বিপ্লব বাবুর একটি দিন, ১২ আগস্ট, ২৩০০

অংশুমান দাশ

বিপ্লব বাবু একটা নতুন জামা কিনেছেন। জামাটা পরে আজ তাঁর একটি জায়গায় যাওয়ার কথা। জামা পরার সময়েই তাঁর ফোনে খবর এল — এটা তাঁর এ বছরের ৩ নম্বর নতুন জামা — উনি তাঁর বছরে দুটো নতুন জামার লিমিট পেরিয়ে গেছেন। যেহেতু প্রতিটা জামা তৈরি করতে ২৭০০ লিটার জল লাগে — সুতরাং তাকে জল খরচও সেই অনুপাতে কমাতে হবে। চট করে হিসাব মিলিয়ে দেখতে গিয়ে বিপ্লব বাবু দেখলেন — ১ একর জমিতে প্রায় ৪০০০০ তুলো গাছ লাগানো যায়, আর এক একটা তুলো গাছের প্রায় ৪০ লিটার জল লাগে। এই জমি থেকে প্রায় ২০২ কেজি তুলো উৎপাদন হয়, তাতে ১৫,১৪,০০০ লিটার জল লাগে। তার মানে ১ কেজি তুলো উৎপাদনে প্রায় ৭৫০০ লিটার জল খরচ হয়। ১ কেজি তুলো থেকে ৪-৫ টা জামা হয় — মানে জামা পিছু ১৫০০ থেকে ১৯০০ লিটার জল কেবল মাত্র তুলোর খরচ। তার উপরে জামা তৈরি করতে আরও জল খরচ আছে। তার মানে হিসাব ঠিকই আছে। বাথরুমের জল খরচের মিটারটা কমিয়ে দিনে ১৫ লিটার করে দিলেন বিপ্লব বাবু। এমনিতেই তাঁদের আবাসনে মাথা পিছু প্রায় ১৫ লিটার জল দিনে রিসাইকেলড হয়। কিছুটা আবার ট্যাঙ্কে ফিরে আসে, কিছুটা ছাদের বাগানে চলে যায়, কিছুটা মাটির তলায় রিচার্জ হয়। প্রতিটা বহুতল বাড়ির সঙ্গে জল পুনরাবর্তনের ব্যবস্থা করা আছে।

বিপ্লব বাবুকে আজ একটু বেশি দূরে যেতে হবে তাই সাইকেলে যেতে পারবেন না। হয় সাধারণভাবে সোলার বাসে যেতে হবে, বা সোলার গাড়িতে। ২০৩৫ সাল নাগাদ সমস্ত ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকানা বাজেয়াপ্ত করা হয় — এবং সমস্ত গাড়িই সাধারণের গাড়ি হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। প্রতি পাড়ায় এইরকম গাড়ির গ্যারাজ আছে এবং সেখানে আগে থাকতে আপনি কোথায় যাবেন বলে রাখলে একই দিকে একসঙ্গে একই সময়ে যাবেন এইরকম অন্তত তিনজন লোককে একটি গাড়ি দেওয়া হয়। তেলে চলা গাড়ি প্রায় উঠে গেছে — কেবল জরুরি পরিষেবা অর্থাৎ খাবার পরিবহণ, হাসপাতাল — এইসবের জন্য তেল রিজার্ভ থাকে। এক লিটার পেট্রোল পুড়লেই প্রায় ২.৩ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড। শুধু সে কারণেই নয়, মাটির তলার তেলও শেষ। আর খাবার উৎপাদন করার জমিতে বায়োডিজেল উৎপাদন করাও নিষিদ্ধ। 

সোলার গাড়ির কথা আগে থেকেই বলা ছিল। বিপ্লব বাবু পাড়ার গ্যারেজে গিয়ে দেখলেন তার সঙ্গে এক জন যুবতি, তাকে তিনি আগে দেখেননি, আর ইউনুস তার সঙ্গী হবেন। ইউনুসকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন — ভালোই হবে ব্যাপারটা। কথা বলতে বলতে সময় কেটে যাবে। গাড়িতে উঠে আড়চোখে দেখলেন — মেয়েটির হাতে একটি বই। বইটির নাম ‘গীতাঞ্জলি’ — হলুদ মলাট তার উপরে লাল রঙের নাম — লেখকের নাম পড়া যাচ্ছে না। মনে হল পুরোনো বই — নতুন প্রিন্ট। এখনকার বই সব রিসাইকেল্ড প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। এখন প্লাস্টিক তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে, তাও যত প্লাস্টিক এখনও আছে তা দিয়ে বই ছাপা হয়। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ই-বই ব্যাপারটা একটা জায়গার পরে থেমে গেছে। রিসাইকেল্ড প্লাস্টিক দিয়ে বই ছাপার পর থেকে বই পড়ার ব্যাপারে আবার একটা উন্মাদনা ফিরে এসেছে। বিপ্লব বাবুর বাড়িতে কিছু কাগজে ছাপা বই আছে— অনেক পুরোনো। পাতা উলটে দেখার সাহস হয় না — পাতা ঝুর ঝুর করে পড়ে যায়। সেখানে গীতাঞ্জলি দেখেছেন কি না মনে পড়ল না। কাগজ এবং কাগজে ছাপা বই প্রায় বন্ধ। একটা ২৫ মিটার উঁচু পাইন গাছ থেকে মোটামুটি ১,২১,০০০ কাগজ তৈরি হয় — এবং একসময় এই কাগজের জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করে কাগজ তৈরির জন্য গাছ লাগানো হয়েছে। সেই সব গাছ কাগজ ছাড়া আর কোনও কাজে লাগেনি — না হয়েছে পাখির বাসা, না হয়েছে খাবার বা অন্য কোনও কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই ওইসব অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের দফা রফা। ২০৫০ সালে একটি চুক্তি করে সারা পৃথিবীর জঙ্গলকে সরকারের হাত থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাদের দেখভাল করার জন্য স্থানীয় কমিটি তৈরি হয়। বিপ্লব বাবুর বয়স এখন ৭৫। অনেক কিছু পরিবর্তন দেখেছেন, তাই কথায় কথায় এইসব ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিপ্লব বাবু কলকাতা শহর থেকে একটু দূরে জামতলা বলে একটা গ্রামে যাচ্ছেন। তাঁদের ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডকে দেখাশোনা করে এই গ্রাম। কলকাতা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডকে দত্তক নিয়েছে আশেপাশের ৫টি করে গ্রাম। এইরকম প্রতি ৫টি গ্রামের গুচ্ছে একটি করে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র আছে— যেখানে ওই গ্রামগুলিতে উৎপাদিত চাল, ডাল, তেল ভাঙানো যায় — যা ওই ৫টি গ্রাম ও একটি ওয়ার্ডের সমস্ত খাবারের চাহিদা মেটায়। খাবার শুধু নয় — জামা কাপড়ের জন্য তাঁতও বসানো আছে। কোম্পানির মুনাফার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়ার পরে প্রচুর ছোটো ব্যাবসা নানা স্তরে উঠে এসেছে গত ৫০ বছরে। গ্রামের এই সব ডাল-তেল কল বা তাঁত — সবই এখন ছোটো ছোটো কোম্পানি। গ্রাম শহরকে দত্তক নেবে— এই রকম ব্যবস্থা চালু হওয়ায় এইসব কোম্পানিগুলির বিক্রি বাটায় কোনও অভাব নেই। ১০০ কিমি ব্যাসার্ধের বাইরে খাবার দাবার বা অন্য কোনও জিনিস আমদানি-রপ্তানি করার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। যেহেতু কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন হিসেব করে সব কাজ করতে হয় — তাই এত কড়াকড়ি। এমনকি এই ১০০ কিমি ব্যাসার্ধের মোট জল, মাটির পুষ্টিগুণ, মোট কার্বন — সব এই পরিসরের মধ্যেই আটকে রাখা হয়। জিনিস রপ্তানি হলে সেই হিসেবটা আবার মেলাতে থাকতে হয় — ১ কিলো চাল ১০০ কিলোমিটারারে বাইরে গেল মানে ওই চাল উৎপাদন করতে যে জল লেগেছিল সেটাও বাইরে গেল আর কী। চাল এমনিতেই মহার্ঘ অবশ্য। আজ থেকে এই ৭৫-৮০ বছর আগেও কৃষকরা শীতকালে মাটির তলা থেকে মিষ্টি জল তুলে চাষ করতেন — প্রায় ৩০০০ লিটার জল লাগত ১ কিলো চাল উৎপাদনে। এখন প্রতি বছরে মাটির তলার জল ও বৃষ্টির জলের হিসাব করে প্রতি ১০০ কিলোমিটার জায়গায় ফসল পরিকল্পনা করা হয়। সঙ্গে থাকে চাহিদার হিসাব। গ্রামের এই উৎপাদনের কাজে দত্তক নেওয়া ওয়ার্ডের মানুষদের শ্রম দিতে হয়। আজ বিপ্লব বাবু সেই কাজেই যাচ্ছেন। বয়স ও দক্ষতা অনুযায়ী কাজের ভাগ পড়ে — বিপ্লব বাবু ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরুন মাসে একবার দুটি তেলকলের মেশিন পরীক্ষা করেন। বয়স কম হওয়ার জন্য ইউনুস যেমন মাল লোডিংএর কাজ করেন। এই মেয়েটিও হয়তো কোনোরকম কাজেই যাচ্ছে। প্রতিটা ১০০ কিলোমিটার জায়গার এই এককগুলি এখন প্রায় স্বয়ং সম্পূর্ণ দেশ বলা চলে। সেখানে প্রায় ৭-৮টা পঞ্চায়েত ঢুকে যায়। দেশের সব থেকে সেরা মাথার লোকেরা এই সমস্ত এককের কেন্দ্রে। কারণ সম্পদ ব্যবস্থাপনাই এই সমাজের মূল পরিচালনা শক্তি আর তার হিসাব চালিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। এইসব সিদ্ধান্তের অনেকটাই অবশ্য স্বয়ংক্রিয়। এই যেমন একটা জামা পড়ার হিসাব টক করে বিপ্লবা বাবুর ফোনে চলে এল। স্কুল কলেজ— সবই এখন এই গ্রামগুলোতেই, ফলে শহরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমেছে। শহর মূলত বহর্বিশ্ব সামলায় আর গ্রামগুলিকে নানা ধরনের সার্ভিস দেয়। নিজের ছোটোবেলাতেও বিপ্লব বাবু এমনটা দেখেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের ক্ষমতা লোপ পেয়ে বিকেন্দ্রীকরণের চরম লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে থাকে মূলত যখন থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের অসাম্য সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি হয়। উপলব্ধি হয় যে, সম্পদটার ভৌতিক অবস্থান ও তার অধিকার আসলে একটাই ভৌগোলিক সীমায় নেই। অর্থাৎ জিনিস্টা শহর থেকে দূরে থাকলেও সেটা কীভাবে ব্যবহার হবে তার অধিকার শহরের লোকেদের হাতে। 

রাস্তায় যেতে যেতে একটি পরিত্যক্ত সার কারখানার দিকে নজর যায় বিপ্লব বাবুর। মাটির পুষ্টির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে চলে আসার পর থেকে অনেক সার কারখানা গত কয়েক দশকে বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানাটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে লতাপাতা জঙ্গল। গাছেদের কারখানা মনে হচ্ছে যেন। গাড়ির সামনে বসা মেয়েটি গাড়ি থামিয়ে নেমে যেতে থাকে। বিপ্লব বাবু আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না। জানা যায় পারমিতা এই জামতলা অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধান, সে সপ্তাহে একদিন ১০৪ নং ওয়ার্ডের স্কুলে জীববৈচিত্র্য পড়াতে যায়। আজ সে পড়িয়ে বাড়ি ফিরছে। কিন্তু এখন এই কারখানায় নামতে চায়, কারণ সে খবর পেয়েছে এই কারখানায় একটি বাঘরোলের দম্পতি থাকা শুরু করেছে, এবং তাদের সম্প্রতি ৩টি বাচ্চাও হয়েছে। তাদের ছবি তুলে, কিছু তথ্য সংগ্রহ করে তিনি গ্রামে ফিরে যাবেন। বিপ্লব বাবু আঙুল উঁচিয়ে বইটির দিকে দৃষ্টিপাত করায় পারমিতা জানায় — কবিতা পড়া তার নিছক শখ। প্রকৃতি প্রেম থেকে সে জঙ্গলে ঢুকে যেতে চাইছে — ব্যাপারটা এমন নয়। বিপ্লব বাবু চাইলে বইটি রাখতে পারেন, পারমিতা পরে গিয়ে নিয়ে আসবেন — কারণ ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডে তাকে প্রতি সপ্তাহেই যেতে হয়।

বিপ্লব বাবু বইটি নিয়ে লেখকের নাম দেখলেন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নামটা শোনা হলেও কোনও লেখা পড়েছেন বলে মনে হল না। পারমিতা ঝোপ জঙ্গল ঠেলে উধাও হয়ে গেল। গাড়িও আবার জামতলার দিকে রওনা হল। ইউনুস নেমে গেলেন রাস্তায়। বিপ্লব বাবু ঝোলা বগলে আর একটু পরে তেল কলের সামনে নেমে পড়লেন। গাড়ি আবার তাকে বিকেলে ফেরত নিয়ে যাবে। এবারে সরষের ফলন ভালো হয়েছে। তাই মেশিন কাজ করছে বেশি। গোলমালও কম। আজকে সরষের খোলের গুণমান মাপা হল যাতে এই খোল আগামী বছর কোন জমিতে কতখানি দিতে হবে তার মাত্রা ঠিক হল। জমির উর্বরতা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এখন যেহেতু চাহিদা অনুযায়ী নানা ফসল হয়, জঙ্গুলে জমি ছেড়ে রাখায় পোকা খায় এমন পোকার সংখ্যাও বেড়েছে — তাই ফসলে পোকা লাগার পরিমাণও কম। 

সারাদিন কাজের পরে বাড়ি ফিরেছেন বিপ্লব বাবু। সঙ্গে সপ্তাহের সবজি। যখন আসেন তখন ফেরার পথে সবজি নিয়ে গেলে কিছুটা কার্বন খরচ কমে। মাসের শেষে কার্বন ডাই অক্সাইড পোড়া আর জল খরচ— এই দুটির ভিত্তিতে ট্যাক্স দিতে হয় সকলকে। একটি বেশি জামা কেনায় এমনিতেই জল বাজেটের হিসেবে ঘাটতি হচ্ছে। তাই কার্বন বাঁচিয়ে কিছুটা পরিত্রাণের চেষ্টা আর কি! তবে আজ ভালোই সবজি পেয়েছেন বিপ্লব বাবু। বর্ষার মুখে কিছু জংলি শাকও এবার বরাদ্দ হয়েছে ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য। এছাড়া কিছু ডেউয়া আর ফলসা। চুনো মাছ। এ মাসের চাল ডাল তেল পরে সাপ্লাই হবে জামতলা থেকে। 

সারাদিনের ক্লান্তির পরে রাতে বিছানায় শুয়ে ‘গীতাঞ্জলি’-র পাতায় চোখ রাখলেন বিপ্লব বাবু। পড়লেন—  

                   “মাঝে মাঝে কভু যবে অবসাদ আসি                                                                                             
                    অন্তরের আলোক পলকে ফেলে গ্রাসি,                                                                                          
                    মন্দপদে যবে শ্রান্তি আসে তিল তিল                                                                                                
                     তোমার পূজার বৃন্ত করে সে শিথিল                                                                                               
                     ম্রিয়মাণ— তখনো না যেন করি ভয়,                                                                                               
                     তখনও অটল আশা যেন জেগে রয়                                                                                                
                             তোমা-পানে।” 

কিছুটা যেন বুঝতে পারছেন। কিছুটা অধরা। সারা জীবন যন্ত্রপাতি ঠেলে এসেছেন। কবিতা পড়েননি। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছে যেন। নিছক মানেটা বোঝার কৌতূহলেই। আবার জোরে জোরে পড়লেন –

                  “রাত্রি এনে দাও তুমি দিবসের চোখে                                                                                               
                  আবার জাগাতে তারে নবীন আলোকে।” 

এর মানে কী? না বুঝতে পারলে যেন ঘুম আসছে না। পারমিতাকে কাল সকালে ফোন করতে হবে। সত্যি তো নতুন করে জেগে ওঠার কোনও বিকল্প নেই। বিপ্লব বাবু ভাবলেন — যদি আমরা রোজ জন্মাতে পারতাম, রোজ নতুন থাকতে পারতাম। আজকের জামতলা যাওয়াটাও তো একরকম নবজন্মই হল। 

বিপ্লব বাবু পাতা ওলটালেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান