বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সমাজনীতি

অতীশ চট্টোপাধ্যায়

বিশ্ব উষ্ণায়ন এই বসুধার কোনও রোগ নয়, এ এক রোগ লক্ষণ। সর্বব্যাপী এর প্রভাব মানব সভ্যতাকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলেছে। রোগ অনেক গভীরে। এই পৃথিবীর ভৌত পরিবেশে। মানব জমিনে। সে সম্পর্কে আলোচনার আগে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার দিকে চোখ রাখা যাক। পুরীর সমুদ্র উপকূলে হঠাৎই জেলিফিশের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাদের স্টিং আক্রমণে পর্যটকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মত, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রজলের উষ্ণতা বৃদ্ধি উপকূলবর্তী সমুদ্রজলে জেলিফিশের সংখ্যাবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জল তাদের পছন্দ। পাশের দেশ পাকিস্তানের জ্যাকোবাবাদ গত মে মাসে পৃথিবীর উষ্ণতম শহর হয়ে উঠেছিল। তাপমাত্রা ছাড়িয়েছিল ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা। যাঁরা তরমুজ খেতে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সূর্যকিরণে দগ্ধ হয়ে। অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ তাপের সংস্পর্শে থাকলে বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। ১৯৯০ সাল থেকে এরকম ৭০টি সমীক্ষা হয়েছে। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে সেপ্টেম্বর ২০২০-তে প্রকাশিত একটি মেটা-অ্যানালাইসিসের ফলাফলে দেখা গেছে প্রত্যেক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতাবৃদ্ধির জন্য মৃত সন্তান প্রসব এবং আগাম প্রসবের সংখ্যা ৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এধরনের কিছু ঘটনার উল্লেখ থেকেই বোঝা সম্ভব বিশ্ব উষ্ণায়ন কেন মানব সভ্যতার কাছে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এই সমস্যার সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে পৃথিবীর সব দেশ মিলে। পৃথিবী জুড়ে বহতা বাতাসের, বায়ুমণ্ডলের, সমুদ্র জলের বা আকাশের কোনও দেশ নেই। 

মানুষের ভূমিকা 

এখন দেখা যাক বিশ্ব উষ্ণায়নের কয়েকটি প্রাথমিক বিষয়। পৃথিবীতে শক্তির প্রধান উৎস হল সূর্য। সূর্য থেকে যে আলোকরশ্মি পৃথিবীতে পড়ে তার খানিকটা বরফ এবং মেঘে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায়। সূর্যরশ্মির বাকিটা ভূপৃষ্ঠ এবং বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়। এই শোষিত সৌরশক্তি পুনর্বিকিরিত হয় দীর্ঘ তরঙ্গ বা অবলোহিত রশ্মি রূপে। বায়ুমণ্ডল এই পুনর্বিকিরিত শক্তিকে শোষণ করে। এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শক্তি বায়ুমণ্ডল দিয়ে বেরোতে পারে না। বায়ুমণ্ডল তা শোষণ করে তাপশক্তি নির্গত করে। এই তাপ শক্তির কিছুটা মহাকাশে নির্গত হয়। বাকিটা বায়ুমণ্ডলে থেকে গিয়ে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। ভূপৃষ্ঠের এই উষ্ণতা বৃদ্ধিকেই বলা হয় বিশ্ব উষ্ণায়ন বা বসুধা উষ্ণায়ন। বায়ুমণ্ডলের এই ধর্মের জন্য দায়ী কয়েকটি গ্যাসীয় পদার্থ। যেমন জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি। এই গ্যাসের অণু পুনর্বিকিরিত শক্তি শোষণ করে চারিদিকে তাপ নির্গত করে। ফলে সেই তাপ নীচের দিকেও নামে। ফলে ভূপৃষ্ঠ এবং বায়ুমণ্ডলের নিম্নভাগ উষ্ণ হয়ে ওঠে। বায়ুমণ্ডলের এই ধর্ম ছাড়া ভূ-পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা এখনের থেকে ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কম হত। ফলে পৃথিবীতে জীবজগতের উপস্থিতি সম্ভব হত না। কিন্তু মানুষের ক্রিয়াকলাপের (অ্যান্থ্রোপজেনিক) ফলে এই গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ছে বায়ুমণ্ডলে। আর তার ফলেই পৃথিবী বেশি গরম হয়ে উঠছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মানমন্দিরের মাপ অনুযায়ী গড় কার্বন ডাই অক্সাইড ঘনত্ব ১৯৫৯ সালে ৩১৬ পি পি এম থেকে ২০১৯ সালে ৪১১ পি পি এম হয়েছে। শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময় থেকে বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ৪০%, মিথেন ১৫০%, নাইট্রাস অক্সাইড ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইডের অর্ধেক বৃদ্ধি ঘটেছে ১৯৭০ সালের পর। দক্ষিণ মেরুর বরফের গভীরে আটকে থাকা বাতাস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে শুরু করেছে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। তার আগের ১০,০০০ বছরে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ২৬০ থেকে ২৮০ পি পি এম -এর মধ্যে। তার আগের ৮০০,০০০ বছরে অনেকগুলি বরফের যুগের চক্রেও তা ছিল ১৭০-৩০০ পি পি এম এর ভিতরে। এই ঘনত্ব কখনোই ৩০০ পি পি এম-এর উপরে ওঠেনি বিগত ২০০ বছরের আগে। এসবই দক্ষিণ মেরুর বরফের গভীরে আটকে থাকা বায়ু পরীক্ষা করে পাওয়া তথ্য।

বর্তমান বায়ুমণ্ডলে কার্বন সমস্থানিক (আইসোটোপ) পরিমাপ করে ‘পুরানো’ কার্বনের ছাপ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে যে কার্বন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হচ্ছে তার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। জীবজগৎ থেকে আসা ‘নতুন’ কার্বনের থেকে। বর্তমানে প্রতিবছর মানুষ প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে ১০ বিলিয়ন টন কার্বন বাতাসে যুক্ত করছে। এসব থেকেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি মূলত মানুষের কাজকর্মের ফসল (অ্যান্থ্রোপজেনিক)।

জলবায়ু পরিবর্তন 

পৃথিবীর গড় পৃষ্ঠ তাপমাত্রার পরিমাপ করা খুবই কঠিন। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে লক্ষ লক্ষ বার তাপমাত্রার পরিমাপ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে স্থলকেন্দ্র, সমুদ্রের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানকারী জাহাজ, কৃত্রিম উপগ্রহ। বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন দল পৃথকভাবে এবং সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ১৯০০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। যদিও এই সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কখনও কিছু সময় থেমে থেকেছে, কখনও বা দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু গত চার দশক উষ্ণতর থেকেছে ১৮৫০ সালের পর থেকে। এই সময় থেকেই যন্ত্রের মাপা তথ্য পাওয়া যায়।

কিন্তু যখন নির্ভুল থার্মোমিটার সর্বত্র কাজে লাগানো যেত না, সে সময়ের কথা কীভাবে জানা সম্ভব। সেই সময়ের তাপমাত্রার পুনর্নির্মাণ করা হয় জলবায়ু-স্পর্শকাতর বিভিন্ন সূচক ‘প্রক্সিস’ থেকে। যেমন গাছের কাঠের মধ্যে উপস্থিত গোলাকার রেখা বা দাগ (ট্রি রিং), বরফের গভীর অভ্যন্তর (আইস কোর) বা সমুদ্র তলদেশের অধঃক্ষেপ (মেরাইন সেডিমেন্টস)। এসব থেকে অনুমিত সেসময় পৃথিবীর তাপমাত্রার সঙ্গে বর্তমানের তাপমাত্রার তুলনা করলে দেখা যায় ১৯৮০ থেকে শুরু হওয়া বিগত ৪০ বছর গত আট শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে গরম। এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একটি বৃদ্ধির চূড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যা দেখা গিয়েছিল বিগত ৫০০০-১০,০০০ বছরের মধ্যে। যা ছিল বর্তমান আন্তঃবরফ যুগের (ইন্টারগ্লেসিয়াল পিরিয়ড) সবচেয়ে গরম সময়।

ভূ-উষ্ণায়নের রসায়ন 

মানুষের হাতে যে তথ্য আছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে ভূ-উষ্ণায়ন হচ্ছে এবং তা আগের থেকে দ্রুত গতিতে। তাই মানব সভ্যতার সময় সারণিতে (হিউম্যান টাইম স্কেল) অপরিবর্তনীয় এবং নাটকীয় পরিবর্তন রোধ করতে গেলে বিশ্বজুড়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বায়ুমণ্ডলে কিছু কিছু পদার্থের নিঃসরণ তৈরি করে গ্রিন হাউস এফেক্ট। যার ফলে ঘটছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই সব পদার্থের নিঃসরণ ঘটে প্রাকৃতিকভাবে। যেমন জীবদেহে তৈরি মিথেন গ্যাস, বিশেষ করে সমুদ্রের জীবমণ্ডলে। কোনও কোনও সময় তা মানুষের ক্রিয়াকর্মের দরুন তৈরি হয়। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে তৈরি কার্বন ডাই অক্সাইড। মার্কিন শক্তি দপ্তরের তথ্য মোতাবেক জীবাশ্ম জ্বালানি দহনে তৈরি কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১৯০০ সালের পর ১০ গুণ বেড়েছে। এ ছাড়াও অন্য বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থও গ্রিন হাউস এফেক্ট ঘটিয়ে ভূ-উষ্ণায়ন বাড়ায়। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের দ্রাবক, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, অন্যান্য উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিক যৌগসমূহ (ভি ও সি), নাইট্রোজেন এবং সালফার অক্সাইডস। এর কোনও কোনোটির ভূ-উষ্ণায়ন ঘটানোর ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকেও বেশি। কিন্তু উৎপাদন এবং বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এদের মধ্যে নাইট্রোজেন অক্সাইডগুলি আবার কার্বন ডাই অক্সাইডের সঙ্গে একইসঙ্গে উৎপাদিত হয় জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের সময়। ইউরোস্ট্যাট ই ইউ ২৮, ২০১২-র জন্য যে তথ্য দিয়েছিল তাতে দেখা গেছে, শক্তি উৎপাদনের জন্য ৫৮ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ঘটে। পরিবহণের দরুন তৈরি হয় ২২ শতাংশ। শিল্পোৎপাদন এবং কৃষির ফলে তৈরি হয় যথাক্রমে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ।

কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি শুধু জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় এমন নয়। এর ফলে অম্ল-ক্ষার ভারসাম্যেরও পরিবর্তন ঘটে। তবে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড রাসায়নিকভাবে তেমন সক্রিয় নয়। তাই এমন প্রশ্ন হতেই পারে যে পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থায়, বিশেষ করে মানুষের কার্যকলাপের দরুন জলবায়ুর পরিবর্তনে রসায়নের ভূমিকা কী থাকতে পারে?

এর উত্তর বহুমুখী। প্রথমত, কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া বেশ কিছু রাসায়নিকভাবে সক্রিয় দ্রব্যের নিঃসরণ বায়ুমণ্ডলে ঘটে মানুষের কাজকর্মের ফলে। তাদের মধ্যে রয়েছে মিথেন, হ্যালোকার্বনস্‌, মিথেন ছাড়া অন্যান্য হাইড্রোকার্বনস্‌ (এম এইচ সি) এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডস্‌। কার্বন ডাই অক্সাইড রহিত এই নিঃসরণগুলির জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অবদান কার্বন ডাই অক্সাইড সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের (ক্লাইমেট ফোর্সিং) মতোই। বিকিরণ বাধ্যকরণ (রেডিয়েটিভ ফোর্সিং) -এর পরিমাপ থেকেই একথা প্রতীয়মান। কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণের দরুন ধনাত্মক বিকিরণ বাধ্যকরণ পরিমাপ করা হয়েছে প্রায় ১.৬৮ ওয়াট প্রতি বর্গমিটার। কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া অন্যান্য বিকিরণে সৃষ্ট এই বিকিরণ বাধ্যকরণ ১.৬৫ ওয়াট প্রতি বর্গমিটারের মতো। অন্যদিকে, এরোসল (বাতাসে ভাসমান তরল ও কঠিনের সংমিশ্রণ) এবং মেঘ ঘটাচ্ছে ঋণাত্মক বিকিরণ বাধ্যকরণের প্রায় ৫০ শতাংশ। যদিও বিভিন্ন এরোসলের বাতাসকে উষ্ণ কিংবা শীতল করার ক্ষমতা সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীরা অনিশ্চিত। ঝুল-কালি (সুট), ধুলো (ডাস্ট) এবং শোষক জৈব যৌগ কীভাবে উষ্ণায়নকে প্রভাবিত করে তা এখনও নিশ্চিত নয়। কোনও কোনও এরোসল বায়ুতে সরাসরি নিঃসৃত হয়। কোনটা আবার বায়ুমণ্ডলেই তৈরি হয় একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার সারণির মাধ্যমে। যা শুরু হয় বিভিন্ন উদ্বায়ী গ্যাসের জারণের মাধ্যমে। ওজোন আরও একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। যা তৈরি হয় বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। যেসব বিক্রিয়ার উদ্বায়ী জৈব যোগ (হাইড্রোকার্বন) গৃহীত হয় এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড সমূহ উৎসেচক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সমস্ত নিঃসরণ বায়ুমণ্ডল থেকে দূরীভূত হয় বিভিন্ন জারক দ্রব্যের মাধ্যমে। যার মধ্যে রয়েছে ও এইচ র‍্যাডিক্যাল, নাইট্রেট র‍্যাডিক্যালস্‌ (তড়িতাধান যুক্ত যৌগ) এবং ওজোন। এদের ওপর নির্ভর করে বায়ুমণ্ডলের নিজেকে পরিষ্কার (ক্লিনজিং) করার ক্ষমতা। আর এসবের উপর নির্ভর করে বায়ুমণ্ডল কতটা তপ্ত কিংবা শীতল হবে।

দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বহুমুখী। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যগুলি হল – সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন, খরা, চরম আবহাওয়া ও অন্যান্য। রসায়ন এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠনের প্রভাব পড়ে আরও অনেক দিক থেকে। বায়ুমণ্ডলের গুণমান নিম্নগামী হলে তার ফলে জারন ক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটে। আবহাওয়ার প্রবাহ চরিত্রের বদল ঘটে। এরোসলের উপস্থিতি, পরিমাণ ও গুণমান বিকিরণ বাধ্যকরণ ও বৃষ্টিপাত চরিত্রের মূল নির্ধারক হয়ে ওঠে।

তৃতীয়ত, কার্বন ডাই অক্সাইড রহিত অন্যান্য গ্যাস এবং এরোসলের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন নানাভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। মূল প্রশ্ন হল, নিঃসৃত পদার্থ বায়ুমণ্ডলে কতক্ষণ স্থায়ী হয় সম্পূর্ণভাবে অপসারিত বা অন্য পদার্থে রূপান্তরিত হওয়ার আগে। কোথায় এবং কীভাবে সেইসব পদার্থ শোষণ এবং বিচ্ছুরণ ঘটায় অতিবেগুনি, দৃশ্যমান এবং অবলোহিত রশ্মির। কী ভাবেই বা সেগুলি বায়ুমণ্ডলে অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের স্থায়িত্ব এবং ধর্মাবলির পরিবর্তন ঘটায়।

চতুর্থত, ভুবন উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং এর সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার যে কোনও ধরনের মানব পদক্ষেপ গ্রহণে রসায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার মধ্যে রয়েছে বহুল আলোচিত ‘সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনা’ (সোলার রেডিয়েশন ম্যানেজমেন্ট) বা ‘ভূ-কারিগরিবিদ্যা’ (জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং)।

কিছু সম্ভাব্য পরিকল্পনা

পার্থিব ব্যবস্থা (আর্থ সিস্টেম) একটি খুবই সংযোজিত ব্যবস্থা। পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনা এবং বিষয় একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির দহন সুনির্দিষ্টভাবেই মানবসৃষ্ট (অ্যান্থ্রোপজেনিক) জলবায়ু পরিবর্তনের মূলে রয়েছে। তাই ভূ-উষ্ণায়ন এবং অবাঞ্ছিত জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপগুলি বায়ুমণ্ডলের গুণমানের (এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকবে। ওজোন ক্ষয়কারী (ওজোন ডিপ্লিটিং) রাসায়নিকগুলি (ও ভি এস-গুলি) শুধু ওজোন স্তরেরই ক্ষতি করে না, তারা বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাও বাড়ায় (গ্রিন হাউজ গ্যাস)। তাই ও ভি এস-গুলির নির্গমন নিয়ন্ত্রণ শুধু ওজোন স্তরে স্বাস্থ্যোদ্ধারেই সাহায্য করে না, তা জলবায়ুকে স্বাভাবিক রাখতেও সাহায্য করে। ট্রোপোস্ফিয়ারে উপস্থিত ওজোন নিজেও একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। ফলে তা নিজেও বায়ুমণ্ডলকে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট হাইড্রোকার্বনগুলি ট্রোপোস্ফিয়ারে বর্তমানে উপস্থিত এবং ভবিষ্যৎ ওজোন স্তর নিরূপণে মুখ্য ভূমিকা নেবে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ চরিত্র ট্রোপোস্ফিয়ারে ওজোন স্তরের পরিবর্তন ঘটাবে। তা প্রভাব ফেলবে আঞ্চলিক এবং পৃথিবীব্যাপী বায়ুমণ্ডলের গুণমানে।

বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইডের স্থায়িত্ব খুবই বেশি। বায়ুমণ্ডলে তা কয়েক শতাব্দী ধরে থেকে যায়। ফলে তার প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হয়। পক্ষান্তরে রাসায়নিকভাবে সক্রিয় পদার্থগুলির স্থায়িত্ব কম। তাই এইসব পদার্থের বায়ুমণ্ডলে নির্গমন কমাতে পারলে তা জলবায়ু ব্যবস্থায় দ্রুত প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হবে। তাই বর্তমানে এই অপেক্ষাকৃত ক্ষণস্থায়ী উপাদানগুলির দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের পন্থা পদ্ধতিতে। ভূ-উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে রসায়নের গুরুত্ব একারণেও বাড়ছে।

বিগত কয়েক দশকে জলবায়ুর চরিত্র নির্ধারণে এরোসলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। পৃথিবীতে আগত সূর্যকিরণের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন, মেঘ ও বৃষ্টিপাতের উপর প্রভাব বিস্তার এবং পৃথিবীর বিকিরণ ভারসাম্য রক্ষায় এরোসলের ভূমিকা নতুন দিশা দেখাচ্ছে। কারণ এখন মনে করা হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস সৃষ্ট ধনাত্মক জলবায়ু বাধ্যকরণের বিপক্ষে কাজ করছে এরোসল। অর্থাৎ কি না তা পৃথিবীকে কিছুটা শীতল করার কাজ করছে। কিন্তু নীতি নির্ধারণের সময় এরোসলকে দূষণকারক হিসাবেই দেখা হয়। কারণ মানবশরীরের উপর তাদের বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও এরোসল বর্তমানে বায়ুমণ্ডলীয় রসায়নের (অ্যাটমস্ফেরিক কেমিস্ট্রি) গবেষণায় একটি বহু চর্চিত বিষয় এরোসলে বৈচিত্র্যের জটিলতা বিজ্ঞানীদেরও বিচলিত করছে।

বায়ুমণ্ডলের শেষ দুই স্তর আয়নোস্ফিয়ার ও মেসোস্ফিয়ার এর ভর তুলনায় খুবই কম। কিন্তু তারাও জলবায়ু পরিবর্তনে সাড়া দেয়। বায়ুমণ্ডলের এই সব অঞ্চলের রসায়নকেও তাই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে বসুধা উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন বা নিয়ন্ত্রণের কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে।

মানব সৃষ্ট (অ্যান্থ্রোপজেনিক) ভূউষ্ণায়নে বর্তমানে সবচেয়ে বড়ো উপাদান হল বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। তাই বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন নিয়ন্ত্রণ হল এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জৈবিক জ্বালানির (বায়ো ফুয়েল) মাধ্যমে প্রতিস্থাপন এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জৈবিক জ্বালানির দহনেও কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়। কিন্তু তা সাম্প্রতিক অতীতে বায়ুমণ্ডল থেকেই বিভিন্ন জীব দ্বারা গৃহীত হয়েছে। ফলত তা ভারসাম্য রক্ষা করছে। এর সঙ্গে ভূমি এবং জল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সমাজকে সুবিবেচকের ভূমিকা নিতে হবে। দেখতে হবে খাদ্যদ্রব্য যেন কোনোভাবেই শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত না হয়। তাই এখন জৈবিক জ্বালানি তৈরি করা হচ্ছে অভোজ্য তেল বা চর্বি জাতীয় দ্রব্য এবং বর্জ্য দ্রব্য থেকে। ব্যবহার করা হচ্ছে বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রের জল জোয়ার ভাটা এবং সৌরশক্তি।

বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথককরণেও নেওয়া হচ্ছে নানা কৌশল। উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড-কে নিজের কাজে লাগায় এবং তাদের প্রয়োজন মতো জৈবযৌগ তৈরি করে। তাই বনভূমির ক্ষয় এবং মরুকরণ রোধ, অরণ্যের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথক-করণে বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক পদ্ধতির কথাও ভাবা হচ্ছে। সমুদ্রে লৌহ যোগ করা, বিভিন্ন খনিজের কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথক করার ক্ষমতা খতিয়ে দেখা, বিভিন্ন সছিদ্র ভূ-স্তরীয় কাঠামোয় কার্বন ডাই অক্সাইড প্রবেশ করানো (ইনজেক্ট) এবং প্রতিদিনের ব্যবহার্য দ্রব্য তৈরিতে কার্বন ডাই অক্সাইড-কে অন্যতম কাঁচা মাল হিসাবে ব্যবহারের কথাও ভাবা হচ্ছে।

সমাজনীতি

এখানে যে-সমস্ত কৌশলের কথা আলোচিত হল সেগুলি সবই সামাজিক এবং সমাজগ্রাহ্যভাবে নিতে হবে। কেননা এই সমস্যার সমাধান এককভাবে বা নীতি নির্ধারকদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর ব্যাপ্তি ভবিষ্যত জীবন ধারণের পদ্ধতিতে কিছু বদল নিয়ে আসবে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সমাজগুলি তাদের বর্তমান জীবন মানের অবনমনের সঙ্গে আপস করতে চাইবে না। উন্নয়নশীল বা অনুন্নত সমাজ বা দেশগুলিকেও ভৌত উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে, এও গ্রাহ্য হবে না। তাই নীতি যতই গৃহীত হোক না কেন তা সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়িত হবে না। বসুধা উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই তাই কোনও না কোনোভাবে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে। যে কোনও পদক্ষেপকে সমাজগ্রাহ্য করে তোলার পদ্ধতিও মানুষকে শিখতে হবে। এই সমস্যার কোনও রাষ্ট্র নেই, রাজ্য নেই, ধর্ম নেই, গোষ্ঠী নেই। তাই চলার পথে রাষ্ট্র বিলীন হয়ে যাবে কি না, মুক্ত উৎপাদকদের সমাজ পৃথিবী দেখবে কি না তা ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। তবে মানুষকে তো মানবিক হয়ে উঠতে হবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান