মাটি দূষণ : বিকল্প কৃষি

সমীর সরকার

কয়েকদিন আগে পাশের গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। গ্রামে ঢোকার আগে একটা মাঠ পড়ে। তখন খরিফ মরশুম। ওই মাঠেরই একটা জমিতে (খুব বেশি হলে ১০ কাঠা হবে) একজন চাষি থলে থেকে ইউরিয়া নিয়ে একটা ঝুড়িতে কোনও ওজন না করেই পরপর দু-বার ছড়িয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম — আপনি যে এত ইউরিয়া দিলেন এতে ভালো ফসল হবে? উনি বললেন : একটু বেশি দিলে ক্ষতি কি! গাছ তো আরও ভালো বাড়বে।

আশা করি এই বিষয়টা ওনার অজানা নয় যে কী পরিমাণ সার দিলে ধান গাছের বৃদ্ধি ঠিকমতো হবে। এরকম আবিবেচকের মতো রাসায়নিক সারের ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে!

আমার চিন্তা এই বাংলাকে নিয়েই। কারণ এই বাংলার মাটিতেই আমার শিকড়-বাকড় ছড়িয়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই চিন্তা? কারণ আছে বই-কি!

প্রয়োজনের বেশি নাইট্রোজেন জমিতে প্রয়োগ করলে বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতি হতে পারে। গাছ তার নাইট্রোজেন (N2) নাইট্রেট (NO3) হিসাবে মাটি থেকে গ্রহণ করে। প্রয়োজনের বেশি NO3 জমির মাটি চুঁইয়ে মাটির নিচে জলের সঙ্গে মেশে, সেই জল পানীয় জল হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই NO3 মিশ্রিত জল পান করলে শিশুদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের (Haemoglobin) অক্সিজেন (O2) বহন করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। অবিবেচকের মতো রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে মাটির স্বাভাবিক pH ব্যাহত হয়, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের আয়নিক (Ionic) উপাদানের তারতম্য ঘটে এবং বিভিন্ন খনিজ লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়। জমির মাটি ক্রমশ শক্ত হতে থাকে, মাটিতে ঠিকমতো বাতাস চলাচল করতে পারে না; যার ফলে — গাছ প্রয়োজন মতো জল নিতে পারে না এবং মূলের বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না। 

এই প্রসঙ্গে আর একটা বিষয় উল্লেখ করছি। ছেঁড়া চটের থলে (পাট দিয়ে তৈরি) পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ (HPLC) করে BHC (গ্যামাক্সিন)-এর রাসায়নিক অবশেষ (residue) পাওয়া গেছে — এটি কয়েক বছর আগের ঘটনা। পাট গাছ যখন ছোটো ছিল তখন BHC প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেই পাট বড়ো হওয়ার পর তার আঁশ থেকে যে সব থলে তৈরি করা হয়েছিল সেই থলেগুলির মধ্যে যেগুলি ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেই থলে থেকেই পাওয়া গিয়েছিল BHC (গ্যামাক্সিন)-এর রাসায়নিক অবশেষI এ তো একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম আরও কত নিষিদ্ধ (banned) Pesticide বিভিন্ন ফসলের সঙ্গে সরাসরি মানুষের শরীরে আসছে এবং বাকি অংশ জমির মাটির সঙ্গে মিশছে! এরকম নিষিদ্ধ Pesticides এবং তাদের ‘Transformation Products’ চাষের জমির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যায়। তাদের রাসায়নিক অবশেষ বহুদিন পর্যন্ত বিভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায় যার ফলে মাটির গুণাগুণ বহুল পরিমাণে নষ্ট হয়।

এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে ৪৬টি কীটনাশক বা Pesticide নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হল — Aldrin, Benzene Hexa Chloride (BHC), Chlordane, Carbofuran, Endrin, Heptachlor, Lindane, Monocrotophos, Parathion, Phosphamidon।

বেশি মাত্রায় Pesticide এবং Chemical fertilizers-এর প্রভাবে মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন উপকারী জীবাণু ও প্রাণীর সংখ্যা কমতে থাকে।

মাটি বিশেষজ্ঞ Dr. Elaine Ingham এর মতে — “If we lose both bacteria and fungi then the soil degrades. Overuse of chemical fertilizers and pesticides have effects on the soil organisms that are similar to human overuse of antibiotics. Indiscriminate use of chemicals might work for a few years, but after a while, there aren’t enough beneficial soil organisms to hold onto the nutrients.”

আসল কথা লুকিয়ে আছে একটি জায়গায় — মাটির বাস্তুতন্ত্র বা ‘Soil Ecosystem’-এ। মাটিতে বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে চাপ পড়ছে মাটির উপর এবং তার ফলে Soil Ecosystem একেবারে ভেঙে পড়ছে।

জমির মাটিতে বিভিন্ন জীবজ (Biotic) ও অজীবজ (Abiotic) বস্তুগুলির মধ্যে সঠিক সমন্বয় ও মিথষ্ক্রিয়া থাকলে তবেই মাটির চরিত্র (Soil Ecosystem) ঠিকমতো বজায় থাকবে এবং গাছ তার সমস্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যরস (SAP) মাটি থাকে আহরণ করতে পারবে। গাছের বৃদ্ধিও হবে যথাযথ।

তাহলে এই সমস্যা থেকে মাটিকে রক্ষা করার উপায়? উপায় আছে! কয়েকটা ব্যাপারে একটু সচেতন হলেই আমরা এই সমস্যা থেকে মাটিকে রক্ষা করতে পারব। মাটির চরিত্র বা গুণমান ঠিকমতো বজায় রাখার জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে বা যথাযথ ব্যবহারের উপর নজর দিতে হবে।

মাসানবু ফুকুওকা (Masanobu Fukuoka) উদ্ভাবিত Natural Farming বা প্রাকৃতিক উপায়ে চাষের উপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। এরকম চাষের গ্রহণযোগ্য ও পরিমার্জিত পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সরকারি কৃষি খামার এবং বিভিন্ন কৃষি গবেষণা সংস্থা থেকে পাওয়া যাবে।

এই Natural Farming-এর গ্রহনণযোগ্যতা ও নির্ভরতা ইউরোপের বিভিন্নদেশে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও কিছু কিছু রাজ্য, যেমন — অন্ধ্রপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, গুজরাত, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা ও কেরলে এই প্রাকৃতিক চাষ পদ্ধতির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। এই চাষ পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু জীব তথা Biocontrol agents, Biofertilizers এবং Plant Growth Promoting Bacteria-র genome-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।

এগুলির কিছু উদাহরণ হল —

Bio-Control agents : Trichoderma viridae, Beuvaria bassiana এবং Genera-Fusarium, Rhizoctonia ইত্যাদি।

Biofertilizers : Strains of Azotobacter chroococcum, Bacillus megaterium, Pseudomonas fluorescens ইত্যাদি।

Genome of plant growth promoting bacteria : Bacillus velezensis FZB 42, B. methylotrophicus B 25, Pseudomonas fluorescens Pf-5 ইত্যাদি।

প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করার জন্য সরকার থেকে বিভিন্ন রকমভাবে উৎসাহ দিতে হবে। এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান পরীক্ষাগার থেকে জমিতে (Lab to Land) নিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারের কৃষি বিভাগ, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা সংস্থা এবং চাষিদের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ও পদ্ধতিগত আদান-প্রদান গড়ে তুলতে হবে।

তথ্যসূত্র :

  1. Dept. of Plant Pathology, Agril. Chemistry & Soil Science, Agril. Entomology — B.C.K.V., W.B, India.

2.  ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান সংস্থা (ICAR)-এর রিপোর্ট।

3. ‘Biofertilizers & Biocontrol Agents for Agriculture : How to Identify & Develop New Potent Microbial Strains and Traits’, M. Pirttilä, H. M. Parast Tabas, […] and J.J. Koskimäki [Francois Lefort, Academic Editor Ecology & Genetics, University of Oulu, Oulu, Finland]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান