তরুণকুমার দত্ত
জৈবিক প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার তাগিদেই সমাজের সৃষ্টি। সমাজের গোড়ার কথাটা নিশ্চয়ই পারস্পরিক প্রয়োজনে একত্রে বাস করা। আদিম সমাজ, আধুনিক সমাজ — সে যাই হোক সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কোনও অর্থেই তা স্বনির্ভর সত্তা নয়। এই সমাজ তথা মানব সমাজ গড়ে তুলল মানব সভ্যতা। সভ্যতায় এসেই মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদটুকু শুধু আর রইল না। এখন জীবনধারণ শুধু নয়, জীবনশৈলীর উন্নয়নই হল লক্ষ্য। অন্যান্য প্রাণীরা যেমন মূলত প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে, মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে; মানুষ কিন্তু প্রকৃতির উপর একটু একটু করে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল। দুর্গম গিরি, গভীর অরণ্য, অতল সমুদ্রের গর্ভ থেকে শুরু করে পা ফেলল চাঁদে, ছুটে চলল গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বিজ্ঞান মানুষের মধ্যে এনে দিল দুরন্ত বেগ। এই উন্মত্ত আধিপত্যের তীব্র লালসায় মানুষ যে সভ্যতার সৃষ্টি করল, দ্বান্দ্বিক নিয়মেই সেই সভ্যতায় দেখা দিল বিরাট এক সংকট। সংকটটা কী? না মানুষ এখন আর নগরের থেকে অরণ্যে ফিরে যেতে পারবে না — ফিরে যেতে পারবে না প্রস্তর যুগে।
Brunowski তো বলেন প্রযুক্তি বিদ্যার দৌলতে মানুষ এই গ্রহে তার dominant position অর্জন করেছে। তাঁর কথায় মানুষ যেন প্রকৃতির প্রভু হয়ে উঠেছে। এই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে তাই মনে হওয়াই স্বাভাবিক — মানুষ প্রকৃতির প্রভু নাকি তার সন্তান। এখন মানুষকে প্রকৃতির সন্তান বলা হলে সভ্যতাগর্বী অহমিকা চূর্ণ হয়। আবার যৌক্তিক বিরোধও দেখা দেয়। সংকট সামলাতে না পারায় মানুষকে প্রভুও বলা যাবে না। সভ্যতায় বিজ্ঞান হল মানুষের গর্ব। এতদিন মানুষের কাছে, বিজ্ঞানীর কাছে সত্যের উপলব্ধিই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। বিজ্ঞানী তাঁর আবিষ্কারের কী পরিণতি ঘটবে সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবিচলিত থাকবেন। আবিষ্কারের ফলাফল সম্বন্ধে তিনি নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন। এতে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হল। তাই পরিণতির কথা ভেবে বিজ্ঞানের সঙ্গে নৈতিকতাকে যুক্ত করতে হল। এই নৈতিকতার বিষয়ে বিজ্ঞানী মহলে উৎসাহ দেখা দিল। বোঝা গেল বৈজ্ঞানিক কর্ম ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে চোখ বুজে থাকা বিজ্ঞানীদের উচিত নয়। তাঁদের নিশ্চয়ই দায়িত্ব বোধ করা উচিত তাঁদের আবিষ্কারের ফলাফল সম্বন্ধে। উনিশ শতকের শেষাবধি কিন্তু এই ধারণারই প্রাধান্য ছিল যে বিজ্ঞানের কাজ শুধু সত্যানুসন্ধান। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানের সামাজিক গুরুত্ব হঠাৎ পালটে গেল।যাই হোক সভ্যতার সংকট মুক্তির তাগিদে এল নবতর বিজ্ঞান ‘পরিবেশবিদ্যা’, পরিবেশ নীতিবিদ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সমাজ ও প্রকৃতির অন্তর্বর্তী সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়ল পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ওপর। বাস্তব সত্য হিসেবে উপলব্ধি হল — ‘মানুষ ও প্রকৃতি’র অন্তর সম্পর্কটি ক্রিয়াশীল হয় ‘মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতি’র আন্তরিক সম্পর্ক হিসেবে। এই গভীর পরিবেশ সমস্যা নিষ্পত্তির উপায় হচ্ছে সমাজ সাংস্কৃতিক, শিল্পগত ও আর্থিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি এবং নৈতিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি ঘটানো। এর জন্য দরকার বিজ্ঞান দর্শনের। এই দর্শন শুধু জ্ঞানের গুরুত্ব কী ব্যাখ্যা করে না। এই জ্ঞান কোন কোন উদ্দেশ্য সাধন করে, তাও স্পষ্ট করে। সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতে একে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেসব বিষয়ে ধারণাটি উন্নত করে তোলে। তার মানে শুধু জ্ঞান নয় দরকার প্রজ্ঞা। রাসেল একবার বলেছিলেন ‘হারিয়ে গেছে প্রজ্ঞা’। সেটা বুঝতে আমাদের একটু বেশি সময় লেগে গেল। এই দর্শন আমাদের জানাল জ্ঞানের অন্তত পক্ষে তিনটি দিক সম্বন্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। এই দিকগুলো হচ্ছে বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও মানুষের নৈতিকতা সংক্রান্ত জ্ঞান।
এখন প্রকৃতি-মানুষের সম্পর্কের সমন্বয় সাধনের একটা উদ্দেশ্য হল পরিবেশ রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করা। আগেই বলেছি আমাদের পেছনদিকে ফিরে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে পরিবেশ রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের সমস্যাটা প্রধানত যুক্ত অনেকগুলি আন্তর্জাতিক আইন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের সমাধানের সঙ্গে। এখানেই শেষ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর স্বার্থ, শিল্প সংস্থার স্বার্থ, অঞ্চল ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার স্বার্থ। এই স্বার্থগুলির বিবেচনা না-করাটা কোনও বাস্তববাদী পথ নয়। এই স্বার্থগুলির মধ্যে সাধারণ হল মানুষের স্বার্থ। যদিও মানুষের স্বার্থ বলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা anthropocentric হয়ে যাচ্ছে। তবু বিষয়টিকে একটু সহজভাবে বোঝার স্বার্থে সীমিত অর্থেই আপাতত গ্রহণ করা হল। মানুষের স্বার্থে পরিবেশের যুক্তিসংগত বিকাশে সহজ সমাধানের বাচিক উপায় হয়ে দাঁড়াল। একে একটা গাল ভরা নাম দিলাম ‘ইকো ডেভেলপমেন্ট’। এখন আবার সমস্যা এড়াতে একমাত্র ত্রাতা হল ‘ইকো’ শব্দটি। কোনও কিছুর সঙ্গে ‘ইকো’ শব্দটি যোগ করে দিলেই সাতখুন মাফ। কিন্তু আসল বিষয় হচ্ছে কোন্ আর্থসামাজিক ভিত্তিতে এই ‘ইকো ডেভেলপমেন্ট’ বাস্তবায়িত করা যাবে। যদিও মানুষ প্রকৃতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সংঘাত দেখা দিচ্ছে আজকের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতির পটভূমিতে। তবুও এই সংঘাতকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতির অন্তর্নিহিত ফল বলে গণ্য করা যায় না। এই সংকটের প্রধান কারণ হল পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা আর্থসামাজিক, আত্মিক ও ব্যবহারিক কাঠামো।[১] পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রকৃতিকে বল্গাহীন ও মাত্রাতিরিক্ত শোষণ করা হয়। আর বস্তুসামগ্রীর উৎপাদন চলে মুনাফার স্বার্থে। এটা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন ভোগবাদী স্বেচ্ছাচারিতা। এই মাত্রাতিরিক্ত শোষণে প্রকৃতি আত্মরক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর মানুষ হয়ে ওঠে সর্বশক্তিমান। এই পরিবেশগত সংকট এমন এক ক্রমবর্ধমান দুর্ভোগ সৃষ্টি করে যা থেকে পুঁজিবাদী সমাজ রেহাই পায় না। তাই পরিবেশগত সংকট আজ পুঁজিবাদের একটি সাধারণ সংকট।
এই সংকট এড়াতে হলে প্রকৃতির মাত্রাতিরিক্ত শোষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই পরিবেশগতভাবে যুক্তিসংগত উন্নয়নের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও সীমা আর সেই সঙ্গে বাহ্য উপাদান হিসেবে প্রকৃতির সীমারেখা নির্ধারণ পরিবেশগত মোকাবিলার কার্যনীতির একটি জোরালো দিক। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্য থেকে এই পরিবেশগত সংকটের সমাধান বাস্তব ক্ষেত্রে অসম্ভব। তাই দরকার আমূল সামাজিক সংস্কার। উলটোদিকে পুঁজিবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদরা চেষ্টা করছেন পরিবেশের সমর্থনে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলনকে নিজ স্বার্থে বশ করতে। পরিবেশগত সংকটের সঙ্গে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের স্পষ্ট বিরোধকে ধোঁয়াটে করে তুলতে। পরিবেশগত সমস্যাগুলি এইভাবে একটা জটিল রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে স্বার্থের সংঘাতের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে।
এই স্বার্থের সংঘাত একটা চরম পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত এই অবস্থার শেষটা অনুমান করা সম্ভব বলে মনে হয় না। একটু আগে anthropocentric ব্যাপারটাকে কিছুক্ষণের জন্য আগলে রেখেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা হল মানুষ ও প্রকৃতির যে সমন্বয়ী ঐক্যের ধারণা এতদিন ধরে চলে আসছে সেটা মূলত মনুষ্য-কেন্দ্রিক anthropocentric। একটু অন্যভাবে বললে ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’, এভাবে মানুষের স্বার্থই কেবল বিবেচিত হওয়া উচিত। মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত এই মতকে শক্তিশালী করে তোলে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনিবার্যভাবেই ‘নিঃশেষিত’ হয়ে যাবে। এই মনুষ্যকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বোধোদয় হওয়ার পর ১৯৭০-এর দশকে এটা ব্যাপকভাবে মনে করা হত যে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান প্রধাণত নির্ভর করে উন্নততর প্রযুক্তিবিদ্যার সৃষ্টির ওপর। আসলে এটা কোনও কাজের কথা নয়। উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক, মিথস্ক্রিয়া দিন দিন দুর্বল হতে চলেছে। আর মানুষ কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক সুখে মজে যাচ্ছে। Albert Einstein অনেক আগেই এটা বুঝেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল ভবিষ্যত প্রজন্মে প্রযুক্তি মানুষে মানুষে সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যাবে। পৃথিবীতে ভবিষ্যত প্রজন্মে থাকবে কিছু নির্বোধ মানুষ। তাঁর কথায় — “I fear the day technology will surpass our human interaction. The world will have a generation of idiots”.
Technology -র একটা মোহিনী ক্ষমতা আছে। না হলে আজ আর এত tech addict, gaming disorder, nomophobia হ্যানাত্যানা আরও হাজারো কত কী দেখছি কেন। আমরা শুধু যন্ত্রের দাস হইনি তার থেকেও অনেক অনেক বেশি। দাসরা তো জানে তারা মুক্ত নয়; সেই জ্ঞানটা তাদের আছে। আমাদের অবস্থাটা তাদের থেকেও অধম। Nassim Nicholas Taleb সুন্দর ভাষায় বললেন, “The difference between technology and slavery is that slaves are fully aware that they are not free”. এবার এই প্রযুক্তি শিল্পপতিদের হাতে এসে পুরো সমাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রও শিল্পপতিদের সঙ্গে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। মোবাইল আসার পর একটা নতুন পৃথিবী চলে এসেছে আমাদের কাছে। আর সেটা হল virtual world। এই virtual world আমাদের real world থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। তাঁর পর cyber security বিপন্ন। প্রযুক্তি যেমন আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে কিছু সুবিধা তেমনি আমাদের অন্য দিক দিয়ে নিঃস্ব করে তুলেছে। তাই আমরা খুইয়েছি বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক সত্তা ও ঐতিহ্যকে। তারপর তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিভাজনের গবেষণা আমাদের অস্তিত্বকে চারদিক থেকে গভীর বিপন্নতায় ফেলে দিল।
এই বিপন্নতার একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। উন্নত বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কীভাবে মানবজাতি ও জীবমণ্ডলের ওপর দানবীয় আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করা যায়, হিরোশিমা ও নাগাসাকি তার ভয়ংকর নজির। সেই থেকে নজিরহীন বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু অস্ত্রের নির্মাণ ও ব্যবহার বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক গভীর নৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং একই সঙ্গে এক যন্ত্রণাদায়ক পথ সন্ধান শুরু হয় এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। গুরুতর পরিবর্তন ঘটে তাঁদের মানসিকতায়, মূল্যবোধ ও অভিমুখিতায় এবং বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। জাঁ-জাকুয়স সালোমনের ভাষায়, “বিজ্ঞান তার দায়িত্ববোধের চাপে নিরপেক্ষতা বর্জন করে”।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে পারমাণবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিপদ গুরুতর আকারে দেখা দিয়েছে। তাই সভ্যতা ও প্রাণের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত সামাজিক পরিবেশগত দায়িত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে এবং এটা সমগ্র বিজ্ঞানী মহলকেই জড়িয়ে ফেলেছে। এটা লক্ষনীয় যে সামাজিক-পরিবেশগত সমস্যা এবং মানুষ ও তার বসবাসের পরিবেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের সমগ্র দিক প্রাধান্য অর্জন করায়, বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধের পরিবেশভিত্তিক পুনর্বিচারই শুধু দেখা দেয়নি বিজ্ঞানীদের মানবতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেও একটা পরিবর্তন এসেছে। তার ফলে সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি প্রয়োগের সম্ভাব্য সামাজিক-পরিবেশগত ফলাফলের মূল্যায়ন এবং এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপকতর, আরও সামগ্রিক আন্তঃবিভাগীয় দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের প্রয়াস সার্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিতে শুরু করেছে। এইসব প্রক্রিয়া থেকে প্রমাণ মেলে যে বিজ্ঞানীরা এখন সামাজিক পরিবেশগত দায়িত্ব বেশি করে উপলব্ধি করছেন। তাতে আসল সমস্যার কত দূর সমাধান হচ্ছে সেটা আমরা বুঝতে পারছি এবং সময় আমাদের আরও গভীরভাবে বুঝিয়ে দেবে।
এবার মহাকাশে কর্তৃত্ব স্থাপনের ব্যাপারটায় আসা যাক। পরিবেশ-সমস্যা মোকাবিলার প্রশ্নে প্রায় সময়ই মহাকাশে কর্তৃত্ব স্থাপনের বিষয়টির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়। কিন্তু যখন পৃথিবীতেই মানুষের জীবন সুসংগঠিত করা যাচ্ছে না, বরঞ্চ পার্থিব প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় অবনতি বিপন্ন করে তুলেছে প্রাণের অস্তিত্বকেই, তখন মহাকাশে মানুষের কী প্রয়োজন? বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যাক্স বোর্ন মহাকাশ যুগের সূচনায় বলেছিলেন, “মহাকাশ-পরিক্রমা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিজয় কিন্তু যুক্তির শোচনীয় পরাজয়।” কিন্তু স্মৃতি কি তাই? বেশ কিছু পরিবেশ বিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ ও অন্যান্য কিছু ব্যক্তি মনে করেন যে পৃথিবীতে পরিবেশগত সমস্যার বাস্তবতা ও গুরুত্ব সম্বন্ধে ব্যাপক উপলব্ধ এসেছে মহাকাশযানগুলির প্রদত্ত চন্দ্র, মঙ্গল, শুক্র ও অন্যান্য গ্রহের ছবি থেকে। তবে এটা বলা যেতেই পারে মহাকাশচারণবিদ্যা অন্ততপক্ষে পরিবেশ সমস্যাটি উত্থাপন করতে পেরেছে ও আমাদের সচেতন করে তুলেছে। এটা বলতে পারা যায়ই পৃথিবী থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য মানুষ মহাকাশে অভিযান চালাচ্ছে না; বরং নিছক ‘পার্থিব’ প্রয়োজনেই এটা ঘটছে। বরঞ্চ এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের গবেষণায় এবং এগুলি বহু পরিবেশগত বাঁধা ও অশুভ ঘটনা মোকাবিলা করতে সহায়ক হবে।
একেবারে শেষে প্রশ্ন জাগে এই পৃথিবীতে কে প্রভু মানুষ না প্রকৃতি? এ বিষয়ে মার্কসের অভিমত প্রকৃতিকে “বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে — মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন স্থির প্রকৃতি — মানুষের কাছে কিছুই নয়”। এর অর্থ কোনোক্রমেই এটা নয় যে প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষ এক ধরনের অহংসর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে। মানুষ প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে পারে একমাত্র মানুষের দৃষ্টিতে ও মানবিক আবেগ অনুভবের মাধ্যমে। প্রকৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ন্যায্যতা ও সত্যতায় কেউ যদি আস্থা না রাখেন, তাহলে তাকে প্রকৃতিতে ‘হস্তক্ষেপ না-করার’ অবস্থান নিতেই হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। মানুষের প্রতি ও মানুষের প্রয়োজনীয় প্রকৃতির প্রতি সেটা সুবিচার করা হবে না। একেবারে শেষে রেচেল কার্সন-এর মতটিকে আমাদের মননে নিয়ে আসা দরকার বলে একটু দেখে নেওয়া যাক —
“The modern world worships the gods of speed and quantity and of the quick and easy profit, and out of this idolatry monstrous evils have arisen”.
তথ্যসূত্র :
১) বি. এম. সাকলায়াস্কি, ‘দি ইকোলজিকাল বুমেরাং : ক্লাস আসপেক্ট অব দি প্রব্লেম অব প্রোটেকটিং দি এনভায়রনমেন্ট’, ১৯৮০