বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থাই সৃষ্টি করছে জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট

সহদেব

পৃথিবীতে বর্তমানে চলছে ষষ্ঠ প্রজাতি গণবিলুপ্তি। এইরকম প্রজাতি গণবিলুপ্তি আগেও ঘটেছে পাঁচবার। আগের পাঁচবারের প্রজাতি গণবিলুপ্তিতে মানবজাতির অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমান প্রজাতি গণবিলুপ্তি চলছে মানবজাতির উপস্থিতিতে। শুধুমাত্র মানবজাতির উপস্থিতে এমন নয়। মানবজাতি এই প্রজাতি গণবিলুপ্তির শিকার হবে কিনা সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।

মানবজাতি প্রজাতি গণবিলুপ্তির শিকার হবে কিনা এনিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত কিছু বলেননি। তবে বিজ্ঞানীরা যে বিষয়ে নিশ্চিত তা হল প্রজাতি গণবিলুপ্তিতে মানবজাতির সক্রিয় ভূমিকা থাকছে। অর্থাৎ মানবজাতির সক্রিয়তার কারণে ঘটছে বা বলা যায় ত্বরান্বিত হচ্ছে ষষ্ঠ প্রজাতি গণবিলুপ্তি।

প্রজাতি গণবিলুপ্তি (Mass Extinction of Species) পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রজাতির গণবিলুপ্তি বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই সময়ের বেঁচে থাকা প্রজাতিগুলির ৭৫%-এর বিলুপ্তি। প্রথম পাঁচটি প্রজাতি বিলুপ্তিতে বিশ্বের সেই সময়ের বেঁচে থাকা প্রজাতিগুলির ৭৫% থেকে ৯০% বিলুপ্ত হয়েছে। এই প্রজাতি বিলুপ্তির সবকটির নেপথ্য কারণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সেই সময়ের তাপমাত্রা পরিবর্তনকে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষত শেষ তিনটি প্রজাতি বিলুপ্তিতে পৃথিবীতে অগ্নুৎপাতের কারণে অথবা অন্যান্য কারণে ভূপৃষ্ঠের বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা বহু প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়েছে।

বর্তমানকালের ষষ্ঠ প্রজাতি গণবিলুপ্তির মধ্যেও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি অন্যতম বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি বর্তমান ষষ্ঠ প্রজাতি গণবিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির নাম দেওয়া হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন।

বিশ্ব উষ্ণায়ন হল ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। ভূ-পৃষ্ঠ বলতে ভূমি এবং জল— সমগ্র উপরিতলকেই বোঝায়। বিশ্ব উষ্ণায়নে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হচ্ছে ভূমি ও জলতল সর্বত্রই। তাপমাত্রা বৃদ্ধি বলতে বোঝায় সময়ের নির্দিষ্ট অতীত কোনও বিন্দুর তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা কতটা।

বিজ্ঞানীরা বলছেন ১৮৫০ সালের তুলনায় ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমান কালে প্রায় ১° সেন্টিগ্রেড (০.৯৯) বেড়েছে। কেন এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর তার কী ফল তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে।

কার্বন ডাই অক্সাইড ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ধরে রাখে। কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া অন্য গ্রিন হাউস গ্যাস একই কাজ করে। গ্রিন হাউস গ্যাস না থাকলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা হত মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রিন হাউস গ্যাসের উপস্থিতির কারণে পৃথিবীর বর্তমান গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়লে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। এই প্রক্রিয়াকে বলে গ্রিন হাউস এফেক্ট। আর কার্বন ডাই অক্সাইডকে বলে গ্রিন হাউস গ্যাস।

কার্বন ডাই অক্সাইড হল গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ উপাদান। অন্য যে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলি আছে সেগুলি হল মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং ক্লোরোফ্লুরো কার্বন। এর মধ্যে প্রায় সবকটির নির্গমন বাড়তে থাকে কয়লা এবং পেট্রোলিয়ামের মত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বাড়তে থাকলে।

জীবাশ্ম জ্বালানি হল তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। কয়লা এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। বর্তমানে বিশ্বের তাপমাত্রা যে ১° সেন্টিগ্রেড বেড়েছে তার মধ্যে ০.৩° সেন্টিগ্রেড আসে কয়লা পুড়িয়ে। তথ্যে প্রকাশ ২০১৮ সালে কার্বন ডাই অক্সাইডের ৮৯%-এর নির্গমন হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং শিল্প থেকে। জ্বালানি তেল ব্যবহার করেও কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে তুলনায় কার্বন ডাই অক্সাইড কম নির্গত হয়।

গ্রিন হাউস গ্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে আবার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অংশ হল কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। যে দেশগুলি গ্রিন হাইস গ্যাস নির্গমনে শীর্ষে আছে তারাই স্বাভাবিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে শীর্ষে আছে।

কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে ২০২০ সালে (million metric tons) যে দেশগুলি শীর্ষে আছে তাদের প্রথম দশটি দেশের নাম নীচে দেওয়া হল। উৎস : World Population Review। দেশগুলির মোট কার্বন নির্গমন এবং বিশ্বে তার শতাংশের পরিমাণ দেওয়া হল :

১। চিন                  ১১৬৮০.৪২        ৩২.০%

২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র     ৪৫৩৫.৩০        ১২.৬%

৩। ভারতবর্ষ              ২৪১১.৭৩         ৬.৬%

৪। রাশিয়া                 ১৬৭৪.২৩          ৪.৫%

৫। জাপান                 ১০৬১.৭৭          ২.৯%

৬। ইরান                     ৬৯০.২৪           ১.৯%

৭। জার্মানি                  ৬৩৬.৪৪           ১.৭%

৮। দঃ কোরিয়া              ৬২১.৪৭           ১.৭%

৯। সৌদি আরব            ৫৮৮.৮১          ১.৬%

১০। ইন্দোনেশিয়া          ৫৬৮.২৭           ১.৫%

——————————————————

                                               মোট = ৬৭%

অর্থাৎ বিশ্বে মোট যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয় তার ৬৭% আসে মাত্র দশটি দেশ থেকে। আর এই দেশগুলির উপরিতল পৃথিবীর মোট উপরিতলের মাত্র ৯.০১%। নীচে তার হিসাব দেওয়া হল:

১। চিন                        ১.৮৮%

২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র         ১.৮৭%

৩। ভারতবর্ষ                ০.৬৪%

৪। রাশিয়া                   ৩.৩৫%

৫। জাপান                      ০.৭%

৬। ইরান                       ০.৩২%

৭। জার্মানি                    ০.০৭%

৮। দঃ কোরিয়া               ০.০২%

৯। সৌদি আরব              ০.৪২%

১০। ইন্দোনেশিয়া            ০.৩৭%

—————————————-

                            মোট = ৯.০১%  

যে দশটি দেশ কয়লা ব্যবহারে শীর্ষে আছে তাদের নাম নীচে দেওয়া হল। উৎস Worlometer, 2022, বিশ্বের মোট ব্যবহারের শতাংশে:

১। চিন                     ৫০.৫%

২। ভারতবর্ষ               ১১.৩%

৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র        ৮.৫%

৪। জার্মানি                   ৩.০%

৫। রাশিয়া                    ২.৭%

৬। জাপান                    ২.৫%

৭। দঃ আফ্রিকা              ২.৪%

৮। দঃ কোরিয়া               ১.৮%

৯। পোল্যান্ড                   ১.৭%

১০। অস্ট্রেলিয়া                ১.৫%

এই দশটি দেশ একত্রে বিশ্বে মোট ব্যবহত কয়লার ৮৫.৯% ব্যবহার করে।

যে দশটি দেশ জ্বলানি তেল ব্যবহারে শীর্ষে তাদের নাম নীচে দেওয়া হল। উৎস Worldometer, বিশ্বের মোট ব্যবহারের শতাংশে :

১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র       ২০.৩%

২। চিন                      ১৩.২%

৩। ভারতবর্ষ                 ৪.৬% 

৪। জাপান                    ৪.১%

৫। রাশিয়া                    ৩.৭%

৬। সৌদি আরব             ৩.৪%

৭। ব্রাজিল                    ৩.১%

৮। দঃ কোরিয়া              ৩.১%

৯। কানাডা                   ২.৬%

১০। জার্মানি                 ২.৫%

এই দশটি দেশ একত্রে মোট জ্বালানি তেল ব্যবহারের ৬০.২% ব্যবহার করে।

যে দশটি দেশ প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে বিশ্বে শীর্ষে তাদের নাম নীচে দেওয়া হল। উৎস World Population Review, বিশ্বে মোট ব্যবহারের শতাংশ :

১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র             ২১.৭%

২। রাশিয়া                        ১২.৪%

৩। চিন                             ৫.৪%

৪। ইরান                            ৫.২%

৫। জাপান                         ৩.৫%

৬। কানাডা                        ৩.২%

৭। সৌদি আরব                  ২.৯%

৮। জার্মানি                        ২.৩%

৯। মেক্সিকো                       ২.২%

১০। ইউ. আ. আমিরশাহি     ২.১%

এই দশটি দেশ একত্রে বিশ্বে মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের ৬১% ব্যবহার করে ।

দেখা যাচ্ছে কেবলমাত্র দশটি দেশ বিশ্বের মোট কার্বন ফুটপ্রিন্টের ৬৭%-এর জন্য দায়ী। প্রায় ওই একই দেশ কয়লা ব্যবহারের ৮৫%, জ্বালানি তেলের ৬০.২% এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ৬১% ব্যবহারের জন্য দায়ী।

মোটামুটিভাবে বিশ্বের এই দশটি দেশই Nominal GDP-তে বিশ্বের শীর্ষে। IMF-এর ২০২২ সালের সম্ভাব্য হিসেব অনুযায়ী Nominal GDP-র (মার্কিন ডলার) শীর্ষে থাকা দশটি দেশের নাম নীচে দেওয়া হল :

১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র      ২৫৩৪৬৮০৫

২। চিন                     ১৯৯১১৫৯৩

৩। জাপান                    ৪৯১২১৪৭

৪। জার্মানি                    ৪২৫৬৫৪০

৫। ভারতবর্ষ                 ৩৫৩৪৭৪৩

৬। যুক্তরাজ্য                 ৩৩৭৬০০৩

৭। ফ্রান্স                       ২৯৩৬৭০২

৮। কানাডা                     ২২২১২১৮

৯। ইতালি                     ২০৫৮৩৩০

১০। ব্রাজিল                   ১৮৩৩২৪৭

GDP-তে শীর্ষে থাকা, কার্বন নির্গমনে শীর্ষে থাকা এবং কয়লা তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস নির্গমনে শীর্ষে থাকা দেশগুলি একত্রে সারণি : ১-এ দেওয়া হল। দেখা যাচ্ছে বিশ্বের কয়েকটি মাত্র দেশ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ঘটিয়ে গ্রিন হাউস এফেক্টের মাধ্যমে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে। আর এই বিশ্ব উষ্ণায়ন জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সমগ্র বিশ্বের সামনে হাজির করেছে। 

সারণি : ১ থেকে দেখা যাচ্ছে যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে শীর্ষে থাকা দশটি  দেশের মধ্যে পাঁচটি nominal GDP-তে শীর্ষে থাকা দশটি দেশের মধ্যে আছে। এগুলি হল চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতবর্ষ, জাপান এবং জার্মানি। বাকি দেশগুলিও nominal GDP-তে প্রথম ১১ থেকে ১৮ দেশের মধ্যে আছে। কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে যে দশটি দেশ শীর্ষে আছে তারা nominal GDP-তে বিশ্বে কীরকম স্থানে আছে তা নীচে দেওয়া হল :

১। চিন                    ২

২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র     ১

৩। ভারতবর্ষ            ৫

৪। রাশিয়া              ১১

৫। জাপান               ৩

৬। ইরান                ১৪

৭। জার্মানি               ৪

৮। দঃ কোরিয়া        ১২

৯। সৌদি আরব       ১৮

১০। ইন্দোনেশিয়া     ১৭

এই দেশগুলির মধ্যে ইরান বাদ দিয়ে বাকি দেশগুলি সবই G20 গোষ্ঠীভুক্ত। G20 গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি বিশ্বের অন্যতম ধনী, উন্নয়নের শীর্ষে থাকা দেশ। বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে এই দেশগুলিই। অথচ এইসব দেশের কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ ঘটে চলেছে। এবং এই বিপদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

Paris School of Economics প্রকাশিত World Inequality Report 2022 বিশ্বে কার্বন নির্গমনের আঞ্চলিক হিসাব দিয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী ১৮৫০- ২০২০ সাল পর্যন্ত বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়েছে ২৪৫০ বিলিয়ন টন। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং চিনের অবদান যথাক্রমে ২৭%, ২২% এবং ১১%। এই অঞ্চল থেকে মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের ৬০% নির্গত হয়। এই অঞ্চল পৃথিবীর ভৌগোলিক অঞ্চলের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর মোট উপরিতলের ৮.৬৮%, পৃথিবীর মোট ভূমির ২৯%। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া এবং অন্যান্য এশিয়া যথাক্রমে ৯%, ৯% এবং ৬% কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী। অর্থাৎ এই অঞ্চল থেকে বিশ্বের মোট কার্বন নির্গমনের ২৪% আসে। উপরের দুটি অঞ্চল থেকে একত্রে বিশ্বের মোট কার্বন নির্গমনের ৮৪% আসে। বাকি ১৬% আসে যে অঞ্চলগুলি থেকে সেগুলি হল লাতিন আমেরিকা ৬%, মধ্য প্রাচ্য ৬% এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা ৪%।

বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে এমন ভাবেই যে কিছু সংখ্যক দেশ আর্থিকভাবে এগিয়ে। কিছু সংখ্যক দেশ বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে অধিক সম্পদ এবং আয়ের অধিকারী। এই আর্থিক বৈষম্য বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। মোটামুটিভাবে এই দশটি দেশের জন্য সমগ্র বিশ্ব আজ বিপদের সম্মুখীন। বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা যদি-না-এমন আর্থিক বৈষম্যের জন্ম দিত তাহলে সমগ্র পৃথিবী আজ এই বিপদের সম্মুখীন হত না। একথা বলা অবান্তর হবে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন হল কতটা বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে বর্তমান বিশ্ব? বিজ্ঞানীরা যে তথ্য এবং ধারণা দিয়েছেন তা যথেষ্ট বিপদের ঈঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন বেড়ে যাওয়াতে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে এবং তা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বে মানবজাতির বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ভূপৃষ্ঠের জলতল এবং ভূমিতল দুই-ই উত্তপ্ত হয়। ভূমিতল উত্তপ্ত হওয়াতে মেরু অঞ্চল বা অন্যান্য অঞ্চলের বরফ গলে যায়। এই বরফ গলা জল ভূ-পৃষ্ঠে মোট জলের পরিমাণ বাড়ায় এবং ওই বর্ধিত জলরাশি সমুদ্রে জমা হয়। সমুদ্রের জলের পরিমাণ বাড়ায় সমুদ্রের জলতল বাড়তে থাকে। ফলে উপকূলের শহর প্লাবিত হবার আশঙ্কা থাকে। ১৮৮০ সালের তুলনায় বর্তমানে সমুদ্রের জলতল গড়ে ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি বেড়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরের জলস্তর প্রতি বছর ৩.৬ মিলিমিটার হারে উঁচু হচ্ছে। কোটালের জলোচ্ছ্বাস এবং টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হচ্ছে সুন্দরবনের নীচু অঞ্চলগুলি। নিম্নভূমিতে অনেক সময় প্রচণ্ড জল-ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বেড়িবাঁধ উপচে বা ভেঙে লোনা জল প্রবেশ করে চাষের জমি পুকুর ডুবে জলবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। আবার প্রতি বছর ভূমিভাগ ২.৯ মিলিমিটার করে বসে যাচ্ছে। এই জোড়া প্রভাবে কার্যত ৬.৫ মিলিমিটার করে বসে যাচ্ছে ভূমিভাগ। সাধারণত পলি জমে ভূমিভাগ উঁচু হবার কথা কিন্তু সর্বত্র তা হচ্ছে না।

Nature Climate Change পত্রিকা জানাচ্ছে তাপমাত্রা যদি ১.৫°সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যায় তাহলে এই শতাব্দীর শেষে ভূ-পৃষ্ঠের সমুদ্রতল ১-২ মিটার উঁচু হতে পারে। NASA জানাচ্ছে এর ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার নিরিখে সবচেয়ে নীচু দেশ মালদ্বীপ চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। ২১০০ সালের মধ্যে আরও ১১টি শহর সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

উষ্ণায়নের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হিমবাহ ধীরে ধীরে গলছে। ১৯৭৫ – ২০০০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হারে গলছে হিমবাহগুলি। হিমালয়ের ৮৮০০টি হিমবাহ হ্রদ রয়েছে। তার মধ্যে ২০০-র বেশি বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। 

ভূ-পৃষ্ঠের জলতল উত্তপ্ত হওয়াতে সমুদ্রের জলের উপরিতল উত্তপ্ত হয়। উপরিতলের বর্ধিত তাপ সমুদ্রের গভীরে নামতে থাকে। বর্ধিত তাপের কারণে সমুদ্রের নীচে কোরাল থেকে শৈবাল খসে গিয়ে তা বর্ণহীন হয়ে পড়ে। একে বলে কোরাল ব্লিচিং। এতে কোরালের মৃত্যু হতে পারে। ১৯৯৮ থেকে এখন পর্যন্ত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের ৯৮% কোরাল ব্লিচিং-এ আক্রান্ত। গ্রেট ব্যারিয়ার বা কোরাল প্রাচীর ২৯০০টি একক রিফের সমন্বয় এবং ৯০০ দীপপুঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং কুইন্সল্যান্ডের উপকূলে কোরাল সাগরে অবস্থিত। মহাশূন্য থেকে এই কোরাল রিফকে চিহ্নিত করা যায়। কোরাল স্টারফিসও মাছের খাদ্য। কোরাল ব্লিচিং-এর ফলে তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে এবং সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হতে পারে।

ভূ-পৃষ্ঠের জলতল উত্তপ্ত এবং বায়ুস্তর ঠান্ডা থাকলে যে তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয় তা থেকে উৎপন্ন হয় হ্যারিকেন। ভূ-পৃষ্ঠে জলতলের তাপমাত্রা যত বাড়ে বায়ুস্তরের সঙ্গে তাপমাত্রার পার্থক্য ততই বাড়তে থাকে। ফলে হ্যারিকেনের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়ে। ১৯৭৯ সালের তুলনায় ক্যাটেগরি ৩ হ্যারিকেন ৮% বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২০ সালে করোনা মহামারি ছাড়াও কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে মারা পড়েছিল প্রচুর পশুপাখি, এমনকি মানুষও। আমেরিকার পশ্চিমাংশে এবং ইউরোপের দক্ষিণাংশে দেখা গেছে দাবানল। ভারতবর্ষে রাজস্থান ও গুজরাতে ধেয়ে এসেছিল পঙ্গপালের দল। ২০২১ সালে জুলাই মাসে চিন ও জার্মানিতে বন্যা হয়। কেদারনাথের মতো ঋষিগঙ্গার উৎসেও

ঘটে একই রকম ঘটনা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এইসব ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফল।

জলবায়ু পরিবর্তনের নানান কুফল আগামী দিনে মানব জাতির সামনে বড়ো বিপদ হাজির করবে।

কয়েকটি দেশ যে বিপদের কারণ তা সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। বিপদের কারণ এই দেশগুলি কী মাত্রায় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করছে তা দেখা যাচ্ছে। দেশগুলির মোট গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের হিসাব এখানে দেওয়া হয়েছে।

গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের অন্য যে হিসাব আছে তাতে দেশগুলির অবস্থান আগের হিসাবের চেয়ে অন্যকরম। এতে চিন ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে নেই। যে দেশগুলি প্রথমে আছে তারা সাধারণভাবে বড়ো কিছু কার্বন নির্গমন করে না। জনঘনত্ব কম হওয়ার কারণে এই দেশগুলি এই হিসাবে শীর্ষে আছে।

The CSR Journal, May 12, 2022-এর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী যে দেশগুলি মাথাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে (tCO2e/capita) শীর্ষে আছে তারা হল:

১। কাতার              ৩৭.০৫ (টন)

২। কুয়েত                ২৩.৪৯

৩। সৌদি আরব       ১৯.৩৯

৪। কানাডা              ১৬.৮৫

৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র    ১৫.৭৮

৬। জার্মানি                ৯.৭০

৭। চিন                      ৭.৭০

৮। স্পেন                   ৬.০৯

৯। ফ্রান্স                    ৫.০২

১০। থাইল্যান্ড             ৪.৫০

গড় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকে শুধুমাত্র কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের আকারে প্রকাশ করা যায়। তাকে লেখা হয় tCO2e — অর্থাৎ ton Carbon Dioxide equivalent। বিভিন্ন দেশের Average Greenhouse Gas Footprint-কে tCO2e/capita বা মাথাপিছু টন কার্বন ডাই অক্সাইড ইকুইভ্যালেন্টে প্রকাশ করা হয়। এই হিসাবেই CSR Journal এর তথ্য।

বর্তমানে গড়ে প্রত্যেক মানুষ বছরে ৬.৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। ১৮৫০ সালের পর থেকে ক্রমশ তা বাড়ছে। বছরে মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ১৮৫০ সালে ছিল ০.৮ টন, ১৯০০ সালে ২.৭ টন, ১৯৫০ সালে ৪.৩ টন, ২০০০ সালে ৫.৮ টন এবং ২০১৯ সালে ৬.৬ টন। 

বর্তমানে গড়ে প্রত্যেক মানুষ ৬.৬ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। এটা পৃথিবীর গড় হিসাব। কিন্তু দেশে তা ভিন্ন।

Paris School of Economics প্রকাশিত World Inequality Report 2022 (WIR 2022)-তে এই বিষয়ে ২৬ দেশের tCO2e/percapita-র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সারণি ২-এ তা দেওয়া হল। এর মধ্যে বেশিরভাগ দেশই বিশ্বের গড় ৬.৬-এর বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী।

WIR 2022-তে যে দেশগুলি বিশ্বে মাথাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের শীর্ষে আছে তারা হল অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মাথাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ যথাক্রমে ১৯.৬, ১৯.৪ এবং ২১.১। পরবর্তী ধাপে আছে জাপান, ইসরায়েল, জার্মানি এবং রাশিয়া, মাথাপিছু কার্বন নির্গমন যথাক্রমে ১১.৩, ১২.৫, ১১.৯ এবং ১২.৩। ভারতবর্ষ আছে এই ২৬ দেশের মধ্যে সর্বনিম্নে, ২.২ মাথাপিছু নির্গমন নিয়ে।

জনসংখ্যার আকারের জন্য ভারতবর্ষ মাথাপিছু নির্গমনে সর্বনিম্নে। চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাই। মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে এই তিনটি দেশই বিশ্বে শীর্ষে আছে। এই দেশগুলির মধ্যে যেগুলি কার্বন নির্গমনে প্রথম দশটি দেশের মধ্যে আছে সেরকম দেশগুলি হল চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতবর্ষ, জাপান, জার্মানি।

আর্থিকভাবে উন্নত দেশগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজনও গুরুত্বপূর্ণ। সারণি- ২-এ ২৬ টি দেশের জনগণের বিভিন্ন অংশ কীভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী তা দেখানো হয়েছে। কয়েকটি দেশের শীর্ষ ১% মানুষ মাথাপিছু গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে খুবই এগিয়ে আছে। দেশগুলি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া। এই দেশগুলির শীর্ষ ১% মাথাপিছু কার্বন নির্গমন যথাক্রমে ২৬৯.৩, ১৯৬.০০, ১৯০.০২, ১৮৬.১ টন। এই দেশগুলির আর্থিকভাবে দুর্বল ৫০% মানুষ মাথাপিছু কার্বন নির্গমন যথাক্রমে ৯.৭, ৯.৭, ১০.০, ৬.৮। পরবর্তী পর্যায়ের দেশগুলি হল চিন, ইসরায়েল, জার্মানি। যাদের শীর্ষ ১% মানুষ যথাক্রমে ১৩৮.৯, ১৩০.৩ এবং ১১৭.৮ টন মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী। ওই দেশগুলির আর্থিকভাবে দুর্বল ৫০% মানুষ যথাক্রমে মাথাপিছু ৩.০, ৬.৭ এবং ৫.৯ টন কার্বন নির্গমন করে থাকে। সারণি-২-এ যে দেশগুলির মধ্যে যে দেশগুলির শীর্ষ ১% সবচেয়ে কম কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী সেগুলি হল যথাক্রমে আলজিরিয়া, ভারতবর্ষ এবং মরক্কো যাদের শীর্ষ ১% যথাক্রমে মাথাপিছু ২৬.১, ৩২.৪ এবং ৩৩.৪ কার্বন নির্গমন করে থাকে।

আর্থিকভাবে উন্নত দেশগুলির মধ্যে আবার জনগণের আর্থিকভাবে উন্নত অংশ ওই দেশগুলি দ্বারা কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী। সামগ্রিকভাবে সমগ্র বিশ্বে জনগণের আর্থিকভাবে উন্নত অংশ বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী তা সমস্ত তথ্যই বলছে।

WIR 2022-এ সমগ্র বিশ্বের জনগণের বিভিন্ন অংশের মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। সারণি-৩-এ তা দেওয়া হল। দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সমগ্র জনগণের মাথাপিছু কার্বন নির্গমন যখন ৬.৬ টন (২০১৯ সাল) তখন বিশ্বের আর্থিকভাবে উচ্চতম ১০% এর মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ৩১ টন, উচ্চতম ১%-এর মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ১১০ টন। যত জনগণের উচ্চতম অংশকে ধরা হবে মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ততই বাড়বে। উচ্চতম ০.১%-এর মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ৪৬৭ টন এবং উচ্চতম ০.০১%-এর মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ২৫৩১ টন। 

অর্থাৎ বর্তমান বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা যে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে তা থেকেই মূলত উৎসারিত হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ।

আশার কথা বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা United Nations বা সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ এই বিষয়ে সদর্থক ভূমিকা পালন করছে। United Nations Environment Programme (UNEP) এবং World Meteorological Organization একত্রে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করে Intergovernmental Panel for Climate Change বা IPCC এবং United Nations General Assembly তাকে মান্যতা দেয়।

IPCC ১৯৯০ সালে প্রথম Assessment Report বা AR1 প্রকাশ করেছে ও করে যাচ্ছে। এইভাবে AR2 থেকে AR5 প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৯৫, ২০০১, ২০০৭ এবং ২০১৪ সালে। AR6 প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে। এই রিপোর্টগুলিতে জলবায়ু পরিবর্তনের তৎকালীন সাম্প্রতিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও IPCC গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন সংক্রান্ত বিভিন্ন Guide Book প্রকাশ করেছে এবং Task Force গঠন করেছে।

United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC)-র অন্তর্গত kyoto protocol জাপানের কিয়োটো গৃহীত হয়। এই চুক্তিতে কেবলমাত্র শিল্পোন্নত দেশগুলিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিয়োটো প্রোটোকলের প্রথম দফায় ৩৭টি শিল্পোন্নত দেশকে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর কথা বলা হয়।

প্যারিস চুক্তির খসড়া ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর cop 21-এ চূড়ান্ত করা হয়। Cop হল conference of parties বা অংশগ্রহণকারী দেশ। ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি পার্টি বা দেশ এই চুক্তিতে অনুমোদন দেয়। প্যারিস চুক্তির cop 21-এর পর cop 26 পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে cop 26 অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক cop-তে প্যারিস চুক্তিকে শক্তিশালী ও বাস্তবায়িত করার কথা বলা হয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে আর শুধুমাত্র শিল্পোন্নত দেশের কথা বলা নেই, সমস্ত দেশের কথা বলা আছে। প্যারিস চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হল ভূ-পৃষ্ঠ তথা পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্প বিপ্লবের তুলনায় গড়ে ২°সেন্টিগ্রেডের অনেকটা নীচে এবং সম্ভব হলে ১.৫° সেন্টিগ্রডের মধ্যে রাখতে হবে। ২০৫০ এর মধ্যে নেট শূন্য নির্গমন বা net zero emmission-এ পৌঁছাতে হবে। cop 26-এ জলবায়ু পরিবর্তনের সাপেক্ষে সহনশীলতা তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলি থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়িত করার কথা বলা হয়েছে। গ্লাসগোতেই প্রথম ডাক দেওয়া হল যে অপ্রতিরোধ্য কয়লার শক্তির ব্যবহার এবং জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে হবে।

কয়লা এবং জীবাশ্ম জ্বলানির চিরাচরিত শক্তির উৎসের পরিবর্তে নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস নিয়ে আসার কাজটা নিশ্চিতভাবেই সহজ নয়। এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারার সদিচ্ছা থাকাটাও এই কাজে সাফল্যের পূর্বশর্ত। সংশ্লিষ্ট দেশে এই মর্মে পরিকল্পিত অর্থব্যয়ের প্রসঙ্গটা থাকছেই। রাষ্ট্রের উদ্যোগ ছাড়া এই কাজ অসম্ভব। সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতটা জনকল্যাণমূলক তার উপর নির্ভর করে রাষ্ট্র এই কাজে কতটা উদ্যোগী হবে বা আদৌ হবে কিনা। কার্বন নির্গমনে প্রথম সারিতে থাকা দেশগুলির রাষ্ট্র কী ভূমিকা নিচ্ছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের ডাকে তারা বাস্তবে কতটা এগিয়ে আসবে তার নিশ্চয়তা সম্ভবত দেওয়া যায় না।

উন্নত দেশগুলি উন্নতিশীল দেশগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যে বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। উন্নত দেশগুলি কার্বন নির্গমন মোকাবিলায় নিজের দেশেই যে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। ভারতবর্ষ জানিয়েছে ২০৭০ সালের আগে দেশে নেট জিরো নির্গমনে পৌঁছোনো সম্ভব নয়। চিনের ক্ষেত্রে সময়টা ২০৬০ সাল। ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্য নির্গমন বাস্তবায়িত করার কথা, কিন্তু কার্বন নির্গমনে প্রথম সারিতে থাকা দেশগুলি তা সরাসরি অস্বীকার করছে। আর যে দেশগুলি নীরব আছে তারা কিছুই বলছে না এবং তাদের সদিচ্ছা কতটা তা বুঝতে পারা অসম্ভব।

বিশ্বের প্রথম সারির দশটি দেশ যদি নিজেরা কার্বন নির্গমন না কমায় তাহলে সমগ্র বিশ্বের কার্বন নির্গমন কম হবার কোনও সম্ভাবনা থাকে না। বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা যে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে তাতে ধনীতম দেশগুলি যেমন কার্বন নির্গমনের শীর্ষে তেমনি সমগ্র বিশ্বের মানুষের ভবিষ্যৎ তথা পৃথিবীর ভবিষ্যত কয়েকটি দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জলবায়ু সংকটের নিয়ন্ত্রণও কয়েকটি দেশের হাতে।

টীকা ও তথ্যসূত্র :

  • ‘The 5 mass extinction events that shaped the history of the earth — and the 6th that’s happening now’ written by Scott Dutfield, How it works Magazine, published May 17, 2021.
  • Greenhouse Gas Bulletin : ‘Another Year Another Record’, UN, October 25, 2021
  • ‘What are the effects of global warming?’ by Alina Bradford and Stephine Pappas, Live Science.
  • ‘Coral bleaching impacts 98% of Great Barrier Reef : study’, Phy.Org., Nov 4, 2021.
  • World Inequality Report 2022, World Inequality Lab.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান