মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
“তাদের অবিশ্বাসী চোখ তাকিয়ে আছে বাঁধের দিকে। কী দানবীয় আকার, আমাদের ঘর, আমাদের জমির উপর থাবা গেড়ে আছে। তারা পশ্চিমে তাকিয়ে দেখল বিশাল জলরাশি। আমোদিত পর্যটকেরা রংবেরঙের নৌকায় চেপে আহ্লাদে উঠছে নামছে। এই জলেই সমাধি হয়েছে আমাদের জীবন্ত প্রাণপ্রিয় সবুজ জন্মভূমির। কোথায় সেই গাছগুলো, সীমানা প্রাচীরের পাশে অশ্বত্থ গাছে যারা কিচিরমিচির করত, কাদামাটির ইস্কুলঘর যা শিশুদের কলহাস্যে কেঁপে উঠত, সেই গোরু ছাগল, সেই লালমুখো বাঁদর………”
১৯৯২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া উপন্যাস ‘ঝাড়াঝাড়াতি’, প্রখ্যাত মারাঠি লেখক বিশ্বাস পাটিলের কলমে তুলে ধরেছিল বড়ো বাঁধের নির্মাণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি গোটা জনপদ ও তার মানুষের মর্মান্তিক কাহিনি।
অনুরূপ গল্প আছে আমাদের ঘরের কাছেই। শান্তিনিকেতন তারাপীঠ বক্রেশ্বরের সাথে যে পর্যটন স্থলটি জুড়ে আছে। ম্যাসেঞ্জোর, মশানজোড় সেখানেও দুই পাহাড় জোড়া বাঁধ। কত লোক আসে। “কত কত টাকা ওড়ে, ফুর্তি ওড়ে — মশানজোড়ের আশেপাশের গ্রামের লোকেরা সে সব শুধু চোখেই দেখে, একটু তফাতে থেকে।” কুমার রাণা তার ‘জলছবি’ গল্পে দেখিয়েছেন কীভাবে নদীর ধারের গ্রামে বসবাসকারী সচ্ছল মানুষ যাদের জমি ছিল, গবাদি পশু ছিল, খাওয়া পড়ার অভাব ছিল না, বড়ো বাঁধের কারণে তাদের জমি, ঘর, জল সব চলে গেল। অনেক ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি নিয়ে আজ সর্বহারা বর্তমান গুয়হাজোড়ি গ্রামের বৃদ্ধ বলছেন, আমাদের গ্রামের আসল নাম বাহাটোলা। “নদীর স্রোত আটকাল আর আমাদের চোখের জলের স্রোত বইতে লাগল অঝোরে। সেই চোখের জলেই আমরা বেঁচে আছি।” যেন জলের মাছ হাঁড়িতে জিয়ানো আছে।
‘ঝাড়াঝাড়াতি’ উপন্যাসে নবনির্মিত বাঁধের উদ্ঘাটনে বাস্তুচ্যুত আদিবাসী পরিবারের একটি মেয়েকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় উদ্ঘাটককে বরণের। মেয়েটির টলমলে অশ্রুর মাঝে ফুটে ওঠে তাদের গোটা জাতির জীবন, সংগ্রাম ও সব হারানোর ইতিহাস।
২০১৫ সালে প্রকাশিত হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখরের বিতর্কিত বই ‘The Adivasi will not dance’-এর শীর্ষক কাহিনিতে নদীবাঁধের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে মঙ্গল মুর্মু ও তার সঙ্গীরা বলেন আদিবাসী নাচবে না।
অরণ্য ও আদিবাসী মিলে মিশে এই ভূখণ্ডের পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখেছে এটাই প্রধান সত্য। কিন্তু স্পষ্টতই পুঁজিবাদ এবং তার পরিকল্পিত বিকাশের মডেল এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সারা দুনিয়া জুড়ে এই চেহারাটি আজ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। একদা বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে উঠেছিল, এখন রাজদণ্ডই বণিকের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত। একের পর এক নতুন ফিকিরে সেই কাজটাই হচ্ছে।
বিষয়টি প্রাচীন। মহাভারতের কালেও বন ধ্বংসের নমুনা আছে। খাণ্ডব বন খেয়েছিলেন অগ্নি, মারা পড়েছিল বহু পশু পাখি দুর্লভ প্রজাতির নাগ। দাঁড়িয়ে থেকে সেই কাজ সুসম্পন্ন করিয়েছিলেন মহাবীর অর্জুন। এর পরেই তৈরি হয়েছিল ময়দানবের প্রাসাদ। তবু ঐতিহাসিক প্রাক্-ঔপনিবেশিক কালে বিষয়টা এমন সর্বগ্রাসী ছিল না। সম্রাট অশোক তার শিলালিপিতে বৃক্ষ রোপণের কথা বলেছেন। চতুরাশ্রমের একটি পর্যায় ছিল বাণপ্রস্থ, সেখানে বন হত মানুষের প্রৌঢ়ত্বের আশ্রয়। তারও পরে বিভিন্ন রাজশক্তির সময়ে বন কাটা হলেও তা ছিল বিকেন্দ্রিত।
ব্রিটিশ শাসনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কালে সম্পূর্ণ বন হয়ে যায় জমিদারের সম্পত্তি। ১৮৭৮ সালে প্রথম অরণ্য আইনে সমগ্র বনভূমিতে রাষ্ট্রীয় দখল কায়েম হয়। জঙ্গলের একমাত্র উপযোগিতা ছিল দেশের সম্পদ ব্যবহার করে শাসকের আর্থিক শোষণে সাহায্য করা। রেললাইন, ঘরবাড়ি, আসবাব সব কিছুতেই কাঠের দরকার। লড়াইও চলতে থাকে। স্বাধীন ভারতেও প্রথম দিকে অরণ্য ছিল শুধুই সম্পদ। ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিমে মানচিত্রের কোমর বরাবর যে অঞ্চল তাতে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। ঘটনাচক্রে রাজ্যগঠনের প্রক্রিয়ায় এরা এক একটি রাজ্যের এক এক প্রান্তে ছড়িয়ে যান। ইতিমধ্যে ভারতের উত্তরভাগে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে মহিলারা ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কোম্পানির গাছ কাটা রুখতে গাছকে জড়িয়ে ধরে চিপকো আন্দোলন করেছেন। উঠে এসেছে চণ্ডীপ্রসাদ ভাট, সুন্দরলাল বহুগুণার মতো নাম।
প্রশ্ন উঠেছে বিকাশের ধারণা নিয়ে। গোটা দুনিয়ায়। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, যার জন্য বহু মানুষ নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হয়েছেন, তা শেষ পর্যন্ত পরিবেশের জন্য সংহারক হয়ে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী দুনিয়া জুড়েই তথাকথিত ‘সম্পদে’-র সঙ্গে নিবিড় অবস্থানে বাস করে। পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে তারাই যেন এর সংরক্ষক। কিন্তু পুঁজিপতির মুনাফায় তারাই প্রধান বাধা। তাই ছলে বলে কৌশলে তাদের উৎখাত করা চলে আসছে। ভারতের জনসংখ্যার আট শতাংশ আদিবাসী কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ। জল জঙ্গল জমির অধিকার হারিয়ে এরা সর্বত্র কায়িক শ্রমের দ্বারা কোনোভাবে টিকে থাকেন। এদের নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিপন্ন তখন।
পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে মানুষের বলা ভালো মানুষ বাধ্য হয়েছে ভাবতে। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ সংক্রান্ত কনফারেন্সে পৃথিবীর সুরক্ষায় ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এর পর কেটে গেল পাঁচ দশক। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ অভিঘাতের সামনে। প্রকৃতি নিকেশ করে উৎপাদন বাড়ানোর পুঁজিবাদী আগ্রাসন এখন প্রশ্নের মুখে। বনের মাটি, গাছ, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেয়। বাতাসে এই গ্যাসের আধিক্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে এনেছে।
অতএব আবার অরণ্য সংরক্ষণ। প্রথম দিকে এটাই ভাবা হত যে আদিবাসীরা অরণ্য ধ্বংস করছে, ফলে তাদের সরকার নির্দিষ্ট জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। আর এক দিকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের অজুহাতেও জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা ছিল। অদ্ভুতভাবে অরণ্য পর্যটনে কিন্তু কোনো বাধা ছিল না। ক্রমে বোঝা গেল রাষ্ট্রের হাতে বনপ্রকৃতি ততটা নিরাপদ নয়, যতটা আদিবাসীদের হাতে। রাষ্ট্রের কাছে অরণ্য মুনাফার বস্তু, আদিবাসী তার বেঁচে থাকার জন্যই বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করে। অরণ্যের সাথে তার সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যেমন শাল গাছ। সে গাছে দাঁতন হয়, পাতা দিয়ে বাসন হয়, বাহা পরবে তার ফুল লাগে। ‘জলছবি’ গল্পে বৃদ্ধ বলছেন, তাদের পবিত্র জাহের থান নেই। শালগাছ ছাড়া জাহের থান হয়? জাহের ছাড়া কি গ্রাম বসে? সরকারি বনসৃজনে লাগিয়েছে আকাশমণি। ইউক্যালিপটাসের মত গাছ লাগানো হয়েছে কাগজ শিল্পের জন্য যার তলায় একটা ঘাসও হয় না।
বনসৃজনের ভাবনায় বোঝা গেল গাছ বাঁচাতে মানুষের সাহায্য দরকার অর্থাৎ বনসংলগ্ন গ্রামবাসীদের বনসংরক্ষণ ও সৃজনের অংশিদার করতে হবে। যৌথ অরণ্য পরিচালন ব্যবস্থা (Joint Forest Management) শুরু হল, যেখানে বনজ সম্পদের উপর তাদের অধিকার দেওয়া হল এবং তাদের নজরদারিরও ক্ষমতা দেওয়া হল। কিন্তু এটা ধোপে টিকল না কারণ গ্রামবাসীরা তাদের প্রাপ্য অংশ পেলেন না।
২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংসদে পাশ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন যেখানে ঐতিহাসিক অন্যায়কে শুধরে নেওয়ার প্রয়াস দেখা গেল। একভাবে অরণ্যের অধিকার ফিরে পেলেন সেখানকার বাসিন্দারা। এই আইনে জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃত হয়, বসবাসের,গবাদি পশু চরানোর, বনজ সম্পদ ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং গোষ্ঠীগত স্বত্ব তৈরি হয়। যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আরণ্যক গ্রামবাসীর গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। এর ফলেই কুখ্যাত অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানি শেষ পর্যন্ত ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় দখলের অভিসন্ধি থেকে পিছোতে বাধ্য হয়। দেবাশিস আইচ তাঁর লেখায় উল্লেখ করছেন কুনাকাডু গ্রামসভার কুটিয়া কন্ধ টুঙগুরু মাঝি বলছেন, “ঝরনা, পানি, পবন, পাতা সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। তোমরা এখনই চলে না গেলে আমরা বিরসা মুন্ডা, রিন্ডো মাঝির মতো মরব।” প্রকৃতির সন্তান যে কথা বলছেন কর্পোরেটের সঙ্গে, সে ভাষা আমরা শুনেছি আমেরিকায় আদি বাসিন্দা চিফ সিয়াটেলের বিখ্যাত ভাষ্যে।
কিন্তু রাষ্ট্রের আক্রমণের পন্থা অনেক। ২০০৫-০৬ সালে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি আদিবাসী ছত্তিশগড় ছেড়ে যেতে বাধ্য হন সরকারি সেনা সালওয়া জুড়ুম ও নকশালবাদীদের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বের কারণে। সেখানকার মর্মান্তিক ঘটনাগুলি এখনও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। কোনো সরকার এদের নিপীড়ন থেকে রেহাই দেয়নি।
নগর সভ্যতার কাছাকাছি যারা বাস করছেন তাদের বিপদ আরেকরকম। ইদানীং ইকোট্যুরিজমের ধুম হয়েছে। সেখানে প্রকৃতির সবটুকুই পণ্য। সংরক্ষিত অরণ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী দেখানোর পাশাপাশি চলছে আদিবাসী সংস্কৃতি দর্শন। আবারও সেই নাচের গল্প। এর কুৎসিততম উদাহরণ শান্তিনিকেতনের খোয়াই হাট। একদা স্থানীয় শিল্পীদের সৃষ্টিকে উৎসাহ দিতে পরিবেশ অনুকূল ছোট্ট একটি হাট বসত সপ্তাহের একটি দিনে। যে যার নিজের হাতে তৈরি সামগ্রী আনতেন। দিনের আলো ফুরাতে ফুরাতে হাট শেষ হয়ে যেত। এখন সারা সপ্তাহ জুড়ে হাট। স্থানীয় শিল্পীদের স্থান সংকুচিত। কোম্পানির উৎপাদন কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে চলে আসছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অঢেল জিনিস নিয়ে বসছে তারা। জঙ্গলের মাঝেই তৈরি হয়েছে স্থায়ী রিসর্ট যেখানে নানান বিনোদন ব্যবস্থা। এই হাটে গোল হয়ে নাচ দেখান আদিবাসী মেয়েরা। মাঝে থালায় টাকা পড়ে। আর বারমুডা পরা পর্যটক তাদের বৃত্তে বুকে পা মেলায়, বাকিরা এথনিক ছবি তোলেন। সন্ধ্যার পর চারিদিকে ছিটিয়ে থাকে সারাদিনের উচ্ছিষ্ট, মদের বোতল ও অন্যান্য। সংলগ্ন গ্রামের এক প্রৌঢ় বললেন, আমাদের ছোটোরা আর স্কুল যেতে চায় না, তারা পর্যটকদের পায়ে পায়ে ঘুরে ফাইফরমাশ খেটে টাকা রোজগারের চেষ্টায় লেগে থাকে। একটু পিছনে গেলেই জানা যাবে কীভাবে এখানকার আদিবাসী জমির হাত বদল হয়েছে সব জামানাতেই।
দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজের এ ব্যাপারে আর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। পর্যটনের প্যাকেজ, উন্নয়নের প্রকল্পে ইংরেজি মিডিয়াম পুষ্ট চাকরির টোপ এবং এথনিক মোড়কে বিজ্ঞাপিত সংস্কৃতি তাকে আদিবাসী, প্রকৃতি, পরিবেশ সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বছর বছর পরিবেশের জন্য তার দায়বদ্ধতা সীমাবদ্ধ প্রতীকী বৃক্ষরোপণে। উন্নয়নের নামে লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলা তার কাছে উদ্বেগের নয়। ফোর লেন রাস্তা, শপিং মল, পাহাড়ি গ্রামে হলিডে রিসর্ট এই সমস্তই তার চাহিদার তালিকায় জাঁকিয়ে বসেছে। আদিবাসী সংস্কৃতিও শেষ পর্যন্ত বাজারকে পুষ্ট করবে। তার সুরে চটুল কথা বসিয়ে গান হবে। সংস্কৃতির বিশেষ কিছু বিষয়কে সামনে আনা হবে, যেমন মদ্যপান ইত্যাদি।
এই পরিস্থিতির মধ্যে মোক্ষম কোপটি পড়ল অতি সম্প্রতি। মাননীয়া দ্রৌপদী মুরমু রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেই এ কাজটি করে নেওয়া হল। ২৮ জুন ২০২২ জারি হল নতুন অরণ্য সংরক্ষণ বিধি, যেখানে গ্রামসভার অধিকারকে খর্ব করে বলা হল এদের অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি সংস্থা বন কাটতে পারবে কেন্দ্রের অনুমতি পেলে। সুপ্রাচীন অরণ্য ও তার জৈববৈচিত্র্য ধ্বংস করার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দিতে হবে কিছু টাকা। আগামীর লক্ষ বছরের ক্ষতির হিসেব অবশ্য কেউ নেবে না। এর পরে পরেই সংসদে কেন্দ্রীয় বন, পরিবেশ ও জলবায়ু দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে জানিয়েছেন, বিগত তিন বছরে ৫৫৪.৩ বর্গ কিমি বনভূমি খনি-রাস্তা-সেচ প্রকল্পে বদলে ফেলা হয়েছে। ২০১৩ সালে অধ্যাপক ভার্জিনিয়াস য়াক্সার নেতৃত্বে গঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি জানিয়েছিল স্বাধীনতার পর বাঁধ, খনি, অভয়ারণ্য, শিল্পের কারণে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন তাদের ৭৫ শতাংশ পুনর্বাসিত হয়নি। তারা দেখেছেন মূলত আদিবাসীরাই এই উন্নয়নের ধাক্কায় উৎখাত হচ্ছেন এবং এদের রক্ষা করার আইনগুলি কৌশলে এড়ানো হয়েছে।
পরিশেষে ২০২১ সালে প্রকাশিত অমিতাভ ঘোষের The Nutmeg’s Curse বইটির উল্লেখ করা যায়। ভারত মহাসাগরের ছোট্ট একটি দ্বীপে বসবাসকারী আদি বাসিন্দারা মনে করতেন তারা এবং সেখানকার বিখ্যাত জায়ফল এবং অন্য সবকিছুই প্রকৃতির অংশ। জায়ফলের লোভে ১৬২১ সালে ওলন্দাজ ঔপনিবেশিকেরা এক বীভৎস আক্রমণে এখানকার কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করে। এই বাসিন্দাদের বলা হয় তাদের চিরকালের বাসস্থান দ্বীপখানি, তার ঘন সবুজ জঙ্গল এবং উজ্জ্বল নীল সমুদ্রের ধারে তাদের যে বসতি তা ধ্বংস করতে তারা যেন ঔপনিবেশিক ওলন্দাজদের “সহযোগিতা” করে। অবিশ্বাস্য এই দাবি। কিন্তু তার বহুকাল বাদে আজকেও এমন দাবি নিয়েই তো রাষ্ট্র উৎখাত করে প্রকৃতির সন্তানদের। কেবল মাত্র জায়ফল নয়, আজকের পৃথিবীর ‘উন্নত’ মানুষকে প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হয় শুধু খাদ্যের জন্য এমনটা নয়, তার সভ্যতা চলে মাটির গভীরে সৃষ্ট জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর। আর আগ্রাসন, দেশে দেশে যুদ্ধ এই দখলদারি নিয়েই।
অমিতাভ স্পষ্ট বলছেন পুঁজিবাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত যুদ্ধ অর্থনীতি। সামরিক বলে বলীয়ান হতে গেলে পোড়াতে হবে জীবাশ্ব জ্বালানি এবং বাড়বে কার্বন নিঃসরণ, যার অবশ্যম্ভাবী ফল বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। প্রকৃতি ও তার সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত যে মানব গোষ্ঠী তার উপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে আক্রমণ। চলছে লড়াই।
কিন্তু আগামীর পৃথিবীকে বাঁচতে হলে ফিরতেই হবে মাটির কাছে, শিখতে হবে তার সাথে মিলে মিশে থাকার উপায়। আর এই পাঠ দিতে পারতেন তারাই যারা সেই আদিকাল থেকে যুক্ত থাকতে পেরেছেন মূল সত্যের সঙ্গে যেখানে সম্পদ ও শোষণের মতো শব্দাবলির স্থান নেই।
ঋণ :
‘গল্পসংগ্রহ’, কুমার রাণা, গাঙচিল, ২০১৩
‘নয়া অরণ্য সংরক্ষণ বিধি : আদিবাসীদের অধিকার হরণই মূল লক্ষ্য’, দেবাশিস আইচ
‘আদিবাসী জীবন ও জীবিকা বনাম ‘বন্যপ্রকৃতি’’, মানবেশ সরকার
অনুষ্টুপ আদিবাসী ভারত বিশেষ সংখ্যা, ২০২২
‘The Nutmeg’s Curse’, Amitav Ghosh, ২০২১
‘Down to Earth’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা