ভারতবর্ষে পরিবেশ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত

তরুণ মণ্ডল 

আমাদের শারীরিক অবস্থা কেমন তা বোঝার জন্য ডাক্তারবাবুরা নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন : রক্ত পরীক্ষা, রক্ত চাপ, এক্স রে, এম আর আই, স্ক্যান ইত্যাদি। তেমনি পরিবেশের অবস্থা কেমন, বসবাসের কতটা উপযোগী তা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা ৯টি সূচক (planetary boundary) চিহ্নিত করেছেন: বিশ্ব উষ্ণায়ন, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সারের প্রয়োগ, জমির ব্যবহার, পরিস্রুত জলের ব্যবহার, ওজোন স্তরের ক্ষয়, এরোসল (বাতাসে নানাবিধ কণা), সমুদ্র জলের অম্লত্ব, রাসায়নিক দূষণ। এগুলোর মধ্যে ৭টির বিপদ সীমাও নির্ধারিত হয়েছে। এই ৭টি সূচকের বর্তমান মাত্রা পরিমাপ করে দেখা গেছে তিনটির ক্ষেত্রে (উপরের তালিকার প্রথম তিনটি) বিপদসীমা অতিক্রান্ত হয়েছে, বাকিগুলির অবস্থা বিপদসীমার বেশি দূরে নয়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন যে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন ২০৩০ (sustainable development goal) সালের মধ্যে বলিষ্ঠ ব্যবস্থা না নিলে আমরা ষষ্ঠ গণ-অবলুপ্তির (কোনও প্রজাতির ৭৫ শতাংশের অবলুপ্তি ঘটলে তাকে গণঅবলুপ্তি বলে ধরা হয়ে থাকে) সম্মুখীন হব। ফলে পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন আজ বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছে। 

আমাদের দেশে পরিবেশ চেতনার ইতিহাস সুপ্রাচীন (সম্রাট অশোকের শিলালিপি দ্রষ্টব্য), কিন্তু পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা তিনশো বছর আগে।আধুনিক আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনের সূত্রপাত পাশ্চাত্যে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকায় ৩১ মাস এক নম্বরে থাকা রেচেল কার্সন রচিত যুগান্তকারী বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে (২৪ টি দেশে সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হয়, কর্পোরেট বোর্ড রুম, সরকারি দপ্তর, সায়েন্টিফিক জার্নাল, মিডিয়ায় তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়)। অবশ্য পরিবেশ সংক্রান্ত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার সূচনা হয়েছিল শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকেই। শিল্প বিপ্লব কেবল শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ কোনও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। কাঁচা মালের জন্য কৃষি ক্ষেত্র, জঙ্গলে ব্যাপক অভিযানের জন্য পরিবেশের উপর গুরুতর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’ জাতীয় মনোভাব থেকে আসে শিল্পায়ন বিরোধী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া (back to the land)। শিল্প বিরোধী এই মনোভাবের পরিবর্তন হয়ে পরবর্তী ধাপে (ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে) নিয়ন্ত্রিত শিল্প উৎপাদন ও পরিবেশের বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণের (scientific conservation) দাবি ওঠে। 

পরিবেশবাদের (environmentalism) এই ভাবনার ওলট পালট হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায়। যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন পর্বে শুরু হয় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। উন্নয়নশীল দেশগুলিও এতে শামিল হয়। ধরে নেওয়া হয় প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার অফুরন্ত। পরিবেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনাকে উন্নয়ন বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়। তাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুটি দশককে চিহ্নিত করা হয় ‘এজ অফ ইকোলজিক্যাল ইনোসেন্স’ (age of ecological innocence) বলে। ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এ রাসায়নিক দূষণের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষ রাস্তায় নামে, আদর্শবোধ সক্রিয়তায় রূপান্তরিত হয়। বসুন্ধরা দিবস (Earth Day)-এর সূচনা হয় ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল। ঐ দিন আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সংগঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিলে প্রায় দু কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করে। ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে দেশে দেশে পরিবেশ রক্ষায় নানা আইন কানুন তৈরি হয় ও ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এই সময় কালের বৈশিষ্ট্য হল ‘ইকোলজি ফর কেয়ার এণ্ড কনসার্ন’ (ecology for care and concern)। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে ধনতান্ত্রিক দেশগুলির সরকার উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে। পরিবেশ সংক্রান্ত আইন কানুন বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করে প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছ ব্যবহার করে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে মুনাফা করাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই, আজকের দিনের বৈশিষ্ট্য হল ‘ইকোলজি অফ অ্যারোগেন্স’ (ecology of arrogance)।

পাশ্চাত্যের পরিবেশ আন্দোলন গড়ে ওঠে সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিপন্ন প্রাণী/ উদ্ভিদ এবং প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষার তাগিদ থেকে। ভারতবর্ষের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে ওঠে দুর্বল শ্রেণির বাঁচার তাগিদে, সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে। পাহাড়ি বনাঞ্চল রক্ষার জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের, জঙ্গল রক্ষার জন্য আদিবাসীদের আন্দোলন, বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন — এসব আমাদের দেশের ভিন্ন প্রকৃতির পরিবেশ আন্দোলনের উদাহরণ। পাশ্চাত্যে পরিবেশ আন্দোলনের প্রণোদনা এসেছে রেচেল কার্সন-এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বা ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ বই থেকে। কিন্তু ভারতে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠেছে গরিব মানুষের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকে।

পরিবেশ আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা : বিভিন্ন ধারা বলতে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই অনুযায়ী আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ। আবার বিভিন্ন ধারা বলতে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন বোঝায়। অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে দুটি পক্ষ থাকে যাদের মধ্যেকার বিভাজন রেখা স্পষ্ট : হ্যাভনট-রা (Havenots) হ্যাভস (Haves)-দের কাছে কিছু পেতে চায় বলে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। পরিবেশ আন্দোলনে বিভাজন রেখা অস্পষ্ট। যেমন, পরিবেশ দূষণের যে সমস্যা, তার শিকার সাধারণভাবে সমাজের সবাই। তাই, অনেকে মনে করেন এই আন্দোলন সমগ্র মানবসমাজের বিরুদ্ধে মানবসমাজের আন্দোলন। আবার অন্য অংশের মতে, পরিবেশ দূষণের শিকার সবাই হলেও এর দায় বর্তমান সমাজব্যবস্থা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার যারা কর্ণধার তাদের। আজকের দিনে বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ করতে ব্যর্থতার মূলে আছে দায় নিয়ে বিরোধ, যার সূচনা ১৯৯২ সালে রিও বসুন্ধরা সম্মেলনে Common But Differentiated Responsibility (CBDR) নীতিকে কেন্দ্র করে। উন্নত দেশগুলি (Annex I country) গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার মূল দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। এ বিরোধ এখনও চলছে। 

উন্নত দেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি বড়ো পার্থক্য উন্নয়নের প্রশ্নে। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে প্রথম আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বলেন : ‘Poverty is the worst pollutant’। দরিদ্র মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য পরিবেশের উপর প্রত্যক্ষভাবে অনেক বেশি নির্ভরশীল, ফলে দূষণ ঘটে অনেক বেশি। যেমন, জ্বালানির জন্য কাঠের ব্যবহার বেশি করে, ফলে দূষণ বেশি হয়, বিশ্ব উষ্ণায়ন বেশি ঘটে। দরিদ্র দেশে দারিদ্র্যই  যদি পরিবেশ দূষণের মূল কারণ হয় তাহলে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যও দূর হবে, পাশাপাশি পরিবেশের সমস্যাও মিটবে বলে আশা করা হয় । 

এখানে আমাদের দেশের কয়েকটি বড়ো পরিবেশ আন্দোলনের আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে।

বিষ্ণোয়ী আন্দোলন (Bishnoy Movement) : ভারতবর্ষের প্রথম পরিবেশ আন্দোলন বিষ্ণোয়ী আন্দোলন (Bishnoy Movement) সংগঠিত হয় রাজস্থানের মাড়োয়ার অঞ্চলের খেজারলিতে। গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে ৮৪টি গ্রামের বিষ্ণোয়ীরা শামিল হয়। বিষ্ণোয়ীরা হল রাজস্থানের পশ্চিম থর মরুভূমি এবং উত্তর ভারতে বসবাসকারী প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের সম্প্রদায় যারা গুরু মহারাজ জম্বেশ্বরজির মতবাদ ও নীতি মেনে চলে। গুরু জম্বেশ্বরজি ২৯টি নীতি ঠিক করেন (১৪৮৫)। যারা এটা মেনে চলে তাদের বলে বিষ্ণোয়ী (২০ অর্থাৎ বিশ, ৯ অর্থাৎ নয়, দুয়ে মিলে বিষ্ণোয়ী)। এই নীতিগুলির মধ্যে ৬টি হল প্রকৃতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত। বিষ্ণোয়ীরা গাছ কাটে না (কাঠের জন্য মৃত গাছ সংগ্রহ করে, জ্বালানির জন্য গাছ না কেটে গোবর ব্যবহার করে), কোনও প্রকার জীব জন্তু হত্যা করে না।

বিষ্ণোয়ী আন্দোলন সংগঠিত হয় অষ্টাদশ শতকে। যোধপুরের রাজা অভয় সিং ১৭৩০ সালে নতুন প্রাসাদ নির্মাণের জন্য কাঠের প্রয়োজনে (চুনাপাথর পুড়িয়ে চুন তৈরি করার জন্য কাঠের প্রয়োজন হয়) খেজারলি গ্রামের গাছ কাটার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দেন। গাছ কাটতে গেলে অমৃতা দেবী গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছ কাটায় বাধা দেন। সৈন্যরা অমৃতা দেবীর মাথা কেটে দেয়। মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তিন কন্যাও গাছ জড়িয়ে ধরে বাধা দিতে থাকে। সৈন্যরা তাদের মাথাও কেটে নেয়। ভয়ংকর এই ঘটনার পর অন্যান্য গ্রামের বিষ্ণোয়ীরা প্রতিরোধে শামিল হয়। ৩৬৩ জন বিষ্ণোয়ী সৈন্যদের হাতে প্রাণ ত্যাগ করে। 

অবশেষে রাজার কাছে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পৌঁছানোর পর রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বিষ্ণোয়ী সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিষ্ণোয়ী এলাকায় গাছ কাটা এবং বন্যপ্রাণী হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। শহিদ বিষ্ণোয়ীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রচুর খেজরি গাছ বসানো হয়। এখনও এই জঙ্গল দেখা যায়। বিষ্ণোয়ী আন্দোলনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। স্বাধীন ভারতের ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলন, যে আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য গাছকে জড়িয়ে ধরে প্রতিরোধ, তার প্রেরণা ছিল বিষ্ণোয়ী আন্দোলন। অমৃতা দেবীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারত সরকার ‘অমৃতা দেবী বিষ্ণোয়ী স্মৃতি পরিবেশ পুরস্কার’ প্রবর্তন করে। 

প্রকৃতির উপর আক্রমণ প্রতিরোধে বিষ্ণোয়ীরা আজও সক্রিয়। বিষ্ণোয়ীরা না থাকলে কালো হরিণ, চিংকারা প্রভৃতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীরা এতদিনে অবলুপ্ত হয়ে যেত। বেআইনি শিকারের ব্যাপারে এরা খুব কঠোর, কাউকে রেয়াত করে না, সলমন খান, মনসুর আলি খান (পতৌদি) কাউকে না।

চিপকো আন্দোলন : ১৯৭০-এর দশকে বনাঞ্চল ধ্বংসের বিরুদ্ধে গোটা দেশে সংগঠিত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। যুগান্তকারী এই আন্দোলন দেশে বিদেশে চিপকো আন্দোলন নামে খ্যাত। হিন্দি শব্দ ‘চিপকো’-র অর্থ হল জাপটে ধরা বা আলিঙ্গন করে ধরে রাখা। দক্ষিণ ভারতে এই আন্দোলন ভিন্ন নামে খ্যাত। যেমন, ‘অপিক্কো’ আন্দোলন (‘চিপকো’-র সমার্থক কন্নর শব্দ হলো ‘অপিক্কো’)। আসলে চিপকো আন্দোলন হল বিষ্ণোয় আন্দোলনের পরিবর্ধিত রূপ। 

পটভূমি : বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে সংঘটিত ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে উত্তর প্রদেশের হিমালয় অঞ্চলে প্রচুর রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়। সংঘর্ষ পরবর্তী কালে এই পরিকাঠামো আকৃষ্ট করে দেশি বিদেশি কাঠের ব্যবসায়ীদের। দীর্ঘদিন ধরে যাদের নজর ছিল পার্বত্য বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছের দিকে। সরকারি অনুমোদন নিয়ে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিকভাবে গাছ কাটা শুরু করে। অথচ স্থানীয় অধিবাসী যারা জীবন জীবিকার প্রয়োজনে (খাদ্য, জ্বালানি প্রভৃতি) বনাঞ্চলের উপর ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরশীল (এঁরা নিয়ন্ত্রিত ভাবে গাছ কাটে ফলে নিজেদের প্রয়োজন মেটে অথচ বনাঞ্চল রক্ষা পায়)  তাদের ন্যূনতম অধিকার দিতে সরকার অস্বীকার করে। পরিবেশবিদ ও গান্ধিবাদী সমাজকর্মী চণ্ডীপ্রসাদ ভাট ১৯৬৪ সালে দাসোলি গ্রাম স্বরাজ্য সংঘ (পরবর্তী কালে নাম হয় দাসোলি গ্রাম স্বরাজ্য মণ্ডল, DGSM) নামে একটি সমবায়  গড়ে তোলেন যাতে স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগিয়ে গ্রামবাসীরা ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সরকার ছোটো খাটো গাছ কাটার অনুমতি দিতেও অস্বীকার করে। 

১৯৭০ সালে এই এলাকায় বন্যা হয় যা ভয়াবহ আকার নেয়। কারণ বাণিজ্যিক কারণে বড়ো বড়ো গাছ কাটার ফলে অস্বাভাবিক মাত্রায় ভূমিক্ষয় হয়। প্রায় ২০০ গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। সমবায় সংগঠনকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক বৃক্ষচ্ছেদনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত হতে থাকে। এই পটভূমিকায় ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে প্রথম চিপকো আন্দোলন সংগঠিত হয় অলকানন্দা উপত্যকায়। চণ্ডীপ্রসাদ ভাটের নেতৃত্বে গ্রামের মানুষ গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সরকার বড়ো বড়ো কোম্পানির গাছ কাটার পারমিট বাতিল করে গ্রামবাসীদের আবেদন পত্র মঞ্জুর করতে বাধ্য হয়। আন্দোলনের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে মণ্ডল সমবায়ের কর্মীরা পরিবেশবিদ সুন্দর লাল বহুগুণার নেতৃত্বে পাশ্ববর্তী এলাকায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়। সরকার অলকানন্দা উপত্যকায় ১০ বছরের জন্য বাণিজ্যিক গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য হয়। ১৯৭৯ সালের মধ্যে ১৫০টি গ্রামে চিপকো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বহুগুণার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি উত্তরাখণ্ড হিমালয়ে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই নিষেধাজ্ঞা হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়।

চিপকো আন্দোলনে গাছ জড়িয়ে ধরে প্রতিরোধ ছাড়াও আন্দোলনের অন্যান্য ধরন যুক্ত হয়। বহুগুণা, নেগি প্রমুখ গান্ধিবাদী নেতারা অনশন সত্যাগ্রহ করেন।১৯৮১ থেকে ১৯৮৩-র মধ্যে বহুগুণা হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে ৫ হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা করেন। গাছ রক্ষার আন্দোলন হিমালয় বাঁচাও (Save Himalayas) আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন দক্ষিণ ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে। বহুমুখী পরিবেশ আন্দোলন — ভাগীরথী নদীর উপর তেহরি বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে, বহু খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে, সামাজিক বনসৃজন প্রভৃতি যে আন্দোলনের তরঙ্গ আশির দশক জুড়ে সংগঠিত হয় তার ক্ষেত্রে চিপকো আন্দোলনের প্রভাব অপরিসীম।

সাইলেন্ট ভ্যালি মুভমেন্ট (Silent Valley Movement) : কেরালার পালাক্কাড জেলায় পশ্চিমঘাট পর্বতের সাইলেন্ট ভ্যালিতে [শব্দ সৃষ্টিকারী উচ্চিংড়ে (cicada) জাতীয় পতঙ্গের অনুপস্থিতি জন্য পরিবেশের নিস্তব্ধতার কারণে ইংরেজরা এই উপত্যকা নাম দেয় সাইলেন্ট ভ্যালি (১৮৪৭)] জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিরুদ্ধে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তা সাইলেন্ট ভ্যালি মুভমেন্ট নামে পরিচিত। নিম্নবর্ণিত ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন জয়যুক্ত হয় এবং প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।

১৯৭০: কেরালা রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ সাইলেন্ট ভ্যালির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কুন্তিপুজা নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প তৈরি করে (Silent Valley Hydroelectric Project)। উদ্দেশ্য — ৪ টি পাওয়ার প্ল্যান্ট (প্রতিটি ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন) তৈরি করা। বলা হয়, বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জমিতে সেচের জল দেওয়া যাবে এবং নির্মাণ কালে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে রাজ্যের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।

১৯৭১৭২: প্রকল্প রূপায়িত হলে জীববৈচিত্র্য এবং বিরল প্রজাতি সমৃদ্ধ সাইলেন্ট ভ্যালির পরিবেশ বিপন্ন হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

১৯৭৬: কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত টাস্কফোর্স প্রকল্প বাতিল করার সুপারিশ করলেও মন্তব্য করল যে বাতিল করা একান্তই অসুবিধাজনক হলে প্রকল্প রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে পরিবেশের স্বার্থে বেশ কিছু রক্ষা কবচ রাখতে হবে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজ্য সরকার প্রকল্প রূপায়ণ করতে উদ্যোগী হল। 

বিভিন্ন স্বচ্ছেসেবী সংস্থা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রকল্প বাতিলের দাবি জানাল। পরিবেশবিদদের মূল্যায়ন ছিল : নিম্ন অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে। বাস্তুতন্ত্রের ১০ শতাংশ মাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও বাস্তবে হবে অনেক বেশি (সমস্ত প্রকার রক্ষা কবচ নিলেও)। নির্মাণ কর্মীরা কয়েক বছর ধরে বসবাস করার কারণে পরিবেশের সাংঘাতিক ক্ষতি হবে।

১৯৭৭: পরিবেশবিদ সহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি — সালিম আলি, মাধব গ্যাডগিল, সি ভি রাধাকৃষ্ণন, এম এস স্বামীনাথন, সুব্রহ্মনিয়ম স্বামী, সীতারাম কেশরী, পিলু মোদী, কৃষ্ণকান্ত — কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন প্রকল্পের অনুমোদন না দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান— বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার এণ্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (IUCN) — সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণার দাবি জানায়। প্রতিবাদ সংগঠিত করার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নেচার ক্লাব তৈরি হয়। কিন্তু এতসব আবেদন নিবেদন দাবি উপেক্ষা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই প্রকল্প রূপায়ণের সবুজ সংকেত দেন।

১৯৭৯: রাজ্য সরকার প্রকল্প রূপায়ণ শুরু করে। ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করে কেরালার জনবিজ্ঞান সংগঠন কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ (KSSP)। সংগঠনের পক্ষ থেকে সমীক্ষা করে দেখানো হয় শক্তি চাহিদা পূরণের যে ছবি তুলে ধরা হচ্ছে তা বাস্তবোচিত নয় : ১৯৯০-৯১ সাল নাগাদ কেরালার বিদ্যুতের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ৭,৭০০ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা যার মধ্যে এই প্রকল্পের অংশ হবে মাত্র ৫২২ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা (৭%)।

১৯৮৩: প্রতিবাদ এবং গণআন্দোলনের চাপে সাইলেন্ট ভ্যালি হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট বাতিল ঘোষণা করা হয়।

১৯৮৫: সাইলেন্ট ভ্যালিকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি এর উদ্বোধন করেন।

বিষ্ণোয়ী ও চিপকো আন্দোলন — শুরু থেকেই ছিল সাধারণ মানুষের আন্দোলন। কিন্তু সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন ছিল সে তুলনায় অনেক জটিল কারণ এক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত ছিল। প্রতিবাদ শুরু করেন পরিবেশবিদ, প্রকৃতিবিদরা, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের পাশাপাশি সংবাদপত্রগুলি এমনভাবে উন্নয়নের বিষয়গুলি (উত্তর কেরালার বিদ্যুৎ সংকটের একমাত্র সমাধান, সেচ সম্প্রসারণ, কর্ম সংস্থান) তুলে ধরে যে বিষয়টি দাঁড়িয়ে যায় ‘উন্নয়ন বনাম পরিবেশ’। যেন, পরিবেশপ্রেমীরা উন্নয়নের তথা সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার বিরোধিতা করছে। প্রকল্প বাতিলের দিন পর্যন্ত বিতর্কের জের থাকে, সাধারণ মানুষের একটি অংশ এই আন্দোলন থেকে দূরে থেকে যায়। ১৯৮৩ সালে ত্রিবান্দমে (তিরুবনন্তপুরম) অনুষ্ঠিত জনবিজ্ঞান আন্দোলনের দ্বিতীয় সারা ভারত কনভেনশনে এই পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়। প্রকৃতির নিয়ম কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা মানুষের আগের থেকে অনেক বেশি এবং এই পরিবর্তনের আশু ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কে মানুষ অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। কিন্তু এইসব কেতাবি জ্ঞান (academic knowledge)-ই যথেষ্ট নয়, আর্থ-সামাজিক বিষয় সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। কেতাবি জ্ঞানের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার (real life experience) তফাত প্রতিফলিত হয় সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলনের সময় কেরালার চেলিয়ার নদীর দূষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে। চেলিয়ার আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থে জনগণের আন্দোলন। কারখানার বর্জ্যের কারণে জলের দূষণের ফলে পানীয় জল, স্নানের ও সেচের জলের সংকট, চিমনির ধোঁয়ায় বাতাসের দূষণের জন্য শ্বাস প্রশ্বাসের রোগ, ফসলের ক্ষতি এসবই মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিল। কিন্তু সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলনে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে অংশগ্রহণের সুযোগ সাধারণ মানুষের ছিল না। সাধারণ মানুষ নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয়, অন্য জায়গার অভিজ্ঞতা প্রসূত কেতাবি জ্ঞান দ্বারা তার চেতনাকে প্রভাবিত করা অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাধ্য প্রক্রিয়া। এখানে জনবিজ্ঞান সংগঠনের একটি বিরাট ভূমিকা আছে। 

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন (NBA) : মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৪৫০ কিমি দৈর্ঘের নর্মদা নদী দেশের পঞ্চম বৃহত্তম নদী। এর জল এবং জলশক্তি ব্যবহার করে সেচ, পানীয় জল ও বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত নর্মদা উপত্যকা উন্নয়ন পরিকল্পনা (Narmada Valley Development Plan)-র সূচনা ১৯৪৬ সালে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসে সর্দার সরোবর বাঁধ নির্মাণের ভাবনা। ২০০ বছরের পরাধীনতার পর স্বাধীন ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বড়ো বড়ো প্রকল্প (mega project) ভিত্তিক পরিকল্পনার উপর নেহরু সরকার গুরুত্ব আরোপ করে। জওহর লাল নেহরু ১৯৬১ সালে সর্দার সরোবর প্রোজেক্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যদিও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নানাবিধ কারণে প্রকল্প রূপায়ণের কাজ স্থগিত থাকে। ২৬ বছর পর ১৯৮৭ সালে পরিবেশগত ছাড়পত্র মেলে।

৩০টি বড়ো, ১৩৫টি মাঝারি ও ৩০০০টি ছোটো বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা সম্বলিত নর্মদা ভ্যালি ডেভলপমেন্ট প্রোজেক্ট পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলপ্রকল্প, যার অংশ হল দুটি মেগা ড্যাম — সর্দার সরোবর বাঁধ এবং নর্মদা সাগর বাঁধ। নর্মদা প্রকল্পের ইতিবাচক দিক হিসাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ৩৮,৪০০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে, ২,৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। কিন্তু এই বক্তব্য এক বড়ো অংশের পরিবেশবাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। তাঁরা মনে করেন প্রকল্প রূপায়িত হলে রিজার্ভারের জন্য ৩৭,০০০ হেক্টর এবং সেচ সম্প্রসারণের জন্য খাল কাটার প্রয়োজনে আরও ৮০,০০০ হেক্টর জমি জলমগ্ন হবে, ২৪৫টি গ্রামের প্রায় ১ লক্ষের মতো মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কর্মহারা ও বাস্তুচ্যুত হবেন এবং আরও ১,৪০,০০০ মানুষ সেচখালের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, ৫৪ হাজার হেক্টরের মতো জমির উপর বনভূমির আচ্ছাদন বিনষ্ট হবে।

পরিবেশবিদদের সতর্কবাণী সত্ত্বেও সরকার প্রকল্প রূপায়ণের পদক্ষেপ নিলে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বেশ কিছু সংস্থা মিলে একটি সাধারণ বৃহৎ সংগঠন গড়ে তোলে যার নাম দেওয়া হয় ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’ (NBA)। আন্দোলন শুরু হয়। মেধা পটেকর তাঁর পিএইচডি গবেষণার কাজ ছেড়ে দিয়ে বাবা আমতেকে সঙ্গে নিয়ে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। মেধা পটেকর বিভিন্ন সময় অনশন করেন। আসলে বড়ো নদী প্রকল্প যেখানে হয় আর প্রকল্পের সুফল যেখানে পৌঁছায় — এই দুই স্থানের মধ্যে প্রায়শই বিস্তর দূরত্ব থাকে। ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে উপকৃতদের বিরোধ এমন রূপ নেয় যাতে মনে হয় প্রকল্পস্থলের লোকজন উন্নয়নের পথে বাধা।

সর্দার সরোবর বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে, উদ্বোধন হয় ২০১৭ সালে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম (ব্যবহৃত কংক্রিটের আয়তনের বিচারে) বাঁধের উচ্চতা ১৩৮.৬৮ মিটার, দৈর্ঘ্য ১২১০ মিটার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৫০ মেগাওয়াট। ইন্দিরা সরোবর বাঁধ (নর্মদা সরোবর ড্যাম)-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় ১৯৮৪ সালে, উদ্বোধন হয় ২০০৫ সালে। ভারতবর্ষের বৃহত্তম বাঁধ (জলধারণ ক্ষমতার বিচারে) -এর উচ্চতা ৯২ মিটার, দৈর্ঘ্য ৬৫৩ মিটার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১০০০ মেগাওয়াট।

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ আটকাতে না পারলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন, বিকল্প জীবিকার বিষয়গুলি গোটা দেশের সামনে তুলে ধরতে এবং কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করাতে অনেকাংশে সফল হয়।

বড়ো বাঁধ নিয়ে নীতিগত বিতর্কের পাশাপাশি আছে প্রায়োগিক ও পদ্ধতিগত বিতর্ক অর্থাৎ, ভুলভাবে পরিকল্পনা করা, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করা, স্বচ্ছতার সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে না নিয়ে কাজ করা ইত্যাদি। ফলে যেকোনও সমালোচনাই বাঁধ বিরোধিতা বলে চিহ্নিত হয়। যেমন, নর্মদা বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবিতে, গোটা বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া হওয়াতে ছাড়পত্র, শর্ত আরোপ, শর্ত ভঙ্গ, কমিটির পর কমিটি, ছাড়পত্রের আগেই ঋণ মঞ্জুর ইত্যাদি বিষয়গুলি জনসমক্ষে আসতে থাকে। 

সাধারণ ভাবে বাঁধ নির্মাণের পক্ষের ও বিপক্ষের বক্তব্য নিম্নরূপ :

বিরোধীদের বক্তব্য : ক) প্রচুর খরচ, লাভ অনেক কম (অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুন সাগর প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯১ কোটি টাকা, বাস্তবে হয়ে দাঁড়ায় ৮৪৪ কোটি টাকা)।  খ) যত জমিতে সেচের জল পাবে বলে দেখানো হয় বাস্তবে তার অর্ধেকও পায় না। গ) বাঁধের আয়ু (life span) বাড়িয়ে দেখানো হয়। ঘ) প্রচুর জমি জলমগ্ন হয়, অসংখ্য পরিবার বাস্তুচ্যুত হয় (গুজরাতের কেভারিয়ায় সর্দার সরোবর বাঁধের জলভান্ডারটি ২১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা মহারাষ্ট্রের ৩৩, গুজরাটের ১৯ আর মধ্যপ্রদেশের ১৯৩টি গ্রাম ডুবিয়েছে। এর মধ্যে ১০০ -র বেশি পার্বত্য আদিবাসী গ্রাম)। উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হয় না, অনেক সময় কাগজপত্র ঠিক মতো না থাকার কারণে পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত হয়। ঙ) বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে অন্যত্র গাছ বসানো হলেও বৃক্ষ আচ্ছাদন (tree cover) তৈরি হয়, বনাঞ্চল তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, একই ধরনের গাছ বসানোর (monoculture) ফলে আরও সম্ভব নয়, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়।  চ) বাঁধ থেকে নির্গত জলস্রোত পরিষ্কার, এতে পলি থাকে না, ফলে নিম্ন অববাহিকার জমি পলিমাটি থেকে বঞ্চিত হয়ে উর্বরতা শক্তি হারায়। মোহনা অঞ্চলে সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে ভূমিক্ষয় জনিত ক্ষতিপূরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

পক্ষের বক্তব্য : ক) বাঁধ নির্মাণের জন্য যতটা বনাঞ্চলের ক্ষতি হয় তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হয় অন্যান্য কারণে। খ) বড়ো বাঁধের বদলে ছোটো ছোটো বাঁধ তৈরি করতে অনেক বেশি জায়গা লাগে। গ) ভূগর্ভস্থ জলের তুলনায় নদীর জল ব্যবহারের প্রকল্প অনেক বেশি পরিবেশ বান্ধব। ঘ) বড়ো বাঁধে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের যে মাত্রায় সুযোগ আছে ছোটো ছোটো বাঁধের ক্ষেত্রে তা নেই।

জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন : ১৯৮২ সালে বিহার সরকার সিংভূম জেলায় শাল জঙ্গলের শাল গাছ কেটে মূল্যবান সেগুন গাছ বসানোর পরিকল্পনা করে। স্থানীয় আদিবাসীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে যা পরবর্তী কালে ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যায় ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের দমন পীড়ন এবং পুলিশি অত্যাচারের ফলে ১৮ জন আদিবাসীর মৃত্যু হয়, বহু শত আহত হয়, প্রায় ১৫ হাজার পুলিশ কেস হয়, ২০০০ জন গ্রেপ্তার হয়। এই  সময় জঙ্গল আন্দোলনের পরিসমাপ্ত ঘটে এবং আন্দোলনকারীদের বড়ো অংশ ঝাড়খণ্ড মুক্তিমোর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আদিবাসীদের আন্দোলন চলতেই থাকে। পরবর্তী কালে বামপন্থী সাংসদদের চাপে ২০০৬ সালে ড.মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার  লোকসভায় জঙ্গলের অধিকার বিল (Forest Rights Bill) পাস করে জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার স্বীকার করে। এটিকে জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলনের এবং বিভিন্ন জায়গার আদিবাসীদের আন্দোলনের জয় হিসাবে মনে করা হয়। 

ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনা: ১৯৮৪ সালে ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় বিপুল পরিমাণ মিক (MIC) গ্যাস লিক করায় ভয়াবহ দূষণের শিকার হন পার্শ্ববর্তী এলাকার বহু মানুষ। সরকারি হিসাবে তৎক্ষণাৎ মারা যান ২২৫৯ জন (বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি)। ২০০৮ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার ৩৭৮৭ জন মৃতের পরিবারকে এবং ৫৭৪৩৬৬ জন আহত ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। বেসরকারি হিসাবে এই দুর্ঘটনায় দুসপ্তাহের মধ্যে ৮০০০ জন এবং পরবর্তী কালে আরও ‌৮০০০ জন মারা যান। প্রায় ৫ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা নানাবিধ রোগের শিকার। পৃথিবীর সব থেকে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা এবং নিকৃষ্টতম পরিবেশ দুর্ঘটনা হিসাবে ভোপালে গ্যাস দুর্ঘটনা চিহ্নিত। 

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি/ সংগঠন বিক্ষোভ, আন্দোলনে শামিল হয়, যদিও দোষীদের শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা যা হয় তা গভীর হতাশাব্যঞ্জক।

ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞান কর্মী/ সংগঠন এক মঞ্চে সংগঠিত হয়। দেশের পাঁচটি প্রান্ত থেকে পাঁচটি জাঠা — ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান জাঠা (BJVJ) দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে ভোপালে মিলিত হয় (১৯৮৭)। পরের বছর (১৯৮৮) কান্নানুরে এই সংহতি থেকে ২৮টি বিভিন্ন সংগঠন নিয়ে তৈরি হয় সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্ক (AIPSN)। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৪০ যার মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি সংগঠন— পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ও বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি। নেটওয়ার্কের ধারাবাহিক কর্মসূচির অন্যতম হল পরিবেশ সংক্রান্ত।

আজকের দিনে বিভিন্ন দেশের পরিবেশ আন্দোলনে জাতীয় চরিত্র ছাড়াও আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত স্পষ্ট। বিশ্ব উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত সংকট থেকে কোনও দেশ মুক্ত নয় এবং কোনও একটি দুটি দেশ হাজার চেষ্টা করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, সব দেশের সম্মিলিত উদ্যোগেই তা সম্ভব। তাই ভারতবর্ষের পরিবেশ আন্দোলন আর নিছক আমাদের দেশের নয়, আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনের অংশ। পরিবেশ আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানের পরিবেশ সংকট তৈরি হয়েছে মুনাফা তাড়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য। জমি খনি জল জঙ্গল — সব জায়গার প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে চলছে মুনাফার পাহাড় গড়ার কর্মকাণ্ড। তাই আজ দাবি উঠেছে ব্যবস্থা পরিবর্তনের। গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’-এর আহ্বানে ২০২১ সালের বিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘটের স্লোগান ছিল — “Do not change the climate, change the system”। 

তথ্যসূত্র :

১৷ ‘Environmentalism’, Ramchandra Guha

২৷ ‘Environmental Movement’, Tapan Saha

৩৷ ‘পরিবেশ আন্দোলন : বিভিন্ন ধারা’, অজয় দে, “প্রসঙ্গ পরিবেশ”, অনুষ্টুপ।

৪৷ ‘উন্নয়ন বনাম পরিবেশ : ভারতীয় চালচিত্র’, প্রসাদ রায়, ঐ।

৫৷ ‘বিকল্প শক্তি ও বাঁধ : ভিন্ন মত’, মানস রায়, ঐ।

৬৷ ‘জল’,দেবাশিস গুপ্ত, পরমেশ গোস্বামী, কল্যাণ রুদ্র, এভেনল প্রেস।

৭৷‘জল এবং জীবনের লড়াই’, অনিতা অগ্নিহোত্রী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩.০৮.২০২২।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান