ফিরে দেখা : রেচেল কার্সন (২৭ মে, ১৯০৭ – ১৪ এপ্রিল, ১৯৬৪)

যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি

রাহুল রায়

মুখপাত

“পৃথিবীর উপচে পড়া সৌন্দর্য রয়েছে তার প্রাণের সমারোহে। তার ফুলের প্রতিটি পাপড়ি নতুন চেতনার জন্ম দেয়। যে সময়টুকুতে মন এই শোভায় বুঁদ হয়ে থাকে, সেই সময়টাতেই আমরা সত্যিকারের বাঁচার মতো বাঁচি।” প্রকৃতি নিয়ে এমনই গভীর এক বোধ ছিল উনিশ শতকের ইংরাজ প্রকৃতিপ্রেমী রিচার্ড জেফারিজ এর।[১] বহু বছর আগে, বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ভ্লাদিমির নবোকভ সোচ্চারে জানিয়েছিলেন, “কল্পনা ছাড়া কোন বিজ্ঞান হয় না এবং প্রকৃত ঘটনা ছাড়া কোন শিল্প হয় না।”[২]  শিল্প ও সংস্কৃতির উর্বরতম বীজটি অংকুরিত হতে কয়েক প্রজন্ম সময় লাগে। এক শতক পরে, জেফারিজ-এর জীবনবোধ গভীরভাবে প্রাণিত করেছিল আমেরিকান সমুদ্র-জীববিজ্ঞানী রেচেল কার্সন-কে। কার্সন ১৯৬২ সালে ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ নামে যে বইটি লিখেছিলেন, সেটিই বিশ শতকে আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের অনুঘটকের কাজ করেছিল।[৩] পৃথিবীর পরিবেশপ্রেমী সকল মানুষ ও গোষ্ঠী সেপ্টেম্বর, ২০২২-কে পরিবেশ আন্দোলন নির্মাণের একটি বিশেষ কালচিহ্ন রূপে আবার স্মরণ করবে। সমুদ্রবিজ্ঞানী রেচেল কার্সন-এর বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ প্রকাশের ষাট বছর পূর্ণ হবে সেপ্টেম্বর ২০২২-এ। বেলাগাম অর্থনৈতিক বিকাশ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের স্বাস্থ্য এবং প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ওপর যে কী বিপদ ডেকে আনছে, বিশেষ করে ডিডিটি ব্যবহারের যে অসীম কুফল, কার্সন তাঁর বই সাইলেন্ট স্প্রিং-এ তা দেখিয়েছিলেন। আধুনিক পরিবেশবাদ এর বাইবেল এবং নান্দীকার হিসেবে সাইলেন্ট স্প্রিং বিশ্বনন্দিত। উত্তর আমেরিকা ও ইওরোপে দূষণমুক্ত পরিবেশের দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান রূপকার ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। বিজ্ঞান যে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়, এরও যে এক সহজাত কাব্যময়তা রয়েছে, কার্সন তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এ এক নতুন সাহিত্যসম নান্দনিকতায় তা প্রথম দেখালেন।

‘সায়েন্স অ্যান্ড আওয়ার স্পিরিচুয়াল বন্ড উইথ নেচার’ রচনায় কার্সন বললেন, “আমাদের সৃষ্টি পৃথিবী থেকে। এই কারণেই বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি আমাদের সকলের এক গভীর দায়িত্ববোধ রয়েছে। এটি আমাদের মানবতারই এক দিক।” আমেরিকান প্রাবন্ধিক সুজান সনট্যাগ একবার বলেছিলেন যে “তথ্য কখনোই প্রতিভাসের জায়গা নিতে পারে না।”[৪] কার্সন এই পথরেখা ধরে, কাব্যময় প্রকৃতির ছন্দে, মানুষের প্রাথমিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে, আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের চেতনা গড়ে দিলেন। প্রাকৃতিক নানান ঘটনা থেকেই যে সত্য ছড়িয়ে পড়ে, এমনই এক কাব্যময় নান্দনিক মনন ও লিখন, তিনিই প্রথম মানুষের সামনে মেলে ধরলেন।

শব্দের ভিতর এত দীপন

পৃথিবীতে খুব অল্প সংখ্যক বিজ্ঞান-লেখক বিষয়ের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং লেখনীর জাদুতে মানুষকে কার্সন-এর মতো মুগ্ধ করতে পেরেছেন। বিশ্বপ্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে কার্সন আজীবন হৃদ্‌মাঝারে ধরে রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে মহিলা সাংবাদিকদের এক আলোচনাসভায় তিনি এ নিয়ে এক চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরে “লস্ট উডস্‌ — দ্য ডিসকভারড্‌ রাইটিং অফ্‌ রেচেল কার্সন” নামে বইতে ‘দ্য রিয়্যাল ওয়ার্ল্ড অ্যারাউন্ড আস’ শিরোনামে বক্তৃতাটি ছাপা হয়।[৫] উল্লিখিত বইটি নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্সন তাঁর ত্রিকালজয়ী বৌদ্ধিক দৃষ্টিতে অনুভব করেছিলেন যে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের ওপর মার্কিন সরকারের আঘাত নেমে আসছে। ১৯৫৩ সালে কার্সন সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ পত্র লেখেন। তাঁর ‘লস্ট উড্‌স’ বইতে এই প্রতিবাদ পত্রটি রয়েছে। প্রকৃতিকে বিনি পয়সার জিনিস ভেবে, কেবল বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক লাভের জন্য নির্মম ভাবে তার সম্পদ ব্যবহারে, প্রকৃতি ক্রমশ বিপন্ন ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে যে অভূতপূর্ব নানান সংকট সৃষ্টি হতে চলেছে, প্রতিবাদ পত্রটির পরতে পরতে কার্সন আশ্চর্য মুন্সিয়ানায় তা দেখিয়েছেন। কবি এলা হুইলার উইলকক্স এর ১৯১৪ সালে লেখা কবিতার একটি লাইন তাঁকে এ কাজে কেবল সঞ্জীবিতই করেনি, লাইনটির মর্মার্থ কার্সন নিজের আত্মীভূত করে নিয়েছিলেন। উইলকক্স এর লেখা লাইনটি হল – “To sin by silence, when we should protest makes cowards out of men.’’[৬] 

১৯৫৩-৬১ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান সদস্য আইজেনহাওয়ার আমেরিকার ৩৪তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মসনদে বসেই তিনি ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থে দ্রুত বেশ কিছু নীতি চালু করেন, যা প্রকৃতিকে ক্রমশ ধ্বংস করতে থাকে। এই সময় ‘দ্য ফিশ্‌ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস’-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন কার্সন। এই সরকারি সংস্থাটির দায়িত্ব ছিল প্রকৃতিকে রক্ষা করা। মনে রাখতে হবে, সেই সময় এটি ছাড়া আর কোনও পরিবেশ সুরক্ষাকারী সরকারি সংস্থা এদেশে ছিল না। পরে ১৯৭০ সালে চালু হয় ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন অ্যাক্ট’। ‘দ্য ফিশ্‌ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস’-এর শুরু থেকেই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং সংরক্ষণবাদী অ্যালবার্ট এম ডে এই সংস্থার সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে এর অধিকর্তা হন। আইজেনহাওয়ার ক্ষমতায় এসে ডে-কে সরিয়ে দেন। এই জায়গায় বসান তাঁর পেটোয়া এক রাজনীতিককে। ইনি প্রথমেই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষাকারী সমস্ত রকম নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবসায়ীদের বাজারি পণ্যে পরিণত হয়। কার্সন কোনও মতেই এটি মেনে নিলেন না। তিনি খোলাখুলি জানালেন যে সিদ্ধান্তটি যে কোনও বিবেচক নাগরিকের কাছেই যথেষ্ট বিরক্তিকর। এর প্রতিবাদ করে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর সম্পাদক-কে তিনি এক চিঠি লেখেন। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা খুব অল্প সময়ে চারিদিকে ধ্বনিত হতে থাকল। স্বভাবতই কার্সন হলেন আইজেনহাওয়ার এর চোখের বালি। 

তো কী ছিল সেই চিঠিতে যা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে গেল! আমেরিকাকে জগৎসভায় আবার শ্রেষ্ঠ দেখার আশায় কার্সন লেখেন –

“কোন রাষ্টের প্রকৃত সম্পদ থাকে তার প্রকৃতিতে – মাটিতে, জলে, খনিজে, বনভূমি ও বন্যপ্রাণে। বর্তমানের চাহিদা বুঝে, পরবর্তী প্রজন্মের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে, এদের ব্যবহার করতে হয়। এর জন্য দরকার নিরন্তর গবেষণামূলক নানান বিবেচনাপ্রসূত কর্মসূচি। আর এসব কর্মসূচির পরিচালনা কখনোই রাজনীতির বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক সম্পদ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন বেশ কিছু অভিজ্ঞ ও পেশাদার মানুষ। বিজ্ঞানীদের নানা পর্যবেক্ষণকে এঁরা গভীর মূল্য দেন এবং তাঁদের দেখানো পথেই চলেন।” 

কার্সন-এর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, ইচ্ছেমতো অবিবেচক উন্নয়নের বিরুদ্ধে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জোরালো দাবি উঠল আমেরিকার সর্বত্র। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল আমেরিকায় লক্ষ মানুষ এক হয়ে ঘোষণা করল এক নতুন পরিবেশ যুগের। সেদিন থেকে দিনটি পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় ‘বসুন্ধরা দিবস’ হিসেবে। বর্জ্য পদার্থহীন, দূষণমুক্ত, প্রতিবন্ধীহীন এক নতুন পৃথিবী গড়ার ডাক ধ্বনিত হয়েছিল সেদিনের সমাবেশে উপস্থিত লক্ষ মানুষের গলায়। ওই বছরেই আমেরিকার সরকার গড়ে তোলে ‘এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সি’। চালু হয় ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন অ্যাক্ট’। এই আইনের ফলে নতুন কোনও প্রকল্প গড়ে তোলার আগে তাতে পরিবেশের কী পরিণতি হবে বা হতে পারে, তা আগাম খতিয়ে দেখা বাধ্যতামূলক হল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কার্সন এই এজেন্সি বা আইনটি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৬৪ সালে কর্কটরোগ এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর জীবন কেড়ে নেয়। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে বিগত ট্রাম্প প্রশাসনের কাছেও বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব ছিল না।

প্রকৃতির প্রতি অপার বিস্ময় কার্সন-এর বই লেখার শুধু উপাদানই ছিল না। এটি তাঁর মনের সহজাত গড়ন ছিল। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ পাঠানো প্রতিবাদ পত্রে তিনি লিখছেন –

“আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে এই পৃথিবীর অপার শোভা ও নানান রহস্য নিয়ে। আমার কাছে সবচেয়ে বড় রহস্য পৃথিবীতে বাস করা প্রাণের সম্ভার। এমন কেউই এখানে দীর্ঘকাল কাটাতে পারেনি যার মধ্যে গভীর কোন চেতনা ছিল না; অনেক কিছুরই উত্তর সহজে হয় না জেনেও তেমন প্রশ্নের পিছনে ছোটা ছিল না এবং সর্বোপরি কোন একটা জীবনদর্শন ছিল না। প্রতিটি রহস্যের জট যখনই খুলে গেছে, পৃথিবী আমাদের আরও বড় একটি রহস্যের চৌকাঠে এনে দাঁড় করিয়েছে।

বেশ কয়েকশো বছর ধরে আমেরিকার সুশীল নাগরিক সমাজ, প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য কী অপরিসীম, তা বুঝে একে সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এঁদের একনিষ্ঠ পরিশ্রমের সুফল এখন মুছে যেতে বসেছে, কারণ রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী প্রশাসন প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ আহরণ ও ধ্বংসসাধন করে আমাদের অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”[৭]

এই একই রকম ভাষা ধ্বনিত হতে দেখা যায় ওয়াল্ট হুইটম্যান এর ‘অ্যাবাইডিং ট্রিটিজ অন্‌ ডেমোক্র্যাসি’-তে।[৮] হুইটম্যান বলছেন – “আমেরিকা যদি তার পতন ও ধ্বংসের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে, তবে এই যোগ্যতা সে দেশের ভিতর থেকেই অর্জন করছে।” আমাদের হতবাক করে দেওয়া দূরদর্শিতায় কার্সন আগেই মন্তব্য করেছিলেন – 

“আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় তামাশা হল যে, বাইরের শত্রুর সাথে মোকাবিলা করার জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তর অতি মনযোগী। কিন্তু যারা দেশের ভিতর থেকে একে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাদের প্রতি কী চরম উদাসীন।”

১৯৫৩ সালে কার্সন-এর সাহসী কন্ঠ তখনই কোনো রাজনৈতিক আমূল পরিবর্তন আনতে পারেনি। তবে, ফল্গুধারার মতো মানুষের মনে এটি পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তুলছিল। এর এক দশক পরে ১৯৬২ সালে বেরোল তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। বইটি বেরোনো মাত্রই জনমানসে পরিবেশ রক্ষার উদ্দীপনার তুমুল জোয়ার। আমেরিকার সরকার বাধ্য হল ‘এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সি’ গড়তে। সুদূর ভবিষ্যতেও এই নীল গ্রহটিকে বাঁচাতে, আধুনিক পরিবেশ চেতনা মানুষের মনে ছড়াতে, ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ এখনও আমাদের সেরা ভরসা।

বিজ্ঞান ও সাহিত্য — মেলাবেন তিনি মেলাবেন

কার্সন-এর কালোত্তীর্ণ এবং সময়োপযোগী অপরিহার্য প্রজ্ঞার আকরগুলি একত্রিত হয়ে আছে হিরণ্ময় সংকলন ‘লস্ট উডস্‌’-এ। কেন এবং কীভাবে তিনি ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ লিখেছিলেন, এলা হুইলার উইলকক্স এর ১৯১৪ সালের লেখা কবিতাটি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নানান অস্বস্তিকর সত্য তুলে ধরতে তাঁকে কী প্রেরণা জুগিয়েছিল, প্রিয়তম বন্ধু ডরোথি ফ্রিম্যান এর উদ্দেশে লেখা তাঁর গভীর মানবিক বিদায়লিপি, ‘সায়েন্স অ্যাজ অ্যান ইনভ্যালুয়েবল টুল অফ্‌ ডেমোক্র্যাসি’[৯] রচনায় কার্ল সাগান-কে ফিরে দেখা — এমন অনেক দীপিত রচনা ‘লস্ট উডস্‌’-এ আমাদের পরম পাওনা।   

মহাকাশচারী মারিয়া মিশেল তাঁর বইতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “যে কোন প্রাকৃতিক ঘটনা সাধারণ মানুষের কাছে যতখানি, ঠিক ততখানিই একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছে। অবশ্য মানুষকে এটি বোঝানো বেশ কঠিন।…..প্রকৃতির প্রতিটি নিয়মই ঈশ্বরের বন্দনা-গান।”[১০]  কার্সন-এর কাছেও এই পবিত্র প্রকৃতি ছিল অনির্বচনীয় এক অতীন্দ্রীয় অনুভব। এই অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে আছে ১৯৩৭ সালে রচিত তাঁর প্রবন্ধে এক কাব্যিক দ্যোতনায়। 

“প্রকৃতির সাথে নিত্য যোগাযোগের যে আনন্দ, যে অপরিসীম মূল্য, তা কেবল বিজ্ঞানীদের জন্য না। যে কেউই তা পেতে পারে, যখন সে নিজেকে পর্বত চূড়ার বিশাল শূন্যতার কাছে ধরা দেয়, বা কোন সমুদ্রের ব্যাপ্তির কাছে, বা কোন অরণ্যের নীরবতায় কান পাতে, অথবা ছোট্ট বীজ থেকে অংকুরিত হবার রহস্যকে হেলাফেলা না করে।”

এই প্রবন্ধটি ১৯৩৭ সালে ‘দ্য আটলান্টিক মান্থলি’ পত্রিকায় ‘আন্ডারসী’ (Undersea) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে লেখা কার্সন-এর প্রথম বই ‘আন্ডার দ্য সী-উইন্ড’[১১] বইটি দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রধানত এই রচনাটিকে ভিত্তি করে। পরে ‘আন্ডারসী’ প্রবন্ধটি “লস্ট উডস্‌ — দ্য ডিসকভারড্‌ রাইটিং অফ্‌ রেচেল কার্সন”-এ স্থান পায়।       

অতলান্তিক মহাসাগরের কোলে অবস্থিত মেইন এর সাউথপোর্ট দ্বীপের গৃহব্ধূ ডরোথি ফ্রিম্যান কার্সন-এর প্রিয়তম বান্ধবী ছিলেন। ১৯৫২ সালের শেষদিকে, কার্সন তাঁর মা-কে নিয়ে যখন এই দ্বীপে চলে যান, তার ঠিক আগে ডরোথি তাঁকে সাউথপোর্টের স্থানীয় অধিবাসীদের তরফ থেকে স্বাগত জানিয়ে এক মরমি চিঠি দিয়েছিলেন। ততদিনে কার্সন লেখিকা হিসেবে এক অতি পরিচিত নাম। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য সী অ্যারাউন্ড আস’[১২] বইটি তখন ৩৯ মাস ধরে একনাগাড়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌ বেস্টসেলার। এরপর কার্সন ১৯৫৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর ডরোথির বাড়িতে থাকেন। ডরোথিকে কার্সন অনেক চিঠি লেখেন। এই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সংযোগ যে কী আত্মিক, চিঠিগুলির প্রতিটি বাক্য যেন সেই উপলব্ধির এক মুক্তোমালা। এই সমস্ত চিঠি পরে একত্রে সংকলিত হয়েছে ‘অলওয়েজ, রেচেল : দ্য লেটার্স অফ রেচেল কার্সন অ্যান্ড ডরোথি ফ্রিম্যান, ১৯৫২-৬৪’ বই-তে। ১৯৫৬ সালের অগাস্ট মাসে ডরোথিকে লেখা এমনই একটি চিঠি পড়া যাক।  

“আমাদের এখানে এখন পূর্ণিমার ভরা জোয়ার। গত কয়েক রাত হল আমাদের বাড়ির সামনের বেলাভূমিতে জোয়ারের জল বাড়ছে। সারাদিন ধরেই ফেনিল ঢেউ আর তার শব্দ। মাঝরাতে এটি সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। সমস্ত পাথর ফেনার মুকুট পরে থাকে। তাদের সাদা চূড়াগুলি আমাদের বেলাভূমি থেকে অন্য বেলাভূমিতে ছুটে যায়। এই বন্যতাকে পুরোপুরি অনুভব করতে আমরা সমস্ত বিজলি বাতি নিভিয়ে দিই। তখনই শুরু হয় আসল মজা। ঢেউ এর ফেনাগুলি হিরে-পান্নায় খচিত। ভিজে বেলাভূমিতে এরা ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে। প্রিয় ডরোথি, আমরা গোটা রাত এখানে কাটিয়েছি। ফেনিল জলরাশির অনুপ্রভা আর তার শব্দের আদিম সঙ্গ, সবকিছুই এক নিবিড় তীব্রতায় ধরা দিয়েছে। আছড়ে পড়া জলরাশির প্রতিটি আলোককণিকা বেলাভূমিতে কী বড়ো হয়ে ঝিলমিল করছে! একের পর এক ঢেউ আসছে, যাচ্ছে। আমি অনেক বার চেষ্টা করেছি নুড়ি-পাথর আর ঝিনুকের খোলায় এই আলোককণিকা ধরতে। কিন্তু পারিনি।

এখান থেকেই আমার এই গল্পটা একটু অন্যরকম। একবার ওপর দিকে চেয়ে আমি বোনঝি মার্জি-কে মজা করে বললাম, দ্যাখ, একটা আলো বাতাসে মিলিয়ে গেল। যেন একটা জোনাকির আলো জ্বলছে, নিবছে। এ নিয়ে আমরা বিশেষ কিছু ভাবিনি তখন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের একজন বলে উঠল, ওই দ্যাখো, আবার জোনাকি। ভালো করে নজর দিয়ে সত্যিই আমরা দেখলাম জলের ঠিক ওপর দিয়ে এক জোনাকি উড়ছে। তার ঝিকমিক আলো ছোট্ট হেডলাইটের মতো জলের ওপর পড়ছে। তখন পুরো ঘটনাটি আমি বুঝলাম। জোনাকিটা সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত এই আলোকে অন্য জোনাকির আহ্বান ভেবেছে। তাই সে সাড়া দিয়ে কাছে এগিয়ে বিপদে পড়েছে। সমুদ্রের ভিজে বেলাভূমিতে আটকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার আলো খুব তাড়াতাড়ি দপ্‌দপ্‌ করছে। এরকম অসংখ্য জোনাকির আলোয় বেলাভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে ছোট আলেয়া।

এরপর কী হল তুমি বোধহয় আন্দাজ করতে পারছ। আমি জল ভেঙে জোনাকিটার কাছে গেলাম। সেটকে তুলে রজার (কার্সন-এর ছেলে) এর বালতিতে রাখলাম, তার ডানা শুকোবার জন্য। বেলাভূমি ছেড়ে ঘরের বারান্দা পর্যন্ত জোনাকিটাকে সঙ্গে এনেছিলাম, যাতে সে আবার একই ভুল না করে।”

১৯৫৭ সালে আর একটি চিঠিতে কার্সন ডরোথিকে লিখছেন —

“বিজ্ঞানে আমার যেটুকু অবদান আছে, সেগুলিকে আমি ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। বরং প্রকৃতির প্রতি আমাদের যে আবেগময় দায়িত্ব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটা অনেক জরুরি। তাই প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা বিজ্ঞানের যে কোন বিষয়বস্তুর প্রতিবেদনের চেয়ে অনেক বড়।”

বিজ্ঞান ও বিস্ময়ের মেলবন্ধনের চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল এর কয়েক বছর পর তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইয়ে। বিজ্ঞান ও বিস্ময় – এ দুটি প্রেক্ষিতের প্রভাবে সৃষ্ট চেতনায় রচিত হল আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের পটভূমি। কার্সন সবসময় স্বীকার করেছেন যে প্রকৃতির অপার বিস্ময় ও শোভার প্রতি তন্ময়তা তাঁর নিজের জীবনকে প্রাণিত করেছে। তিনি বলছেন —

“আমি বিশ্বাস করে কোন ব্যক্তি বা মানব সমাজের আত্মিক বিকাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমি এটাও মানি যে, যখনই আমরা এই সৌন্দর্যকে ধ্বংস করি, বা যখন আমরা মানুষের তৈরি কৃত্রিম কোন কিছুকে প্রাকৃতিক উপাদানের পরিবর্ত হিসেবে ভাবি, আদতে আমরা তখন মানুষের আত্মিক বিকাশকেই বাধা দিই।

এই পৃথিবী ও তার সৌন্দর্যের সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্পর্ক সঙ্গত কারণেই যে অতি গভীর, তা আমি মানি। মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণপ্রবাহের আমরা এক অংশবিশেষ। গত প্রায় ১০ লক্ষ বছর ধরে আমরা মানুষ রূপে প্রকৃতিতে বাস করছি। কিন্তু প্রাণ– আমাদেরই চারিপাশে থাকা নানান বস্তুর মধ্য দিয়ে তার রহস্যময় স্বাতন্ত্র্য ও প্রবাহে, কোন জড় শিলা বা কাদামাটি থেকে শত লক্ষ বছর আগে, আগমন সূচিত করেছে। তারপর থেকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সে অহরহ লড়াই করেছে, বিকশিত হয়েছে, তার চারপাশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, শেষে অসংখ্য রূপে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত রূপের সজীব প্রোটোপ্লাজম তৈরির উপাদান এক– বাতাস, জল এবং শিলা। এই উপাদানের সাথেই প্রাণের রহস্যময় ফুলকি যুক্ত হয়েছিল। এই পৃথিবীই আমাদের উৎস। আর সে জন্যই এই পৃথিবীর প্রতি আমাদের সকলের এক গভীর দায়িত্ববোধ রয়েছে। এটি আমাদের মানবতারই অঙ্গ।” 

নির্দয় ধনতন্ত্রের হাতে প্রকৃতিকে বাজারি সম্পদ রূপে পণ্যায়িত করার যে কী সংকট হতে পারে, তা নিয়ে বহু আগেই কার্সন আমাদের চেতাবনি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

“মানুষের তৈরি কদর্য বিকল্প দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ধ্বংস করার এই প্রবণতা আমাদের এক বিপজ্জনক কৃত্রিম পৃথিবীর দিকে নিয়ে চলেছে। সৌন্দর্য, এবং এই সৌন্দর্য থেকে যা কিছু নান্দনিক মূল্যবোধ জন্মে, তা কখনোই ডলার দিয়ে মাপা যায় না।”

সুরের গুরু দাও গো দীক্ষা

বিজ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতা ও অর্থের প্রতি মানুষের মোহের অশুভ বন্ধনটি সময় বিশেষে যে কী ভয়ানক সংকট ডেকে আনে, ১৯৬০ এর দশকে সেই ভয়াল ছবিটি কার্সন সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এ। তৎকালীন পরিবেশ চেতনায় এবং পাশ্চাত্যের পেশাদার, বুদ্ধিজীবীদের মননেও এটি জোর নাড়া দেয়। নানান বাস্তুতান্ত্রিক চক্রের ওপর রাসায়নিক কীটনাশকের অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এ তাঁর চেতাবনি মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় নতুন করে ভাবতে শেখায়। কার্সন বলছেন —  

“প্রাকৃতিক জীবন-কাঠামোর বিরুদ্ধে রাসায়নিক এই বেড়াজাল আমাদের গভীর সংকটের মুখে ছুঁড়ে দেবে। প্রকৃতির এই কাঠামোটি একদিকে যেমন কোমল ও ভঙ্গুর, অন্যদিকে আশ্চর্যজনক ভাবে তেমনই শক্তপোক্ত, স্থিতিস্থাপক ও প্রাণোচ্ছল। অভাবনীয় ভাবে এটি পাল্টা আঘাত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার শক্তি ধরে। জীবনের এই অসাধারণ শক্তিটিকে রাসায়নিক ব্যবহারকারীরা আমল দিলেন না। প্রকৃতির ওপর অন্যায় খবরদারি করার আগে কোনও নম্রতা দেখালেন না।”

পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে কার্সন সমাজের বহু ধরনের মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত চিঠি পেতেন বলে তাঁর ‘দ্য সী অ্যারাউন্ড আস’ বইটিতে জানিয়েছেন। এঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন কেশবিন্যাসকারী, কেউ জেলে, কেউ বা সুরকার। পেশায় বৈচিত্র্য থাকলেও সকলের চিঠির মনোভাব কিন্তু একই। 

“এই পৃথিবী নিয়ে আমরা খুবই বিব্রত। মানুষের ওপর আস্থা আমাদের প্রায় হারিয়েই গেছে। এটিই আমাদের পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে ভাবায় যে কীভাবে প্রাণের আগমন সূচিত হয়েছিল। আর যখনই লক্ষ লক্ষ বছরের নিরিখে এ কথা ভাবি, মনে হয়, আমরা এমন অধীর নই যে আগামী দিনে আমাদের সমস্যার কোন সমাধান হবে না।”

কার্সন পরিবেশ সংরক্ষণকামী সমস্ত মানুষের হৃদয়ে সবুজ কাঙ্ক্ষার এই অনির্বাণ আলোকশিখাটি সযত্নে জ্বেলে দিয়েছিলেন। 

তথ্যসূত্র :

১। Richard Jefferies: ‘The Life of the Fields’, Pinnacle Press, May 25, 2017.

২। Vladimir Nabokov: ‘The Paradox of Intellectual Promiscuity’ in “I Have Landed: The End of a Beginning in Natural History” by Stephen Jay Gould; Belknap Press: An Imprint of Harvard University Press; Reprint Edition (October 1, 2011). 

৩। Rachel Carson: ‘Silent Spring’, Houghton Mifflin, September 27, 1962.

৪। Susan Sontag: ‘At the Same Time – Essays & Speeches’,  Picador, December 26, 2007.

৫। Beacon Press, 1999.

৬। Ella Wheeler Wilcox: ‘Poems Of Problems’, Leopold Classic Library, 2015.

৭। Martha Freeman (Edited): ‘Always, Rachel – The Letters of Rachel Carson and Dorothy Freeman, 1952-1964, An Intimate Portrait of a Remarkable Friendship’, Beacon Press, 1995.

৮। Walt Whitman: ‘Poetry and Prose’, Library of America, 1982.

৯। Carl Sagan: ‘The Demon-Haunted World – Science as a Candle in the Dark’, Ballantine Books, 1997.

১০। Maria Mitchell: ‘Life, Letters, And Journals, 1986’, Compiled by Phebe Mitchell Kendall, Boston Lee And Shepard Publishers, 1896; Classic Reprint Series, Forgotten Books, 2012.

১১। Penguin Classics, 2007.

১২। Special Edition, Oxford University Press, 1997.  

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান