কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ — জিন চাষ, চুক্তি চাষ ও ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে তার প্রভাব

সৌমিলি বেরা

“If agriculture goes wrong, nothing else will have the chance to go right” — MS Swaminathan

ভারতের সবুজ বিপ্লবের কান্ডারি মানকম্বু সম্বাসিভান স্বামীনাথনের এই উক্তি নিছক মুখের কথাই নয়, এ এক ধ্রুব সত্য যা বার বার মনে করিয়েছে আমাদের কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষের আপামর জনগণকে এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত কঠিন বাস্তবটিও। যে দেশে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে কৃষিকর্মের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে কৃষির সার্বিক উন্নয়ন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। তাই তো আমরা এখনও বলি — “agriculture is the soul of India” — কৃষিই ভারতবর্ষের আত্মা, এবং তাই এখনও আমরা বার বার মাটির টানেই ফিরে যাই। এখনও চষা মাটির সোঁদা গন্ধে আমাদের বুকের ভেতরটা আনচান করে ওঠে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন শুধু সামাজিকই নয়, আবহাওয়ারও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে এই কয়েক বছরে, বিজ্ঞানীরা যাকে “climate change” বলে অভিহিত করেছেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব “struggle for existence and survival of the fittest” অনুযায়ী আমাদের বাস্তুতন্ত্রও নিজেদের রূপ বদলাচ্ছে নিজেকে এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। বদলাচ্ছে মাটি, শস্যের ধরন ও তাদের বিভিন্ন চাহিদা, তাই কৃষকদেরও তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিরাচরিত প্রথাগত উপায়ে কৃষিপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটানো একান্তই প্রয়োজনীয়।

চাহিদাই উদ্ভাবনের মূল, তাই ভারতীয় কৃষির সমৃদ্ধির জন্য কৃষকরা বেছে নিয়েছে তাদের চিরাচরিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ ছাড়াও কিছু বিকল্প উপায়। এদের উদ্ভাবন পাশ্চাত্যে হলেও ভারতে এ ধরনের new age agricultural approaches যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হিসাবে নাম করতেই হয় জিন চাষ ও চুক্তি চাষের কথা, যা দেশের কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে বেশ কয়েক দশক ধরে, এবং যা আজও বজায় রয়েছে। কিন্তু কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের কারণে দেখা গিয়েছে নানান সমস্যা। অর্থনীতিবিদ ও প্রকৃতিবিদরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন জিন চাষ বা চুক্তি চাষের প্রযোজনীয়তি নিয়ে। জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন তাদের ক্ষতিকর দিকগুলো। ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাব, চুক্তি চাষ, জিন চাষের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা, কৃষিতে এদের অবদান ও এদের থেকে উৎপন্ন নানাবিধ সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে এই প্রবন্ধে।

চুক্তি চাষ ও ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব

আমাদের দেশে চুক্তি চাষের সূচনা বলতে গেলে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। প্রাক্-স্বাধীনতার সময়কালীন নীল চাষিদের ওপর শ্বেতাঙ্গ নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কথা তো ইতিহাসের পাতায় এক বিশাল অংশ জুড়েই রয়েছে। এককথায় বলতে গেলে চুক্তি চাষ হল পূর্বনির্ধারিত দামের ভিত্তিতে কোনও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষকদের চুক্তির মাধ্যমে চাষের ব্যবস্থাপনা। Pepsico-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পশ্চিম ভারতে টমেটো চাষ, 1948-50 সালে Gujarat-এ Anand Milk Co-operative limited (AMUL)-এর চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে এই চুক্তি চাষেরই অবদান। বাজার মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, বা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণবশত প্রায়ই দেখা যায় যে কৃষকেরা কঠোর পরিশ্রমের পরেও ক্ষতির সম্মুখীন। এই ঝুঁকিই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের দেশের কৃষির বৈচিত্র্যকরণের পথে, এবং প্রশাসন ও অর্থনীতিবিদদের একাংশ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, চুক্তি চাষই এই দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার এক অন্যতম হাতিয়ার। 

কিন্তু এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন সমস্যাও। চুক্তিগুলি সম্পন্ন হয় প্রধানত কর্পোরেট বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে, মুনাফা অর্জন করাই যাদের প্রধান লক্ষ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ভারতীয় কৃষিকে সমৃদ্ধ করা নিছকই গৌণ একটি বিষয়। এ সূত্রে Indian Institute of Management (Ahmedabad)-এর অধ্যাপক শুকপাল সিং বলেছেন, “চুক্তি চাষ কেবলমাত্র কোম্পানির স্বার্থবাহী, এটা কোনোভাবেই কৃষকের স্বার্থে পরিচালিত নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বা বাজারে দাম অস্বাভাবিক হারে পড়ে গেলে কৃষকেরা বিরাট ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

চুক্তি চাষের কুপ্রভাব এর কথা বলতে গেলে উল্লেখ করতেই হয় পাঞ্জাবের চাষিদের সঙ্গে পেপসিকোর চুক্তির কথা। Pepsico, এক বিশ্ববিখ্যাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের অতিজনপ্রিয় “lays” এর জন্য পাঞ্জাবের কিছু চাষিকে তাদের রেজিস্টার্ড করা আলুর variety-র বীজ দেয়। চুক্তির নিয়মানুসারে চুক্তির মেয়াদ ফুরোলে সেই ফলন পেপসিকোর কাছেই বিক্রি করে চাষিরা লাভের মুখ দেখে। এখানে বলে রাখা ভালো, যে এই চাষিরা প্রায় সকলেই বৃহৎ ও মাঝারি চাষি (large and medium farmers)। যে দেশের আশি শতাংশেরও বেশি কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, সেখানে এই চুক্তি চাষের ভূমিকা ভারতের সামগ্রিক কৃষিক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে উঠেছে গভীর প্রশ্ন। একটু খতিয়ে দেখলেই জানা যায় যে, চুক্তি চাষের এই চুক্তি হয় শুধুমাত্র আর্থ-সামাজিক ভাবে যথেষ্ট সচ্ছল বৃহৎ ও মাঝারি চাষিদের সঙ্গেই। এর ফলে যে দেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে থাকা বিস্তর ফারাকটি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে গরিব চাষিরা বাজারে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে, বা বাজারে এই প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছে নানান অসুদপায় অবলম্বন করতে। 

২০১৯ সালে গুজরাতে নয়জন ক্ষুদ্র চাষি পেপসিকোর সম্মতি ছাড়াই রেজিস্টার্ড বীজ রোপণ করে নিজেদের ব্যক্তিগত চাষের জমিতে। পরবর্তীকালে পেপসিকো প্রত্যেকটি চাষির কাছ থেকে এক কোটি টাকারও বেশি জরিমানা আরোপ করে। এ আর নতুন করে বলে দিতে হবে না, যে ভারতবর্ষের দিন-আনা-দিন-খাওয়া ক্ষুদ্র চাষির পক্ষে এই বিশালাকায় অঙ্কের জরিমানা দেওয়া শুধুমাত্র অসম্ভবই নয়, অকল্পনীয়ও বটে।

পশ্চিমবঙ্গেও চুক্তি চাষকে কেন্দ্র করে ঘটেছে অনেক বিতর্ক। সর্বভারতীয় কিষান সভা (AKIS)-এর ৩৭তম সম্মেলনে বিস্তারিত আলোচনার পর প্রতিনিধিরা চুক্তি চাষের ফলে বঙ্গের কৃষকদের সমস্যার কথা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বর্ধমান ও হুগলি জেলার গ্রামে গ্রামে কৃষকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এক বছরে ২১৮টির মতো কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এ রাজ্যে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়েছে চুক্তির পর চাষীদের ফসল নষ্ট হওয়া, ও তার পরিণতি স্বরূপ কৃষকদের নানান ঋনের বোঝায় জর্জরিত হওয়া। এ যেন এক অভিমন্যুর চক্রব্যূহ, যার থেকে পরিত্রাণের রাস্তা পশ্চিমবঙ্গের চাষিরা এখনও ভেবে উঠতে পারেনি।

চুক্তি চাষের আরও কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা যাক এখানে। দেশের ৩০ শতাংশের মতো চাষি আজও নিরক্ষর, তাই লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন সেই সমস্ত প্রান্তিক চাষিদের কাছে সম্ভবপর নয়। কৃষকদের এই নিরক্ষরতা বা চুক্তিপত্র যে ভাষাতে লেখা সেই নির্দিষ্ট ভাষার ওপর অজ্ঞতার অন্যায় সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোটার ঘটনাও খুব একটা বিরল নয় আমাদের এই দেশে। আইন অনুযায়ী, চুক্তিপত্র একবার স্বাক্ষর হয়ে যাওয়ার পর, কৃষকদের কাছে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার রাস্তা কিন্তু চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়, তাই এই চুক্তি চাষ এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষিদের কাছে জীবনদায়ী হওয়ার বদলে গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে আরও কিছু বৃহত্তর সমস্যা। বেশ উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে চুক্তি চাষের হাত ধরে কীভাবে ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে আমাদের দেশে কৃষির কর্পোরেটকরণ, যার ফলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলি ধীরে ধীরে কবজা করে নিচ্ছে বাজার, নিয়ে নিচ্ছে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নিজেদের হাতের মুঠোয়; যা কোনোমতেই দেশের অর্থনীতির পক্ষে সুখবর নয়। এছাড়াও, দেশের খাদ্যসুরক্ষার পক্ষে চুক্তি চাষ এক অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও আমাদের দেশের কৃষকরা চুক্তির জালে আবদ্ধ হচ্ছে এবং এর ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতি যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আমাদের সকলের উচিত, অতি সত্বর চুক্তি চাষের এই নানাবিধ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা, বা অন্য কোনো বিকল্প উপায়ের সন্ধান করা, যার হাত ধরে দেশে কৃষির বৈচিত্র্যকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন একই সূত্রে অগ্রসর হতে পারে।

জিন চাষ — প্রকৃতিবিরুদ্ধ না জীবনদায়ী?

যেকোনো জীবের, সে উদ্ভিদই হোক বা প্রাণীর, সমস্ত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত থাকে ক্রোমোজোমের মধ্যে থাকা জিনের ভেতরে। ফসলের ক্ষেত্রেও তাই। তাদের ফলনের পরিমাণ, গাছের উচ্চতা, অপর্যাপ্ত আবহাওয়াকে সহ্য করে টিকে থাকার ক্ষমতা, এসব রহস্যের চাবিকাঠি সেই জিনের মধ্যেই।

বৈজ্ঞানিকরা তাই এই জ্ঞানকেই কাজে লাগিয়ে বদলে দিচ্ছে ফসলের জেনেটিক রূপ। এতে বাড়ছে ফলন ও কমছে আবহাওয়ার ওপর চাষিদের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, কমছে রাসায়নিক সার ব্যবহারের হার, ও কমছে খরচা। স্বামীনাথনের হাত ধরে এই জিন চাষই এনে দিয়েছে যুগান্তকারী সবুজ বিপ্লব। আজ যে আমরা বাজারে এত ধরনের ধানের সন্ধান পাচ্ছি, এবং সোনালি ধান বা golden rice-এর মতো নিত্যনতুন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যের যে খোঁজ মিলছে, তা এই জিন চাষের মাধ্যমেই সম্ভবপর হয়েছে।

কিন্তু জিন চাষের গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে কিছু সমস্যাও। লাভের সাথে সাথেও সমানতালে চলছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতিসাধন। এই ক্ষতির ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতেই হয় বহু বিতর্কের মূল বিটি তুলো (BT cotton)-এর কথা। বিটি তুলো, বা যেকোনো বিটি শস্যই হল জিন রূপান্তরিত উদ্ভিদ, বা genetically modified crop। বিটি কথাটি এসেছে Bacillus thuringiensis থেকে। Bacillus thuringiensis এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যার জিন উদ্ভিদের মধ্যে কৃত্রিমভাবে প্রবেশ করিয়ে বৈজ্ঞানিকরা উদ্ভিদকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তোলে। বিটি প্রযুক্তি প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৯৩ সালে আমেরিকাতে, এবং ভারতে এর প্রবেশ ২০০২ সালে Monsanto-Mahyco কোম্পানিদ্বয়ের হাত ধরেই। চটকদার বিজ্ঞাপনে এও প্রচার করা হয় যে, সাধারণ বীজ ব্যবহার করে প্রচলিত নিয়মে চাষই কৃষকদের সমস্ত দুর্ভাগ্যের কারণ ও জিন রূপান্তরিত বীজ (GM seeds)-ই হল এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। এজাতীয় বীজে নাকি সার ও কীটনাশকের ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে লাঘব হয়। অনাবশ্যক ভাবেই বিজ্ঞাপনের জেরে চাষিদের, প্রধানত পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের তুলো চাষিদের মধ্যে এই বিটি তুলো চাষ করার হিড়িক লেগে যায়।

অন্ধ্রপ্রদেশের এক সংস্থা, The Andhra Pradesh Coalition in Defense of Diversity (APCDD), তেলেঙ্গনার ওয়ারাঙ্গালে এক সমীক্ষার আয়োজন করে ২০০৩-০৪ সালে এই বিটি শস্যের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত কুপ্রভাবগুলি জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য। এতে দেখা যায় যে চাষ বাবদ মোট খরচের পনেরো শতাংশের মতো লেগে যায় বিটি বীজ ক্রয় করতে, যেখানে সাধারণ তুলোবীজের খরচ মোট খরচের মাত্র পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। শুধু তাই না, Monsanto-Mahyco-র বিজ্ঞাপনে বিটি বীজের যে গুণাগুণ সম্পর্কিত সুদীর্ঘ দাবি করা হয়েছিল, তা প্রায় নস্যাৎ করে দেখা যায় যে সাধারণ বীজের ফলন (১৭২৫ কেজি/হেক্টর) সেই বছরে বিটি তুলোর ফলনের থেকে বেশ কিছুটা বেশি।

কিন্তু এই জিন চাষ নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড়ো বিতর্ক এখানেই শেষ নয়। আমাদের দেশের চাষিরা সকলেই প্রায় প্রথম বছরের উৎপাদিত ফসল থেকে সংরক্ষিত করে রাখে বীজ দ্বিতীয় বছরে তাদের জমিতে বপন করে বীজ ক্রয়ের খরচা হ্রাস করার জন্য। কিন্তু বিটি শস্যের বীজ সংরক্ষণ করে রেখে চাষিরা এক অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করে। দেখা যায়, যে জমিয়ে রাখা একটিও বীজ দ্বিতীয়বারের জন্য কোনো ফলন দিতে অক্ষম, এমনকি সে সমস্ত বীজের অঙ্কুরোদ্গমও হয় না। এর ফলে নিরুপায় চাষিরা বাধ্য হয় ঋণ নিয়ে আবার বছরের পর বছর নতুন করে কোম্পানির কাছে বিটি তুলোর বীজ কিনতে। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক এখনও বর্তমান। বৈজ্ঞানিক মহলের একাংশ মনে করে যে Monsanto তাদের বিটি বীজে “cry gene” (যেটি উদ্ভিদের কীটনাশকঘাতী ক্ষমতার জন্য দায়ী) ছাড়াও বেআইনি ভাবে প্রবেশ করিয়েছে “terminator gene”। এই terminator প্রযুক্তির কাজ হল এমন বীজ তৈরি করা, যার নিজের অঙ্কুরোদ্গম এর ক্ষমতা ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এদেরকে বলা হয় ‘suicide seeds’। এই সুইসাইড বীজকে ঘিরে শয়ে শয়ে ভারতীয় চাষিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; জন্ম নেয় ‘Cremate Monsanto’-র মতো অভিযান, যেখানে বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা কোম্পানির পরীক্ষামূলক জমিতে অগ্নিসংযোগ করে দেয়।

জিন চাষের ঝুঁকি শুধু আর্থসামাজিক দিক থেকেই নয়, এর পরিবেশগত প্রভাবও আজ বিজ্ঞানীমহলকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। রেচেল কার্সন তাঁর বই ‘Silent Spring’-এ লিখেছেন— “But man is a part of nature, and his war against nature is inevitably a war against himself”। সত্যিই তো, প্রকৃতির আপন চালের ছন্দপতন ঘটানোটা এক অপরাধই বটে । মানুষের স্বার্থে প্রকৃতির বিকৃতিকরণের পরিণাম হয়ে উঠছে ভয়ানক, যা পরিবেশবিদরা বেশ ভালোরকম ভাবে আঁচ করতে পারলেও, দেশের জনসাধারণ এখনও এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট অজ্ঞ। কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা যাক এখানে।

Herbicide সহনকারী খাদ্যশস্যের variety এই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিরই ফলাফল। যার জন্যে চাষিদের কাছে glyphosate বা bromoxynil-এর মতো broad spectrum আগাছানাশকের ব্যবহার সুবিধাজনক হয়েছে। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণাম হয়ে উঠেছে ভয়ংকর। দেখা গেছে যে, এসব ক্ষতিকর রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে হারাচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য। জন্মের পর বহু পশু-পাখিদের মধ্যে নানান বিকৃতি দেখা দিচ্ছে এবং জলজ জীবনেরও প্রাণহানি ঘটাচ্ছে এই মারণ রাসায়নিক। ঘটাচ্ছে eutrophication, জৈব magnification এর মতো প্রাকৃতিক সংকট। মানুষের শরীরেও আজ খাদ্যশস্যের মধ্য দিয়ে ঢুকছে মারণ বিষ।

শুধু তাই নয়, জিন চাষের ফলে আরও গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে মানুষের স্বাস্থ্যেও। বাইরে থেকে নতুন কোনো জিন যখন কোশের অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়, তা ঠিকঠাক সনাক্তকরণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য আরও এক বা একাধিক জিনও তার পাশাপাশি প্রবেশ করানো হয়, যার প্রকাশ আমরা বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারি। এর মাধ্যমে প্রধান resistant জিনের প্রতিষ্ঠা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল কিনা তা বুঝতে বৈজ্ঞানিকদের খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। এ সমস্ত জিনদের বলা হয় marker genes। দেখা গেছে যে, marker genes হিসাবে যেসমস্ত জিনকে বেছে নেওয়া হয়, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিক resistant জিন। খাদ্যশস্যের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক resistant gene থাকার দরুন অদূর ভবিষ্যতে মানুষের স্বাস্থ্যে যে কী প্রভাব পড়বে, তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।

জিন চাষের ফলে ক্রমাগত কমছে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যও। কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা খাদ্যশস্যের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় প্রজাতি বা landraces। বেশ কিছু বছর আগেও বাংলার গ্রামে-গঞ্জে যেসব ধানের প্রজাতির ব্যাপক হারে চাষ হত, বাজারের প্রতিযোগিতার জাঁতাকলে পড়ে আজ তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিলুপ্তির পথে। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির অতি পরিচিত রামশাল, তুলাইপঞ্জি, কনকপানি, এবং বদলাচ্ছে বাংলার সংস্কৃতি।

পরিবেশবিদদের মতে, সবুজ বিপ্লবের জেরে উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর সঙ্গে ক্ষয় হয়েছে আমাদের দেশের বিশাল জীববৈচিত্র্যের। বেশি লাভের লোভে পড়ে চাষিরা বারংবার একই খাদ্যশস্যের চাষ করে চলেছে একই মাটির ওপর, যা নিঃশেষ করে দিচ্ছে মাটির উর্বরতা। সবুজ বিপ্লব ভারতের বৃষ্টিনির্ভর চাষাবাদের এলাকাগুলিতে না পৌঁছাতে পারার কারণে বেড়েছে সমাজের শ্রেণির মধ্যে থাকা ফারাক। পরিবেশবিদ গ্রিফিন তার ‘The political economy of Agarian Change’ বইতে তাই বলেছেন — “The green revolution in India has clearly accentuated the ongoing trend towards regional inequality; it has not reversed it.” এইসমস্ত করণগুলিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জিন-বদলানো শস্য ব্যবহারের নিরাপত্তা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

যদিও এই বিশ্বায়নের যুগে কৃষির সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ অপরিহার্য, তবুও এই বানিজ্যিকীকরণ যখন জনগণের খাদ্যসুরক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা যেকোনো দেশের পক্ষেই এক চরম সংকটের আকার নেয়। তাই, বাণিজ্যিকীকরণের পূর্বে ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উচিত জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ ও রাষ্ট্রীয় স্তরে যথেষ্ট পরিমাপে কৃষকদের জন্য সুরক্ষাজালের ব্যবস্থা করা। যা না করা হলে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ সামাজিকভাবে ঝুঁকিবহুল হয়ে উঠবে ও প্রকট হয়ে উঠবে পূর্বালোচিত সংকটগুলি।

উপসংহার

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ অবশ্যম্ভাবী। প্রশাসনের দায়িত্ব এর সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্যাগুলির সত্বর সমাধান খুঁজে বার করা, এবং দেশের আইনব্যবস্থাকে কৃষকদের স্বার্থ সহায়ক করে তোলা। এদেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে আমাদেরও উচিত, ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের দিকে প্রশাসনের দৃষ্টি যাতে বজায় থাকে তার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। করোনা পরবর্তী যুগে যেখানে শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, সমস্ত ক্ষেত্রেই জাতীয় আয়ের হার ক্রমশ নিম্নগামী, সেখানে কৃষিক্ষেত্রের আয়ের হার ২০২০-২১ সালে ৩.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কৃষিক্ষেত্রের বিকাশ ছাড়া দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। এই যান্ত্রিক, ডিজিটাল যুগেও কৃষকেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে দেশের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, সশ্রদ্ধ সম্মান দিচ্ছে দেশের মাটিকে। এ প্রসঙ্গে কবিগুরুর কলমে লেখা “গুরু” নাটকের এক যূনকের বলে ওঠা কথা মনে পড়ছে — 

“চাষ করি বৈকি, খুব করি! পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি!”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান