স্থবির দাশগুপ্ত
এক
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখিবা নিমিত্ত কোলাহল এমনই প্রবল যে, কথাগুলি বলিবার ফুরসতই মেলে না। স্মরণে আছে, বাল্যকালে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ‘পরিচ্ছন্নতা’ বাবদ কিঞ্চিত নম্বর থাকিত। যাহারা উত্তর লিখিতে তেমন পারঙ্গম ছিলাম না বলিয়া পাশ-ফেল-এর বাঙ্ময় সীমানায় ঝুলন্ত থাকিবার আশংকা থাকিত, তাহাদের নিকট আপাত-তুচ্ছ নম্বরটি অতিশয় লোভনীয় ছিল। উপরন্তু হেডমাস্টার মহাশয়ের সুক্তি – পোশাকআশাক ফুটাফাটা হইলেও চলিবে, কিন্তু অপরিচ্ছন্নতা অতীব দূষণীয়। এমত শুনিয়া পরিচ্ছন্নতার মহিমা সবিশেষ উপলব্ধ হইত।
উপলব্ধি ক্রমে প্রখরতর। বুঝিলাম, পরিবেশ পোশাকআশাক প্রায়। তবে এই উপলব্ধির অন্তস্থলে কখন যে আধুনিকতা বাসা বাঁধিয়াছে, টের পাই নাই। যখন পাইলাম তখন শুনিলাম, পরিচ্ছন্নতা যথেষ্ট নহে, ফুটাফাটাও চলিবে না; মানুষ হিসাবে আরও দীর্ঘকাল জগদানন্দযজ্ঞ উপভোগ করিতে হইলে, মলিনতা প্রবেশ করিতে পারে এমন যাবতীয় ছিদ্রপথ বুজাইয়া দিতে হইবে। এইসকল দৈববাণী শুনিয়া মনের মধ্যে কিছু ‘সতর্ক সংশয়’, কিছু ধন্দ জাগিয়াছিল, তবে তাহা জনসমক্ষে বলিবার সাহস ছিল না। এই নির্ঘাত, নিরতিশয় বার্ধক্যে উপনীত হইয়া মনে হয়, যাহা বলিবার তাহা বলিয়া ফেলাই মঙ্গল, জরুরিও।
যেমন ধরা যাউক, যাহাকে আমরা পরিবেশ বলিয়া শুনি, ইংরাজিতে যাহা খুশি বলা হউক, বাংলায় তাহাকে প্রতিবেশ বলাই কি যথাযথ ছিল না? তাহা না-হইলে মনে হয় যেন পরিবেশ এমন এক বস্তু যাহা আমাদের চতুষ্পার্শ্বে দণ্ডায়মান এক পৃথক সত্তা, আমাদের সঙ্গী, সখা, এমনকী, শত্রুও, আমাদেরই সঙ্গে নাচিতেছে, চলিতেছে, খেলিতেছে– ‘এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে’! অথচ যাহা নৃত্যরত, ক্রীড়ারত তাহা তো পরিবেশ নহে, বরং প্রতিবেশ। কারণ, জীবদেহের মধ্যেও এক-একটি অনন্য পরিবেশ বিদ্যমান। তাহাকে যদি দেহপ্রকৃতি বলা যায়, তাহা হইলে তাহাকে ঘিরিয়া যে রাজ্য তাহাকে বাহ্যপ্রকৃতি বলিতে হয়। এমন বলিলে বিষয়টি স্বচ্ছতর হয় বটে, তবে বলিবার দস্তুর নাই। বিস্ময় জাগে, কোন কুক্ষণে, কে বা কাহারা যে ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দটি আমাদের ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ প্রবেশ করাইয়া দিল!
ধন্দও জাগে, পরিবেশ প্রকৃতপক্ষে কী? অসংখ্য পরমাণু লইয়া তৈয়ারি হয় একটি অণু। হাজার হাজার অণুর সমষ্টিতে গঠিত হয় পলিমার। লক্ষ লক্ষ পলিমার লইয়া হয় কোষ– জীবদেহের ‘একক’। কোটি কোটি কোষের সমবায়ে তৈয়ারি হয় দেহের কলা, ইংরাজি ‘টিস্যু’। লক্ষ কোটি কোশের বিচিত্র সমবায় আমাদের এই দেহ। এই দেহের মধ্যেই রহিয়াছে আণুবীক্ষণিক জীবের জগৎ। তেমন জগৎ আমাদের দেহের বাহিরেও রহিয়াছে। তাহারই সঙ্গে আছে বৈচিত্র্যে ভরপুর উদ্ভিদজগৎ ও অন্যান্য প্রাণীজগৎ। পরিবেশ এই বিচিত্র, বিশাল জীবজগৎ এবং বিশালতর জড়জগৎ লইয়া নির্মিত। এই পরিবেশের প্রতিটি উপাদান পরস্পরের সহিত জটাজালববদ্ধ। তাই পরিবেশে অ-পর বলিয়া কিছু নাই।
বরং আছে এক অতিকায় জাল-বিন্যাস। ইহাই পরিবেশ। ক্ষণিক চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ভাবিলে বুঝা যায়, এই বিচিত্র বুননের একটি নিরতিশয়, ক্ষুদ্র প্রসাধন হইল মানবদেহ, তাহার চালচলন, মানবজগৎ। এই অবিচ্ছেদ্য জালিকাবন্ধনই যাবতীয় জীবকে জোগায় বাঁচিবার খোরাক, উহা ছাড়া জীবের মৃত্যু অনিবার্য। এইভাবে দেখিলে আমরা বুঝিতে পারি, প্রকৃতপক্ষে এই নির্মম নিগড় আপনিই একটি সুসম্বদ্ধ ব্যবস্থা, ইংরাজি ‘সিস্টেম’। আপনিই এক জীবন্ত সত্তা হিসাবে আলো, বাতাস, তাপ, শৈত্য– সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করিয়া তাহার সমস্ত সন্তান-সন্ততির রক্ষণাবেক্ষণ করাই এই মহাজালিকার কাজ। পরিবেশ তাই নিরেট, নিথর নহে, বরং এক মহত্তর সত্তা। মহত্তর, কিন্তু নিখুঁত নহে, নিখুঁত কিছুই হয় না।
অথবা বলা উচিত, এই সত্তার মধ্যে খুঁত খুঁজিতে খুঁজিতে পরিবেশ লইয়া আমাদের যা গতানুগতিক ধারণা জন্মিয়াছে তাহাই খুঁতে পরিপূর্ণ। মিথ্যা নহে, যে-মহাজালিকার কথা বলিতেছি তাহা অতি জটিল, এবং আমাদের আধুনিক উৎকর্ষস্পৃহায় এই জটিল জালিকার কোনও কোনও উপাদান পালটাইয়া দেওয়া সম্ভব। কখনও হয়তো বা তাহা দরকারিও বটে। কিন্তু তাহার পূর্বে প্রশ্ন, উৎকর্ষ কী, তাহার সংজ্ঞা নিরূপণ করিবে কে? আপনি বলিবেন, কেন, মানুষের প্রজ্ঞা! প্রতিপ্রশ্ন, প্রজ্ঞা কাহার আছে, কাহার থাকে? আমরা তো জানিয়াছি, দেখিতেছি, মানুষ দুই প্রকার, শাসক ও শাসিত। প্রজ্ঞা কি দুই তরফেই থাকে, নাকি কেবল এক তরফেই? ইহাও জ্ঞাত, প্রজ্ঞার চালিকাশক্তি হইল যুক্তি।
এই স্থলে অপর একটি ধন্দ উপস্থিত: কাহার যুক্তি, শাসকের নাকি শাসিতের? উভয়ের যুক্তির মিলন কি সম্ভব? নিঃস্বার্থ যুক্তি বলিয়া কিছু কি আছে? সুস্থ এবং সুষ্ঠুভাবে বাঁচিয়া থাকিবার স্বার্থে জীবনচর্যার বা জীবনের যাপন প্রক্রিয়ার কিছু পদ্ধতি অনুপযুক্ত বোধে মানুষ তাহা এড়াইয়া চলে, ইহা নূতন নহে। ইহা শাসকের ইচ্ছানিরপেক্ষ। আবার শাসক নিজেও তাহার কোনও স্বার্থ চরিতার্থ করিবার লক্ষ্যে কিছু উপাদান এড়াইতে বলে, বর্জন করিতে বলে বা অধিক পরিমাণে গ্রহণ করিতে বলে, কখনও জবরদস্তিও করে। এই দুই স্বার্থের চরিত্র অ-সমান। তাহা হইলে যুক্তি কাহাকে বলিব? শাসকের যুক্তি শাসিতকে উদ্বেল না-করিলে কী করা? দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব যে চিরন্তন।
জলবায়ুর দূষণ লইয়া আমরা যারপরনাই পীড়িত। সে-পীড়ায় দূষণ-বিরোধী বিজ্ঞাপনে মহাপ্রকৃতি ছয়লাপ। কিন্তু শাসিত তাহার অভিজ্ঞতায় দেখিয়াছে, দূষণের কলকাঠি শাসকেরই জিম্মায়, অন্যত্র নহে। অথচ সে দোষ চাপায় অন্যত্র, ব্যক্তিসাধারণের উপর। এক্ষণে উপায়? একটি উপায় হয়তো আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের অঞ্চলে নিহিত। কাণ্ডজ্ঞান আমাদের শিখাইতে পারে, প্রতিবেশের যে-উপাদান বর্জনীয় অথবা গ্রহনীয় বলিয়া বোধ হয় তাহার পিছনে জীবনবোধ্য যুক্তি থাকিতে হইবে, অবান্তর ভীতি, উদ্বেগ আর নির্বোধ নকলনবিশি না। অগণিত দোষত্রুটি সমেত মানুষ আপনিই এক ক্রিয়াশীল, উন্মেষশালী, জীবন্ত সত্তা। তাহার নিকট জীবন কেবল এড়াইয়া যাওয়া, ধ্বংস করা আর তিতিক্ষার পাঠশালা নহে, শাসক জবরদস্তি করিলেও নহে।
এ-পর্যন্ত কেবল সলিতা পাকানো হইল, তবে প্রদীপ জ্বলিবে বলিয়া মনে হয় না, কেননা এ নিবন্ধের শিরোনাম যতেক শ্রদ্ধা-গম্ভীর, তাহা লইয়া চর্চা করিবার মতন জ্ঞানশলাকা লেখকের অধিকারে নাই। বিষয়টি প্রায় অনধিগম্য, তদুপরি তাহার দ্বৈত সত্তা– জলবায়ু এবং বিশ্বস্বাস্থ্য। প্রথমটির অধিষ্ঠান দেহপ্রকৃতি ও বাহ্যপ্রকৃতি, উভয়তই। তবে দ্বিতীয় বস্তুটির অর্থ যে বাস্তবিক কী, তাহা বুঝিয়া ওঠা দুঃসাধ্য। তথাপি সভাস্থলে জ্ঞানীগুণীদের অবস্থান, উপরন্তু বৎসরান্তে পরিপাটি পরিবেশচর্চা ‘ইন থিং’ হইয়া উঠিয়াছে; তাই একটি উপশিরোনামের প্রয়োজন পড়িল। ইহাতে সম্পাদক বিলক্ষণ কুপিত হইবেন, পাঠকও উপকৃত হইবেন মনে হয় না। এতৎসত্ত্বেও সাহস করিতেছি, কেননা ইহাতে লেখকের কিঞ্চিৎ আত্মতৃপ্তির আশা আছে, আত্মরতিও।
দুই
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বে মানব স্বাস্থ্য যে প্রবল হুমকির মুখে পড়িয়াছে এই সত্য কথাটি প্রাচীন। যদিচ মানব স্বাস্থ্যমাত্র নহে, জীবসমুদয়ের মধ্যেই যে ত্রাসসঞ্চার ঘটিয়াছে ইহা অধিকতর সত্য। ইহারও অধিক সত্য এই, বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী সুবিধাভোগীদের তুলনায় অধিকতর বিড়ম্বনায়। কী কী কারণে আমাদের এই দুর্ভোগ তাহা লইয়া এ যাবত পর্বতপ্রমাণ সুপাঠ্য, দুষ্পাঠ্য, অপাঠ্য পুস্তক ও প্রবন্ধাদি রচিত হইয়াছে; ইহার পর একটি শব্দও অতিরিক্ত হইবেক। এই নিরতিশয় দুর্ভোগ হইতে পরিত্রাণ নিমিত্ত নানান পন্থার কথাও আলোচিত হয়। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ও বারংবার নিদান হাঁকে; তবে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের গুরুভার যে এই সংস্থাটি বহন করিতে পারে না তাহা সুপ্রমাণিত। তাই তাহার উপদেশাবলি লইয়া বাক্যব্যয় বাহুল্যমাত্র।
বরং অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করা ভালো। জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্ব সংসারের নিয়ম, আমরা তাহা চাই অথবা না-চাই। একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবে লক্ষ লক্ষ বৎসর যাবত বিশ্ব সংসারের জলবায়ু যে কতবার, কত প্রকারে পরিবর্তিত হইয়াছে তাহা অবর্ণনীয়। জীবন্ত সত্তার অন্তর্গত ধর্ম পরিবর্তন। এই নিয়মের ব্যতিক্রম নাই, ধর্মাচরণে তাহার ক্ষান্তি নাই, ক্লান্তিও নাই। সেই আচরণের সহিত অন্যান্য জীবসত্তা সম্মতি রক্ষার প্রয়াস করে। এই প্রসঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার কথা স্মরণ করা যায়। অনেকের মতে, এই সভ্যতার ধ্বংসের পিছনে মূল কারণ ছিল জলবায়ুর ক্রমান্বয়, তুমুল পরিবর্তন। ইহা হইতে উদ্ভূত বাস্তুতান্ত্রিক বিপন্নতার সহিত সম্মতি রক্ষা অসম্ভব ছিল, তাই জনমানুষ পূর্ব ও দক্ষিণের অজানা পথে পাড়ি দিতে বাধ্য হইয়াছে। বিশ্ব জুড়িয়া একই বিপন্নতা বারংবার সংঘটিত, ঘটমান। সংশয় এই যে, অমন মহানিষ্ক্রমণের পশ্চাতে মনুষ্যসৃষ্ট, অন্যান্য উপাদানগুলির প্রভাব সত্যই কতখানি ছিল?
বোধ করি, প্রতিবেশের নিজস্ব স্বভাবধর্মে আমাদের হাত থাকে না, কিন্তু উহার উপর আমাদের প্রভাব কিছু না-কিছু থাকেই। তাহা লইয়া কি আমরা বিচার করিতে পারি? প্রভাবের কথা প্রকৃতপক্ষে একটি আর্থনীতিক প্রস্তাব– আমরা কীরূপে অর্থনীতিকে বিন্যস্ত করিয়া লইব। এইস্থলে ঘুরিয়া-ফিরিয়া পুনরায় একই প্রশ্ন উঠিবে, সেই আর্থনীতিক প্রস্তাব কে, কাহার স্বার্থে, কখন, কেন আনিবে? বিশ্ব অর্থনীতি বলিতে আমরা বাজার বুঝি। সেই বাজারের অধিপতি কে? নিশ্চয়ত, অধিপতির ইচ্ছায়, তাহারই স্বার্থে বাজারের গড়ন, গঠন আর চরিত্রের নির্ধারণ। পুরাতনী কাহিনিমালায় কাজ নাই, বর্তমান বিশ্বে যে-বাজারব্যবস্থা চলিতেছে তাহা কি আদৌ জলবায়ু সংকটের কোনও সুরাহা করিতে পারে? সে নিজেই এই দুর্দশার উত্তেজক উপাদান হিসাবে সংকটের আবাহন করিয়াছে, বিসর্জনের ক্ষমতা তাহার অনায়ত্ত।
এই প্রেক্ষিতে বিশ্বস্বাস্থ্যকে কীভাবে দেখিব? বিশ্বমানবের স্বাস্থ্য? তাহা কি একটি আখাম্বা, বৈচিত্র্যহীন বংশদণ্ড, কদাপি দণ্ডায়মান, কদাপি পপাত ধরণীতলে? বরং সে এক সদা বৈচিত্র্যময় সত্তা, নিদারুণ, অত্যাকর্ষক, চঞ্চলতম প্রতীতি; অঞ্চল ও জাতির বৈশিষ্ট্য হিসাবে তাহার রূপভিন্নতা, উহাই তাহার মহিমা। তাহার কি নির্দিষ্ট মাপ থাকিতে পারে? মানদণ্ড? জবরদস্তি উহা নির্মাণ করিতে গেলে বিজ্ঞানের অহমিকা প্রমাণিত হয়, কিন্তু পরিহাসপ্রিয়, অভিমানিনী স্বাস্থ্যরানী মুচকি হাসে। পঞ্চাশৎ বৎসর পূর্বে আমেরিকার জনসংখ্যা ছিল বিশ কোটি মাত্র, এখন তাহা বাড়িয়া প্রায় তেত্রিশ কোটি। অনেকে ইহাকে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ কল্পে কম্পিত, অথচ সেথায় ক্ষুধা অপেক্ষা পৃথুলতাই সমস্যাসংকুল। এই পঞ্চাশৎ বৎসরে, সাধারণভাবে বলিতে গেলে বিশ্বময় আমাদের প্রজাতির ‘প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল’ কমে নাই, ক্রমশ বাড়িয়াছে। বিস্ময়, বাস্তুতন্ত্রের সংকটকালে ইহা ঘটিল কী করিয়া?
এমনকী, বিগত শতকের ষাটের দশকের তুলনায় সারা দুনিয়া জুড়িয়া খাদ্যোৎপাদন কমে নাই, বাড়িয়াছে। অসাম্যও সমতালে বর্ধমান। যাহারা সেই অসাম্যের শিকার তাহারা কি এক্ষণে খাদ্যে সমবণ্টনের কথা ভাবিবে, নাকি জলবায়ুর পরিবর্তন এড়াইয়া কোনও এক নিদর্শনহীন কল্পস্বর্গ, দৃষ্টান্তহীন “আদর্শ” প্রতিবেশ কল্পনা করিবে? যাহারা শ্রেষ্ঠীতন্ত্র অনুপ্রাণিততাহারা আমাদের যে-স্বপ্ন দেখায় তাহাই দেখিতে হইবে, সেই অনুযায়ী আইনকানুন চালু করিতে হইবে, ইহা কেমন আবদার? দেখিতে হইলে আমরা অন্য কোনও ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিতে পারি, সম্ভাব্য বাস্তব ঘটনাবলি যাহার পিছনে ধাবমান হয় তেমন স্বপ্ন। কেননা বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থাই যখন জলবায়ু সংকটের প্রধানতম, বাহ্যিক উপাদান তখন তাহাকে কায়েম রাখিলে সংকট তীব্রতর হইতে বাধ্য। পরিবেশ লইয়া অতিব্যাকুলদের অনেকেই এই মূল প্রশ্নটি এড়াইয়া যান; এই মনোবৃত্তি পরিবেশ আন্দোলনে পরাজয়ের বীজ বপন করে।
তাঁহারা হামেশাই কোনও এক ‘স্থিতিশীল প্রতিবেশ’ রচনা করিবার কথা বলিয়া থাকেন। তেমন একটি টেকসই ধরিত্রী কীভাবে রচনা করা সম্ভব তাহা লইয়া তাঁহাদের মধ্যেই ভুরি ভুরি সংশয়। কারণ, যে-ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বহু বহুকাল দিনাতিপাত করিতেছি তাহা ধরিত্রীর স্বভাবধর্মের বিপরীত। তাই এই ব্যবস্থা মানুষ এবং ধরিত্রীর মধ্যে এমন এক ফাটল সৃষ্টি করে যাহা উদ্ধৃতি এবং উত্তম বাণীর জলপ্রপাতে আবৃত থাকে না। এ এমন এক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, এমন এক শিল্পকলা যাহা শুধু মানুষ নহে, তাহার মৃত্তিকা সমেত সমগ্র আকাশ বাতাসও লুণ্ঠন করে। তাই বর্তমান পরিবেশ শুদ্ধিকরণের আন্দোলন সুপ্রচুর তথ্য, তত্ত্ব এবং ভাবাবেগ রচনা করিয়াও নিতান্ত ব্যর্থ হয়। যতকাল আমরা কুম্ভীরাশ্রুপটু, হৃষ্টপুষ্ট, কেতাদুরস্ত পারদর্শীদের প্রভাব হইতে মুক্ত না-হইব ততকাল এমনই চলিবে, নিয়তিপ্রায়।
প্রসঙ্গক্রমে, ইহাও অনেকের ধারণা, প্রযুক্তিই নষ্টের গোড়া। বিশেষ, আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুতগতি অশ্ব যখন ছুটিতে শুরু করিল তখন তাহার সহিত অসমান সংঘাতে প্রতিবেশ বিপর্যস্ত হইয়া গেল। তাই অনেকে ভাবেন, প্রযুক্তির মালিকানায় হস্তান্তর ঘটিলে প্রতিবেশের উপর বলাৎকার কমিবে। কিন্তু ধরা যাউক, পারমাণবিক প্রযুক্তি। ইহা যে প্রতিবেশ দূষণের অতি উন্নত এবং সর্ববৃহৎ উপাদান তাহা তর্কাতীত। অপরদিকে, উন্নয়নের উৎকর্ষ লাভ ও প্রতিবেশীর সমকক্ষ হইতে হইলে ইহা নির্বিকল্প। প্রযুক্তির মালিকানা পাল্টাইয়া গেলে আমাদের কী সুরাহা ঘটিবে? প্রযুক্তির নিজস্ব কোনও পক্ষপতিত্ব না-থাকিলেও তাহার কিছু সহজাত ধর্ম তো আছেই। তাহা সময়মতো, পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রকাশিত হইবে, ইহাও সত্য। তাহা না-হইলে চের্নোবিল-এর ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে কী করিয়া? উহা কি কেবলই অনবধানতার ফল?
অর্থাৎ কোনও আদর্শ সমাজের গতিবিধি নির্ধারণ ও উন্নতির সোপান রচনা করিতে গিয়া আমরা যদি এমন সরিষা ব্যবহার করি যাহার মধ্যেই ভূতের অবস্থান তখন সেই ভূত তো সময়বিশেষে উৎপাত করিবেই। বলিতে পারেন, প্রকৃতির উপর কারিকুরি ঘটাইয়াই প্রযুক্তির সৃষ্টি, উন্নত প্রজাতি হিসাবে আমরা তাহা ঘটাইবই এবং প্রকৃতিকে জয় করিব। ইহাই মানবপ্রজাতির জয়যাত্রার নিদর্শন। কিন্তু মানুষ এই মহাপ্রকৃতির একটি যৎসামান্য উপাদান। সে যখন মনে করে প্রকৃতির উপর বিজয় অর্জন করিল তখন তাহাকে এ-কথাও স্মরণে রাখিতে হইবে যে, তাহার প্রতিটি প্রত্যাশিত সুফলের পুচ্ছ ধরিয়া একাধিক অপ্রত্যাশিত কুফল অনিবার্য। প্রত্যেক ‘বিজয়’ কাণ্ডের পরিবর্তে প্রকৃতি প্রতিশোধ লয়, আমাদের অর্জনগুলি বিনষ্ট হইয়া যায়।
তাই প্রকৃতির উপর প্রভুত্বকামী মধু-স্বপ্ন না দেখিয়া আমরা ভাবিতে পারি, উন্নত মস্তিষ্ক সমেত সম্পূর্ণ মানবশরীর প্রকৃতিরই রূপসজ্জামাত্র। আমরা প্রকৃতির দাস নহি, প্রভুও নহি; অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় আমাদের মস্তিষ্কের চমৎকার এই যে, আমরা কল্পনা করিতে পারি, প্রকৃতির নিয়মগুলি শিখিয়া-বুঝিয়া, আমাদের স্বার্থে, প্রয়োজনমতো তাহার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাইতে পারি। সেই হেতু সর্বাধিক প্রয়োজন জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য। বিকল্প রচনা মানুষের হৃদয়গত, পরিত্রাহী সাধ, ইহার জন্য সে বিনিদ্র রজনী যাপন করিতে রাজি। কিন্তু এমন বিকল্প কি কিছু আছে যাহাতে জনসমাজের প্রত্যেকেই সমানভাবে উপকৃত, প্রত্যেকেই অ-ক্ষতিগ্রস্ত? থাকিলে তাহা কল্পনায়; বাস্তবে বিকল্প রচনা করিতে গিয়া আমরা কাহারও না-কাহারও ক্ষতিসাধনে উদ্যত।
তাহাতেও দোষ নাই, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ নাট্যকলা যেমন থমকিয়া থাকে না, আমাদের সক্রিয়তাও তদ্রূপ। তাহাতে আমরা পরস্পর যুযুধান হইলেও, অনন্যোপায়। তবে ইহারই মধ্যে, আপাতত, ভারসাম্য রচনার কাজটিই সর্বাপেক্ষা জরুরি। যে-আর্থনীতিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির উপর প্রতিবেশের চরিত্র নির্ভরশীল তাহারা সকলেই বিবর্তনমুখী। প্রতিটি সভ্যতাই বিবর্তনমুখী এবং প্রজাতি-নির্ভর। বুদ্ধিমান, কল্পনাপ্রবণ প্রজাতি হিসাবে এখন আমাদের স্বার্থের নেশা প্রবলতর— মোহ, অসূয়া, ঈর্ষা এবং হঠকারিতা তুলনারহিত। উন্নয়নের কুহকিনী মায়ায় বিভোর মনুষ্য এখন ধর্ষকামী। সংশয়, ইহাই যদি আমাদের বুদ্ধিমত্তার নমুনা হয় তাহা হইলে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে আমরা কি সত্যই ‘যোগ্যতম’? অথবা, ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ কথাটি আপ্তবাক্যই?
নির্মলীকরণের যুগ, জৈবিক যুগ ও জীবনচর্যার যুগ অতিক্রম করিয়া আমরা নাকি এখন জনস্বাস্থ্যের চতুর্থ যুগে পঁহুছিয়া, অধিকতর স্বাস্থ্যসচেতন হইয়া উঠিয়াছি। কিন্তু যে-চৈতন্য প্রতিদিন হাসপাতালমুখী করিয়া তোলে তাহা কি আমাদের বাস্তব বোধের পরিচায়ক? আমরা বিজ্ঞানসচেতন, তাই প্রমাণ করিয়া দিতে পারি, সূর্যালোক হইতে মৃত্তিকা অবধি সমস্ত কিছুই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। কিন্তু, এইরূপ উদ্ভট সচেতনতা লইয়া আমরা অগ্রসর না পশ্চাদমুখী? প্রসঙ্গ হেত্বাভাস বা ‘কনটেক্সট ফ্যালাসি’ কথাটি আমরা কবে বুঝিব? আপাতত যেইরূপে আমরা বি-উষ্ণায়ন, পারমাণবিক বিকিরণ ও খনিজ জ্বালানি লইয়া বিব্রত, তাহাতে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি নগরায়ণ বন্ধ করিয়া পুনরায় অরণ্যবাসী হইব? তাহাতে কি ‘বিশ্বস্বাস্থ্য’ লাবণ্যময় হইয়া উঠিবে?
বোধ হয়, এক ধারণাগত, উৎকট প্রহেলিকার মধ্যে আমাদের অধিষ্ঠান। মানবদেহ যে নিজেই একটি সাক্ষাৎ প্রহেলিকা তাহা আমরা ভুলিয়া যাই। ভাবিতে থাকি, এই মানবদেহ প্রতিবেশের আবর্জনাভার সহিতে অক্ষম। অথচ সেই ভার সহন করিবার ধর্ম তাহার অন্তর্গত। নচেৎ, ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’ শূন্য করিয়া মানব-মানবী টিকিয়া থাকিত না। অবশ্যই, আধুনিকতার ‘বীভৎস মজা’ উপভোগ করিবার ক্ষমতা এই দেহে নাই। আর যাহা তাহার আত্ম-বৈশিষ্ট্যের বিপরীত তাহা হইল, ভারসাম্যহীনতা। অতএব, প্রতিবেশ শুদ্ধিকরণ নিশ্চয় মহৎ কর্ম, কিন্তু মহত্তর ও জরুরি হইল আর্থ-সামাজিক হইতে রাজনৈতিক ইস্তক সর্বস্তরে ভারসাম্য রচনা। নতুবা, ছিন্ন ঘুড়ির ন্যায় অলীক প্রত্যাশার অধোগমনই নিয়তি।
গোঁড়ামির ফরমুলা দিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখীন হইতে গেলে, বিশ্বস্বাস্থ্যের রাগ-রাগিণী কতটা স্ফুরিত হইবে তাহা অজ্ঞাত, তবে ইহা স্পষ্ট যে, ভারসাম্য রচনা করিতে পারিলে এই তমসাবৃত রজনীতেও জীবনের অপার আনন্দ সম্পূর্ণ আস্বাদন সম্ভব। ভারসাম্যের দাবিটি অধিক নহে, অল্পও নহে; ইহাই যথার্থ। কুৎসিত পুঁজিতন্ত্রের আধিপত্যে সেই ভারসাম্য রচিত হইবে না; তবে কীভাবে রচিত হইবে তাহা এক অন্য সন্দর্ভের ভূমিকা হইতে পারে।