বিপন্ন জলাভূমি বিপন্ন সভ্যতা

সৌরভ চক্রবর্তী

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার জলাভূমি। মনুষ্য সভ্যতার অস্তিত্বের পরিচায়ক জলাভূমি আজ চরম বিপন্ন। এই বিপন্নতা যেমন বিশ্বজুড়ে, তেমনি আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যে, আমাদের পাড়ায়। বিপন্ন আমাদের আবাসস্থল নীল সবুজ গ্রহ আমাদের পৃথিবী। আবহাওয়া পরিবর্তন আজ বারবার লাল সংকেত বার্তা পাঠাচ্ছে আমাদের প্রিয়তম গ্রহটির প্রতি। বিপন্ন মানবসমাজ। বিপন্ন মানব সভ্যতা। 

আজ বাতাসে সঞ্চিত কার্বন লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে বিশ্ব পরিবেশকে খরা, বন্যা, সাইক্লোন, দাবানল, সমুদ্রের জলের স্ফীতি, ফসলের উৎপাদনশীলতার হ্রাস, শ্রমিকের শ্রমদিবস নষ্ট, রোগভোগ, জলসংকট, সর্বোপরি আইপিসিসি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)-র ষষ্ঠ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নাসা ভারতের ১২টি উপকূলবর্তী শহর ডুবে যাওয়ার সতর্কবার্তা দিয়েছে। এর মধ্যে আমাদের কলকাতা শহরের খিদিরপুরও আছে। খিদিরপুর ডুবলে বাকি কলকাতা? সুন্দরবন? 

পুরা ভূ-তত্ত্ববিদ্যা অনুসারে সাত হাজার বছর আগে সুন্দরবন ছিল ব্যারাকপুরে, কোলাঘাটে। আমরা কি এমন পরিণতি আবার চাইব! আগে প্রকৃতির কারণে এই ঘটনা ঘটেছিল তাই তা জিওজেনিক। আজ যা কিছু হচ্ছে তা আমাদের, মানে অ্যান্থ্রোপজেনিক কারণেই হচ্ছে, তাই এই যুগটাকে হলোসিনের পরিবর্তে এ্যান্থ্রোপসিন নামকরণ করা হয়েছে। এর আগে প্রকৃতির কারণে পাঁচবার প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স কি ষষ্ঠ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে?

প্রতিটি জলাভূমি ভরাটের ক্ষেত্রে তা পাড়ায় হোক, আফ্রিকায় হোক, আর আমেরিকায় হোক, উপরের এই বিভীষিকাময় পঙক্তিগুলি যেন আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। প্রতিটি জলাভূমি ভরাটের ঘটনায় আমরা যেন দৃঢ়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারি। এ দায় ইতিহাস আমাদের দিয়েছে। 

১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসার শহরে অনুষ্ঠিত হয়, “ওয়েটল্যান্ড অফ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পর্টেন্স” বা রামসার কনভেনশনে স্বাক্ষর করার দিন। বিশ্বের ১৭০টি দেশ রামসার কনভেনশনের আন্তর্জাতিক চুক্তিকে অনুমোদন করেছে। রামসার কনভেনশন কর্তৃক প্রকাশিত “গ্লোবাল ওয়েটল্যান্ড আউটলুক”-এ ২০১৮-তে, রামসার কনভেনশনের সাধারণ সম্পাদক মার্থা বোজাস বলেন যে, পৃথিবীর সবচাইতে বেশি আর্থিকভাবে মূল্যবান বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম, বিশ্ব জলবায়ুর নিয়ামক, জলাভূমিগুলি বনাঞ্চলের থেকেও তিনগুণ দ্রুতহারে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র দ্রুত হারিয়ে যাওয়াই নয়, জলাভূমিগুলি যে জরুরি পরিষেবা প্রদান করে, হারিয়ে যাচ্ছে তাও। জলাভূমি ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য কিছুতেই বাস্তবায়িত হবে না। 

জলাভূমি কাকে বলে 

জলাভূমি সংক্রান্ত রামসার কনভেনশনের এক নম্বর ধারায় জলাভূমির সংখ্যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, জলাভূমি হল ‘মার্স’, ‘ফেন’, পিটল্যান্ড; যে ভূমি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে জলমগ্ন থাকে, যা স্থির বা গতিশীল; স্বাদু, অল্প নোনা, লবণাক্ত, সামুদ্রিক ভূমি যেখানে ভাটার সময় গভীরতা ৬ মিটারের বেশি হবে না।

সার্বিভাবে নদী নালা, পুকুর, খাল বিল, বাওর, ম্যানগ্রোভ, প্রবাল প্রাচীর, প্লাবন ভূমি, জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত।

মার্স : সবসময় জলমগ্ন ভূমি, লতানো গাছের প্রাচুর্য, ভূপৃষ্ঠ থেকে জল আহরণ করে।

পিটল্যান্ড : যে জলাভূমিতে লতাপাতা সহ মৃত উদ্ভিদের অসমাপ্ত বিভাজন হয়, ফলত আংশিক বিয়োজিত উদ্ভিদ জমতে জমতে, জমাট স্তরীভূত হয়। পিট, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

বগ, ফেন : পিটল্যান্ডকে দুভাগে ভাগ করা হয়। ‘বগ’ ও ‘ফেন’। বগ-এর উদ্ভিদ বর্ষার জলে লালিত পালিত হয় তাই প্রচুর বৃষ্টিপাতের অঞ্চলে ‘বগ’ জলাভূমি দেখা যায়। ফেন মাটির তলার জলে জীবন ধারণ করে তাই শুকনো জায়গায় ‘ফেন’ স্বাভাবিক। 

জলাভূমি উৎপাদনশীল প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী

জলাভূমির পরিধি বিরাট। নদী-নালা, নদীর প্লাবনভূমি, ম্যানগ্রোভ জলা, সামুদ্রিক জলাভূমি বলতে প্রবাল প্রাচীর,পাথুরে তটরেখা। বিপুল বৈচিত্র্যময় এই জলাভূমি। জলাভূমি উদ্ভিদ লতাগুল্ম, বন্যপ্রাণের, মাছেদের, পাখিদের আবাসস্থল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। জলাভূমি উৎপাদনশীল। উৎপাদনের আর্থিক মূল্য সুবিশাল। সেই সঙ্গে জলাভূমি অতিরিক্ত জল সঞ্চয় করে বন্যা রোধ করে। বৃষ্টির জল ধারণ করে, জল পরিশ্রুত করে, ভূ-জল ভান্ডারকে সম্পূরণ করে সমৃদ্ধ করে। জলাভূমি দূষণ রোধ করে, ভূমিক্ষয় রোধ করে, বিনোদনের উপাদান হল জলাভূমি। 

জলাভূমি বিশ্ব উষ্ণায়ন তথা জলবায়ু পরিবর্তনকে রোধ করে, মানুষ, উদ্ভিদ প্রজাতির, বন্যপ্রাণ, মাছ, পাখিদের জীবনধারণে অত্যন্ত জরুরি ভূমিকা পালন করে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জলাভূমিগুলি পৃথিবীর প্রায় সব মিষ্টি জলের জোগান দেয়। বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ কোনও-না-কোনও ভাবেই জলাভূমির উপর নির্ভরশীল। এই পৃথিবীর প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি মানুষ জলাভূমির ধানে জীবনধারণ করে। বিশ্বের ৪০% প্রজাতি জলাভূমিতে বাস করে। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও সত্যি যে, বিশ্বময় জলাভূমি অস্তিত্বের সংকটে। ২৫% উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি ধ্বংসের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। সারা বিশ্বে ১২.১ মিলিয়ন বর্গ কিমি জুড়ে জলাভূমি বিস্তৃত যার ১৩-১৮% জলাভূমি, সর্বমোট ২৩০০টি জলাভূমি রামসার সাইট-এর অন্তর্গত। যারা ‘ওয়েটল্যান্ড অফ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পর্টেন্স’ অভিধায় ভূষিত। 

বিজ্ঞান পত্রিকা Hindawi নেপালের জগদীশপুর রামসার সাইট জলাভূমির বছর প্রতি আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করেছে, তা হল ৯৪.৫ মিলিয়ন নেপালি টাকা প্রতি বছরে। তারা গোটা বিশ্বের জলাভূমির যে আর্থিক হিসেব দিচ্ছে তা হল, ১৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রতি বছরে। 

পারতপক্ষে যেকোনো ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের থেকে জলাভূমি ঢের বেশি কার্বন সঞ্চয় করে। পিটল্যান্ড একাই সারা বিশ্বের বনভূমি থেকে দ্বিগুণের বেশি কার্বন শোষণ করে। পিটল্যান্ড জলাভূমির আয়তন, বিশ্বের আয়তনের মাত্র ৩% কিন্তু কার্বন সঞ্চয় করে ৩০%। একটা হিসেব বলছে পিটল্যান্ডের মোট কার্বন সঞ্চয় হল ৫৫০ গিগাটন। তাই জলাভূমি হল সারা বিশ্বময় এক তন্ত্র যা এ গ্রহে জীবনধারণের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের বিশ্বায়ন প্রতিরোধে কার্বন শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে পাড়ার এক জলাভূমি সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ার এক জলাভূমির সঙ্গে একসূত্রে জোট বেঁধে কার্বন শোষণ করে, খাদ্য দিয়ে, জল দিয়ে পৃথিবীতে রক্ষা করে চলেছে। অনাদরে পড়ে থাকা পাড়ার একটা পুকুর বিল যে তামাম বিশ্বের উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে আর্থিকভাবে মূল্যবান বাস্তুতন্ত্রের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিবেশ পরিষেবা প্রদান করে চলেছে এই চেতনার আলোকে এখনও আমাদের সমাজকে আলোকিত করা যায়নি। তাই তো রিয়েল এস্টেট কারবারের প্রমত্ত ষণ্ডের বিক্রমে যথেচ্ছভাবে জলাভূমি ভরাট হয়ে চলেছে। ডেকে আনছে সর্বনাশা পরিণাম।

ভারতে জলের কষ্ট বাড়ছে, জলাভূমি কমছে 

২০১৮ সালের ১৪ জুন ‘কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইন্ডেক্স’ প্রকাশিত হল, নীতি আয়োগ বলল, ২০২০ সালে ভারতবর্ষের ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ জল থাকবে না। ৬০ কোটি মানুষ জল কষ্টে, ৪০% মানুষ ২০৩০ সালে পানীয় জল পাবে না, বছরে পানীয় জলের কারণেই দু লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে। ‘গ্লোবাল ওয়াটার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স’-এ ১২২টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২০ নম্বরে। সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড-এর তত্ত্বাবধানে দেশে ২২,৩৩৯টি ভূগর্ভস্থ নলকূপ রয়েছে, তা থেকে জানা যাচ্ছে ৫৪% ভূগর্ভস্থ নলকূপের জল নীচে নেমে গেছে। 

এমন একটা তীব্র জল কষ্টের ছবির সঙ্গে আমরা আত্মহননের আর-একটা চিত্র মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারব জলাভূমির সঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলভান্ডারের কী সম্পর্ক! ডাউন টু আর্থের ১৩ আগস্ট, ২০২০ সংখ্যা বলল, চেন্নাই ৯০% জলাভূমি হারিয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য, ভদোদরা ৩০.৫% জলাভূমি হারিয়েছে ২০০৫-২০১৮ সালের মধ্যে, হায়দরাবাদ ৫৫% জলাভূমি হারিয়েছে অনিয়ন্ত্রিত নগর উন্নয়ন, দূষণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে, মুম্বাই ৭১% জলাভূমি হারিয়েছে, আমেদাবাদ ৫৭%, বেঙ্গালুরু ৫৬%, পুনে ৩৭%, দিল্লি ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন ৩৮% জলাভূমি এবং দূষণজনিত ইউট্রোফিকেশন (জলজ উদ্ভিদে ভরে যাওয়া)-এর জন্য। 

আমাদের রাজ্য আর কলকাতার অবস্থা কীরকম

‘নিউজক্লিক’ ৫ ডিসেম্বর ২০২১ বলছে, ২০০৫ সালে কলকাতায় ৭২০০ পুকুর ছিল ২০১৭-তে তা প্রায় অর্ধেক কমে হল ৩৮০০টি। টিভি৯ বাংলা ১৮ই ডিসেম্বর ২০২১-এ বলল, ২০১০-এ কলকাতায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ৭২০০, ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়াল ৩৭২০টিতে।

স্নানের অযোগ্য গঙ্গা

অত্যধিক উত্তোলনে মাটির তলায় জলের স্তর হু-হু করে নামছে, শূন্যের উপরে ঝুলছে কলকাতার ভূমিপৃষ্ঠ। নির্মল গঙ্গা বা ‘নমোমি গঙ্গে’ প্রকল্পের নামে বাইশ হাজার কোটির ঢক্কা নিনাদী প্রকল্প সত্ত্বেও গঙ্গা নদী স্নানের অনুপযুক্ত। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষায় দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার টোটাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি চার লক্ষ এম পি এন (most probable number) প্রতি ১০০ মিলিলিটারে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নিজেই বলছে যে, রাজ্যের ১৭টা নদী দূষিত। হেজে মজে যাচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিলগুলো। অত্যধিক উত্তোলনে মাটির তলায় জলের স্তর হু-হু করে নামছে, শূন্যের উপরে ঝুলছে কলকাতার ভূমিপৃষ্ঠ। জলাভমি মাটির তলার জলভান্ডার পূরণ করার ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু নির্বিচারে জলাভূমি ভরাট করে ভয়াবহতা আরও বহুগুণ হয়েছে। 

এবার দেখা যাক ভূগর্ভস্থ জল স্তরের অবস্থা 

‘সুইচ অন ফাউন্ডেশন’-এর সমীক্ষা উদ্ধৃত করে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ (২৩ মার্চ ২০২১) বলেছে, পশ্চিমবাংলায় ২০১৩-র পর থেকে সর্বোচ্চ ভূগর্ভস্থ জলস্তর ১১ মিটার নেমে গেছে মধ্যবঙ্গে, মূলত ‘রাইস বোল’ বলে সুবিদিত বর্ধমান জেলায়। বিগত ১২ বছরে কলকাতায় ৭ মিটার থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ জলের অবনমন ঘটেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১-এর টাইমস অফ ইন্ডিয়া বলছে, উত্তরবঙ্গে ধারাবাহিকভাবে জলাভূমি হ্রাস এবং কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে। কোচবিহারের রসিকবিল থেকে জলপাইগুড়ির গজলডোবা একই অবস্থা! 

কোন্ পথে চলেছি আমরা 

এ কোন্ উন্নয়নের পেছনে মত্ত ষণ্ডের মতো ছোটা! জলাভূমি যে ভূগর্ভস্থ জল ভান্ডারকে সম্পূরণ করে সে তো এসব তথ্যেই পরিষ্কার।

সোজা কথায়, অত্যধিক অপরিকল্পিত ভূ-জল উত্তোলন এবং যথেচ্ছ জলাভূমি ভরাটে মাটির তলার জলস্তর নামবে, কে করবে পরিকল্পনা! পরিবেশের মৃত্যুঘণ্টা যখন বাজছে, সরকার এগিয়ে আসবে না? হস্তক্ষেপ করবে না! রিয়েল এস্টেটকে যা খুশি করার ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়ে দেবে? চোখের সামনে জলাভূমিতে নিউট্রিয়েন্ট ঢুকিয়ে জলজ উদ্ভিদে ঢেকে ফেলে ধীরে ধীরে বুজিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, বর্জ্য ফেলে জলাভূমি ভরাট করে দেওয়া হচ্ছে, কেউ দেখবে না? মানুষ তো ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে! ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসতে পারে না। প্রশাসন পাশে দাঁড়াবে না? কেন্দ্রীয় সরকার আগের সরকারের তৈরি করা ২০১০ এর ‘রুলস’ বাতিল করে ‘ওয়েটল্যান্ড (কনজারভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট) রুলস ২০১৭’ করেছে। সেই মোতাবেক প্রতি রাজ্যে ‘স্টেট ওয়েটল্যান্ড অথরিটি’ তৈরি হবার কথা পরিবেশমন্ত্রীকে শীর্ষে রেখে, কী কাজ করছে কেন্দ্র ও রাজ্যের অথরিটি? এই অবিমৃশ্যকারিতার জন্য শতাব্দীর শেষে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ডুবে মরতে হবে! 

‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ যে তথ্য বলছে হাজার ১৯৭০-২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩৫% জলাভূমি হারিয়ে গেছে, এই হারিয়ে যাওয়ার হার ত্বরান্বিত হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। আমাদের দেশের কী হাল? ‘ডাউন টু আর্থের’ ১৩ আগস্ট ২০২১ সালের সংখ্যায় বলা হল বিগত ৩০ বছরে ভারতে ৩০% প্রাকৃতিক জলাভূমি বিনষ্ট হয়েছে, হারিয়ে গেছে। কেন হল এসব? বেআইনি নির্মাণ, অস্থিতিশীল উন্নয়ন, কৃষি ভূমির প্রসার এবং দূষণের কারণে এই সর্বনাশ হয়েছে। সোজা কথায় যে উন্নয়ন হয়েছে তা পরিবেশের বারোটা বাজিয়েছে আর আজকের চরম বিপদকে ত্বরান্বিত করেছে। 

বিশ্বের বিস্ময় পূর্ব-কলকাতা জলাভূমি

সারাবিশ্বের সুবৃহৎ এবং অদ্বিতীয় জলাভূমির নাম ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি।’ এই জলাভূমি প্রাকৃতিকভাবে কলকাতার আশিভাগ দূষিত বর্জ্য জলকে বর্জ্য গর্ভেই জন্ম নেওয়া এবং শতগুণ বেড়ে ওঠা ব্যাকটেরিয়া এবং ‘অ্যালগি’ বা শৈবাল, সূর্যের আলোর সাহায্যে পরিশোধিত করে মাছের খাদ্য তৈরি করে। এই প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে মাছ চাষ, সবজি চাষের ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে তা বিশ্বের বিস্ময়। ২০০২ সালে এই জলাভূমিকে রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কলকাতার আশিভাগ বর্জ্যজল, যার পরিমাণ ১০০০ মিলিয়ন লিটার প্রতি দিনে, এই জলাভূমিতে নালার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে প্রায় ২৫৪টি ভেড়িতে ভাগ হয়ে গিয়ে এমন এক বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড ঘটায় যার জন্য কলকাতাতে ‘সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ নির্মাণ করেনি ইংরেজ শাসকেরা। সেই ব্যবস্থাপনা আজও চলেছে। ফলে বর্জ্য পরিশোধন বাবদ ৪৬,৮০০ মিলিয়ন টাকা বেঁচে যায় অর্থাৎ এই জলাভূমি বছরে সরকার বা কলকাতা কর্পোরেশনকে উক্ত বিরাট অঙ্কের অর্থ প্রদান করে চলেছে। এটাই জলাভূমির উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতা প্রাকৃতিক।উদারনীতির মুনাফাকারী উৎপাদনশীলতা নয়। কলকাতা শহরের বিরাট অংশের মাছ এবং সবজির চাহিদা মেটায় এই জলাভূমি। বছরে ১৮,০০০ টন মাছ এবং দিনে ১৫০ টন সবজি উৎপাদন করে পূর্ব-কলকাতা জলাভূমি। গবেষকেরা আশ্বস্ত করেছেন যে এই বিপুল বর্জ্যজল, যার মধ্যে ‘ট্যানারি ওয়াস্ট’, পৌর, শিল্প, গার্হস্থ্য বর্জ্য রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধিত হবার পর জলের গুণমান নির্ধারক যেসব মাপগুলো রয়েছে তা সন্তোষজনক। তবু আজ জীবনযাত্রা ভীষণ জটিল, তেমনি জটিল হয়েছে বর্জ্যের চরিত্রের। ক্ষতিকারক রাসায়নিক দূষণের সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে, এ বিষয়ে অবশ্যই সরকারকে নজর দিতে হবে। 

হালফিলের গবেষণায় আরও এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন গবেষকেরা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষক-লেখক সুদিন পাল দেখিয়েছেন, পূর্ব-কলকাতা জলাভূমি বর্জ্য থেকে ৬৯ শতাংশ কার্বন সঞ্চয় করে। এ এক উল্লেখযোগ্য গবেষণালব্ধ ফল। কৃষক-মৎস্যজীবীরা জানেনই না যে তারা কত বড়ো কাণ্ডটা করছেন। সারা বিশ্বজুড়ে হাহাকার! আতঙ্ক! কেমন করে বাতাসের কার্বনের পরিমাণ কমানো যায়! পূর্ব-কলকাতা জলাভূমি সারাবিশ্বের জলাভূমির সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে এই বিপুল পরিমাণ কার্বন সঞ্চয় করে রাখছে তার মাটিতে, বায়োটায় (উদ্ভিদ এবং প্রাণীর মধ্যে)। গবেষকেরা বলছেন এই কার্বন সঞ্চয়কে ‘কার্বন ক্রেডিট’ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করে স্বীকৃতি দানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। (তথ্য ঋণ: MONGABAY, ৬ এপ্রিল ২০১৮)

চরম সংকটে পূর্ব-কলকাতা জলাভূমি

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯৭ সালে ২৬৪টি ভেড়ি কার্যকারী ছিল, আজ সেখানে মাত্র ২০০ ভেড়ি বেঁচে রয়েছে। 

কিছুদিনের মধ্যে ধাপা-মনপুর মৌজায় বড়োবন ভেড়ি এবং রবি ঘোষের ভেড়ি বুঝিয়ে ফেলা হয়েছে। ৩৭টা মৌজার কুড়িটি মৌজা ভয়াবহ জবরদখলের আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। জবরদখল এবং বর্জ্যজলের পরিমাণ কমে যাওয়া এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পূর্ব-কলকাতা জলাভূমির অস্তিত্বকে। হিন্দুস্তান টাইমস ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ সংস্করণ অনুযায়ী, ১৯৯২ সালে হাইকোর্ট পূর্ব-কলকাতা জলাভূমি এবং কৃষি জমির ভূমির চরিত্রের পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, অথচ রাজ্য সরকার সেই বিধিনিষেধ তুলে দেবার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যদিও বলা হচ্ছে তা চূড়ান্ত হয়নি।

রিয়েল এস্টেটের জন্য হিডকোর পরিকল্পনা মোতাবেক কলকাতার আদিগঙ্গাকে বাস্তুতন্ত্রচ্যুত করে কংক্রিটের বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে, তাকে মৃত্যু সম্ভাবনার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে, বেহালার চড়িয়াল খালকেও কংক্রিটের বাক্সে পুরে ফেলা হয়েছে। মুর্শিদাবাদের চালতিয়া, বিষ্ণুপুর বিল জবরদখলের চক্রান্তের মুখে। বিরাটির ৯৭ কাঠা জোড়া পুকুরে রিয়েল এস্টেটের থাবা উঁচিয়ে আছে, লেকটাউনের নয়ানজুলি মামলা জেতা সত্ত্বেও পুনরুদ্ধার হল না। আজ একটু বেশি বর্ষায় ভিআইপি রোডের সার্ভিস রোড, যার পাশে নয়ানজুলি ছিল, এক হাঁটু জল দাঁড়িয়ে যায়। হাতে কলমে প্রমাণ হয় জলাভূমির কার্যকারিতা। প্রতিদিন রাজ্যের কোথাও না কোথাও জলাভূমি ভরাটের চক্রান্ত চলছে, বুজিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া চলছে।

এই গ্রহে মানব সমাজের অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা, নয়া উদারীকরণ নীতির আগ্রাসনে আজ উৎপাদন ব্যবস্থা কেবল মুক্ত প্রতিযোগিতার তাড়নায় উৎপাদন আর সীমাহীন মুনাফা বোঝে, তার ফল হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের এই বল্গাহীন লুঠতরাজ। এই আলোকেই জলাভূমিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জানকবুল প্রতিজ্ঞা আমাদের আজ।

পুঁজিবাদ তথা নয়া উদারনীতিবাদের জন্যই এই পরিণতি

মার্কস বলেছেন, “একটা গোটা সমাজ, একটা জাতি বা সমস্ত সমসাময়িক সমাজকে একত্র করলেও তারা এই পৃথিবীর মালিক নয়, তারা কেবলমাত্র এ বিশ্বের ভোগদখলকারী, এর সুবিধাভোগী, এ বিশ্বকে আরও উন্নত অবস্থায় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে।” (‘ক্যাপিটাল’ ৩)।

কার্ল মার্কসের কথা তো আর পুঁজিবাদের চালকরা শোনেনি তবু এরই রেশ ধরে ১৯৭২ সালের বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনের আলোচনার ধারা মেনে ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশন গঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে কমিশন তার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রথম উচ্চারিত হয় — “দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন” বা “সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট” শব্দবন্ধ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন হল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটাবার ক্ষমতার সাথে আপস না-করে বর্তমানের প্রয়োজন মেটানো।” কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় “দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন” এর বাস্তবতা নেই। এই ব্যবস্থা বল্গাহীনভাবে আকরিক তুলবেই, বনাঞ্চল সাফ করবেই, জলাভূমি ভরাট করবেই। আগ্রাসী মুনাফাই তার লক্ষ্য।

মার্কস বলছেন, “মানুষ প্রকৃতির অংশ।” বলছেন, “পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিসাধন করে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বিপাকীয় মিথস্ক্রিয়াকে (metabolic interaction)”। (‘ক্যাপিটাল’ প্রথম খণ্ড) 

মানুষ প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। শরীরের কোশে কোশে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই খাদ্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াই বিপাকক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষ তার বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করে। এভাবেই মার্কস মানুষকে প্রকৃতির শরীরের অংশ হিসেবেই দেখেছেন। দরদ আর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী দৃষ্টি না থাকলে এমন বিরাট উদ্ভাবন করা যায় না, যা মার্কস করেছিলেন সেই সময়ে। 

ক্যাপিটাল এর তৃতীয় খণ্ডে মার্কস আবার উল্লেখ করলেন, ‘irrepairable rift’ এবং ‘social metabolism’ বা মানুষ-প্রকৃতির মধ্যে অপূরণীয় ফাটলের কথা। তিনি বললেন, “পারস্পরিক নির্ভরশীল সামাজিক বিপাকক্রিয়ায় অপূরণীয় ফাটল।” একালের স্বনামধন্য পরিবেশ শিক্ষক আমেরিকার অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক, বিশ্ববিশ্রুত পত্রিকা ‘মান্থলি রিভিয়্যু’-র সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার উল্লিখিত ‘metabolism’ এবং ‘rift’-কে, ‘metabolic rift’ করে জুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, এই metabolic rift-এর ধারণার মূলে রয়েছে মার্কসের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব (theory of alienation)।

“উৎপাদক হিসেবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষের নিজের থেকে বিচ্ছিন্নতা, তার প্রজাতির থেকে বিচ্ছিন্নতা, অন্য মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতা। metabolic rift বা বিপাকীয় ফাটল হল মানুষের জীবনের বস্তুগত শর্ত, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার বাস্তব অভিব্যক্তি।”

পরিবেশ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছে। যদি এই দ্বন্দ্ব অবৈরিতামূলক থাকা সম্ভব হয়, যদি মানুষ পৃথিবীর স্বীয় সম্পদের পুনরুৎপাদনের মধ্যে নিজের চাহিদাকে সীমাবদ্ধ করার শৃঙ্খলা রপ্ত করতে পারে তাহলে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি টিকবে। অন্যথায় যদি এই দ্বন্দ্ব বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে দাঁড়ায় তাহলে মনুষ্য প্রজাতির ভবিষ্যৎ নেই।

১৯৯২ সালের রিও ডি জেনিরোর বসুন্ধরা শীর্ষ সম্মেলন পৃথিবীর ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানোর ঘটনা। এই সম্মেলন এই গ্রহের বাস্তুতন্ত্রগত সংকটের সম্মুখীন হল। পৃথিবীর সব দেশ দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নকে সমর্থন জানাল। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার কথা বলল এবং তা করতে গেলে পৃথিবীর সম্পদের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনের কথা বলল।

আসলে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ থাকলেও এটা প্রাথমিকভাবে আদতে একটা অর্থনৈতিক ধারণা যা সংকীর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থের সেবা করে। 

দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন আর দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি একই কথা, এতে বাস্তুতন্ত্রকে বিবেচনা করা হয়। এতে প্ররোচিত করা হয় বাজারের মধ্যে পরিবেশের মূল্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে, নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক মূলধনের ক্ষতির হিসেব নিকেশ। বিশ্বের উৎপাদনের ৩% গড় বার্ষিক বৃদ্ধি মানে বিশ্বের উৎপাদন ২৩ বছরে দ্বিগুণ হয়। একটা শতাব্দীতেই ১৬% বৃদ্ধি। এমনকি এখনই এই চিহ্ন দেখা যাচ্ছে যে পৃথিবীর অর্থনীতি নির্দিষ্ট সংকট বিন্দু অতিক্রম করে গেছে। এই গ্রহ এই এক্সপোনেনশিয়াল বৃদ্ধি সহ্য করতে পারবে না।

তাহলে কি উন্নয়ন হবে না? তা কেন? আগে উন্নয়ন কথাটারই বিচার করতে হবে। কোন্ ধরনের উন্নয়ন পৃথিবীর মানুষ চায়, তার প্রয়োজন কী? সেটা পরিবেশের সঙ্গে কীভাবে সাযুজ্যপূর্ণ হয় সেটার বিচার করতে হবে।

পুঁজিবাদ পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় কোনায় কর্তৃত্ব করছে। এর সারমর্ম হল, একটা “সঞ্চয়ের” ব্যবস্থা যা সক্রিয় করে পুঁজির উৎপাদন এবং মুনাফা। মার্কস বলেছেন হয় পুঁজির সঞ্চয় কর নাহয় মরো। এই সঞ্চয়ের ভর্তুকি দিত বিশ্ব পরিবেশ, যার সম্পদ ক্রমান্বয়ে লুন্ঠিত হয়েছে। এখন আর সে ভর্তুকি দেবার জায়গায় নেই। পরিবেশ যেন একটা সরবরাহ উৎসে পরিণত হয়েছে যার থেকে যখন তখন যতখুশি সম্পদ নিষ্কাশন করা যায় এবং একটা সুবিশাল প্রশমন ক্ষেত্র যেখানে যত খুশি বর্জ্য নিক্ষেপ করা যায়। বিগত ৫০০ বছরের উন্নয়নের ইতিহাস আদতে অ-দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের ইতিহাস।

দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন মানে মানুষ বিশেষত গরিব মানুষ যা চায়, তার চাহিদা, তার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা। এ কখনও হয়নি। উন্নয়ন মানে তাই দাঁড়িয়েছে সীমাহীন অসাম্য, নির্লজ্জ এক শোষণের বন্দোবস্ত যার ফল আজকের আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত বিশ্ব বিপন্নতা।

এটাও গুরুত্বপূর্ণভাবে মনে রাখতে হবে যে মানুষ প্রকৃতির অংশ প্রকৃতির শোষণ তাই মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ। পরিবেশের অবক্ষয় তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অবক্ষয়। সবুজ পৃথিবী তৈরি করার সংগ্রাম তাই সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলেই আজকের এই বিপন্নতা। তাই এই সংগ্রাম সর্বাত্মক, এই সংগ্রাম আদতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, এই সংগ্রাম তাই শ্রেণি সংগ্রাম, এই সংগ্রাম জিততে হবে, নতুন পৃথিবী তৈরি করতে হবে। নাহলে এ বিশ্বে পরবর্তী প্রজন্মকে আনবার সব ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলব।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান