অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রকস্টর্ম এবং তাঁর সহকর্মীরা ২০০৯ সালে বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে যে দাবি করলেন তা কিন্তু যথেষ্ট চিন্তার। তাঁরা ন’টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির কথা বললেন এবং দেখালেন যে তিনটি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় আছে এবং সেগুলি অনুমোদিত স্তরকে ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছে। এই ন’টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি হল — বায়ুমণ্ডলের এরোসল, রাসায়নিক দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের অ্যাসিডিফিকেশন, ওজোন স্তরের ক্ষয়, রাসায়নিক চক্রে ফসফরাস এবং নাইট্রোজেনের বর্তমান অবস্থা, মিষ্ট জলের ব্যবহার, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়। এগুলির মধ্যে দেখা গেল যে, ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস চক্র বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে গিয়ে পড়েছে এবং তা যথেষ্ট পরিমাণ দুশ্চিন্তার কারণ। তাই একথা বলা চলে যে, এই সমস্যাগুলি থেকে পরিবেশকে সামগ্রিকভাবে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমরা হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকটা দেরি করে ফেলেছি।
পৃথিবী সৃষ্টির পরে প্রাণের উদ্ভব এবং প্রজাতির বিকাশ-বিবর্তনের ধারায় ক্রমশ প্রকাশিত ও প্রসারিত হয়েছে। সে দীর্ঘ ইতিহাসের ধারায় বহু প্রজাতি যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমন অনেকে হারিয়েও গেছে। আজ যারা আছে, তারা যে শুরুর সময় থেকেই ছিল এমনটা নয়। আবার যারা ছিল তারা যে সবাই আজ আছে— এমনটাও নয়। এই গতিশীল ধারা রক্ষা সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের সূত্র মেনে। ডারউইন সাহেব তার ব্যাখ্যাও আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন। বলা যেতে পারে, মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ — বরং অনেক সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসও এগিয়েছে একটি নির্দিষ্ট ধারা মেনে। মানুষের বিকাশে যেমন কৃষি-সভ্যতা এবং শিল্প সভ্যতা — সাম্প্রতিকতম সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বায়িত সভ্যতার প্রভাবও যথেষ্ট। মানুষের উদ্ভব গোটা জীবগোষ্ঠীকে এবং তাদের অস্তিত্বকে একটা অন্যতর সংকটেরও মুখোমুখি করেছে। বাস্তুতন্ত্র — যার উপাদান এবং কার্যকরী প্রভাবের ফলে এতদিন ধরে এত অণুজীব, উদ্ভিদ ও প্রাণীর পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত পৃথিবীর চলমানতা স্বাভাবিক ছিল, অবশ্যই তা বিঘ্নিত হয়েছে মানুষের যন্ত্রনির্ভর জীবনযাত্রার ফলস্বরূপ। প্রকৃতির ওপর অতি-আগ্রাসনে। এ কথা ঠিক যে, স্বাভাবিক প্রকৃতির যে নিয়ম ছিল সেখানেও ছিল বিপর্যয় ও ধ্বংসের অনিবার্যতা। কিন্তু আজকের পৃথিবীর যে সংকট তার মূলে মানুষের কর্মপদ্ধতি, লোভ এবং অবিমৃশ্যকারিতা মূলত দায়ী।
আমরা বিগত বেশ কিছু বছর ধরে কিছু বিপদের কথা শুনে আসছি, যেমন ওজোন স্তরের ক্ষয়, অম্ল বৃষ্টি, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস, বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, শক্তির উৎসের পরিমাণ কমে আসা, মৃত্তিকার গুণমান নষ্ট হওয়া, নানা প্রকারের জলদূষণ এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন। আজও যদি কোনও ব্যক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সন্দিহান হন, তাঁর জন্য তিনটি তথ্যই যথেষ্ট: এক, গত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট হারে বৃদ্ধি হয়েছে; দুই, প্রত্যেক বছর আমরা বাতাসে গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছি যা কিনা বিশ্বউষ্ণায়নের জন্য দায়ী এবং তিন, এটা প্রমাণিত সত্য যে সমুদ্রপৃষ্ঠে জলতলের বৃদ্ধি ক্রমশ হয়েই চলেছে।
এবার একটু ভারতবর্ষের দিকে দেখা যাক। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০০৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সবথেকে উষ্ণ ১৫টি বছরগুলির মধ্যে ১২টিকে এই সময়ই পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে ২০২০ সাল অষ্টম উষ্ণতম। ২০১৬ সালকে সবথেকে উষ্ণ বছর হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ২০১১ থেকে ২০২০ সবথেকে উষ্ণ-দশক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। একটি সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা যায় যে, জলবায়ুর নিরিখে ভারতবর্ষের কোনো কোনো রাজ্য কত পরিমাণে বিপদসংকুল বা ভালনারেবেল। দেখা গিয়েছে যে, আটটি রাজ্য সবথেকে বিপজ্জনক, দশটি রাজ্য মাঝারিস্তরের বিপজ্জনক এবং এগারোটি রাজ্য কম বিপজ্জনক। যদিও যে ইনডেক্স নির্ভর করে এমন মূল্যায়ন করা হয়েছে তার মূল্যমানের বিস্তার খুবই কাছাকাছি — ০.৪২ থেকে ০.৬৭-এর মধ্যে।
একথা জানা আছে যে, সমুদ্রে জলতল বৃদ্ধি পেলে তীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয় এবং সেখানকার স্থানীয় মানুষজন পরিযায়ী হতে বাধ্য হন। কারণ তাঁদের জীবন ও জীবিকা এই পরিযানের সঙ্গে যুক্ত। ভারতবর্ষে শুধু নয়, তৃতীয়বিশ্বের একটা বড়ো অংশ জুড়ে বেশি জনসংখ্যার দেশগুলিতে সমুদ্র তীরবর্তী জায়গায় মানুষের অবস্থান অনেক বেশি। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় ৭৬ শতাংশ মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিযানে বাধ্য হন জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে এবং বাকি ২৪ শতাংশ মানুষ যুদ্ধ বা অন্যান্য কারণে পরিযান করেন। অতএব এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, জলবায়ু বিপর্যয় মানুষের বাসস্থান এবং তার অস্তিত্ব ও জীবন জীবিকাকে বাধ্য করছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে।
ভারতবর্ষের পরিবেশ এবং পরিবেশ আন্দোলনের নিরিখে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং তার সমাধান নিরূপণে মানুষের বুদ্ধি ও বিবেকের প্রয়োগের উদাহরণ নেহাত কম নয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা চিপকো, এপিকো, সাইলেন্ট-ভ্যালি বা বড়ো বাঁধের আন্দোলন দেখতে পাই। যদিও প্রকৃত অর্থে সারা দেশজুড়ে, সার্বিক ভাবে এক সামগ্রিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে এই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে — এমনটা হয়তো নির্দিষ্ট করে বলা ঠিক হবে না। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হল, প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে, সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতার এক অনন্য পর্যায় হিসাবে সংগঠিত হয়েছে।
বহুদিন ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জল, জঙ্গল এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা দেখা গেছে। এমন আন্দোলন আমরা লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বারবার খেয়াল করেছি। যদিও সাধারণভাবে বিশ্বের সামগ্রিক দৃষ্টি থেকে অনেক দূরে — তবু আজ বিভিন্ন মহাসাগরের মধ্যেকার ছোটো ছোটো দেশগুলির হাহাকার ও আর্তি মূল ভূখণ্ডের মানুষের কানে এসে পৌঁছাচ্ছে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম যারা শিকার হচ্ছেন তাঁরা অনেকক্ষেত্রেই এই ছোটো ছোটো দ্বীপগোষ্ঠীর মানুষজন। অথচ এই দেশগুলি কোনোভাবেই তাদের বর্তমান এই নিয়তির জন্য সরাসরি দায়ী নয়। এ প্রসঙ্গে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ বলে নেওয়া দরকার। তা হল, পৃথিবীর সবথেকে আর্থিকভাবে বলশালী দেশগুলি হয়তো বাস্তুতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে পড়া, আবার বাস্তুতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলি হয়তো আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা। অথচ অনেক আর্থিকভাবে অগ্রসর দেশকে আজ পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। যদিও তাদের গ্রিনহাউস গ্যাসের মাথাপিছু উদ্গিরণের পরিমাণ খুব বেশি। তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে খুবই সমস্যাসংকুল এবং তাদের ন্যূনতম উন্নয়নের প্রয়োজনে প্রচলিত শক্তির ব্যবহারও দরকার এবং মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার তাগিদে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে পুনঃসংজ্ঞায়িত করবার একটা প্রয়োজন আছে। প্রথম বিশ্বে যেহেতু আর্থিক সচ্ছলতা ও ভোগবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে— সেই জন্য পরিবেশের সমস্যাকে দেখার ভঙ্গি উভয় বিশ্বের কাছে এক না হওয়ারই কথা। তাই, একটা দ্বন্দ্ব থেকেই যাচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব চিরাচরিত এক দার্শনিক দ্বন্দ্ব। পরিবেশকে দেখার জন্য যে সাংস্কৃতিক মনন দরকার, তার আকার আকৃতি নিয়েও একটা পূর্ণাঙ্গ আলোচনার প্রয়োজন আছে। আর্থিক উন্নয়নের প্রশ্নে কাকে আমরা প্রকৃত মানবকেন্দ্রিক এবং ভবিষ্যৎমুখী উন্নয়ন বলব, তা আর-একবার ভাবা দরকার। প্রকৃতির যা উপাদান তাকে অনিঃশেষ ভেবে ফেলাটা অন্যায়। অসংখ্য মানুষের সমূহ লোভ তাকে যে নিশ্চিতভাবে আরও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রতিক বিশ্বে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে, বিশেষত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কিছু পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে — যার উদ্যোগ খুবই সদর্থক বলা যায়। যদিও সার্বিকভাবে তাকে সফল হিসাবে দাবি করাটা সমীচীন হবে না। আমরা জানি, ১৯৭২ সালে স্টকহোমে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে ভারতবর্ষের উজ্জ্বল উপস্থিতি পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সরকারি স্তরে বহু পরিবেশ উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করেছিল। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সংক্রান্ত তিনটি শব্দের কথা বলেছেন— দারিদ্র্য, জনসংখ্যা এবং দূষণ— যা পরবর্তীকালে একটি জনপ্রিয় পরিবেশ ধারণা হিসাবে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এই সম্মেলনের পরে আমাদের দেশে বহু পরিবেশবিধি চালু হয় যেমন বন্যপ্রাণ আইন ১৯৭২, জলদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৭৪, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮১, পরিবেশ রক্ষা আইন ১৯৮৬, জীববৈচিত্র্য আইন ২০০২, ইত্যাদি। ১৯৯২ সালে রিয়ো-ডি-জেনিরো-তে অনুষ্ঠিত বসুন্ধরা বৈঠকে ঐতিহাসিক ‘পরিবেশ সম্মেলন’ হয় — প্রায় সমগ্র পৃথিবীর নানা পর্যায়ে এবং নানা স্তরে মানুষ অংশগ্রহণ করেন এবং জলবায়ু থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়, সমস্যার প্রতিকার কীভাবে করা হবে তা নিয়েও সবাই মতামত দেন এবং ভবিষ্যতে পরিবেশের কী অভিমুখ হবে, সে বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করা হয়। যে তিনটি বিষয় উঠে আসে সেগুলি হল— ১) ফ্রেম ওয়ার্ক কনভেনশন ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ, ২) কনভেনশন ফর বায়ো-ডাইভারসিটি এবং ৩) এজেন্ডা টোয়েন্টি ওয়ান। অর্থাৎ এই প্রথম গোটা বিশ্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বকে সহনশীল উন্নয়নের মাধ্যমে এক অন্যতর অধ্যায়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার এক সাহসী পদক্ষেপ দেখাল। কারণ মানুষের সভ্যতা ততদিনে প্রত্যক্ষ করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিটি বিকট লক্ষণ ও তার ফলাফল। যে ফলাফলের হাত ধরে কৃষি থেকে স্বাস্থ্য, জল থেকে মাটি, অরণ্য থেকে সমুদ্র নানা পর্যায়ে সবকিছুই আরও চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
আমরা দেখেছি গোটা বিশ্বে বহু জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি সংকট ক্রমবর্ধমান। বৃষ্টিনির্ভর কৃষিতে পরিবেশের খামখেয়ালিপনা কৃষির উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। অতিবৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টি দুই-ই বিপজ্জনক। এর সঙ্গে রয়েছে মৃত্তিকার ফলন ক্ষমতা কমে যাওয়া। এমনকি বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি যা কিনা একটি গ্রিনহাউস গ্যাস, খাদ্যের পুষ্টির পরিমাণের হেরফের ঘটাতে সক্ষম। খাদ্যে কমে যায় প্রোটিন এবং অন্যান্য খনিজর পরিমাণ। এছাড়াও জলের পরিমাণ ও গুণগত মান পরিবর্তিত হতে থাকে। অনেক নতুন ধরনের অসুখ নানা রূপে ফিরে আসে। ভেক্টরবাহিত ও জলবাহিত অসুখ যে ক্রমবর্ধমান— তা প্রমাণিত সত্য । অরণ্য কমে গেলে কার্বনস্টোরেজের ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও শেষ পর্যন্ত নানা ভাবে মানুষের জীবন ও জীবিকার মান ক্রমাগত অবনমন এর দিকে চলতে থাকে।
পরিবেশের যেকোনও সমস্যা যেহেতু সীমানা নিরপেক্ষ, তাই সমস্যার সমাধানেও সব দেশের, সব জাতির, সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হতে পারে এক প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ। ১৯৮৮ সালে আইপিসিসি গঠন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জলবায়ু সংক্রান্ত ঘটে চলা ঘটনাবলি এবং পরিবর্তনের ধারা পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়ার্ল্ড মেটেরিওলজিকাল অর্গানাইজেশন এবং ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম এই আইপিসিসি গঠন করে। আজ পর্যন্ত অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট তারা পেশ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২-এর রিয়ো ডি জেনিরো সম্মেলনের পরে জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণাচর্চা এবং আলোচনার পরিসর আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৭-এর কিওটো প্রোটোকল তো অতি বিখ্যাত। ২০০৬-এর তৎকালীন মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি আল গোরের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘একটি অসুবিধাজনক সত্য’ তো উল্লেখযোগ্য একটি চলমান এবং ঘটমান আশঙ্কার আখ্যান। পরবর্তীতে জলবায়ু সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন সাড়া জাগিয়েছিল, যা প্রত্যেক বছরই এখন অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। যেমন কোপেনহেগেন ২০০৯ সালে, ২০১০ এ কানকুন, ২০১১ ডারবান, ২০১২ দোহা, ২০১৩ ওয়ার্সো, ২০১৪ লিমা, ২০১৫ প্যারিস, ২০১৬ মারাকাশ, ২০১৭ বন, ২০১৮ কাতোয়িস, ২০১৯ মাদ্রিদ, ২০২১ গ্লাসগো। এইসব আলোচনা চক্রে নানা দেশ ও গোষ্ঠী তাদের একক বা সম্মিলিত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বিশ্বব্যবস্থাকে তার সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এবং দ্বীপরাষ্ট্রগুলি — যারা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যে কারণ, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নগণ্য। উন্নত দেশগুলি যদিও সমস্যার সমাধানে আগ্রহী এবং আলোচনায় অংশগ্রহণকারী তবুও এ কথা এখনও বলার সময় আসেনি যে, তারা সব থেকে বেশি গ্রিনহাউস নির্গমনকারী হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট পরিমাণে দায়িত্ব সহকারে সামগ্রিক সমস্যার সমাধানে খুব বেশি নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ।
স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় উঠে আসে লো-কার্বন ইকনমি বা নো-কার্বন ইকনমির কথা। কিছু উন্নত দেশ এ ব্যাপারে অবশ্যই অঙ্গীকার করেছেন এবং অনেক বেশি বিকল্প এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখিয়েছেন। বহু দেশে দেখা যাচ্ছে বিকল্প শক্তি যেমন— সোলার, টাইডাল, উইন্ড, বায়োমাস, জিওথারমাল ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। আশা করা যায় এগুলি পরিবেশের গুণগতমান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। যদিও কয়লার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনও নিয়ন্ত্রণ আসেনি উল্লেখযোগ্যভাবে। ভারতবর্ষ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে শূন্যে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে ২০৭০ সালকে লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট দেশের যে নির্গমনের হার তা বর্তমানে উদ্বেগজনক। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, ৩৮ টি এমন দেশ আছে যারা মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ষাট শতাংশ নির্গমনের জন্য দায়ী। আমেরিকা দেশ হিসাবে সমগ্র গ্রিন হাউজের প্রায় ১৭ শতাংশ এবং শুধু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের ক্ষেত্রে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ। মাথাপিছু নির্গমনের ক্ষেত্রে আমেরিকা প্রায় ২০ টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে যেখানে ই.উ.-এর মাথাপিছু নির্গমন ৬ থেকে ১২ টন, চিন সেখানে মাথাপিছু ৪ টন এবং ভারতবর্ষ ১.১ টন। অর্থাৎ মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন নানাভাবে সংগঠিত হয়ে চলেছে। তার ফলে জল, মাটি, বায়ু এবং জীবমণ্ডলে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে, তুষারপাত বদলে যাচ্ছে, ঘূর্ণাবর্তের সংখ্যা এবং তার কারণে বিপর্যয় বেড়েই চলেছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে নানা অভিজ্ঞতা যেগুলি হচ্ছে, তার একটি অন্যতম হল — উত্তরোত্তর নতুন ভাবে তাপপ্রবাহ ও শীত প্রবাহের অভিজ্ঞতা। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা পৃথিবীর নানা জায়গায় দাবানল প্রত্যক্ষ করেছি, খরা তো ঘটেই চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা বরফ গলছে এবং তার ফলে নানা স্তরে জলতলের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এমনকি পশু-পাখির বিস্তার এবং অরণ্যের অস্তিত্ব আজ বিপর্যয়ের মুখে। পশু-পাখির জীবনচক্র ও পরিযান সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমরা দেখেছি। বিশেষত জলে থাকা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের নানাভাবে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অরণ্য নিধনের ফলে প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন ডাই অক্সাইড-এর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে এবং ব্যাপকভাবে বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যেতে পারে। শুধু তাই নয় অরণ্য হল জীববৈচিত্র্যের আধার। গোটা পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো থেকে দুশো কোটি মানুষ সরাসরি অরণ্যের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। অনেক জনজাতি সরাসরি অরণ্য নির্ভর। তাদের অস্তিত্ব অরণ্য নিধনের ফলে আজ প্রশ্নের মুখে।
এটা ঠিকই যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নানা সম্মেলন, আলোচনা চক্র, গবেষণা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত করে চলেছি। অনেক লেখালেখিও এই বিষয়ের উপর হয়েছে। তবুও শেষ পর্যন্ত একথা বলার সময় আসেনি, প্রকৃত অর্থে আমরা মূল সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমে পৌঁছতে পেরেছি। বরং, আমরা বলতে চেয়েছি হয়তো যে, জলবায়ুর পরিবর্তন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং এই সমস্যার সমাধান অন্য কেউ করে দেবে। কিন্তু তাই কী? সেভাবেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে? নাকি, আমাদেরকে এখনই ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক স্তরে সদর্থক কিছু করতে হবে?
একসাথে করতে হবে এবং তার ভিত্তি হবে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বুদ্ধির ও বিচারের সঠিক প্রয়োগ এবং লক্ষ্য হবে একটি সহনশীল ভবিষ্যৎ, যা কিনা মানুষের সার্বিক অংশগ্রহণে সম্ভব হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সঠিকভাবেই ২০১৫ সালে যে ১৭টি সহনশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে, তার মধ্যে ১৩ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হলো জলবায়ু সম্পর্কে কার্যক্রম। এটি পূরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে ২০৩০ সাল। মনে পড়ছে ২০০৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অঙ্গারি মাথাই-এর একটি কথা। তিনি গ্রিন বেল্ট আন্দোলন করে কেনিয়াতে সাড়া জাগিয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার সময় বলেছিলেন যে, পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে, পতিত জমিতে অরণ্য তৈরি সম্ভব — যদি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য হয়, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সম্ভব হয় এবং সাধারণ মানুষকে তথ্য ও অংশিদারির ভিত্তিতে পরিবেশের কাজে ভাগিদারি করা যায়। তাই, জলবায়ু বিপন্নতার সমাধান সম্ভব যদি সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সামগ্রিক অংশগ্রহণ, সহমর্মিতা এবং ভবিষ্যতমুখী চেতনার প্রকাশ নিশ্চিত করা যায়।