ইকোপোয়েট্রি : ‘নিসর্গকে অনাহত রাখবার অভিপ্রায়’

ঋতম্‌ মুখোপাধ্যায়

              “Beauty is sexual, and sexuality                                                                                                  
               Is the fertile of the earth and                                                                                                              
                         The fertility                                                                                                                                  
                  Of the earth is economics.”  

(‘Ezra Pound’s Proposition’, Robert Hass) 

কেন ইকোপোয়েট্রি? আমেরিকার বিখ্যাত ‘পোয়েট্রি’ ম্যাগাজিনে এমনই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে (জানুয়ারি, ২০১৬)। প্রবন্ধটির নাম ‘Why Ecopoetry?’ প্রাবন্ধিক John Shoptaw। আমেরিকার কবি রবার্ট হ্যাস সহ একাধিক কবির কবিতার দৃষ্টান্ত টেনে জন বোঝাতে চেয়েছিলেন, ইকোপোয়েট্রি নিসর্গনিবিড় কবিতারই একটা বৃহত্তর সংরূপ, যদিও এসব কবিতা মানুষের হাতে জড় ও অজড় পরিবেশের বিপন্নতার কথা তুলে ধরে, নিছক ভয়ংকর সুন্দর প্রকৃতি চিত্রণই এখানে শেষ কথা নয়। আর সেই সূত্রেই নদী, পাখি, অরণ্য, আকাশ ও পৃথিবীর বিপন্নতা আমাদের ভয়ার্ত করে এসব কবিতায়। যদিও কেবল ভীতিসঞ্চার নয় পৃথিবীর প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধুর চেহারাটিও এই ইকোপোয়েট্রির বিষয় হয়েছে বারংবার। তাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর ‘সবুজ দুর্ভাবনা’র পাশাপাশি ‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে’ গান আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। ইকোক্রিটিসিজমের পাঠপদ্ধতি মেনেই এখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’র বাঁধ নির্মাণের রাজনৈতিক অভিপ্রায় কিংবা ‘রক্তকরবী’-র কর্ষণজীবী-আকর্ষণজীবী সভ্যতার দ্বন্দ্বকে নতুন করে বুঝতে পারি। ইকোলজি (গ্রিক ঐকোস্‌ = বাড়ি) শব্দের মধ্যে যে সকলের বাসা রক্ষা করার শুভৈষণা নিহিত রয়েছে, তা আমাদের জীবনানন্দের এই পঙ্‌ক্তিগুলিকে যেন নতুন করে পড়তে শেখায় :  

               “আমরা মধ্যম পথে বিকেলের ছায়ায় রয়েছি                                                                                    
               একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের আগে;                                                                             
              আরেকটি পৃথিবীর দাবি স্থির করে নিতে হলে লাগে                                                                      
                    সকালের আকাশের মতন বয়স;                                                                                                        
             সে সকাল কখনও আসে না ঘোর স্বধর্মনিষ্ঠ রাত্রি বিনে।”   

(‘বিভিন্ন কোরাস’ / “মহাপৃথিবী”)

এই যে ‘নষ্ট পৃথিবী’র কথা কবি বলেন আমাদের সে কি এই বিপন্ন প্রহরে আমাদের এই দৃশ্যমান পরিবেশ আর মানব-সম্পর্কেরও বিনষ্টি নয়? এই কি পৃথিবীর গভীরতর অসুখ নয়? তাই ভারতীয় ইকোলজির অগ্রদূত রবীন্দ্রনাথ এবং উত্তরজাতক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পরিবেশভাবুকতা গদ্যে-কবিতায় যেমন আমাদের সতর্ক করে, তেমনি সাম্প্রতিকালের কবিদের কবিতায় এই বিপন্ন পৃথিবীর জন্য কান্না এক নতুন পরিবেশবোধের জন্ম দেয়। এই ইকোলজিময় নন্দনতত্ত্বকে ইকোপোয়েটিক্সও বলা চলে। যে-ইকোপোয়েটিক্স-এর মধ্যে গৃহনির্মাণ ও রক্ষার আশ্বাস নিহিত থাকে, শুধু নিজে বাঁচা নয়, সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচার মতো এক ‘আলোপৃথিবী’ যেন গড়তে চায় এই ইকোপোয়েট্রি।    

দুই

রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘অরণ্যের ধর্ম’ প্রবন্ধে বারংবার পৃথিবীকে ভালোবেসে তার সঙ্গে যৌথভাবে বাঁচার উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। তাঁর ভাষায় : 

“For us the highest purpose of this world is not merely living in it, knowing it and making use of it, but realizing our own selves in it through expansion of-sympathy; not alienating ourselves from it and dominating it, but comprehending and uniting it with ourselves in perfect union.” 

(‘The Religion of The Forest’)

এছাড়াও তাঁর প্রবন্ধে ও অন্যান্য সাহিত্যে এই পরিবেশভাবনা মূর্ত হয়েছে। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা, তপোবনের মত উন্মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদান, হলকর্ষণ-বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা – এসবই রবীন্দ্রনাথের এই ইকোলজি-সচেতনতাজাত প্রয়াস। উত্তরকালের সাহিত্যিকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দর প্রকৃতিচেতনা কীভাবে পরিবেশমুখী হয়েছে, তা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। যদিও এই তালিকায় ঈষৎ উপেক্ষিত কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। এই অভিযাত্রী মনের কবির ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘আরণ্যক’, ‘বাঘের কপিশ চোখে’ ‘সীতা’ ইত্যাদি কবিতা কিন্তু সচেতন পরিবেশভাবনার চিহ্নবাহী। শহরের সাজানো সভ্যতার হৃদয়হীনতা তাঁর সংবেদী মন-কে পীড়িত করে। ‘আরণ্যক’ কবিতায় দেখেন বন কেটে, পশু হত্যা করে মানুষ হয়ে ওঠে হিংস্র শ্বাপদ। তবু জেগে থেকে ‘অনুচ্ছিন্ন অরণ্যের ডাক’। আর ‘হরিণ চিতা চিল’ কাব্যের নাম কবিতায় ধ্বনিত হয় সেই আর্তনাদ আর প্রতিবাদের যুগলভাষ্য। কবিতার শুরু হয় এক দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া প্রশ্ন দিয়ে :

                       “পালাতে পালাতে কতদূর?
                ওদিকেও সেই পিচের রাস্তা অজগর-গ্রাসে খুঁজছে।                                                                             
                        বনের সবুজ গাঢ় মগ্নতা                                                                                                            
                          লাঙলে কুড়ুলে ভ্রষ্টা।
                          হরিণ, আমার হরিণ,                                                                                                                 
                     তোমার জন্যে জাদুঘর দেব বানিয়ে।                                                                                              
               সেখানে তোমার অবোধ চাউনি বরফে থাকবে জমানো।”

পিচের রাস্তার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয় অজগরের রাক্ষুসে ক্ষুধা। তাই সবুজকে ধ্বংস করার ছবির পরেই আসে হরিণের কথা। যে প্রাণচঞ্চল, সুন্দর, নিরীহ হরিণ-কে শিকার করে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখে মানুষ। বন্য পশুকে বিনা কারণে প্রাণ দিতে হয়। জীবনানন্দের ‘ক্যাম্পে’, ‘শিকার’ ইত্যাদি কবিতাতেও নাগরিক মানুষের হরিণ শিকারের নির্মম ছবি আছে। কবিতাটিতে এরপর আসে চিতা ও চিলের কথা। হিংস্র, গতিময়, ক্ষিপ্র চিতাও বাতানুকূল ঘরে মানুষের অধীনতা শিকার করবে, মৃত বা জীবিত হয়ে। কেবল একলা চিল এসব প্রকৃতি-বিরোধী কাজের দ্রষ্টা। সে দেখে মানুষের ক্ষমতার আস্ফালনে ‘বাধ্য নদীরা বইছে’ আর ‘আকাশের মেঘ হুকুম-মাফিক গর্জায়’। মানচিত্রের ফাঁক ভরাতে মানুষ নদ-নদীকেও বেঁধে দিয়েছে, নগরায়ণের এই নির্মম চিত্রটির প্রতি বিদ্রুপ আর বেদনা যুগপৎ ব্যক্ত হয়েছে। মানুষের ক্ষমতার আস্ফালনে প্রকৃতিকে প্রাণীকুল-কে এইভাবে নতি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু কবি এই নাগরিক ‘অজগর গ্রাস’ থেকে মুক্তি চান। তাঁর চিল হয়ে ওঠে গগনবিহারী এক পাখি, যাকে তিনি এই সর্বগ্রাসী, ধ্বংসাত্মক নাগরিকতা থেকে দূরে রাখতে চান। যদিও জানেন চিলেরও নীড়ে ফেরা প্রয়োজন। কিন্তু সেই নীড়ও খুঁজে নিতে হবে হয়তো দুর্গম পাহাড়ে, যদিও সেটুকু যদি মানবসভ্যতা অবশিষ্ট রাখে। চিলের জন্য তাই কোনো শান্তি নেই, আছে কেবল ‘স্বস্তির উচ্ছিষ্ট’। প্রকৃতি মানুষের আন্তরিক সহাবস্থান হারিয়ে যাওয়ার এই যে ছবি ফুটে ওঠে এখানে, তার কোনো সমাধান কি নেই? অতীতের মুক্ত আরণ্যক জীবন আজ জীবাশ্ম মাত্র। কবি যেন প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংসকারী মানুষের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন ‘অগ্নিগর্ভ গহ্বর সব বোজানো’? কবিতার শুরু এবং শেষ পঙ্‌ক্তিদ্বয় এভাবেই জিজ্ঞাসা খচিত। চিল-কে উদ্দেশ্য করে তিনি যেন বলতে চান আদি সভ্যতা শুধুই জীবাশ্ম নয়, বরং এই অনাচারের বিরুদ্ধে অগ্ন্যুৎপাত-ই একমাত্র প্রকৃতির প্রতিশোধ। 

তিন

প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্যান্য প্রাণীদের ধ্বংসের ছবির পাশাপাশি উপদেশাত্মক কবিতাও রয়েছে সেখানে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘গাছ কেটো না’ কবিতায় গাছ কাটার কুফল দেখিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুদের বলা হয়,

                   “তাই তো বলি গাছ কেটো না,                                                                                                           
                        গাছকে রাখো ধরে,                                                                                                                          
                     তা নইলে ভাই লক্ষ্মীসোনা                                                                                                           
                        বাঁচবে কেমন করে?”    

ঠিক একইভাবে কবীর সুমনের কণ্ঠে ‘পুকুর পাড়ের নোয়ানো গাছ’ গানটিও পুকুর বুজিয়ে, গাছ কেটে প্রোমোটারদের ফ্ল্যাট বাড়ি বানানোর অবিরাম প্রচেষ্টাকে বিদ্রুপ করেছে ‘যুগের হাওয়া অন্য মনে জমি বেচার টাকা গোনে’। সরল দে তাঁর ‘যন্তর মন্তর’ ছড়ার বইয়ে মজার ভঙ্গিতে গভীর কথা বলেন : ‘উড়ে এসে পড়ে যদি পরমাণু ভস্ম / পরমায়ু হ্রস্ব’। জয় গোস্বামীও লেখেন ‘মা নিষাদ’ কবিতা, পরমাণু বিস্ফোরণের বিরুদ্ধে যা আমাদের সচেতন হতে বলে :

                    “ভূগর্ভবিষ ফসলের দেহে ঢোকে                                                                                                            
                   ও মেয়ে তোদের শরীরে শরীরে যায়                                                                                                    
                    দূরে বসে কেউ বন্ধ্যা করেছে তোকে                                                                                                      
                    তুই ভেবেছিস মাটিরই তো সব দায়...
                   পুরাকাল থেকে তীর তুলে আছে ব্যাধ                                                                                             
                     বোতাম টিপলে পৃথিবী ধ্বংস হবে।” 

তবে ওপার বাংলার আল মামুদের ‘রসায়নের রান্না’ ছড়ার ছন্দে লেখা একটি চমৎকার ইকোপোয়েট্রি, যা বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে পরিবেশদূষণের সমস্ত চিহ্নগুলিকে তুলে আনে আমাদের সামনে : 

                “শস্য ছিল শ্যামল ছিল, ছিল সুখের পার্বণ                                                                                  
                 শান্তিটাকে পুড়িয়ে মানুষ করল কালো কার্বন।                                                                                     
                  পক্ষী কাঁদে পুষ্প কাঁদে। রসায়নের রান্না                                                                                              
                বন্ধ করো বন্ধ করো, আর পারি না আর না।” 

একালের সবুজ রসায়নের চর্চার পিছনে এই ধরনের অনুভূতিই হয়তো বিজ্ঞানীদের মনে কাজ করছে ইদানীং। তবে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এই ইকোপোয়েট্রি চর্চায় বাংলা সাহিত্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর একাধিক প্রবন্ধ এবং অসংখ্য কবিতা এ-প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথম জীবনে ‘জীবনানন্দ’ প্রবন্ধ গ্রন্থে তিনি কবির ‘ক্যাম্পে’ ‘শিকার’ ইত্যাদি কবিতা, ‘জীবনপ্রণালী’ এসবের সূত্র ধরে ইকোলজি নন্দিত তন্ময় সংবেদের কথা আমাদের জানিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল : 

“ইয়োরোপের মানুষ আজ বুঝতে পারছে যোগ্যতমের টিঁকে থাকার নাম দিয়ে মানুষ এপর্যন্ত বিশ্বপ্রকৃতিতে যে সর্বগ্রাসী ব্যভিচার চালিয়ে এসেছে, তাকে মার্জনা করা চলে না, বুঝতে পেরেছে প্রকৃতি তথা সার্বিক প্রাণলোকের সঙ্গে এক স্তরে অন্বিত থেকে সহযোগিতা না করতে পারলে সৃষ্টিই তলিয়ে যাবে।”

এ-ভাবনায় অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা আছে। কেননা ‘অরণ্যদেবতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ “এ সমস্যা আজ শুধু  এখানে নয়, মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদ্‌কে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”– এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অলোকরঞ্জন তাঁর অসংখ্য কবিতায় পরিবেশভাবুকের উদ্বেগ, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ বারংবার লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘আয়ুকর’ কবিতাটি যেমন, অরণ্যকে ডাক নাম ধরে ডেকে নির্জনতাকে বাসযোগ্য করে তোলার কথা বলে। কবি বলতে চান প্রকৃতি ও মানুষের সমন্বয় সাধিত না হলে আয়ুকেই কর হিসেবে দিতে হবে আমাদের : “মানুষকে মাঝখানে রেখে নয়। আকাশের পাশে কিংবা সান্দ্র গাছগাছালির ছায়াকোণে স্পর্শাতীত যেসব বটের ঝুরি মগ্নচৈতন্যের শিখা জ্বেলে আছে মানুষকে স্বযাচিত হয়ে তাদের গরজ বুঝে নিতে হবে”। এই দায়বদ্ধতার গরজেই তিনি পাখিদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মরণমুখী মোবাইলের টাওয়ারের বিরোধিতা করেন, মেরুবরফ গলে গিয়ে পেঙ্গুইনদের ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কায় ব্যথার্ত হন, প্রতিবাদ করেন ভারতের মতো কল্যাণরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তিপরীক্ষার। হিরোশিমা, ফুকোশিমা আর চ্যের্নোবিল আজ তাঁর কাছে তিনটি মৃত শরীরের নাম। করোনা আবহেও বলেন, এই ‘ধনতন্ত্রের তৈরি করা ভাইরাস’ আসলে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ। একদা ‘চৌরঙ্গীর ফুটপাতে’ হাঁটতে গিয়ে দূষণের ছবি দেখে লিখেছিলেন “আমার শতাব্দীর কামধেনু / ঢেলে দিচ্ছে কালো দুধ, সীসারঙা” কিংবা গাছ কেটে ফোয়ারা তৈরি করার নাগরিক সৌন্দর্যায়ণকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন “প্রাঙ্গণে যাব না”; তিনি একইভাবে বিরোধিতা করেন সৌরবিদ্যুৎ তৈরির মাধ্যমে আণবিক বিষবাষ্প ছড়ানোর। তবু সভ্যতার এইসব গর্হিত পাপকে সরিয়ে কবিতার স্পন্দনে ফুটিয়ে তোলেন অমূর্ত গোলাপ, ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও প্রজাপতির ডানায় জীবনের ছন্দ খুঁজে পান।   

চার

সাম্প্রতিক বাংলা ইকোপোয়েট্রির আলোচনা করতে গেলে আমাদের এই ধারাটিকে ভুলে গেলে চলে না। তাই যখন বিপ্লব মাজীর ‘পানিয়ার যুবতীর একসমুদ্র গল্প’ (২০১৫) এবং কবি অচিন্ত্য নন্দীর ‘আসবাবজন্ম’ (২০১০) ও ‘গাছেদের ভুল প্রাণে’ (২০১৮) কাব্যগুলি পড়ি; তাদের বিষয় বৈচিত্র্য নয়, শৈলীর নিজস্বতা এবং পরিবশবোধের ধারবাহিকতায় ভাবিত হই।  ইকোপোয়েট্রির বিষয় হিসেবে প্রকৃতি-মানুষের সম্পর্ক, প্রাণীহত্যা, অরণ্য নিধন, গাছ কাটা, পুকুর বোজানো বা দূষণ, পরমাণু বিস্ফোরণ, আর্সেনিক ও প্লাস্টিক দূষণ, মোবাইল টাওয়ার, নদীদূষণ ও বাঁধের সমস্যা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বর্জ্যপদার্থের বিষক্রিয়া ইত্যাদিকে সব দেশের সাহিত্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সাহিত্যও। সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনীতি পরিবেশচেতনার সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত। কবিতা, গান, নাটক এবং কথাসাহিত্যের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পরিবেশচেতনা এখন বিস্তৃত। এসেছে ইকোফেমিনিজম, ডিপ ইকোলজি, পোস্ট কলোনিয়াল ইকোক্রিটিসিজম, ইকোট্রান্সলেশন-এর মতো নিত্যনতুন শাখাও। বিপ্লব বা অচিন্ত্যের কবিতার মধ্যেও এসবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছায়া পড়েছে। বিশেষত বিপ্লব মাজী বিশ্বায়নের ভোগবাদী চরিত্রকে আঘাত করেছেন বারংবার। তাঁর কয়েকটি কবিতার অংশ এইরকম :

১)                                  

                     “এই দেশ কোথায় চলেছে?                                                                                                           
                          দূষিত আকাশ                                                                                                                            
                            মৃত-নদী                                                                                                                                       
                        ধসে যাওয়া পাহাড়                                                                                                                      
                   অদৃশ্য অরণ্য আর জলাধার নিয়ে                                                                                                     
                       এ-দেশ কোথায় চলেছে?”  

(‘চিপকো’)

২)                                       

                       “প্রকৃতিকে ধ্বংস করে                                                                                                                      
                       মানুষ আগুনে পুড়ছে                                                                                                                 
                     মানুষ আগুনে পুড়বে আরও                                                                                                       
                       যতক্ষণ না জ্বলে ওঠে                                                                                                               
                          মানবিক চিতা”     

(‘পরমাণু-চুল্লি হতে পৃথিবীর দেরি নেই আর’) 

৩)                                   

                      “নদী, তুমি কেন পাথর?                                                                                                                 
                             জাগো।                                                                                                                                    
                       দেখো, আমরা এসেছি।                                                                                                                  
                            বাঁধ দিয়ে                                                                                                                             
                         ব্যারেজের লকগেটে                                                                                                                  
                        তোমাকে ধরে রেখেছে                                                                                                                    
                           তোমার প্রবাহ                                                                                                                              
                         স্তব্ধ করে রেখেছে                                                                                                                 
                         যন্ত্রদানবের হাত।”  

(‘নদী, তুমি কেন পাথর?’)

৪)                                         

                        “দশবছর আগেও                                                                                                                     
                 জানাল দিয়ে দেখা যেত সবুজ পৃথিবী,                                                                                                
                        এখন আকাশরেখা                                                                                                                 
                         কংক্রিটের জঙ্গল …”                       

(‘উন্নয়ন’) 

৫)                                        

                          “গাছের রক্তপাত                                                                                                                  
                 আমরা কী ডেটলে ধুয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিই?                                                                                        
                     অরণ্য ধ্বংসে আমরা গণহত্যাকারী…”  

(‘অরণ্য ধ্বংসে আমরা গণহত্যাকারী’) 

বিপ্লব মাজীর কবিতায় একদিকে ভুবনগ্রামের নাম দিয়ে কর্পোরেট সভ্যতার আস্ফালন যেমন দেখা যায়, তেমনি শহর থেকে ফুল আর ঘাসের হারিয়ে যাওয়ার জন্য কান্নাও ঝরে পড়ে। আত্মধ্বংসী মানুষের পরিণাম কল্পনা করে তিনি শিহরিত হন। তাঁর মনে হয় মানবিক অনুভূতিগুলিও আজ কোমলতা হারিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থে পরিণত। শাইনিং ইণ্ডিয়ার আড়ালে আমরা আসলে রিক্ত, নিঃসঙ্গ। পায়রার খোপের মতো হাইরাইজে সমবায় জীবন কাটানো আজকের মানুষেরা আত্মকেন্দ্রিক ভিনগ্রহের বাসিন্দা যেন “আলোর বন্যাশহরে / শহরে পাখি নেই”। অথচ বৃক্ষের কাছে স্তব্ধ হয়ে আছে আমাদের ভালোবাসা, যদি কোনোদিন সেইখানে ফেরা যায় তবে হয়তো আমরা বেঁচে যেতে পারি এমন বিশ্বাস তাঁর। বিপ্লবের কবিতায় রাষ্ট্রযন্ত্র, ধর্মতন্ত্র আর নগরোন্নয়নের নামে বণিক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে ঘৃণা স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে, যদিও সর্বদা সেই ভাষা শিল্পিত হয়নি বলেই কিছুটা বিবৃতিধর্মী বলে মনে হয়, যেমন, ‘বারাণসী’, ‘সংবাদ.কম’, ‘ম্যাগডোনাল্ড’, ‘উন্নয়ন’ এইসব কবিতা। তবে ইকোপোয়েট্রির মৌল লক্ষণ অর্থাৎ মানুষের হাতে পৃথিবীর বিপন্নতার ছবি, তা কবিতাগুলিতে চমৎকারভাবেই রয়েছে। পাশাপাশি তাঁর রোম্যান্টিক মনেরও পরিচয় মেলে এ-কাব্যে। তাই ‘বৃষ্টির দিন’ ও ‘ঝুমঝুমি গাছ’ কবিতায় প্রেমিকার জন্য প্রতীক্ষার আবহ যেমন পাই, তেমনই গাছেরা তাঁর কাছে শৈশবে শোনা রূপকথার চরিত্র হয়ে ওঠে। 

অচিন্ত্য নন্দীর কবিতার কেন্দ্রে আছে তাঁর বৃক্ষপ্রীতি। তিনি অনুভব করতে চান গাছেদের মনের কথা, বলেন “একটু জলের প্রত্যাশায় / বিগতজন্মের তৃষ্ণার্ত গাছেরা আসবাব হয়েছে”। দুঃখী পৃথিবীমায়ের কথা তিনি ভাবেন বলেই এই বিশ্বায়নের যুগে বহুজাতিক সংস্থার ঝাঁ চকচকে পৃথিবী গড়ার প্রস্তাবকে বিদ্রুপবিদ্ধ করেন কবি :

         “হিমভোরে শৈত্যপ্রবাহেরা ফিরে আসে যে যার বাসায়। পাখিদের                                                         
           পায়ের চিহ্ন ধরে গ্রাফিক্‌স কৌশলে জেগে থাকে জনবসতি।                                                         
      তামাদি হয়ে যাওয়া পৃথিবীটা পালটে দেবার প্রস্তাব নিয়ে হাজির বহুজাতিক।                                                
      এই সুযোগে ঘর আসবাব ফ্রিজ ও বাবা মাকে পালটে নেবার কথা ভাবি।”  

(‘বোধ’)

তাঁর কবিতায় জড় ও অজড় প্রকৃতির উপমা ও চিত্রকল্প এসেছে বারংবার। নাব্যতা হারানো নদী ও বন্দিনী নারী সমার্থক তাঁর কাছে। পাতাঝরা গাছেদের কান্না তিনি শুনতে পান — “পাতাঝরা দুহাতে কান্না ঢেকে প্রকৃতিতে পাথর হয়েছে”। একটি কবিতায় বিশেষভাবে তাঁর পরিবেশ-ধ্বংসবিরোধী-চেতনা কাব্যিক মহিমায় ফুটে ওঠে :

     “আমি একটু একটু করে নিজেকে ধান গাছের সমান করে আনি। তুমি এক                                             
        ধানসেদ্ধ নারী। কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের                                                     
        মৃত্যু হলে ঝাটিঙ্গা পাখির অনুষঙ্গে এসো দু মিনিট নীরবতা আনি।                                                    
          নীরবতার মাঝখানে সত্যি কথারা কী ভীষণ ডানা মেলে ওড়ে।”  

(‘শব্দ’)

আমাদের রেচেল কার্সন-এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ (১৯৬২)-এর কথা মনে পড়ে যায়। কীটনাশক ছড়িয়ে কৃষিকাজের আপাত সুবিধে হলেও, মানুষের দেহে সেই কৃষিবিষ কীভাবে ক্ষতিকর প্রভাব আনতে পারে, পরিবেশের ভারসাম্য কেমনভাবে এই শস্যফলন বৃদ্ধির নেশা নষ্ট করে দেয় – এসব নিয়ে তাঁর সাহসী লড়াইয়ের কাহিনি আজ প্রায় সকলের জানা। ‘নীরব বসন্ত’-এর যে সতর্ক বার্তার রূপকথার মোড়কে আমাদের তিনি শুনিয়েছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। 

‘গাছেদের ভুল প্রাণে’ কাব্যে নামহীন কবিতার একটি প্রবাহ, যেখানে গাছেই কেন্দ্রীয় চরিত্র। ছাপ্পান্নটি ছোট কবিতা এখানে স্থান পেয়েছে, কিছু কবিতা আগের কাব্য থেকেও নেওয়া থিম-সাদৃশ্য মাথায় রেখেই। প্রাণময় গাছেদের সঙ্গে এখানে কবির নিভৃত কথোপকথন নানারূপে আঁকা হয়েছে। আজকের এই নগরসভ্যতার বৃক্ষনিধন যজ্ঞ মানুষের একদা বন্ধু গাছেদের বেদনায় মূক করে দিয়েছে বলেই, তারা কবির ‘কেমন আছ’ প্রশ্নের উত্তরে নির্বাক। কবির মনে হয় :

                 “গাছেরা নির্বাক। বুঝি, আমার দেরি দেখে                                                                                          
                তারা কাঠ হয়ে গেছে। আমার তাহলে কী হবে?
              যে ভাষায় কথা বলি গাছেদের, তাও কি লুপ্ত আজ!”

বৃক্ষছেদনের অপরাধ না করেও এই পাপের বিরুদ্ধে সরবতার বদলে নীরব হয়ে থাকার যন্ত্রণা তাঁকে কুরে কুরে খায় : “গাছেদের মুখ দেখাতে পারিনি আমি। ছিন্ন ডানা / পড়ে থাকে”। এই বৃক্ষপ্রজন্ম এক কয়লায় রূপান্তরিত হবে ও মানুষের তা কাজেও লাগবে কবি জানেন। তাই গাছকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরহ-মিলনের দ্বৈতালাপ চলে আজীবন। নিজেকে কখনো গাছ, কখনো বা মাটি কিংবা পাখি ভেবেছেন কবি এ-কাব্যে। গাছেদের একজন হয়ে বেঁচে থাকবার নিবিড় আকাঙ্ক্ষা তাঁর কবিসত্তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। গাছেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য মাতৃভাষাসন্ধানী কবির এসব কবিতা ডিপ ইকোলজি তথা নিসর্গ দর্শনের অন্তর্গত। গাছেরা এখন পৃথক চরিত্র পেয়েছে দেখা যায়। বাংলা কবিতায় ‘বৃক্ষবন্দনা’র আনুষ্ঠানিক যে-সূচনা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, যদিও প্রেরণা ছিল উপনিষদ, কালিদাস এবং রোম্যান্টিক ইংরেজি কবিতা, তার সার্থক উত্তরজাতক এই কাব্য। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, তাঁর সমকালীন মেদিনীপুরের আরেক মেধাবী কবি বীতশোক ভট্টাচার্যের কবিতায় আমরা বৃক্ষ আর ফুলের তাৎপর্যময় সমাবেশ লক্ষ করেছিলাম। তাঁর প্রেমের অনুষঙ্গে যেমন “আমের বউল তবে কেন এনে দেওয়া ছিল মাঘের দুপুরে?” আমাদের চমৎকৃত করে, তেমনই ‘পুষ্পটিকে ভালোবাসি’, ‘উঠেছিলে হয়তো প্রবাল’, ‘অথবা হলুদতর সেই দেশে’ ইত্যাদি কবিতায় গোলাপফুল, প্রবাল কিংবা পতঙ্গকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতাবলি ইকোলজিক্যাল উপাদানকে কাজে লাগিয়েছে। তবে অন্য দুটি কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে :  

১)            

          “গাছের পুষ্পিত জঙ্ঘা ভরে ওঠে তোমাদের নীলাভ সন্ত্রাস;                                                                
          আরো অন্ধতমে এসো, হে মৌমাছি, বৃক্ষে আজ চুম্বন শিহরে;                                                                
            একা গহ্বরের মধ্যে কেন রাখো পুঞ্জাক্ষির থাকার অভ্যাস :                                                                     
        ব্যস্ত হও, উড়ে যাও; কেবল একটি কীট, বুদ্ধিমান, ডালের উপরে”  

(‘আরো অন্ধতমে এসো’)

২)                                

                      “কথা বলা হয় না আমাদের,                                                                                                      
                      আমাদের আছে ফুলের ভাষা।                                                                                                        
                 গরম দুপুরে তুমি ঘরে নিয়ে আসো কৃষ্ণচূড়া,                                                                                           
            তেতে-ওঠা বিকেলের পথে আমি তোমায় দেখাই গুল্‌মোহর।” 

(‘ফুলের ভাষা’)   

বীতশোকের এসব কবিতায় প্রকৃতি ও পরিবেশ-অনুষঙ্গ সচেতন ইকোলজি-চেতনার অংশ হয়ে আসেনি, তবে প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে মিলিয়ে দেখার অনুভব খুঁজে পাওয়া যায়। তবে আশির নারীচেতনাবাদী কবি ঊর্মিলা চক্রবর্তীর ‘আমাজন’, ‘ঝরাপাতা’ এইসব সাম্প্রতিক কবিতায় দেখি, আগুনের তাণ্ডবনৃত্যের মাঝখানে কবি শোনেন বন্যপ্রাণের আর্তনাদ, দেখেন ‘পুড়ে যায় সবুজের বুক’। আশঙ্কার বিষবাষ্প বুকে নিয়ে বলেন : ‘লক্ষকোটি প্রাণমুখে চেয়ে পৃথিবী আকুল ভাবে, কি আছে কপালে?’ অরণ্যের মৃত্যু তাঁর কাছে তাই বেদনাবহ, যে-অরণ্য শুধু সবুজের সমারোহ নয়, সেখানে ‘লক্ষ প্রজাপতি ওড়ে জীবনরঙিন, / প্রাণগন্ধ পথ বেয়ে / কত পোকা, পিঁপড়ে।’ মাটির ধমনী বেয়ে জীবনস্রোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় তাঁর, যদিও কবে তা সম্ভব অজানাই থাকে। কার্বন শুষে অক্সিজেন ছাড়ার কারণে পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত ব্রাজিলের আমাজন অরণ্যের পুড়ে যাওয়া ছিল আমাদের বাড়ি পুড়ে যাওয়া, এমন মন্তব্য করেছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট  এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ২০১৯ সালের এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পিছনে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবেশনীতিকে দায়ী করেছিলেন অনেকেই। প্রেসিডেন্টের সমর্থনে অবৈধ খনন এই ভয়াবহ দাবানলের অন্যতম কারণ – খনিজ পদার্থ নিষ্কাশন, গাছ কাটা, খোঁড়ার ব্যবহৃত পারদের বিষক্রিয়ায় নদীর মাছেদের ক্ষতি, মানুষেরও ক্ষতির সম্ভাবনা ইত্যাদি একাধিক ঘটনা যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। ঊর্মিলার কবিতায় পরিবেশভাবুকের গভীর উদ্বেগ ধরা পড়েছে বলেই ‘আমাজন’-কে চমৎকার ইকোপোয়েট্রি বলা চলে।      

পাঁচ

সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদী কিংবা নারীবাদী কবিতায় উদ্দেশ্যমূলকতা মুখ্য হয়ে গেলে কবিত্বগুণ নষ্ট হতে থাকে, আমরা তা জানি। আসলে তত্ত্বকে কাব্যরূপ দিতে গেলে এই সমস্যা অবধারিত। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে বিষয় মোটামুটি একই থাকে শোষিত মানুষ কিংবা নির্যাতিতা নারীর অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে ভাষারূপ দেওয়া, সংকট-প্রতিরোধ-প্রতিবাদ এই তিন বিন্দুতে শিল্প-সাহিত্যের মূল সুর বাঁধা থাকে। ইকোপোয়েট্রির ক্ষেত্রেও যে এর ব্যতিক্রম ঘটছে, তা বলা যায় না। বিপন্ন পরিবেশ ও মানুষের দায়বদ্ধতা এখানে বারংবার নানা রঙে আঁকা হয়েছে। নিছক নিসর্গ কবিতা বা নেচার পোয়েট্রির থেকে এখানেই তা আলাদা। তবু ওরই মাঝে কবিতার মধ্যে যে সমাজ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে ইকোপোয়েট্রিও তা প্রমাণ করতে পারে। অতএব ‘ক্ষমতালুব্ধ এলিটের পরাক্রম থেকে নিসর্গকে অনাহত রাখবার অভিপ্রায়’ পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে ইকোপোয়েট্রি ও ইকোলজি-সচেতন সাহিত্যের মাধ্যমেই সিদ্ধ হতে পারে, হয়েছেও – ‘সবুজ দুর্ভাবনা’ গদ্যে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের এই বীক্ষণ আজ উপেক্ষা করবার হেতু নেই কোনো।।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান