আগামীর রূপকথা

রেচেল কার্সন

(অনুবাদ : মানস মুখোপাধ্যায়)

[‘Silent Spring’ গ্রন্থের কথামুখ ‘Fables for Tomorrow’ নিবন্ধের অনুবাদ।]

এক যে ছিল শহর, কোন্ সে অতীতে, আমেরিকা দেশের মাঝখানে, যেখানে মনে হত তার জীবনধারা চারদিকের পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। চারপাশের সমৃদ্ধ ফসলের খেতের মাঝে ছিল সেই শহর — ফসল ভরা খেত আর পাহাড় ঘেরা বাগান; যেখানে বসন্তে সবুজ মাঠের উপর ফুলের মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াত। শরতে ভন, ম্যাপেল, আর বার্চের বর্ণময় শোভায় আগুনের বিচ্ছুরণ; পাইন সারির পটভূমিতে জানাত তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। দূরে পাহাড় থেকে আসত শিয়ালের হাঁকডাক। হরিণের দল নিঃশব্দ পায়ে খেত পেরিয়ে পাড়ি দিত তাদের ডেরায়; ভোরের রহস্যময় কুয়াশায় বাকিরা যেত মিলিয়ে।

প্রায় বছরভর রাস্তার পাশে সারি দেওয়া ল্যরেল, ভাইবার্ণাম, অ্যান্ডার ও নানা রঙের বনফুলের মনকাড়া শোভায় বেড়াতে আসা মানুষের চোখ তৃপ্তি পেত। এমনকি শীতেও রাস্তার ধারের রূপের বাহারে ছিল না কোনও ঘাটতি। সেখানে বরফের থেকে মাথা তোলা আর ছড়িয়ে পড়া আগাছার ফল, বীজের মাঝে ভিড় জমাত পাখির দল। নানা পাখির সমাবেশ আর তার বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ শোভা দেখতে দলে দলে ছুটে আসত দূর-দূরান্তের মানুষ, বসন্তে-শীতে। দূর দেশের লোকেদের কেউ-বা আবার দাঁড়াত গিয়ে সাঁকোর ওপর, ট্রাউট মাছ ধরার আনন্দ নিতে। প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়া এই আবহমান জীবনধারায় মানুষ তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল তার বসতি — ঘর তুলেছিল, কুয়োয় কলসি ডুবিয়েছিল, বানিয়েছিল শস্যের গোলা।

এরপর সহসা অচেনা আতঙ্কের বিভীষিকা এল ধেয়ে। বদলে যেতে লাগল সবকিছুই, যেন নিমেষে। কোনও এক পিশাচ-শক্তির করাল হাতছানি মানুষগুলোকে করল হতবাক। মুরগিগুলো দলবেঁধে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল, গবাদিপশু ও ভেড়ার পালে হঠাৎ লাগল মড়ক। সর্বত্র মৃত্যুর মিছিল। চাষি পরিবারগুলোর ঘরে ঘরে রোগের বার্তা ছড়িয়ে পড়ল। শহর থেকে ডাক্তার-বদ্যির দল এসে অজানা অসুখের কারণ খুঁজে না পেয়ে হল বিভ্রান্ত। অস্বাভাবিক আর উপসর্গহীন অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনার বাস্তবিক কোনও ব্যাখ্যা খুজেঁ পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল তাদের। শুধু বয়স্করাই নয় শিশুরাও এর থেকে বাদ গেল না; খেলতে খেলতে সামান্য আঘাত পেয়ে তারা প্রহর না পেরোতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। 

এক বাকহীন নীরবতা খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের আচ্ছন্ন করছিল। পাখিরা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অসহায় দিশেহারা মানুষ তাদের বিভ্রান্তি নিয়ে ওদের কথা বলছিল। ঘরের পেছনে গাছ-গাছালির আস্তানায় কয়েকটা পাখি ভয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, প্রাণপণ চেষ্টা করছে উড়ে যেতে, কিন্তু মুমূর্ষু আর অসহায় পাখিদের সে ক্ষমতা আর নেই। সর্বত্র এক স্তব্ধ বসন্তের নিদারুণ রূপ। এতদিন ধরে রবিন, ক্যাটবার্ড, ঘুঘু, জেস, রেন আরও অন্য কত পাখির কলতানে যেখানে ভোর হত, সেখানে আজ সবকিছুই শব্দহীন। খেতে, জঙ্গলে জলাভূমির সর্বত্র এক অদ্ভুত নীরবতা। 

খামারে খামারে এখন মুরগি ডিম পারে, কিন্তু ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয় না। চাষিদের অভিযোগ, তারা শুয়োর পালন করতে অক্ষম, কেননা শুয়োরের ছানারা জন্মাবার পরেই মারা যাচ্ছে। আপেল গাছে ফুল এলেও মৌমাছিরা আর গুনগুন করে না, তাই পরাগমিলনের বিহনে ফলও আর ধরে না। রাস্তার পাশে সেই বর্ণময় সৌন্দর্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, শুধুই সারি সারি শুষ্ক গাছপালা— আগুনে ঝলসানো তার রূপ, ছন্দহীন জনজীবনের মোতই বড় প্রাণহীন। নদীও নিস্তরঙ্গ, নিষ্প্রাণ আজ। সেখানে আর মাছ নেই, তাই মাছ ধরার জন্য ছিপ ফেলতে কেউ আর আসে না এখন।  

ঘরের চালের উপর, নর্দমার পাশে, এদিকে ওদিকে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা কী এক গুঁড়ো গুঁড়ো সাদাটে বস্তুর ছোপ! মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে যা পড়েছিল তাদের ঘরের চালে, বাগানে, চাষের খেতে আর নদীর জলে। এক ভয়াবহ সন্ত্রাস। ওদের সমাজের আবহমান জীবনধারাকে কোনও ডাকিনী যোগিনীর কালোজাদু বা শত্রুদের অপকর্ম নিঃশেষ করেনি, নিঃশেষ করেছে মানুষ নিজেই।

… এই শহরটির আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই, তবে আমেরিকা বা বিশ্বের অন্যত্র এরকম হাজার হাজার শহর আজ থাকলেও থাকতে পারে। আমি যে দুর্ভাগ্যের কথা এখানে বর্ণনা করেছি তার অভিজ্ঞতা পৃথিবীর কোনও জনজাতির হয়েছে কিনা, আসলে তা আমার জানা নেই। তবে এই বিপর্যয়ের কোনও-না-কোনও অভিঘাত কোথাও-না-কোথাও পড়েছে। বর্তমানের অগণিত জনসম্প্রদায় ইতিমধ্যেই তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আসলে এক সর্বনাশের প্রেতচ্ছায়া আমাদের অলক্ষ্যে আজ আমাদেরকেই গ্রাস করছে। এই কল্পিত দুর্ভাগ্য অচিরেই হয়তো নির্মম বাস্তব হয়ে আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াবে। 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান