জল-মানুষ-পৃথিবী এবং সংকট

সুশান্ত চৌধুরী

জল ও জীবন

১৯৯০ সালে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা থেকে উৎক্ষিপ্ত, বিজ্ঞানীদের পাঠানো মহাশক্তিশালী ‘হাবল টেলিস্কোপ’ (Hubble Space Telescope) মহাশূন্যে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে চলেছে অবিরাম। তার দৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। সে সর্বদা খুঁজে চলেছে মহাকাশের মহাশূন্যে প্রাণের অস্তিত্ব। কিন্তু না, এখনো পর্যন্ত দেখা মেলেনি কোনো প্রাণের। শুধুমাত্র মানুষ বা মানব সভ্যতা নয়, ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের এই নীল গ্রহেই রয়েছে প্রাণের সঞ্চার, জীবনের তরঙ্গ। আণুবীক্ষণিক সামুদ্রিক অণুজীব ‘স্ট্রোমাটোলাইট’-কে দিয়ে আজ থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে যে জৈবমণ্ডলের সূচনা হয়েছিল, যুগ যুগান্তরের অভিযোজনে তার সাম্প্রতিক প্রজাতিটি উন্নত সুসভ্য মানুষ। সে পৃথিবীতে এসেছে মাত্র তিন লক্ষ বছরও হয়নি। জীবনের এই স্ফুরণ, এই ব্যাপকতা, ব্রহ্মাণ্ডের একটি মাত্র গ্রহে এর নিরবচ্ছিন্ন স্থায়িত্বের প্রাথমিক উপাদান দুটি, পৃথিবীর আকর্ষণে তার চারিপাশে আটকে থাকা বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন আর মাটিতে জলের উপস্থিতি। ব্রহ্মাণ্ডের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহ পৃথিবীতে সমগ্র জীবকুলের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার নিরিখে একমাত্র জলেরই আছে এক অসাধারণ যোগ্যতা। প্রাণের সৃষ্টি, তার স্থায়িত্ব ও ক্রমপর্যায়িক বিবর্তনের প্রাথমিক চাহিদা হল তাপমাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত পরিসীমা। উত্তাপের খুব বেশি বা দ্রুত তারতম্য, সময়ের সাপেক্ষে প্রাণের স্বাভাবিক চলমানতার বিঘ্ন ঘটায়, বিপন্ন হয় তার স্বাভাবিক নিরবচ্ছিন্ন চলমানতা। জল যে কোনো অবস্থাতেই তাপের কুপরিবাহী।  খুব তাড়াতাড়ি গরম হয় না, আবার ঠাণ্ডা হতেও বেশ সময় নেয়। আর এই কারণেই পার্থিব প্রকৃতিতে জলকে তিনটি অবস্থাতেই পাওয়া যায়। জলীয়বাষ্প,  তরল জল আর কঠিন বরফ। জলের আর একটি বিচিত্র বৈশিষ্ট্য হল জল সব থেকে ভারী হয় যখন সে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল অবস্থাতেই থাকে। আরও বেশি ঠাণ্ডা হয়ে জল জমে, যখন কঠিন বরফ হয় তখন সে আগের থেকে হালকা হয়ে জলেই ভাসে। তাই সাগর, নদী, হ্রদের জল জমে শক্ত বরফের চাদরে ঢেকে গেলেও তার তলায় তরল জলে দিব্যি চালু থাকে জীবনের চলমানতা। শুধুমাত্র এই এক অদ্ভুত কারণে ভূতাত্ত্বিক সময় সারণিতে পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন সময়ে নেমে আসা হিমযুগে বা অন্যান্য ঘাত-প্রতিঘাতেও প্রাণ তার অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। চালু থেকেছে যোগ্যতমের জয়ের এক সুষম লড়াই। অবশেষে বিবর্তনের পথ ধরে, উত্তরণের এই বর্তমান সময়ে জীবকুলের মাথায় এসে বসেছে মানুষ। সেও কিন্তু প্রকৃতিরই সৃষ্টি। এই জলীয়, বায়বীয় আর মৃত্তিকাময় প্রকৃতিই তার রক্ষাকর্তা, প্রাণভোমরা। কিন্তু, বুদ্ধিমান মানুষ, কেন আজ এই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেও বুঝল না জল নামক এই প্রাকৃতিক উপাদানটি সবথেকে সহজলভ্য হলেও, সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবেই সে বুঝেও খানিক নিরুপায় হয়েই এড়িয়ে যেতে চায় সেই চরম সত্য।

জলময় পৃথিবী

আমাদের এই ধরিত্রীর বুকে তরল জলের তো অভাব নেই। পৃথিবী পৃষ্ঠের তিনভাগই তো জল আর মাত্র একভাগ কঠিন পাথর, তার ওপর কোনো কোনো অঞ্চলে পাতলা স্তরে বিছিয়ে থাকা মৃত্তিকাময় স্থলভাগ। তাই এটা ভেবে সন্তুষ্টির কারণ নেই যে, যাক পৃথিবীতে জলের কোনো অভাব নেই বা ভবিষ্যতে তা হবারও নয়। কিন্তু, বাস্তব ছবিটি আলাদা। অন্তত, আমাদের মানে — স্থলভূমিতে রাজত্ব কায়েম করা মনুষ্যকুল ও তাকে লালন পালন করে বাঁচিয়ে রাখা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ছবিটি বেশ উদ্বেগের। এখনকার হিসেব বলছে আমাদের পৃথিবীতে মোট জলের পরিমাণ ১৪০ কোটি ঘন কিলোমিটার। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্রের নোনা জলও এবং শতাংশের হিসেবে তা ৯৭ শতাংশ, যা কোনোভাবেই মানুষের কাজে লাগে না প্রায়। অর্থাৎ বাকি হাতে থাকা তিন শতাংশ স্বাদু বা মিষ্টি জলেই পৃথিবীর ডাঙার মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, গাছপালা, সবার জীবনকে চালু রাখার প্রধান উপাদান। এখানেই শেষ নয়, এই তিন শতাংশ স্বাদু জলের মধ্যে ২.৩১ শতাংশ জল আবদ্ধ রয়েছে মেরু অঞ্চলের জমাট বাঁধা কঠিন দুধ সাদা বরফের চাদরে, আর বাকি ০.৬৯ শতাংশ জল ছড়িয়ে আছে পৃথিবী পৃষ্ঠের নদী, হ্রদ, মাটিতে, পাথরে তরল জল হিসেবে, আর বায়ুমণ্ডলের নীচের অংশে তা মিশে থাকছে জলীয় বাষ্পকণায়। পৃথিবীর স্থলভাগে থাকা তরল জলের বেশিটাই রয়েছে ভূপৃষ্ঠের তলায় মাটি আর পাথরের গঠনকারী মূল কঠিন কণাগুলির মধ্যেকার ছিদ্রপথে। সেটি শতাংশের হিসেবে ০.৬৬ ভাগ। ০.০১০৩ ভাগ মিষ্টি জল রয়েছে নদ-নদীতে, জলাশয়ে, জীবদেহে আর রাসায়নিক যৌগে আবদ্ধ জলের পরিমাণ ০.০১৮৭, বাতাসে জলীয় বাষ্প হিসেবে আছে ০.০০১ ভাগ জল। আধুনিক পৃথিবীর জলের হিসেব আপাতত এটাই। অর্থাৎ কিনা ভূপৃষ্ঠে আর ভূগর্ভে জলের যে ক্ষুদ্র অংশটি আবদ্ধ আছে সেটুকুই আমাদের ব্যবহারের উপযোগী, এর ওপর নির্ভর করে টিকে আছে ডাঙার তাবৎ জীবজগৎ। সুতরাং জল সম্পর্কে দুটি চলতি, এবং মারাত্মক ভুল ধারণা ‘জলের কোনো দাম নেই’ অথবা ‘জলের কোনও ক্ষয় নেই’ এবং তার সঙ্গে আমাদের আপাত উদ্ধত আচরণ — জল যে এক অমূল্য সম্পদ তা ভাবতে অস্বীকার করিয়েছে। ফলত, জলের বেলাগাম ব্যবহার, জলের অপচয় বাড়িয়েছে এবং সেই লাফিয়ে বেড়ে চলা অপচয়, জলের চাহিদা বাড়িয়েছে বহুলাংশে, কমিয়েছে তার গুণমান। দ্রুতলয়ে বিঘ্নিত হয়েছে বা এখনো হয়েই চলেছে প্রকৃতিতে নিরন্তর ভাবে চলতে থাকা ‘জলচক্রের’ সাম্যাবস্থা। মানুষের বাঁধন ছাড়া উন্নয়নে দ্রুত হারে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভের জলস্তর, দূষিত হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে বয়ে চলা জলরাশি। রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষায় সেই ভয়াবহ চিত্রটিই ধরা পড়েছে, যে অনতিবিলম্বে জলের বেলাগাম অপচয় ও তারই ফলস্বরূপ জলের দূষণ বন্ধ না হলে অদূরেই কেবল মাত্র তৃষ্ণার জলের অভাবে বিলুপ্ত হবে বহু প্রাণী। বিঘ্নিত হবে খাদ্য শৃঙ্খল, নষ্ট হবে বাস্তুতন্ত্র। 

প্রাকৃতিক জলচক্র – বিঘ্নিত সাম্যতা

এক্ষেত্রে প্রকৃতি নির্ধারিত জলচক্র সম্পর্কে খানিক আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পৃথিবীপৃষ্ঠে ও ভূগর্ভে জলের স্বাভাবিক সত্তা বজায় রাখতে নিরন্তর ঘটে চলেছে চক্রবৎ এক ভূপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়া– ‘জলচক্র’। সমুদ্রের বিশাল পরিমাণ জলরাশি ও সেই সঙ্গে স্থলভাগের নদী, নালা, খাল বিলের জল সূর্যের তাপে ক্রমাগত বাষ্পীভূত হয়ে চলেছে। যা মিশে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলে, সেই বাষ্পকণা খানিক ওপরে উঠে ঠান্ডায় পুঞ্জীভূত হয়ে তৈরি করছে মেঘ। আর সেই মেঘ থেকেই ঝরে পড়ছে বারিধারা, বৃষ্টি। বাষ্পীয় জল আবার ফিরে আসছে পৃথিবী পৃষ্ঠেই। এখানে একটা দারুণ ব্যাপার এই যে, সমুদ্র থেকে যে বিশাল পরিমাণ জলরাশি প্রতিনিয়ত বাষ্পীভূত হচ্ছে তা কিন্তু বাষ্পীভবনের পরে আর লবণাক্ত থাকছে না। বদলে যাচ্ছে মিষ্টি জলের বাষ্পকণায়। মিশে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। আর এর থেকে তৈরি হওয়া মেঘের অনেকটাই বায়ু তাড়িত হয়ে চলে আসে স্থলভাগের দিকে। সেই মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জল সিঞ্চিত করে স্থলভাগের মাটিকে। যদিও সমুদ্র থেকে উত্থিত বাষ্পের খানিকটা আবার সোজাসুজি বৃষ্টি হিসেবে সমুদ্রেই ফিরে যায়। স্থলভাগে নেমে আসা বৃষ্টির জলের বেশ খানিকটা অংশ ভূপৃষ্ঠে বয়ে চলা নদী নালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ফিরে যায় সমুদ্রে। পৃথিবীপৃষ্ঠে থাকা জলের কিছুটা বাষ্পীভূত হয় সূর্যতাপে, কিছুটা গ্রহণ করে পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল। মেরু প্রদেশ আর উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তুষারপাত ঘটায় সেখানে, সময়ের সঙ্গে আরও ঠান্ডায় তা জমাট বাঁধে হিমবাহে। সেই হিমবাহ আবার সূর্যালোকের তাপে গলে গিয়ে তরল জলে রূপান্তরিত হয়ে নেমে আসে নদীর প্রবাহে। বছরভর সাগরের পানে বয়ে চলা নদীর জলের বেশ খানিকটা আবার মাটি আর তার নীচে থাকা শিলাস্তরের মধ্যে দিয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রাকে এক নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে রাখে। এই ভাবে সমুদ্র থেকে বাষ্পীভূত হওয়া বিশাল জলরাশির বেশিটাই আবার সমুদ্রেই ফিরে যায়। সম্পূর্ণ হয় জলচক্র। এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল একটি সম্পূর্ণ জলচক্রের সময় ও স্থানের সাপেক্ষে বিভিন্ন পর্যায়গুলির সাম্যতা ও নিরবচ্ছিন্ন যোগসূত্রতার প্রাকৃতিক ক্রমবিন্যাস। আজকের এই জনবহুল পৃথিবীতে স্বাদুজলের পরিমাণ ও তার গুণমান বজায় রাখতে গেলে প্রাকৃতিক জলচক্রের সাম্যতা বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সাধারণত জলচক্রের একটি আবর্তন সম্পূর্ণ হতে, অর্থাৎ সমুদ্রের সাধারণ শীতল জল গরম হয়ে বাষ্প হয়ে উঠে, বৃষ্টি হয়ে নেমে এসে স্থলভাগের ভূপৃষ্ঠ আর ভূগর্ভ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সম্পূর্ণটাই সমুদ্রে ফিরে আসতে সময় নেয় ৩৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ বছর। ভূতাত্ত্বিক সময় সারণির নিরিখে যা কিন্তু খুব বেশি সময়, তা বলা যাবে না।

প্রকৃতিতে এই নিরন্তর জলচক্র চলছে বলেই আমরা, মানে মনুষ্যকুল, নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর, কুয়ো আর ভূগর্ভ থেকে জল পেয়ে থাকি। পান করি, ব্যবহার করি, দৈনন্দিন প্রয়োজনে, কৃষিকাজে, উৎপাদন শিল্পে। এই যে উৎস থেকে আমরা জল নিচ্ছি আমাদের প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে, তার কোনোটিই কিন্তু জলের প্রাথমিক উৎস নয়। বৃষ্টি হয়ে নেমে আসা জলই সমগ্র পৃথিবীতে স্বাদু জলের একমাত্র প্রাথমিক ও প্রধান উৎস। 

হিসেব বলছে, যে আধুনিক আবহাওয়া আর প্রকৃতি তৈরি হওয়ার পর পৃথিবীতে জলচক্রের আবর্তনে প্রতিদিন গড়ে মোটামুটি ৮৭৫ কিউবিক কিলোমিটার জল বাষ্পীভূত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭৭৫ কিউবিক কিলোমিটার বাষ্প আবার বৃষ্টি হয়ে সরাসরি সমুদ্রের ওপরই ঝরে পড়ে, বাকি ১০০ কিউবিক কিলোমিটার জলীয় বাষ্প বায়ু বাহিত হয়ে স্থলভাগে চলে আসে, যেখানে এর সঙ্গে মেশে জলাশয় থেকে উদ্ভূত আরও প্রায় ১৬০ কিউবিক কিলোমিটার জলীয় বাষ্প। এই ২৬০ কিউবিক কিলোমিটার জলীয় বাষ্প বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে পৃথিবীর স্থলভাগে। যা ডাঙায় থাকা সমগ্র জীবকুলের জন্য প্রয়োজনীয় জলের একমাত্র জোগান। হিসেব শাস্ত্রের ভাষায় ‘ক্রেডিট’। এই ক্রেডিট হওয়া স্বাদু জলের সমস্তটাই কিন্তু মানুষের নাগালে আসে না। এই নেমে আসা বৃষ্টির জলের ১০০ কিউবিক কিলোমিটার পরিমাণ জল নদীবাহিত হয়ে ফিরে যায় সমুদ্রে, হাতে থাকা ১৬০ কিউবিক কিলোমিটার জল প্রতিদিন জমা হয় স্থলভাগে, অর্থাৎ কিনা বছরে প্রায় ৬০,০০০ ঘন কিলোমিটার। এটিই পৃথিবীর স্থলভাগে স্বাদুজলের বছরভর নিট জোগান যা কোনও ভাবেই অন্তত প্রাকৃতিক উপায়ে বাড়ানো সম্ভব নয়। সুতরাং মানব সভ্যতার ক্রমাগত লাগামহীন উন্নয়ন আর সাম্প্রতিক অতীতের জনবিস্ফোরণের কারণে জলের চাহিদা, ভৌমজলের উত্তোলন এবং পৃথিবীর ভূস্তরের অভ্যন্তরে তার জোগান, এই দুটির মধ্যে সাম্যাবস্থা ব্যাহত হলে, সঞ্চিত জলভান্ডার একদিন নিঃশেষ হবেই। এটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট যে এখানে আমরা আমাদের ব্যবহৃত জলের কথাই কেবলমাত্র আলোচনা করছি, কিন্তু প্রকৃতিতে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদেরও বেঁচে থাকার জন্য জলের প্রয়োজন। 

মানুষ ও জল

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সারাদিনে ২.৭ লিটার জল পান করে। এই হিসেবে এখনকার পৃথিবীতে কেবলমাত্র মানুষের পানীয় হিসেবে প্রায় ৫০০০ ঘন কিলো-লিটার স্বাদু জলের প্রয়োজন, যা পৃথিবীতে বাৎসরিক জলের যোগানের শতকরা ৪ ভাগ। ২০৫০ সাল নাগাদ যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ১৫০০ কোটির মতো তখন ঐ জলের পরিমাণ হবে বর্তমানের প্রায় তিন গুণ। পৃথিবীতে বর্তমানে স্বাদু জলের মোট পরিমাণ ধরলে এই হারে জনসংখ্যা বাড়লেও হিসেব মতো পানীয় জলের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মূল সমস্যা এই যে পৃথিবীতে সর্বত্র জলের সরবরাহ সমান নয় এবং জনসংখ্যাও তাই। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে জনসংখ্যা ও জলের সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলেও, প্রায় সব উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে, যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি, সেখানে জলের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ফারাকও বিস্তর। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা বলছে এই অঞ্চলগুলিতেই জল-জনিত ও জল-বাহিত সমস্যা ভবিষ্যতে প্রকট থেকে প্রকটতর হবে। বলে রাখা ভালো, পৃথিবীর বহু দেশের সঙ্গে আমাদের ভারতবর্ষ সেই আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়। ছোট্ট একটা তুল্যমূল্য হিসেব দেওয়া যাক — আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে একজন লোক বছরে গড়পড়তা মোট ২২৫ ঘনমিটার জল পান ও অন্যান্য গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করে, আর আমাদের দেশে এই পরিমাণ হল মাত্র ৭০ ঘনমিটার। আমদের মনে রাখা উচিত যে প্রয়োজনীয় জলের জোগান বাড়ানোর একটা অন্তিম সীমা থাকবে, কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে জলের চাহিদা বাড়ে গুনিতক হারে, আর যেহেতু পৃথিবীতে বিগত একশো বছরের জনবিস্ফোরণ, প্রায় সব যুক্তিগ্রাহ্য অঙ্কের হিসেবকে পিছনে ফেলে সুতীব্র গতিতে ঊর্দ্ধমুখী, তাই আগামী দশকেই জলের চাহিদার মাত্রা তার প্রাকৃতিক জোগানের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জল সরবরাহ ও জনসংখ্যার তারতম্যে দেখা দেবে জল দুর্ভিক্ষ। 

অবাক করা ব্যাপার আছে অন্যত্র। মানুষ বাদে পৃথিবীর তাবৎ জীবজগতের বাসিন্দাদের জীবন প্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে এই মূল্যবান জলসম্পদের একটুও যাতে অপচয় না হয় সে বিষয়ে সকলেই সচেষ্ট। এ ব্যাপারে তারা নানা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, অভিযোজিত তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নানা পরিবর্তন ঘটেছে। উদ্ভিদ তার প্রয়োজনের জলটুকু বাদ দিয়ে বাকিটা বাষ্পাকারে বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে দেয়। স্থলচর প্রাণীদেহে কিডনি এমনই এক যন্ত্র যা দেহে অবস্থিত মোট জলের একভাগ মূত্র হিসেবে বাইরে ত্যাগ করে ও বাকি ৯৯ ভাগ জল বিশুদ্ধ করে কাজ চালায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে বুদ্ধিমান মানুষ তার আশে পাশের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেখে, এমনকি তার দেহের অভ্যন্তরের বিস্ময়কর যন্ত্র কিডনির কার্যকারিতা দেখেও এ বিষয়ে এতটুকু সচেতন হল না। তাই মানুষের হাতেই হচ্ছে জলের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার, অপচয় আর ব্যাপক দূষণ, যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে পৃথিবীর সমগ্র জীবকুলকে।

জলজীবনধারণে, কৃষিতে, শিল্পে 

জীবনধারণের জন্য জলপান প্রয়োজন সমস্ত জীবের। কিন্তু জল যদি শুধুমাত্র জীবনধারণের নিমিত্তে, শুধু মাত্র পানীয় হিসেবে ব্যবহার হত, যা কিনা মানুষ ছাড়া জীবকুলের সমস্ত প্রাণীই করে থাকে, তাহলে দুশ্চিন্তার কোনো অবকাশই থাকত না। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী যে পানকার্য ছাড়া জলকে আরও নানান কাজে ব্যবহার করেছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। বস্তুত পানীয় এবং গৃহস্থলির কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের পরিমাণের থেকে, মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে ও ঝড়ের গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে নিয়মিত ঘটে চলা কর্মকাণ্ডে জলের ব্যবহার অনেকে অনেক গুণ বেশি।

মানুষ যে জল ব্যবহার করে তার সিংহভাগই ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে। সারা পৃথিবীর মানুষ যে পরিমাণ জল মোট ব্যবহার করে, তার প্রায় শতকরা ৬৮ শতাংশ খরচ হয় কেবল মাত্র কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটির বিশালতার খানিক আন্দাজ পাওয়া যাবে। হিসেব বলছে এক কিলোগ্রাম আলু ফলাতে যে জলের প্রয়োজন হয় তার পরিমাণ প্রায় ২০০ গ্যালন, অর্থাৎ প্রায় ৮০০ লিটার জল। এক কিলোগ্রাম গম ও ধানের জন্য দরকার পড়ে যথাক্রমে ১৭০ ও ২৮০০ লিটার। সেই কাঁচা খাদ্যবস্তু যখন আবার প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্যাকেটজাত হয়ে বাজারে আসছে, জলের ব্যবহার তাতে আরও ভয়ানক ভাবে বাড়ছে। একটা দশ টাকার পোট্যাটো চিপ্সের প্যকেটের জন্য নিদেনপক্ষে প্রয়োজন হয় ৪০০ লিটার জল। স্প্রাইট বা পেপসির ৫০০ মি.লি. একটা বোতল যখন আমরা কিনি— আমরা কিন্তু হিসেবেই রাখি না এর জন্য জল ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৭৫০ লিটার।

কৃষিক্ষেত্রে জলের চাহিদা ক্রমশই দ্রুত গতিতে ঊর্দ্ধমুখী। এর মূল এবং একমাত্র কারণ অবশ্যই বিগত একশো বছরের জনবিস্ফোরণ। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১৮০০ সাল অবধি পৃথিবীর জনসংখ্যা — ১ বিলিয়ন। ১৮০০ থেকে ১৯২০, ঠিক ১২০ বছরে হয়ে গেল দ্বিগুণ, ২ বিলিয়ন। ১৯৭০, এবার মাত্র ৫০ বছরে আবার হয়ে গেল দ্বিগুণ, ৪ বিলিয়ন। ২০২০, আবার 50 বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছাড়াল ৮ বিলিয়ন। WHO জানাচ্ছে ২০৫০-এ পৃথিবীর জনসংখ্যা ছাড়াবে ১৫ বিলিয়ন অর্থাৎ ১৫০ কোটিরও বেশি। মাত্র ২২০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা অকল্পনীয় হারে বেড়েছে ১ বিলিয়ন থেকে ৮ বিলিয়ন। (১ বিলিয়ন = ১00 কোটি) তাই কেবলমাত্র থাকার জন্যই চাই অনেক জায়গা। ফলে নগরায়ণ হয়েছে দাবানলের দ্রুততায়। নির্বিচারে কাটা হয়েছে বনাঞ্চল। হাত পড়েছে কৃষিজমিতেও। তার পরিমাণ ও কমেছে পাল্লা দিয়ে। কমে আসা জমিতে চেষ্টা চলছে তিনগুণ — চারগুণ বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনের। ফলে স্বাভাবিক ঐকিক নিয়মের হিসেবেই লাগামহীন ভাবে পাম্প বসিয়ে তোলা হচ্ছে ভূগর্ভের জল। হু-হু করে নেমে যাচ্ছে মাটির নীচের জলস্তর।

ভারতে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি টন প্রতি বছরে। এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে হল প্রায় ২৩ কোটি টন। আর এখন এই সময়ে সেই উৎপাদনের পরিমাণ ৩১ কোটি টন। খাদ্য উৎপাদনের এই চোখ ধাঁধানো বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে সুসংহত নদী পরিকল্পনা (অবশ্যই অনেক ক্ষেত্রেই নদী পরিকল্পনা সময়ের সাপেক্ষে ফলপ্রসূ হয়নি মোটেও), বায়োটেকনোলজির প্রভূত উন্নতি, উন্নত মানের সার ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত নানাবিধ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের জন্য। কিন্তু তাতে কিলোগ্রাম পিছু উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর জন্য প্রয়োজনীয় জলের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। ফলে মাটির নীচে বা নদীতে প্রবাহিত জলের নিষ্পেষণ ক্রমাগত বেড়েই গেছে এবং ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। সুতরাং সহজ পাটিগণিতের হিসেবে কেবল মাত্র খাদ্যের জোগান বজায় রাখতে গেলে গুণিতক মাত্রায় নামতে থাকবে ভূগর্ভের জলস্তর। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যেই সারা বিশ্বে তা গড়ে নেমে যাবে প্রায় দুই থেকে তিন মিটার। ফলে জলের অভাবেই আজকের আবাদি জমিতে আর ফসল ফলানো বোধহয় সম্ভব হবে না অনেক ক্ষেত্রেই। কারণ অনেক কিছুই মানুষ পারলেও স্বাদু জলের স্বাভাবিক জোগানের জন্য সে সম্পূর্ণ ভাবেই একমাত্র বৃষ্টি হয়ে নেমে আসা বারিধারার ওপরই নির্ভরশীল। গুহাবাসী মানুষ যেদিন কৃষিকাজ শিখেছিল, সেদিনও সে নির্ভরশীল ছিল ঐ একমাত্র মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ওপর। বুদ্ধিমান মানুষ আরও বুদ্ধিমান হয়েছে। পৌঁছেছে সভ্যতার চরম শিখরে, কিন্তু প্রকৃতির ওপর, তার থেকে পাওয়া সম্পদের ওপর সে আজও একই ভাবে নির্ভরশীল। সম্পদ উন্নততর প্রক্রিয়ায় আরোহণ করা গেলেও মনে রাখতে হবে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ, তার স্বাভাবিক নিরবচ্ছিন্ন নিয়মেই সীমিত। আমরা মনুষ্যকুল তাতে ভাগ বসাই মাত্র। সম্পদ যদি সহজলভ্য হয় সেটিকে আমরা আর সম্পদ বলে মানতে চাই না। যে কারণে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনকে, জঙ্গলের গাছকে, ফসল ফলানো মাটিকে, নদীর জলকে আমরা এই কদিন আগে পর্যন্তও সম্পদের মর্যাদা দিইনি। ব্যবহার শুধু নয়, অপচয় করেছি নিজেদের খেয়াল খুশি মতো।

জল ব্যবহারে পরিমাণের দিক দিয়ে ও চাহিদা অনুযায়ী কৃষির পরেই রয়েছে শিল্পক্ষেত্র। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা বলছে ভারতে শিল্পক্ষেত্রে জলের ব্যবহার শতকরা ১৫ ভাগ। ২০৩০ সালে শিল্পক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ব্যবহৃত জলের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। শিল্পোন্নত দেশ গুলিতে স্বাভাবিক ভাবেই শিল্পে ব্যবহৃত জলের পরিমাণ কৃষিকাজে ব্যবহৃত জলের পরিমাণের থেকে বেশি। জনসংখ্যার নিরিখে শিল্পে উন্নত দেশগুলির অবস্থান, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলির থেকে ভালো হওয়ায় সেখানে মাথাপিছু জলের জোগানও বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রতি বছরে যেখানে প্রায় ২৭৫০ ঘনমিটার জল ব্যবহৃত হয়, আমাদের ভারতে জনপ্রতি জলের ব্যবহার বছরে ১৬০০ ঘনমিটার। 

একটা শিল্পজাত বস্তু, সে ইটভাটার ইট বা কারাখানায় তৈরি হওয়া অত্যাধুনিক মোটরগাড়ি যাই হোক না কেন — প্রতিটি জিনিস উৎপাদনে ব্যয়িত হওয়া জলের পরিমাণ কত, তার হিসেবটা কিন্তু বেশ চমকে দেবার মতো। দু-একটি উদাহরণ দিলে খানিক আন্দাজ পাওয়া যাবে। এক টন ইট তৈরিতে জল খরচ হয় ১.৫ টন, এক টন সিমেন্ট তৈরি করতে প্রয়োজন পড়ে ৫ টন জলের। কাগজ, ইস্পাত, নাইট্রোজেন সার টন প্রতি প্রয়োজন যথাক্রমে ২৫০, ৪৫০, ৬০০ টন জল। একটি মোটর গাড়ি তৈরি হয়ে যখন কারখানা থেকে বের হয় — তখন তার উৎপাদনে ইতিমধ্যেই ব্যবহার হয়ে যায় ৮০,০০০ টন জল। 

এক গ্যালন পেট্রোলিয়ামকে শোধন করে বাজারজাত করতে লাগে ৪৪০ গ্যালন জল। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি টন কয়লা হিসেবে জল ব্যবহৃত হয় ৬০০ টন। পারমাণবিক চুল্লিতে জলের চাহিদা আরও কয়েক গুণ বেশি। কাজেই আমরা অত্যাধুনিক মনুষ্যকুল সভ্যতার ভারে যত বেশি শক্তিশালী হব, শক্তির চাহিদা ততই বাড়বে, আর তার গুণিতকের মাত্রায় বাড়বে জলের ব্যবহার। কিন্তু সেই বিপুল জল আসবে কোথা থেকে? পৃথিবীতে থাকা প্রাকৃতিক স্বাদু জলের সামগ্রিক পরিমাণকে একটি ফোঁটাও বাড়ানোর ক্ষমতা কিন্তু আধুনিক মানুষের নেই। তাই স্বভাবিক নিয়মেই সে জলের জন্য মাটির নীচে পাম্পের জল তোলার নলকূপকে গভীর থেকে গভীরতর করছে, নদীর অববাহিকায় একের পর এক বাঁধ উঠিয়ে আটকে দিচ্ছে নদীপ্রবাহের স্বাভাবিক ছন্দ। হু-হু করে নেমে যাচ্ছে মাটির নীচের জলস্তর, বিপদসীমা ছাড়াচ্ছে তার গুণমান। নদী হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক ভূমিক্ষয় ও পলি অবক্ষেপনের যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসা নিয়মিত সাম্যতা। এক সর্বগ্রাসী, ঋণাত্মক হিসেবহীনতা মাত্রাহীন চাপ সৃষ্টি করছে নীলগ্রহের তরল স্বাদু জলের ওপর। 

অতএব ঘটনা হল জনংখ্যা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের জীবন যাত্রার গুণগত মান। ফলে, প্রতিদিন বাড়ছে মাথাপিছু জলের চাহিদা। পানকার্যে যে জল আমরা ব্যবহার করি সেই পরিমাণটুকু বাদ দিলে, অন্যান্য কাজে কি জলের সঠিক ব্যবহার আমরা করছি? প্রকৃতপক্ষে জলের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণে আমাদের যতটা জল প্রয়োজন বহুক্ষেত্রে তার বেশি জল আমরা ব্যবহার করছি। অন্যদিকে সাময়িক লাভের আশায় আমরা এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করছি যা জলের সঠিক ব্যবহারের পরিপন্থী। আর এই অবহেলায় ঘটছে ব্যাপক জল দূষণ।

জনবিস্ফোরণ ও জলদূষণ – কৃষি নির্ভর ভারত

এবার দেখা যাক দূষণের মাত্রা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের জীবন ধারণের দৈনন্দিন ক্ষেত্রগুলিতে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূষণের হার কিন্তু সময় ও স্থান ভেদে পরিবর্তিত হয় ভিন্ন ভিন্ন হারে। কৃষিক্ষেত্রের কথাই প্রথমে ধরা যাক। কৃষির প্রধান সহায়ক হল বৃষ্টির জল। কিন্তু ভারতের মতো সুবিশাল দেশে বৃষ্টি সর্বত্র সমান ভাবে হয় না। আবার সারা বছরে যা বৃষ্টি পড়ে তার প্রায় আশি শতাংশ বৃষ্টি পড়ে জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাসেই। ফলে শুধু আমাদের দেশ নয় পৃথিবীর প্রায় সবকটি কৃষিপ্রধান দেশ আংশিক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে সেচ নির্ভর। এই সেচের জলের উৎস নদীবাঁধের জলাধার। কিন্তু সেই ধরে রাখা জলের প্রাথমিক উৎসমুখ বৃষ্টির জলই। বিগত কুড়ি বছরের হিসেব বলছে ভারতে বার্ষিক গড় বৃষ্টির পরিমাণ ১৩ সেন্টিমিটার। সেটিও সর্বত্র যে সমান, তা তো নয়ই। কিন্তু মেঘ থেকে নেমে আসা এই বৃষ্টির জলের মাত্র ১০ শতাংশ আমরা, বাঁধের জলাধারে আটকে রেখে সেচের কাজে ব্যবহার করতে সক্ষম। বৃষ্টির বাকি ৯০ ভাগ স্বাদু জল নদী নালার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফিরে যায় সাগরে, আবার পরিবর্তিত হয় লবণাক্ত জলে। বোঝাই যাচ্ছে সেই জল আর মানুষের কোনো কাজে আসে না। অন্যদিকে প্রায় প্রত্যেক বছরই বর্ষার এই অতিরিক্ত জল, বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী উপত্যকায় থাকা জনবসতিগুলিতে বন্যা ঘটিয়ে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতির কারণ হয়। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মতো প্রাচীন সভ্যতার বিকাশকাল বা তারও আগে থেকে দেখা যাচ্ছে নদীর জলপ্রবাহকে বাঁধ দিয়ে আটকে জলাধার তৈরির উদ্দেশ্যই হল বর্ষার অতিরিক্ত জলকে জলাধারে ধরে রেখে, শুখা মরশুমে ও খরা প্রবণ এলাকায় সেই জলকে সেচের কাজে ব্যবহার করা। সুতরাং সোজা কথায় বললে ধরে রাখা জল যদি সুষ্ঠু ভাবে ব্যবহার না করতে পারি সেটাই জলের এক প্রাথমিক অপচয়। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থাটা একবার দেখা যাক।

ভারতে মোট কৃষিজমির শতকরা প্রায় ৩০ শতাংশ সেচের জলে পুষ্ট। বাকি সব কৃষিজমি চাষের জন্য নির্ভর করে থাকে জমিতে সরাসরি নেমে আসা বৃষ্টির জলের ওপর। এই কারণে প্রাকৃতিক নিয়মে সময় মতো আশানুরূপ স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে বেশির ভাগ জমি থেকেই হিসেব অনুযায়ী শস্য উৎপাদন পাওয়া যায় না। আর এখন বিগত পঞ্চাশ বছরে বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলস্বরূপ আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বৃষ্টিপাতের আগাম হিসেবে গরমিল হচ্ছে বিস্তর। এমনকি স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও অপেক্ষাকৃত খরা প্রবণ এলাকায় প্রয়োজনীয় জলের অভাবে অধিক উৎপাদনশীল ধান গমের চাষও সেই ভাবে সফলতার মুখ দেখছে না। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পঞ্চাশের দশকের পর থেকে গড় বৃষ্টিপাত বেড়েছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে মৌসুমি বায়ুজনিত বৃষ্টিপাত প্রায় ছয় শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, যা সারা ভারতের খাদ্যশস্যের এক প্রধান উৎসমুখ। মৌসুমি বায়ুজনিত বৃষ্টি কমে আসায় পঞ্চাশের দশক থেকেই খরার সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টির ঘটনাও বেড়েছে। বিশেষ করে আশির দশক থেকে। অল্প জায়গায় অতিরিক্ত বৃষ্টি বন্যার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। ভবিষ্যতে বন্যার তীব্রতা বাড়ার সম্ভাবনা এবং তা বাড়বে গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্রর মতো বড়ো নদীগুলির উপত্যকায়। এক দিকে খরা, অন্য দিকে বন্যার মতো পরিস্থিতি জলচক্রের সাম্যতাকে দারুণ ভাবে বিঘ্নিত করবে যার ফল অবশ্যই জলের স্বাভাবিক গুণমানকে নষ্ট করবে। 

গত দুই দশকে হিমালয়ের হিমবাহগুলি যতখানি ক্ষয় হয়েছে, তার আগের একশো বছরে অতটা হয়নি। বিশেষ করে বাকি দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় হিন্দুকুশ, হিমালয়ের উষ্ণতা বাড়ার সম্ভাবনা বেশি, ফলে হিমবাহগুলি গলবে বেশি। অনুমান এই উষ্ণায়ন কমানোর জন্য এখনই ব্যবস্থা না নিলে, একুশ শতকের মাঝে হিমালয়ের হিমবাহের দুই-তৃতীয়াংশ গলে যাবে। বাড়বে নদীর প্রবাহ। বরফ হয়ে জমে থাকা স্বাদু জলের আধার দ্রুততার সঙ্গে মিশে যাবে সাগরের নোনা জলে। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে নদীর জলে জীবন ধারণ করা প্রাণী ও উদ্ভিদকুল।

বিশ্বে যত ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করা হয় তার এক-চতুর্থাংশ হয় আমাদের ভারতে। তার উপর নির্ভর করেই ভারতে সবুজ বিপ্লব হয়েছে। এই পরিবর্তন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অতটা নয় যতটা দেশের নীতির জন্য। ভূগর্ভের জল ব্যবহারের নীতির জন্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে বছরে দুই সেন্টিমিটারেরও বেশি হারে ভূগর্ভের জলস্তর নেমেছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে ভারতের আধাশুষ্ক অঞ্চলগুলিতে ভূগর্ভের জলের ঘাটতি বেশ কিছুটা কমেছে এটা ঠিক, কিন্তু জলবায়ুর এই খামখেয়ালি আচরণ চালু থাকলে, ভবিষ্যতে যে একই ভাবে চলবে তা অবশ্যই বলা যায় না। ভারতে ভূগর্ভস্থ জল কমে আসার প্রধান কারণ হল শ্রমনীতি। বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছেন জলের জন্য উৎপাদনে ঘাটতি সব চাইতে বেশি হবে বিশ্বের যে পাঁচটি নদী উপত্যকায়, তার তিনটি ভারতে— সিন্ধু, সবরমতী ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র।

আমাদের দেশে বিগত কুড়ি বছর আগেও শিল্পক্ষেত্রে জলের ব্যবহারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বিধি ছিল না। এখনো কৃষির মতো প্রায় অবাধেই ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার হয়। আইন অনুযায়ী উৎপাদন শিল্পে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব জলের সংস্থান ও জলাধার থাকতে হবে। মুখ্যত নদী বা ভূপৃষ্ঠের জলের অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হবে জল। ভূগর্ভের জলে ভাগ বসানো যাবে না। কিন্তু সেই ‘environment impact analysis’ খাতায় কলমে থাকলেও সে আর কজনই বা ঠিকঠাক মানছে? আক্ষেপের কারণ এই, যে সুবিশাল জল রাশি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার হয় তা একবার ব্যবহারের পরেই অতিদূষিত হয়ে পরিত্যক্ত হয়। আরও দুর্ভাগ্যবশত সেই বিষজল অধিকাংশ সময়েই মিশে যায় নদীতে। নদীর জলে জীবন ধারণ করা প্রাণীরা সম্মুখীন হয় সমূহ বিপদের। কমতে থাকে তাদের সংখ্যা, সময়ের তালে তাল মেলাতে না পেরে কেউ বা হয়ে যায় চিরতরে বিলুপ্ত।

একমাত্র পানীয় জলের অপচয় আমরা ঘটাতে পারি না, সেটা প্রধানত প্রাকৃতিক কারণেই। কিন্তু গৃহস্থালির কাজে জলের অপচয় মোটেই কম নয়। অপচয় ঘটে প্রধানত পরিকল্পনাহীন জল সরবরাহ ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থায়। কাপড় কাচা, বাসন ধোওয়ার জল, ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ধোওয়ার জল, মলমূত্রবাহী জল ও বৃষ্টির জল একই সঙ্গে মিশে অন্তিমে সেই চলে যায় নদীতে। এই সুতীব্র দূষিত জলে নদী আরও একপ্রস্থ দূষিত হয়। গত শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত আমাদের দেশে নদী তীরবর্তী প্রধান শহরের আপাত পরিকল্পনাহীন নিকাশি ব্যবস্থার শেষ আধারটি ছিল নদীই। আমাদের এই কলকাতাতেই এখনো বহু অঞ্চলেই নিকাশি নালা আর পানীয় জলের পাইপ পাশাপাশি রয়েছে মাটির তলায়। সেই মাটির পাইপে ফাটলও ধরে। পানীয় জল আর নিকাশি নোংরা জল মিলেমিশে যায়। জলে দুর্গন্ধ জানান দেয় ভয়ংকর দূষণের। এর ফল সরাসরি গিয়ে পড়ে জনস্বাস্থ্যে। দৃশ্যতই একদম সে কারণেই শহরাঞ্চলগুলিতে পেটের ব্যামোর রমরমা।

অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে যে বিশাল পরিমাণ জল ব্যবহৃত হয় তা থেকে সরাসরি জলদূষণ ঘটে না ঠিকই, কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরের জনবিস্ফোরণ খাদ্যের চাহিদা বাড়িয়েছে প্রায় তিনগুণ। আবাদি জমির পরিমাণও কমেছে বিশ্বজুড়ে। ফলে কম জমিতে বেশি উৎপাদন পেতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। সেই সার আর কীটনাশকের বিষ রাসায়নিক জমিতে দেওয়া সেচের জলের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে ধীরলয়ে মিশে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে। সেই দূষিত ভূগর্ভস্থ জল আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রবিশেষে গিয়ে পড়ে আশেপাশে থাকা নদীতে। নদীর দূষণ বয়ে যায় সাগরে। সামগ্রিক ভাবে দূষণের একটা স্থায়ী চক্র তৈরি হয়। বা সঠিক হবে বলা যে সেই দূষণ চক্র ভয়াবহ ভাবে বিষ মেশাচ্ছে নীল গ্রহের জলরাশিতে। ক্যাডমিয়াম, সিসা, পারদ, দস্তা, আর্সেনিক, ফ্লুওরাইট এর মতো ভারি ধাতব মৌলের আয়ন যদি একবার পাকাপাকি ভাবে জলে দ্রবীভূত হয়, তাকে আলাদা করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। না, জলকে বারংবার উচ্চ তাপে ফোটালেও এরা জল থেকে বিযুক্ত হয় না। ফলে সেই জল সরাসরি আঘাত হানে জনস্বাস্থ্যে, এবং আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এর দূষণ ভারতের মতো অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এক সুবিশাল জনসংখ্যাকে সরাসরি আক্রান্ত করছে। বিগত কয়েক দশকে এই আক্রান্ত জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শহরাঞ্চলে এর সঙ্গে যুক্ত হয় জৈব আবর্জনা থেকে জন্ম নেওয়া নানান ধরনের ব্যাকটেরিয়া। ফলে সেই দূষণের মাত্রা বাড়ে বহুগুণ। এই সর্বগ্রাসী দূষণে সবথেকে বেশি প্রভাবিত হয় জলচর প্রাণী ও উদ্ভিদকুল। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক সমীক্ষায় সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা নির্ভুল হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছেন জলের ব্যবহার যত বাড়বে, অপচয়ও তত বাড়বে। আর জলের এই অপচয়ের সঙ্গে জলদূষণ সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলে। সোজা কথায় যেখানে জলের অপচয় বেশি, সেখানে জলের দূষণও একইরকম ভাবে বেশি। অপরিকল্পিত কলকারখানা, প্রাচীন শিল্পাঞ্চল, প্রাচীন প্রযুক্তিতে চলা মাঝারি শিল্প থেকে আজও যে জল ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত হয়, সেই অপচয় হওয়া জলের সিংহভাগ জলই দূষণের প্রধান উৎস। তাই শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে শুধুমাত্র মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্রণালীকে আরও, আরও মসৃণ ও সুখকর করার স্বার্থে গত আড়াইশো বছর আগে জলদূষণের যে যাত্রা শুরু হয়ে ছিল আজ তা বাস্তবিকই আয়ত্তের বাইরে। এই জলদূষণের মাত্রা ও হার যদি না কমানো যায় আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বহু শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে মানুষজনকে। পড়ে থাকবে জনহীন ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট। জল নেই, তাই মানুষ থাকার কোনো প্রশ্নও নেই।

জল এখনও বহু দেশেই বিনামূল্যে সহজ লভ্য। স্বভাবতই মূল্যহীন ভেবে নিয়ে এই অমূল্য সম্পদটির ব্যবহারও হয় সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে। অন্তত বছত বিশেক আগে পর্যন্ত তাই হয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের এই নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের ফল কখনো তাৎক্ষণিক, কখনো আবার সুদূরপ্রসারী। যে জায়গায় জলের ব্যবহারের পরিমাণ প্রাকৃতিক জোগানের থেকে বেশি, সেখানে নদী, নালা, পুকুর সবই ধীরে ধীরে জলশূন্য হয়ে পড়ে। বেশি ব্যবহার জলের চাহিদা বাড়ায় ফলে সেই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয়ও কমতে থাকে দ্রুততার সঙ্গে, স্থায়ী ভাবে নীচে নামতে থাকে মাটির নীচের জলস্তর। মাটির উপরিভভাগেও জলের স্থায়িত্ব কমে। উপরিস্তরের মাটি হতে থাকে ক্রমশই শুষ্ক। ফলে যে জলকে শিকড় দিয়ে টেনে জাইলেম ফ্লোয়েম দিয়ে প্রবাহিত করে গাছ গাছালি বেঁচে থাকত তাদের অস্তিত্বও খারিজ হতে থাকে। সরাসরি জোগান কমে প্রাণবায়ু অক্সিজেনের। সুজলা সুফলা সবুজ গ্রাম্যতা কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় এক রুক্ষ প্রাণহীন প্রান্তরে। এই পরিবর্তন সুদূরপ্রসারী। একটি মনুষ্যজীবন তা হয়তো দেখতে পায় না ঠিক, কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের একমাত্র কারণ জলের বেহিসাবি ব্যবহার, মাত্রাছাড়া অপচয়।

বিগত পঞ্চাশ বছরের জনবিস্ফোরণের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বহুগুণ বেড়েছে খাদ্যের চাহিদা। সেই কারণেই বেলাগামভাবে কুপিত হয়েছে বনভূমি। জঙ্গল কেটে বাড়ানো হয়েছে কৃষিজমির পরিমাণ। মাটির উপর সবুজ আস্তরণ বা বৃক্ষরাজি মাটির উপরিভাগে বৃষ্টির আপতিত জলকে ধরে রাখে, যা কিনা স্থলভাগ থেকে জলের বাষ্পায়নকে সীমিত করে, বজায় থাকে মাটির ভিজে ভাব। ফলত, নির্বিচারে বনচ্ছেদনের ফল হল এই যে স্থলভাগে বৃষ্টির বারিধারা হয়ে যে পরিমাণ জল আসছে তা অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি বাষ্প হয়ে উবে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। জল যতদিন ভূপৃষ্ঠে বা ভূস্তরের নীচে থাকবে ততদিনই তা আমাদের ব্যবহার যোগ্য। মাটির জল বাস্প হয়ে গেলে তা আর সরাসরি মানুষের কোনো কজে আসে না। সুতরাং এর ফলে জল ব্যবহার করার আগেই তা হারিয়ে যাচ্ছে, যা একরকম জলের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার অন্য দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিভাগের জলীয় বাষ্পের বেশ কিছু স্থলভাগে আকর্ষণ করে আনে উদ্ভিদ, ও বৃষ্টিপাত ঘটায়। সুতরাং উদ্ভিদহীন ভূপৃষ্ঠে বৃষ্টিপাতও কমতে থাকে। সোজা কথায় বনাঞ্চল হ্রাসই হচ্ছে পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার এক প্রধান কারণ। পৃথিবীতে শুখা, বৃক্ষহীন জমির পরিমাণ বিগত শতাব্দীতে বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল এই পঞ্চাশ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি একর জমি শুখা জমিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বনাঞ্চল কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। এই শতাব্দীতে জলের সীমিত ব্যবহার ও অপচয় সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সচেতনতা যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেও, এখনও সাধারণ জনমানসে জলের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞতা সীমাহীন। জলকষ্টের প্রভাব সবথেকে বেশি প্রভাবিত করে শহরাঞ্চলের জনপদকে। আমাদের দেশেই বহু শহরে এখনও প্রতি গ্রীষ্মে জলের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। কলকাতার মতো শহরে আজও বৃষ্টির জল ধরে রাখার মতো বড়ো কোনো জলাধার নেই, জলের চাহিদা শহরের বিস্তারের সঙ্গে দ্রুত হারে বেড়েই চলেছে। হুগলি নদীর জল শহরের বেশ উল্লেখযোগ্য অংশে সরবরাহ হলেও তা সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া খরচসাপেক্ষ ও বাস্তবে সম্ভব নয়। অথচ এই কলকাতা শহরে প্রতিদিন যে জলের অপচয় হয় তার পরিমাণ প্রায় ৩.৫ লক্ষ লিটার।

পদক্ষেপ

এতক্ষণের আলোচনায় এটা পরিস্কার যে জল নামক এই প্রাকৃতিক সম্পদটি অফুরন্ত নয়, মূল্যহীনও নয়। এটা যদি আমরা এখনও বুঝতে না পারি তাহলে সমূহ বিপদ। উপরন্তু এর পরিমাণ ভীষণ ভাবে সীমিত। যদিও প্রকৃতির নিজস্ব প্রক্রিয়ায় এটি নবীকরণ যোগ্য সম্পদ, কিন্তু আমাদের হঠকারিতায় এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও বাধাপ্রাপ্ত হয়। দিনে দিনে কমে আসছে ব্যবহার্য জলের পরিমাণ। সুতরাং ভবিষ্যতের এক ভয়াবহ জল সংকট বা জল দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। সেদিন বোধহয় আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন, এখনকার পেট্রোল পাম্পের মতো, জলের জন্য জলাধার হাতে লাইনে দাঁড়াতে হবে জল কেনার জন্য।

তবুও সময় শেষ হয়ে যায়নি, এখনও আমাদের হাতে কিছু উপায় অবশিষ্ট আছে যার প্রয়োগ জলের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ফারাকটা কমিয়ে আনতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন জলের অপচয় ও দূষণকে ন্যূনতম মাত্রায় কমিয়ে আনা। এতে আসন্ন জলসংকটকে আরও কিছুকাল ঠেকিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু এই পরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করা মোটেই সহজ নয়। তার কারণ এই কাজে প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা ও প্রচুর অর্থ। আমাদের মতো দেশে যে দুটির অভাব এখনও যথেষ্টই। তবুও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের অস্তিত্বের কথা বিচার করে এই সমস্যাটিকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। 

কৃষিকাজে জলের অপচয় রোধে প্রয়োজন সুষ্ঠু ও পরিকল্পনা মাফিক সেচ ব্যবস্থা। উপযুক্ত স্থানে জলাধার তৈরি করা। বন্যাপ্রবণ নদীতে চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক জলাধার নির্মাণ। এতে বন্যা যেমন রোধ হবে, বৃষ্টির জলের সঠিক ব্যবহারে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে, ফলে খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে। 

নদীতে জলাধার নির্মাণের পাশাপাশি এখন নদী সংযুক্তিকরণের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। খরাপ্রবণ এলাকার নদীগুলির সঙ্গে বন্যাপ্রবণ নদীর জল খাল কেটে যোগ করা। এতে আশা করা হচ্ছে এর ফলে অন্তত বর্ষার মরশুমে খরা এলাকায় সেচের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দরকার জলাধারগুলির তলদেশ থেকে ও নদীগুলির নিম্ন অববাহিকা থেকে সঞ্চিত পলির অপসারণ। 

এটা ঠিক যে গত শতক থেকে বর্ষার জল ধরে রেখে শুখা মরশুমে সেচ করে প্রচুর সুফল পাওয়া গেছে। সেচসেবিত জমির পরিমাণ ১৯৫০ সাল নাগাদ ছিল ২.২ কোটি হেক্টর, ২০০০ সালে ৯.৫ কোটি হেক্টরের বেশি। খাদ্যশস্যের উৎপাদন এই পর্বে পাঁচ কোটি টন থেকে শুরু করে কুড়ি কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশ আজ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর। কিন্তু আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই— কারণ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে জনসংখ্যাও। ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের দেশের জনসংখ্যা যখন দাঁড়াবে আনুমানিক ১৬০ থেকে ১৮০ কোটি, তখন খাদ্যশস্যের চাহিদা দাঁড়াবে আনুমানিক ৪৫ কোটি টন। এই পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে গেলে ১৬ কোটি হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় আনতে হবে। এর মধ্যে ১৪ কোটি হেক্টর জমিতে সেচ পৌঁছে দেওয়া যায় এক একটি নদীর সেচ সম্ভাবনার পূর্ণ রূপায়ণ করতে পারলে। বাকি প্রয়োজন মেটাতে এর বেশি কিছু দরকার। এক মরশুমে জল ধরে অন্য মরশুমে ব্যবহার করা যথেষ্ট নয়— চাই এক স্থানের জল অন্যত্র নিয়ে যাওয়া। যে নদীর অববাহিকায় বন্যা বেশি হয়, সেখান থেকে উদ্বৃত্ত জল নিয়ে যেতে হবে খরাপ্রবণ নদী অববাহিকায়। গোটা দেশে এই কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে দরকার বিশেষ বিশেষ নদীকে খাল দিয়ে যুক্ত করার একটি জাতীয় প্রকল্প। নদীর সঙ্গে নদীকে জুড়ে দেওয়ার কল্পনা নতুন নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্যার আর্থার কটনের উদ্যোগে দক্ষিণ ভারতের নদীগুলিকে যুক্ত করা শুরু হয়েছিল নৌপরিবহনের উদ্দেশ্য। ক্রমে রেলপথের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নদী অববাহিকাগুলিতে জলের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়, শুখা মরশুমে নাব্যতা দ্রুত কমে আসে, ফলত সেই উদ্যোগ তখনকার মতো থমকে যায়।

বর্তমানে নদী সংযুক্তির যে রূপরেখা তৈরি হয়েছে তাতে হিমালয় থেকে জাত নদীগুলিকে ১৪টি খাল ও দাক্ষিণাত্যের নদীগুলিকে ১৬টি খাল দিয়ে যোগ করার কথা। সুফল হিসেবে সরকারের তরফে বলা হয়েছে সাড়ে তিন কোটি হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসে খাদ্য সুরক্ষা দেবে, ৩৪ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, খরা ও বন্যার প্রকোপ কমবে, পানীয় ও অন্যান্য জলের চাহিদা মিটবে ও দেশের মধ্যে নৌ-বাণিজ্যের উন্নতি হবে। প্রকল্প রূপায়ণে ব্যয় হবে ৫.৬ লক্ষ কোটি টাকা — এটি ২০০২-০৩ সালের হিসাবে। এর আগে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর থেকে সমস্ত নদী প্রকল্পে যত ব্যয় হয়েছে, এই পরিমাণ তার দশ গুণ।

আগেই বলা হয়েছে নদী বাঁধের জলাধারগুলি থেকে বিভিন্ন ছোটো বড়ো ক্যানেলের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে পৌঁছাতে জলের বেশ একটা বড়ো অংশ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। প্রখর গ্রীষ্মে জলাধারগুলি থেকেও জল বাষ্পীভূত হয়। এই বাষ্পীভবন কমিয়ে আনার জন্য এখনও তেমন কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের দেশে কিছু রাজ্যে, জলাধার থেকে কৃষিক্ষেত্রে জল খাল কেটে না এনে সরাসরি প্লাস্টিক পাইপের সাহায্যে আনা হচ্ছে। এতে অবশ্যই জলের বাষ্পীভূত হয়ে অপচয়ের হার কমবে। কিন্তু দূরবর্তী কৃষিজমিতে এই পদ্ধতি অবশ্যই খরচের নিরিখে যুক্তিসঙ্গত নয়, অন্তত ভারতের মতো সুবিশাল কৃষিবহুল দেশে। বাঁধের জলাধারগুলি থেকে বেশ খানিকটা জল আবার চুঁইয়ে মাটির নীচে চলে যায়। যা জলাধারে আশেপাশের এক বড়ো অঞ্চলের মাটিতে জলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সারা বছর সেই জমি এতটাই ভিজে থাকে তা চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। খুব সম্প্রতি আমাদের দেশে বেশ কিছু অগভীর জলাধারগুলিকে জল-নিরোধক করতে ব্যবহৃত হচ্ছে সোডিয়াম কার্বনেট, পলিথাইলিন ও পলিপ্রোপাইলিনের স্তর। গভীর জলাশয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে ভিনাইওলের আস্তরণ। জলবাহী ক্যনাল-এর ক্ষেত্রে, জল চুঁইয়ে মাটিতে প্রবেশ করা বন্ধ করতে ক্যানেলগুলির মেঝে ও পাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিলে, তাও খুব কার্যকরী হয়।

বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখিয়েছেন নিরক্ষীয় অঞ্চলে এক একর জমির গাছপালা রাতের বেলা এক লক্ষ লিটার জল বাষ্পমোচন প্রক্রিয়ায় ত্যাগ করে। এই বাষ্পমোচনের পরিমাণ যদি কমিয়ে আনা যায়, তাহলে গাছেরও জলের প্রয়োজন স্বাভাবিকের থেকে অনেক কমে যাবে। পৃথিবীর কিছু উন্নত দেশে এই কাজে বেশ কয়েকটি রাসায়নিকের ব্যবহার পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছে, যেমন এলকালিন সাকসিনিক এসিড অথবা এবসিসিক এসিড। এগুলি গাছের পত্ররন্ধ্রগুলির বন্ধ ও খোলা নিয়ন্ত্রণ করে। কৃষিজমির ওপর বায়ুপ্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রণ করেও বাষ্পমোচন কমাবার প্রক্রিয়া কমানোর পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা উন্নত দেশগুলিতে চালু হয়েছে।

শিল্পক্ষেত্রে জলের অপচয় ও দূষণ রোধের একমাত্র কার্যকারী ব্যবস্থা হল ব্যবহৃত জলকে শোধন করে তাকেই আবার ব্যবহার করা। এখন প্রতিটি শিল্পের, তা ছোটো,  মাঝারি বা বড়ো যাই হোক না কেন সেই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জল সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা আবশ্যিক এবং ঐ জলকেই পরিশুদ্ধ করে বারংবার ব্যবহার করতে হবে, কোনো অবস্থাতেই শিল্প প্রতিষ্ঠান জলকে দূষিত অবস্থায় বাইরে পরিত্যাগ করতে পারবে না। কিন্তু এখনও আমাদের দেশে এই নিয়ম অনেকটাই খাতায় কলমেই সীমিত। এই নিয়ম কঠোর ভাবে বলবৎ হলেই শিল্পজাত জলের অপচয় ও দূষণ কমবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন — আমাদের দেশে এখনও পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ। 

উপসংহার

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে এক শিল্পে উৎপন্ন দূষিত পদার্থ বা আবর্জনা অন্যশিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষত Sludge gas এখন ভারতে বহু জয়ায়গাতেই প্রস্তুত হচ্ছে ও গৃহস্থালির জ্বালানি হিসেবে সরবরাহ করা হচ্ছে। শহরাঞ্চলের জৈব আবর্জনা থেকেও Bio gas তৈরি হচ্ছে। এর ব্যবহার ক্রমিক হারে বাড়লে জল দূষণের মাত্রা যে অনেকাংশে কমবে তা বলাই যায়। সেই সঙ্গে ঐ পরিশুদ্ধ জলকে আবার শিল্প ও কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়। 

এটা সর্বৈব সঠিক যে, অপচয় ও দূষণের মাত্রাকে ন্যূনতম মানে কমিয়ে আনলেও জলের বিপুল ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই বিকল্প জলের উৎস সন্ধানের কাজ চলছে বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর বুকে যে জলের পরিমাণ অফুরন্ত তা হল সমুদ্রের নোনা জল যা সাধারণ ভাবে আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য। সেই সঙ্গে আছে মেরু অঞ্চলের বরফে জমাট বাঁধা জল যা এখনও সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে আর্থিক খরচ ও অন্যান্য অসুবিধা তুলনায় কম। প্রয়োজন শুধু তাপের। কিন্তু সামগ্রিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের কথা মাথায় রেখে, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই বরফ গলিয়ে জল করার বিপক্ষে। এমনিতেই বিশ্ব-উষ্ণানের ফলে মেরু প্রদেশের বরফ গলনের হার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বেড়েছে বিগত পঞ্চাশ বছরে, যা সামগ্রিক ভাবে পৃথিবীর জলবায়ু — আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাকে ব্যাপক ভাবে বাড়িয়েছে। তাই মেরুর বরফ গলিয়ে স্বাদু জলের জোগানের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা আপতত গ্রহণযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে কী হবে তা অবশ্যই তখনকার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।

সুতরাং জলের নতুন উৎস খুঁজতে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশকে হাত বাড়াতে হচ্ছে সেই সমুদ্রের বিশাল জলরাশির দিকে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে খরাপ্রবণ ও মরু অঞ্চলের সমুদ্রের জলকে লবণ মুক্ত করে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে বেশ কিছু কাল ধরে। কিন্তু ব্যবস্থাটি এখনও খরচ সাপেক্ষ। এছাড়া জল থেকে বিয়োজিত অবশিষ্ট লবণকে কোথায় ফেলা হবে — তা এক বড়ো সমস্যা। ভারতেও কিছু সরকারি গবেষণা সংস্থা, সমুদ্রজলের এই লবণ বিযুক্তকরণের কাজটি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের এখনকার পরিস্থিতিতে তার বাস্তবায়ন অর্থনৈতিক কারণেই অসম্ভব, এই মুহুর্তে তা হয়তো প্রয়োজনীয়ও নয়। জলের ব্যবহারকে সীমিত ও অপচয় রুখতে বহু দেশে এবং আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে জলের মিটার বসানো হয়েছে। সেই কাজকে অবশ্যই শহরাঞ্চলে ও শিল্পক্ষেত্রগুলিতে সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে যেটার সব থেকে বেশি প্রয়োজন তা হল জল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ধারণা ও মানসিকতার আমূল পরিবর্তন। সেটি করতে হবে দ্রুত, অন্যথা আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই প্রায় নাগালের বাইরে চলে যাওয়া পরিস্থিতির পুরোটাই চলে যাবে আয়ত্তের বাইরে।

সহায়কগ্রন্থসূচি, গবেষণাপত্রআন্তর্জালিকযোগসূত্র :

দাশগুপ্ত, অমল (1997) ‘জল : ব্যবহার, দূষণ ও সংরক্ষণ’, SCAN, Vol – 15, 18 – 32.

মিত্র, শচীনাথ (1984) ‘জল ও সমুদ্র’, শ্রীভূমি পাব্লিশিং কোং, কলিকাতা।

রায়, সঙ্কর্ষণ (1982) ‘ভূবিজ্ঞানীর চোখে বিশ্বপ্রকৃতি’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ

সেনগুপ্ত, দেবাশিস ; গোস্বামী, পরমেশ; রুদ্র, কল্যাণ (2013) ‘জল’, এভেনেল প্রেস, কলকাতা। 

Allan, T. (2011). ‘Virtual water : Tackling the threat to our planet’s most precious resource’. Taurus, London, UK: I.B.

Famiglietti, J. S. and Rodell, M., (2013). ‘Water in the Balance’. ENV. SCIENCE, 340:1300–1301.

Fao (2017). FAOSTAT. ‘Rome : Food and Agriculture Organization of the United Nations’. Retrieve on 15th Nov 2018 from http://www.fao.org/faostat/en/#data.

Hoekstra, A. Y. (2013). ‘The water footprint of modern consumer society’. London, UK: Routledg

Mukherjee, I. and Singh, U. K., (2020). ‘Delineation of groundwater potential zones in a drought-prone semi-arid region of east India using GIS and analytical hierarchical process techniques’. Catena, 194:104681.

World Health Organization (2017). ‘Guidelines for drinking-water quality’, 4th edition, corporating the 1st addendum.

https://www.unep.org/annualreport/2021/index.php

http://www.cwc.gov.in/

http://cgwb.gov.in/

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান