তপন সাহা
আমরা খুব ছোটো থেকে যখন কিছু বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই জেনেছি জল আমাদের জীবনে একটি অপরিহার্য বস্তু। ওই সময় থেকেই আমরা অনুভব করেছি প্রাত্যহিক জীবনধারণের জন্য জল আমাদের কতটা প্রয়োজনীয়। তাছাড়া খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ইত্যাদির প্রয়োজন মেটাবার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যা যা উৎপাদন করতে হয় তার জন্য জল একটি আবশ্যিক উপাদান। তাই একটি শিশুর জন্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জল অসীম নয়, পৃথিবীতে জলের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে যা জলের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে। ১৮২০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। ১৯৩০ সালে জনসংখ্যা হয় ২০০ কোটি। তারপর থেকে রকেট গতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ২০২২-এর আগস্ট মাসে বৃদ্ধি পেয়ে হয় প্রায় ৭৯৬ কোটি ৫১ লক্ষ। বর্তমানের প্রায় ৮০০ কোটির জনসংখ্যার মধ্যে ৬০০ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১০০ বছরে। বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য জল সম্পদের সংকট সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে এই রকেটগতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি। নদীনালা, হ্রদ, পুকুর ও অন্যান্য ভূপৃষ্ঠস্থ ব্যবহারযোগ্য জলাধারগুলি আবার অনেক ক্ষেত্রেই চরম দূষণের কবলে পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ভূ-জলের উপরে নির্ভরশীল। অতিরিক্ত মাত্রায় ভূ-জল উত্তোলনের ফলে ভূ-জলের ভাণ্ডার ক্রমশ নিঃশেষিত হওয়ার পথে। রাষ্ট্রসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৮০ কোটি মানুষের বিশুদ্ধ পানীয় জলের কোনও সংস্থান নেই, ১৮০ কোটি মানুষ মলমূত্র দ্বারা দূষিত জল ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। ২৪০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জনসংখ্যা জল সংকটের মধ্যে বাস করছে। দশ জনের মধ্যে চারজন জলের অভাব সম্পন্ন নদী উপত্যকায় বাস করে। ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৩০০–৫০০ কোটি মানুষ জল সংকটের মধ্যে বাস করবে। প্রতিদিন পরিমাণগত ও গুণগতভাবে বিশুদ্ধ জল ও শৌচাগারের অভাবে বিভিন্ন রোগে প্রায় ১০০০ শিশুর মৃত্যু ঘটে। প্রতি বছর সেচের জন্য যে পরিমাণ জল ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয় এবং যে জল প্রাকৃতিক উপায়ে ভূগর্ভে সঞ্চিত হয় তার মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য আছে। যা জল উত্তোলন করা হয় তার থেকে প্রতি বছর ভূগর্ভেস১৬০ বিলিয়ন ঘন মিটার কম জল সঞ্চিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং গৃহস্থালী ও প্রাত্যহিক অন্যান্য কাজে প্রায় ৩৫ শতাংশ জল অপচয় হয়। ৩০ শতাংশ পাইপের মধ্যে দিয়ে সরবরাহকৃত জল পাইপ ভাঙা বা ফুটো বা অন্যান্য লিকেজের কারণে নষ্ট হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই নষ্ট হওয়ার মোট পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ঘনমিটার, যা দিয়ে প্রায় ২০ কোটি মানুষের জলের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
২০২২ সালের জুলাই মাসের ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে — ১৭টি দেশ যেখানে পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষের বাস, তারা সেখানে এখন খুব চরম মাত্রার (Extremely High) জল সংকটের মধ্যে বাস করছে, ওই অঞ্চলে সেচ, শিল্প-কারখানা ও শহরে দেশের মোট ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণের ৮০ ভাগ জল প্রতি বছর খরচ হয়ে যাচ্ছে, ফলত বৃহৎ অংশের গ্রামীণ মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ৪৪টি দেশ যেখানে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা বসবাস করে সেখানেও জলের অভাব দেখা যাচ্ছে, এই অংশে প্রতি বছর ব্যবহারযোগ্য সরবরাহকারী জলের ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে। মধ্য পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকার ১৭টি দেশের মধ্যে ১২টি দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জল সংকটের দেশ হিসাবে চিহ্নিত। এই অঞ্চলগুলি প্রচণ্ড গরম ও শুষ্ক হওয়ার কারণে প্রথম থেকেই জলের অভাব আছে, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলের চাহিদা বাড়ায় সংকট তীব্রতর হচ্ছে। ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনকে ‘জলশূন্য শহর’ হিসাবে ঘোষণা করতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন জলের এই সংকটকে সারা পৃথিবীতেই আরও দ্রুত ত্বরান্বিত করছে। বিশ্ব ব্যাংক তাদের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত জল সংকট পৃথিবীর অর্থনীতিকে বিপদাপন্ন করে তুলবে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ৬ থেকে ১৪ শতাংশ হ্রাস পাবে।
২০২১ সালে রাষ্ট্রসংঘের একটি হিসাব অনুযায়ী ৪৫ কোটি শিশু সহ ১৪২ কোটি জনসংখ্যা চরম থেকে খুব চরম জল সংকটের মধ্যে বাস করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বৃষ্টির চরিত্রের পরিবর্তন, অতিরিক্ত ঝড়-ঝঞ্ঝা, খরা, বন্যা, সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি এই জল সংকটকে আরও তীব্রতর করছে। অতিরিক্ত ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা ও সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধির জন্যে শহর ও গ্রামের জল সরবরাহ, শৌচাগার, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও খাদ্য উৎপাদনের পরিকাঠামো একাধারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, পাশাপাশি সমুদ্রের নোনা জল নদীনালা ও ভূগর্ভস্থ জল ভান্ডারে প্রবেশ করে তাকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্লেসিয়ারের বরফ গলা জল ও সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি সমুদ্র ও নদীনালা ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু অঞ্চল স্থায়ীভাবে জলের তলায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়ে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে। রাষ্ট্রসংঘের একটি সমীক্ষাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে খরা, সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি ও অন্যান্য চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি মানুষ আরও উদ্বাস্তু হয়ে যেতে বাধ্য হবে। ২০০১ থকে ২০১৮ পর্যন্ত যত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে তার ৭৪ শতাংশ হয়েছে খরা ও বন্যার মতো জল সংক্রান্ত কারণে, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তুর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি ঘটছে, এই উদ্বাস্তুরা যে অঞ্চলে আশ্রয় নেয় সেখানে আবার জল ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে জল সংকটের সৃষ্টি করছে। ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জলের চাহিদা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। নগরায়ণ বৃদ্ধি পেয়েও দূষিত বর্জ্য জল ও আবর্জনা নিক্ষেপের ফলে নদীনালা, জলাশয় সহ অন্যান্য ভূপৃষ্ঠস্থ জলাধার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ টন বর্জ্য নদীনালা ও সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। ১.৫ কোটি থেকে ১.৮ কোটি ঘনমিটার ব্যবহারযোগ্য ভূপৃষ্ঠস্থ জল ভান্ডার প্রতি বছর জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় দূষিত হয়। ব্যবহার পরবর্তী ৮০ শতাংশ অপরিশোধিত দূষিত বর্জ্য জল পরিবেশে (নদীনালা, জলাশয়, সমুদ্র ও কৃষিক্ষেত্র) নিক্ষেপ করা হয়। নিম্ন আয়ের দেশগুলির শিল্প ও শহর নির্গত ময়লা জলের মাত্র ৮ শতাংশ পরিশোধন করা হয়। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির মোট বর্জ্য জলের ২৮ শতাংশ পরিশোধন করা হয়ে থাকে। ৫০ লক্ষ থেকে ২ কোটি হেক্টর জমি বর্জ্য জল দিয়ে সেচ করা হয়। ২০২১ সাল থেকে ২০৩০ সাল এই দশ বছরের মধ্যে ৪৫টি প্রধান শহরাঞ্চলে যেগুলিতে ৩০ লক্ষের বেশি মানুষের বাস, সেখানে চরম থেকে খুব চরম জল সংকট দেখা দেবে। জলের অভাবের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও অভিবাসন ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২১ সালের আগের দশ বছরে জল নিয়ে দ্বন্দ্ব বা লড়াই বা যুদ্ধ যত সংখ্যায় হয়েছে তা তার আগের থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। জলের অভাব অভিবাসনের একটি মূল কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই জলের সমস্যা কোনও একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, কিছু অঞ্চলে এটি সামাজিক ও আন্তর্দেশীয় রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। আন্তর্দেশীয় নদীগুলি থেকে ৬০ ভাগ ব্যবহারযোগ্য জল পাওয়া যায় এবং প্রায় ৫৯২টি আন্তর্দেশীয় ভূগর্ভস্থ জলস্তর আছে। বর্তমান পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অবস্থা এবং বর্তমানের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫০ সালে প্রায় ৯৭০ কোটি হওয়ার সম্ভাবনাকে বিবেচনার মধ্যে রেখে আন্তর্দেশীয় জলচুক্তিগুলি যথেষ্ট রূপায়ণযোগ্য হওয়া উচিত।
২০১৮ সালের জুন মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশের বাস, কিন্তু পৃথিবীর মোট জলসম্পদের মাত্র ৪ শতাংশের অধিকারী। ২০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল পায় না। আগামী ২০৩০ সালে ৪০ শতাংশ মানুষের বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংস্থান থাকবে না। আমাদের দেশের ৬০ কোটি মানুষ চরম জল সংকটের সম্মুখীন হবে। আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ জল দূষিত। রাষ্ট্রসংঘের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় গুণগত দিক দিয়ে ১২২ দেশের মধ্যে আমাদের দেশের অবস্থান ১২০তম। পরিমাণগত ও গুণগতভাবে বিশুদ্ধ জলের অভাবে প্রতি বছর প্রায় দু-লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ৭৫ শতাংশ বাড়ির ভিতরে জলের কোনও সংস্থান নেই। ৮৪ শতাংশ গ্রামীণ বাড়িতে পাইপের মাধ্যমে জল সরবরাহের কোনও সংস্থান নেই। ২০২০ সালেই নিউ দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং হায়দরাবাদ সহ ২১ শহরে ভূগর্ভস্থ জল নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তাতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ভুক্তভোগী হবে। ২০৫০ সালে জল সংকটের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ৬ শতাংশ হ্রাস পাবে। জলের অভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্নের সম্মুখীন হবে। ২০১৯ সালেই গ্রীষ্মের সময় চেন্নাইতে ১ লিটার জল ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্য জায়গা থেকে রেলের ট্যাংকারে করে জল নিয়ে এসে চেন্নাইতে সরবরাহ করতে হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পৃথিবীতে চরম জল সংকটের মধ্যে আছে ১৭টি দেশ। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে চরম জল সংকটের নিরিখে ১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৩ তম। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেমন জল সম্পদের পরিমাণের বৈষম্য আছে তেমনি ভারতেও রাজ্য ও আঞ্চলিক স্তরে এই বৈষম্য চরমভাবে দেখা যায়। বিহারে ভারতের দশ ভাগ মানুষ বাস করে, কিন্তু ভারতের মোট জল সম্পদের মাত্র ৫ শতাংশ বিহারে আছে, ৮ শতাংশ জনসংখ্যার বাস রাজস্থানে মোট জল সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ আছে। ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে কোনও গ্লেসিয়ার নির্ভর নদী নেই, প্রায় সমস্ত নদী বৃষ্টির জল ও ভূগর্ভস্থ জলের উপরে নির্ভরশীল, তাই জল সংকটও অনেক তীব্র। অনেক ক্ষেত্রেই নদীতে অল্প জল থাকায় আন্তঃরাজ্য নদীগুলির জল বণ্টন নিয়ে প্রতিনিয়ত বিবাদ লেগেই আছে। ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলির মানুষের জল সম্বন্ধে অনুভূতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনুভব করতে পারে না। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার নির্ভর গঙ্গা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ও অনেক নদনদীর অবস্থান এবং এখনও বেশিরভাগ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর দ্রুতহারে নামলেও টিউবওয়েল থেকে জল পাওয়া যায়, তাই এই রাজ্যে জলের অভাব বা সংকটের অনুভূতি বোঝার মতো মানসিকতা গড়ে ওঠেনি।
রকেটগতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ক্ষেত্রে জলের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সারা পৃথিবীতেই মাথাপিছু মোট জল পাওয়ার পরিমাণ কমছে। ১৯৫১ সালে ভারতে মাথাপিছু জল পাওয়ার পরিমাণ ছিল ৫১৭৭ ঘনমিটার। ২০০১ ও ২০১১ সালে হ্রাস পেয়ে হয় যথাক্রমে ১৮১৬ ও ১৫৪৫ ঘনমিটার, বর্তমানে হ্রাস পেয়ে হয়েছে প্রায় ১০০০ ঘনমিটার। কোনও দেশে বা রাজ্যে বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যদি মাথাপিছু জল পাওয়ার পরিমাণ ১৭০০ ঘনমিটারের নীচে হয় সেই জায়গায় জলের অভাব সৃষ্টি হয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়। যদি মাথাপিছু জল পাওয়ার পরিমাণ ১০০০ ঘনমিটারের কম হয় সেই অঞ্চলটি তীব্র জল সংকটের অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত হয়। মানুষের প্রতিদিনের মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণ, কাগজ, জামাকাপড় অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র উৎপাদনের জন্য যে পরোক্ষ জলের প্রয়োজন, বর্তমানে সারা পৃথিবীতে তার গড় হচ্ছে মোট প্রায় ৩৬৬৩ লিটার, এর মধ্যে শুধু খাদ্য উৎপাদনের জন্যই লাগে ৩৪৯৬ লিটার ও অন্যান্য জিনিসপত্রের জন্যে লাগে ১৬৭ লিটার। যদিও পৃথিবী জুড়েই এই পরোক্ষ জল ব্যবহারের বিশাল বৈষম্য আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী একজন মানুষের সুস্থভাবে বাঁচতে গেলে প্রত্যেকদিন পান করা, রান্না করা, কাপড় ধোওয়া ও বাসনপত্র পরিষ্কার করা, স্নান করা, শৌচাগার, বাগান পরিচর্যা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ ব্যবহারের জন্য মোট ১৩৫ লিটার জল প্রয়োজন। পৃথিবীতে প্রাত্যহিক মাথাপিছু জল ব্যবহারের বৈষম্য প্রকট। এশিয়ায় এই পরিমাণ হচ্ছে গড়ে ৮৭ লিটার, আফ্রিকায় ৮৪ লিটার, ব্রিটেনে ৩৩৪ লিটার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৮৭ লিটার। ভারতবর্ষে অধিকাংশ অঞ্চলে এই পরিমাণ ৫০–৬০ লিটার। ভারতবর্ষে একমাত্র কলকাতা পৌরসভা তার অন্তর্গত শহরবাসীদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত প্রতিদিন মাথাপিছু ১৩৫ লিটারের মাত্রার থেকেও বেশি পরিমাণ জল সরবরাহ করে, সেই পরিমাণ হচ্ছে গড়ে প্রায় ২০২ লিটার। এছাড়াও কলকাতা পৌরসভার অন্তর্গত বড়ো বড়ো হাউসিং কমপ্লেক্সগুলি যথেচ্ছভাবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসিয়ে জল উত্তোলন করে ২৪ ঘণ্টা জল সরবরাহ করছে, শুধু কলকাতা পৌরসভা নয় বৃহত্তর কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বড়ো, মাঝারি ও ছোটো শহরে একইভাবে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলত ভূগর্ভস্থ জলস্তর দ্রুতহারে নীচে নেমে যাচ্ছে।
পৃথিবীর বর্তমান ৭৯৭ কোটির জনসংখ্যা ২০২৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে আনুমানিক হবে প্রায় ৮৫০ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাহিদা মেটাবার জন্য কৃষি, শিল্প ও দৈনন্দিন কাজে জল ব্যবহার দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাবে, ফলে সমস্ত নদী থেকে জল উত্তোলন বৃদ্ধি পাবে এবং সমুদ্রে নদীর জল পৌঁছাবার সুযোগই পাবে না। আমেরিকার বৃহত্তম নদী কলোরাডো নদী থেকে জল উত্তোলন বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে সাতটি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে মিশলেও শেষ অংশে জল পৌঁছাতো না এবং সমুদ্রেও জল যেত না। রাজ্যগুলির মধ্যে জল বিতরণের কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে এখন সমুদ্রে কিছু পরিমাণ জল পৌঁছায়। গঙ্গা নদী গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার থেকে সৃষ্টি হয়ে উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ও ঝাড়খণ্ড, এই রাজ্যগুলির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মেশে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যে হারে গঙ্গা থেকে জল উত্তোলন বাড়ছে এবং সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দেওয়া হচ্ছে তাতে আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গের অংশে গঙ্গার জল পৌঁছানোও প্রশ্নের সম্মুখীন। তাছাড় বিশ্ব উষ্ণায়ন জনিত কারণে যে হারে সারা পৃথিবীর হিমবাহ ও ক্রান্তীয় অঞ্চলের বরফ গলছে তার থেকে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারও মুক্ত নয়। এখন খুব বড়ো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আগামীদিনে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের বরফ গলে তার আয়তন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে গ্লেসিয়ারটি সম্পূর্নভাবে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। তখন গঙ্গায় জল থাকবে কি? হয়তো জোয়ার-ভাটার কারণে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে পর্যন্ত সমুদ্রের নোনা জল প্রবেশ করবে, অথবা সমুদ্রের জলতল যে হারে বাড়ছে IPCC-র ষষ্ঠ রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতাও সম্পূর্ণ সমুদ্রের জলের তলায় চলে যাবে। ইতিমধ্যেই গঙ্গার জলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার থেকে যদি জল না আসে নোনা জল গঙ্গার নীচের অংশে প্রবেশ করবে, বর্তমানে পলতা, গার্ডেনরিচ, হাওড়ার পদ্মপুকুর, শ্রীরামপুর, বাইপাসের আজাদহিন্দ জল শোধানাগার, নিউটাউনের জল পরিশোধানাগার ইত্যাদি জল শোধানাগারে গঙ্গার জল নিয়ে এসে পরিশোধন করে যে জল সরবরাহ করা হয় তা সম্পূর্নভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়াও নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ইত্যাদি কয়েকটি আর্সেনিকপ্রবণ জেলায় আর্সেনিক মুক্ত জল সরবরাহের জন্য গঙ্গার জল পরিশোধন করার কয়েকটি জল পরিশোধনাগার আছে। ইতিমধ্যেই বৃহত্তর কলকাতায় ভূগর্ভস্থ জল ব্যাপকহারে উত্তোলনের ফলে ভূ-জলের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। গঙ্গায় নোনা জলের অনুপ্রবেশ এবং ভূ-জলের পরিমাণ হ্রাস— এই দুয়ের কারণে অদূর ভবিষ্যতে বৃহত্তর কলকাতার চরম জল সংকটে পড়ার সম্ভাবনা তীব্র হচ্ছে। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা ভূ-জলের উপরে নির্ভরশীল। সমস্ত দেশেই ভূ-জলের উত্তোলনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে জল সমস্যা নিরসনে অনেক সম্মেলন, নীতি, চুক্তি ইত্যদি সংগঠিত করা হয়েছে। প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় ১৯৭৭ সালে আর্জেন্টিনার মার ডেল প্লাটা–তে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২২ মার্চকে ‘বিশ্ব জল দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়। রাষ্ট্রসংঘ মার্চ ২০১৮ থেকে মার্চ ২০২৮— এই দশ বছরকে “টেকসই উন্নয়নের জন্য জল” (“Water for Sustainable Development”)–কে মূল ভাবনা রেখে “আন্তর্জাতিক কাজের দশক” (International Decade for Action) হিসাবে ঘোষণা করেছে। এর আগে আরও দুবার জলকে গুরুত্ব দিয়ে “আন্তর্জাতিক দশক” হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির উদ্যোগে ধারাবিহিকভাবে জলের গুণগত ও পরিমাণগত সমস্যার সমাধানে কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিছুটা অগ্রগতি হলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক কারণ সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মূল কারণ হচ্ছে অধিকাংশ রাষ্ট্র তাদের নীতিতে জলকে সামাজিক অপরিহার্য বস্তু (Essential Social Goods) থেকে অর্থনৈতিক পণ্যে (Economic Goods) রূপান্তরিত করেছে। জল হচ্ছে মানবাধিকারের একটি অন্যতম অঙ্গ— এই ভাবনার উপরে আঘাত আসে যখন গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে বিশ্ব ব্যাংক কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের নামে বিভিন্ন দেশে ঋণ দেওয়ার সময় জলকে একটি অর্থনৈতিক পণ্য হিসাবে বিবেচনা করার জন্য শর্ত দিতে শুরু করে। ৯০-এর দশকে দোহায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একটি সভায় জলকে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বিশ্বায়নের উন্মুক্ত বাণিজ্যের বাজারে জল হচ্ছে অন্যতম পণ্য। জল সামাজিক অপরিহার্য বস্তু থেকে অর্থনৈতিক পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভারতবর্ষে ১৯৮৭, ২০০২, ২০১২ ও ২০২০ সালে মোট চারটি “জাতীয় জলনীতি” গ্রহণ করা হয়। প্রথম তিনটি নীতির ঘোষিত কার্যক্রমের অধিকাংশ রূপায়ণ করা হয়নি। ২০২০ সালের ঘোষিত নীতির কর্মসূচি রূপায়ণ করা শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের ঘোষিত নীতিতে রাজ্যভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০২ সালের নীতিতে পরোক্ষভাবে জলকে অর্থনৈতিক পণ্যে রূপান্তরের পরিকল্পনার কথা প্রচ্ছন্নভাবে উল্লেখ করা হয়। ২০১২ সালের নীতিতে রাখঢাক না-রেখে জলকে নিয়ে ব্যবসার কথা প্রত্যক্ষভাবে বলা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী ভারতের জল সম্পদকে ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের নদীনালা সহ অন্যান্য বিভিন্ন জল সম্পদকে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কোক, পেপসির মতো খাদ্যগুণহীন ঠান্ডা পানীয়ের জন্য প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লিটার জল ভূগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে। ছত্তিশগড়ের শিওনাথ নদী ও তামিলনাড়ুর ভবানী নদীর মতো নদীর কিছু অংশ বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই দিল্লি, কর্ণাটক, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, বিহার ইত্যাদি রাজ্যে জল পরিশোধন ও সরবরাহ করার দায়িত্ব ফরাসি সুয়েজ, ভিভেন্দি, মার্কিন বেকটেল, ব্রিটিশ টেমস ওয়াটার, আঙলিয়ান ওয়াটার সার্ভিসেসের মতো বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। জল হচ্ছে মানবাধিকারের একটি অঙ্গ, সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সহ সমস্ত ক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমস্ত মানুষকে শামিল করতে হবে।
রাষ্ট্রসংঘ নির্ধারিত “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য” (Sustainable Development Goal‐SDG)-এর জন্য যে ১৭টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৬ নম্বরে (SDG 6) উল্লেখ করা আছে “সবার জন্য জল ও স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে”। জলের টেকসই ব্যবস্থাপনা জলের প্রাপ্যতাকেই শুধু নিশ্চিত করবে তাই নয়, খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, সর্বজনীন শিক্ষা, বাসস্থান সহ দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য”-(Sustainable Development Goal -SDG)-এর মূল উপাদানগুলি, যা জলসম্পদেরও উপর নির্ভরশীল তার রূপায়ণেরও সহায়তা করবে। টেকসই জল সম্পদ ব্যবস্থাপনার সার্থক রূপায়ণের মধ্যে দিয়েই সার্বিক “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য”–কে রূপায়ণ করা সম্ভব। জলসংকট মোকাবিলায় চাই সমন্বিত জল সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Integrated Water Resources Management)-এর পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ। নদী-নালা, পুকুর, হ্রদ, খাল-বিল ইত্যাদি ভূপৃষ্ঠস্থ জলসম্পদ, ভূগর্ভস্থ জলসম্পদ, বৃষ্টির জল, বর্জ্য জলের পুনর্ব্যবহার ও বর্জ্য জলকে পরিশোধন করে ব্যবহার ইত্যাদি সমস্ত জলসম্পদকে অন্তর্ভুক্ত করেই সমন্বিত জল সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে পরিকল্পনা করে রূপায়ণ করতে হবে। সমস্ত ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ ব্যবহারযোগ্য জলসম্পদকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে জল অপচয়কেও সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে।
তথ্যসূত্র :
১. Global Water Crisis, a report by UNU, INWEH, 2019
২. Water Security for All by UNICEF, 2021
৩. তপন সাহা, ‘পৃথিবী চরম জল সংকটের সম্মুখীন – জল সংকট ও আমদের কর্তব্য’, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত “প্রকাশিত জল সংকট ও জলের নানা কথা” পুস্তকের একটি প্রবন্ধ।