সাম্প্রতিক বলিউডি জাতীয়তাবাদ : শত্রুর নাম যখন মুসলমান

সুশান্ত পাল

শুরু করব গোরার ভারত অনুসন্ধানে। নাগরিক ভদ্র সমাজের বাইরে যে বৃহৎ প্রকাণ্ড ভারতবর্ষ, তার স্বরূপ সন্ধানে বেরিয়েছেন তখনও ব্রাহ্মণ গোরা। গ্রাম্য মানুষের বোধশক্তির অসাড়তায় গোরা ক্ষুব্ধ হতাশ বিস্মিত। ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত মুসলমান পাড়ায়। এই গ্রামে একটি ঘর মাত্র হিন্দু। তিনি আবার নাপিত। বৃদ্ধ নাপিত ও তাঁর স্ত্রী পালন করছেন এক মুসলমান সন্তান। এ ছেলের নাম তামিজ। ওর বাপ ফরু সর্দার। নীলকুঠির পুলিশ ঠ্যাঙিয়ে আজ তিনি জেলে। নাপিতের বউ তামিজের গ্রামতুতো মাসি। এক কুয়োতেই তাঁদের জলপানি মিশেছে। কী করবেন গোরা? রবীন্দ্রনাথ স্বীয় ভারতচেতনায় একরকমের সমাধান রেখেছেন গোরার সামনে। 

লেখার শুরুতে প্রক্ষিপ্ত অবতারণা থাকল।                                                             

হাউ ইজ দ্য জোশ [১] 

জানুয়ারি ১০, বছর ২০১৯। করণ জোহারের টুইটার অ্যাকাউন্টে ভেসে উঠল এক রুপালি সেলফি। মধ্যমণি শ্বেতশ্মশ্রু শোভিত প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। তাঁকে ঘিরে চারপাশে বলিউডের প্রযোজক-পরিচালক-তারকা সমাবেশ। স্বয়ং করণের সঙ্গে রণবীর কাপুর, রণবীর সিং, ভিকি কৌশল, আয়ুষ্মান খুরানা, রোহিত শেট্টি, আলিয়া ভাট প্রমুখ ইত্যাদি । 

১১ জানুয়ারি মুক্তি পেল উরি : দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক । উরির সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার পালটা প্রত্যাঘাত হানতে পাকিস্তানের মদতে চলা জঙ্গিশিবিরকে গুঁড়িয়ে দিতে ভারতীয় সেনার সার্জিকাল স্ট্রাইকের রোমহর্ষক কাহিনি সম্বলিত চলচ্চিত্র। পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে ইসলামিক জঙ্গিদের নিকেশ করার হিম্মত দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। বাস্তবে, চলচ্চিত্রে তাঁর দৃঢ় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের প্রভাব ব্যাপ্ত হচ্ছে। 

অতঃপর, সাতদিন পরে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’-র অনুষ্ঠানে। অভ্যাগত বলিউডি অতিথিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সম্বোধন — ‘হাউ ইজ দ্যা জোশ?’ মুহূর্তেই বলিউড বলে উঠবে – ‘হাই (high) স্যার’। প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভরশীল নতুন ভারত গঠনে বলিউড পাশে আছে। 

গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি, স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে নীরব থাকলেও বায়োপিক বানানো হবে পিএম নরেন্দ্র মোদি (২০১৯)। কাঠুয়া, উন্নাও, হাথরস, লখিমপুর বলিউডের বিবেক ঘুমিয়ে থাকলেও টয়লেট — এক প্রেম কথা (২০১৭), প্যাডম্যান (২০১৮), অথবা মেরে প্যায়ারে প্রাইম মিনিস্টার (২০১৮) সিনেমায় স্বচ্ছ ভারত অভিযানের কিংবা ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’ সরকারি প্রকল্পকে উপস্থাপন করবে। প্রধানমন্ত্রীর সদর্প ঘোষিত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ মাল্টিপ্লেক্সের পর্দায় হাজির সুই ধাগা (২০১৮)-র পরোক্ষ ইঙ্গিতে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য চিৎকার অথবা কৃষক-শ্রমিকের হাহাকারে বলিউড তার চিত্রনাট্যের রসদ খুঁজে পায় না। তার মন মজেছে দেশদ্রোহী নিধনের গল্পে। অনুপ্রবেশকারীর ইতিহাস খননে। ঐতিহাসিক আক্রমণকারী থেকে আজকের সন্ত্রাসবাদী। সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দখলদার বিনাশকারীদের ধর্মের রকমফের ঘটেনি। আলাউদ্দিন খলজি থেকে আজকের মুখতার আনসারি। বেবি (২০১৫), পদ্মাবৎ (২০১৮), পানিপথ (২০১৯), তানহাজি (২০২০), সূর্যবংশী (২০২১) সিনেমায় খলনায়ক অবশ্যই মুসলমান। আবহমান ধারায় ঘরে-বাইরে দেশের শত্রু যেন মুসলমান। “বাবু যত বলে পারিষদ দল বলে তার চেয়ে শতগুণ।” আসুন বলিউডের লেন্সে চোখ রেখে ঘুণপোকাদের খুঁজি। ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ খুঁজে বের করে নতুন ভারত গঠনের স্বার্থে তাদের পিষে মারি।  

বজরংবলী বনাম আলি [২]

প্রাচ্যকে অসভ্য, বর্বর, হিংস্র রূপে দাগিয়ে দিতে পারলেই মানবতাবাদী পশ্চিমের আলোকোজ্জ্বল অবয়ব প্রতিষ্ঠার কাজ সহজতর হয়। স্বঘোষিত প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী পশ্চিমের জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে প্রাচ্য নিজেকে দেখার ফলে সাম্রাজ্যবাদের প্রাধান্য প্রশ্নহীন হয়েছে বলে মনে করেছেন এডোয়ার্ড সাইদ। এই ‘other’ তথা ‘অপর’ থেকে জন্ম নেয় আমরা-ওরা বোধ। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, নৃ-বৈশিষ্ট্যের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় একতায় একসময় গড়ে ওঠে ‘ইমাজিনড্ কমিউনিটি’ (বেনেডিক্ট আন্ডারসন)-র আমরা। কল্পিত সংঘের সদস্যরা, গভীর আনুভূমিক একাত্মবোধের রাজনৈতিক পরিচিতিতে নির্মাণ করে তাদের জাতীয়তাবাদ। উপনিবেশের জনগণের মুক্তির লড়াইতে স্বাধীনতাকামী জনগণের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী চেতনা। জাতীয়তাবাদ জাতিরাষ্ট্র গঠন করে। একথা অনস্বীকার্য যে ‘আমরা-ওরা’ জাতি রাষ্ট্রের মূল ভাবাদর্শ। অর্থাৎ, অন্য রাষ্ট্র আছে তাই আমাদের রাষ্ট্র আছে। তবে ‘আমরা’, ‘ওরা’-র সীমা কখনোই স্থির অপরিবর্তনীয় নয়। ধারাবাহিক সংঘাত চলে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের মধ্যে। বাইরের পূর্ব-পশ্চিমের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী সংঘাতের ভিত্তিভূমি অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ ঘরশত্রু ‘ওরা’-র নির্মাণ হয়ে চলে। একদা ‘আমরা’ বিভাজিত হয়ে জন্ম নেয় নতুন ‘অপর’। 

আজকের ভারতে সরকারি জাতীয়তাবাদী আখ্যানে ন্যাশনাল আইডেন্টিটির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে পড়েছে হিন্দুধর্মীয় পরিচিতি। সমন্বয়বাদী ভাবাদর্শের ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রতিস্থাপনের আগ্রাসী পরিকল্পনা চলছে। এখানে প্রধান শত্রু রূপে ঘোষিত অনুপ্রবেশকারী মুসলমান, লাভ জিহাদি মুসলমান, আতঙ্কবাদী মুসলমান, ডন মুসলমান, অ্যান্টি-ন্যাশনাল ছাত্র মুসলমান, গোরুখেকো শত-শত বাচ্চা জন্ম দেওয়া মোল্লার দল; বাইরের প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান। ‘অপর’-এর সরল সমীকরণটি এরূপ – অপর = মুসলমান = পাকিস্তান। ৯/১১-উত্তর পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়া জাতীয়তাবাদের এই একচেটিয়া ধারাকে পরিপুষ্ট করেছে। গোঁড়া, ধর্মান্ধ, নিষ্ঠুর, হিংস্র, আদিম বর্বরতার সঙ্গে সমার্থক হয়ে ইসলাম যেন এখন মানব সভ্যতার মূর্তিমান শয়তান। জাতীয়তাবাদ শত্রু খুঁজে ফেরে। 

War is Cinema And Cinema is War [৩]

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর Open ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে নরেন্দ্র মোদির ছবির সঙ্গে ক্যাপশনটি ছিল “Triumph of Will”। পাঠকের স্মরণে থাকতে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের অনুমোদন সাপেক্ষে সমনামের একটি প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বানানো হয়। ছবিতে নাৎসি সম্রাটের প্রতি জার্মানবাসীর আস্থা, ভক্তি, বিশ্বাসের প্লাবন প্রদর্শনের সাহায্যে বার্তা দেওয়া হয় হিটলার = জার্মানি। টড এটকিন্সের গবেষণা প্রমাণ করেছে, যে মগজধোলাইতে চলচ্চিত্রের জুড়ি মেলা ভার। আজকের পোস্ট-ট্রুথ সময়ে চলচ্চিত্র অন্যতম রাজনৈতিক অস্ত্র। নিজের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে, বিরোধীপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে সিনেমা বিকল্পহীন। যোগ্য সংগতকার হয় যদি ট্রোল, নেটিজেন, আইটি সেল, ইনফোডেমিক অনুগত মিডিয়া; তখন আধুনিক ফ্যুয়েরার আবির্ভূত হন সময় সমাজের দাবিতেই। 

বিশ্বায়নকালীন অনালম্ব পরিচিতি সংকটে  “Imagined Community” আজ পুনরায় সমষ্টি পরিচিতিতে সংঘবদ্ধ হতে চাইছে, হচ্ছে। দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন জাতীয়তাবাদ  অনেকাংশে ব্যক্তিসত্তার অবলম্বন। রাষ্ট্রিক ভূখণ্ডের বাইরের প্রবাসী জাতীয়তার সূত্রে ভারতীয় চেতনার শরিক হচ্ছেন, যা তাঁকে উদ্দীপিত করে, গৌরবান্বিত করে। এখন ‘ভারতীয়ত্ব’-কে সংজ্ঞায়িত করা হবে কীভাবে? জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা প্রদান করবেন কে? ‘আমরা’ ও ‘ওরা’-র সীমা নির্ধারিত হবে কোন্ আদর্শের প্রেক্ষিতে? জাতীয়তা সম্পর্কে কি সবাই একই ধারণা ব্যক্ত করবে? নাগরিক অধিকার, বহু মত পথের প্রতর্ক থাকবে না বিলীন হয়ে যাবে জাত্যভিমানের একমুখী স্রোতে? 

প্রয়োজন ‘সম্মতি উৎপাদনের’। শাসকের জাতীয়তাবাদ সর্বোত্তম। দেশপ্রেম অতুলনীয়। ক্ষমতাধরের চিহ্নায়িত ‘অপর’ দেশের শান্তি স্থিতাবস্থার পক্ষে ভয়ানক বিপদ। আধিপত্যকামী  অথবা সরকারি ভাষ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চায় শিল্পমাধ্যম, গণমাধ্যম আপন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের জন্য। শিল্প তখন কার্যসিদ্ধির, প্রচারণার শামিল। শাসকের প্রোপাগান্ডায় শক্তিশালী মাধ্যম রূপে প্রায়শই ভূমিকা পালন করেছে সিনেমা। বিংশ শতকের নয়ের দশক থেকে ভারতবর্ষেও ‘হিন্দুত্বের’ জাতীয়তাবাদী সংজ্ঞায় ‘অপর’ তথা সংখ্যালঘু পরিচিতি নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সুনির্দিষ্ট গ্রহীতাকে লক্ষ্য রেখে তৈরি হল বর্ডার (১৯৯৭), গদর — এক প্রেম কথা (২০০১), এল ও সি কার্গিল (২০০৩), লক্ষ্য (২০০৪), ফানা (২০০৬)। প্রত্যেকটি ছবিতে ভারতীয় সেনার আত্মত্যাগ, বিপরীতে মুসলিম চরিত্রগুলি আতঙ্কবাদী, সন্ত্রাসবাদী, বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী। দেশের অখণ্ডতার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক রূপে হাজির হল বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলমান। মুসলমানি অপরায়নের জনমত সংহতকরণে এই সিনেমা সমূহ বলিউডি জাতীয়তাবাদের নতুন ধারার প্রবর্তন করল। 

ক্যামেরা হবে ফাউন্টেন পেনের মতো সস্তা, কাঁচা রিল কাগজের মতো [৪]  

বলিউড প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির। বলিউডের হিন্দি সিনেমায় ভারতকে চিনে বুঝতে চেয়েছে বিশ্ব। সাংস্কৃতিক অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে হিন্দি সিনেমা। মূলত উত্তর-ভারতের উচ্চবর্গীয় হিন্দুসংস্কৃতির দাপট সত্ত্বেও, বলিউডের সিনেমার ভাষা হিন্দি হলেও বহুভাষার ধর্মের আচার বিচারের শ্রেণিভেদাভেদের ভারতবর্ষ যেন আত্মপ্রকাশ করে বলিউডের লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরায়। আপামর ভারতবাসীর চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিকোণ গঠনে ভূমিকা আছে হিন্দি সিনেমার। নাচ, গান, অভিনয়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে বৈচিত্র্যমণ্ডিত  ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতি তথা ধ্রুপদী ঘরানার প্রভাব অনস্বীকার্য। 

স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনের সময় হিন্দি সিনেমায় দেখি সমাজবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। দো বিঘা জমিন (১৯৫৩), মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭), নয়া দৌড় (১৯৫৭), ভুবন সোম (১৯৬১) ইত্যাদি সিনেমায় রিয়েল লাইফ উঠে আসে রিল-লাইফে। জাতীয়তাবাদে উদ্দীপিত যুদ্ধকেন্দ্রিক ছবিও তৈরি হয়েছে – হাকিকত (১৯৬৪), উপকার (১৯৬৭), ক্রান্তি (১৯৮১)। কিন্তু এখানে সুনিয়ন্ত্রিত প্রচারণার কৌশল অনুপস্থিত। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের প্রাক্-মানসব্যাপৃতি থেকে ঘরে ঘরে মীরজাফর খুঁজে বার করা হয়নি। সত্যের সঙ্গে বিনোদনের সম্পর্কে তখনও ফাটল ধরেনি। বিনোদন উদ্দেশ্যমূলক হয়ে পড়লে সিনেমার যাবতীয় দায় অর্পিত হয় বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃত্ববাদের প্রতি। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ঘৃণার উৎসারে লক্ষ্মীও সুপ্রসন্না হন। 

ভালো মুসলমান, মন্দ মুসলমান [৫]

বলিউডের সিনেমায় মুসলমান চরিত্রের বিবর্তন লক্ষণীয়। মুসলিম চরিত্রের আত্মিক সংকট, উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, বেঁচে থাকার দৈনন্দিন লড়াই নিয়ে ছবি হয়েছে। মনে পড়বে – গরম হাওয়া (১৯৭৪), তমস (১৯৮৮), মাম্মো  (১৯৯৪), সেলিম ল্যাংড়ে পে মত রো (১৯৮৯) সিনেমার কথা। অথবা চৌধভি কা চাঁদ (১৯৬০), মেরে মেহেবুব (১৯৬৩), পাকিজা (১৯৭২) চলচ্চিত্রে মুসলিম মানসের, পরিবারের ছবি যথাযথ রূপে প্রকাশের প্রচেষ্টা দেখা যায়। কিন্তু, হিন্দুত্বের চশমায় মুসলমানকে নতুন করে দেখায় রূপান্তর ঘটল সিনেমার কাহিনি, বিন্যাস, মেকআপ, সংলাপ, টেম্পো তথা প্রতীকায়নে। অভিজাতবর্গ মুসলিম চরিত্রের রূপান্তর ঘটল নেতিবাচক চরিত্রে। তাদের মুখে ভারতবিরোধী স্লোগান। মুসলিম মানেই দাড়ি, ফেজটুপি, লুঙ্গি। একদল থাকে পাকিস্তানে, একদল ভারতে যোগসাজশ করে। মসজিদে সাধারণত ধর্মগুরুর তত্ত্বাবধানে অথবা আশ্রয়ে নাশকতার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়। তাদের মেয়েরা বোরখা, হিজাব পড়ে থাকে। এমনকি গণিকারা চড়া মেকআপের মুসলিম নারী হয় (পাকিজা, আমিরন, আনারকলির মুখচ্ছবি ভেসে উঠবে)। বস্তিতে থাকে। বহুবিবাহ করে (গাল্লি বয় সিনেমার মুরাদের বাবা আফতাব আহমেদের উদাহরণ আছে সদ্য)। এক ধরনের পূর্ব-পরিকল্পিত মনোভঙ্গি থেকে স্টিরিওটাইপ মুসলমান চরিত্র সিনেমার পর্দায় হাজির হয়। আর্থসামাজিক বাস্তবতা অনুপস্থিত থাকে, ধর্মীয় রীতি-আচার  সংস্কৃতির বৈভিন্ন্য অস্বীকার করা হয়। 

২০১১ খ্রিস্টাব্দে বলিউডের ৫০টি চলচ্চিত্রের ওপর ভিত্তি করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মুসলিম চরিত্রের বিশ্লেষণ করা হয় (Khan and Bokhari)। বিচারের একক ছিল বহুবিধ – পোশাক, পেশা, মনোজগৎ, দেশপ্রেম ইত্যাদি। দেখা গেল, সর্বমোট মুসলিম চরিত্রের ৬৫.২% বিদ্যমান ভারতীয় সংস্কৃতিতে মোটেও সুবিধাজনক নয়। ৩০.৪% মুসলিম চরিত্রকে এককথায় ভালো অথবা মন্দ বলে দাগিয়ে দেওয়া যাবে না। অবশিষ্ট ৪.৪% মুসলিম চরিত্র গ্রহণযোগ্য। 

হিন্দুর মতো নম্র, ভদ্র, সুশীল, শান্ত, পরিমার্জিত, সর্বোপরি ব্যতিক্রমী দেশপ্রেমিক ভালো মুসলমান চরিত্রও বলিউড হাজির করে নিজের মতো করে। চক দে ইন্ডিয়া (২০০৭)-র কবির খান সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেন – “সির্ফ এক নাম শুনাই দেতা হ্যায় ইন্ডিয়া”। রাজি (২০১৮) সিনেমার হৃদয়ত্ খান নিজে দেশের সেবা করেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। প্রাণাধিক কন্যা সেহমত খানকে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য গুপ্তচরবৃত্তির ভয়ংকর অভিযানে প্রেরণ করেছেন। দাম্পত্য, প্রেম, সম্পর্ক হেলাভরে প্রত্যাখ্যান করে শেহেমত। ‘ওয়াতন’ এর জন্য তার ‘জান কুরবান’। পাহাড়প্রমাণ প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে ইকবালকে তো রুপালি পর্দায় জিতিয়ে দিয়েছে বলিউড। প্রোটাগনিস্ট হিন্দু পুলিশের সহকারী রূপে মুসলিম পুলিশও সমাজবিরোধী দমনে অদৃষ্ট নয়। সারফারোশ (১৯৯৯) সিনেমার ইন্সপেক্টর সালিমকে অবশ্য মুসলিম বলেই দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবু ওরা মন্দ নয়। এই খোপের মুসলমান নারীরা বোরখার আড়ালে বিশুদ্ধতার লিপস্টিক লুকিয়ে রাখে। 

ঘুসপেঠিয়ো কো বাহর করেঙ্গে [৬]

‘ভারত’ নামে দেশ, ‘ভারতীয়’ চেতনার জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে উদ্ভূত হলেও হিন্দু জাতীয়তাবাদকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে হলে ইতিহাসকে নতুনরূপে রচনা করতে হয়। ‘আর্য ইতিহাস’ ‘হিন্দু ইতিহাস’ ‘ভারত ইতিহাস’ তখন একাকার হয়ে যায়। ২৫০০ বছরের ইতিহাসকে প্রাগৈতিহাসিক সূচনালগ্নে স্থানান্তর করা হয়। দেশচেতনা হয়ে ওঠে আদি অকৃত্রিম। সেই দেশ হিন্দুর। তার পিতৃভূমি, পুণ্যভূমি। সুতরাং, ভারত হিন্দুর জন্মভূমি। ধর্ম সংস্কৃতির সনাতনি ধারা ভারতচেতনার জন্মদান করেছে। জাতীয়তাবাদী চেতনার মূল হিন্দুত্বের ভাবধারায় উৎসারিত। খণ্ডিত পরিকল্পিত এই হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তায় হিন্দু ব্যতীত বাকি সব ‘অপর’। সংখ্যাধিক্যের  ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের আলোয় চলে অতীত বিচার। আফগান, তুর্কি, মোগল শাসনেও তখন ভারত ভূখণ্ডের অস্তিত্ব একান্ত বাস্তব। লক্ষ্য পূরণে, বানানো ইতিহাসের যাথার্থ্য প্রমাণে এগিয়ে আসে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। সার্ত্র্ কথিত ‘manipulated seriality’-র কৌশলে রাষ্ট্রের গোষ্ঠীবদ্ধ বিভিন্ন মাধ্যম, মিডিয়া, সিনেমা ক্রমাগত বার্তা প্রেরণ করে অসংগঠিত জনতার কাছে। শোনা কথা বলা কথার চেয়ে সিনেমার কাহিনি জনতা বিশ্বাস করতে থাকে। প্রোপাগান্ডা ফিল্ম এভাবেই ছকবন্দি ভাবনায় অভ্যস্ত করে তোলে জনতাকে। ঐতিহাসিক রোমান্সে আবেগমথিত জনতা তখন ধীরোদাত্ত নায়ক খুঁজে ফেরে অতীতে। বর্তমানে। 

এক যে ছিল আফগান, দোসর তার মোগল 

তানহাজি : দ্য আনসাঙ্ হিরো (২০২০) সিনেমা মুক্তির প্রাক্কালে তানহাজি চরিত্রের অভিনেতা অজয় দেবগন আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীর উদ্দেশে ঘোষণা করলেন – আসন্ন ছবি মোগল  সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত যেন এক সার্জিকাল স্ট্রাইক (শব্দবন্ধের ব্যবহার নিশ্চয়ই সমাপতনের নয়)। এই সিনেমা মোগল সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত। ভাবুন CAA ও NRC বিরোধী আন্দোলনের আবহে আপনি দেখতে যাবেন এমন এক সিনেমা, যা আপনাকে নিয়ে যাবে সপ্তদশ শতাব্দীর সময়কালে। যেখানে অনুপ্রবেশকারী মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ধর্মীয় সাম্রাজ্যবিস্তার অভিযানে মত্ত। বিপরীতে হিন্দুসম্রাট শিবাজি মহারাজ মাতৃভূমি রক্ষার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করে চলেছেন। চলচ্চিত্রের শিরোনাম দেখেই স্পষ্ট প্রোটাগনিস্ট চরিত্র তানহাজি মালুসারে। শিবাজি মহারাজের বিশ্বস্ত অনুগত; বীর  দেশপ্রেমিক। পিতার তত্ত্বাবধানে ছোটো থেকেই তানহাজি রণপারদর্শী, রণকৌশলী, দেহ সৌষ্ঠবে, মানস প্রত্যয়ে এক অকুতোভয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দেওয়া মোগল সৈন্যের নৃশংস অত্যাচারে মৃত্যুবরণের পূর্বে পিতা তানহাজির জীবনের প্রকৃত বীজমন্ত্র রোপণ করে দিয়েছেন – সবার আগে দেশ, দেশের স্বাধীনতা। অক্ষরে অক্ষরে সেই আদর্শ তানহাজি পালন করে চলেছেন সমগ্র ছবি জুড়ে। দেশ, পরিবার, দেশের সাধারণ জনতার প্রতি কর্তব্য দায়িত্বে তিনি অবিচল। অন্যদিকে বহিঃশত্রু মোগল সম্রাট আলমগিরের সাম্রাজ্য বিস্তারের সহযোগী সেনাপতি উদয়ভান সিং রাঠোড় সিনেমার প্রতিনায়ক। তিনিও বীর ও শক্তিশালী যোদ্ধা। তাঁর উপস্থিতি দর্শকদের মধ্যে ক্রোধ, ঘৃণার উদ্রেক করে। উদয়ভান হিংস্র, কুটিল, কামুক। মানবতার লেশমাত্র তাঁর মধ্যে নেই। কথায় কথায় তিনি নিরীহ প্রাণী হত্যা করেন। বন্দিদের ওপর অত্যাচারে তৃপ্তি লাভ করেন। পোড়াপশু মাংসে রসনা তৃপ্ত করেন। বলপূর্বক নারী দখলে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। বৈপরীত্যের আর্কিটাইপ দুই চরিত্রের অঙ্গসজ্জা, পোশাক পরিকল্পনায়, আলোর ব্যবহারে। তানহাজির কপালে তিলক, পরনে শ্বেতশোভিত বস্ত্র, আবির্ভূত হন তিনি আলোকোজ্জ্বল পরিমণ্ডলে। অন্যদিকে হিন্দু হয়েও উদয়ভান দাড়ি রাখেন, অধিকাংশ সময় গাঢ় রঙের রাজবস্ত্র পরিধান করেন। এমনকি উদয়ভানের সেনার বস্ত্র হয়ে ওঠে মুসলমানি পরিচ্ছদের প্রতীক। তানহাজি লড়াই করেন গেরুয়া পতাকার মর্যাদা রক্ষার্থে। অন্যদিকে উদয়ভান সবুজ নিশানে নিজের আক্রামক অস্তিত্বের জানান দেন। বিদেশাগত দস্যু আক্রমণকারী রূপে ছায়ায় থাকেন আলমগির, যাঁর হিন্দি সংলাপে থাকে বহিরাগত টান। ছবিতে আসলে ছায়াযুদ্ধ চলে হিন্দু-মুসলিমে। মারাঠা ও রাজপুত দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা উধাও হয়ে যায়। শেষে মারাঠার বিজয়কেতনে জ্বলজ্বল করে ‘ওম’। কোন্দহানা-য় হিন্দু জয়গাথার ধ্বজা উড়তে থাকে দেশের জন্য তানহাজির আত্মবলিদানের জন্যই। এদিকে এই সিংহবীরের জন্য অপেক্ষারতা সহধর্মিণী সাবিত্রীবাই। স্বদেশের স্বাধীনতায় তাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষা কোনও অংশে কম নয়। 

আত্মোৎসর্গের মহিমা বলিউড হাজির করেছে পদ্মাবৎ (২০১৮)  সিনেমায়ও। সুফি ভাবধারার আখ্যানকাব্য মায়া ছড়ায় সিলভার স্ক্রিনে। বিগ বাজেট, সুপারস্টার, নামী পরিচালকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রূপক কাহিনি ইতিহাসের মর্যাদা পেয়ে যায়। সেই এক উদ্দেশ্যজারিত সমীকরণ। চিতোরের রানা রতন সিং ও সিংহলের রাজকন্যা সৌন্দর্যের  প্রতিমূর্তি পদ্মাবৎ  সুখে শান্তিতে প্রেমে জীবন অতিবাহন করছিল। এদিকে সুদূর আফগানিস্তান থেকে সাম্রাজ্যলিপ্সু, ধূর্ত, বর্বর শাসক জালালউদ্দিন খিলজি দখল করল দিল্লির সিংহাসন। সঙ্গে এল ভ্রাতুষ্পুত্র আলাউদ্দিন। বহুগামী, কামুক, লম্পট। তাঁর চাই নিত্যনতুন নারী। ক্ষমতা। মেবারের সুস্থিত পারিবারিক বন্ধনের ভারতীয় মূল্যবোধের বিপরীতে দিল্লির সুলতানি পর্যাবরণে শুধুই লোভ, ষড়যন্ত্র, হত্যা, রক্তপাতের বীভৎসা। ‘খালিবালি’ গানটার কথাই যদি ধরা যায়। মশাল জ্বালিয়ে অন্ধকারের দৃশ্যপটে একদল অসভ্য বুনো নিজেদের শক্তিমত্তা, পৌরুষের বহিঃপ্রকাশ করছে কী নিদারুণ উল্লাসে। আলাউদ্দিনের চোখের চাহনিতে যেন ছিঁড়ে খাওয়ার উদ্দামতা। রণমদমত্ততা ও যৌনতাড়না মিলে সে কি ভয়ংকর কোরিওগ্রাফি। সহযোগী প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র, কালো পোশাক। জীবন্ত জাহান্নামে দাপাদাপি করছে শয়তানের দল!  এখান থেকে কাহিনি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায় পদ্মাবতীর প্রতি আলাউদ্দিনের অনিস্তার আকর্ষণে। অতএব নারীকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ। হিন্দুনারী পদ্মাবতীর হৃদয়ে প্রেম কায়েম করতে চায় আফগান মুসলমান শাসক আলাউদ্দিন। যুদ্ধ বাধে। রতন সিং নিরস্ত্র অবস্থায় আলাউদ্দিনকে নিধন না-করে মহারথি প্রথা অনুসরণ করলেও মালিক কাফুর (ছবিতে যার সঙ্গে আলাউদ্দিনের যৌনসম্পর্কের ইঙ্গিত আছে) পিছন থেকে ছুরি মারেন রতন সিংকে। উপসংহারে হিন্দুনারীর সতীত্বের গৌরব প্রতিষ্ঠা — জহরব্রত পালনের দৃশ্যে। একবিংশ শতকে দর্শক দেখতে থাকে হিন্দুনারী জীবনের পরম সার্থকতা সতীত্বের পরাকাষ্ঠায়। সীতার দেশের নারী যে পদ্মাবতী, রাজপুত রমণীকুল! চলমান ‘লাভ জিহাদের’ বিতর্কের মাঝে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এক দিশা। ইসলামফোবিয়ার বিপ্রতীপে ‘পদ্মাবৎ’, ‘তানহাজি’ আত্মদানের সংকল্প ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। গৌরবান্বিত ইতিহাসের শ্লাঘা জনমানসে সঞ্চারিত করে এভাবেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের মানসভূমি কর্ষণের কাজ চলে। 

দেশ সুরক্ষিত হাতো মে হ্যায় [৭]

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। উরি সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। ১৮ জন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারালেন। দেশজুড়ে নিন্দা, শোক, ক্রোধের বাতাবরণ। এগারো দিন পর (২৯ সেপ্টেম্বর) ব্রেকিং নিউজ ছড়িয়ে পড়ল। ভারতীয় সেনা উরির নাশকতার বদলা নিয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি ঘাঁটিতে উপর্যুপরি প্রত্যাঘাত হেনেছে। অগণিত হানাদারের মৃত্যুর নিশ্চিতি প্রকাশ্যে এল সদর্পে। রাষ্ট্রনায়কের বন্দনায় মুখরিত আকাশ বাতাস। সমুচিত বদলা নেওয়া হয়েছে গুলির বদলে গ্রেনেড ছুড়ে। জয় করে তবু যায় না সংশয়। বিরোধীপক্ষ চিৎকার করতে থাকে — সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রমাণ কোথায়? ফোনে, সমাজমাধ্যমে খেলনা বন্দুকে নকলযুদ্ধের ভিডিও গেম ঘুরতে থাকে। তারপর সিনেমায় যেমন দেখায় ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড। দো সাল কে বাদ। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ। ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের বছরের শুরুতে মুক্তি পেল উরি — দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। ২৫ কোটি টাকায় তৈরি সিনেমায় নতুন দেশনেতার নেতৃত্বে নতুন ভারত নির্মাণের কথা তুলে ধরা হল। সেখানে জঙ্গিনিকেশে দীর্ঘসূত্রী পদক্ষেপের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকট হল। সিনেমায় দেখলাম জঙ্গিহানার সমুচিত জবাব দিতে প্রধানমন্ত্রী  তৎক্ষণাৎ নির্দ্বিধায় অনুমতি দিলেন শত্রু শিবিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের। কন্ট্রোল রুম থেকে বিনিদ্র রাষ্ট্রপ্রধান যেন নিজেই অভিযানে শামিল হয়েছেন। রাষ্ট্রনায়ক যখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সেনাদল তখন বুকটান উদ্দীপনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপক্ষ শিবিরে। মেজর বিহান সিং শেরগিলের চৌকস পরিচালনায় ভারতীয় সেনা ধ্বংস করে দেয় পাকমদতপুষ্ট জঙ্গি শিবির। সিনেমার শেষ দৃশ্যে (নামলিপি প্রদর্শনের পরেও) দেখা যায় পাকিস্তানের জনৈক মন্ত্রী জামির হতাশায় ক্ষোভে চিৎকারে নিজেদের অসহায় পরাজয় স্বীকার করছে। সিনেমার শেষ টাইটেল কার্ডে বিঘোষিত হল — ‘জয় হিন্দ’। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, সমরাভিযান উপযোগী দৃশ্যবিন্যাস, আবেগাপ্লুত চিত্রনাট্য, চরিত্র অনুসৃত ক্যামেরা, চকচকে গ্রাফিক্স, উৎকণ্ঠা মিশ্রিত বলদৃপ্ত আবহসংগীত এবং দক্ষকুশল অভিনয়ে ‘উরি’ আখ্যান ও বাস্তবতার সীমা ঘুচিয়েছে।  

বাক্-স্বাধীনতার ঝান্ডাধারী জামাত কেঁপে গিয়েছে [৮]

বর্তমান ভারতের শাসকের জাতীয়তাবাদের মূলে আছে ঘৃণা। বিধর্মী বিদ্বেষে, চোখরাঙানিতে, হুংকারে, কোণঠাসা করো। সংখ্যালঘুকে অধিকারবিহীন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করো। ভয় ধরাও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা বিরুদ্ধ স্বর এখানে নিষিদ্ধ; বুলডোজার বাবার কল্যাণে এনকাউন্টারের প্রহর গুনছে। সরকার বিরোধিতা দেশদ্রোহের সমার্থক। দানবীয় UAPA রাজদ্রোহ দমনের অস্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা পাশ্চাত্য আমদানিকৃত অচল মতাদর্শ। 

উল্লেখিত অভিযোগ করে চলেছেন বামপন্থীরা, মানবাধিকার কর্মীরা, বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠন। শাসক দল তথা তাঁদের ভাবাদর্শের কান্ডারিরা আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লেফট্ লিবারালরা হিন্দু ধর্ম, সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। তাদের কুমিরকান্না কোন্ কন্দরে লুকায় যখন স্ব-দেশে হিন্দুর [ আধিপত্যবাদী এই ভাবচেতনায় ও কর্মসূচির বহিঃপ্রকাশে ভারত এক জাতি, এক দেশ। সে দেশ হিন্দুস্তান। ধর্ম বহু হতে পারে।] জীবন নরক হয়ে ওঠে? নিজের পিতৃভূমি থেকে উৎখাত হয় শত সহস্র হিন্দু? গণতন্ত্রপ্রেমীদের আসলে একচোখে ঠুলি। শাসক কথিত ধামাচাপা পড়া সেই ইতিহাস জনসমক্ষে উন্মুক্ত করে বলিউড ফিল্ম। 

১১ মার্চ, ২০২২। সারা ভারতের ৬০০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় দ্য কাশ্মীর ফাইলস । সপ্তাহান্তে বক্সঅফিসে ব্যবসায়িক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ২৫০০। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছবিটি দেখার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করেন। ভারতের ইতিহাসে কলঙ্কজনক এক অধ্যায় সাক্ষী হওয়ার তাগিদ তৈরি হয়। ১৯৮৯-৯০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাসস্থান থেকে উৎখাত হওয়া, নরমেধ যজ্ঞের কাহিনি দেখতে ছুটছেন সবাই। সাধারণ গৃহস্থ  থেকে গৃহত্যাগী সাধুসন্ত। কোথাও সবেতন পূর্ণদিবস ছুটি, কোথাও অর্ধদিবস। পাকিস্তানের প্রতিপোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী কুখ্যাত জিহাদি ফারুক মালিক বিট্টার নেতৃত্বে নিরীহ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গণহত্যা করছে, গণধর্ষণে নারীশিকারে নির্মম মাতন, জ্বলছে ঘরবাড়ি; ‘নিজভূমে পরবাসী’ হয়ে পড়লেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। এ যেন হিন্দু হলোকস্ট (holocaust)! পুষ্করনাথ পণ্ডিত যেন সমগ্র কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের, স্বজনহারানো উদ্বাস্তু জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তব দিবালোকে নিয়ে এলেন। শিউরে উঠবেন দর্শকরা যখন গুলিবিদ্ধ স্বামীকে রক্তমাখা ভাত খাওয়ার জন্য ইসলামি জঙ্গি নির্দেশ দেবেন। সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় আর-এক ঘৃণার রক্ত কি মানবীয় অস্তিত্ব গ্রাস করল? 

সিনেমা দেখে অসমের মুখ্যমন্ত্রী বললেন —

“ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে  এমন ঘটনা অসমেও হতে পারে — এই ভয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের মন থেকে দূর করা এ রাজ্যের মুসলমানদের কর্তব্য।” [ সূত্র: TV9 Bangla, 16Mar, 22 ] এখানেই সিনেমা লক্ষ্যপূরণে সার্থক। সেই চেনা ছক — সব মুসলিম অল্পবিস্তর জঙ্গি, সব জঙ্গির জন্মদাতা, পালনকর্তা পাকিস্তান। আর এই পাকিস্তান ভারতীয় মুসলিমেরও পাকভূমি। 

আগামী বিপদের আঁচ করে আদিল হুসেন টুইট করলেন — “সত্য অবশ্যই বলা উচিত!  এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে তা নম্রভাবে বলা উচিত। তা না হলে সত্যকথনের উদ্দেশ্য হারায়। যার প্রভাব প্রতিক্রিয়াশীল হয়।… শিল্পের কখনোই প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়”। [সুত্র: @_ AdilHussain: 10:17 pm: March 18, 2022]

দীর্ঘ হলেও বামপন্থী মহম্মদ ইউসুফ তারিগামির উদ্ধৃতি পড়তে হবে আমাদের – “যারা এখনও কাশ্মীরি রক্তের  সওদা করছে, খোলাবাজারে বিক্রি করছে, তাদের বলছি, অনেক হয়েছে, এবার রেহাই দাও। কে মরেছে? কে মেরেছে? যেই মরেছে আমার আত্মীয় মরেছে। আমার অভিভাবক মরেছে। তাঁর নাম কী ছিল, কোন্ ধর্মের ছিল — আসলে তা কাশ্মীরি ছিল। ওয়ানধামা হত্যাকাণ্ড যেমন হয়েছে, গাওকদল হত্যাকাণ্ডকেও ভোলা যায় না। বাগদামের সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তেমনই কুপওয়ারাতে বন্দিপোরা থেকে আসা বাসের যাত্রীদের কে মেরেছিল?… প্রধানমন্ত্রীজি আমি চাই এই সব ঘটনার তদন্ত হোক”। [সূত্র : ফেসবুক পোস্ট : CPI(M) West Bengal Supporters : 20/3/2022] 

অভিনেতা প্রকাশ রাজের অভিমত — “এই ছবিটি দিয়ে শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিমকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, পুরো দেশ হিন্দু-মুসলমানে রূপান্তরিত হবে এবং শীঘ্রই আমরা ভারতীয় সংখ্যালঘুতে রূপান্তরিত হব”। [সূত্র : @prakashraaj: 2:03pm: Mar 20, 2022] 

‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রের (না প্রোপাগান্ডা ফিল্মের?) অভূতপূর্ব সাফল্য এখানেই। জাতীয়সত্তা নির্মাণে ভারতীয় পরিচিতি গৌণ হয়ে পড়েছে। 

বিঃদ্রঃ — উদ্ভূত উত্তপ্ত বাগ্-বিতণ্ডার পরিসরে পাঠক সময় সুযোগে দেখে নিতে পারেন  ফ্রিত্জ্ হিপলার নির্দেশিত নাৎসি প্রোপাগান্ডা ফিল্ম দ্য ইটারনাল জিউ (১৯৪০)। 

সফল ত্রিভুজ  

উইং কমান্ডার প্রশান্ত বালাকৃষ্ণন নায়ার যুদ্ধভিত্তিক ছবির মূলে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে গূঢ় অভিসন্ধি কাজ করে তার কৃৎকৌশল অনুধাবন করতে চেয়েছেন। সমস্ত প্রোপাগান্ডা ফিল্মের গঠনপ্রণালী সূত্রায়িত করা যেতে পারে পরস্পর অন্বিত ত্রিভুজ বন্ধনে। নায়ারের পর্যবেক্ষণকে সহজ করে বুঝতে আমরা নিজেরাই একটা ত্রিভুজ এঁকে নেব —  

প্রপাগ্যান্ডা ফিল্মের লক্ষ্যকেন্দ্রে থাকে নির্দিষ্ট দর্শকমণ্ডল (target audience), যারা অবস্থান করছে ত্রিভুজশীর্ষে। ত্রিভুজের ভিত্তিভূমি গঠন করে সিনেমার পরিচালক ও শাসক/অধিপতি দর্শন। এখন পরিচালকের প্রধান প্রথম স্বার্থ ব্যবসা। এছাড়াও তিনি আস্থা স্থাপন করতে পারেন কোনও মতাদর্শে। অন্যদিকে শাসক অথবা কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীর রয়েছে আগামী কার্যকলাপ, আপন মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। তাঁদের প্রয়োজন জনগণকে স্ব-ভাবনায় পরিচালিত করা। দর্শনের শক্তপোক্ত বনিয়াদ গড়ে তোলা। এখন পরিচালক ও প্রশাসকের স্বার্থ যদি মিলে যায় তাহলে উদ্দেশ্যমূলক চলচ্চিত্র বাজার ছেয়ে যাবে। জনতাকে সুনির্দিষ্ট ভাবনায় (mass mobilization) পরিচালিত করার জন্য একের পর এক তৈরি হবে প্রোপাগান্ডা ফিল্ম। পরিচালক, অভিনেতা দ্বিমত পোষণ করলে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন পেয়াদা [ ভারতীয় প্রেক্ষিতে CBI, ED, ITAX দপ্তর ভাবা যেতে পারে, আর snapdeal দ্বারা বরখাস্ত আমির খানের কাঁচুমাচু অবস্থান স্মরণ করা যেতে পারে।] শমন নিয়ে হাজির হবে। সরকারি সত্যের সিনেমা বানালে লাভ অনেক। [ কর মকুব হতে পারে। করণ জোহারের মতো সরকারি খেতাব জুটতে পারে। অক্ষয় কুমারের মতো প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনন্য বিরল সুযোগ জুটে যেতে পারে। ] সুতরাং সুনির্দিষ্ট বার্তা ঊর্ধ্বমুখী অভিমুখে ক্রমাগত প্রেরিত হবে। গ্রহীতা দর্শক ধারাবাহিক প্রচারণায় প্রভাবিত হবেন। শাসকের ‘হ্যাঁ’-তে  ‘হ্যাঁ’ মেলাবেন।  চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে তখন সে একান্ত ভক্ত। পরিচালকের প্রাপ্তি পয়সা উশুলের সঙ্গে জাতীয় বিবেকের উপাধি লাভ। আধিপত্যকামী দর্শন তখন অপ্রতিরোধ্য। 

২০১০ খ্রিস্টাব্দের পর মুক্তিপ্রাপ্ত জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) বলিউডি সিনেমার ব্যাবসায়িক খতিয়ান এক নজরে : 

জাতীয়তাবাদ বিক্রির বাজার বেশ লোভনীয়  নিন্দুকেরা বলতেই পারেন। 

পকড়ো মারো কাটো চিড় দো — জিঙ্গোস্তান জিন্দাবাদ [৯]

কিন্তু তবু, যদি, এসত্ত্বেও, এতদ্ব্যতীত অব্যয় আছে, তাই দ্বৈধ্য আছে। আনুগত্য, অনুরক্তি সুতরাং নিশ্ছিদ্র হয় না। অধিপতি বাচনের প্রতি তৎকালের প্রান্তিক বাচনের কূট প্রশ্ন ধেয়ে আসে, এ কথা ইতিহাস জানায়। বলিউড যখন বর্তমান শাসকের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে ভয়ে ভক্তিতে ব্যবসায়িক লক্ষ্য পূরণের জন্য সেলুলয়েডে হাজির করছেন, বশীকরণের মাধ্যমে মানুষের সহমর্মী চেতনায় ‘আমরা-ওরা’-র প্রাচীর গড়ার চেষ্টা করছেন, বিদ্বেষের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তবুও মানবতাবাদী পরিচালক তাঁর আপন স্বদেশ খুঁজে চলেন। এক যে ছিল সেই বহুত্ববাদের ভারতবর্ষ। প্রভুর পদলেহনকারী পরিচালক যখন “হিন্দুর ইতিহাস নাই” আক্ষেপ মেটাতে কল্পনাশ্রয়ী রোমান্সে ঘৃণার বারুদ ঠেসে হিন্দুর গৌরবোজ্জ্বল বীরকাহিনির সহায়ে অভিভূত উত্তেজিত করে তুলতে চাইছেন আপাদমস্তক। শিল্পী যিনি, গণিকাবৃত্তিতে থুৎকার করে তিনি ভূমা-র সাধনা করেন। শাসকের প্রচল বয়ানে অন্তর্ঘাত করে ‘অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতাকে’ উন্মোচিত করে দেন। মানুষের পাপ চেতনা, শুভাশুভ বোধকে তিনি খুঁজে চলেন শিল্প মাধ্যমে, চলমান সময় সমেত। রক্তাক্ত সময়ে শূন্যতার সিনেমা, মানুষীবোধ প্রস্থানের সিনেমা ফিরাক (২০০৮) দেখেছেন? গুজরাত দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা, কুঁকড়ে থাকার যন্ত্রণা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস অনুশোচনা, কুটিল হিংসার চলচ্ছবি? অথবা, পরজানকে আমরা কি খুঁজে পেয়েছি আজও? এলান কি গান্ধির অহিংস ভারতের খোঁজ এখনও পেয়েছেন? (পারজানিয়া, ২০০৭) আমাদের অন্তস্তলে কি অনুরণিত হচ্ছে ধর্মজল্লাদের হাত থেকে বিধর্মী মুসলমানের সন্তান আলিঙ্গনাবদ্ধ   পণ্ডিত চতুর্বেদীর আত্ম-উপলব্ধি – “ধর্ম শুধুমাত্র সাধনার নয় কর্তব্যের, কর্মের। একতা ও সদ্ভাবনা হল ধর্ম। ভেদভাব ত্যাগ করাই হল ধর্ম। মানবতাই ধর্ম”। (ধর্ম, ২০০৭) সূক্ষ্ম অথবা মোটা দাগের প্ররোচনা আসবে বলিউড সিনেমা সমেত বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়া মারফত। কিন্তু ভুলে যাব কী করে — ভারতবর্ষ ক্ষুধার্ত, অসুখী। স্বাধীন মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকার দিনদিন সংকুচিত। 

এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও … [১০]

বন্ধু চলুন আমরা ভেসে চলে হামিদের সঙ্গে। রক্তবর্ণ রঞ্জিত কিস্তি ভাসিয়েছে সে ঝিলামের বুকে। হারিয়ে যাওয়া আব্বুর খোঁজে যাত্রাপথ তার অনির্দেশ্য। (হামিদ, ২০১৮) তার যাত্রাপথের সঙ্গী হয়ে আমরাও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারি ভারতজাতির জনকের ভাবসাধনা। 

এই ভারতবর্ষেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উন্মূলন অস্তিত্বের খোঁয়ারিতে বেঁচে থাকা অসংখ্য ভারতীয়ের সঙ্গে সেলিম মির্জার পরিবার (গরম হাওয়া, ১৯৭৪ )। অশীতিপর দাদ্দা আমৃত্যু আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন তাঁর মকাম, তিন ফুট বাই ছয় ফুটের খাটিয়া। আর তাঁর স্বদেশ ভারতবর্ষ। 

শেষ করব সরলার মায়ের কথায়। ‘পোড়াকপাল’ বুড়ি। বাড়ি ছিল তাঁর পাবনায়। সোয়ামি কন্যা হারিয়ে পুবদুয়ারি ভিটেমাটি, সিঁদুরে আমের চারা ছেড়ে ছিন্নমূল সে অনেক দিন হল এসেছে এদেশে। হঠাৎ যেদিন শুনল পুব-পাকিস্তানে বন্যা, চোখে জল এল অঝোর ধারায়। হয়তো বানে ডুবেছে তার ঘরদুয়ার। বুড়ির দুশ্চিন্তায় ঘিরে থাকে ফেলে আসা ছেড়ে আসা দেশের রহিমের বাবা, করিমের ব্যাটা, মাঝিপাড়ার

আমিনা আর বুড়ো বটগাছ। কি জানি কী হল তাদের! তখন মনে হয় : 

                         “বুঝি সে তো খোঁজে না স্বদেশ                                                                                                                     
                          টাকা আনা পাইয়ের হিসাবে                                                                                                                   
                           ঘর বাড়ি মানুষ প্রকৃতি                                                                                                                      
                          বিন্দু বিন্দু মিলে যে উন্মেষ                                                                                                                  
                          সে দীপ্ত আলোতে তার স্মৃতি                                                                                                        
                           আশ্বিনের প্রখর আকাশ!”

                                                                                      (চিঠি : মণীন্দ্র রায়) 

শিরায় শিরায় ওতপ্রোত এই দেশচেতনা আমাদের আছে? 

তথ্যসূত্র :

১) Uri : The Surgical Strike (2019) ছবির সংলাপ 

২) www.ndtv.com : April 11, 2019

৩) Paul Virilo, ‘World War II : Film and History’

৪) ফরাসি চিত্রপরিচালক জাঁ ককতো-র চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিশ্লেষণ 

৫) মাহমুদ মামদানির গ্রন্থের শিরোনাম 

৬) nababharattimes.indiatimes.com : 11 Sep, 2018

৭) thequint.com(hindi) : Feb 26, 2019

৮) হিন্দুস্তান টাইমস, মার্চ ১৫, ২০২২

৯) গাল্লি বয় (২০১৯) সিনেমার গানের অংশবিশেষ 

১০) দাঁড়াও : শক্তি চট্টোপাধ্যায়

সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ : 

১) খাজা আহমদ আব্বাস, ‘কেমন করে সিনেমা তৈরি হয়’ (অমিতাভ চক্রবর্তী অনূদিত), দিল্লি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ১৯৭৭।

২) আজকাল.ইন, ‘সিনেমার রাজনীতি, রাজনীতির সিনেমা’, সুদীপ্ত চক্রবর্তী, ১৬ জানুয়ারি, ২০২০।

৩) Dianna Dimitrava, ‘Hinduism and its Others in Bollywood Films of the 2000s’, Journal of Religion and Film: Volume 20; Issue 1, Article 10, 2016

৪) lmages, ‘Bollywood film Sooryavanshi under fire for criminalizing normal muslim behviour’, lmages Staff, 18 Nov. 2020.

৫) Jairus Banaji, ‘The Political Culture of Fascism: What the Nations Really Needs to Know’, The JNU Nationalism Lectures, New Delhi, Harper Collins, 2016.

৬) Misha Khan, ‘No ‘Me’ Before the Nation: Portrayal of Nationalism and Religious Identities in Bollywood Movies Created During Modi Era’, Illinois State University, 2020.

৭) Pakistan Journal of Islamic Research, ‘Portrayal of Muslims in Indian Cinema : A Context Analysis of Movies during 2002-08’, M.A. Khan & S.Z. Bokhari, (Vol.8, 1-15), 2011. 

৮) Scroll.in, ‘We cannot allow ourselves to forget what constitutes us’, Nandini Ramnath, Sept.20, 2021.

৯) Wing Commander Prasant Balakrishnan Nair, ‘War Movies Decoded’ (Research Report), Alabama, Air Command & Staff College Air University,  2014.

ছবি : অন্তর্জাল।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান