উদয়শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্জ্য বা বর্জ্য পদার্থ বলতে আমরা কী বুঝি? যা বর্জনীয়, তাই বর্জ্য। দেহের মধ্যে যা থাকলে দেহের ক্ষতি তা বর্জনীয় এবং তা বর্জন করতে হবে। দেহের বাইরে বর্জ্য হিসেবে নিষ্কাশন করতে হবে। এতদূর অবধি ঠিক আছে, কিন্তু দেহের বাইরে গিয়েও কিছু বর্জ্য অশেষ ক্ষতিসাধন করতে পারে। প্রাণীজ বর্জ্য সেরকম ক্ষতিকারক না হলেও বেশ কিছু বর্জ্য পদার্থ আছে যেগুলো প্রকৃতি ও পরিবেশের চরম ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম।
পৃথিবীতে প্রথম বর্জ্য নিষ্কাশনের ধারণা আসে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে ক্রেট দ্বীপে। তখন গর্ত খুঁড়ে বর্জ্য পুঁতে রাখা হত। সিন্ধু সভ্যতাতেও বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। এরপর বহুদিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ঐতিহাসিক প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায় না। ১৩৮৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে আইন পাস হয়। ১৬৫৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে অনুরূপ আইন পাস হয়। এরপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বর্জ্য বিষয়ক সচেতনতা গড়ে ওঠে।
বর্জ্যের শ্রেণিবিভাগ
বর্জ্য বহু রকমের। শিল্পজাত বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য, ব্যাবসায়িক বর্জ্য, কৃষিজাত বর্জ্য, পৌরসভার বর্জ্য, সামুদ্রিক বর্জ্য, বৈদ্যুতিন সামগ্রীর বর্জ্য, জৈব বর্জ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ইত্যাদি। এছাড়া আকারগত দিক দিয়েও বর্জ্যকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন তরল বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য, গ্যাসীয় বর্জ্য ইত্যাদি। এছাড়া কিছু বর্জ্য হল পুনর্ব্যবহারযোগ্য।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
প্রথমে বর্জ্য সংগ্রহ, তার পরে তার পরিবহণ, বর্জ্য পৃথকীকরণ, ভরাটকরণ, কমপোস্টিং বা মিশ্র সারে পরিণতকরণ, নিষ্কাশন এবং কিছু ক্ষেত্রে বর্জ্যদহন। বর্জ্য পৃথকীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই পর্যায়ে পচনশীল, অপচনশীল ও দূষিত বর্জ্যকে আলাদা করা হয়। ভরাটকরণ প্রক্রিয়ায় বর্জ্যগুলিকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এই মাটিচাপা বর্জ্য থেকে হিউমাস তৈরি হয় এবং তা সার হিসেবে কাজে লাগানো হয়। তবে লক্ষ রাখতে হয় বৃষ্টির জলে বা অন্য কোনো ভাবে এই বর্জ্য যেন আশেপাশের জলাশয়ের ভূগর্ভস্থ জলস্তরে ছড়িয়ে না যায়। সেক্ষেত্রে জল দূষণের সম্ভাবনা। প্রাকৃতিকভাবে জৈব বর্জ্যের বিয়োজনের প্রক্রিয়া হল কমপোস্টিং। এই প্রক্রিয়ায় জৈব বর্জ্য ও কৃষিজ বর্জ্যগুলি গর্তে ফেলে পচিয়ে মিশ্রসার তৈরি করা হয়। এই সারে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফেট ইত্যাদি বহুল পরিমাণে থাকে। এই কমপোস্টিং প্রাকৃতিক পদ্ধতি বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হতে পারে। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে একটি পরীক্ষার মধ্যে বর্জ্যগুলি ফেলে তার ওপর পয়ঃপ্রণালী ও বিভিন্ন গবাদি পশুর মলমূত্রের একটি স্তর তৈরি করা হয়। কালক্রমে নীচের বর্জ্য ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বিয়োজিত হয়ে কম্পোস্ট সারে পরিণত হয়।
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যকে যন্ত্রের মধ্যে চূর্ণ করে তার সাথে মলমূত্রকে মিশিয়ে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বিয়োজিত করা হয়। নিষ্কাশন পদ্ধতিতে বর্জ্যগুলি নালার মাধ্যমে জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এই পদ্ধতিতে যদিও বা অন্যান্য জলাশয়ে দূষণের সম্ভাবনা থাকে। কিছু এলাকায় অবশ্য নিষ্কাশনের আগে পরিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে তা ব্যয়সাপেক্ষ। বর্জ্যদহন আরও এক ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এই পদ্ধতিতে বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু বর্জ্যদহনের ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করে।
বর্জ্য কী সত্যিই বর্জ্য
কিছু প্রকল্প কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বর্জ্যও যথেষ্ট প্রয়োজনীয় এবং ঠিকমতো ব্যবহার করলে বর্জ্যপদার্থ দিয়েও অনেক কিছু করা যায়। ২০১৯ সালে তামিলনাড়ুর বিরুধুনগরে ‘Garbage Bank’ বলে একটি প্রকল্প চালু হয়েছে। এই ব্যাংক বর্জ্য সংগ্রহ করে, বর্জ্যগুলিকে পেপার, প্লাস্টিক, মেটাল ও ই-ওয়েস্ট এই চারভাগে ভাগ করে। এরপর সেগুলি থেকে নতুন ধরনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করে। সেগুলি আবার বিক্রিও হয়। এরা রীতিমতো পয়সা দিয়ে বর্জ্য কেনে এবং ব্যবসা হিসেবে এটি বেশ লাভজনক। বিরুধুনগরের কিছু মানুষ একটি সংস্থা তৈরি করে এই ব্যাবসা শুরু করেছেন এবং এই বাণিজ্যিক উদ্যোগকে অনেকেই এখন সাধুবাদ জানাচ্ছেন। বর্জ্য দিয়ে এরা ব্যাগ, জামাকাপড়, টুকিটাকি গৃহস্থালির বস্তু এমনকি ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীও তৈরি করে। এরা শুধু এই বাণিজ্যিক উদ্যোগেরই শরিক নন, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সচেতনতাও তৈরি করেন।
সাধারণ জৈব বর্জ্য ক্ষতিকর কিন্তু কিছু বর্জ্য সাংঘাতিক ক্ষতিকর। সেগুলি শুধুমাত্র ক্ষতিকারকই নয়, সেগুলির নিষ্কাশন প্রক্রিয়া ও বিপজ্জনক। আমাদের সবার মনে আছে জাপানে সুনামির পর ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঘটনা। এই ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্র চলত পারমাণবিক শক্তির দ্বারা এবং সুনামির পর যখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে জল ঢুকতে শুরু করে তখন সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সম্ভাব্য তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণের আশঙ্কায়। এই রকম পারমাণবিক চুল্লি বা অন্যান্য জায়গা, যেখানে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহৃত হয় সেখানেই তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও উৎপন্ন হয়। এই ধরনের বর্জ্য পদার্থর পৃথকীকরণ, পরিবহণ ও নিষ্কাশন খুব দুরূহ কাজ। বেশ খরচসাপেক্ষ। কারণ এই প্রক্রিয়াগুলির ক্ষেত্রে চরমতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হয় নইলে বিপদের আশঙ্কা থাকে। ফলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। একইরকম ভাবে সামুদ্রিক বর্জ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়ে যায়। আমরা প্রায় শুনি জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল জলে মিশে যায় বা জাহাজের কোনো বর্জ্য জলে মিশে যায়। এর ফলে সমুদ্রের এক বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। এইসব ক্ষেত্রে জল থেকে বর্জ্য আলাদা করা হয় খরচসাপেক্ষ। বহু দেশ তাদের বিশেষ অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় রাখার জন্যে সমুদ্রে বিভিন্ন পারমাণবিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। ফলস্বরূপ, বহু তেজস্ক্রিয় বর্জ্য জলে মেশে এবং বিভিন্নভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে। এদের জল থেকে আলাদা করা কঠিন ও ব্যয়সাপেক্ষ। অর্থাৎ বোঝা গেল যে, বিশেষ বিশেষ বর্জ্যমুক্তির পদ্ধতি খুব জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। শুধু মানুষের সদিচ্ছা ও প্রযুক্তির ব্যবহারেই সেগুলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ সম্ভব নয়, প্রভূত অর্থের জোগান দরকার।
বর্তমান সময়ে e-waste বা ইলেকট্রনিক্স বর্জ্যও বেশ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই বেশ কিছু পুরোনো টিভি, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার থাকে যেগুলি ব্যবহার হয়না এবং ইলেকট্রনিক্স বর্জ্যে পরিণত হয়। এগুলির সাধারণ বর্জ্যের সাথে মিশে যাওয়া একেবারেই কাম্য নয়। এই যন্ত্রগুলি তৈরির সময় এমন অনেক কিছু ব্যবহার করা হয় যেগুলি প্রাণীদেহের পক্ষে ক্ষতিকারক। এগুলি যত্রতত্র পরে থাকলে তার সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাব রয়েছে। এছাড়া medical waste বা চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য ও খুব বিপজ্জনক। হাসপাতাল বা অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্রে যে বর্জ্যগুলি উৎপন্ন হয় সেগুলি বিভিন্ন রোগ ছড়াতে পারে বা পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এগুলির নিষ্কাশনও দুরূহ কাজ। প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে অবশ্য নতুন করে বলার কিছু নেই। প্লাস্টিক বর্জ্য যে কতটা মারাত্মক হতে পারে তার অনেকটা আঁচ আমরা বিভিন্নভাবে পেয়েছি। এই বর্জ্য আবার মাটিতে মেশে না, বছরের পর বছর পরিবেশে একইরকম আকারে থেকে যায়, পরিবেশের ক্ষতি করতে থাকে। জল নিষ্কাশনকে ব্যাহত করে, স্থানীয় বন্যা পরিস্থিতির উপক্রম করে। ২০২২ এর জুলাই মাস থেকে ভারতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পলিপ্যাকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। এই ধরনের বর্জ্য মোকাবিলার ক্ষেত্রে এটি নিশ্চয়ই একটি সদর্থক পদক্ষেপ। বস্তুত, বিভিন্ন ধরনের কারখানা বর্জ্য উৎপাদনের সূতিকাগার। কিন্তু বিশেষ কিছু কারখানার বর্জ্য বিশেষ মাথাব্যথার কারণ। এই যেমন ইলেকট্রিক ব্যাটারি চালিত গাড়ি তৈরির কারখানা। সাধারণ গাড়ির ধোঁয়া গ্যাসীয় বর্জ্য হিসেবে অনেকটাই ক্ষতি করে কিন্তু ব্যাটারি চালিত গাড়ি তৈরির কারখানায় শুধুমাত্র ব্যাটারি গাড়ি তৈরির প্রক্রিয়াতেই বিপুল পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এইসব বর্জ্য ধোঁয়ার চেয়ে কিছু কম ক্ষতিকারক নয়।
বর্তমানে সরকার প্লাস্টিক পলিপ্যাক ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আনায় প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ কিছু পরিমাণে কমবে আশা করা যায়। সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম, জাতীয় পরিবেশ আদালতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তর জানিয়েছে তারা বর্জ্য মোকাবিলায় বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। বর্জ্য থেকে উৎপন্ন মিথেন পথবাতিতে ব্যবহারের পরিকল্পনা বা প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে দরজা, জানলা, বেঞ্চ বানানোর পরিকল্পনা তারা ইতিমধ্যেই নিয়েছে। নিউটাউনের যাত্রাগাছিতে নতুন ডাম্পিং গ্রাউন্ডের বর্জ্য থেকে বেরোনো মিথেন গ্যাসকে কাজে লাগাতে বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে বলেও শুনলাম। প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকায় পথবাতি জ্বালানো যাবে ওই গ্যাসে। তবে ক্রমবর্ধমান দূষণ ঠেকাতে বায়োমাইনিং-এর ব্যবহার এখনও যথাযথ ভাবে হয়নি। ভারতে বর্জ্য সচেতনতা পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় একটু দেরি করে শুরু হলেও ধীরে ধীরে বর্জ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রক্রিয়া উন্নততর ও গতিময় হচ্ছে। আর বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এমন এক সহজ পদ্ধতি পেয়ে যাব যে পদ্ধতিতে বর্জ্যের প্রাথমিক স্তরে পরিবর্তন ঘটিয়ে বর্জ্য থেকেই নিমেষে সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যবহারোপযোগী পদার্থ পাওয়া যাবে। ব্যাস তাহলেই মার দিয়া কেল্লা। বর্জ্য নিয়ে আর ভাবনার অবকাশ থাকবে না। প্রার্থনা করি এমন দিন জলদি আসুক। মানুষের সচেতনতা জাগ্রত হোক। যাবতীয় উন্নয়ন বর্জ্যহীন পৃথিবীর লক্ষ্যে পরিচালিত হোক।