চিত্রিতা বসু
এক
“গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর ছল ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার
তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে”
(‘অন্ধকার’, “বনলতা সেন”)
মানব-শরীর, মানব-চেতনা সহজাত প্রাকৃতিক অভ্যাসকে ধারণ করে। যেহেতু মানুষও এক প্রাকৃতিক নির্মাণ, তাই তার বায়োফিলিক প্রবণতায় বাহ্যিক প্রণোদনা ছাড়াই মানুষ বুঝে নিতে পারে আসন্ন বৃষ্টির আভাস, শীত থেকে বসন্তের রঙবদল। যারা আ-যৌবন মাটি কর্ষণ করেন বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় মাঠ-পুকুর-শস্যের সঙ্গে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হন, তারা প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই বলে দিতে পারেন গাছগাছালির শিরা উপশিরার খবর, মাছেদের গতিবিধি কিংবা হাওয়ার আগাম বার্তা। তাছাড়া, মানুষ তার সহজাত ক্ষমতায় যেমন ভাষা শেখে, তেমনই বাস্তব জীবনের তৎকালীনতার সঙ্গে, যাপিত অতীত ও অনাগত ভবিষ্যতকে অবিচ্ছিন্ন চলমানতায় গ্রহণ করতেও শেখে। নির্মাণ করে নিজস্ব কালচেতনা। মানুষিক অস্তিত্বের বোধ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ‘জেগে ওঠা’র প্রাথমিক ধাপ — উল্লিখিত সময়প্রবাহে নিজের আকস্মিক অথচ অপরিবর্তনীয় অবস্থান সম্পর্কে বিদিত হওয়া, একইসঙ্গে মানুষের পার্থিব অবস্থানের ব্যাপ্তিকাল যে সীমিত — এই সারসত্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া। তাই, জীবনানন্দের স্পর্শকাতর মনন, কবিতাজীবনের শুরু থেকে প্রকৃতি, মানুষের অস্তিত্ব ও মৃত্যুকে একসূত্রে গেঁথে নিয়েছিল।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থের ‘জীবনানন্দ দাশ: ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রবন্ধে বলেছেন “প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন এমন কোনো কবি নেই, কিন্ত সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়েই গ্রহণ ও প্রকাশ করেন এমন কবির সংখ্যা অল্প”।[১] জীবনানন্দ যে সেই অল্পসংখ্যক কবিদের একজন তা বলাবাহুল্য। তিনি যেভাবে বাংলাদেশ তথা সামগ্রিকভাবে প্রকৃতিকে শ্রবণ করেছিলেন, তা নিছক নিসর্গপ্রেম বা পরিবেশ রক্ষণের তাগিদে নয়। বস্তুত, তাঁর কবিতায় প্রকৃতি-বিলাসিতার কোনও স্থান নেই, কারণ তাঁর চেতন-অবচেতন চিন্তাস্রোতের ঘোলাটে ঘূর্ণনকে বুঝতে হলে, কবিতার মধ্যে দিয়ে চেনানো পৃথিবী ও প্রকৃতিকে, নিজ অস্তিত্বের প্রতিফলক হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
সভ্য মানুষের কর্ষিত ক্ষেত থেকে যাত্রা শুরু করে জীবনানন্দ মেধাবী কল্পনায় হেঁটে এসেছেন অতীতের বুনো পৃথিবীর হরিণের কাছে। বৃদ্ধ হলুদ ঘাসে মৃত প্রজাপতিদের শীতল নিশ্চল ডানায় অস্তিত্বের শেষতম রেশটুকু তিনি মানুষিক চেতনায় ধারণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু কেন এই কাল্পনিক অতীতচারণা? মাটির উর্বর জঠরে আলু-পটলের মতোই ফলে ওঠা মানুষ, নিজের ভেতরে কিয়ের্কেগার্দ কথিত ভোগীয় সত্তার অতিরিক্ত কোনও অস্তিত্বের খবর পায়, যা তাকে বর্তমানকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতদ্রষ্টা করে তোলে। যে মুহূর্তে মানুষ উপলব্ধি করে সে জন্ম-জনন-মৃত্যুর আবহমান জৈবিক আবর্তনের অংশ এবং অস্তিত্বের কোনও অবিনাশী রূপ নেই এবং সমস্ত চেতন-অচেতন সত্তার জীবৎকাল নির্দিষ্ট, সেই সময় থেকেই সম্ভাব্য মৃত্যুর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সম্ভবত, অজ্ঞাত মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হতেই প্রকৃতি ও সময়ের ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের যুক্ত হওয়া। মৃত্যুবিলাসী রোমান্টিকতায় লুপ্ত-মৃত শরীর ও বিগত চেতনাকে ছুঁয়ে দেখতে সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে সচেতন মানস।
দুই
জীবনানন্দ, তাঁর কবিতায় স্বয়ং প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন। প্রকৃতি তাঁর চেতনা-ঊর্ধ্ব সংস্কারের মতো, যার শিকড় চারিয়ে আছে প্রাক্-উপলব্ধির সময় থেকে। আত্মসচেতন হওয়ার আগেই যেন প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর জানা-বোঝা হয়ে গিয়েছে। জন্মের কয়েকমাস পর শিশুর কৌতূহলবিদ্ধ সংবিদ নিজের হাত-পা-শরীর ছুঁয়ে আত্ম-সচেতনতা লাভ করে একইসঙ্গে বিস্মিত হয় ও বিস্ময়-নিবারণ করে। জীবনানন্দ প্রকৃতির দিকে তাকিয়েছেন শৈশবের এইরূপ বিস্ময়বোধ নিয়ে। পঞ্চভূতের প্রতিটি বৈচিত্রকে তিনি আত্ম-আবিষ্কারের সুড়ঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যে জৈব-শরীর জল মাটি হাওয়ায় গড়া, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সে শরীর নিজের থেকেই শিখে নেয় প্রশ্বাসের সঙ্গে বাতাস টেনে নেওয়া, কিংবা স্তন থেকে মাতৃদুগ্ধ শোষণ। বেঁচে থাকা বা সার্ভাইভ করার এই প্রাথমিক পাঠ প্রতিটি জীব তার সহজাত প্রাকৃতিক অধিকারসূত্রেই পেয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রথম মানুষের ইন্দ্রিয়জাগৃতির স্মৃতি নিহিত থাকে জৈবিক নিয়মেই। তাই, সমুদ্রের নোনাজলের সঙ্গে, আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়ানো ফসলের সঙ্গে কিংবা পশ্চিম আকাশে দিনের আলোর শেষ কণার সঙ্গে যখন সদ্যজাগ্রত ইন্দ্রিয়ের দেখা হয়ে যায়, তখন অবচেতনে ঘুমন্ত প্রাকৃতিক অভ্যাসের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটে। আদিম অতীতের জৈবিক অভ্যাসের অস্পষ্ট স্মৃতি ও ব্যক্তিমানসের অবচেতনের অন্ধকার তখন একাকার হয়ে যায়, দুই মিলিয়ে বর্তমান মানুষের সচেতন-অর্ধচেতন-অবচেতন সত্তা গড়ে ওঠে। জীবনানন্দের কবিতায় সহজ, অতি পরিচিত অথচ অন্ধকার, রহস্যাবৃত প্রকৃতিকে পাঠ করি, তা বর্তমানকালে আবদ্ধ একক মানুষের স্মৃতি, অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে যূথবদ্ধ মানবের সর্বজনীন চৈতন্যের গুঞ্জরন। তাঁর কবিতা পাঠককে পিছিয়ে নিয়ে যায় অতীতঘনিষ্ঠ পূর্বোক্ত জৈবিক অভ্যাসের দিকে। পাঠকের অব্যক্ত অবচেতনে আঘাত করে মহাপৃথিবীর বিশালতার সামনে ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে দাঁড় করায়। যেমন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-এর ‘জীবন’ নামক ৩৪টি কবিতা নিয়ে গঠিত দীর্ঘ কবিতাটির শুরুতেই তিনি লিখেছেন :
“সে কোন্ প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে!
আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ,—
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে!
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে,—তার সাথে সে-ও আছে জেগে”
উপরোক্ত ‘সে’ আবহমান মানবসত্তা, যার অস্তিত্বের বোধ একক শরীরে আবদ্ধ নেই, সামগ্রিক মানব-অস্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তি মিলিত হয়েছে। অসংখ্য টুকরো টুকরো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভবকে আশ্রয় করে সে মহাবিশ্বের সন্ধান পায়, যেখানে ব্যক্তি তার অতিক্ষুদ্রতা নিয়ে ভৌত অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সুতরাং, জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি দৃষ্টিসুখের উপাদানমাত্র নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে মানব-চৈতন্যের প্রেক্ষাপট।
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ” — চৈতন্য উদ্ভাসন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙ্ক্তি খুব সহজভাবে মানুষের অস্তিত্বের দর্শনকে প্রকাশ করে। একদিকে যেমন আমাদের বোধ বা উপলব্ধি পান্নাকে প্রতিভাসিত করে, বিপরীতভাবে পান্নার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতাই ব্যক্তিকে ‘দ্রষ্টা’ করে তোলে। অর্থাৎ ব্যক্তি নিজেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। একইভাবে, প্রকৃতিকে জেনেবুঝে নেওয়ার মধ্যে নিজের বিভিন্ন আঙ্গিককে ‘চিনে নেওয়া’ বা ‘জেনে নেওয়া’ থেকে যায়। জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার আয়না। চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান কবি ব্যক্তিত্বের আত্ম-প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে। যেমন: ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘বেড়াল’ কবিতাটিতে দেখি, একটি বিড়ালের সঙ্গে জীবনের আশ্রিত-অনাশ্রিত পরিস্থিতিতে অথবা অসংখ্য প্রথা-নিয়ন্ত্রিত কবন্ধ মানুষের ভিড়ে কবির দেখা হয়ে যায়। মানবমনের যে সত্তা কেজো পৃথিবীর সঙ্গে ক্রমাগত তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে, তাকে কবি খুঁজে পান এই বেড়ালের মধ্যে :
“সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলি আমার দেখা হয়:
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি”
কবি প্রকৃতির অনুষঙ্গেই মানুষের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করেছেন, তাই প্রাকৃতিক উপাদানই তাঁর কবিতার প্রতীক ও চিত্রকল্প হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বিড়ালটি বস্তুত চেতনসত্তার আত্ম-প্রতিকৃতি। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সার্ত্রের মতে জন্মের পর আকস্মিকভাবেই আমরা বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হই।এই পারিপ্রেক্ষিক কাঠামোর মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, পূর্বনির্ধারিত প্রতিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় পৃথিবীর ‘রণ-রক্ত-সফলতা’র প্রতিযোগিতায় মানুষকে যোগদান করতেই হয়। দুনিয়াদারিতে সামিল হওয়ার জন্য তাকে টুকরো-টাকরা লাভ-লোকসানের হিসেব কষতে হয়। মৌমাছির ডানায় তোলা গুঞ্জনে যে ঝিম ধরা ধ্বনি থাকে, তাতে একপ্রকার লুপ বা আবর্ত অনুভূত হয়। ‘মৌমাছির মতো নিমগ্ন’ হয়ে থাকার শব্দবেধী উপমাটি মনস্তাপের অসমাপ্য আবর্তে আটকে ছটফট করার যন্ত্রণাকে দ্যোতিত করছে। ব্যক্তির স্বচ্ছ আলোকিত ‘True self’, যে জাগতিক মালিন্যের ধার ঘেঁষতে চায় না, তাকেও মার্জার প্রবৃত্তি ধারালো নখের আঁচড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চায়। প্রকৃতি ও সহজাত স্বভাবের থেকে ক্রমেই দূরবর্তী হতে থাকে। এইভাবেই ক্রমে ক্রমে মানুষ হয়ে ওঠে ‘তিমিরবিলাসী’।
জীবনানন্দের কবিতায় সময়ান্তরের মানবেরা প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে সমপঙ্ক্তিতে উচ্চারিত হয়েছেন। প্রকৃতির অস্পষ্ট আলো-আঁধারির ছাঁচে তাদের জীবন সংগ্রামের গল্পে, বাস্তব-কল্পনা-স্বপ্ন মিলেমিশে তৈরি হয়েছে রূপকধর্মী জনশ্রুতি। তাদের বেদনার রং যেন বাংলার বিজন ঘাসে, গঙ্গাফড়িং-এর ভঙ্গুর নীড়ে, কাঁচপোকা-শ্যামাপোকা-প্রজাপতিদের নীরব ডানার উড়ানে কিংবা হিজলের ক্লান্ত আনত পাতার শ্যামল অন্ধকারে প্রতিফলিত হয়েছে। যে কিশোরী-কুমারী-কল্কাপেড়ে শাড়ি পরিহিতা গ্রামীণ বধূরা পায়ের চিহ্ন রেখে হারিয়ে গেছে সময়ের পটপরিবর্তনের সঙ্গে, তারা ছিল পৃথিবীর স্বভাবজ সারল্যের মানবী রূপ, আবহমান প্রকৃতির অপর এক সত্তা, যারা সংক্ষুব্ধ মানবের হাতে ব্যবহৃত হতে হতে বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছে বাংলার নদী-মাঠ-ভাটফুলের আঙিনায়। জীবনানন্দের কবিতায় যে লোককথা-রূপকথা-মঙ্গলকাব্যের নারী-পুরুষদের পাই, তারা প্রায় প্রত্যেকেই সমসময়ের কাছে অপাঙক্তেয় বিবেচিত হয়েছেন। যেমন মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগর একদিকে যেমন দেবতার রোষের শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে পারিবারিক জীবনে কখনও নিজ আদর্শের সমর্থন পাননি। আবার, বেহুলা দেব-মানবের দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্রের ‘ভিক্টিম’, একইভাবে সনকাও তার পরিবারে আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে পারেননি বা স্বতন্ত্র মতামতের স্বীকৃতি পাননি, বরং আরাধ্য দেবীর কাছ থেকেই চরমতম যন্ত্রণা লাভ করেছেন। আবার শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা, মাণিকমালাদের গল্পে ঢুকে পড়ে লোভী কামুক রাক্ষস। অভীষ্ট লাভ করার জন্য তাদের পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ এবং জটিল কণ্টকিত পথ। সুতরাং মানবীয় দুনিয়া এদের অকাতরে নির্যাতন করে ছেড়ে দিয়েছে অনিশ্চিত ভবিতব্যের কাছে। সমাজ-রাজনীতি-পরিবারের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁদের ফিরে আসতে হয়েছে প্রকৃতির কাছে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি ও মহাকালের অংশ হয়ে উঠেছেন। প্রকৃতি ও কালাতীত জনচেতনা ধারণ করে আছে বেহুলা, সনকাদের মতো অজস্র জীবনক্লান্ত নারী-পুরুষের খিন্নতা, দীর্ঘশ্বাস। জীবনানন্দের কাব্যদর্শনে সময় চলিষ্ণু; অন্যদিকে, প্রকৃতির অজড়তা গাণিতিক সত্যের মতো ধ্রুবক, তাই, প্রকৃতি তাঁর কাছে কালেকটিভ আনকনশাসের আর্কাইভ। রূপসী বাংলা কবিতার ছত্রে ছত্রে এই বহমান কালের জনচেতনা প্রকাশিত হয় প্রকৃতির আধারে। যেমন :
১। “পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে স’য়ে
ধানসিঁড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে,
যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,
যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি পরে কোনও এক সুন্দরীর শব
চন্দন চিতায় চড়ে—আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ—সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা;”
(‘যতদিন বেঁচে আছি’, “রূপসী বাংলা”)
২। “আজ সারাদিন এই বাদলের কোলাহলে মেঘের ছায়ায়
চাঁদ সদাগর: তার মধুকর ডিঙাটির কথা মনে আসে,
কালীদহে কবে তারা পড়েছিল একদিন ঝড়ের আকাশে,—
সেদিনও অসংখ্য পাখি উড়েছিল না কি কালো বাতাসের গায়ে,”
(‘হায় পাখি, একদিন’, “রূপসী বাংলা”)
জীবনানন্দের কাব্যচিন্তার দর্শনগত ভিত্তির মূলে রয়েছে মানুষের চেতনা-অবচেতনায় প্রকৃতি ও জীবের অনিত্য অস্তিত্বের নিবিড় সম্পর্ক। নিজেকে অস্তিত্বের সূচনাপ্রান্তে আবিষ্কার করার পর প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ব্যক্তিকে প্রবৃত্তি ও প্রবৃত্তি-অতিরিক্ত চিন্তাশক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। প্রকৃতিজাত শরীর ও চেতনার যে নির্দিষ্ট আয়ু ও সীমা আছে, সেই বোধ মানুষকে মরণশীলতায় আক্রান্ত করে, আবার একইসঙ্গে ব্যক্তিকে যুক্ত করে মানবের সঙ্গে। জীবনানন্দের কবিতাকে যদি একটি রেখাচিত্র দিয়ে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সূচনাবিন্দুতে থাকবে মানুষের অস্তিত্বের বোধ, এবং শেষবিন্দুতে থাকবে প্রকৃতি। মৃত্যু এই দ্বি-বিন্দুর মধ্যবর্তী স্টেশন।
তিন
গৌতম বুদ্ধ ‘নির্বাণ’ শব্দটিকে মৃত্যুর দ্যোতনা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কারণ নির্বাণ শব্দটির মধ্যে নির্বাপিত হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। জীবনপ্রবাহের সমাপ্তির নাম নির্বাণ। বিশ শতকে দার্শনিক সার্ত্র মানুষের জৈবিক মৃ্ত্যুকে পূর্ণ সত্তায় রূপান্তর বলে অভিহিত করেছেন। ‘মৃত্যু’ বিষয়টিকে এক এক দর্শনে এক এক রকমভাবে ব্যাখ্যা করা হলেও, মোটামুটিভাবে মৃত্যুকে একটি পর্যায়ের পরিসমাপ্তিই ধরা হয়। জীবনানন্দের কবিতায় ‘মৃত্যু’-এর দুটি তাৎপর্য আছে। এক, মৃত্যু জাগতিক ঘাত প্রতিঘাতের নির্বাণস্বরূপ, বলা ভালো অনিঃশেষ বিশ্রাম। দুই, মৃত্যু হল সজীবত্ব থেকে জড়ত্বে উত্তরণ।
জীবনানন্দের ভাষ্যে যা কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, যা জীবচক্রের অংশ হিসেবে আসে নির্দিষ্ট সময়ের পর লাল বটফল কিংবা শেফালি ফুল ঝরে পড়ে, কাচপোকাদের সংক্ষিপ্ত শরীর মিশে যায় পাতার ওপরকার শিশিরের সঙ্গে — মৃত্যুর এই সহজ সমাহিত রূপ জীবনানন্দকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে প্রকৃতির শান্ত অথচ ছন্দোময় সমারোহের অন্দরে। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় বর্তমানের সীমা অতিক্রম করে আবহমান টাইম ফ্রেমের প্রেক্ষাপটে স্থির নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক আশ্রয়ের ধারণা উঠে এসেছে, যার পরতে পরতে রয়েছে মৃত্যু ও প্রাকৃতিক পুনর্নিমাণ। ব্যক্তির দেহগত পরিসমাপ্তি কেবল চেতনার অবসানই নয়, জীবনানন্দের কাছে তা সত্তার রূপান্তর।
মৃত্যুর আহ্বানে ফেলে যেতে হয় আকাশের শুকতারা, আশৈশব পরিচিত বাঁশবাগান, হেলেঞ্চা গাছের ঝোপ, জোনাকির ডানায় তোলা আলোর একরাশ মুগ্ধতা — এমন অসংখ্য ছোটো বড়ো আকর্ষণ, অভ্যাস, আসক্তি। ‘যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়’ সে যেমন কখনও ফিরে আসে না, একইরকমভাবে মানুষের মৃত্যু হলে তার জৈবিক অস্তিত্বের আর ফিরে আসা হয় না, তা সে যতই কীর্তিমান হোন না কেন। মানবচৈতন্যের কাছে কাজের মূল্য থাকলেও প্রকৃতিতে একটি মেঠো ইঁদুরের-যে স্থান, মানুষের তাই। সুতরাং, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এক অনিবার্য বিচ্ছেদের সূচনা হয় — এই যন্ত্রণার বোধ বিকল্পহীন সত্য। একক মানুষ চলে যায়—ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তার স্মৃতি, কালের নিয়মে মানুষের তথ্যগত অস্তিত্বও ধুয়ে মুছে যায়। জীবনানন্দের কবিতায় প্রাকৃতিক ও কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর প্রতি বেদনাবিধুর রোমান্টিকতা দেখা যায়। যেমন :
১। “মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়,—দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন,
শুকনো পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আধাঁর
আমার চোখের কাছে…”
(‘মনে হয় একদিন’, “রূপসী বাংলা”)
২। “কোথাও চলিয়া যাব একদিন,— তারপর রাত্রির আকাশ
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি;
জানিব না কত কাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী
পাতাগুলো—”
(‘কোথাও চলিয়া যাব’, “রূপসী বাংলা”)
চোখের কোলে জীবনতৃষ্ণা লেগে থাকলেও জীবনের শুরু ও শেষ দুই-ই অনিশ্চিত, তবু কবির কাছে এই মৃত্যুই প্রত্যাশার, কারণ এটাই প্রকৃতি ও জীবের অভ্যন্তরীণ সংলগ্নতার ঐতিহ্যে সামিল হওয়ার প্রবেশিকা। আবহমান কালের মানবস্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে চাঁদ সদাগর বা চন্দ্রমালা, মানিকমালার মতো, ব্যক্তি কালেকটিভ আনকনশাসের অংশ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, ‘এক’-এর শরীর ছেড়ে ‘বহু’-এর চেতনায় সংযুক্ত হওয়া। সুতরাং, মৃত্যুর মধ্যে যে যন্ত্রণাপূর্ণ শীতলতার আবহ রয়েছে, তা জীবনানন্দের মৃত্যুদর্শনে সদর্থক উষ্ণতা ও প্রাকৃতিক নিবিড়তা লাভ করেছে। নক্ষত্রখচিত অন্ধকার রাতে যদি জাগ্রত ইন্দ্রিয়ের ওপর স্তব্ধতার অন্ধকার নেমে আসে, যদি তখনও জৈব শরীরের সমস্ত জীবনীশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত না হয়ে থাকে, তবু মৃত্যু যেন শীতঘুমের মতো চঞ্চল প্রশ্নাতুর সত্তাকে হাইবারনেট করে রাখে। মৃত শরীর পায় কোমল ঘাসের আরাম।
১। “ঘুমায় পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে;
তখনও যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা—আমার তরুণ দিন
তখনো হয়নি শেষ—সেই ভালো—ঘুম আসে—বাংলার তৃণ
আমার বুকের নিচে চোখ বুজে—বাংলার আমের পাতাতে
কাচপোকা ঘুমায়েছে—আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে,”
(‘ঘুমায় পড়িব আমি একদিন’, “রূপসী বাংলা”)
২। “এ জনমে নয় যেন—এই পাড়াগাঁর
পথে তবু তিন শো বছর আগে হয়তো বা আমি তার সাথে
কাটায়েছি; — পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা—সাতশো বছর
কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে;
ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে মাঠে কতবার কুড়ালাম খড়”
(‘ঘুমায় পড়িব আমি’, “রূপসী বাংলা”)
জীবন-মৃত্যুর যে সহজ স্বাভাবিক আবর্ত, তাতে ফুলের, শস্যের, পাখির, ইঁদুরের অধিকার, কিন্তু মানুষের মৃত্যুর পরিধি এত সংক্ষিপ্ত নয়। দেহ-পদার্থের মৃত্যু ঘটা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, জন্ম-জনন-মৃত্যু সরলরেখার এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুর দিকে যাত্রা, চিন্তাশীল হওয়ার সূত্রে মানুষের চেতনা ও মনন সরলরৈখিক পথে নিরাসক্তভাবে চলতে পারে না। বর্তমান প্রবন্ধের শুরুতে যে ‘জেগে ওঠা’-র কথা বলা হয়েছে, ইন্দ্রিয় জাগৃতির সূত্রে ‘মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি’ দাঁড়াতে হয়, অংশ নিতে হয় ‘জীবন’ নামক যুদ্ধে। ‘Survival of the fittest’-এর সূত্র এক্ষেত্রেও কাজ করে। প্রবৃত্তিকে সাড়ম্বরে পরিপুষ্টি দান করার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারাটাই ‘Survival’-এর মূল মন্ত্র। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রাপ্তির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ককে সমানুপাতে আনার প্রবল চেষ্টা মানুষকে না ‘সহজ মানুষ’-এর সারিতে দাঁড় করাতে পারে না নিজের স্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, অর্থাৎ, ব্যক্তি-মানুষকে কোনও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে স্থির হতে দেয় না। এই অবস্থাকেই হাইডেগার আত্ম-উপলব্ধিজনিত মনস্তাপ বলেছেন, যেখানে ব্যক্তি, জগতে বা পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশের মানদণ্ডে অসমর্থিত হয়, এমনকী জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে কারণ ‘বাস্তবতা’ বিষয়টি যে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ নয় তা অনুধাবন করতে পারে। জীবনানন্দ সত্তার এই ক্ষুব্ধতাকে প্রকৃতির নানাবিধ উপাদানের প্রতিফলকে দেখেছিলেন, যেমন :
১। “রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি।”
(‘আট বছর আগের দিন’, “মহাপৃথিবী”)
২। “কত কোকিলকে স্থবির হয়ে যেতে দেখেছি
তারা আর কিশোর নয়
কিশোরী নয় আর,
কোকিলের গান ব্যবহৃত হয়ে গেছে।”
(‘শীতরাত’, “মহাপৃথিবী”)
মানুষিক পৃথিবী যতই প্রাকৃতিকতা হারিয়ে কৃত্রিমতার দিকে এগোচ্ছে, ততই হৃদয়ের কোকিল স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। সার্কাসের সিংহ যেভাবে নিজের স্বাভাবিকতা হারিয়ে বাধ্য সারমেয়র মতো মানুষের অঙ্গুলিহেলনে মঞ্চে খেলা দেখায়, একইভাবে মানুষও প্রাত্যহিকতার রঙ্গমঞ্চে নিজেদের যোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেদের ‘True self’-কে অস্বীকার ও আনলার্ন করে আরও নিবিড়ভাবে শিকারি প্যাঁচার মতো ইঁদুর ধরায় মন দেয়। আবার কেউ কেউ ম্যান-মেড রিয়েলিটিকে প্রত্যাখান করে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ, যেমন ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় লোকটি অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতার ঝুলিকে এড়িয়ে মৃত্যুকে নির্বাচন করেছিলেন। সেই মৃত্যু ইচ্ছাধীন হতে পারে, কিন্তু শান্তির বা সুখের নয় :
“‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম—অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে—অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানলার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।”
(‘আট বছর আগের একদিন’, “মহাপৃথিবী”)
উটের গ্রীবার মতো দীর্ঘ, শুষ্ক, বক্র অন্ধকার মানুষের সত্তার ওপর নেমে আসে, যাতে ছুটন্ত জীবনের মাঝখানে নিজেকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। হাইডেগার যে যথার্থ অস্তিত্বের কথা বলেছেন, অস্তিত্বের সেই স্তরে মানুষ প্রকৃতি ও জগৎ থেকে নিজের স্বতন্ত্রতা উপলব্ধি করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে একক হয়ে ওঠার বোধ মানুষের বেঁচে থাকাকে উদ্দেশ্যহীন ও নিরর্থক করে তোলে। এই অনুভূতি লোকটিকে জীবনের পিছুটান ত্যাগ করার প্রেরণা জুগিয়েছিল। জীবনানন্দের প্রায় সব কাব্যগ্রন্থের কবিতাতেই ‘ঘুম’ ও ‘অন্ধকার’-এর প্রসঙ্গ আছে, তা অস্তিত্বশীলতার ক্লান্তি ও গ্লানি। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে ঘুম বা সুষুপ্তি কেবল জীবন থেকে দৈহিক ‘এসকেপ’ বা শরীরী বিচ্ছিন্নতা নয়, তা বস্তুত মানব-হৃদয়ের মৃত্যু। সচেতন সত্তার অভ্যন্তরে চলতে থাকা অসংখ্য মৌমাছির ডানায় তোলা গুঞ্জরণের অস্বস্তিকর চিৎকারকে চুপ করিয়ে দেওয়া এবং ‘True self’-কে অবচেতনের ভেতর নিদ্রিত করার একটি প্রক্রিয়া, যেখানে মৃত্যু ঘটছে ব্যক্তির মনন-চিন্তন এবং আমিত্বের।
চার
আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর মা নেওমি গিন্সবার্গের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা ‘Kaddish’ কবিতাটিতে মৃত্যুকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মা বা স্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করে মৃত অবস্থাকে তুলনা করেছেন জীবের স্বভাবজ নগ্নতার সঙ্গে। তাঁর কাছে মৃত্যু এমন এক অনন্ত কুমারিত্ব যা ভেদ করার সাধ্য কোনও প্রকাণ্ড বিপ্লবেরও নেই। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের যে চক্র পৃথিবী অনন্তকাল ধরে ধারণ করে চলেছে তার এক প্রান্তে থাকে চেতনা-জাগৃতি, অন্যপ্রান্তে থাকে চেতনা-সমাপ্তি। প্রকৃতির ভেতর জীবের স্বাভাবিক মৃত্যু নগ্ন ও নীরব। হাইডেগার কথিত ‘Radical finite’ বা চরম সসীমত্বের বোধ মানুষের চেতনাকে পৌঁছে দেয় দ্বন্দ্বের কিনারায়, যেখানে জীবনানন্দের মতো প্রতিটি মানুষ নিজেকে জিজ্ঞাসা করে ‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব / আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?’ এই প্রশ্নটিই ব্যক্তির জীবনপ্রবাহে যাবতীয় কার্যের কারণ ও সূচনাবিন্দু।
মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতিতে ফিরে আসার যে আবর্ত ভৌত পৃথিবীতে চলতে থাকে, এর সমান্তরালে একটি চেতনাগত আবর্তের অংশী হয়ে ওঠে মানুষ। আত্ম-সচেতন হওয়ার পর Survive করার তাড়নায় মানবসভ্যতা ‘সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে’ (শ্যামলী, কাব্যগ্রন্থ: বনলতা সেন) রওনা দিয়েছে নগরে-বন্দরে-যুদ্ধক্ষেত্রে। পণ্যেই মানুষের পুণ্য—এখন এই আপ্তবাক্যেই রয়েছে ক্ষমতায়নের ইতিহাস। সুতরাং, প্রকৃতি-সংলিপ্ততার আদিম চেতনা থেকে মানুষ এখন কয়েক শো মাইল দূরে অবস্থান করছে। আধুনিক ইনভেস্ট-প্রবণ মানসিকতা অসংখ্য ঘাত প্রতিঘাতের চিহ্ন নিয়েও লড়ে যাচ্ছে সম্পদ-সম্পন্নতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে, তবে তাকে আশ্বাস খুঁজতে আজও শরণাপন্ন হতে হয় আদিম জীবনের কাছে। জীবনানন্দ ‘মিতভাষণ’ কবিতাটিতে লিখেছেন :
“মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সংকল্প স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।”
(‘মিতভাষণ’, “বনলতা সেন”)
সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত বিদিশা শ্রাবস্তীর মতো ঐতিহাসিক নগরগুলো পাথুরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সময়ের অভিঘাতে, তাদের প্রাচুর্য-গুরুত্ব-আভিজাত্য সবই ক্ষয়ে গেছে ধীরে ধীরে। বিম্বিসার, অশোক থেকে শুরু করে চাঁদ সদাগর, বেহুলা, রাজাদের দিগ্বিজয়ের দম্ভ বা সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ক্লান্তি সমস্তই জমা পড়েছে প্রকৃতি ও সময়ের ঘরে। অর্থাৎ, দেহ-পদার্থের সঙ্গে সঙ্গে মানবমনের যা কিছু নিষ্ফলতা-সঞ্চয়, তার অঙ্গারটুকুও গ্রহণ করছে আকাশ-বাতাস-মাটি-জলের নিত্য আশ্রয়। জীবনানন্দ যখন বলেন — “গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; / আমাকে কেন জাগাতে চাও?” (‘অন্ধকার’, “বনলতা সেন”) — এই প্রশ্ন যে ক্লান্তির উদর থেকে উঠে আসা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। জাগ্রত অস্তিত্বের অনুভব থেকে আত্মাকে প্রত্যাহার করার এই ইচ্ছা কেবল জীবনানন্দের ব্যক্তিগত নয়, প্রতিটি বানিজ্যপ্রবণ মানুষের অন্তঃকরণও একইভাবে বিশ্রাম চেয়ে নেয় প্রকৃতির কাছে। ইন্দ্রিয়জাগৃতি দিয়ে অস্তিত্বের সূচনা হয়েছিল, মৃত্যু ও প্রকৃতিতে সমাহিত হতে চাওয়ার মধ্যে দিয়ে মানুষের চেতনাগত আবর্তটি সম্পূর্ণ হচ্ছে। প্রকৃতি, মানুষের অস্তিত্ব ও মৃত্যুর আন্তঃসম্পর্কটিই জীবনানন্দের কাব্যদর্শনের প্রধানতম অন্বেষণ।
আকরগ্রন্থ :
১। জীবনানন্দ দাশ, প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র, আবদুল মান্নান সৈয়দ (সংকলিত ও সম্পাদিত), ঢাকা, অবসর, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুরারি ১৯৯৪, চতুর্দশ মুদ্রণ এপ্রিল ২০১৫
তথ্যসূত্র :
১। বুদ্ধদেব বসু, ‘জীবনানন্দ দাশ : ধূসর পাণ্ডুলিপি’, কালের পুতুল, কলকাতা, নিউ এজ, প্রথম প্রকাশ ১৯৪৬, নিউ এজ সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৫৯, পৃষ্ঠা: ২৭