কার্বন ব্যবসা, কার্বন কর্ম ও কার্বন পদচিহ্ন — একই বৃন্তে তিনটি কুসুম

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

“It may no longer be in anyone’s personal capacity to make changes great enough to reverse the damage already done. In a world where just 100 companies are responsible for 71% of global emissions, we need a total overhaul of the carbon-intensive systems around us instead.”

— Marcelle McManus (Professor of Energy and Environmental Engineering, University of Bath)

কবি বিষ্ণু দে তাঁর প্রেয়সীর উদ্দেশে বার্তা দিয়েছিলেন, “তুমি কর্মের কার্বন”। ভাষা হিসেবে বাংলার স্থান অধোগামী হওয়ায় বিদেশি বিজ্ঞাপন নির্মাণ সংস্থাগুলি এমন উচ্চ মানের সাংস্কৃতিক নির্মাণকে এখনও জানতে পারেনি। এই ‘আক্ষেপ’-এর যাথার্থ্য এই নিবন্ধের শেষের দিকে বোঝা যাবে আশা রাখি।

পরিবেশ-প্রতিবেশ সমস্যা নিয়ে বৈশ্বিকস্তরে চিন্তাভাবনা শুরু হয় গত শতকের সত্তর দশকে। এই চর্চা করতে গিয়ে বোঝা যায় যে এই সমস্যার উৎস লুকিয়ে আছে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা এবং সেই সময়ের চলতি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কার্যক্রমের অভ্যন্তরে। এই সমস্যা শেষ পর্যন্ত এক বিশ্বব্যাপী সংকটের জন্ম দেয় যা আড়াল করার নানান কৌশল আর শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। আজ সেই সংকটকে পৃথিবীর কর্তাব্যক্তিরা চিহ্নিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট বা ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ক্রাইসিস’ বলে। এই সংকটের জন্য কে বা কারা দায়ী, তা নিয়ে অনেক জল্পনার পর সাব্যস্ত হয়েছে যে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা-র হাড়-হাভাতে পিল পিল সংখ্যায় বিপুল জনরাশি দু-হাতে এই পৃথিবীর যাবতীয় রসদ অ-টেকসই পদ্ধতিতে গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে বলে পৃথিবীর জলবায়ুর অপ্রত্যাহারযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। এই বিষয়ে বিল গেটস থেকে পিতা-পুত্র বুশ— সবাই একমত। আর মার্কিন দেশ বা ইউরোপ বা চিনের মতো অতি-উন্নত দেশের কর্তাব্যক্তিরা নানান কৌশল উদ্ভাবন করে সেই সংকটের মোকাবেলায় একজোট হয়ে সেই সংকট থেকে পৃথিবীর উদ্ধারের রাস্তা তৈরি করছে।

কিন্তু গোল বেধেছে অন্য জায়গায়। এই পৃথিবীর বেশ কিছু মানুষ, যার মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরাও আছেন, তাঁদের মত কর্তাদের মতের চেয়ে ভিন্ন, তাঁরা তাঁদের মতো একজোট হয়ে কর্তাদের বর্ণনা করা জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত এই সংকটের মোকাবেলায় অন্য পথের কথা বলেন। এই দ্বিতীয় দলের সঙ্গে পৃথিবীর অনেক সাধারণ মানুষ থাকলেও, প্রথম দলের সঙ্গে আছে টাকার থলির মালিকরা, যারা চায় যে তাদের তাদের টাকার থলির ভার ও আয়তন যেন কোনো ভাবেই না কমে। তাই তাদের কাছে এই সংকট টাকা রোজগারের এক অভাবনীয় সুযোগ, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার মতে “turning the crisis into an opportunity”। 

বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফসল হিসেবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টির অবতারণা প্রায় দু-শতাব্দী প্রাচীন এক ধারণা। সেই বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস-এর আমল থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে সময়ের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত বিভিন্ন গ্যাসের আপেক্ষিক অনুপাত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম মতে, নাকি মানুষের কোনও কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের ফল, তা নিয়ে আরও গবেষণা চলে। এই গবেষণার ধারায় এক সময় প্রথমে অনুমান এবং পরে খানিকটা কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলতে থাকেন যে মুনাফার তাগিদে সারা পৃথিবীর ব্যবসায়ীবৃন্দ যে ভাবে তাদের ব্যাবসায়িক কাজ, তাদের আর্থিক ব্যবস্থা, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তার অন্যতম ফল হিসেবে আজ আমরা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখতে পাচ্ছি। 

জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান তাঁদের নিজস্ব বোধ থেকে এই সংকটের মোকাবেলায় এক এক ধরনের নিদান বাতলাচ্ছেন। কিন্তু বৈশ্বিক স্তরে জলবায়ু সংকটের মুখ্য বিষয় হিসেবে একমত প্রায় সকল দলের মানুষ চিহ্নিত করেছেন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের উপস্থিতিকে। কী প্রক্রিয়ায় এই গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে, সে বিষয়ে যে মোটা দাগের সহমত তাকে বলা যেতে পারে যে আমাদের বর্তমান সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তাকে ঘিরে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্মিত হয়েছে, তা কার্বন-ভিত্তিক এবং এই কার্বন-ভিত্তিক উৎপাদন ও আর্থিক ব্যবস্থা বায়ুমণ্ডলে এই অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড-এর উপস্থিতির অন্যতম কারণ। 

যেহেতু এই সংকট বুঝতে বারে বারে উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থ ব্যবস্থার কথা সামনে আসছে, তাই এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মূল অংশের কথা দিয়ে শুরু করতে পারি। এদের কথায় মান্যতা দেন দেশ বিদেশের শাসকরা, সেই সব উৎপাদক সংস্থা, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যাঁদের কাজকর্ম এই জলবায়ু সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী বলে বোঝা যাচ্ছে।  

সহজ ব্যাপার হল পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের পর তাকে পণ্যে রূপান্তরিত করতে হয়। এই কাজ করতে শক্তি ব্যয় করতে হয়, যা সংগ্রহ করতে গেলে আমাদের এখনও পর্যন্ত উৎস হল কয়লা, খনিজ তেল (পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদি) এবং অধুনা প্রাকৃতিক গ্যাস। এই প্রত্যেকটি উৎস থেকে শক্তি উৎপাদনের বর্তমান প্রক্রিয়ায় অবশেষ হিসেবে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গিয়ে জমা হয়। 

বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাস-এর আপেক্ষিক অনুপাতের ভারসাম্য রক্ষার যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা রয়েছে, তার মাধ্যমে জমা হওয়া অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডকে প্রশমিত করার ব্যবস্থা থাকলেও, এখন উৎপন্ন হওয়া সেই অতিরিক্ত পরিমাণের একটি প্রাকৃতিক সীমানা আছে বলে অনুমান করা হয়। পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তা বজায় রাখতে কার্বন-ভিত্তিক যে প্রণালীতে শক্তি উৎপাদন করা হয়, তার ফলে বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে যে হারে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হচ্ছে, সেই পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইডকে চালু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া প্রয়োজনীয় মাত্রায় প্রশমিত করতে পারবে না বলেই বিজ্ঞানীদের অনুমান। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান হার কমাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এই অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেওয়া কমাতে হবে, অন্যথায় পণ্য উৎপাদন ও পণ্য উৎপাদনের জন্য শক্তি তৈরির জন্য উৎস মুখেই কার্বন-ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় রাশ টানার ব্যবস্থা করতে হবে।  

এই রাশ টানার পদ্ধতি হিসেবে অর্থনীতিবিদদের নিদান সরল। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত হল (এর মধ্যে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী উইলিয়াম নর্ডহাউস-ও আছেন) বিষয়টি বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতির ওপর ছেড়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও তার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন ( যার ভেতর পড়বে পরিষেবা খাত, গৃহস্থের ব্যবহারের জন্য শক্তি খাত ইত্যাদি) ব্যবস্থায় যতটা কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে, তার হিসেব করে, তাকে কার্বন তুল্যাঙ্কে পরিবর্তিত করে (অর্থাৎ কতটা কার্বন ডাই অক্সাইড কতটা কার্বনের সমান সমান) সেই কার্বনের ওপর কর চাপানো। কয়লা, খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করলেই এখন থেকে তাদের ওপর কর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হোক। এর ফলে উৎপাদক সংস্থাগুলি দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে এই কার্বন-ভিত্তিক উৎপাদন প্রণালীর পরিবর্তে অন্য বিকল্প প্রণালী খুঁজে নেবে এবং শেষ বিচারে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড-এর আপেক্ষিক পরিমাণ কমে আসবে। এই কার্বন-কর আদায় পদ্ধতি মানলে, আমাদের উৎপাদন ও পরিষেবায় গুরুতর কোনও বিঘ্ন না ঘটিয়েই মসৃণভাবে কার্বন ভিত্তিক উৎপাদন ও অর্থনীতির পরিবেশ-প্রতিবেশ-বান্ধব রূপান্তর ঘটানো সম্ভব।

জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বৈশ্বিক স্তরের সবচেয়ে সংগঠিত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোচনের জন্য যে কমিটি আছে, তাতে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশই সদস্য, প্রায় প্রতি বছর এই মর্মে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সব দেশগুলির প্রতিনিধিবৃন্দ মিলিত হয়ে আগের নেওয়া প্রস্তাব বিভিন্ন দেশ কতটা রূপায়িত করল তার হিসেব নেওয়ার পাশাপাশি নতুন করণীয় বিষয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়। গত শতকের নব্বই-এর দশকের শেষ দিকে জাপানের কিয়তো শহরে অনুষ্ঠিত এমন এক বহুদৈশিক সম্মেলনে এই কার্বন করকে ব্যবসার অঙ্গীভূত করা হয়। সেখানে বলা হয় যে কোনও সংস্থা যদি এমন কোনও পথ গ্রহণ করে যার মাধ্যমে বৈশ্বিক স্তরে কার্বন নির্গমন কমবে, তাহলে সেই সংস্থা সেই পরিমাণে “কার্বন-ক্রেডিট” অর্জন করবে, এবং যে সংস্থাকে কার্বনের জন্য কর দিতে হচ্ছে, তাকে সেই অর্জিত “কার্বন-ক্রেডিট” বিক্রি করা চলবে। যেমন ধরা যাক ভারতের আদানি সংস্থা আফ্রিকার কোনও একটি দেশে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সামাজিক বন সৃজন করল। এই “ক্রেডিট” হিসেব করে (কেননা গাছ সালোক-সংশেষের জন্য বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড মূলত শোষণ করে) শোষিত কার্বনের হিসেবে তা আদানির ভাঁড়ারে জমা পড়ল। এইবার আদানি ভাঙ্গরে বা বীরভূমের দেওচা পাচামিতে তাপবিদ্যুৎ বা কয়লা খনির জন্য বাতাসে যতটা কার্বন নির্গমন করবে বা করেছে, তার হিসেব কষা হল। এখন এই হিসেব থেকে আদানি সংস্থা আফ্রিকায় বনসৃজনের জন্য যে “কার্বন-ক্রেডিত” অর্জন করেছে তা বাদ গেল। যতটা কার্বন নির্গমন পড়ে রইলো, এখন কার্বন-কর নির্ধারিত হবে সেই নিরিখে। শুনতে মন্দ না হলেও আদতে বিষয়টি এত সহজ নয়। প্রথমত কার্বন-তুল্যাঙ্ক হিসেব কষায় বিরাট ফাঁকি আছে। দ্বিতীয়ত, যে সব প্রকল্পের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে “কার্বন-নির্গমন” কমানো যাবে বলে কিয়তো বিধিতে বলা হয়েছিল, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যথেষ্ঠ নড়বড়ে। যেমন এক কিলোগ্রাম কয়লা থেকে তাপ বিদ্যুৎ তৈরি করলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশে যায়, তার সমতুল্য কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাস থেকে শুষে নিতে যে পরিমাণ জমিতে বন সৃজন করা দরকার তার পরিমাণ বিরাট। ফলে এত গ্রাম কার্বন সমান সমান এতগুলি গাছ, এই হিসেবে অর্থনীতির জমা-খরচের খাতায় যতটা সহজে লেখা যায়, বাস্তবে অত সহজে মোটেই তা রূপায়িত করা যায় না। অতএব “কার্বন-ক্রেডিট অর্জন”, এই ধারণাটিই বিরাট ভ্রান্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। 

কার্বন পদচিহ্ন

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর এই কার্বন পদচিহ্নের ধারণা আসে। এই ধারণার উৎস হল বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্নের ধারণা। ১৯৯০ সাল নাগাদ এই বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্নের ধারণার কথা বলেন কানাডার বাস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানী উইলিয়াম রিস এবং নগর পরিকল্পনাবিদ ম্যাথিস ওয়াকেমাগাল। এই ধারণার ব্যাখ্যায় তাঁরা যুগলে বলেন যে অধিবাসীদের বেঁচে থাকার এবং সামাজিক কাজকর্মের জন্য যে পরিমাণে জমি লাগবে সেই পরিমাণ জমিই হল ঐ অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন। এই জমির পরিমাণের মধ্যে পড়ে জলসম্পদ ব্যবহার, চাষের জন্য ও অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জমির ব্যবহারও।  

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কার্বন ডাই অক্সাইড তথা কার্বনকে চিহ্নিত করার পর অনেকে এই আদলে কার্বন পদচিহ্নের ধারণা আমদানি করেন। এই ধারণা মতে কার্বন পদচিহ্ন হল একজন ব্যক্তি বা সংস্থার (যেমন একটি আবাসন, পুরসভা, একটি দেশ ইত্যাদি) পক্ষ থেকে সমস্ত কাজকর্মের জন্য যে পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে তার মোট পরিমাণ। এই পরিমাণের মধ্যে সাধারণত অন্তর্ভুক্ত করা হয় সব ধরনের সরাসরি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের উৎস গুলিকে, যা আসতে পারে জীবাশ্ম-জ্বালানি, যেমন কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস দহনের ফলে; যা আসতে পারে এই দহন থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন থেকে, খনিজ তেল ব্যবহার করে পরিবহণ ব্যবস্থা থেকে। এই কার্বন পদচিহ্ন হিসেব কষায় আজকাল কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া অন্যান্য যে সব গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী হিসেবে জানা গেছে, যেমন মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বনকেও ধরা হয়ে থেকে। 

বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন হিসেবের সময় উৎপাদনের সময় জলবায়ু পবিবর্তক গ্যাস নির্গমনের সমগ্র পরিমাণকেই ধরা হয়, আর কার্বন পদচিহ্ন হিসেব করার সময় কেবলমাত্র একজন পণ্য ভোক্তার পণ্য উপভোগের কারণে নির্গত এই জাতীয় গ্যাসের পরিমাণকে হিসেবে আনা হয়। প্রথম ক্ষেত্রে দায় বর্তাত উৎপাদকের ওপর, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দায় বর্তাচ্ছে ব্যক্তি উপভোক্তার ওপর!

আমরা এখন ১৯৭১ সালের একটি ছোটো বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ ফেরাই। সেই সময়ে আজকের যুগের মতো সর্বত্রগামী ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের প্রকোপে মানুষের জীবনযাত্রা নির্ধারিত হতে শুরু করেনি। সেই সময়ের টিভি-র বিজ্ঞাপনটা খানিকটা এই রকমের। একটি সুখী পরিবার একটি মহার্ঘ গাড়ি চেপে দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় প্লাস্টিকে মোড়া এক দলা ময়লা গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার থেকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল আর তা রাস্তার পাশে বিশ্রাম নেওয়া একজন মার্কিন দেশের আদি অধিবাসীর পোষাক তা নষ্ট করে দিল। ক্যামেরা ঘুরে গিয়ে দেখাল সেই আদি অধিবাসীর চোখে বড়ো বড়ো অশ্রুবিন্দু, তার ছিন্ন পোষাকের পাশাপাশি তার বাসস্থান দূষিত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠলো লেখা — “People Start Pollution. People can Stop it”. এই বিজ্ঞাপনের নির্গলিতার্থ— গাড়ি করে যারা চলে গেল, সেই ব্যক্তি উপভোক্তা যাবতীয় দূষণের উৎস, অতএব সেই দূষণ ঠেকানোর যাবতীয় দায় সেই উপভোক্তার নিজের। এই বিজ্ঞাপনটির মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে কার্বন পদচিহ্নকে জলবায়ু পরিবর্তন রুখে দেওয়ার কাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্তর্নিহিত দর্শনটির দেখা মিলছে। কী ভাবে? তা বুঝতে আমাদের এই বিজ্ঞাপনের পেছনের কিছু চোরা তথ্য জানতে হবে। এই উচ্চ প্রশংসিত ও নানা পুরস্কারে ভূষিত ছোট্ট বিজ্ঞাপনটির নির্মাতা সংস্থাটির নাম “কিপ আমেরিকা বিউটিফুল”, যেটি একটি অ-মুনাফাকারী পরিবেশ-বান্ধব সংস্থা হিসেবে বিখ্যাত। কিন্তু…। সংস্থাটি এই বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছে পরিবেশ-দূষণকারী, লক্ষ লক্ষ প্লাস্টিক বোতল এবং প্লাস্টিক মোড়ক তৈরি করার সংস্থাগুলির একটি মিলিত সংস্থার টাকায়, যে টাকার জোগান দিয়েছে কোকা-কোলা, পেপসিকো এবং আন্‌হেউসের-বস সংস্থা! এই তিন সংস্থার তৈরি করা প্লাস্টিক মোড়ক, বোতল, ধাতুর বোতল সারা পৃথিবীতে বর্জ্য হিসেবে এত জমেছে যে সেগুলিকে পৃথিবীর বেড় বরাবর সাজিয়ে দিলে সারা পৃথিবীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করা যায়। যত বোতল এই মুহূর্তে উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে আছে, সেগুলিকে পর পর সাজালে তা নিউইয়র্ক থেকে টোকিও পর্যন্ত দূরত্ব হবে। কিন্তু যদি আমরা এখন কার্বন পদচিহ্ন কত তা হিসেব কষতে বসি, তাহলে আমাদের হিসেবে এই বোতল তৈরির জন্য যে শক্তি খরচা হয়েছে, খনিজ তেল থেকে যে হাইড্রোকার্বন পৃথক করা হয়েছে বা সংশ্লেষ পদ্ধতিতে যে শক্তি ব্যয় হয়েছে, পরিবহণ ও বিতরণে, বিজ্ঞাপনে যে বিপুল রসদ ও শক্তি ব্যয় হয়েছে, এসবের জন্য মোট কার্বন নির্গমনের কিছুই প্রায় হিসেবে আসবে না। তার পরিবর্তে হিসেবে আসবে ওই ব্যক্তিটি ওই বোতল বা প্লাস্টিক মোড়কবন্দি অবস্থায় সংগ্রহের জন্য যে খনিজ তেল পোড়ালো, তারপর ফেলার জন্য গাড়ি করে এল, বাড়িতে আলো জ্বেলে খেল, ঘর গরম করল ইত্যাদি নানান খাতে যতটা কার্বন বাতাসে ছাড়ল, সেটাই হল তার কার্বন পদচিহ্ন; আর বিপুল পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে এই সব জিনিস যারা নির্মাণ করল, তাদের ভাগের কার্বন পদচিহ্ন? সে তো হিসেবের মধ্যেই এল না! তাই বিজ্ঞাপনটিতে উৎপাদন সংস্থার পরিবর্তে দূষণের দায় ঠেলে দেওয়া হল উপভোক্তাদের ঘাড়ে।

এরপর আসি ২০০০ সালে। পরিবেশ-প্রতিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনে পৃথিবী উত্তাল, সারা পৃথিবীর মানুষের এক বড়ো অংশ পরিবেশ ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বহুজাতিক সংস্থাগুলির কারচুপির অনেকটাই ধরতে পেরেছেন। ১৯৭১ সালে পরিবেশ দূষণের দায় তারা চাপিয়েছিল ব্যক্তির ঘাড়ে। ২০০০ সালে এসে তাদের নতুন প্রচার হল বায়ুমণ্ডলে কার্বন (অর্থাৎ কার্বন ডাই অক্সাইড) ছাড়ার দায় খনিজ তেলের একচেটিয়া বেসরকারি ব্যবসাদার সংস্থার নয়, যারা ওই তেল ব্যবহার করে গাড়ি চেপে, বিমান চেপে, জলযানে চেপে রুটি-রুজির চেষ্টায় পাড়ি দিচ্ছে, দায়টা আসলে তার। শুনতে যতই অবাস্তব মনে হোক না কেন, প্রচুর খরচা করে অগিলভি কোম্পানিকে দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করলে গল্পের গোরুকে গাছেও চড়ানো যায়। এবারে প্রচারের দায়িত্বে পৃথিবীর সবচেয়ে সুগঠিত বেসরকারি খনিজ তেল নিষ্কাশনের সংস্থা, ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম বা সংক্ষেপে বিপি, যাদের পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যে রয়েছে ১৮,৭০০টি প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল বিক্রির বিপনণ কেন্দ্র। এদের প্রচারের মূল সুর এই রকম: তাপ-শোষক কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেওয়ায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে সতর্কবার্তা জারি করেছেন, তার জন্য মাতা ধরিত্রীর পেট চিরে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সুপ্ত কার্বনকে তুলে এনে বেচা-কেনার পণ্য করে তোলা তেল কোম্পানির এই বিষয়ে কোনও দায় নেই, যত দায় এই তেল যারা ব্যবহার করে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে তাদের। কেন? আমরা তো আগেই দেখিয়েছি যে কার্বন পদচিহ্নের দৃষ্টিকোণ থেকে উপভোক্তার কার্বন পদচিহ্ন বেশি আর যারা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় কার্বন বাতাসে ছাড়ছে তাদের ভাগিদারি কম! অগিলভি সংস্থা এই প্রচার সারা মার্কিন দেশ জুড়ে জনপ্রিয় করার পর এখন তেল এবং তাপবিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থাগুলি, যারা বায়ুমণ্ডলে বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড জমা করার আসল কুশীলব, তারা এখন বাজারে একটা “অ্যাপ” ছেড়েছে, যার “জেনেরিক নাম” কার্বন ফুট-প্রিন্ট ক্যালকুলেটর, যার মাধ্যমে আপনি প্রতি মুহূর্তে আপনার কার্বন পদচিহ্ন কত বাড়ছে তার হিসেব জানতে পেরে যাবেন (অবশ্যই ভুল গাণিতিক সমীকরণ, ভুল তত্ত্ব এবং ভুল গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করে)। আর কোম্পানি এই সংকটের জন্য আপনাকে দায়ী করে তার ব্যবসা নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাবে।

সভ্য জগতে অনেক আধুনিক ধাপ্পা চলে। বেশির ভাগই চলে বিজ্ঞানের নামে, অপবিজ্ঞান প্রয়োগ করে। বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ আমাদের সন্ধান দেবে কার্বন-ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে, টেকসই বিকাশের দিশায় যাত্রা করতে, তা করবেন বিজ্ঞানীরা, কোম্পানির আর্থিক সাহায্য ব্যতিরেকে, সামাজিক দায়বদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। সেই কাজ অনেক বিজ্ঞানী করে চলেছেন, বিজ্ঞানীদের সেই কাজের প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করছেন পরিবেশ কর্মীরা, রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান