বিধান কান্তি দাশ
গ্লাসগোয় COP 26 বৈঠকে ২০০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা বৈশ্বিক উষ্ণতা (global warming) প্রাক-শিল্পস্তরের থেকে ১.৫⁰ C-এর মধ্যে রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। যদিও জলবায়ু সংকট প্রশমনে বনভূমির ভূমিকা ভারতসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ কার্বন নিষ্ক্রমণ প্রশমন করতে পারে বনসুরক্ষা ও বন পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ, বন পুনরুদ্ধার এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে জলবায়ু প্রশমনের কৌশল হিসাবে। সেটা সম্ভব কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন এবং গ্রিন হাউস গ্যাস নিষ্ক্রমণ কমানোর মাধ্যমে। অন্যদিকে এই ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের রক্ষা করতে পারে। যেমন ধরুন, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল ও প্লাবনভূমি প্রাকৃতিক সুরক্ষা হিসাবে কাজ করতে পারে চরম আবহাওয়ার ঘটনা ও সমুদ্র স্তর বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। বলা হয়, যত বেশি বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য থাকবে তত বেশি বাস্তুতন্ত্রের প্রজাতির সহ্য ক্ষমতা বাড়বে। এবং বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতাতে কিছু প্রজাতির অবদান বাড়বে বিভিন্ন পরিবেশগত চাপের মধ্যে। বাস্তুতন্ত্রের টেকসই পরিচালনা গ্রিন হাউস গ্যাস নিষ্ক্রমণ কমায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সাহায্য করে। অন্যদিকে যথেষ্ট না ভেবে হস্তক্ষেপ জৈববৈচিত্র্য নষ্ট করে। ফলে এমন সব নীতি ও কর্মসূচি নেওয়া দরকার যাতে জীববৈচিত্র্য ক্ষতি না হয় এবং স্থানীয় লোকদের জীবনযাত্রায় কুপ্রভাব না পড়ে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কী কী নীতি বা কর্মসূচি নিয়েছে জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এবং স্থানীয় মানুষের যোগদান ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে, তার একটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
জঙ্গল ও জলাভূমি ‘কার্বন স্টক’-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হিসাবে কাজ করতে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে। পুনর্বনায়ন (Forest restoration) বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের কার্যকারী ভূমিকা নিতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের মত। IPCC-র রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বন বাতাসের কার্বনের এক-তৃতীয়াংশ শোষণ করতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫০ মিলিয়ন হেক্টর জঙ্গল পুনরুদ্ধারের জন্য জার্মান সরকার ও IUCN উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা Bonn Challenge হিসাবে পরিচিত। ভারত, চিন, ব্রাজিল সহ প্রায় ৪৩টি দেশ ৩০০ মিলিয়ন হেক্টর নষ্ট হয়ে যাওয়া বন পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছিল। ওই দেশগুলোর রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় ওই জমির অর্ধেক অংশে বাণিজ্যিক গাছ, যেমন অ্যাকাসিয়া, ইউক্যালিপটাস বা রাবার লাগানো হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পুনর্বনায়ন পরিকল্পনায় অনেক জায়গা জুড়ে একই প্রজাতির গাছ লাগানো সেই দেশগুলিতে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ এইসব দ্রুতবৃদ্ধির প্রজাতির গাছ বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক। ব্রাজিলে, শতকরা ৮২ ভাগ অঙ্গীকারবদ্ধ জমিতে একই প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে প্রাকৃতিক জঙ্গলের (natural forest) পরিবর্তে, যেটা শতকরা ৯৯ ভাগ চিনের ক্ষেত্রে। অথচ Bonn Challenge-এর অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নষ্ট হওয়া বনজমির এক-তৃতীয়াংশ জমিতে সহজ ও খরচ-কার্যকর বহু প্রজাতির প্রাকৃতিক পুনর্জন্মের (natural regeneration) অঙ্গীকার করেছিল। অতএব দুই-তৃতীয়াংশ জমিতেই এই ধরনের গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাকে বলা হয় মোনোকালচার প্লান্টেশন। এক প্রজাতির গাছের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা প্রাকৃতিক জঙ্গলের থেকে অনেক কম, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা অনেকেই একমত। তাছাড়া যেহেতু এই ধরনের গাছ খুব কম সময়ের মধ্যে কাটা হয়, ফলে কার্বন ধরে রাখার সময়ও কম। অন্যদিকে প্রাকৃতিক জঙ্গল বহু দশক ধরে কার্বন ধরে রাখতে পারে। একটি হিসাব অনুযায়ী, ‘মোনোকালচার’ প্ল্যানটেশনের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা প্রাকৃতিক বন বা জঙ্গলের থেকে প্রায় ৪০ গুণ কম। বরং কৃষি বনের ক্ষমতা জঙ্গলের চেয়ে ৭ গুণ কম। ভারতের পশ্চিম ঘাটে একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক জঙ্গল প্রতি হেক্টরে ৩০০ টন কার্বন ধরে রাখতে পেরেছে, যেটা টিক (teak) এবং ইউক্যালিপটাস প্লান্টেশন থেকে অনেক বেশি। এমনকি খরা বা অন্য অনেক ঘটনার সময়ও প্রাকৃতিক জঙ্গল অনেক বেশি কার্বন ধরে রাখতে পারে। অতএব, যে নীতি প্রাকৃতিক বনকে প্ল্যানটেশনে রূপান্তরিত করে, যেমন ভারতের কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন কার্যক্রম, সেটা একদিকে যেমন কার্বন ধরে রাখার ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে, অন্যদিকে জৈববৈচিত্র্যর সমস্যা হতে পারে। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রাকৃতিক পুনর্বনায়নে দুরকমের উপকার হবে। এক, জলবায়ু প্রশমনে বহু প্রজাতির প্ল্যানটেশন বেশি কার্যকারী এক প্রজাতির থেকে। দুই, এটা জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করবে ও স্থানীয় অধিবাসীরা বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা থেকে উপকৃত হবে।
আমেরিকার একটি গবেষণা সংস্থা হিসাব করে দেখিয়েছে যে, নষ্ট হয়ে যাওয়া বনজমিকে পুনরায় বৃদ্ধি ঘটানোর যদি সুযোগ দেওয়া হয়, সেই বনজমি বাৎসরিক ৩ বিলিয়ন টন কার্বন শোষণ করতে পারে ৬০ বছর ধরে। বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশমনে বন ও গাছের কার্যকারিতা অনুধাবন করে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন, ২০২০ সালে World Economic Forum-এর ‘One trillion trees initiatives’ বা Plant for the Planet’s এর ‘Trillion Trees Campaign’ অথবা World conservation Society এবং World Wild Fund-এর যৌথ উদ্যোগে ‘Trillion Trees’ ইত্যাদি। দুঃখের ব্যাপার হল, ওইসব প্রচার ও উদ্যোগ এক বা দুই প্রজাতির প্লান্টেশন উৎসাহিত করছে । ফলে একদিকে কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা কমাচ্ছে, অন্যদিকে জৈববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত Nature পত্রিকা থেকে জানতে পারছি, যদি ৩৫০ মিলিয়ন হেক্টর নষ্ট হয়ে যাওয়া বনজমি প্রাকৃতিক নিয়মে পুনর্জন্ম হয় তাহলে ওই জমি প্রায় ৪২ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন শোষণ করতে পারবে ২১০০ সালের মধ্যে। অন্যদিকে, ওই জমিতেই যদি এক প্রজাতির গাছ লাগানো হয় তার কার্বন ধারণ ক্ষমতা ১ বিলিয়ন মেট্রিক টন হবে। চিনে ‘Grain for green’ কার্যক্রমে ১০০ মিলিয়নের বেশি চাষিকে গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহ ভাতা দেওয়া হয়েছিল যার দ্বারা ১০,৮০০ বর্গ মাইল বন পুনরুদ্ধার করা গিয়েছিল। কিন্তু জৈববৈচিত্র্য কমে গিয়েছিল। আবার কোস্টা রিকা সরকার যখন বন্য প্রজাতির জঙ্গল তৈরি করার উৎসাহ ভাতা দিয়েছিল তাতে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি বন পুনরুদ্ধার করা গেছে। অন্যদিকে নেপালের ১৭,০০০ সম্প্রদায়গত গোষ্ঠী যাদের জঙ্গল রক্ষা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, তাতে তিন দশক পরে শতকরা ২০ ভাগ জঙ্গল বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৭,১৩,৭৮৯ বর্গ কিমি বনভূমি আছে, যার মধ্যে গভীর বনভূমির পরিমাণ ৪,০৬,৬৬৯ বর্গ কিমি এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া বনের পরিমাণ ৩,০৭,১২০ বর্গ কিমি। আবার যদি ২০০১ সালের পরিসংখ্যান দেখি, তাতে দেখা যাচ্ছে গভীর বনভূমির পরিমাণ ছিল ৪,১৬,৮০৯ বর্গ কিমি। সুতরাং গত ২০ বছরে যদিও দেশের বনভূমি ৩৮,২৫১ বর্গ কিমি বেড়েছে, গভীর বনভূমি কিন্তু আসলে ১০,১৪০ বর্গ কিমি কমেছে।
অতএব ভারতের গভীর বা ভালো বন দ্রুত শেষ হচ্ছে। এই ধরনের বনভূমির নীচে বেশিরভাগ খনিজপদার্থ রয়েছে। জিডিপি দ্রুত বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশগত ক্ষতির মূল্যায়ন যথাযথ না করেই বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে দ্রুত ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভারত সরকারের লোকসভায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-২০২০ সালের মধ্যে ২৫,৮০০ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৭-২০১৮ সালেই ৪৯৬ বর্গ কিমি বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের নামে। একটি হিসাব অনুযায়ী, ওড়িষার সম্বলপুর জেলায় একটি কয়লা খনন প্রকল্পের জন্য ১,৩০,৭২১টি গাছ (১০.৩৮ বর্গ কিমি বন) কাটা হবে বলে ধার্য হয়েছে। খনিজ ও লৌহ আকরিক সমৃদ্ধ বিভিন্ন রাজ্যে বহু প্রকল্প আটকে রয়েছে বা বাতিল হয়েছে গ্রাম সভার অনুমতি না পাওয়ায় বা প্রতিরোধের ফলে। যেমন, হিমাচল প্রদেশে কিন্নড় জেলার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, ছত্তিশগড়ের হাশদেও বনে তিনটি খনন প্রকল্প বা ওড়িশায় পসকো প্রকল্প। এই প্রাকৃতিক বনভূমি দেওয়া হচ্ছে মূলত বেসরকারি সংস্থাকে খননে বা সিমেন্ট বা অন্য কারখানা তৈরি করতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাম সভার অনুমতি নেওয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম প্রলোভন বা বলপূর্বক অনুমতি নেওয়া হচ্ছে। সবই চলছে Pro-investment climate এবং Ease of doing business-এর নামে। বিভিন্ন জায়গায় গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের ফলে প্রকল্পের জমি কিছুটা হলেও ধাক্কা খাচ্ছিল। সম্প্রতি বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের আনা বন সুরক্ষা আইন ১৯৮০-র বিধি বা নিয়মাবলির পরিবর্তনের ফলে বনভূমির হস্তান্তর প্রক্রিয়া গতি পাবে। ২০২২ সালের ২৮ জুন প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে, জঙ্গলের জমিতে বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ মূলক কাজ বা খনন কাজে বেসরকারি সংস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি অনুমতি দেবে। এর জন্য আদিবাসীদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সরকার অনুমতি দেবে বন উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে, যেখানে সরকারি আমলার প্রাধান্যই বেশি। আদিবাসীরা জঙ্গলের মুখ্য অংশিদার হওয়া সত্ত্বেও কমিটিতে তাদের স্থান নেই। বনভূমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের বিষয়ে আদিবাসীদের স্বাধীনভাবে অবহিত প্রাক্-সম্মতি (prior informed consent) দেওয়ার বা না-দেওয়ার এবং তাদের অধিকার খর্ব হচ্ছে কিনা তা পর্যালোচনা করার নিয়মটাই তুলে দেওয়া হল। এর ফলে আদিবাসীরা, যাদের জীবন, জীবিকা এবং সংস্কৃতি জঙ্গলের জমি ও তার সম্পদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে বহুবছরে গড়ে উঠা জঙ্গল ধ্বংসের ফলে জৈববৈচিত্র্য কমবে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধের ক্ষমতাও হ্রাস পাবে।
বন সুরক্ষা আইন ১৯৮০ অনুযায়ী, যে পরিমাণ বনজমি হস্তান্তরের ছাড়পত্র দেওয়া হবে, বনের বাইরে সম পরিমাণ জমির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেই জমিতে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ বনসৃজন করতে হবে, যাকে বলা হয় ‘কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন’। বন ধ্বংস ও বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করার পরিবেশ মূল্য বা নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু (এনপিভি) হিসাবে টাকা কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে জমা করতে হবে। এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৬ সালে একটি আইন তৈরি হয়েছে যাকে বলা হয় ‘কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টশন অ্যাক্ট ২০১৬’। নষ্ট হওয়া প্রাকৃতিক বনের মূল্য থেকে পাওয়া অর্থ এই কাজে লাগানো হবে। নতুন বিধিতে প্রাকৃতিক জঙ্গল ও জৈববৈচিত্র্যের ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ মূল্য বাড়িয়ে হেক্টর প্রতি প্রায় ১১ লাখ থেকে ১৬ লাখ করা হয়েছে। আগেই বলেছি, বনদপ্তর অ্যাফরেস্টশনের নামে যে সব গাছ লাগাচ্ছে তা মূলত বাণিজ্যিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাসিয়া বা রাবার। অর্থাৎ একই রকম প্রজাতির বন তৈরি করা, যাকে বলা হয় ‘মোনোকালচার’। এর প্রভাব অপরিসীম জলবায়ু পরিবর্তনে এবং জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর। ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫০ কোটি টন ‘কার্বন সিঙ্ক’ তৈরি করার লক্ষ্যে, ভারত সরকার গ্রিন ইন্ডিয়া মিশন-এর অধীনে জাতীয় সড়কের দুধারে ১,৪০,০০০ কিমি গাছের লাইন এবং গঙ্গার ধার বরাবর গাছ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। অনেক রাজ্য সরকার এক জাতীয় গাছ লাগানোয় ভর্তুকি বা উৎসাহ ভাতা দিচ্ছে। যেমন গুজরাট, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র। কিন্তু প্রাকৃতিক পুনর্বনায়নে তারা উৎসাহিত নয়। এই কার্যক্রমে স্থানীয় লোকেদের কোনও ভূমিকা নেই।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, “কার্বন সিঙ্ক” বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় বনসৃজন প্রকল্পে তেমন কোনো সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না। বরং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের জন্য অধিকৃত প্রাকৃতিক জঙ্গল থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ভান্ডার তৈরি হয়েছে ‘কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টশনের’ জন্য। কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তর ২০০৯-২০২০ সালের মধ্যে আনুমানিক ৫৯,০০০ কোটি টাকা এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছে। পরিবেশ দপ্তরের ‘ই-গ্রিন ওয়াচ’ পোর্টালের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৫-২০১৮ সালের মধ্যে কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টশন ফান্ড থেকে অর্থ নিয়ে যে ২৩,৫০০ হেক্টর বনসৃজন করা হয়েছে, তার অর্ধেক জমিতে এক বা দুই প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। আবার, সেই পোর্টালের তথ্যের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রে বাস্তবের কোনো সম্পর্কই নেই। এক গবেষক ওই পোর্টালের ৬টি রাজ্যের ২০০০ নথি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, এই বনসৃজন যেসব এলাকায় হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই সব এলাকায় কোনো গাছের অস্তিত্বই নেই! পরিবেশ দপ্তরে পাঠানো ভারতীয় বন সর্বেক্ষণের নোটে বলা হচ্ছে যে, রাজ্য বন দপ্তরের পাঠানো বনসৃজনের তথ্য শতকরা ৭৫ ভাগই অসত্য! আবার প্রত্যেক রাজ্যে এই অর্থ ভান্ডারের ৩০% টাকা নতুন বন রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ থাকে। অভিযোগ, বাস্তবে কিছুই হয় না, বরং ওই টাকা অন্য কাজে লাগানো হয়। এই কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টশন অ্যাক্ট ২০১৬-র নিয়মে কোথাও স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের উল্লেখ নেই। এই অ্যাফরেস্টশন কার্যক্রম স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো কাজে লাগে না। ফলে তারা একে নিজেদের কার্যক্রম বলে মনে করে না। এছাড়া যথাযথ নজরদারির ব্যবস্থা নেই। দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। এতে একদিকে যেমন ‘উন্নয়নের’ নামে প্রকৃত জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ করতে সমগোত্রীয় বনও তৈরি হচ্ছে না। কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশনের নামে সরকারের বনসৃজন কার্যক্রম হাজার-হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা প্রাকৃতিক বনের কতটা পরিপূরক হতে পারে? এই ধরনের বনসৃজন বা প্লানটেশনকে জঙ্গল বা বন বলা যেতে পারে কিনা এই নিয়েই বিতর্ক আছে। প্রাকৃতিক বনের জৈববৈচিত্র্য বেশি এবং জঙ্গলের অধিবাসীরা সেখান থেকে অনেক রকম পরিষেবা পায়, যেটা মোনোকালচার প্লানটেশনে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মোনোকালচার খুব একটা কার্যকারী ভূমিকা নিতে পারে না। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে বনসৃজনের মাধ্যমে আনুমানিক ১০০ কোটি টন কার্বন শোষণের অঙ্গীকার করা হয়েছে।
অতএব প্রশ্ন হচ্ছে, জঙ্গলহীন বন এলাকায় পুনঃবনসৃজন বা রিফরেস্টেশন ও বনের জৈববৈচিত্র্য কীভাবে রক্ষা করা যেতে পারে? এটা বলা যেতেই পারে, বর্তমান বনপরিচালনা পদ্ধতি বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানে উপযুক্ত নয়। পরিচালন ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। জঙ্গলের সাথে আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানতে পারছি, আদিবাসী-পরিচালিত জঙ্গল এলাকাতে জঙ্গল ধ্বংস হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম বনদপ্তর-পরিচালিত বন এলাকার থেকে। ভারত সরকারের ‘বন অধিকার আইন ২০০৬’ জঙ্গলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে জঙ্গলের উপর অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, ২০০৬ সালে পাশ হওয়া বন অধিকার আইন ভারতে বন পরিচালনায় একটি দিকনির্দেশক আইন, যেখানে ব্রিটিশ আমল, এমনকি স্বাধীন ভারতেও বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আদিবাসীদের জল-জঙ্গলের অধিকার যেভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। অনেক অধিকারের মধ্যে মূল চারটি অধিকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যা জঙ্গলের অধিবাসী তথা আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। প্রথমত, আদিবাসীরা যে যেখানে বংশানুক্রমে বসবাস ও চাষবাস করছে সেই জমির আইনগত স্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত, জঙ্গলের যে সম্পদের (minor forest produces) উপর নির্ভর করে আদিবাসীরা জীবনযাপন করে আসছে তার উপর আইনগত অধিকার দেওয়া। তৃতীয়ত, আদিবাসীরা যে জঙ্গল পুরুষানুক্রমে পরিচালনা, রক্ষা ও ব্যবহার করে আসছে তার অধিকার তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া। জঙ্গলের কী-কী সম্পদ কখন কীভাবে ব্যবহার করা যাবে বা কীভাবে প্রাণী সম্পদ রক্ষা করতে হবে, এর সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব সেই এলাকার অধিবাসীদের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রান্তিক আদিবাসীদের ক্ষমতায়নে ও জীবনযাত্রার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অধিকার। এই অধিকারগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামসভার গুরুত্ব অপরিসীম। সমস্যা হচ্ছে বনদপ্তর কোনোভাবেই বনের উপর তাদের কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। তাদের যুক্তি, আদিবাসীদের বনপরিচালনার ক্ষমতা নেই। অধিকার পেলে আরও বন ধ্বংস হবে। অথচ যেসব জায়গায় বনপরিচালনার অধিকার দেওয়া হয়েছে সেখানে অত্যন্ত সফলতার সাথে আদিবাসীরা সেই কাজ করছে। সংরক্ষিত বনদ্রব্য বিক্রি করে নিজেদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে সাহায্য করছে, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। যেমন ধরুন, মহারাষ্ট্রের গড়চিড়ৌলি জেলার আদিবাসী গ্রামগুলো শুধুমাত্র বাঁশ গাছ বিক্রি করে প্রচুর রোজগার করছে। আবার গুজরাটের নর্মদা জেলার ২০টি গ্রামের মানুষ বাঁশ গাছ চাষ করছে এবং তা বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে। একইরকমভাবে অন্ধ্রপ্রদেশের সিরসানপল্ললি গ্রামের অধিবাসীরা সমষ্টিগত জঙ্গলের অধিকার পাওয়ার পর আনুমানিক ২৬ লক্ষ টাকার বাঁশ বিক্রি করেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ওই টাকার অর্ধেক জঙ্গলের উন্নতিতে ব্যয় করবে এবং তাদের গ্রামকে মডেল গ্রামে পরিণত করবে। অন্যদিকে জাতীয় উদ্যানে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিচালনায় স্থানীয় মানুষের অবদানও উল্লেখনীয়। ওড়িষার সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে ২১টি গ্রামের অধিবাসীরা চিরাচরিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে সম্প্রদায়গত সংরক্ষণ ও পরিচালন পরিকল্পনা তৈরি করেছেন বনদপ্তরের সহায়তায়। অন্যদিকে কর্ণাটকের একটি টাইগার রিজার্ভে ৩২টি গ্রামের সলিগা আদিবাসীরা একত্রিত হয়ে বাঘ সংরক্ষণ পরিকল্পনা করেছে এবং বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, অধিবাসীদের ক্ষমতা দেওয়া হলে তারাও সফলভাবে বন সংরক্ষণ করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে এবং জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অধিবাসীদের সমষ্টিগত জঙ্গলের সম্পদের (community forest rsources বা CFRs) অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে।
আসলে বনদপ্তরকে বনপরিচালনায় পুরোনো ধ্যানধারণা ছাড়তে হবে। বনকে পণ্য হিসাবে না দেখে সামাজিক বাস্তুতন্ত্র বা ‘সোসিও-ইকোলজিকাল সিস্টেম’ হিসাবে দেখতে হবে, যেখানে মানুষ ও জীবজগৎ একে-অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্থানীয় মানুষের হাতে বনপরিচালনার ক্ষমতা দিলে তারা জীবনযাত্রার প্রয়োজনমতো জীবজগৎ সংরক্ষণ করবে। এতে এক প্রজাতির পরিবর্তে বহু প্রজাতির বন তৈরি হবে এবং জৈববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে, যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকারী ভূমিকা নেবে। বন সংরক্ষণে সরকারের খরচ কমবে। তাহলে বনদপ্তর কী করবে? তারা বনপরিচালনায় জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও সাহায্যকারীর কাজ করতে পারে। বন সংরক্ষণ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, বা না হলে শাস্তির বিধান দেওয়া, ইত্যাদি। অনেকটা যেমন দূষণরোধে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ করে থাকে। প্রথমে ছোটো আকারে শুরু করে দেখা যেতেই পারে। জলবায়ু সংকট নিরসনে পুনর্বনায়ন, জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ যা বাতাসের কার্বন হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। আর সেটা করা যেতে পারে বন অধিকার আইনের দেওয়া অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া এবং তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে।