কৌস্তভ সাহা
মানব সভ্যতার ক্রমোন্নয়ন আর তারই সঙ্গে নিরলস অর্থনৈতিক বিকাশ — এই দুই যে পরিবেশ ও প্রকৃতির বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে ও প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে একথা আজ সর্বজনবিদিত। বিদ্যালয় পাঠক্রমে পরিবেশ বিদ্যার অন্তর্ভুক্তিকরণ থেকে শুরু করে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন, জীবাশ্ম জ্বালানির সীমিত ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জনে উৎসাহ প্রদান — এই সবই মানুষের ক্রমবর্ধমান পরিবেশ সচেতনতার প্রতীক। বিগত তিন চার দশক ধরেই প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান (Natural and Social Science) মহলে পরিবেশ সংকট একটি বহুল চর্চিত বিষয়, বিশেষজ্ঞরা এই ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা চালাচ্ছেন। ভূতাত্ত্বিক গবেষণা অনুযায়ী, মানব প্রজাতির কর্মকাণ্ড আজ আগ্নেয়গিরি ও হিমবাহ চক্রের ন্যায় প্রাকৃতিক পার্থিব শক্তির সমান্তরাল এক শক্তিতে উপনীত হয়েছে। যা প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করতে সক্ষম। প্রকৃতির ওপর মানুষের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞান মহলের একাংশ সম্প্রতিককালে দাবি করেছে যে পৃথিবী এক নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগে পদার্পণ করেছে। যাকে অ্যানথ্রোপোসিন (Anthropocene) নামে অভিহিত করা হচ্ছে, এর অর্থ মানুষের যুগ।
নোবেল জয়ী রসায়নবিদ পল ক্রুটজেন ২০০০ সালে এই অ্যানথ্রোপোসিন নামক নতুন ভূতাত্ত্বিক মুখের ধারণাটি উত্থাপন করেন (Bonneuil and Fressoz 2016)। বিজ্ঞানীদের অধিকাংশ যদিও মনে করেন যে পৃথিবী এখনও ভূতাত্ত্বিক সময়রেখা (Geological Time Scale) অনুসারে হলোসিন (Holocene) যুগেই অবস্থান করছে। কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দে মানুষের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে ‘সাব কমিশন অফ কোয়াটারনারি স্ট্যাটিগ্ৰাফি’ (Sub commission of Quaternary Stratigraphy) ২০০৯ সালে অ্যানথ্রোপোসিন ওয়ার্কিং গ্ৰুপ (Anthropocene Working Group, AWG) গঠন করে তার উপর অ্যানথ্রোপোসিন প্রস্তাবটির বিজ্ঞানসম্মত গুরুত্ব খতিয়ে দেখার দায়ভার আরোপ করে। প্রায় এক দশক ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১৯ সালে AWG যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে অ্যানথ্রোপোসিন ভূতাত্ত্বিক সময়রেখায় অন্তর্ভুক্ত করার এবং এই ধারণাটিকে বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সপক্ষে পর্যাপ্ত প্রমান দেওয়া হয় (Zalasiewicz et al. Eds. 2019)।
অ্যানথ্রোপোসিন বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্নের অবকাশ না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা এর সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। একদিকে যেমন অ্যানথ্রোপোসিনের আগমন অধিকাংশের কাছেই উৎকন্ঠার বিষয়, অপরদিকে একদল একে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, এই নতুন যুক্তির আবির্ভাব প্রকৃতির কাছে মানুষের সহায়তা ও পরাধীনতার অবসান ঘোষণা করে যা সমগ্র মানবজাতির জন্য এক বিরাট সাফল্য (Bonneuil in Hamilton et al. Eds. 2015)।
যদিও পরিবেশ বিপর্যয়বাদীদের (Eco-Catastrophists) মতানুসারে অ্যানথ্রোপোসিন পরিবেশ ও প্রকৃতির ক্রমাবনয়নের সূচক, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) সহ আরও বিভিন্ন গ্রিন হাউস গ্যাসের ক্রমবর্ধমান ভাণ্ডার বিশ্বের উষ্ণায়নের সংকট ডেকে এনেছে। যা মেরু প্রদেশের বরফের বিগলনকে তরান্বিত করেছে আর এর ফলস্বরূপ সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা বেড়ে আগামী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে বর্তমান স্থলভাগের বহু অংশ প্লাবিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ঘনিয়ে এসেছে। এছাড়াও এসিড বৃষ্টির ফলে সমুদ্রের জলে এসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে যা সামুদ্রিক জীবেদের ক্ষতিসাধন করছে এবং অরণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। পরিবেশের এই পরিবর্তন মনুষ্যকুলের জন্য অনুকূল নয়। মানব শাস্ত্রের উপর পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব আজ সর্বজনবিদিত তাই এই প্রবন্ধে সেই সম্পর্কে বিশদ আলোচনা নিরর্থক। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কৃষিকার্য ব্যাহত হওয়ার বিপুল আশঙ্কা রয়েছে। আগামী দিনে এর ফলস্বরূপ মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষের চিত্র অদূর ভবিষ্যতে আমরা দেখতে চলেছি (Fosten and Clark 2022; lPCC 2021)।
সুতরাং আমাদের চেনা পৃথিবীটা ধীরে ধীরে একটু একটু করে অচেনা হয়ে উঠছে এবং আগামী দিনগুলিতে আরও অচেনা হয়ে উঠতে চলেছে। যার সঙ্গে সমন্বয় বিধান করতে মানুষকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু শুধু এই কারণ কি অ্যানথ্রোপোসিন নিয়ে বিজ্ঞানীদের কপালে ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট? কারণ পরিবর্তন এ মহাবিশ্বের একমাত্র অপরিবর্তনীয় নিয়ম। পৃথিবী তার সাড়ে-চারশো কোটি বছরের ইতিহাসে ব্যাপক ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে এবং আগামী দিনেও যে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। যেখানে সাগর-মহাসাগর পর্বত এসব সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছে সেখানে পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তন খুবই সামান্য ঘটনা। যে পরিবেশের সঙ্গে আজকের মানুষ পরিচিত যার নিরিখে সে পরিবেশের পরিবর্তন যাচাই করছে সেই হলোসিন যুগের ব্যাপ্তি ভূতাত্ত্বিক সময়রেখা অনুসারে মাত্র সাড়ে-এগারো হাজার বছর। উপরন্তু সমগ্র হলোসিন যুদ্ধ জুড়েই যে পরিবেশ ও প্রকৃতি স্বরূপ এক ও অভিন্ন রয়েছে তা কখনোই নয়। অতএব অ্যানথ্রোপোসিন নামক এক নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগের আগমন কখনোই অপ্রত্যাশিত হওয়া উচিত নয়, হতে পারে অ্যানথ্রোপোসিন যে ধরনের পরিবর্তন ডেকে আনছে তার জন্য মানুষ অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে এবং হতে চলেছে। তবে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির আনুকূল্য ও প্রতিকূলতার মাঝে নিজের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই মানুষের কাজ। তাহলে এমনকি গূঢ় কারণ নিহিত রয়েছে অ্যানথ্রোপোসিনের মধ্যে যা চিন্তার উদ্রেক করছে? চিন্তার আসল বিষয় হল অবলুপ্তির আশঙ্কা। পৃথিবীর শাসন আজ পুরোপুরি না হলেও, অনেকটাই মানুষের হস্তগত, কিন্তু যে পথে মানুষ পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে তাতে সে নিজেই নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে। এখনও অবধি পৃথিবীতে পাঁচবার বৃহদাকার বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে (Mass Extinction)। প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যধিক হস্তক্ষেপের ফলে জীববৈচিত্র্য যে হারে হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে তাতে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে শীঘ্রই পৃথিবী ষষ্ঠ বৃহদাকার বিলুপ্তির সম্মুখীন হতে চলেছে (Barnosky et al. 2012)। এক গবেষণা অনুসারে বিগত শতাব্দীতে যে সংখ্যক মেরুদণ্ডী প্রাণীর অবলুপ্তি ঘটেছে তাতে হয়তো ৮০০ – ১০০০০ বছর লাগতো যদি মানুষের প্রকৃতির উপর এই অপরিসীম হস্তক্ষেপ না থাকত (Ceballos et al. 2015)। বিজ্ঞানমহল বিভিন্ন গবেষণা থেকে এই সংকেত পাচ্ছে যে ষষ্ঠ বিলুপ্তি (Sixth Mass Extinction) আসন্ন। মানব প্রজাতির অস্তিত্ব আজ এক বড়ো প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। যে ষষ্ঠ বিলুপ্তির আশঙ্কা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বারে বারে সচেতন করছেন তাতে যদিও বা মনুষ্যপ্রজাতি বিলুপ্ত নাও হয়, মানুষের পক্ষে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা বেশ মুশকিলজনক। কারণ জীব মণ্ডলে সমস্ত প্রজাতি একে অপরের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। নিজের অস্তিত্ব কায়েম রাখার জন্য তাই বিপুল সংখ্যক জীবের বিলুপ্তি ঘটলে মানব প্রজাতির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং এক কথায় বলতে গেলে অ্যানথ্রোপোসিন যুগের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বের সংকট (Existential crisis) ঘনীভূত হয়েছে।
অ্যানথ্রোপোসিন না ক্যাপিটালোসিন (Capitalocene)?
অ্যানথ্রোপোসিন কথাটি দুটি গ্ৰীক শব্দের সমন্বয়ে তৈরি। ‘অ্যানথ্রোপোস’ (Anthropos) তার অর্থ হল মানুষ; এবং ‘কাইনোস’ (Kainos) যা থেকে ‘সিন’ অংশটি এসেছে যার মানে হল নতুন বা সাম্প্রতিক। অতএব অ্যানথ্রোপোসিন শব্দের সমার্থ দাঁড়ায় মানুষের নতুন যুগ। বস্তুত অ্যানথ্রোপোসিন ধারণাটি সমগ্র মানবজাতিকে বিশ্বব্যাপী এই পরিবেশ সংকটের জন্য দায়ী করে যা সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট আপত্তিজনক। প্রকৃতি ও পরিবেশের অমার্জিত যথেচ্ছ ব্যবহার যা মানব প্রজাতিকে আজ অস্তিত্বের সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে তাতে মানবজাতির প্রত্যেক সদস্যের ভূমিকা কিংবা প্রত্যেকের অবদান কখনোই সমান নয়। এমন কি মজা করে কেউ কেউ এমনও বলছেন যে পোলার বিয়ার(মেরু ভল্লুক) কিংবা ওরাং ওটাং এরা প্রকৃতির অবক্ষয়ের জন্য সমগ্র মানবজাতিকে এক ও ভিন্ন ভাবে দায়ী করতে পারে কিন্তু মানুষের এহেন ধারণা পোষণ করা কখনোই কাম্য নয় (Bonneuil and Frassoz 2016)।
এক রিপোর্ট অনুসারে একবিংশ শতকের প্রথম ভাগে বিশ্ব জনসংখ্যার সর্বনিম্ন আয়সম্পন্ন ৪৫ শতাংশ কেবল ৭% কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) নির্গমনের জন্য দায়ী, অন্যদিকে সর্বোচ্চ আয় সম্পন্ন সাত শতাংশ লোকসংখ্যার দ্বারা নির্গত হয় পঞ্চাশ শতাংশ (Male and Hornborg 2014)। এক মার্কিন নাগরিক তার জীবন অতিবাহিত করতে এক ইথিয়োপিয়া অধিবাসীর তুলনায় ৫০০ গুণ বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস পরিবেশে নির্গত করতে থাকে (lbid)। বলা বাহুল্য যে দেশ এবং আয় স্তর ভেদে পরিবেশের অবক্ষয়ের পিছনে মানুষের বিসদৃশ ভূমিকা উপরিউক্ত দুই রিপোর্টে স্পষ্ট হয়। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে ‘অ্যানথ্রোপোসিন’-এর পরিবর্তে ‘অলিগানথ্রোপোসিন’ (Oliganthropocene) শব্দটির ব্যবহার বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন। অলিগানথ্রোপোসিন শব্দের অর্থ হল এক নতুন যুগ যা কতিপয় মানুষের কার্যকলাপের জন্য আবির্ভূত হয়েছে। (Ibid) উপরের উদাহরণগুলি সত্যি সাক্ষ্য দেয় কিছু বিত্তশালী মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবী আজ এই সংকটের সম্মুখীন।
তবে অলিগানথ্রোপোসিনের ধারণায় সম্মতি জানাতে অনেকেই নারাজ। অধিকাংশ তাত্ত্বিকদের মত যে, কিছু মুষ্টিমেয় মানুষকে দোষারোপ করে থেমে গেলে আসল সমস্যা অধরাই থেকে যাবে।সমস্যার প্রকৃত উৎস হল গণতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা যা মানুষকে এই ধ্বংসলীলায় মেতে উঠতে ইন্ধন জুগিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিকরা মনে করেন বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংকটের এই নতুন যুগকে ক্যাপিটালোসিন (Capitalocene) বলে চিহ্নিত করা অধিক উপযুক্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ক্যাপিটাল কথাটি ধনতান্ত্রিক তথা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ইংরেজি প্রতিশব্দ। সুতরাং ক্যাপিটালোসিন হল পুঁজিবাদী অর্থনীতির যুগ। সর্ব প্রথম আন্দ্রিজ মাম (Andreas Malm) ক্যাপিটালোসিন কথাটি উত্থাপন করেন কিন্ত, পরবর্তীকালে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে বিশেষজ্ঞ মহলে। প্রখ্যাত ইকো- সোশ্যালিস্ট (Eco-Socialist) কোহেই সাইকো (Kohei Saito) মনে করেন, অ্যানথ্রোপোসিন অপেক্ষা ক্যাপিটালোসিন কথাটির প্রয়োগ অধিক যুক্তিসঙ্গত। কারণ অ্যানথ্রোপোসিন বর্তমান বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংকটকে তার আর্থসামাজিক ভিত্তি বিহীন শুধুমাত্র পরিবেশ ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে প্রস্তুত করে (Salottolo 2019)।
কার্ল মার্কসের সংজ্ঞা অনুসারে ক্যাপিটাল তথা পুঁজি হল স্বয়ং সম্প্রসারিত হওয়া মূল্য (Self-expanding Value)। অর্থাৎ পুঁজির মূল বৈশিষ্ট্যই হল ক্রমাগত নিজের আয়তন বৃদ্ধি করার কাজে লিপ্ত থাকা। সুতরাং ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বলতে বোঝায় এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার ভিত কায়েম রয়েছে পুঁজির অবশ্যম্ভাবী প্রসারণের ওপর আর পুঁজির প্রসার নির্ভর করে শ্রমশক্তি এবং প্রকৃতির শোষণের উপর। প্রকৃতির অনিয়ন্ত্রিত লাগাম ছাড়া এই শোষণকেই মূলত ইকো সোশ্যালিস্ট তার্কিকেরা প্রকৃতির ভারসাম্য ব্যাহত করার জন্য দায়ী বলে মনে করেছেন। বস্তুত প্রকৃতির সীমিত উপাদান ও তার সীমিত সামর্থ্য এবং পুঁজির বিকাশের অসীম লালসা — এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। আর সেই সংঘাতের ফলশ্রুতি হল বর্তমান পরিবেশ সংকট, যাকে আমরা অ্যানথ্রোপোসিন কিংবা কখনও ক্যাপিটালোসিন বলে চিহ্নিত করছি। (Foster, Holleman, and Clark 2019)।
উপরন্তু পল ক্রুটজেন অ্যানথ্রোপোসিন যুগের আরম্ভের সময়সীমা হিসাবে ১৭৮৪ সালকে প্রস্তাবিত করেন। ১৭৮৪ সালেই জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার করেন যা ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব তথা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জয়যাত্রার সূত্রপাতের ইঙ্গিত বহন করে (Crutzen, 2002)। সুতরাং, স্পষ্টই লক্ষ করা যায় যে বিজ্ঞানীরাও অ্যানথ্রোপোসিন ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অভ্যুত্থান — এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পান। ট্রুটোজেন একমাত্র নন যিনি এই ধারণা পোষণ করেন, অনেকেই তার সঙ্গে সহমত। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, যে সমস্ত পরিবেশ সম্পর্কিত সূচক অ্যানথ্রোপোসিনের আগমন সুনিশ্চিত করে তা বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হতে শুরু করে।
অ্যানথ্রোপোসিন ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই যোগসূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতি এবং পরিবেশের সংকট ভাবনায় মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার শোষণের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী সংগ্রামের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মার্কসবাদী সংগ্রাম মূলত শ্রমিকের শোষণ নিয়ে সোচ্চার থেকেছে, তবে আজ যখন সেই একই আর্থিক কাঠামোর শোষণমূলক নীতি পরিবেশের অবক্ষয়ের কারণ হয়ে উঠেছে তখন পরিবেশ সংগ্রাম ও মার্কসবাদী সংগ্রাম এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন আবশ্যিক হয়ে ওঠে।
ইকো-সোশ্যালিজম (Eco-Socialism) ও মার্কসের পরিবেশ ভাবনা
পরিবেশ আন্দোলন এবং মার্কসবাদী পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামের মধ্যে সমন্বয়ের ফলস্বরূপ জন্ম নেয় ইকো সোশ্যালিস্ট ভাবধারা। ইকো শব্দটি পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়কে সূচিত করে আর সোশ্যালিস্ট কথার অর্থ হল সমাজতান্ত্রিক। অর্থাৎ ইকো সোশ্যালিস্ট ভাবনা এমন এক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে যা প্রকৃতির অবক্ষয় রুখতে সচেষ্ট হবে। বিংশ শতকের শেষ দিক থেকে যখন পরিবেশ সচেতনতার প্রসার ঘটে তারই সঙ্গে সঙ্গে ইকো-সোশ্যালিস্ট ভাবধারা বিকশিত হয়। একে রেড গ্রিন থিওরি (Red-green theory) নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের উষালগ্ন পর্যন্ত ইকো- সোশ্যালিস্ট ভাবনার গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে জন বেলামি ফস্টার (John Bellamy Foster) একে দুটি স্তরে ভাগ করেছেন — প্রথম স্তর (1st stage), দ্বিতীয় স্তর (2nd stage)। ইকো-সোশ্যালিস্ট ভাবধারা অনুসারে মার্কসের লেখায় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা পরিবেশের অবক্ষয়ের কিছু বিচ্ছিন্ন উল্লেখ মাত্র রয়েছে। তাই এর মূল লক্ষ্যই হল মার্কসবাদী তত্ত্বের পুঁজিবাদ বিরোধিতা এবং গ্রিন থিয়োরির মধ্যে এক সুচারু মেলবন্ধন স্থাপন করা। প্রথম স্টেজ ইকো- সোশ্যালিস্ট তালিকা মতে পরিবেশ সংকট মার্কসের সমকালীন পৃথিবীতে সেরকম প্রকট আকার ধারণ করেনি। তাই তাদের ধারণা বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসের পলিটিকাল ইকোনমির ক্রিটিক (Critique of political economy) -এর ধারণার পুনর্গঠন করা প্রয়োজন যাতে পরিবেশ সম্পর্কিত উদ্বেগকে মার্কসবাদী তত্ত্বে গুরুত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অন্যদিকে দ্বিতীয় স্টেজের ইকো সোশ্যালিস্টরা সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হল জন বেলামি ফস্টার, পল বুর্কেট ও কোহেই সাইটো। এদের মতে প্রথম স্টেজের তাত্ত্বিকরা মার্কসের কাজ ভালোভাবে খতিয়ে দেখেননি, কারণ পরিবেশ তথা ইকোলজি সম্পর্কিত ধারণা মার্কসের পুঁজিবাদ বিরোধী তত্ত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সাইটো বলেছেন যে মার্কসের পলিটিকাল ইকোনমির ক্রিটিকের তত্ত্ব কখনোই পুরোপুরিভাবে বোধগম্য হবে না যদি তার ইকোলজির আঙ্গিকটি উপেক্ষা করা হয় (Saito 2018)। মার্কসের পরিবেশ ভাবনার পুনরুত্থানের প্রকল্পটি দ্বিতীয় স্টেজের eco-socialist-রা মূলত মার্কসের বিভিন্ন নোটবুকের সাহায্য নিয়ে সম্পাদন করেছেন, যেখানে মার্কস তৎকালীন প্রকাশিত নানা বিজ্ঞানীদের পরিবেশ ও প্রকৃতির অবক্ষয় সম্পর্কিত মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন এবং পরবর্তীকালে তার ক্যাপিটালসহ আরও নানা লেখায় সেই সকল ধারণার ব্যবহার করেছেন। মার্কসের পরিবেশ ভাবনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা আয়ত্ত করতে হলে দ্বিতীয় স্টেজের ইকো-সোশ্যালিস্টদের সাহায্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই নিবন্ধে আমরা দ্বিতীয় স্টেজের ইকো-সোশ্যালিস্ট, যারা ইকো-মার্কসিস্ট নামেও পরিচিত, তাঁদের কাজের মাধ্যমেই মার্কসের পরিবেশ চিন্তা নিয়ে আলোচনা করব। মার্কসের সমকালীন পৃথিবীতে গ্রিন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধি ও বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে সেরূপ সচেতনতা দেখা যায়নি। তাই মার্কসের পরিবেশ ভাবনা মূলত ইংল্যান্ডের মৃত্তিকার উর্বরতার অবক্ষয়কে (soil fertility exhaustion) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তবে মার্কস এর ভিত্তিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু তত্ত্ব উত্থাপন করেন যা বর্তমান পরিবেশ সংকটের প্রেক্ষাপটে সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক (Saito 2018)।
মার্কস কি পরিবেশপন্থী?
দক্ষিণপন্থী পরিবেশবিদরা চিরকাল কার্ল মার্কসকে পরিবেশ বিরোধী আখ্যা দিয়ে আসছেন। এমনকি প্রথম স্টেজের eco socialist-রাও মনে করেন যে মার্কসের মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতি সেরকম কোনও সচেতনতা তো ছিলই না বরং কখনো কখনো মার্কসের লেখায় পরিবেশ বিরোধী ভাবনার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে এ ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় দ্বিতীয় স্টেজের ইকো মার্কসিস্টদের লেখায়।
এ কথা সত্য যে মার্কস প্রথম জীবনে প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি ও মানব জীবনে তার সুফল নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন এবং তিনি এও মনে করতেন যে প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রকৃতির উপর নির্ভরতা ক্রমশ কমবে এবং এভাবে সে প্রাকৃতিক সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করবে একদিন। তবে তাঁর এই রূপ ভাবনার পিছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কারণ রয়েছে যা দ্বিতীয় স্টেজের ইকো সোশ্যালিস্টদের লেখায় স্পষ্ট হয়।
কোহেই সাইটো বলেন যে মার্কসের প্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী মানসিকতা আসলে ব্রিটিশ ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ (Classical political economist) ডেভিড রিকার্ডো ও রবার্ট ম্যালথাসের দ্বারা প্রস্তাবিত ‘ক্রমহ্রাসমান প্রতিদানের নিয়ম’ (Law of diminishing returns)। এর প্রতি মার্কস অননুমোদন প্রকাশ করেন (Saito 2018)। সংক্ষিপ্তাকারে ক্রমহ্রাসমান প্রতিদানের নিয়মটির সার বক্তব্য হল যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা আবশ্যিক ভাবে বাড়বে আর ফলস্বরূপ কৃষিক্ষেত্রের পরিধিও বাড়বে, কিন্তু প্রকৃতিতে উর্বর জমির জোগান অপরিসীম নয়, প্রথমে উর্বর জমিগুলি কৃষিকার্যে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে মানুষকে অনুর্বর জমির দিকে এগোতে হবে যেখানে শ্রম ও মূলধনের প্রয়োগ উর্বর জমির তুলনায় বেশি করতে হবে। কিন্তু তার প্রতিদান অনেক কম হবে। এইভাবে ধীরে ধীরে কৃষি ক্ষেত্রে শস্যের প্রতিদান ক্রমেই হ্রাস পাবে (Brue 1993)। কিন্তু মার্কস এই তত্ত্বকে স্বীকার করতে নারাজ, কারণ এটি স্বীকৃতি পেলে ম্যালথাসের জনসংখ্যা সম্পর্কিত তত্ত্বটিকে মেনে নিতে হবে আর তার ঘোর বিরোধী ছিলেন মার্কস। ম্যালথাসের তত্ত্বানুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর প্রগতিতে (১, ২, ৪, ৮, ১৬,…), যেখানে খাদ্য শস্যের জোগান বাড়ে সমান্তরাল প্রগতিতে (১, ২, ৩, ৪, ৫,…), আর এর ফলস্বরূপ খাদ্যের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি হবে। ম্যালথাস মনে করেন যে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম (positive checks) অনুসারে দুর্ভিক্ষ, খরা, মহামারি ইত্যাদির মাধ্যমে হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।
মার্কসের ‘লন্ডন নোটবুকস্ ১২-১৪’ (‘London Notebook 12-14’)-এর মধ্যে তিনি যে সমস্ত উদ্ধৃতাংশ (excerpts) সংগ্রহ করেছিলেন তা লক্ষ করলে বোঝা যায় যে তিনি সমকালীন প্রখ্যাত জে. ভি. লাইবিগ্-এর কাজ গভীরভাবে অনুগমন করতেন। লাইবিগের ‘মিনারেল থিয়োরি’ অনুযায়ী কৃষিকার্যের ভূমির মধ্যে যে অজৈব উপাদানগুলি থাকে তা শস্যবৃদ্ধি পাওয়ার সময় শোষণ করে নেয়। সুতরাং কৃষিকার্য সম্পাদনের ফলে সেই উপাদানসমূহ ক্রমেই মৃত্তিকায় হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে জমি অনুর্বর হয়ে ওঠে (Saito 2018)। বৃষ্টিপাত ও আবহমণ্ডলের গতিবিধির মাধ্যমে সেই অজৈব উপাদানের ঘাটতি আংশিক পূরণ হলেও তা কখনোই পর্যাপ্ত নয়। তবে মানুষ যদি কৃত্রিম উপায়ে কোনও সম্পূরকের (Supplement) প্রয়োগ দ্বারা সেই অজৈব উপাদানের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে তাহলে জমির উর্বরতা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হবে। যে সমস্ত কৃত্রিম সম্পূরকের কথা লাইবিগ্ বলেছেন তা হল — প্রাণিজ বর্জ্য, হাড়ের গুঁড়ো, ছাই এবং সর্বোপরি ও সর্বাপেক্ষা কার্যকর রাসায়নিক সার (Ibid.)। লাইবিগের এই তত্ত্বে মার্কস রিকোর্ডো ও ম্যালথাসের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পান। তাই জীবনের এই পর্যায়ে মার্কস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস বিজ্ঞানের গবেষণার উপর ভর করেই মানুষ প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে।
যদিও লাইবিগ পরবর্তীকালে তাঁর মিনারেল থিয়োরির পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন যে রাসায়নিক সারের মাধ্যমে মৃত্তিকার অজৈব উপাদানের ঘাটতি পূরণ সম্ভব। তিনি বলেন যে রাসায়নিক সারের মাধ্যমে মাটির অজৈব উপাদানের ঘাটতি পূরণের প্রচেষ্টা কখনোই সফল হয় না। কারণ মাটি তা শোষণ করতে পারে না। বরং রাসায়নিক সার প্রয়োগের দরুন শস্যের ফলন বেড়ে যায় এবং অধিক শস্য উৎপাদনের ফলে মাটির অজৈব উপাদান খুব দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং মৃত্তিকার সমস্ত উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়। লাইবিগ্ তাই এভাবে সার প্রয়োগের মাধ্যমে সর্ষের ফলন বাড়ানোকে ‘রবারি কাল্টিভেশন’ (Robbery cultivation) বলে অভিহিত করেছেন (Ibid.)। লাইবিগ্-এর এই পরিবর্তনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে মার্কস ও নিজের ধারণা পরিবর্তন করেন এবং পরবর্তী জীবনে ‘প্রাকৃতিক সীমা’-র (Natural limits) গুরুত্ব স্বীকার করেন। লাইবিগের এই ধারণার প্রতিধ্বনি করে মার্কস ক্যাপিটাল ভলিউম ওয়ানের এক জায়গায় লেখেন — “…..all progress in increasing the fertility of soil for a given time, is a progress towards ruining the lasting sources of that fertility.” (Marx 1867(1954), ‘Capital’ Vol. l, 506)। সুতরাং স্পষ্টতই বোঝা যায় মার্কস কখনোই আজীবন পরিবেশের পরিপন্থী ও প্রযুক্তি উন্মত্ত ছিলেন না। যদিও পরিবেশ ও প্রকৃতির ধারণা আগাগোড়া মার্কসের চিন্তার কেন্দ্রে বিরাজ করেছে তা আমরা প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে দেখব।
নৃ-কেন্দ্রিকতা (Anthropocentrism) ও মার্কসের পরিবেশ চিন্তা
মানুষ প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রকৃতির অন্য সকল চেতন ও অচেতন সদস্যের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক কায়েম রেখে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখাই মানুষের কর্তব্য। কিন্তু ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বিকাশ লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়। মানুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রকৃতির ভারসাম্য ক্রমেই বিঘ্নিত হতে শুরু করে। এর জন্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োগ যতটা দায়ী তার চেয়েও বেশি দায়ী প্রকৃতির প্রতি মানুষের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি — এমনটাই মত সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে একাংশের (Bilgrami 2009; Cummins 2018)।
মানুষ ও প্রকৃতির পরিবর্তিত সম্পর্কের ভিত্তি হল কার্তেসীয় দ্বৈতবাদী দর্শন (Cartesian dualism)। সপ্তদশ শতকের ফরাসি দার্শনিক রেনে ডেকার্টে (Rene Descartes) সমস্ত জগতকে দুটি মৌলিক উপাদানে বিভক্ত করেন। সাবজেক্ট (Subject) যার অর্থ হল চেতনা সম্পন্ন সত্তা বা অস্তিত্ব এবং অবজেক্ট (Object) অর্থাৎ জড়। এই দ্বৈত কাঠামোয় মানুষ হয়ে ওঠে সাবজেক্ট আর মনুষ্য ব্যতীত বাকি সমগ্র প্রকৃতি হয়ে ওঠে অবজেক্ট। এই সূত্র ধরেই মানুষ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে জগতের কেন্দ্র, বাকি সমগ্র পৃথিবী হয়ে ওঠে মানুষের কার্যসিদ্ধির উপাদান। বস্তুত এই নব ভাবনায় প্রকৃতি মানুষের কাছে তার পূর্ব গরিমা হারায়। মানুষের চোখে প্রকৃতি হয়ে ওঠে নিছক সম্পদ (resource) মাত্র। যার অবাধ শোষণ বা যথেচ্ছ ব্যবহার করা যায় মুনাফা অর্জন তথা পুঁজি বৃদ্ধির জন্য। মানুষকে জগতের কেন্দ্রে স্থাপন করে প্রকৃতির ওপর তার অভাব স্বেচ্ছাচারকে স্বীকৃতি দেওয়ার এই নতুন দর্শনই হল মনুষ্য-কেন্দ্রিকতা বা নৃ- কেন্দ্রিকতা (Anthropocentrism)। একিল বিলগ্ৰামি (Akeel Bilgrami) মনে করেন যে প্রকৃতি যদি সম্পদে পরিণত না হত তাহলে হয়তো ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ কোনোদিন সম্ভবপর হত না। এই ভাবনার অবদান অনস্বীকার্য ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশের পিছনে। শুধু তাই নয় ধনতন্ত্র প্রসূত পরিবেশের অবক্ষয়ের কারণে যে নতুন অ্যানথ্রোপোসিন যুগের আগমন ঘটেছে তাও নৃ-কেন্দ্রিকতারই ফসল।
অপরদিকে মার্কসের পরিবেশ ভাবনা চিরকালই নৃ-কেন্দ্রিকতা মুক্ত। পরিবেশ ভাবনা শুরু থেকেই মার্কসের চিন্তায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সাইটো দেখিয়েছেন যে ১৮৪৪ সালে মার্কস তাঁর প্যারিস নোটবুকস্ (Paris Notebooks)-এ মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের কথা আলোচনা করেন (Saito 2018)। মার্কস লিখেছেন যে, ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা; ধনতন্ত্র মানুষকে তার জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী (means of subsistence) উৎপাদনে বাধা-প্রদান করে। কারণ উৎপাদনের উপকরণগুলি (means of production) কুক্ষীগত থাকে পুঁজি মালিকদের হাতে এবং তবেই মানুষ পুঁজির মালিকদের কাছে নিজের শ্রম বিক্রি করতে আসবে যা এই ব্যবস্থার প্রথম শর্ত। উৎপাদনের উপকরণের ভান্ডার হল প্রকৃতি — তাই মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেই পুঁজিবাদের আরম্ভ। মার্কস তাই প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধনকেই ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে দেখেছেন তাঁর প্যারিস নোটবুকস-এ (Ibid.)। লক্ষণীয় বিষয় হল মার্কস এখানে পরোক্ষভাবে হলেও নৃ-কেন্দ্রিক ধারণার বিরোধিতাই করেছেন।
পরবর্তীকালে মার্কসের চিন্তাধারা আরও পরিণত ও বিজ্ঞানভিত্তিক হয়েছে কিন্তু তিনি মানুষও প্রকৃতির সম্পর্কের বিষয়টিকে কখনোই উপেক্ষা করেননি। ১৮৪৫ সালের পরে মার্কস মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করতে বৈজ্ঞানিক ধারণা ‘মেটাবলিজম্’ (তাকে বাংলায় বিপাক বলা হয়ে থাকে) এর উপমা ব্যবহার করেছেন। মেটাবলিজম হল সেই সকল রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সমষ্টি যার মাধ্যমে জীবদেহে খাদ্যশক্তি রূপান্তরের কাজ হয় যা সমস্ত জীব কোশগুলির জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে সাহায্য করে এবং সেই কোষগুলিতে উৎপন্ন বর্জ্য দূরীকরণ করে। এখন মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতি থেকেই উপকরণ নিচ্ছে, কখনো তা সরাসরি ব্যবহার করছে কিংবা কখনো সেই উপকরণের কিছু পরিবর্তন সাধন করে তারপর তা গ্রহণ করছে। আবার সেই সকল উপকরণের ব্যবহার শেষে যে বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে তা মানুষ পুনরায় প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে। মার্কস এক্ষেত্রে প্রকৃতি ও মানুষকে একই বৃহত্তর অঙ্গের দুটি অংশ বলে মনে করেছেন এবং ফলস্বরূপ প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এই নিরন্তর আদান-প্রদানের সম্পর্ককে মেটাবলিসমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অতএব মার্কসের বক্তব্য অনুযায়ী মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, যা নৃ-কেন্দ্রিকতা পুরোপুরি অস্বীকার করে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পরিবেশের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি মার্কস তার এক তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেছেন এখানে।
মেটাবলিক রিফ্ট (Metabolic Rift)
রিফ্ট কথার অর্থ হল চিড় ধরা বা ফাটল ধরা। মেটাবলিক রিফট বলতে বোঝায় মানুষ ও প্রকৃতির আদান-প্রদানের যে সম্পর্ক তাতে ব্যাঘাত ঘটা। মেটাবলিক রিফট কথাটির প্রথম ব্যবহার করেন জন বেলামি ফস্টার, তিনি মার্কসের তত্ত্বে এই ধারণা খুঁজে বার করে তাকে আরও স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেন। ফস্টারের মতে এটি হল মার্কসের পরিবেশগত আঙ্গিক থেকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা (Foster and Clark 2016)। মার্কস অবশ্যই এখানে মেটাবলিক রিফ্টের ধারণাটি মৃত্তিকার পুষ্টি উৎপাদনের চক্রের (Soil nutrient cycle) প্রেক্ষাপটেই আলোচনা করেছেন।
মার্কসের সমসাময়িককালে ইংল্যান্ড দ্বিতীয় কৃষি বিপ্লবের (Second agricultural revolution) সম্মুখীন। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বনির্ভর কৃষিকার্যের (Self-sustaining agriculture) জায়গায় পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ ঘটে, যা আধুনিক প্রযুক্তি ও রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। মার্কসের লাইবিগের পরবর্তীকালের কাজ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে প্রযুক্তি ও সারের প্রয়োগ সর্বস্ব পুঁজিবাদী কৃষি কাজ মৃত্তিকার অজৈব পুষ্টি় উপাদান সমূহ লুট করে এবং ক্রমে মাটির শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। এমনটাই হয়েছিল ব্রিটিশ পুঁজিবাদী কৃষিকারদের ব্যাপক প্রসারের ফলে।
অন্যদিকে মার্কস লাইবিগ্-কে অনুসরণ করে গ্রাম ও শহরের বিভাজনের সমস্যাটি তুলে ধরেছেন। প্রাক্-ধনতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোয় গ্রামাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ বসবাস করত। নিকটবর্তী কৃষি ক্ষেত্রে যে শস্য উৎপাদিত হত তা তারা হয় খাদ্য হিসাবে বা বস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করত। অবশেষে তারা সেই সমস্ত কৃষি জমিতেই বর্জ্য ত্যাগ করার দরুন কিংবা ওই ব্যবহৃত বস্ত্রের কোনও জীর্ণ অবশেষ সেই কৃষিক্ষেত্রের মাটিতেই মিশে যাওয়ার ফলে মাটি থেকে যে পরিমাণ পুষ্টি উৎপাদন শস্যের ফলনে নিঃশেষিত হয়েছে তার কিছুটা আবার সেই মাটিতেই ফিরে যেত। কিন্তু ধনতান্ত্রিক কৃষিকার্যের বিকাশের ফলে বৃহদাকার জমিতে কৃষিকাজ শুরু হয়, যার ফলে গ্রামাঞ্চলে কৃষক ক্রমশ কমতে থাকে। তাছাড়া ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরগুলিতে বস্ত্র কারখানায় শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেও প্রচুর মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে ভিড় করে। ফলত শহরগুলিতে জনবসতি গড়ে ওঠে। শহর অঞ্চলে এই ব্যাপক জনসংখ্যা যে খাদ্য ও বস্ত্র গ্ৰহণ করে তা থেকে উৎপন্ন বর্জ্য বা বস্ত্রের অবশেষ আর সেই গ্রামাঞ্চলের মৃত্তিকায় গিয়ে পৌঁছায় না। বরং সেই বর্জ্য শহুরে নিকাশি ব্যবস্থার মাধ্যমে গিয়ে জমা হয় ইংল্যান্ডের টেমস্ নদীতে এবং শুধুমাত্র নদীর দূষণ বাড়ায় (Ibid.)। ফলে একদিকে যেমন পুঁজির কৃষি কাজে প্রয়োগের ফলে জমির পুষ্টি উৎপাদন ব্যাপক হারে নিঃশেষিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল লোকসংখ্যার গ্রাম থেকে শহরের স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে পুষ্টি উপাদান আংশিক ভাবে জমিতে ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এই উভয় সংকটের কারণে মৃত্তিকার পুষ্টি উৎপাদনের ভান্ডার শূন্য হয়ে যায়। মার্কসের ভাষায় মাটি হল “irreparable Rift” (Ibid)। মেটাবলিক রিফ্টের এই ধারণাটি বর্তমানে ইকো-সোশ্যালিস্টদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং কৃষি ক্ষেত্র ছাড়াও আবহাওয়া, সাগর, অরণ্য প্রভৃতির আলোচনা ও বিশ্লেষণে মেটাবলিক রিফ্টের প্রয়োগ করা হচ্ছে (Foster and Clark 2016)।
পরিবেশগত সাম্রাজ্যবাদের ধারণা ও মার্কস
পরিবেশগত সাম্রাজ্যবাদ বা ইংরেজিতে Ecological imperialism-এর ধারণাটি সর্বপ্রথম ১৯৮৬ সালে আলফ্রেড ক্রসবি (Alfred Crosby) উত্থাপন করেন। মূলত পাশ্চাত্যের তথাকথিত উন্নত ও প্রযুক্তি উন্মত্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি যখন তাদের দেশের সীমানার মধ্যে প্রকট হওয়া মেটাবলিক রিফটকে মেরামত করার প্রচেষ্টায় তাদের দূষণ সৃষ্টিকারী উৎপাদন কার্যগুলি তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলিতে স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে ঐ সমস্ত দেশের পরিবেশগত অবক্ষয় ঘটায়। এটাই হল পরিবেশগত সাম্রাজ্যবাদ। মার্কসের সমকালীন সময়ে এই ধারণাটির স্পষ্ট কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবুও মার্কস এই বিষয়টির উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন, যদিও ইকোলজিক্যাল ইম্পিরিয়ালিজম কথাটির ব্যবহার তাঁর লেখায় কোথাও নেই।
মার্কসের লেখায় গুয়ানো বিভ্রাটের উল্লেখ বারে বারে পাওয়া যায়। গুয়ানো হল দক্ষিণ আমেরিকার এক স্থানীয় সামুদ্রিক পক্ষীর বিষ্ঠা। আলেকজান্ডার হামবোল্ড ১৮০২ সালে পেরুতে ভ্রমণে গিয়ে এই গুয়ানোর সন্ধান পান এবং সেখানকার স্থানীয় কৃষিকার্যে এর প্রয়োগের ব্যাপারে অবগত হন। তাই তিনি গুয়ানোর নমুনা (sample) নিয়ে আসেন ইউরোপে। পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে গুয়ানো ফসফরিক অ্যাসিড নাইট্রোজেন পটাশ সহ নানা ধরনের খনিজে সমৃদ্ধ যা একটি অত্যন্ত কার্যকারী সার হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলে আশা করা হয় যে গুয়ানোর প্রয়োগ দ্বারা ইউরোপের মৃত্তিকার পুষ্টি উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। এরপরই শুরু পেরুর চিচ্ঞা দ্বীপে গুয়ানো ভান্ডারের অনিয়ন্ত্রিত লুঠ (Saito 2018)। ১৮৬৩ থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে ব্রিটেন প্রতি বছর ১০৯,০০০ থেকে ২৪৩,০০০ টন গুয়ানো আমদানি করেছে (Clark and Foster 2009)। এর ফলে চিচ্ঞা দ্বীপের অজস্র সামুদ্রিক পক্ষীর আবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণ স্বরূপ হামবোল্ড পেঙ্গুইনদের বাসা ব্যাপক ভাবে ক্ষতিপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় (Saito 2018)।
গুয়ানো বিভ্রাট ছাড়াও ব্যাপক কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে ইংল্যান্ড আয়ারল্যান্ড, ভারত ও আমেরিকার পরিবেশগত ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে এবং সে বিষয়টিও মার্কসের দৃষ্টি এড়ায়নি (Ibid.)।
পরিবেশ সম্পর্কে মার্কসের নিবিড় ভাবনা ও পরিবেশগত দিক থেকে মার্কসের ধনতন্ত্রের সমালোচনা সবটাই দ্বিতীয় স্টেজের eco socialist-দের অনুসন্ধানের ফল। বলা বাহুল্য মার্কসের পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তাকে আমরা ইকো-মার্কসিস্টদের চোখ দিয়েই দেখেছি। ইকো মার্কসিস্টরা তবে এখানে সব থেকে বেশি জোর দিয়েছেন ধনতন্ত্রের পরিবেশ বিরোধী চরিত্রের ওপর, ফলে ধনতন্ত্রের অপসারণই তাদের মতে পরিবেশ অবক্ষয় রোধে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু এই মত নির্বিবাদে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম সমাজতন্ত্রের উদাহরণ সোভিয়েত রাশিয়া পরিবেশ হিতৈষী ভাবমূর্তি স্থাপনে অসমর্থ হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়া বাঁধ নির্মাণ ও বিভিন্ন নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে এক বৃহদাকার হ্রদ যাকে সাগর আখ্যা দেওয়া হত, অ্যারল সি (Aral Sea), তার ধ্বংস ডেকে এনেছে এবং তার ক্ষতিকারক প্রভাব সুদূরপ্রসারী (Gare 2002)। সুতরাং বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে ইকো-মার্কসিস্টরা কোন ভবিষ্যতের দিশা নির্দেশ করছেন সে বিষয়ে তাদের আরও চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। যদিও এই সমালোচনা কখনোই মার্কসের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য নয়, কারণ মার্কসের সমাজতন্ত্রের ভাবনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তার সঙ্গে সোভিয়েত মডেলের সমাজতন্ত্রের সংঘাত বাধে। তাছাড়াও মার্কস তার জীবন সায়াহ্নে লেখা এথনোলজিকাল নোটবুকস-এ (Ethnological Notebooks) গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে পরম্পরাগতভাবে বাঁচার ধরন নিয়ে আলোচনা করেছেন যা হয়তো ধনতন্ত্র ও পরিচিত সমাজতন্ত্রের বিকল্প কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সন্ধান দিতে সহায়ক হবে, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে।
সহায়ক পত্রিকা ও গ্রন্থসূচি :
- Barnosky, A. D., Hadly, E. A., Bascompte, J., Berlow, E. L., Brown, J. H., Fortelius, M., … & Martinez, N. D. 2012. ‘Approaching a state shift in Earth’s biosphere’. Nature, 486(7401), 52-58.
- Bilgrami, A. (2009). ‘Value, enchantment, and the Mentality of Democracy: some Distant perspectives from Gandhi’. Economic and Political Weekly, 47-61.
- Bonneuil, C., & Fressoz, J. B. 2016. ‘The shock of the Anthropocene: The earth, history and us’. Verso Books: London & New York.
- Bonneuil, C., Gemenne, F., & Hamilton, C. (2015). ‘The Anthropocene and the Global environmental crisis: rethinking modernity in a new epoch’. Routledge: New York.
- Brue, S. L. (1993). ‘Retrospectives: The law of diminishing returns. Journal of Economic Perspectives’, 7(3), 185-192.
- Burkett, P. 2006. ‘Two Stages of Ecosocialism?’ International Journal of Political Economy, 35(3), 23-45.
- Ceballos, G., Ehrlich, P. R., Barnosky, A. D., García, A., Pringle, R. M., & Palmer, T. M. (2015). ‘Accelerated modern human–induced species losses: Entering the sixth mass extinction’. Science advances, 1(5), e1400253.
- Clark, B., & Foster, J. B. (2009). ‘Ecological imperialism and the global metabolic rift: Unequal exchange and the guano/nitrates trade’. International Journal of Comparative Sociology, 50(3-4), 311-334.
- Crutzen, P. J. 2002. ‘Geology of mankind’. Nature, 415(3) (January).
- Cummins, P. 2018. ‘The Anthropocene: A challenge to humanism in bioethics?’ Ethics, Medicine and Public Health, 6, 105-114.
- Foster, J. B. 1999. ― ‘Marx‘s Theory of Metabolic Rift: Classical Foundations for Environmental Sociology’. The American Journal of Sociology 105(2): 366-405.
- Foster, J. B., & Burkett, P. 2016. ‘Marx and the earth: An anti-critique. Brill’.
- Foster, J. B., Holleman, H., & Clark, B. (2019). ‘Imperialism in the Anthropocene’. Monthly Review, 71(3).
- Gare, A. 2002. ‘The environmental record of the Soviet Union’. Capitalism Nature Socialism, 13(3), 52-72.
- Malm, A., & Hornborg, A. 2014. ‘The Geology of Mankind? A Critique of the Anthropocene Narrative’. The Anthropocene Review, 1(1), 62-69.
- Marx, K. 1954. ‘Capital’, Volume 1. Moscow: Progress Publishers.
- Marx, K. 1974. ‘Capital’ vol. 3. Moscow Progress Publishers.
- Saito, K. 2018. ‘Karl Marx’s Ecosocialism: Capitalism, Nature, and the Unfinished Critique of Political Economy’. Monthly Review Press: New York.
- Salottolo, D. (2019). (a cura di V. Carofalo e D. Salottolo), ‘Anthropocene and ecosocialism : a perspective-intervista a Kohei Saito’’.
- Zalasiewicz, J., Waters, C. N., Williams, M., & Summerhayes, C. P. (Eds.). 2019. ‘The Anthropocene as a Geological Time Unit : A Guide to the Scientific Evidence and Current Debate’. Cambridge University Press.