ধান : জিয়নকাঠির স্পর্শে তার আপন সংস্কৃতি ফিরে পাক

লীনা চাকী 

উঠোনে গর্ত-উনুনে ইয়া বড়ো একটা মাটির হাঁড়ি বসানো। তারমধ্যে ভাত ফুটছে। দিদিমা পাটকাঠির জ্বাল দিচ্ছেন। ভাতের মধ্যে ছোটো সাইজের গোটা গোটা বেগুন। টগবগিয়ে ভাত ফুটছে। দুটো উঠোন পেরিয়ে আমাদের নাকে সেই সুঘ্রাণ এসে পৌঁছোচ্ছে। জিভে জল। আমরা বাটি নিয়ে দে ছুট। কানুদা, বলাইদা, বসনদা, মনাদি উবু হয়ে বসে। সামনে কাঁধা উঁচু কাঁসার থালা। পিসিমা আমাদের বাড়ি থেকে হাঁক পেড়ে বলছেন, ‘ও সুনতের মা, ওদের বেশি দিসনে। পেট কামড়াবে।’ দিদিমা সবার থালায় হাতা হাতা ভাত দিচ্ছেন, আমার আর মেজদির থালায় এক হাতা করে দিয়ে বলছেন, ‘আর চাবি নে, তোর পিসিমা বকবে।’ সেই ফ্যানা ভাত, যাকে আমরা বলতাম ঢলঢলে ভাত, কী যে স্বাদের! মিষ্টি, একটা চমৎকার গন্ধ লেগে থাকা তাতে। দেখতে একটু গোলাকার, মোটা, কিঞ্চিৎ লালচে। সে আমার শৈশবের কথা। প্রায় ৬০ বছর তো হয়ে গেল। বাদকুল্লার দেশের বাড়িতে আমরা বছরে দুবার যেতাম। তখন দিদিমার বাড়িতে ওই অন্ন-প্রাপ্তি ঘটত। সেই ভাতের গন্ধ এখনও যেন পাই। শুধু আমি কেন, যাঁরাই সেই ভাত খেয়েছেন, তাঁরা দেখছি কেউই ভোলেননি। পরে জেনেছি সে-চালের নাম আউস। গ্রামে ঘরে ঘরে সেই চাল রান্না হত। আমনের চেয়ে দাম কম, ভাতে বাড়ে, এছাড়াও অনেকক্ষণ পেটে থাকে। মাঠ-খাটিয়ে মানুষের জন্য আউসের ভাত ছিল আদরণীয়। বাড়িতে খাবার জন্য বিশেষ প্রকারের আউস ধান চাষ করা হত। সেই আউসের ধান এখন মাঠ থেকে উধাও হয়ে গেছে। শুধু আউস নয়, হারিয়ে গেছে হাজার হাজার নামধারী দেশি ধান। আর ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যতা। 

কৃষিযুগে মানুষ খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে জানতে পারল ধরিত্রী তাদের খাদ্য দিতে প্রস্তুত। মানুষ অভিজ্ঞতার বলে জানতে থাকল কোনটা খাদ্য, কোনটা অখাদ্য। এভাবেই ধান নামক এক শস্যের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটল। ভাতই হল তাদের প্রধান খাদ্য। ধান হল মুখ্য চাষ। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সাহায্য নিয়ে তারা ধান নিয়েই কতশত পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলল। কালে কালে কৃষকরা ধানেরই নানা জাত আবিষ্কার করতে শুরু করলেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের বাসনা জাগল ধানের নানা রকমফের করা ও সোহাগ করে তাদের নামকরণ করা। সেইসঙ্গে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে শুরু করলেন কোন ধানের চাল শরীরের জন্য উপকারী, ওষধিগুণসম্পন্ন। তাঁরাই তো সেই আদিকাল থেকে খাঁটি কৃষি-গবেষক। নানা উপায় খুঁজে নিয়ে তাঁরা হাজার হাজার রকমের ধান নিয়ে এলেন। এ এক লম্বা ইতিহাস। অতীত হয়ে গেছে সেসব ধানের নাম, ঐতিহ্য, চাষের পদ্ধতি, গুণকথা। এখন কৃষকরা হয়ে গেছেন কৃষিব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল। 

গত শতকের, এই ধরুন ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত ধান, অন্য শস্য, আনাজপাতি ফলানোর জন্য কৃষকের বোঝাপড়া চলত মাটির সঙ্গে। মাটিকে খাঁটি রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁদের। মাটিও তাঁদের বঞ্চিত করত না। খরা, অতিবৃষ্টির মুখোমুখি হয়েও তাঁরা ধৈর্য হারাতেন না। মাটি তাঁদের ফসল দিচ্ছে, সেই কৃতজ্ঞতায় কৃষক তার যত্নআত্তি করতেন। ফসল কাটার পর মাটিকে বিশ্রাম দিতেন। 

একবার বা দুবার ধান চাষ। বৈশাখে আউস, আষাঢ়ে আমন। বা কোথাও আউস-আমন কাছাকাছি সময়ের মধ্যে বোনা হত। খনার বচনে আছে ‘বৈশাখের প্রথম জলে, আউস ধান দ্বিগুণ ফলে।’ আউস ধানের বীজ ছড়ানোর সময় অড়হরের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হত। আউস ধান পাকতে লাগে তিন মাস। আষাঢ়ে লাগালে ভাদ্রে ফসল কাটা শুরু হত। অড়হরের গাছ জমিতে থাকত। আশ্বিন মাসে কাটা হত। গাছের পাতাপুতি জমিতে পড়ে সার হয়ে যেত। আর গাছের শক্ত ডাল হত জ্বালানি আর ডালের খোসা খেত বাড়ির গরু-বলদ। এখন আউসের চাষ একেবারেই বন্ধ। কারণ কম ফলন। এ-চালের তো বাজারে কদর নেই। তারসঙ্গে অড়হরের চাষও বন্ধ হয়ে গেছে। খনার বচনে নির্দেশ, ‘যখনকার যেমন, আউস ফুরোলে আমন।’ আমন ধানের ভরসা ছিল বৃষ্টির জল। ‘কথায় কথা বাড়ে, জলে বাড়ে ধান।’ আল দিয়ে জল বাঁধা হত। জমিতে জল দাঁড়ালে বা কাদা হলে বীজতলিতে লাগানো ধান রুয়ে দেওয়া হত, কিংবা সরাসরি বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হত। এটা এখনও আছে। অঘ্রাণে আমন ধান কাটার পর জমির বিশ্রাম, ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব। সময় মেনে কলাই, মুগ, ছোলা, মুসুর ডাল, তিল, সরষে ইত্যাদি শস্য, আনাজ ফলানো হত। 

অবশ্যই জমিতে সার দেওয়া হত। জৈব সার। অনেকেই, মানে যাঁদের জমি বেশি থাকত, ফসল কাটার পর ধঞ্চে চাষ করে নিতেন। এটা করা হত বর্ষার সময়। বৃষ্টির জলে সেগুলি পচে উৎকৃষ্ট সার হত। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সার গোবর। চাষের জমিহীন মানুষ ছাড়া সব কৃষকের বাড়িতে গাই-বলদ থাকতই। গোবরে ১৫/১৬ রকমের পোকা হয়। গোবর জমা হত জমিতে। আমিই দেখেছি জমিতে উঁচু করে রাখা গোবর। আগে জমিকে উর্বর করার জন্য একটা চমৎকার ব্যবস্থা ছিল। আমন চাষের আগে মাঠে রাখা গোবর মাটিতে মিশিয়ে দিতে হত। ‘বাপ ঠাকুরদাদের মুখে শুনেছি আগে একটা মাঠে কয়েকবছর চাষ করার পর তা ফেলে রাখত। গোচারণ ভূমিতে পরিণত হত। অন্য মাঠে চাষ চলত। কয়েকবছর পর সেই মাঠে আবার চাষ শুরু করত। অন্য মাঠ ফেলে রাখা হত। গোচারণ মাঠ পাওয়া যেত। প্রচুর গোরু পোষা হত। জমির স্বাভাবিকভাবে উর্বরতা বৃদ্ধি পেত। আমরা আগে প্রচুর গোবর সার দিতাম। তাছাড়া কোনো জমি এক বছর ফেলে রেখে বারবার চাষ করতাম। একে পচান করা বলে। এতে জমি সতেজ হত।’ (‘জমি বাঁচাতে বিশ্রাম প্রয়োজন’, ‘চণ্ডী মণ্ডল’। ‘বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি’। সম্পাদনা : লীনা চাকী) এটাই ছিল আগেকার নিয়ম। গ্রামের মানুষ একসঙ্গে বসে ঠিক করতেন কোন জমিকে গোচারণভূমি করা হবে। গ্রামের গোরু-বলদগুলিকে রাখালরা সেই জমিতে চরাতে নিয়ে যেত। গোবর আর ছাগলের নাদিতে জমি উৎকৃষ্ট চাষের যোগ্য হয়ে উঠত। জমির একবছর বিশ্রাম হত। তারপর চাষ করলে ধান ফনফনিয়ে বেড়ে উঠত। সত্যিই ধানের মাটিতে কোনও মালিন্য থাকত না। নষ্ট হত না প্রকৃতি ও পরিবেশ। ধান, পাট, আখ, ডাল, নানা আনাজ নিয়ম মেনে কৃষকরা চাষ করতেন। হাতের চেটোর মত জানতেন কোনটা আগে করতে হবে, পরে কোনটা বুনলে লাভ হবে। তাঁদের দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতাকে তাঁরা কাজে লাগাতেন। যেমন, ছোলা মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার পরে ধান বুনলে খুব লাভ। খনার বচন তো আসলে কৃষকদের মুখে মুখে তৈরি হওয়া প্রবাদ-প্রবচন। ‘খনা বলে চাষার পো, শরতের শেষে সরিষা রোঁ।’, ‘সরিষা বুনে কলাই মুগ, বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক।’, ‘পটল বুনলে ফাগুনে, ফল বাড়ে দ্বিগুণে’।, ‘খনা বলে শোন শোন, শরতের শেষে মূলা বোন’। বিস্তর নির্দেশ। বয়স্ক মানুষরা সবই জানতেন। তাঁদের জানা ছিল কোন সময়, কোন জায়গায় কী কী গাছ লাগালে ফল দেবে। পান গাছের জন্য নিবিড় ছায়া দরকার, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠতে হলুদ গাছ লাগাতে হয়, কার্তিকের মাঝসময়ে মটর, কলাই লাগাতে হয়। আউস ধানের জন্য নির্দিষ্ট মাঠে বেশ ক’টা বাবলা গাছ থাকত। বাবলা কাঠ দিয়ে গরুর গাড়ির চাকা, লাঙল বানাতে হত যে। আরও কত কিছু জানা নিয়ে কৃষকদের দিন চলছিল। খরা হলে ফসল শুকিয়ে যাওয়ার জন্য মাথায় হাত, দরিদ্র চাষির ঘরে ভাতে টান। অকৃপণ বৃষ্টি হলে চাষির মুখে হাসি, ধান বেচে ক’টা টাকা ঘরে আসত।  

ধানের জমি তো শুধু ধান গাছের রাজত্ব হয় না। আলবাঁধা মাঠের জমা জলে ঠাঁই নেয় কত পোকামাকড়, জলজ প্রাণী। বাসা বাঁধে পোকারা, কেঁচো, ব্যাঙ, এবং মাছ। ধান পাকলে হাজির হয় মেঠো ইঁদুর। জলে কত রকমের ছোটো ছোটো মাছ — দেড়আঙুলে কই, ল্যাটা, খলসে, পুঁটি, কুচো চিংড়ি — আর কত মাছের নাম বলব। এরা হত দরিদ্র মানুষের পুষ্টির জোগানদার অ্যানিমাল প্রোটিন। অনেকেই দেখে থাকবেন জমির আলের পাশ ঘেঁষে, কিংবা জল ছাড়ার জন্য কাটা আলে শোয়ানো থাকত পলো। লম্বাটে, একদিকের মুখ বন্ধ। রাতে রাখা থাকত, সকালে দেখা যেত নানা মাছ ঢুকে রয়েছে। আবার রাতেও কতজন কোমরে খলুই বেঁধে ধানজমিতে হাতের আন্দাজে মাছ ধরতেন। আমরা প্রায় ৩৫ বছর আগে শ্রীভূমিতে (লেকটাউনের পাশে) থাকতাম। পাশেই ছিল একটা এক বিঘে জমি। সেখানে ধান চাষ হত। একবার প্রবল বৃষ্টিতে চারধার জল থইথই হয়ে গেল। তখন দেখেছি ধানের মাঠের উপচানো জল রাস্তার জলের সঙ্গে এসে মিশছে। নানারকম মাছ ওই মাঠ থেকে জলের স্রোতে ভেসে এসেছিল! জল কমে যেতে দেখেছিলাম বিস্তর কই মাছ রাস্তার জলে হাঁকপাঁক করছে। মাছ ধরার জন্য কত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন! 

শুধু মানুষ ছাড়া প্রাণীজগৎ খাদ্য-খাদকের নিয়মে বাঁধা। পোকার টানে জমিতে থাকত ব্যাঙ। কতরকমের ব্যাং! বৃষ্টি হলে তাদের সে কী উল্লাস ধ্বনি! কান ঝালাপালা করে দিত। জমির পোকামাকড় খেয়ে তারা প্রায় সাফ করে দিত। ধান পাকলে আসত ইঁদুরের দল। প্রচুর ধান তাদের পেটে যেত। তেমন সময়ে কৃষকের বন্ধু হয়ে আসত প্যাঁচারা। ইঁদুর তাদের লক্ষ। এরা ছিল কৃষকের সহায়। তাই তাদের আপ্যায়ন করার জন্য মাঠে মোটা গাছের ডাল বা কাঠ পুঁতে রাখা হত। উদ্দেশ্য, সেখানে নিশ্চিন্তে বসে যাতে খাদ্যটিকে খুঁজে পায়। মাঠে লম্বা লম্বা লাঠি পোতা থাকত। কেন? ধানের শত্রু মাজরা, পামরি, ভেঁপু, চুঙ্গি ও বেশ কিছু পোকা। বিশেষ করে মাজরা পোকা। পোকা লাগলে চাষির দুশ্চিন্তা। এদের অনেকটাই উৎখাত করত চড়াই। এদের বলে মাঠ-চড়াই। ঝাঁকে ঝাঁকে চড়াই ধানজমির ওপর উড়ে বেড়াত। পোকাই ওদের খাদ্য। তাদের বসার জন্য মাঠে লাঠি পোঁতা থাকত। তারসঙ্গে আসত ফিঙে, বাবুই, শালিখ, ছাতারে। তারাও একই ভূমিকা পালন করত, পোকা খেয়ে সাফ করে দিত। কেঁচোর ভূমিকাটি ছিল অন্যরকম। এরা খেত পাতা, গোবর। সেগুলিই শরীরের বর্জ্য পদার্থ হয়ে বেরিয়ে সার হয়ে যেত। নীচের মাটি তারা উপরে তুলে আনত। মাটির নীচে তাদের বাস, তাই সারাক্ষণ চলত মাটি তোলার কাজ। চাষির জমি উর্বর হত, মাটি নিঃশ্বাস নিতে পারত। দেখা যেত পাতিহাঁসের দল ঘর থেকে ছাড়া পেয়েই মাঠের দিকে ছুটছে। আলের ধার ঘেঁষে তারা ঘুরত। তাদেরও খাদ্য মিলত ধানমাঠে। ধানজমিতে জমা জলে বকেরা মাছের খোঁজ করত। এই সব নানা পাখি, কেঁচো, ব্যাঙ, প্যাঁচাদের সঙ্গে চাষির অচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল। এরা ছিল পরিবেশবন্ধু। নিজেরা খাবার পেত, কৃষকেরও উপকার করত। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, কৃষকবিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ভূমিসংস্কার — এসবের মধ্যে দিয়ে আসার পর কৃষকদের সামনে এল ‘সবুজ বিপ্লব’, যা পরোক্ষভাবে পরিবেশ নষ্ট করার অশনি সংকেত হয়ে এল। প্রত্যক্ষভাবে জৈব চাষকে অকেজো করার ব্যবস্থা করা হল। কৃষকদের বহু বহুকাল ধরে বয়ে আসা কৃষিবিজ্ঞান, তাঁদের পরম্পরাবাহিত জ্ঞান মূল্যহীন হয়ে পরমুখাপেক্ষী হতে শুরু করল। 

আগে ছিল আমন আর আউস ধান। চাহিদার অভাব ও অলাভের কারণে আউস ধানের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটার পরে চাষিদের মনে হল বোরো ধান চাষ করলে লাভটা বেশি হবে। এই মনে হওয়াটার নেপথ্যে ছিল সবুজ বিপ্লবের হোতাদের হাতছানি। সময়টা গত শতকের ৭০/৮০র দশক। দেখা গেল আমন ধান কিছু জায়গায় বজায় থাকলেও শীতে বোরো চাষ শুরু হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আমনের পরই বোরো চাষ করে কৃষক বেশ লাভের মুখ দেখেন। যেমন, এখন নদীয়া জেলার চাষিরা বলেন তাঁরা একবারই ওই বোরো ধান লাগান। এই ধান পৌষ-মাঘ মাস নাগাদ লাগালে তিন মাসের মধ্যে পেকে যায়। অর্থাৎ শীতে লাগিয়ে গ্রীষ্মে কাটা। লাভ আমনের চেয়ে বেশি। আমন ধানের চেয়ে বোরো ধানের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি। দেশি ধানে লাভ খুবই কম হত। এক বিঘেতে ৮ মণের বেশি হত না, সেখানে বোরো চাষে ২০মণও হতে পারে। এখন খোঁজ করলে দেখা যাবে বোরো চাষ হাজার হাজার বছর ধরে লালিত দেশি ধানকে একেবারে হটিয়ে দিয়ে জমি দখল করে নিয়েছে। প্রায় লুপ্ত হয়ে গাছে দেশি ধানের চাষ। এর পিছনে আছে সবুজ বিপ্লবের ভূমিকা। যা সেই সময় থেকে মাটি, জৈববৈচিত্র্য ও পরিবেশ নষ্ট করার ভূমিকাটি পালন করতে শুরু করেছিল। তবে, সব ধান লুপ্ত হয়নি, প্রয়োজনে তাদের টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তুলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়া, গোবিন্দভোগ, কনকচূড়, বাসমতী, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, সীতাভোগ ও আরও বেশ কিছু ধান টিকে আছে। কারণ, এগুলির এখনও চাহিদা আছে। প্রতিটি দেশি চালের নিজস্ব গুণ আছে। সে যে কত গুণের ধারক তা বহুকাল আগে থেকেই জানেন চাষিরা ও এখন উদ্ভিদবিদরা। যেমন বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার ভূতমুড়ি ধান। চুঁচুড়া ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী উদ্ভিদবিদ বিজন অধিকারীর একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানছি ভূতমুড়ি চালের ভাত শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়িয়ে অ্যানিমিয়া সারাতে সাহায্য করে। তিনি জানিয়েছেন, ‘এখনকার দিনে যে আয়রন টনিক বা ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয় তার থেকে এর উপযোগিতা অনেক বেশি, তাই আগেকার দিনে আসন্ন প্রসবা মহিলা বা সন্তান প্রসবের পর মায়েদের ভূতমুড়ি চালের ভাত খেতে দেবার চল ছিল।’ (‘বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি’) এখনও এই চালের চাষ বজায় রেখেছেন বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার কিছু কৃষক। তাঁরা জানেন এই চাল গ্রামের মানুষের জন্য ঘরোয়া ওষুধ। মেদিনীপুর জেলায় প্রায় লুপ্তের তালিকায় চলে গেছে কবিরাজশাল ধান। অথচ ক্ষুধামান্দ্য, অরুচি, অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় এই চাল ছিল অব্যর্থ ওষুধ। গ্রামের মানুষরা এটা জানতেন। বিজন অধিকারী জানিয়েছেন, ভূতমুড়ি ছাড়াও মেদিনীপুরের চাপাখুশি, জয়াসিলেট, বর্ধমানের সীতাভোগ চালে আয়রন উচ্চফলনশীল চালের চেয়ে চার থেকে ছয় গুণ বেশি। সুগন্ধী দেশি জাতের মধ্যে আয়রনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এসব ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণায় পরীক্ষিত। আমরা যে শীতকালে জয়নগরের মোয়া খাই, সেটি হল কনকচূড় ধানের খই থেকে করা। জয়নগর-মজিলপুর অঞ্চলে এই ধানের চাষ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতি মেনে। না হলে ওই সুগন্ধ উধাও হয়ে যাবে। আর ঠিক সেই কারণে টিকে আছে ৫০-৫৫ রকমের দেশি সুগন্ধী চাল। বিজন অধিকারী বাণিজ্যিকভাবে এখনও চাষ হচ্ছে এমন কিছু ধানের নাম জানিয়েছেন। গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, বাদশাভোগ, তুলসীভোগ, কাটারিভোগ, সীতাভোগ, তুলাইপাঞ্জি, কালো নুনিয়া, গন্ধেশ্বরী, দাদশাল, চিনি আতপ, রাঁধুনিপাগল, কনকচূড়, জামাইনাড়ু। প্রতিটি চালের গুণাগুণ চাষিরা বংশপরম্পরা ধরে জেনে এসে এখন নির্গুণ উচ্চফলনশীল ধানের বশ হয়ে গেছেন, শুধুমাত্র আর্থিক কারণে।  

বোরো চাষের জন্য দরকার উচ্চফলনশীল বীজ। কৃষকদের বোঝানো হল জমিতে অধিক ফলনের জন্য দরকার এই উচ্চফলনশীল বীজ। এই বীজ প্রথমদিকে চাষিদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হল। তারসঙ্গে বোরো চাষের জন্য দেওয়া হল রাসায়নিক সার, কারণ, অসময়ের গাছ তড়বড়িয়ে বেড়ে উঠবে। আর এল জমির পোকা, ধানের পোকা মারার বিষ! কৃষকরা লাভের আশায় অনুগত হয়ে গেলেন নতুন পদ্ধতির। তার সঙ্গে এল মাটির তলা থেকে দেদার জল টেনে তোলার জন্য শ্যালো মেশিন। ট্রেনে যেতে যেতে দেখা যায় মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘরের সামনে শ্যালো মেশিন বসানো। কী ফোর্স জলের! গ্রামে গেলে সারারাত শক্তিশালী পাম্প চালানোর আওয়াজ কানে আসে। নদী থেকে টুলু পাম্প লাগিয়ে জল টেনে জমিতে ফেলার ব্যবস্থাও হল। বাঁকুড়া জেলার নবাসন গ্রামে যেতাম। নয়ের দশক থেকে সেখানে আমার যাতায়াত ছিল। আশ্রমের গা ঘেঁষে বয়ে যেত শালী নদী। বেশই চওড়া। যেহেতু মালভূমি অঞ্চলের নদী তাই গ্রীষ্মে জল কমই থাকত। তাও বহমান স্রোত ছিল। আস্তে আস্তে নদী ক্ষীণকায় হতে শুরু করল। একবার গিয়ে দেখি একটু দূরে, যেখানে নদীর মুখরক্ষা করার মত জল কিছুটা আছে, সেখানে টুলু পাম্প বসানো। চওড়া ফিতের মতো রাবারের পাইপ চলে গেছে জমির মধ্যে। এটা হচ্ছে কম খরচে জল নেওয়ার উপায়। প্রায় মৃত নদীকে একেবারে মেরে ফেলার ব্যবস্থা আর কী। চাষের জন্য জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা বহু আগে থেকেই ছিল। কিন্তু নাব্যতার সমস্যা, নদীমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে সেইসব কাটা খাল প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। আর আছে সেচের খালের কোনও সংস্কার না হওয়া। কত যে বিশাল বিশাল বিল জলস্তর নেমে যাওয়ার কারণে শুকিয়ে গেছে! বিল ও বহু ছোটো নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়ে এখন হয়েছে চাষের জমি। নদীয়া, মুর্শিদাবাদ জেলায় গেলে এটা দেখা যায়। মালভূমি অঞ্চলের নদী যেহেতু পাথর ও বালিবাহক তাই শুকিয়ে যাওয়া নদীতে চাষ করার তেমন সুবিধা নেই।

এইসব রাসায়নিক সার, হাইব্রিড বীজ, পোকামাকড় ধ্বংস করার বিষ তেল, ক্রমাগত পাম্প করে ভূগর্ভের জল টেনে তোলার ফল কী দাঁড়াল? এককথায় কৃষি-সংস্কৃতি, পরিবেশ, মানুষ ও অন্যান্য জীবের সর্বনাশ করে দেওয়া হল। আর কৃষি-ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করার ব্যবস্থা করে নিলেন। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত ব্যাবসায়িক চাল।। এটির মূলে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র, যার শিকার হয়েছিলেন ড. রিচোরিয়ার মতো মানুষ, এবং ষড়যন্ত্রকারী হয়েছিল আন্তর্জাতিক চক্র ও আমাদের দেশের সরকারের কৃষিদপ্তর। আমার জানাটি ঘটেছে জয়া মিত্রের ‘কৃষিকথা’ (ভূমধ্যসাগর পত্রিকা, ডিসেম্বর ২০২১) প্রবন্ধটি থেকে। সংক্ষেপে কিছু জরুরি অংশ এখানে জানিয়ে রাখি। “১৯৬০এর দশকে ভারতীয় ধানবীজ বিজ্ঞানী ড. রিচোরিয়া ছিলেন কটকের ধান গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর। নিজের চেষ্টায় ইনি ১৯০০০ রকম ধানের বীজ সংগ্রহ করেন। পরে আরও পাঁচ মোট ২৪,০০০। এরমধ্য থেকে তাইচুং ধানের কয়েকটি বিশেষ নমুনাকে তিনি চিহ্নিত করেন উচ্চফলনশীল, রোগমুক্ত দেশি প্রজাতি বলে। কিন্তু আমেরিকা প্রভাবিত ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিট্যুট (ইরি)-র প্রস্তাবিত কিছু ধানের প্রজাতি ভারতবর্ষে চাষ করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়ভাবে আপত্তি করেন। তার কারণ উক্ত প্রজাতিগুলি অপরীক্ষিত অবস্থায় আনীত হয় ও লাগানোর জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে। ‘ইরি’-র চাপে ভারত সরকার এই ভারতীয় ধান্যকৃষির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীর সঙ্গে কলঙ্কজনক কুৎসিত ব্যবহার করে। তাঁর কোয়ার্টার কেড়ে নেওয়া হয়, এমনকি জলের পাইপ লাইনও কেটে দেওয়া হয়! এবং পরবর্তীকালে তাঁর সংগৃহীত ২৪,০০০ রকম দেশি ধানের জার্মোপ্লাজম রায়গড়ের ইন্দিরা গান্ধি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-এর গবেষণাগার থেকে রহস্যময়ভাবে নষ্ট হয়ে যায়।” লিখছেন, “তিনি ‘সবুজ বিপ্লবে’র হিংস্র আক্রমণ থেকে ভারতকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন দেশের নিজের ধানবীজ দিয়ে। তাঁকে পদচ্যুত করা ও চূড়ান্ত অসম্মান করার প্রধান ভূমিকাগ্রাহীদের মধ্যে একজনের নাম ড. এম এস স্বামীনাথন, যিনি ড. রিচারিয়ার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে এসে বসেন।” এখন এই সবুজ বিপ্লবের প্ল্যানমাস্টার বলছেন, “একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল!” ড. রিচারিয়া যে ‘ইরি’-র ঘৃণ্য কুকৌশেলের শিকার হয়েছিলেন, তা তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিলেন একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে। আমি জয়া মিত্রের লেখাটি থেকেই পেলাম। ইরি-র ডিরেক্টর রবার্ট স্যান্ডলার ভালোমানুষের মুখোশ পরে কটকে এসে ড. রিচারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। ড. রিচারিয়া উৎসাহিত হয়ে তাঁর গর্বের আবিষ্কার ‘তাইচুং নেটিভ টি এন ১’ ধানের বিশেষত্ব ও ফলন নিয়ে তাঁকে বিস্তৃতে জানান। এইবারে স্যান্ডলার সর্বস্ব জেনে নিয়ে সোজা চলে গেলেন কেন্দ্রের কৃষি দপ্তরে। সেখানে একেবারে উলটো কথাটি বললেন। এরপরে তিনি আন্তজার্তিক আইন না মেনে ‘কিছু ধানবীজের গুচ্ছ বিনা কোয়ারেন্টাইনে দেশের মধ্যে নিয়ে এসে কৃষি গবেষণাগারের ধানচারার সঙ্গে মিশিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন।’ আইন অনুযায়ী, কোনও দেশের যে-কোনও বিদেশি বীজ বা গাছ কোয়ারেন্টাইন নিয়ম মেনে আনতে হয়। সেই আইনের ধারই ধারা হল না। সাক্ষাৎকারটিতে রিচারিয়া জানিয়েছেন, ‘সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিট্যুট’-এর গবেষণার গোপন কথা কেউ বা কারা ‘ইরি’-র কাছে পৌঁছে দিতেন। জয়া মিত্র সাক্ষাৎকারটি থেকে জানাচ্ছেন, ‘ড. রিচারিয়া বিনা পরীক্ষায় ওইসব ধানবীজ নিতে আপত্তি জানান। তিনি বলেন যে ওগুলিতে ভাইরাস আছে, ভারতের ভালো ধানগুলি সংক্রামিত হবে, এগুলো তিনি পাস করবেন না।’ স্যান্ডলার সরাসরি দিল্লিতে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, “ড. রিচারিয়া যদি কটকের ডিরেক্টার থাকেন তাহলে ‘ইরি’ কোনো সহযোগিতা করবে না।” তারপর যা হবার তাই হল। মূল উদ্দেশ্যটা ড. রিচোরিয়া জানিয়েছেন। “সবুজ বিপ্লবে’র সময়ে এটাই করা হয়। এটা খেয়াল করার বিষয় যে আমেরিকার সঙ্গে ধানের তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না, তারাই এখন ধান বিষয়ে গবেষণায় সর্বোচ্চ মতামত দিচ্ছে। ধান্যকৃষির সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি মানুষের তারাই ভাগ্যনিয়ন্তা।” হায়! ভারতের সফল কৃষিব্যবস্থাকে ধবংস করাই তাহলে মূল উদ্দেশ্য ছিল, যাতে ধানবীজের জন্য তাদের দ্বারস্থ হতে হয়। 

মাটিনির্ভর ফসল আজ মানুষ ও মাঠনির্ভর প্রাণীজগতকে সাংঘাতিক দূষণের শিকার করে দিয়েছে। মাটির নিজস্ব ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ লিখেছেন, ‘আজকের গুরুজি হলেন সার কোম্পানির ডিলার। ডিলার যেমন বলছেন চুপচাপ নিজেরা নিজেরা ঢেলে চলেছেন কৃষকরা।’ (‘কৃষি ও পরিবেশের ভাঙন, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিচিত্র শিল্পায়ন ও কৃষকের ভবিষ্যৎ’, সম্পাদনা : কল্যাণ রুদ্র।) রাসায়নিক সার বলতে বোঝায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, ফসফেট, পটাশ, ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট। চাষিরা গাছ তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠার জন্য নাইট্রোজেন সার বেশি ব্যবহার করেন। সুপার ফসফেটের সঙ্গে মেশানো হয় ক্যাডমিয়াম, ফ্লোরাইড। পটাশেও মেশানো হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। (তথ্যসূত্র : ‘কৃষিতে যথেচ্ছ রাসায়নিক ব্যবহারের কুফল’, রাধাগোবিন্দ মাইতি, ‘পশ্চিমবঙ্গের কৃষিচিত্র শিল্পায়ন ও কৃষকের ভবিষ্যৎ’) এগুলি মানুষের কতটা ক্ষতি করে? এককথায়, ভয়ংকর ক্ষতি করে ডেকে আনে ক্যান্সারের মতো রোগকে! মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে অক্ষম করে দেয়। নাইট্রোজেন যতটা ফসলের কাজে লাগে তো লাগল, বাকিটা জলে মিশে চলে যায় মাটির নীচে। সেখানে গিয়ে মেশে ভূগর্ভের জলস্তরে। সেখান থেকে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী যায় পুকুর, নদী, খালে। রাধাগোবিন্দ মাইতি জানাচ্ছেন, নাইট্রোজেন সার পরিণত হয় নাইট্রেটে। এই নাইট্রেটকে বদলে দেয় বিপজ্জনক জীবাণুরা। নাইট্রেট পরিণত হয় নাইট্রাইটে। তারপর এটির কাজ হল মানুষের শরীরের হিমোগ্লোবিনকে মিথিমোগ্লোবিনে পরিণত করা। ক্ষতি করতে শুরু করে হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন সরবরাহ, দেহকোষ, রক্তের স্বাভাবিক বহমানতা। আর তারই ফলস্বরূপ মানুষের দেহে বাসা বাঁধে ক্যান্সারের মতো মারণরোগ। 

নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামের বাসিন্দারা আমাকে বলছিলেন, বেগুন, করলা, কাঁকরোল লাল শাকে দুবেলা পোকা মারার বিষ স্প্রে করা হয়। পেসটিসাইট করা সেই বিষযুক্ত সবজি সরাসরি আমাদের নানা জটিল রোগের দিকে নিয়ে যায়। রাধাগোবিন্দ মাইতি জানিয়াছেন, ‘খাদ্যে যেসব বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে ডিডিটি, ডাইএলড্রিন, লিন্ডেন, এবং ম্যালথিয়ান প্রধান। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা এই বিষক্রিয়ার সহজ শিকার।’ (ওই) হরিহরপাড়ার আমানত ফকির জানাচ্ছেন, ওল গাছ লাগানোর সময় ফসফেট দিয়ে মাটি ফাঁপিয়ে নেওয়া হয়, তাতে ওল তাড়াতাড়ি বাড়ে। নদীয়া, মুর্শিদাবাদে কলাগাছের চাষটা বরাবরই খুব বেশি। আগে কলাগাছ লাগানোর জন্য সার দেওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারতেন না। এখন, আমানত জানালেন, এক একটা কলাগাছে পাঁচ-ছয় কেজি রাসায়নিক সার দেয়। গাছে খুব তাড়াতাড়ি কলা ধরবে যে! পাটে তো কীটনাশক দেওয়া হয়ই, তবে সেটা তো আমাদের শরীরের সঙ্গে যুক্ত নয়। 

এইবারে জলে আর্সেনিকের কথায় আসা যাক। এই বাংলার প্রায় ১০/১২টি জেলায় ভূগর্ভের জলে যে যথেষ্ট আর্সেনিক আছে সেটা অনেক বছর আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা সেটা জানতে পেরেছি। যেসব জায়গার পানীয় জলে অতিরিক্ত আর্সেনিক থাকে সেখানকার মানুষ ক্যান্সার, ভয়াবহ চর্মরোগের শিকার হন। মৃত্যুও ঘটে। আমনে বৃষ্টির জলই যথেষ্ট, কিন্তু বোরো হচ্ছে অসময়ের চাষ। এরজন্য শ্যালো পাম্পের উপর নির্ভর করতেই হয়। ধানজমির জন্য এই যে পাম্প বসিয়ে যথেচ্ছ জল তোলা হচ্ছে, সে জল আর্সেনিকযুক্ত। চালের মধ্যে দিয়ে সেই বিষও আমাদের শরীরে ঢোকে। 

আর, ধানজমির পাখি, সেই চড়াই, বক, ফিঙে, ছাতারে, প্যাঁচা, যারা এতকাল পরিবেশবন্ধু হয়ে কৃষকের উপকার করত, তাদের কী হল? ব্যাং, সাপ, বক গেল কোথায়! আর সে মৌমাছির দল, যারা পটলখেতের ফুলে ফুলে পরাগমিলন ঘটাত, তারা উধাও হল কেন? এরা সব হল জমির মারণবিষের শিকার। এখন গ্রামে গেলে চড়াই দেখাই যায় না! ছাদে ধান শুকোতে দিলে একটা চড়াইও আসে না। ছোটরা জানেই না চড়াই পাখি কাকে বলে। এসব আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তারা তাদের পরিবেশ রক্ষা করার ভূমিকা থেকে সরে গেছে। মারা গেছে, কিংবা প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কিংবা বুঝে গেছে তাদের খাদ্য আর জমি, ধানগাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এখন চড়াই শহরের জীবনে মানিয়ে নিয়েছে। শালিখ, ঘুঘুও তাই। বকেরা খোঁজ করে জলাজমির। প্যাঁচারা ধানজমির ইঁদুরের লোভে আর আসে না। গ্রামে এরাও এখন বিরল। যে দরিদ্র মানুষরা জমির মাছ পেয়ে শরীরে বল পেতেন, তাঁদেরও ভাতের পাতে মাছ এখন বিরল হয়ে গেছে। তাঁরা আশপাশের পুকুর থেকে পেতেন গেঁড়ি গুগলি। গ্রামের মহিলারা পুকুরে স্নান করতে গিয়ে কোঁচড়ে করে নিয়ে আসতেন অত্যন্ত উপকারী এই খাদ্যটি। এখন শুনি বর্ষায় ধানজমির উপচে পড়া বিষাক্ত জল পুকুরে মিশে তাদেরও শেষ করে দিয়েছে। অপুষ্টির শিকার হতে হচ্ছে তাঁদের ঘরের সন্তানদের। সেই মানুষরা তারসঙ্গে পেতেন মাঠে আপনিই হওয়া শাকপাতা। কতরকমের শাকের নাম তাঁরা বলেন। মাঠের আলের পাশ থেকে কোঁচড় ভরে শাক তুলে আনতেন। ভাতের সঙ্গে ওই একটিই পদ। জমির মালিক মোটেও তাঁদের বাধা দিতেন না। এখন বোরো ধানের জমিতে আগাছা জন্মায়, চাষি সেগুলি নির্মূল করার জন্য বিষের সাহায্য নেন। অর্থাৎ রাসায়নিক সার-তেলের কোপ এই মানুষগুলির ওপরও পড়েছে।  

বাড়ির পোষ্য প্রাণীরাও এই রাসায়নিক বস্তুগুলির শিকার হয়ে গেছে। তাদের মাধ্যমে মানুষও। গোরুর খাদ্য খড়। বোরো চাষ যেহেতু এখন প্রায় প্রধান, তাই তারই খড় কেটে গোরুকে দেওয়া হয়। এই খড়ের মধ্যে মিশে থাকে সার ও শত্রুকীটের বিষ। গোরুকে এই বিচুলি দিলে তারা হয় অসুস্থ হয়ে পড়ে, নয়তো অকালে মারা যায়। আবার, ওই বিচুলি খাওয়া গোরুর দুধও বিষ বহন করে, যা মানুষের শরীরে ঢোকে। এসব পরিবেশবিজ্ঞানীরা জানেন। আগে পাতুয়া গ্রামে আমাদের দেশের বাড়ি ছিল। গেলে রোজ দেখতাম গো-রক্ষক নিতাইদা লম্বা লম্বা, (অন্তত চার-পাঁচ ফুট তো বটেই) বিচুলি কাটছেন। এখন, এই বোরো ধানের খড় বেঁটে বেঁটে। দেখবেন, এখন আর ধানের খেতে বাতাস আর ঢেউ খেলিয়ে বয়ে যেতে পারে না। এই ধান দিয়ে মাটির ঘরের ছাউনিও হয় না, দিলেও একবছরও স্থায়ী হয় না। বাঁকুড়া অঞ্চলে খড়কে বিনুনির মতো পাকিয়ে যাঁরা বহুকাল ধরে ধানের গোলা করে এসেছেন, তাঁরাও নিরাশ। একটা দড়িতে পরপর গিটের মত থাকা এই বন্ধন এখন একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। এই নতুন চাষপদ্ধতি যে কতরকমভাবে প্রাণীজগতের ক্ষতি করে চলেছে তার খবর দেন পরিবেশবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা। 

প্রকৃতি ও পরিবেশের শৃঙ্খলা, একের সঙ্গে অপরের স্বাভাবিক সম্পর্ক, নির্ভরতা ও ব্যাবহারিক সাম্যতা যেভাবে ছিল, তা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল সবুজ বিপ্লবের পরে। চাষিদের বোঝানো হল জৈব নয়, কারখানায় উৎপাদিত রাসায়নিক সার, ধানের শত্রু কীটনাশক ওষুধ, হাইব্রিড বীজই তাঁদের পয়সার মুখ দেখাবে। আর, মাটির নীচের জল টেনে তুলে বোরো ধানের চাষ করলে সেচের জল, বৃষ্টির জলের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে না। চাষিদের বোঝাতে খুব বেগ পেতে হয়নি। ফুলে ফেঁপে উঠল পুঁজি নিয়োগ করা কৃষি-ব্যবসায়ীদের ব্যবসা। কোটি কোটি টাকা তাঁদের পকেটস্থ হল। এখনও তেমনটা চলছে। গ্রামের দিকে গেলে জানা যায় এই ব্যবসাটা ঠিক কতটা গতিতে চলছে। গ্রামে যদি পাঁচটা দোকান থাকে, তারমধ্যে তিনটেই সার-বীজের দোকান। দোকানি চাষিদের বোঝান, কোন সার কতটা লাগবে! তাঁরা তাই-ই করেন। দোকানির কাছে তাঁরা বাঁধা হয়ে গেছেন। সার-বীজের মূল সাপ্লায়াররা একটা অন্য খেলা খেলতে শুরু করলেন। সবুজ বিপ্লবের নামে প্রথমে বিনে পয়সায়, পরে চাষি কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেলে দাম নেওয়া শুরু হল। এক দশক এমনটা চলার পর দাম বাড়ানো শুরু হল। এখন সার, কীটনাশক ওষুধ ইত্যাদির দাম এতই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে চাষির মাথায় হাত। চাষের খরচের সঙ্গে তারা পাল্লা দিয়ে ধানের দাম বাড়াবেন কী করে? তাঁদের এখন টনক নড়েছে। তাঁরা জৈব ব্যবস্থার সঙ্গে এখন রাসায়নিকের তুলনা করছেন। কিন্তু তাঁরা এখন ওই পলোতে পড়া মাছের মতো, যেখানে ঢুকে পড়েছেন সেখান থেকে উলটোদিকে ফেরার রাস্তা নেই। নেই বলব না, আছে, কিন্তু এখনও তাঁরা সাঁড়াশির চাপে আছেন। তাঁরা কি চাইছেন, সেটা পরে বলছি। এখন দেখি একটা এক বিঘে জমিতে ধান চাষ করতে চাষিকে কি করতে হয়, কত খরচ হয়। প্রথমত ট্র্যাক্টর ভাড়া। এই বাংলা তো পঞ্জাব নয়, সেখানে প্রায় প্রত্যেক কৃষকের ঘরে ট্র্যাক্টর থাকে। এখানে প্রচুর জমির মালিক যাঁরা তাঁদের ঘরে ট্র্যাক্টর থাকে, তাঁরা কম জমির মালিকদের সেটি ভাড়া দেন। আবার, নিজস্ব জমি নেই এমন ট্র্যাক্টর-মালিকও আছেন, তাঁরা ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করেন। এখানেও চতুর বুদ্ধি চলে। ট্র্যাক্টরের ফাল বা দাঁত যতটা গভীরে গেলে জমি ঠিকঠাক কর্ষিত হয়, চালকটি তা করেন না বেশি ডিজেল খরচ হয়ে যাবে বলে। চাষিরা খেদ করেন। নদীয়া জেলার করিমপুরের বাসিন্দা লোকেশ বিশ্বাস বলছিলেন, জমিতে মুসুরি লাগানোর পর দেখছিলাম গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। এক ফুট নীচের মাটি শক্ত হয়ে যাচ্ছে, তাই শিকড় নামছে না। এর কারণটা হল ট্র্যাক্টরের ছ-ইঞ্চি দাঁত তলার মাটি পর্যন্ত যায় না। ওরাও তেল বাঁচানোর জন্যে চালাকি করেন। ওপর ওপর মাটি আলগা হয়, তলা শক্তই থেকে যায়। নদীয়া জেলার তেহট্টর বাসিন্দা চন্ডী মণ্ডলও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ট্র্যাক্টর দিয়ে আমাদের মাটিতে খুব ভালো চাষ হয় না। লাঙলের ফালের মত অত গভীরে যায় না।… তাছাড়া ট্রাক্টর দিয়ে বারবার চাষ করলে চাষ করা মাটির নীচের মাটি ট্র্যাক্টরের ভারে শক্ত হয়ে যায়। ফলে, ফসলের চারা মাটির খুব নীচে শিকড় নামাতে পারে না। ফসলের ভালো বৃদ্ধি পায় না। ফলন কম হয়। বিশেষ করে রবিশস্যের। গোরুর লাঙলে চাষ করলে ফসলের চারার বৃদ্ধি ভালো হয়।’ (‘জমি বাঁচাতে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন’, ‘বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি’, সম্পাদনা : লীনা চাকী) জমির ভালোমন্দ এঁরা ছাড়া কারা বুঝবেন? দানাশস্যের শিকড় যে কতটা গভীরে যেতে চায় তা একমাত্র তাঁরাই জানেন। 

বোরো ধান চাষ করতে আমনের মতই জল লাগে। নদীনালা, সেচের জন্য কাটা খাল, সেচ প্রণালী আর ভরসা দিতে পারে না। কৃষকদের বোঝানো হল গভীর নলকূপ, জল তোলার পাম্প যাকে শ্যালো মেশিন বলে, সেই সমস্যা মেটাবে। হাজার হাজার শ্যালো মেশিন অর্থাৎ ডিপ টিউবওয়েল বসে গেল। মাটির নীচের জল ভয়াবহভাবে নেমে যেতে শুরু করল। পাম্প বিক্রির ব্যবসা, জল বিক্রির ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। ছোটো চাষি জল কিনতে বাধ্য। রাসায়নিক সার, পোকা মারার তেল মাটির সর্বনাশ করতে করতে এখন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে সাত-আট বছর পরপর চাষ করার পর মাটি কোমায় চলে যাচ্ছে। প্রথমদিকে যতটা বিষতেল দিলে জমির শত্রু ও বন্ধুপোকা বিনাশ হত, স্বাভাবিকভাবেই আরও কঠিন প্রাণের বিষসহনশীল পোকারা জন্ম নেওয়ার ফলে আরও কড়া ওষুধ বাজারে এসে গেল। এখানেও চাষিরা ফাঁদে পড়া পাখির মত,— অতিরিক্ত দাম দিয়ে বিষসার, তেল কিনতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। পাঁচ বিঘে জমির মালিক বাঁকুড়া জেলার ছান্দার গ্রামের বাসিন্দা উত্তম পান হিসেব দিচ্ছিলেন। লাঙল ভাড়া নিতে হলে প্রতিদিন লাগে ২০০ টাকা, ট্র্যাক্টর ভাড়া ঘণ্টায় ৫০০টাকা। শুধু আমন ধান চাষ করেন বলে জলটা কিনতে হয় না। অত্যধিক দাম দিয়ে সার, কীটনাশক তেল কিনতে হচ্ছে। প্রতি বছর ধানের বীজ কিনতে হচ্ছে। জন-মজুরের খরচ অত্যধিক বেড়ে গেছে। আনুষঙ্গিক খরচ তো বাদই দিলাম। 

সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষকদের বশ করা গেলেও এখন তাঁরা ঠিক-বেঠিকটি বুঝতে পারছেন। না, মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ইত্যাদির কারণে নয়, তাঁরা এখন হিসেব কষছেন, কেনা সার, তেল, বীজ, জল, জন-মজুরি, ট্র্যাক্টর ভাড়ায় তাঁদের লাভের টাকা হাতের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে এটাও ধরতে পারছেন যে একই জমিতে বছরের পর বছর চাষ করে জমির ফলন একেবারে কমে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার দিয়েও এই হাইব্রিড ধানের উৎপাদন কমেই চলেছে। যতই সার দেওয়া হোক না কেন মাটি এখন বিদ্রোহ করছে। তাকে আর উজ্জীবিত করা যাবে না। মাটি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এখানে আবার জয়া মিত্রের লেখটি থেকে একজন গুজরাতি কৃষকের চিঠির বিষয় উল্লেখ করা যাক। তাঁর নাম ভাস্কর হিরাজি সার্ভে, যিনি একজন অভিজ্ঞ চাষি। ২০০৬ সালে তিনি চিঠিটি লিখছেন ‘ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মারস’-এর অধ্যক্ষ সেই স্বামীনাথনকে। ভারতে নতুন কৃষিনীতি তৈরির আগে কমিশন নিয়মরক্ষা করতে সব কৃষকদের মতামত চায়। তিনি একেবারে স্পষ্টভাবে বিরোধী ভাষায় লিখলেন, “আমি চুরাশি বছর বয়স্ক একজন প্রাকৃতিক-জৈব উপায় ব্যবহারকারী কৃষক। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা ধরনের খাদ্যশস্য ফলানোর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার আছে।…স্বামীনাথন, আপনাকে ভারতে তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লব’-এর পিতা বলা হয়। এই বিপ্লব ভারতে গত চল্লিশ বছর ধরে অসংখ্য জীবন ও জমি নষ্ট করা কৃষি-রাসায়নিক ব্যবহারের দ্বার খুলে দিয়েছিল। আমি মনে করি ভারতের দীর্ঘ ইতিহাসে আপনিই সেই ব্যক্তি এদেশে ঋণের ভারে নুয়ে পড়া কৃষকদের বেড়ে চলা ও আত্মহত্যা ও জমি বিষিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী।” একেবারে আঙুল তুলে স্বামীনাথনকে চ্যালেঞ্জ করে প্রশ্ন তুললেন, “আপনি অস্বীকার করতে পারেন যে চার হাজার বছর ধরে জমির উর্বরতার কোনো ক্ষতি না করে, প্রাকৃতিক তথা জৈব উপায়ে চাষের যে ঐতিহ্য এ দেশে ছিল, তার বদলে রাসায়নিক আর জলসেচের অতিব্যবহারে দুষ্ট এক পদ্ধতি আমদানি করে আপনারা এক প্রজন্মের মধ্যে সেই স্থিতিশীল উর্বরতা আর জৈব সম্পর্ক একেবারে নষ্ট করে দিয়েছেন?” 

হিরাজি সার্ভে সরাসরি সবুজ বিপ্লবের বিরূদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এখন এখানকার কৃষকরা জৈব চাষের সুবিধার কথা বলছেন, এবং রাসায়নিক সারে তাঁরা যে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না, সেটিও বলতে শুরু করেছেন। চণ্ডী মণ্ডল জানাচ্ছেন, ‘দেশি ধানের আবাদ ছিল। বিঘা প্রতি আট মণ ধান হত কিন্তু ভালো লম্বা খড় পাওয়া যেত। গোরুর সারা বছরের খাবার হয়ে যেত। এই ধানে রোগ সাধারণত লাগত না। ধান বুনে দিয়ে দুবার নিড়ানি দিলেই হত। চাষের সময় গোবর পচা সারই শুধু দিতাম। লাগানো ধান লাগিয়ে দিলেই হত। আর কোনো খরচ ছিল না।’ এখন তিনি চার বিঘে জমিতে বছরে দু-তিনবার উচ্চফলনশীল ধানের চাষ করেন। ‘ফলন বেশি হয় খরচও বেশি, পরিশ্রমও বেশি।’….’বারবার একই জমিতে চাষ করার ফলে ফলন আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে, যতই সার বেশি দিই না কেন।’ তিনি দেখছেন বারবার বিষ তেল দিলেও পোকামাকড় দমন করা যাচ্ছে না। ফসলে রোগও লাগছে বেশি। সাক্ষাৎকারে তাঁর কাছে জিজ্ঞাস্য ছিল গোবর পচা সার জমিতে দেন কি না। তাঁর উত্তর, ‘হ্যাঁ, আমি প্রতি বছর অল্প অল্প গোবর সার দিই। দেখি পাশের গোবর সার না দেওয়া জমি থেকে ফসল একটু ভালো হয়।’ অর্থাৎ তিনি জৈব আর রাসায়নিকের তুলনা করে দেখছেন। তিনি খুব হতাশ। নতুন নতুন কীটপতঙ্গ হচ্ছে, মাটির যা অবস্থা হচ্ছে তাতে নতুন করে দেশি ধান চাষ করলে ফল কেমন পাওয়া যাবে তা নিয়ে তাঁর যথেষ্ট সংশয় আছে। বর্ধমান জেলার ছোটো বৈনান গ্রামের ভাগচাষি আনন্দময় পণ্ডিতের স্পষ্ট বক্তব্য, মিল মালিকরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ‘সার-তেল ব্যবসায়ীরা যা বলে চাষিকে ততটা পরিমাণই দিতে হয়।’ ক্ষুব্ধ মানুষটির কথায় ‘পরিবেশের চারধারের ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া কীটনাশক কোনো বছর কাজ হয়, কোনো বছর হয় না, যারা ওষুধের ব্যবসা করে, তারা ভাঁওতা দিচ্ছে কি না বোঝা যায় না। সঠিক ওষুধ নেই। চাষির পয়সা নষ্ট হচ্ছে, লোক লেবার করে চাষি মাঠে মাঠে ঘুরে মরছে।’ (এই সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়া হয়েছিল ২০১১সালে)। যাঁদের বিঘের পর বিঘে জমি আছে তাঁদের কথা আলাদা, কিন্তু দেখছি ছোটো চাষিরা প্রথমদিকে নব্য চাষপদ্ধতির অনুগত হলেও এখন প্রশ্ন তুলছেন। এখন তাঁদের মতো অনেকেই নিজের নিজের মতো করে এই সবুজ বিপ্লবের যাবতীয় ক্ষতিকর দিককে সরিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে চাইছেন তাঁদের জৈব চাষের কাছে। ঠকে এবং ঠেকে জেনে গেছেন এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে জমিও একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়ে তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে চলে যাবে। বিষ্ণুপুরের স্বপনের দুবিঘে জমি, ধানকাটার সময় কলকাতা থেকে দেশের বাড়িতে যান। বলছিলেন, আমনের পর বোরো চাষ শুরু করেও বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, রাসায়নিক সারের কুফল কী হতে পারে তা ওঁর অভিজ্ঞ বাবা হিরাজি সার্ভের মতোই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। ওঁরা জমিতে গোবর সারই দেন। আমন ধান উঠে গেলে নানা সবজি চাষ করেন। 

হারিয়ে যাওয়া দেশি ধানকে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলায় জেলায় ধান্য গবেষণা কেন্দ্রগুলি প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কম জলে কীভাবে ধান চাষ করা যায়, কোথায় কোন মাটিতে কী জাতের ধান লাগালে ফলন ভালো হবে, কত কম সময়সীমার মধ্যে একটা চাষ রাখা যায়, কত কম খরচে চাষ করে চাষি লাভবান হবেন, ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা চলছে। মিলন দত্ত জানাচ্ছেন, ‘খুব ছোটো ছোটো এবং অসংগঠিত উদ্যোগ হলেও এ রাজ্যেও বাংলার ঐতিহ্যগত প্রাচীন জৈব কৃষি-পদ্ধতিকে বাঁচিয়ে তুলে রাসায়নিক বিষের চক্র থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে। মূলত বেসরকারি এবং চাষিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগই সে ক্ষেত্রে বেশি। কিন্তু একটি রাজ্য সরকারি কৃষি খামার রয়েছে, যেখানে গত ছয় বছর কোনো রাসায়নিক সার প্রবেশ করেনি। ফুলিয়ার সেই কৃষি খামারটি ইতিমধ্যে অন্তত সত্তরটি প্রজাতির প্রায়-বিস্মৃত দেশি ধানের চাষ ফিরিয়ে এনেছে। বাংলার প্রাচীন ওই ধানের প্রজাতি তারা কেবল ফিরিয়েই আনছে না, একই সঙ্গে বিভিন্ন জেলার চাষিদের জৈব প্রক্রিয়ায় দেশি ধানের চাষ করার প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। প্রত্যেক বছর ফুলিয়ার ওই কৃষি খামারে সাড়ে তিনশো চাষির প্রশিক্ষণ হয়।’ (‘দিশি ধানের খোঁজে’, ‘ধান ও ধান সংস্কৃতি’) এইসব সদর্থক সংবাদ থেকে পরিবেশকে আবার শুদ্ধিকরণ করার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথাই জানতে পারছি। 

দেশি ধানের চাষও হচ্ছে খামার-সংলগ্ন নির্দিষ্ট জমিতে। চাহিদাও যথেষ্ট। সাধারণ মানুষ খোঁজ করছেন দেশি চালের। সল্টলেকের বিধাননগর মেলায় দেখি বস্তা বস্তা তুলাইপাঞ্জি চাল, গোবিন্দভোগ চাল আনেন উত্তরবঙ্গের বিক্রেতারা। বেশ চাহিদা আছে। কলকাতায় বেশ কিছু অঞ্চলে জৈব সার দেওয়া দেশি চাল, মশলা, ডাল ইত্যাদির দোকান আছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা ব্লকের ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের সুধাংশু দে বললেন, ‘আগে এখানকার চাষিরা জৈব সার দিতে রাজি হত না। আয়লা, আমপানের পর থেকে বিশ্বাস এসেছে।’ সেসময় সুন্দরবনের সমস্ত জমির জল অতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য উচ্চফলনশীল সব জাতের ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বেঁচে ছিল শুধু দেশি দুধেরসর ধান গাছ। সুধাংশু বললেন, ‘রাসায়নিক সার পুরো বন্ধ হয়নি। কিন্তু মানুষ জৈব সার আর দেশি ধান চাষের দিকে ফিরেছে। বীজ তো কিনতে হয় না, আমাদের খামার থেকেই নিয়ে যায়। এখন আমরা এখানে শুধু দুধেরসর ধানই চাষ করাই। আমাদের চাল পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বহু জায়গায় যায়।’ 

অনেকেই নানারকম জৈব সারও তৈরি করার চেষ্টা করছেন। গ্রামের খবর বলছে এখন গ্রামে গোরু নেই-ই বলা যায়। ট্র্যাক্টর আসার পর বড়ো জমির মালিকরা গোয়ালঘর শূন্য করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র হাল-বলদে আস্থা আছে যাঁদের তাঁরাই গোবর সার দিতে পারেন। তবে সে তো যৎসামান্য। এই অভাবটা পূরণ করার জন্যই পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নানারকম জৈব সার আবিষ্কার করার চেষ্টা চলছে। লোকেশ বিশ্বাস বলছিলেন, ‘এখন তো বলছে কচুরিপানা চেপে নিয়ে নিমপাতা দিয়ে পেস্টিসাইট করা যায়। ধান গাছের পোকা মারার এমন সব নানা জৈব ওষুধ আসছে।’ গুগল খুললেও জানা যাচ্ছে মাজরা, চুঙ্গি ইত্যাদি পোকা মারার জৈব উপায়। এসবই আগামী দিনের জন্য সুখবর। মাটি আবার তার হারানো সম্মান ফিরে পাবে। পরিবেশ আবার ফিরিয়ে আনবে মানুষ, পশু, পাখির দূষণহীন খাদ্য-শৃঙ্খলা।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান