বিপন্ন শকুন

দিব্যেন্দু বিশ্বাস 

স্কুলে থাকতে বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম বহু পশু-পাখি নাকি আমাদের দেখার আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে — এরকম নয় যে, ডাইনোসরদের সময়কালের জীবজন্তু; আমাদের সময়েরই জীব-জন্তু বেশ কিছু নাকি প্রকৃতি তে আর নেই- আর কোনোদিন তাদের জীবন্ত অবস্থায় দেখা যাবে না। আমার বাবার কাছে গল্প শুনেছি বেশ কিছু পাখি যেসব নাকি বাবার ছোটোবেলায় অহরহ দেখা যেত, সেসব এই বয়সে এসে খুব একটা দেখতে পায় না বাবা। এরকমই একটা পাখি ছিল শকুন। শকুন ছোটোবেলায় দেখিনি আমি। শকুনের সাথে সবচেয়ে বেশি আলাপ হয়েছে আমার একটি বাংলা প্রবাদ বাক্যের মাধ্যমে, “শকুনের অভিশাপে গোরু মরে না“। এর অর্থ করলে যা দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে শকুনকে ‘দুশমন’ বানানো হয়েছে। পরে শুনেছিলাম কলকাতায় পার্ক সার্কাস এলাকায় বহু শকুন দেখতে পাওয়া যেত এক সময়, যদিও এখন আর সেসব চোখে পড়ে না। 

এরপর বন্য জীবজন্তুদের সংরক্ষণের ওপর গবেষণার সূত্রে আমি যোগ দিই দেরাদুনের ‘ভারতীয় বন্যজীব সংস্থান’-এ (Wildlife Institute of India)। এই সংস্থার গবেষক হয়েই বিগত সাড়ে চার বছর আমি মধ্যপ্রদেশের শকুনের ওপর গবেষণা করছি। ভারতে মোট ৯ রকমের শকুন দেখতে পাওয়া যায় – ইন্ডিয়ান ভালচার (Gyps indicus), হয়াইট-রাম্পড ভালচার (Gyps bengalensis), রেড-হেডেড ভালচার (Sarcogyps calvus), ইজিপ্সিয়ান ভালচার (Neophron percnopterus), হিমালয়ান গ্রিফন (Gyps himalayensis), ইউরেসিয়ান গ্রিফন (Gyps fulvus), সিনেরিয়াস ভালচার (Aegypus monachus), স্লেন্ডার-বিলড ভালচার (Gyps tenuirostris), এবং ল্যামারগিয়ার ভালচার (Gypaetus barbatus)। এর মধ্যে প্রথম সাতটি মধ্য-প্রদেশ অঞ্চলে পাওয়া যায়। প্রথম সাতটির মধ্যে আবার শেষের তিনটি মধ্যপ্রদেশে পরিযায়ী, অর্থাৎ এরা চিন, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলে বাসা বানায়, এবং শীতকালে মধ্যপ্রদেশ অঞ্চলে চলে আসে। 

নব্বইয়ের দশকে একটি গবেষণাপত্রে প্রথম বলা হয় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্ডিয়ান ভালচার, হয়াইট-রাম্পড ভালচার, এবং স্লেন্ডার-বিলড ভালচার এর সংখ্যা ৯৭-৯৯% হ্রাস পেয়েছে [১]। গবেষক মহলে হুলুস্থুলু পড়ে যায়। এরপর আর-একটি গবেষণাপত্রে দেখানো হয় যে শকুনের এই মারাত্মক সংখ্যা হ্রাসের কারণ হল গবাদি-পশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি ওষুধ — ডাইক্লফেনাক [২]। 

কিন্তু কীভাবে একটি ওষুধ, যা কিনা গবাদি-পশুতে ব্যবহৃত হয়, তা শকুনের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠল, সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। আসলে ডাইক্লফেনাক যখন কোনও গবাদি পশুর শরীরে প্রয়োগ করা হয়, তার অবশেষ রয়ে যায় সেই গবাদি পশুর শরীরে। এর পর সেই নির্দিষ্ট পশুটি মারা গেলে তাকে সাধারণত গ্রামের বাইরে বা জঙ্গলের ধারে কোথাও ফেলে দিয়ে আসাটাই প্রথা ভারতে। খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকা মৃত পশুটি শকুনদের নজরে এলে, ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন নেমে আসে সেই মৃত পশুটির মাংস খেতে আর এই মাংস খাওয়ার সময়েই মৃত পশুর দেহের অবশিষ্ট ডাইক্লফেনাক ঢুকে পড়ে শকুনের শরীরে। এই ডাইক্লফেনাক খাদ্য থেকে পর্যায়ক্রমে শকুনের রক্তের মাধ্যমে পৌঁছোয় কিডনিতে এবং শকুনের কিডনিকে অকেজো করে দেয়। ফলত শকুনটি মারা যায়। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে ৪৮ ঘণ্টার কম সময় লাগে এবং শকুনের শরীরে খুব অল্প মাত্রার ডাইক্লফেনাকও একটি শকুনকে মেরে ফেলতে সক্ষম। এবার একটু ভেবে দেখলে বোঝা খুব শক্ত নয় যে, একটি ডাইক্লফেনাক যুক্ত মৃত গোরু বা মোষকে যদি ৫০টি শকুন খেয়ে থাকে, তবে তাদের খাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওই ৫০ টি শকুন মারা যাবে। ভারতীয় উপমহাদেশে যেখানে গবাদি পশুর এত প্রাচুর্য, সেখানে রোজ কত গবাদি পশু মারা যায় এবং তার ফলে কত শকুন মারা যায়, তা একটি চিন্তার বিষয় তো বটেই। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই ভারত সরকার ২০০৬ সালে গবাদি পশুর ওপর ডাইক্লফেনাক এর প্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। যদিও এর পরেও বহু জায়গায় লুকিয়ে চুরিয়ে ডাইক্লফেনাক বেচা হয়েছে এমনকি মানুষের জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লফেনাকও গবাদি পশুর উপর প্রয়োগ করা হয় [৩]। 

ডাইক্লফেনাককেই ভারতে শকুনের সংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ মানা হলেও, অন্যান্য আরও বহু কারণে শকুনের মৃত্যু হয়ে থাকে। খাদ্যাভাব একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এই প্রসঙ্গে আর-একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে নেওয়া ভালো। শকুনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার কারণে, মৃত গবাদি পশুর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় উদ্বৃত্ত হতে থাকে। এর ফলে, যে সমস্ত পথ-কুকুর আমাদের পাশে ছিল তারা অতিরিক্ত খাদ্যের জোগান পেতে থাকে যার ফলস্বরূপ এদের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। কুকুরের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে এরা অন্যন্য বন্য জীব-জন্তুদের অস্তিত্বের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এছাড়া এই মাত্রাতিরিক্ত কুকুরের সংখ্যার জন্য ‘জলাতঙ্ক’ রোগের প্রকোপ বাড়ে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যেই সময় ভারতে শকুনের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে কমে যেতে থাকে সেই সময়েই (১৯৯৩-২০০৬) ভারতে শুধুমাত্র জলাতঙ্ক রোগের জন্য চিকিৎসা খাতে ভারতীয় মুদ্রায় ১০৪৬ বিলিয়ন টাকা খরচ হয় [৪]। 

শকুন আকারে বেশ বড়ো একটি পাখি। এর ফলে জমিতে বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ তাড়া খেলে একদম সঙ্গে সঙ্গে উড়তে পারে না, বরং এক দুই পা লাফিয়ে ধীরে ধীরে উড়তে আরম্ভ করে। এই কারণের জন্যই অনেক সময় দেখা গেছে যে রেল লাইনে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হওয়া পশুর মাংস খেতে বসা শকুন অপর আরেকটি দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে [৫]। এছাড়াও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও শকুনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া শকুনের বাসযোগ্য জঙ্গল ধীরে ধীরে শেষ যাওয়াও শকুনের বিলুপ্তির পথ ধীরে ধীরে প্রশস্ত করছে। এই বছরেই মার্চ মাসে আসামের ছায়গাও অঞ্চলে একদিনে ১০০টি হিমালায়ান গ্রিফনের মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ার ফলে[৬]। কীভাবে হল এই বিষক্রিয়া? স্থানীয় গ্রামবাসীরা বেশ কিছুদিন যাবৎ পথ-কুকুরদের জন্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এই কুকুরগুলি বেশ উপদ্রব চালাচ্ছিল তাঁদের গবাদি পশুর ওপর। এর ফলে কিছু মানুষ সেই উপদ্রব রুখতে মৃত পশুর লাশের সাথে বিষ মিশিয়ে ফেলে রাখেন কুকুরদের জন্য। কিন্তু, ওই মৃত পশুর মাংস খেতে ১০০ এর ওপর শকুন চলে আসে এবং মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে। 

এভাবেই আরও কত ঘটনা হয়তো ঘটে চলেছে কিন্তু তা আমাদের নজরে আসছে না। এছাড়াও, যে সমস্ত কারণগুলি ধীর গতিতে শকুনের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে সেগুলি আমরা আমল দিচ্ছি না। সমস্যা কোথায় হচ্ছে? প্রথমত আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য জনসাধারণের সচেতনতা বেশ অগভীর। যেটুকু বা সচেতনতা বা উৎসাহ আছে তার বেশিরভাগ রয়েছে বাঘ নিয়ে— বাঘের মহিমা এতটাই বড়ো করে দেখানো হয়েছে যে, বিভিন্ন জঙ্গলে যখন পর্যটকরা আসেন, তাঁরা মূলত বাঘ দেখার জন্যই আসেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। বাঘকে ‘umbrella species’-এর তকমা দিয়ে বহু পশুকে একসাথে সংরক্ষণ করার যে প্রথা আমরা মেনে আসছি আমাদের দেশে, তাকে বর্তমান সময়ে একবার খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি বাঘ সংরক্ষণের খাতে যত টাকা খরচ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে তত টাকা অন্যান্য প্রাণীর সংরক্ষণের জন্য মেলা ভার। এর ফলে, শকুন এবং আরও এরকম পশুপাখির সংরক্ষণের জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন তা পুরোপুরি ভাবে করা যাচ্ছে না। যদি, ঠিক মতো গবেষণা না হয়, তবে এই সমস্ত প্রাণীগুলির হারিয়ে যাওয়ার সঠিক ও সব কারণ বুঝে ওঠা যাবে না। ফলস্বরূপ সেসব অজ্ঞাত কারণ দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে না। অচিরেই আমরা হারিয়ে ফেলব আরও বহু প্রাণী। 

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন এবং সেসব গবেষণা করতে প্রয়োজন প্রচুর গবেষক। এখন সমস্যা হল, ভারতে বর্তমান শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, স্নাতকোত্তর যে সমস্ত গবেষকরা এই বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের জন্য নিজেদের জীবন সঁপে রেখেছে তাদের মাস গেলে যে ‘স্কলারশিপ’ দেওয়া হয় বছরের পর বছর, তা খুবই কম। কথায় বলে ‘খালি পেটে বিপ্লব হয়না’, তেমনি গবেষণার মান উন্নত করতে হলে আমাদের চাই প্রচুর উৎসাহী গবেষক, যারা নিজেদের পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব সহজেই কাঁধে নিতে পারবে— নয়তো এই গবেষণা শুধুমাত্র একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণির পেশা হয়েই থেকে যাবে। বহু শহুরে মানসিকতার গবেষক গ্রাম উচ্ছেদ করে দিয়ে বনজঙ্গল সংরক্ষণের খুব সহজ নিদান দিয়ে থাকেন। বহু জায়গায় এই ধরনের প্রচেষ্টা কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু, হিসেব কষে দেখলে খুব সহজেই দেখা যাবে, লাগামছাড়া চাহিদা ও ভোগবাদী জীবনযাত্রার কারণে শহুরে মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীদের উপর সিংহভাগ চাপ সৃষ্টি করছে। সুতরাং, আমাদের চাই এমন একটি সংরক্ষণের পন্থা যা দেশ ও সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করবে। 

শকুন একটি উদাহরণ মাত্র। আসলে আমাদের যা চাই — ১) সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে উৎসাহ; ২) সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিপূর্ণ মানসিকতা; ৩) গবেষণা খাতে বরাদ্দ অর্থের বহুলাংশে বৃদ্ধি। এর ফলে শুধু শকুন নয়, আরও বহু প্রাণী আমরা সংরক্ষণ করতে পারব যা আসলে আমাদের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, সমাজকেই পুষ্টি জোগাবে। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির বছরে এক প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষক হিসেবে দেশের তথা এই দেশের মানুষের সেবা এভাবেই করতে পারি বলে আমার ধারণা। 

তথ্যসূত্র :

১। Prakash, Vibhu, et al. ‘Catastrophic collapse of Indian white-backed Gyps bengalensis and long-billed Gyps indicus vulture populations’, Biological conservation 109.3 (2003): 381-390.

২। Green, Rhys E., et al. ‘Diclofenac poisoning as a cause of vulture population declines across the Indian subcontinent’,  Journal of Applied ecology 41.5 (2004): 793-800.

৩। https://pib.gov.in/newsite/PrintRelease.aspx?relid=127003

৪। Markandya, Anil, et al. ‘Counting the cost of vulture decline—an appraisal of the human health and other benefits of vultures in India’, Ecological economics 67.2 (2008): 194-204.

৫। ‘On a 3-km stretch in Pokhran, speeding trains kill 42 vultures in five weeks’, https://www.hindustantimes.com/jaipur/42-vulture-deaths-on-railway-tracks-in-pokhran-raise-concern/story-7T5AhJStLQnRiKr4jiVlrL.html 

৬। ‘Vultures in Assam die by pesticide poisoning targeting stray dogs’, https://india.mongabay.com/2022/04/vultures-in-assam-die-by-pesticide-poisoning-targeting-stray-dogs/

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান