তানদলের সভা এবং মহেন্দ্র-শান্তির সন্তান ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের সংবাদ। এছাড়া পদচিহ্ন গ্রামে দুর্গ ও অস্ত্র নির্মাণের জন্য মহেন্দ্রর সক্রিয়তার খবরও আমরা জানতে পারি। তৃতীয় তথা শেষ খণ্ডে আছে সন্তান দলের বিরুদ্ধে টমাসের প্রস্তুতি এবং তাদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধের কথা। সেই যুদ্ধে ভবানন্দ শহিদ হলেও সন্তান দল শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। উত্তরবঙ্গের তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর চতুর্থ বা শেষ খণ্ড। এখানে সন্তানদলের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর চূড়ান্ত যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে সন্তানদলের চূড়ান্ত সাফল্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তবে আচমকাই এখানে তাল কেটেছে সন্তান দলকে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে। গুরু সত্যানন্দকে জানিয়েছেন : “ব্রত সফল হইয়াছে — মার মঙ্গল সাধন করিয়াছ — ইংরেজ রাজ্য স্থাপিত করিয়াছ।” দেশপ্রেমিক সত্যানন্দের হৃদয়ে এই কথায় শেল বিঁধেছে। যদিও গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে সে তাঁর সঙ্গে হিমালয়শিখরে মাতৃমন্দিরের উদ্দেশে গমন করেছে তবুও অতৃপ্তির অস্বস্তি পাঠককে বিঁধতেই থাকে!
আর এখানেই আসে স্ববিরোধিতার প্রশ্ন। সন্তান দলকে গুরু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে প্রাণিত করেছিলেন। কিন্ত তা শেষপর্যন্ত শুধুমাত্র মুসলিম শাসক বিরোধী সংগ্রামে পর্যবসিত হল। সত্যানন্দ একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীর মতো চেয়েছিলেন সকল প্রকার দাসত্বের শেকল থেকে বঙ্গজননীকে মুক্ত করতে। কিন্তু গুরু তা হতে দিলেন না। আর এখানেই গুরুতর স্ববিরোধিতা দেখা দিয়েছে। এই স্ববিরোধিতা আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ববিরোধিতারই অনিবার্য প্রতিফলন।আমার অন্তত তো তাই-ই মনে হয়। আমার বক্তব্যের সমর্থনে ‘আনন্দমঠ’-এর প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করা যাক :
“ক) ইংরেজ বহির্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত, লোক শিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব।
খ) সত্যানন্দের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি বলিলেন, শত্রুশোণিত সিক্ত করিয়া মাতাকে শক্তিশালিনী করিব। মহাপুরুষ শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্র রাজা।
গ) ইংরেজ বাংলাদেশকে অরাজকতার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছে।
ঘ) অতএব তোমরা দেশ উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর ফল যাহা হইবে ভালোই হইবে। ইংরেজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।”
এই সকল উক্তি নিশ্চিতভাবেই বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের মনের কথা! অন্যত্রও এই ইংরেজপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গদর্শনের সূচনায় তিনি লিখেছেন : “আমরা ইংরাজি বা ইংরেজের দ্বেষক নহি। উহা বলিতে পারি যে, ইংরেজ হইতে এ দেশের লোকের যত উপকার হইয়াছে, ইংরাজি শিক্ষাই তাহার মধ্যে প্রধান”।
এই ইংরেজ প্রীতি তাঁর জাতীয়তাবাদীচেতনাকে স্ববিরোধিতা দোষে দুষ্ট করেছে। সেই সঙ্গে মুসলিম বিদ্বেষের দিকটিও এড়ানোর নয়। ‘আনন্দমঠ’ সহ একাধিক রচনায় এমন অনেক উক্তি আছে যা পাঠ করে যে-কেউ তাঁকে মুসলিম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। যেমন :
ক) “আমরা রাজ্য চাই না। কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাদের সর্বাংশে নিপাত করিতে চাই।” (‘আনন্দমঠ’)
খ) ‘কবিতা’ পুস্তকে মুসলমান জাতিকে লক্ষ্য করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন :
“আসে আসুক না আরবী বানর
আসে আসুক না পারশী পামর।”
গ) ১২২৭ সালের অগ্রহায়ণের ‘বঙ্গদর্শনে’ লিখেছেন :
“ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে। কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। ক্রিয়া বাড়ীতে কাক আর কুকুর। আদালতে মুসলমান।”[৯]
আমরা জানি একটি জনসমাজ যদি কোনও একটি উপাদানকে ভিত্তি করে ঐক্যচেতনা অনুভব করে তখন সেই জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত হয় এবং সেই অনুভূতি গভীরতা প্রাপ্ত হলে সেই জনসমাজ জাতিতে পরিণত হয়। প্রশ্ন হল এই মূলগত কথাটি কি বঙ্কিমচন্দ্র জানতেন না? অবশ্যই জানতেন। তবে? ভারতবর্ষ তো শুধু হিন্দুদের দেশ নয়। এখানে বৌদ্ধ, জৈন, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ ইত্যাদি বহু ধর্মের মানুষের বাস। তাদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র হিন্দুদের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি জাগিয়ে জাতি গঠন এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা যে আত্মঘাতী রোমান্টিকতা তা কি তিনি বোঝেননি? আর স্বাধীনতার স্বপ্নও কি জোর পায়? তাছাড়া যে ইংরেজ জাতি দেশ দখল করে রেখেছে তাকে তাঁর উপন্যাসের চরিত্র ‘মিত্র’, এমনকি রাজা করার কথা বলেছে। একে স্ববিরোধিতা ছাড়া আর কী বলব! কিন্তু এই স্ববিরোধিতা কেন? উপন্যাসটির পুরানো সংস্করণের সঙ্গে নতুন সংস্করণের পার্থক্যের মধ্যে এর উত্তর নিহিত আছে। তৃতীয় খণ্ডের একাদশ এবং দ্বাদশ পরিচ্ছেদে লেখক বারংবার ‘নেড়ে’, ‘যবন’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। প্রথম সংস্করণে এসব স্থানে ‘ইংরেজ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, সত্যানন্দ যুদ্ধের অবসানে সতীর্থদের উদ্দেশে বলেছে : “এ প্রদেশে যবন সেনা আর নেই।” প্রথম সংস্করণে এই স্থলে ছিল : “এ প্রদেশে ইংরেজ সেনা আর নাই।” কেন এই পরিবর্তন? স্পষ্ট বোঝা যায় লেখকের মধ্যে একটি দ্বিধা কাজ করছিল। কী সেই দ্বন্দ্ব? এই দ্বন্দ্ব আসলে একজন জাতীয়তাবাদীর সঙ্গে একজন মধ্যবিত্ত মানসিকতা সম্পন্ন সাধারণ বাঙালি আমলার। ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকারি পদে থেকে মুখর হলে সরকারের রোষবহ্নিতে পড়ার সম্ভাবনা। তাই প্রথম সংস্করণে রাখা গোরা, ইংরেজ ইত্যাদি শব্দগুলো তাঁকে ছেঁটে ফেলতে হয়। যা ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই তা মুসলিম শাসন বিরোধী আখ্যানে পর্যবসিত হয়। এত করেও কি তিনি রেহাই পেলেন? না, পাননি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় বদলি ও নিয়োগ নিয়ে তাঁকে বারবার নানা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৮৮২ থেকে ১৮৯২-এ অবসর নেওয়া পর্যন্ত সোয়া আট বছরে প্রায় নয়বার তাঁকে বদলি হতে হয়েছিল। এত ঘন ঘন বদলি কোনো কর্মকর্তার প্রতি সরকারের সহানুভূতি বা আস্থার পরিচয় বহন করে না। মনে হয়, তিতিবিরক্ত-হতাশ বঙ্কিম তাই স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
পেশাগত সংকটের পাশাপাশি দেশকালের প্রেক্ষিতটিও মনে রাখা জরুরি। এদেশে ইসলাম এসেছিল বন্যার বেগে। বর্ণবিভক্ত হিন্দুধর্মকে সে তার সাম্যের শক্তিতে অনায়াসে ধ্বস্ত করেছিল একথা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু একথাও তো সত্য ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং দার-উল-হারবকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করার উদ্দেশ্যে এদেশীয় মানুষের উপর নামিয়ে আনা হয়েছিল অভূতপূর্ব অত্যাচার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অযোগ্য নবাবদের শাসনকালে এই অত্যাচার আরও বেড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইংরেজ শাসন হিন্দুসমাজের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। অত্যাচারী মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার আশায় শিক্ষিত হিন্দুসমাজ ইংরেজ শাসনকে দু-হাত ভরে সমর্থন করে। এই মানসিকতা থেকেই বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তসমাজ ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহে ইংরেজদের সোচ্চারে সমর্থন করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র সেই বাঙালি হিন্দুদের প্রতিনিধি। তাঁর অবচেতনেও স্বাভাবিকভাবেই ছিল মুসলিম শাসকের প্রতি ঘৃণা। সেই ঘৃণা ‘আনন্দমঠ’-এ অন্ত:শীল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ফলে স্ববিরোধিতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
এরপর রবীন্দ্র সৃষ্টিলোকের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেললে চোখ পড়ে তিনটি উপন্যাসের উপর — ‘গোরা’, ‘ঘরেবাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়’। ‘গোরা’ উপন্যাসের থিম এক কথায় কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার স্বদেশভাবনার অসংগতি এবং নানা বাঁক ঠেলে তার উত্তরণ। আমরা জানি জাতীয়তাবাদের যে মেটান্যারেটিভ বিগত শতকের প্রথমার্ধে তৈরি করা হয়েছিল তা হয়েছিল বিদেশি থিয়োরির অন্ধ অনুকরণে। দেশীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে তার প্রাণের যোগ ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই থেকে গিয়েছিল স্ববিরোধিতার অবকাশ। এই প্রচ্ছন্ন স্ববিরোধিতাই গোরা চরিত্রে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকে বঙ্গদেশের বুকে জেগে ওঠা সংকীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এই উপন্যাসের পটভূমি। রবীন্দ্রনাথ এই সংকীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি এর বিরুদ্ধে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদকে আয়ুধ করেন। ‘গোরা’ সেই উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদের ‘বাইবেল’। এর আখ্যানের সমাপ্তিতে দেখি গোরা মা আনন্দময়ীকে বলেছে : “মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন — তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই — শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা — তুমিই আমার ভারতবর্ষ”।
সন্দেহ নেই নায়ক গোরার এই কথা উচ্চারণ করার মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন ঘটেছে। এখানে তার জীবনের, তার আত্মপরিচয়ের অসংগতি ও সংকটকে সামনে রেখে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিপদ এবং তার অন্ত:সারশূন্যতাকে লেখক স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এবং তার ফলে তাঁর উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছে বৈধ মহিমা। যে গোরা নিজেকে বর্ণহিন্দুর সন্তান বলে গর্ব অনুভব করত, যে হিন্দুত্বের গর্বে স্ফীতবক্ষ হয়ে সে খ্রিস্টান দাইমা লছমিয়ার হাতের জল পান করতেও অসম্মতি প্রকাশ করেছিল সে-ই শেষপর্যন্ত এসে জানতে পারল সে হিন্দু নয়, খ্রিস্টান আইরিশ পিতার সন্তান! আর সব জেনেও কিনা বর্ণহিন্দু ঘরের স্ত্রী আনন্দময়ী তাঁর এতদিনের আচার-বিচার-সংস্কার বিসর্জন দিয়ে তাকে বুকে টেনে নিয়ে নিজের সন্তান ভেবে পালন করল! গোরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে উপলব্ধি করল নিজের ভাবনার অন্ত:সারশূন্যতা, নিজের অস্তিত্ব এবং মতবাদের অসংগতি। ভারতবর্ষ যে কোনও একটি ধর্মের একচেটিয়া নয়, এই দেশ, এই জাতি যে গড়ে উঠেছে সকলকে নিয়ে এই উপলব্ধিতে পৌঁছাল। তাই উদারতার মূর্ত প্রতীক আনন্দময়ীর মধ্যে সে ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করল। আনন্দময়ী এবং ভারতবর্ষ এক হয়ে গেল তার আবেগময় উপলব্ধিতে ।
এদেশে নবোদ্ভূত ধর্মীয় উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এই উপন্যাসটি হয়ে উঠতে পারে অমোঘ অস্ত্র। যে একমাত্রিক ভারতবর্ষের মেটান্যারেটিভ তৈরি করেছে আরএসএস, তার পাল্টা ন্যারেটিভ রচনা করেই আজ পৌঁছোতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। ‘মন কী বাত’-এর একাঘ্নী বাণকে অকেজো করতে হলে আনতে হবে নতুন আয়ুধ । রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’-র মধ্যে যে সেই সম্ভাবনা আছে সেই কবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তীকালে অনন্তকৃষ্ণমূর্তি বলে গেছেন। আমাদের তাই ‘গোরা’ উপন্যাসটির বক্তব্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হতে হবে।
কিন্তু এতো গেল বইটির বাস্তবমূল্যের কথা। কিন্তু শিল্পগুণ! তার কী হল? গোরা আসল ভারতবর্ষকে তো চিনল। কিন্তু সেই চেনাটা কী বাস্তব? সেখানেও কী অসংগতি নেই! যেকোনও কাণ্ডজ্ঞানী পাঠক স্বীকার করবেন যে এখানে অসংগতি probable impossibility-এর অ্যারিস্টটলীয় বয়ানকে অনায়াসে ছাপিয়ে গেছে। একথা সত্য যে, চরঘোষপুরের বাস্তবতা গোরার কূপমণ্ডূক চেতনায় প্রবল আঘাত হেনেছিল। কিন্তু যদি না আচমকাই মা আনন্দময়ী তার জন্মবৃত্তান্ত তাকে জানিয়ে দিত তবে তার মধ্যে এই অনন্ত নিষ্ফলতার বোধ জাগত? না, জাগত না। আর তা না জাগলে এই নতুন উপলব্ধির কূলে পৌঁছানো বাস্তবিকই অসম্ভব হত বলেই মনে হয়।
পরবর্তী ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়’ — এই দুই উপন্যাসেরও বিভাব জাতীয়তাবাদ।এখানে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক দিক লেখকের সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছে। প্রথমটিতে তিনি সন্দীপকে সামনে রেখে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অন্ত:সারশূন্যতার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কীভাবে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ সম্প্রদায়গত জীবনকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দেয় এবং ধর্মীয় সহিংসতাকে আবাহন করে তা এখানে স্পষ্টতায় উদ্ঘাটিত। দ্বিতীয়টিতে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর বিরূপতা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশ এবং সন্দীপের মধ্যে যে বিরুদ্ধ যুগ্মক নির্মিত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে কী প্রতিফলিত হয়নি স্বয়ং লেখকের ভেতরকার দ্বন্দ্ব! ‘গোরা’ থেকে ‘ঘরে বাইরে’ যিনি রচনা করেন তিনিই তো একদা স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনিই তো একদা রচনা করেছিলেন ‘হোক ভারতের জয়’-এর মতো হিন্দু-জাতীয়তাবাদী কবিতা। হিন্দু মেলা, স্বদেশি আন্দোলনের উচ্চাবচ পথ পেরিয়ে তবেই তো তিনি জাতীয়তাবাদের আসল চেহারাটা চিনতে পেরেছিলেন। আর পেরছিলেন বলেই গোরা, নিখিলেশরা তাঁর হাতে জন্ম নেয়। সেই দ্বন্দ্বের রক্তাক্ত ইতিহাসই ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের নিখিলেশ-সন্দীপের দ্বৈরথে স্তম্ভিত হয়ে আছে। ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে এই আত্মদ্বন্দ্ব থেকেই তৈরি হয়েছে অতীন এবং ইন্দ্রনাথের বাইনারি অপজিশন। ইন্দ্রনাথ লড়াইয়ের পথ নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছে :
“রাস্তায় পাথর পড়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে হাতিয়ার চালাই যেমন করে, অপ্রমত্ত বুদ্ধি নিয়ে। ওরা ভালো কি মন্দ সেটা তর্কের বিষয় নয়। ওদের রাজত্ব বিদেশী রাজত্ব, সেটাতে ভিতর থেকে আমাদের আত্মলোপ করছে — এই স্বভাববিরুদ্ধ অবস্থাকে নড়াতে চেষ্টা করে আমার মানব স্বভাবকে আমি স্বীকার করি।”
এই অন্ধগতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অতীন দেশপ্রেমের নামে কী ভাবে মনুষ্যত্বের অপমান নিরন্তর ঘটে চলেছে বারংবার সে কথাই উচ্চারণ করেছে।
এরপর আমরা তাকাব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের দিকে। তাঁর এই উপন্যাসে একদিকে আছে ভারতমাতার পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির আহ্বান, অন্যদিকে আছে আন্তর্জাতিক ভাবনার উচ্চারণ। এই উপন্যাসের আখ্যানে ধর্মঘটি শ্রমিকদের সম্মুখে দেওয়া বক্তৃতায় মেহনতি মানুষের ঐক্যের কথা উঠে এসেছে :
“শুধু একবার যদি তোমাদের ঘুম ভাঙে, শুধু একবার মাত্র এই সত্যি কথাটা বুঝতে পারো যে তোমরাও মানুষ, তোমরা যতই দু:খী, যতই দরিদ্র, যতই অশিক্ষিত হও তবুও মানুষ, তোমাদের মানুষের দাবী কোনো অজুহাতে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না তাহলে এই গোটাকতক কারখানার মালিক তোমাদের কাছে কতটুকু?”
এই বক্তৃতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় গোর্কির ‘মাদার’ উপন্যাসে কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে পাভেলের আগুনঢালা বক্তৃতার কথা। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নায়কের মুখে মার্কসবাদী আন্তর্জাতিক ভাবনার এই উচ্চারণ আমাদের স্তম্ভিত করে। মনে হয় কেন এই স্ববিরোধিতা! একটু তলিয়ে ভাবলে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম হয়। আসলে শরৎচন্দ্র এক রাজনৈতিক যুগসন্ধিক্ষণের সন্তান। তখন বাংলা তথা ভারতবর্ষে স্বাধীনতার লড়াই দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি কংগ্রেসের নেতৃত্বে গণআন্দোলন, অন্যটি সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ। কংগ্রেসের রাজনীতির কাছাকাছি থাকলেও এই সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদীদের নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমা তাঁর মনকে প্লাবিত করেছিল। আর তাই চোখে দেখা বিপ্লবীদের আদলে উপন্যাস রচনার কথা ভাবেন, রচিত হয় ‘পথের দাবী’। বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের প্রতি তাঁর অনুরাগের প্রমাণ পাওয়া যায় মাস্টারদাকে সাহায্যের ঘটনায়। তখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নায়ক সূর্য সেন আত্মগোপন করে আছেন। এই খবর পেয়ে তিনি নিজের সঞ্চিত পাঁচ হাজার টাকা বিপ্লবী কালীপদ ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেন। আবার রুশ বিপ্লবের পরোক্ষ প্রভাবে তিনি বুঝেছিলেন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবে দেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসবে না। আসবে শোষিত মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তাঁর এই দ্বৈত মানসিকতারই ফলশ্রুতি ‘পথের দাবী’। ‘পথের দাবী’-র পাশাপাশি ‘বিপ্রদাস’ উপন্যাসেও শরৎচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার ছাপ পড়েছে। তবে তার চরিত্র আলাদা। এখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে লেখক ঝুঁকেছেন। আমি মনে করি এ-ও এক স্ববিরোধী মানসিকতার ফলশ্রুতি। কেন এই উপন্যাস তিনি লিখলেন তা ভেবেই আশ্চর্য বোধ হয়! আদ্যন্ত মানবতাবাদী উদারচেতা এই লেখক সম্পূর্ণ বিপরীতমেরুর ভাবাদর্শকে উপন্যাসে রূপ দিতে গিয়ে বিপত্তি ঘটিয়েছেন। বিশ্বাসের উত্তাপের অভাবে এই উপন্যাসের বিপ্রদাস এক নীরক্ত ধূসর চরিত্রে পর্যবসিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী ভাবনার স্বতন্ত্র প্রকাশে উজ্জ্বল হয়ে আছে দুটি উপন্যাস। একটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘ধাত্রীদেবতা’, অন্যটি হল সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’। ‘ধাত্রীদেবতা’-র স্রষ্টা তারাশঙ্কর পূর্বজ লেখক শরৎচন্দ্রের মতোই ছিলেন কংগ্রেসি রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল। তবুও শরৎচন্দ্রের মতোই তাঁরও ছিল বিপ্লবীদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। সেই মনোভাবই ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসে উৎকীর্ণ হয়েছে পূর্ণ চরিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে। আবার সেই পথের যথার্থতা নিয়ে নিজের সংশয়ও তাঁর মধ্যে পুরোমাত্রায় ছিল। সেই সংশয় তিনি সঞ্চারিত করেছেন বিপ্লববাদের পুরোধা একটি চরিত্রের মধ্যে। তিনি পূর্ণ, শিবনাথদের বিপ্লবী আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিলেন। আবার সেই তিনিই শেষপর্যন্ত উপলব্ধি করেছেন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের অন্ত:সারশূন্যতা এবং এই পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর শিবনাথ শেষপর্যন্ত গান্ধিবাদের শরণ নিয়েছে। আসলে গান্ধিবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ শরৎচন্দ্রের মতো তাঁকেও প্রভাবিত করেছে। ফলে দোলাচলতা তাঁকে বিচলিত করেছে। ‘ধাত্রীদেবতা’-র আখ্যানের পরিসর সেই বিচলনের স্পর্শে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। বিপ্লববাদের পাশাপাশি মার্কসবাদী আন্তর্জাতিকতার আদর্শও তাঁর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসের কমিউনিস্ট বিজয়দা চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বজাত অসঙ্গতি স্পষ্টতা পেয়েছে।
এই দ্বন্দ্ব যাঁর উপন্যাসে সর্বাপেক্ষা জীবন্ত হয়ে উঠেছে তিনি সতীনাথ ভাদুড়ী। তাঁর ‘জাগরী’-তেই বোধ হয় প্রথম জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের তীব্র সংঘাতের চিত্র পাওয়া যায়। এখানে বাবা-মা গান্ধিবাদী, বিলু কংগ্রেস-সোস্যালিস্ট পার্টির এবং নীলু কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি। এই আখ্যান প্রমাণ করে ব্যক্তি সতীনাথের রাজনৈতিক মতাদর্শের দোলাচলতা। এই দোলাচলতা থেকেই পরবর্তীকালে গান্ধিবাদী রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে। ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’ উপন্যাসে ঢোঁড়াইয়ের উপলব্ধিতে সেই মোহভঙ্গই স্পষ্ট চেহারা পেয়েছে। ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ আহমেদাবাদ এবং বোম্বাইতে কংগ্রেসের সভায় গান্ধিজি বলেন, স্বরাজ তখনই সম্ভব যখন এদেশের লক্ষ কোটি কৃষক জনসাধারণ সংগ্রামে যোগ দেবেন। আমাদের ঘরের মহিলারা আন্দোলনে অংশ না নিলে কোনও কর্মসূচি ব্যাপক আকার গ্রহণ করতে পারবে না। গান্ধিজি নিজে বিহারের চম্পারণ, গুজরাতের খেড়া প্রভৃতি গ্রামীণ অঞ্চলে স্কুল গড়ে তোলার এবং সত্যাগ্রহীদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত হন, সঙ্গে নেন স্ত্রী কস্তুরবাকে। ক্রমশ পরিচিত হন অতীব পিছিয়ে পড়া দেশবাসীর সঙ্গে। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করেন। তাই জীবদ্দশাতেই ওই তাৎমাটুলির মতো হাজার হাজার গ্রামীণ অঞ্চলে গানহি বাওয়ার আবির্ভাব হয় নেহাতই অকিঞ্চিৎকর লাউ-কুমড়োর মাচায়। আর সেই আখ্যান শোনান সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর উপন্যাসে। এখানেই শেষ নয়। আখ্যানের সমাপ্তিতে দেখি গান্ধিবাদের প্রতি ঢোঁড়াইয়ের বিশ্বাস টলে গেছে। আইনসভার নির্বাচনের পর অন্য সকলের মতো ঢোঁড়াইও ভেবেছিল রামরাজ্য এসে গেল! কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল আধিয়ারদের ভাগ্যে কিছুই জুটল না। “মহাৎমাজীর কানুন কলক্টর সাহেব বদলে দিল! এরপর কী আর মোহ থাকে!”
তবে দ্বন্দ্ব থাকলেও উত্তরণের সংবাদ সতীনাথের উপন্যাসে পাওয়া যায় না। বরং গোপাল হালদারের ত্রয়ী উপন্যাসে ধীর লয়ে এই উত্তরণের চিহ্ন স্পষ্ট। তাঁর ‘একদা’ -‘অন্যদিন-‘আর একদিন’ উপন্যাস ত্রয়ী সমকালীন শিক্ষিত তরুণদের ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে আন্তর্জাতিক চেতনার দিকে উত্তরণের কাহিনি। উপন্যাসের নায়ক চরিত্র অমিত ক্রমশ স্বামী বিবেকানন্দ-সুভাষচন্দ্র-গান্ধিবাদ-বিপ্লববাদের চেতনা অতিক্রম করে সাম্যবাদে উপনীত হয়েছে। — “বস্তুত সমকালীন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের এরকম ধারাবাহিক ইতিহাস আর কোথাও ধরা পড়েনি।”[১০]
পরবর্তীকালেও জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ বাংলা কথাসাহিত্যের বিষয় হয়েছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সমরেশ বসু প্রমুখ লেখকের কথা এপ্রসঙ্গে মনে আসবে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ আপাতভাবে ঐতিহাসিক রোমান্স হলেও এর কেন্দ্রীয় বিভাব জাতীয়তাবাদ। হিন্দুরাজ্য বিজয়নগর এবং মুসলিম রাজ্য বহমনির সংঘাত চিত্রণের প্রেক্ষাপটে ছিল প্রথমে চিন এবং পরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতবর্ষের যুদ্ধের ঘটনা। হিন্দুরাজ্য বিজয়নগর এবং মুসলিম রাজ্য বহমনির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সন্তর্পণে বুনে দেওয়া হয়েছ জাতীয়তাবাদের সুর। তখন এদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছিল চরম বিশৃঙ্খলা। তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতিও সেদিন অন্ত:কলহে রক্তাক্ত হচ্ছিল। Linda Hutcheon-এর তত্ত্ব অনুযায়ী “এই বিশৃঙ্খল পটভূমিতে ইতিহাসের যে ধরনের পুনর্নির্মাণ হতে পারে তার মধ্যে একটি হল, ইতিহাসের এমন একটি পর্ব বেছে নেওয়া যেখানে বহি:শত্রুর আক্রমণে দেশের রাষ্ট্রশক্তি ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক হবার চেষ্টা করছে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে।”[১১] আর তাই লেখক তুলে আনেন বিজয়নগর এবং বহমনী রাজ্যের দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক সত্যকে আয়ুধ করেন। রচিত হয় অনবদ্য এক ঐতিহাসিক রোমান্স। তবে এতক্ষণ যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বলছিলাম তা এখানে মিলবে না। সুখপাঠ্য আখ্যানে তা মেলার আশাই বা কে করে!
এরপর সমরেশ বসুর একটি উপন্যাসের কথা বলে এই প্রবন্ধের সমাপ্তি টানব। উপন্যাসটির নাম ‘তিনপুরুষ’। এই উপন্যাসটির শরীর দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত। আমরা জানি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গান্ধিবাদ এদেশের রাজনৈতিক পরিসরে তার গুরুত্ব হারাতে থাকে। আদর্শবাদী গান্ধিবাদীরা বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে থাকেন। এই সময়ে এদেশে মার্কসবাদ মাথা তুলতে থাকে। ফলে এদেশে জাতীয়তাবাদী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী — এই দুই পক্ষের বিবাদ অনিবার্য চেহারা নেয়। এই সমাজবাস্তবতাই আলোচ্য উপন্যাসের বিষয় হয়ে উঠেছে। এখানে দ্বন্দ্ব শুধু দুই ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের মধ্যে নয়। লেখক স্বয়ং এই দ্বন্দ্বের শরিক হয়ে পড়েছেন।
শেষ কথা
বিশ্ব শিল্প ও সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত পাঠক জানেন শিল্প-সাহিত্যের জন্ম হয় সমাজপ্রতিবেশের সঙ্গে ব্যক্তি লেখক-শিল্পীর দ্বিরালাপের মধ্য দিয়ে। এই দ্বিরালাপের প্রেক্ষাপটে থাকে সমাজপ্রতিবেশের সঙ্গে স্রষ্টার ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন। এর ফলে স্রষ্টার মধ্যে সৃষ্টি হয় আততি। সেই আততি থেকেই স্ববিরোধিতার জন্ম হয়। এই স্ববিরোধিতাই শিল্প-সাহিত্যের অবয়বে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আবার যুগ পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব-স্ববিরোধিতার অমোঘ পরিসর। বাংলা জাতীয়তাবাদী উপন্যাসগুলোর অধিকাংশই — ‘আনন্দমঠ’ থেকে ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’ — এই অসংগতি-স্ববিরোধিতার উদ্ভাসেই দ্যুতিময়। অসংগতিই এই সকল রচনায় প্রাণের সঞ্চার করেছে। ধমনির রক্তচাঞ্চল্যে জীবন জেগে উঠেছে। এই কারণেই আমরা অসংগতিগুলোকে মেনে নিই। প্রসন্ন মনে পাঠ, পুন:পাঠ তাই চলতেই থাকে। চলতেই থাকে…
উল্লেখপঞ্জি :
১) বসু রাজনারায়ণ : ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’, ১৭৯৪ শক, পৃ. ৫৭-৫৮
২) মুখোপাধ্যায় ভূদেব : ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২), পৃ. ২৩১-৩৩
৩) মুখোপাধ্যায় ভূদেব : ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’, ১৩০২ সাল, পৃ. ৫৮
৪) Majumdar R.C : ‘History of the Freedom movement’, Calcutta, p.170
৫) চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র : ‘ধর্মতত্ত্ব’, ২৪ অধ্যায়
৬) Tagore Rabindranath : ‘Nationalism’, reproduced by Sani H Panhwar, 2019, p.41
৭) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ : ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’, রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড বিশ্বভারতী
৮) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ : ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’, রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড বিশ্বভারতী
৯) চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র : ‘বঙ্গদর্শন’, অগ্রহায়ণ সংখ্যা, পৃ. ৪০১
১০) ভট্টাচার্য বিশ্ববন্ধু : ‘কথাসাহিত্য কথাসাহিত্যিক’, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৬ পৃ. ৪৮-৪৯
১১) মজুমদার উজ্জ্বলকুমার : ‘উপন্যাস পাঠকের ডায়ারি’, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০০৯, পৃ.১৩৯