জন বেলামি ফস্টার ও ব্রেট ক্লার্ক
(অনুবাদ : গৈরিক বসু)
[‘ইকোলজিকাল ক্যাপিটালিজম : দ্য কার্স অব ক্যাপিটালিজম’ প্রবন্ধের অনুবাদ।]
২০০৩-এর বসন্তে আমেরিকা ব্রিটেনের সঙ্গে ইরাক আক্রমণ করে। ইরাকে আছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক তেল ভান্ডার। ইরাক দখলের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল এই তেলের ভান্ডারকে কব্জা করে দুনিয়াতে নিজেদের অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করা। ইরাক আক্রমণের আগে এই একই আমেরিকার সরকার কিয়োটো প্রোটোকল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এই প্রোটোকল কীভাবে পৃথিবীর কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ, যা জীবজগতের ভয়ংকর ক্ষতিসাধন করে চলেছে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে রচনা করা হয়েছিল। অনিবার্যভাবে তাই, বিগত কয়েক বছর ধরে বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের মতোই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসছে।
১৯৮৬-তে আলফ্রেড ক্রসবি “বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ : ইউরোপে জৈবিক বিস্তার ৯০০-১৯০০” শিরোনামে এক নিবন্ধ রচনা করেন। এই নিবন্ধে বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ফলে কীভাবে সহজাত প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছিল, দেখিয়েছিলেন। সেই ধ্বংসের অনেকটাই হয়তো অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞানতাবশত। সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর নতুন পরিবেশে আদিম পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের অনেক ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটেছিল। তবে ক্রসবি ঐ নিবন্ধে পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতি বা পুঁজিবাদী শক্তিগুলির পারস্পরিক সংঘাতের বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করেননি, মূলত জীবজগতের পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। কলম্বাস আমেরিকায় অবতরণের ফলে লক্ষ লক্ষ আদিম জনজাতির মানুষ যে মড়কের ফলে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাকে জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়েছিল, উৎপাদনের সামাজিক টানাপোড়েন তাতে ঠাঁই পায়নি।
বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের বিশ্লেষণ যথেষ্ট কঠিন। মার্কসীয় তত্ত্বে পরিবেশের বস্তুগত আলোচনা বিশেষ হয়নি। তবে কিছুটা ইঙ্গিত ছিলই, মার্কসের নিজের লেখাতেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ধনসম্পদ যেভাবে গ্রাম থেকে শহরের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়, পৃথিবীর কিছু দেশ কীভাবে আরও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, প্রান্তীয় অঞ্চল প্রান্তিকই থেকে যায় — বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের বীজ এর মধ্যেই লুকিয়ে। গ্রাম তথা প্রান্তীয় অঞ্চলগুলি ক্রমেই হয়ে ওঠে শহরের ধনীদের সস্তায় শ্রমিক জোগানের কেন্দ্র মাত্র।
মার্কস দেখিয়েছেন, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ফলে উদ্ভূত লাভ আরও পুঁজির জন্ম দেয় যা আবার পরবর্তীকালে বিনিয়োগ করা হয়। ধ্রুপদী অর্থনীতির একটি মূল প্রশ্ন হল আদি বা প্রথম পুঁজিটি কোথা থেকে এল, যা উত্তরকালে পুঁজিকে ক্রমেই বাড়িয়ে তুলল। আমরা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ব্রিটেনে বারবার দেখেছি আদি পুঁজির পুঁজীভবন।
ব্রিটেনকে উদাহরন হিসাবে দেখা যাক। মার্কস দেখিয়েছেন আদি পুঁজির তিনটি ধারাবাহিক ক্রম আছে :
প্রথমত, চাষিদের কাছ থেকে জমির মালিকানা কেড়ে নেওয়া হয়, ফলত তারা কৃষি উৎপাদনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়,
দ্বিতীয়ত, বিপুল পরিমাণ স্বল্প মজুরির কৃষিশ্রমিকের সৃষ্টি হয় যার একটা বড়ো অংশ শহরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে পাড়ি দেয়,
তৃতীয়ত, কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি জমা হয়, যারা এই লভ্যাংশ শিল্পেই বিনিয়োগ করে, কারণ বিপুল পরিমাণ স্বল্প মজুরির শ্রমিকের জোগান তাদের করায়ত্ত।
ভূমিপুত্রদের জমি হারিয়ে শহরে আসার পরিবেশগত মূল্য বিপুল। সামন্ততন্ত্রে তারা অন্তত গ্রামে থেকে জমি চাষ করতে পারত, ধনতন্ত্রের উদ্ভব তাদের শহরের গরিব শ্রমিকে পরিণত করল। ব্রিটেনে ‘উচ্চফলনশীল’ চাষ শুরু হওয়াকে জার্মান রসায়নবিদ লিবেশ জমির ওপর ডাকাতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
মার্কস লিবেশ ও অন্যান্য কৃষি রসায়নবিদদের লেখা মন দিয়ে পড়েছিলেন। বুঝেছিলেন পুঁজিবাদের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বিশাল পরিমাণ বাণিজ্যিক ‘উচ্চফলনশীল’ চাষ এই ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এর জন্য প্রয়োজন উৎপাদন নিয়ন্ত্রন করার আইন। কিন্তু কেউ মাথা ঘামায়নি। উচ্চ ফলনশীল বাণিজ্যিক চাষ এবং আমদানি-রপ্তানির ব্যাপক প্রসারের ফলে মাটি ক্রমেই তার উর্বরতা হারাল এবং দূষণ এবং বর্জ্য বাড়তে লাগল।
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের সঙ্গে অনিবার্যভাবে শুরু হয় ব্যাপক লুণ্ঠন, দাসত্ব ও রক্তের স্রোত যা পুঁজি হয়ে জমা হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কোশাগারে। গরিব দেশগুলির প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে, তাদের পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে ব্যাপক সম্পদের অধিকারী হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। ভারত লবণ, আফিম, সুপারি ও অন্যান্য সম্পদের অফুরান খনি হিসাবে চিহ্নিত হয়, ক্যারিবিয়ান দেশগুলি কফি ও আখ চাষের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যদিও এগুলো কখনোই এসব দেশের স্বাভাবিক প্রকৃতির অংশ ছিল না।
ইউরোপে রপ্তানির জন্য ব্যাপক বাণিজ্যিক চাষ এবং প্রায়-ক্রীতদাস শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব অর্থনীতির ফল। এদুয়ার্দো গালিয়ানো দেখিয়েছেন লাতিন আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদ কীভাবে ইউরোপীয় দেশ- গুলির ভোগে লাগল। প্রাথমিকভাবে কিছু লাতিন অঞ্চলে সামান্য সমৃদ্ধি এসেছিল, কিন্তু শীঘ্রই শুরু হয় ক্ষয় — প্রাকৃতিক সম্পদের, জমির উর্বরা শক্তির, ইত্যাদির। ক্রমেই জেঁকে বসে অসাম্য, দারিদ্র্য, ধ্বংস হয়ে যায় স্থানীয় সংস্কৃতি।
নাইট্রেট-এর অভিশাপ থেকে তেলের অভিশাপ
ব্রিটিশরা তাদের উৎপাদিত বস্ত্রের বিনিময়ে শুধু ব্রাজিলের কফি, চিলির তামা, কিউবার চিনি নিত না, পেরুর গুয়ানো (সামুদ্রিক পাখির বর্জ্য, সার হিসেবে বহুল ব্যবহৃত) এবং নাইট্রেটও নিত। ১৮৪১ এ ফরাসি বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ক্রোশে গুয়ানোকে সার হিসাবে ব্যবহার করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার পরই ১৮৫০-এ আমরা দেখেছি পেরুর গুয়ানো সমৃদ্ধ একটি দ্বীপে নোঙর করেছে ৪৪টি আমেরিকান, ৪০টি ব্রিটিশ, ৫টি ফরাসী, ২টি ওলন্দাজ, একটি করে ইতালি, নরওয়ে, আর্মেনিয়া, বেলজিয়াম ও রাশিয়ার জাহাজ এবং ৩টি পেরুর জাহাজ — উদ্দেশ্য গুয়ানো সংগ্রহ। সংগ্রাহকদের নাক, চোখ, মুখ বিষাক্ত ধুলোয় ঢাকা — দুর্গন্ধে টেকা দায়। তাদের বেশিরভাগই চিনের কুলি, যাদের ধরে আনা হয়েছে প্রধানত হংকং আর ম্যাকাও থেকে। ১৮৭৫-এই দেখছি পেরুতে প্রায় আশি হাজার এই ধরনের কুলি প্রায় দাসত্ব করছেন।
ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকে পেরুর টারাপাকা মরু প্রদেশ এবং পার্শ্ববর্তী বলিভিয়ার আটাকামাতে খনি থেকে সহজে নাইট্রেট নিষ্কাশনের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। ফলে ষাটের দশক থেকেই নাইট্রেট ক্রমেই গুয়ানোর জায়গা নিতে থাকে, ইতিমধ্যে গুয়ানোর প্রাকৃতিক ভান্ডারেও টান পড়েছে। নাইট্রেট শুধুমাত্র সার হিসাবেই ব্যবহার হচ্ছে তা নয়, টিএনটি ইত্যাদি উচ্চ বিস্ফোরকেও কাঁচামাল হিসেবে প্রয়োজন হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ক্রমবর্ধমান যুদ্ধবিগ্রহের কারণে প্রাকৃতিক নাইট্রেট ভান্ডার কুক্ষিগত করতে চাইছে। ১৮৭৫ সালে পেরুর নাইট্রেট শিল্পে ব্রিটিশ পুঁজির পরিমাণ প্রায় দশ লক্ষ পাউন্ড।
পেরুর শাসকশ্রেণি গুয়ানো আর নাইট্রেট-এর ব্যবসায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে। কিন্তু পেরুর রেলপথ তৈরি ছাড়া এই সম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা পরিকাঠামো তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়নি। দেশের বাদবাকি জনতার কাছে নাইট্রেট অভিশাপ হিসাবেই গণ্য হয়। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা পেরুকে ঋণের জালে জড়িয়ে দেন। ঐ জাল থেকে বেরোনোর জন্য পেরু সরকার ১৮৭৫-এ ব্রিটিশদের দখলে থাকা টারাপাকায় নাইট্রেট খনি অঞ্চলগুলির সরকারিকরণ এবং গুয়ানো এবং নাইট্রেট উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
ফলত, চার বছরের মধ্যেই শুরু হয় প্যাসিফিক যুদ্ধ (যাকে নাইট্রেট যুদ্ধও বলা হয়) যখন বলিভিয়া চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের আটাকামা মরুভূমিতে চিলির নাইট্রেট ব্যবসায়ীদের ওপর কর বসায়। ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের সাহায্যে চিলি, পেরু ও বলিভিয়া আক্রমণ করে। ব্রিটিশ নৌশক্তি এবং ফরাসিদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাদের সাহায্যে চিলি আটাকামা এবং পেরুর টারাপাকা চিরকালের মতো দখল করে নেয়। যুদ্ধের আগে চিলিতে কোনো নাইট্রেট গুয়ানোর ভান্ডার ছিল না, কিন্তু ১৮৮৩ এর মধ্যেই চিলির হাতে পেরু এবং বলিভিয়ার সমস্ত নাইট্রেট খনি এবং উপকূলীয় গুয়ানো সমৃদ্ধ অঞ্চল চলে আসে। যুদ্ধের আগে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ পুঁজির পরিমাণ ছিল ১৩%, ১৮৯০-তে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০%।
রপ্তানির প্রধান দুই উপকরণ হারিয়ে পেরুর অর্থনীতি যুদ্ধের পরে ভেঙে পড়ে। পেরু ক্রমেই ব্রিটিশ পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, সরকারি রেল ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। যে ব্রিটিশরা চিলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের জমি ও প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করল, তারাই হয়ে উঠল পেরুর নিয়ন্ত্রক।
যুদ্ধের পরে নাইট্রেট সমৃদ্ধ সব অঞ্চল দখল করার পরবর্তী দশক গুলিতে নাইট্রেট অভিশাপ চিলির ওপর পড়ে। পুঁজিপতিদের স্বার্থে ইউরোপ এই নাইট্রেট ও গুয়ানো সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির উপর দখল ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চাইল। চিলির প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর স্বাভাবিকভাবেই তাদের কোনো রকম মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। ১৮৮৮-তে চিলির রাষ্ট্রপতি জোশ ম্যানুয়াল বালমাসিডা ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের হাত থেকে নাইট্রেট সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিকে চিলির সংস্থার কাছে হস্তান্তরকরনের চেষ্টা করেন এবং তিন বছরের মধ্যে চিলিতে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া হয়। বিরোধী বালমাসিডা সরাসরি ব্রিটিশদের কাছ থেকে অস্ত্র এবং অর্থ পান। ব্রিটিশ সংবাদপত্র বালমাসিডাকে (যেমন এখনও হয়) জঘন্য একনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে। পরাস্ত রাষ্ট্রপতি ১৮৯১-তে আত্মহত্যা করলে চিলির ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত তাঁর বৈদেশিক দপ্তরকে লেখেন যে, ব্রিটেনের বাণিজ্যিক স্বার্থবিরোধী এই রাষ্ট্রপতির পতনে তারা খুশি। গৃহযুদ্ধ শেষ হয়, চিলির সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ক্রমেই কমতে থাকে, ব্রিটিশ পুঁজির দখল বাড়তে থাকে।
১৮৯০-তে দেখা যাচ্ছে চিলির রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশ ব্রিটেনে যাচ্ছে, আমদানির অর্ধেক ব্রিটেন থেকে আসছে। চিলি ক্রমেই একান্তভাবে ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠতে থাকে। নাইট্রেটের ওপর ব্রিটিশদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ জার্মান পুঁজিপতিদের পছন্দ হয়নি, কারণ বিস্ফোরক তৈরির জন্য তাদেরও নাইট্রেট প্রয়োজন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে জার্মান বৈজ্ঞানিক ফ্রিশ হেবার বাতাসের নাইট্রোজেন থেকে নাইট্রেট উৎপাদনের উপায় আবিষ্কার করেন। ফলে চিলির নাইট্রেটের চাহিদা তলানিতে ঠেকে এবং অর্থনীতিতে চূড়ান্ত সংকট দেখা যায়।
কিন্তু নাইট্রেটের (তথা নাইট্রোজেনের) অভিশাপ এখানেই শেষ নয়। এই অভিশাপ ক্রমে সারা পৃথিবীতে, এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য নাইট্রোজেন সারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে (বর্তমানে প্রায় ১00 মিলিয়ন টন) দূষণ বেড়ে চলেছে, ভৌম জলস্তর নামছে — বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের এক প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লাতিন আমেরিকার বাইরে হয়তো নাইট্রেট সংকট লোকে ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাকৃতিক তেলের অভিশাপের ইতিহাস পালটায়নি। সমীক্ষা দেখাচ্ছে, যেসব উন্নয়নশীল দেশ তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল তারা মূলত স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং গৃহযুদ্ধে দীর্ণ। এই দেশগুলি তাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে ঠিকভাবে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে পারেনি। ধনী দেশগুলো এই উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রাকৃতিক সম্পদ নিজেদের দখলে রাখতে চেয়েছে। তেলে ধনী উন্নয়নশীল দেশগুলি সর্বদাই রাজনৈতিক অস্থিতি এবং দুর্নীতি সমস্যা সামলাতেই ব্যস্ত থেকেছে।
তেলের অভিশাপ তখন ধনী দেশগুলির অর্থনীতি এবং পরিবেশকেও আক্রমণ করেছে — বিশ্ব উষ্ণায়ন তখন বিশেষ কোনও দেশের সমস্যা নয়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদের কুফল বিশ্বের এক-এক অঞ্চলে এক-এক রকম। কিন্তু ফলস্বরূপ যে পরিবেশ দূষণ ঘটে — তার বিস্তার পৃথিবীব্যাপী কেউ বাদ নয়।
বাস্তুতান্ত্রিক ঋণ
বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীরা বাস্তুতান্ত্রিক ঋণের ধারণাকে জনপ্রিয় করেছেন। বাস্তুতান্ত্রিক ঋণ হল উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলি তৃতীয় বিশ্বের যে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে — তাঁকেই ঋণ হিসাবে গণনা করা। এর মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের জমির উর্বরা শক্তি ছিনিয়ে নেওয়া ও তাদেরকে শিল্পজাত বর্জ্যর আস্তাকুঁড় হিসেবে গণ্য করার বিষয়টিকেও ধরতে হবে। বাস্তুতান্ত্রিক ঋণের ধারণা পরিবেশ সমস্যা সমাধানের অন্বেষণকে এক নতুন দিগন্ত দেখিয়েছে। বাস্তুতান্ত্রিক ঋণ নানাভাবে বাড়তে থাকছে — লোকায়ত সংস্কৃতি ও জ্ঞানভান্ডার ধ্বংস, জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি, সাগর ও নদীর দূষণ, অপরিকল্পিত কারখানা, ক্ষতিকর রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ প্রভৃতি। এই ঋণ মূল্যায়ন করার সময়ে দুটো বিষয় মাথায় রাখতে হবে —
১. বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের ফলে যে সামাজিক পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে তার মূল্যায়ন এবং
২. বিশ্বজনীন ব্যবহার্য বস্তু যেমন সাগর, বায়ুমণ্ডল ইত্যাদির ধনী দেশগুলির অতিরিক্ত অসম ব্যবহার ও ক্ষতিসাধন।
বাস্তুতান্ত্রিক ঋণের মাধ্যমে বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের ক্ষতিসাধনকে মূল্যায়নে প্রধানত কার্বন ডাই অক্সাইডকেই মাপা হয়, কারণ সবটা সঠিকভাবে মাপা অসম্ভব। ধনী দেশগুলির অধিকতর কলকারখানা, যানবাহনে, সর্বোপরি কর্মজীবনযাত্রার কারণে কার্বন নিঃসরণ করে অনেক বেশি এবং তারাই মূলত আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য দায়ী। উন্নত দেশের প্রযুক্তি প্রাকৃতিক তেলের উপর বেশি নির্ভরশীল, ফলে তাদের নিঃসরণের পরিমাণ প্রাকৃতিক ভাবে এই নিঃসরণকে শুষে নেওয়ার ক্ষমতার থেকে অনেক বেশি। ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) হিসাবে এই শতকে বিশ্বের উষ্ণতা ১.৫° থেকে ৬.০° সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়বে। উষ্ণতা ৪° বাড়লে পৃথিবীর উষ্ণতা গত চার কোটি বছরের রেকর্ড ভাঙবে। মানব সভ্যতা খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াবে। ঘন ঘন সাইক্লোন, বন্যা, খরা যা গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত গ্রিন হাউজ গ্যাস। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জল স্তর বাড়ছে, ফলে অনেক দ্বীপ এমনকি বাংলাদেশ পর্যন্ত ডুবে যেতে পারে।
যেহেতু বায়ুমণ্ডল বা মহাসাগর কোনও দেশের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তাই যেসব দেশ এগুলির বেশি ক্ষতি করছে, তাদের কার্বন ঋণের পরিমাণও বেশি। এই ঋণ শোধ করার দায় তাদেরই। নিঃসরণের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন এই সব দেশের।
নিসঃরণের মাত্রা নির্দিষ্ট করার জন্য অনেক বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন। ১৯৯৬-তে ৭ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণের অর্ধেকের বেশি নিঃসরণের জন্য দায়ী ইউরোপ ও আমেরিকা। পরিবেশ যতটা কার্বন হজম করতে পারে, নিঃসরণের মাত্রা তার থেকে অনেক বেশি। আইপিসিসি হিসাব করেছে ১৯৯০-এর তুলনায় কার্বন নিঃসরণের ৬০% কমলে বিশ্ব উষ্ণায়নে লাগাম পরানো সম্ভব হবে।
সুতরাং ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলি, যাদের কার্বন নিঃসরণ গোটা পৃথিবীর অনুমোদনযোগ্য নিঃসরণের থেকে বেশি — নৈতিকভাবে তাদের কার্বন নিঃসরণ সীমাবদ্ধ করা উচিত। এন্ড্রু সিম ও তাঁর সহকর্মীরা ১৯৯০-তে হিসাব করে দেখিয়েছেন মাথাপিছু বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ ০.৪ টন হলে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু সময় যত পেরিয়েছে, বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বাড়তেই থেকেছে। এখন দেখা যাচ্ছে মাথাপিছু বার্ষিক ০.২ টনের বেশি নিঃসরণ আর করা চলবে না। তা না হলে বিশ্বের উষ্ণায়ন শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
উন্নত দেশের মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণকে যদি আমরা ডলারের মূল্য বিচার করি, তাহলে হিসাব বলছে গরিব দেশেরা ধনী দেশের থেকে বার্ষিক ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার পরিবেশ দূষণের কারণে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। আগে ঘটে যাওয়া দূষণ এই ক্ষতিপূরণের মূল্যে ধরাই হয়নি। এই টাকা দিয়ে গরিব দেশ ঋণমুক্ত তো হতেই পারে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমাতেও পারে।
তবে সমস্যাটা ঠিক প্রযুক্তি বা ঋণের নয়। উন্নত দেশগুলিকে কার্বন ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ আইপিসিসির সুপারিশ মতো কমিয়ে আনতে হবে এবং গরিব দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নিঃসরণ কিছুটা বাড়াতে দিতে হবে। সারা পৃথিবীতে ধনী-দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে জনপ্রতি নিঃসরণের হার একই জায়গায় আনতে হবে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করার চেষ্টা না হলে পরিবেশ দূষণের উপর লাগাম টানা অসম্ভব। কিন্তু ধনতন্ত্র যেন ঠিক করেছে, সে আত্মহত্যা করবেই — একদিকে চূড়ান্ত অসাম্য ও শোষণ ও অন্যদিকে অপার লোভ ও ভোগ — পৃথিবীকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংসকে রোধ করাই বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ।
বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
কিয়োটো প্রোটোকল থেকে আমেরিকার বেরিয়ে যাওয়াই বুঝিয়ে দেয় বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা কত কঠিন। পরিবেশ কর্মীরা পরিবেশ ঋণের ধারণাকে কেন্দ্রে রেখে তাঁদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সংগ্রাম চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে বাস্তুতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই সাম্রাজ্যবাদ পরিবেশ ধ্বংসের জঘন্যতম রূপ যা পৃথিবীর ভারসাম্যকে এক বিপজ্জনক পথে নিয়ে চলেছে। বিপ্লবাত্মক সামাজিক পরিবর্তনই একমাত্র এই ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে। ধনতন্ত্র উৎখাতের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।