মৌমাছির লড়াইয়ে সুন্দরবনের পরিবেশ বিপন্নতা

সসীমকুমার বাড়ৈ

“…জঙ্গলের ডাঁশ মৌমাছির সাথি পালা মাছির লড়াই নেগেছে। এই লড়াই তো যুদ্ধের চাইতেও বড়ো যুদ্ধ।”*

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বীভৎসতা সম্বন্ধে আমরা সকলেই কমবেশি জানি। মৃত্যু এবং মানুষের সৃষ্ট সম্পদ ধ্বংসে আমরা উদ্বিগ্ন হই, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রায়শই আমাদের অগোচরে থেকে যায় অন্য একটি বিষয়, তা হল ব্যাপক পরিবেশ ধ্বংস। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা নাপাম (napalm) বোমা মেরে এবং বুলডোজার চালিয়ে ভিয়েতনামের বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড় পর্বতসহ বনাঞ্চলের ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। এ তো গেল মনুষ্য জগতের কথা, প্রাণী জগতেও নিরন্তর লড়াই চলে তা অবশ্য খাদ্য খাদকের লড়াই। এলাকা দখলের লড়াই। এই যুদ্ধে মানুষ সহযোগী না হলে তা প্রাকৃতিক হয়েই থাকে। কিন্তু মানুষের স্বার্থে হলে তা হয়ে দাঁড়ায় কৃত্রিম যুদ্ধ। ইদানীং সুন্দরবনে মৌমাছিতে মৌমাছিতে লেগেছে এক ধরনের নতুন লড়াই, সে যুদ্ধে তীব্র হয়ে উঠেছে মানুষের ভূমিকায়। 

ঘৃণ্য দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের অভিঘাতে অনুপ্রবেশ শব্দটি বেশ পরিচিত। কিন্ত জীব-বৈচিত্র্যময় জগতেও এমন অনুপ্রবেশ আকছার ঘটে এবং এলাকা দখলের লড়াই চলতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের অগোচরে ঘটে। যুদ্ধটা স্বাভাবিক যতক্ষণ না মানুষের হস্তক্ষেপ না ঘটে, অথবা সেই লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদতদাতা হয়ে ওঠে মানুষ। মানুষের মদত ঘটলে তা কৃত্রিম যুদ্ধে পরিণত হয়। পোষা মৌমাছির অনুপ্রবেশে তেমন একটি কৃত্রিম পতঙ্গযুদ্ধ শুরু হয়েছে সুন্দরবনে। 

মানুষের হাত ধরে সুন্দরবনে পোষা মৌমাছির অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর আটের দশকে। তখন মূলত দুই চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ থেকে মৌমাছি পালকরা বাক্স-তোরঙ্গ নিয়ে সুন্দরবনে যেত। বর্তমানে দ্বীপবাসী বেশ কিছু যুবক মৌমাছি পালনে যুক্ত হয়েছে। তারা আন্দোলন চালাচ্ছে নৌকায় করে তাদের পোষা মৌমাছির বাক্স বনাঞ্চলে নিয়ে যাবে। রাজনৈতিক আশ্বাসও মিলেছে একে বৈধ করার। এখনও মূলভূমি থেকে নিয়ে যাওয়া মৌ-বাক্স লোকের বাড়ি, বাঁধে, বনের পাশে বসায় তারা। জমির মালিক সিজনে বাক্স প্রতি এক কেজি মধু কমিশন পায়। মধু আড়তদাররা অগ্রিম বা দাদন দেয় পালক ও জমির মালিকদের। বিশাল সংখ্যক বিদেশি মৌমাছির ক্রমবর্ধমান হারে সুন্দরবনে অনুপ্রবেশ ঘটে চলছে প্রায় গত চল্লিশ বছর ধরে। ধারণা করা হচ্ছে মৌ-মরশুমে (মার্চের শেষ থেকে জুন পর্যন্ত) স্থানীয় এবং মূল ভূ-খণ্ড থেকে যাওয়া মিলিয়ে প্রায় কুড়ি হাজার মৌমাছির বাক্স স্থাপন করা হয় সুন্দরবনে। অনাদিকাল থেকে সুন্দরবন ছিল ডাঁশ মৌমাছির (এপিস ডরসাটা)। তারাই ভূমিপুত্র (পতঙ্গ)। ডাঁশরা যে ফুলের রস ও ফুলের পরাগ সংগ্রহ করত তাতে নতুন করে ভাগ বসাচ্ছে বাক্সের মৌমাছিরা। ফলে জঙ্গলে ডাঁশ ও পোষা মৌমাছির মধ্যে রাজত্ব বাঁচানোর ও দখলের ভয়ংকর লড়াই শুরু হয়েছে। রয়াল জেলি, মধু উৎপাদন ও জীবন ধারণের জন্য মৌমাছির বিশুদ্ধ জলেরও দরকার। সুন্দরবনাঞ্চলে পুকুর, ডোবায় জল সংগ্রহ করার সময়ও দুই দলের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হচ্ছে। বিশুদ্ধ জলে লবণ খানিক সহায়ক হলেও সুন্দরবনের বেশি লবণাক্ত পুকুরের জল অনভ্যস্ত পোষা মৌমাছির আন্ত্রিক রোগ বৃদ্ধি করে। ডাঁশ মৌমাছি হিংস্র, জেদি আর আকারে বড়ো হলেও পোষা মৌমাছি শক্তিশালী এবং সংঘবদ্ধ। এদের আক্রমণে ডাঁশরা এঁটে উঠতে পারে না। মারা পড়ছে অসংখ্য সুন্দরবনের আদি বাসিন্দা ডাঁশ। রোগগ্রস্ত মৌমাছির সংস্পর্শে আসায় বুনো মৌমাছির মধ্যেও ‘ফাউল ব্রউড’ রোগের সংক্রামণ ঘটছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ বুনো মৌমাছি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে সুন্দরবনের জৈব সংকট। মৌমাছির মড়ক পূর্ণমাত্রায় শুরু হলে সুন্দরবন ধ্বংস অনিবার্য। জুলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার গবেষকরা জানিয়েছেন, সুন্দরবনে পোষা মৌমাছি বৃদ্ধির ফলে ডাঁশ মৌমাছি ও খলসি গাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। সুন্দরবন থেকে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে গড়িয়া, লতাসুন্দরী, কৃপালের মতো অনেক ম্যানগ্রোভ (‘বাঁচায় ম্যানগ্রোভই, তবু লুপ্ত কিছু প্রজাতি’, সুপ্রকাশ মন্ডল, প্রসেনজিৎ সাহা, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ ডিসেম্বর ২০২০)। আইনস্টাইন এই সংকটের কথা বহু আগেই বলেছেন, মৌমাছি না থাকলে মানব সভ্যতার আয়ু মাত্র চার বছর, কারণ মৌমাছি পরাগ সংযোগের আশি ভাগই ঘটিয়ে থাকে। আমেরিকা, চিনসহ নানা দেশে ব্যাপক হারে মৌমাছির হ্রাসের ফলে কৃষি এখন সংকটের মুখে। কৃত্রিম উপায়ে পরাগ সংযোগ ঘটিয়ে কোনো রকমে সমস্যার ঠেকা দিচ্ছে দেশগুলো। সংকট কিন্তু আমাদের ঘরেও শুরু হয়েছে। সবজি চাষে বহুক্ষেত্রেই চাষিদের কৃত্রিম উপায়ে পরাগ সংযোগ করতে হচ্ছে। গ্রামবাসী একে বলে “ফুল লাগান”। পটল চাষিদের অবস্থা দুর্বিষহ। সারারাত জেগে পরাগ সংযোগ করতে হচ্ছে। শুধু অধিক ফলনের জন্য নয়, মৌমাছি কমে যাওয়ায় এবং অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের জন্য মৌমাছি বিষাক্ত ফুল এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। সুন্দরবনে ঘটছে উলটো ঘটনা, অত্যধিক অসুস্থ মৌমাছির অনুপ্রবেশের ফলে বুনো মৌমাছি শুধু মারা পড়ছে না, একই ফুল থেকে বহু সংখ্যক মৌমাছির মধু সংগ্রহের চেষ্টায় ফুল ঝরে গিয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বন বৃদ্ধির সম্ভাবনা। এ এক কৃত্রিম জৈব সংকট, যা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে সুন্দরবনের স্বাস্থ্যকে।

সুন্দরবন বৃদ্ধিতে মৌমাছি অত্যন্ত গুরুপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সুন্দরবনের মৌমাছি আজকাল পরোক্ষভাবে সংক্রামিত হচ্ছে “ফাউল ব্রউড’ নামে এক ধরনের আন্ত্রিক রোগে। সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া বাহক হল বনে আসে পোষা মৌমাছি। বিষয়টি একটু ভালো করে বোঝা যাক। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, মৌমাছি পালকদের মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে মধু রপ্তানি বাণিজ্য মার খাচ্ছে। মৌ-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে আজকাল সুন্দরবনও জুড়ে যাচ্ছে এবং পরোক্ষে বিপন্ন করছে বনকে। মৌমাছি পালকরা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করে। মূলত পোষা বা বিদেশি মৌমাছি (এপিস মেলিফেরা)-র মধ্যে ‘ফাউল ব্রউড’ নামের আন্ত্রিক রোগ হয়। রোগটি ছড়ায় প্যানিব্যাসিলাস লার্ভা থেকে। মৌমাছির অন্ত্রে বাস করে আট প্রজাতির মিত্র ব্যাকটেরিয়া, যারা পাচনে সাহায্য করে। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আসা “ফাউল ব্রউড” দ্রুত হারে শ্রমিক মৌমাছির মৃত্যু ঘটায়। শ্রমিক ছাড়া রানি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। রানিও শ্রমিকের মাধ্যমে এই রোগে সংক্রামিত হয়। ফলে রানিসহ পুরো কলোনির সর্বনাশ ঘটে। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক টেট্রাসাইক্লিন ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মিত্র ব্যাকটেরিয়া সমূহ (microbiomes)। ইতিমধ্যে চার প্রজাতির মিত্র ব্যাকটেরিয়া অবলুপ্ত হয়েছে। সুযোগে মৌমাছির শরীরে বাসা বাঁধছে সের্‌রাসিয়া জাতীয় এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা মৌমাছির মৃত্যুহার বৃদ্ধি করছে। প্যানিব্যাসিলাস লার্ভাও চরিত্র বদলে প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলছে। অ্যান্টিবায়োটিকের বিষাক্ত প্রভাবে তৈরি হচ্ছে সংক্রামক ব্যাধি। ফলত মৌমাছির স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে এবং মৌমাছির কলোনি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এমনই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন টেক্সাস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। আমেরিকায় মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৪০ শতাংশেরও বেশি। ভারতসহ সারা বিশ্বেই মৌমাছি কলোনি পতনের নৈরাজ্য শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। জাতিসংঘ ২০১৬ সালে সারা পৃথিবীকে সতর্ক করেছে যে ব্যাপক হারে মৌমাছির কলোনিতে ধ্বস নেমেছে। অতি সত্বর ব্যবস্থা না নিতে পারলে মানব সভ্যতা সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। 

মৌমাছি পালকের ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, পরিষ্কার জলের ব্যবহার, বাক্স-ফার্মের দূষণমাত্রা ইত্যাদির সঙ্গে রোগটির গভীর সম্পর্ক। মৌমাছি স্বাস্থ্যবিধি আমাদের দেশের পালকরা খুব একটা মানে না। মৌমাছি পালকদের নিজেদের এবং মৌমাছির স্বাস্থ্য বিধি-জ্ঞান খুব সীমিত, ফলে রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার মাত্রাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দেখা যায় পোষকরা সাধারণত অপরিষ্কার পরিবেশে মৌমাছি লালন পালন করে। বাক্সে মৌমাছির পরিচর্যা করে প্রতিবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া দরকার, সেই জল মাটি দিয়ে চাপা দিতে হয়। মৌমাছির কাছে মদ্যপান, বিড়ি-সিগারেট পান, নোংরা জামা কাপড় রাখা বা মোবিল ডিজেল রাখা একেবারেই কাম্য নয়। ১৯৭৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল জন ফ্রিশ মৌমাছির আচরণ বিশ্লেষণ করে শরীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি মৌমাছির নাচের কোণ, দূরত্বের গাণিতিক বিশ্লেষণ করেছিলেন। কত দূরত্বে ফুল আছে, তার কৌণিক অবস্থান কী, ফুলে কেমন মধু আছে তার সমস্তই প্রকাশ থাকে মৌমাছির নাচের মধ্যে। কোণ তৈরি হয় সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে। এবং চাককে কেন্দ্র করে নাচবৃত্তের ব্যাসার্ধ বলে দেয় তার দূরত্ব। এবং নাচে আনন্দ থাকলে বুঝতে পারা যায় ফুলে ভালো মধু আছে। সুন্দরবনের মউলেরা তাদের অধীত বিদ্যায় স্বাভাবিক ভাবেই মৌমাছির নাচ দেখে অনেক কিছু অনুমান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে নাচের সঙ্গে সুন্দরবনের পরিবেশের সম্পর্ক কী? এখানেও গভীর সম্পর্ক আছে, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যাবহারে এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে মৌমাছি শুধু আন্ত্রিক রোগগ্রস্তই হয় না, গন্ধশক্তি, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। একবার তেমনটি ঘটলে সমূহ বিপদ। মৌমাছি আর চাকে ফিরে আসতে পারে না। কোন ফুলে মধু আছে তা চিনতে পারে না। তেমনটি ঘটলে চাকের ধ্বংস, রানির মৃত্যু অনিবার্য। মানসিক ভারসম্য হারিয়ে ফেললে ফুল থেকে মধু নিয়ে আর চাকে ফিরতে পারবে না, ফুলের কৌণিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে না। ফলে সামগ্রিকভাবেই বিশ্বপ্রকৃতির উপর তার প্রভাব পড়বে, সুন্দরবনে এমনই ঘটনা কমবেশি ঘটে চলছে।  

প্রতি বছর সুন্দরবনে সাদা বাইন, কাঁকড়া, খলসি, গেঁও, কেওড়া, গর্জন, চৈলা,পশুর, ঝানা, সিংরা, হরগোজা প্রভৃতি গাছের ফুলের মরশুম মার্চ থেকে জুন, চার মাসের। নদীয়া, দুই চব্বিশ পরগনা থেকে প্রায় কুড়ি হাজার বাক্স-মৌমাছি নিয়ে পালকরা দ্বীপে হাজির হয় পিক সিজনে। সুন্দরবনের জৈব সংকটের সঙ্গে শুরু হয়েছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকটও। বিভিন্ন ধরনের পাস নিয়ে প্রায় মউলরা বংশানুক্রমে বনের বিশুদ্ধ মধু সংগ্রহ করে জীবিকা অর্জন করে। এই তিন মাসে এটাই তাদের মুখ্য আয়। যদিও এটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রাচীন পেশা। পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রত্নপ্রস্তর চিত্র নিদর্শন “কুভ্য দ্য লা আরানা” থেকে বোঝা যায় এই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সম্পদ আহরণে মানুষ যত্নশীল ছিল। অনুপ্রবেশকারী মৌমাছি আসার ফলে, যে সব বনে মউলদের প্রবেশাধিকার আছে সেখানে চাকে আর আগের মতো মধু পাওয়া যায় না। আগে যে চাকে এক দেড় মণ মধু হত সেখানে এখন আর দশ টনের কেজির বেশি মধু মেলে না। বুনো মৌমাছিরা সাধারণত একই গাছে বা ধারে কাছে চাক বাঁধে। বুনো মৌমাছি সংক্রামিত হওয়ার ফলে মধুর মানও আগের মতো থাকছে না। মৌমাছির লড়াই অর্থনৈতিক কারণে রূপান্তরিত হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতায়। মউল, মৌমাছি পালক বা আশ্রয়দাতার মধ্যে তৈরি হচ্ছে আর্থ-সামাজিক বৈরিতা। রাজ্যে তিরিশ হাজার মৌমাছি পালক যে ২৫-৩০ হাজার টন মধু সংগ্রহ করে, তাতে সুন্দরবনের আহরিত ৩০০ টনের মতো মধু থেকে। পৃথিবী বিখ্যাত পুষ্টিকর সুস্বাদু সন্দরবনের মধুও অ্যান্টিবায়োটিকের দোষে দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মধুতে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য আমেরিকা, ইউরোপে রাজ্যের মধু রপ্তানি বাণিজ্য এক ধাক্কায় হ্রাস পেয়েছিল ৫০-৬০ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারত থেকে মধু রপ্তানি হয় ৮২-৯০ হাজার টন। শুধু মৌবনের জগৎখ্যাত মধুর বিশুদ্ধতাই হারাচ্ছে না, অসাধু ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে ভারতীয় মধুর খ্যাতিও। যে নামীদামি ব্র্যান্ডের মধু বাজারে অত্যন্ত চালু তাতে ভেজালের খবরে আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। Centre for Science and Environment (সিএসই) নামে একটি সংস্থা দাবি করেছে, তারা ১৭টি বড়ো এবং মাঝারি ব্র্যান্ডের ২২টি নমুনা পাঠিয়েছিল National Dairy Development Board-র Centre for Analysis and Learning in Livestock and Food-এ। Nucleus Magnetic Resonance টেস্টে মাত্র ৫টি নমুনা পাশ করেছে, বাকি ৭৭% (১৭টি নমুনা) মধুতেই চিনির ভেজাল সিরাপ মিশানো হয়েছে। ডাবর,পতঞ্জলি, বৈদ্যনাথ, এপিস হিমালয়াজ-এর মতো নামী সংস্থাগুলির মধুও পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। সিএসই জানিয়েছে, ১৩টি নমুনা জার্মানির পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র তিনটি পাশ করেছে। এই ভেজাল মধুতে আছে চিনির সিরাপ। সিরাপ সি৩, সি৪ সুগার টেস্টের মতো সাধারণ পরীক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। এই চিনির ভেজাল সিরাপগুলো আসে চিন থেকে, যা মধুর সঙ্গে ৫০-৮০% মেশালেও সি৩, সি৪ সুগার টেস্টে ধরা পড়ে না। সহজেই অনুমেয় মৌ-সুখে কীভাবে বিষ মিশছে। (‘‘চিনি গো চিনি’ বলছে সমীক্ষা’, এই সময়, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০)। এর সঙ্গে সুন্দরবনের মধুর তুলনা অনিবার্য, সুন্দরবনের পদ্মমধু পৃথিবী বিখ্যাত অন্যান্য মধুর মধ্যে অন্যতম। খাদ্যগুণ, পুষ্টিগুণ এবং রোগব্যাধি নিরাময় ক্ষমতায় এর জুড়ি নেই। কিন্তু মূলভূমি থেকে বয়ে নেওয়া বিষের ধাক্কায় তাও বিপন্ন। তেমনি বিপন্ন পেশা। 

সুন্দরবনের জৈব বৈচিত্র্য সংকটের জন্য শুরু হয়েছে এক অকল্পনীয় আর্থ-সামাজিক সংকট। বিভিন্ন ধরনের পাস নিয়ে মউলেরা পুরুষানুক্রমে বনের বিশুদ্ধ মধু সংগ্রহ করে আংশিক জীবিকা অর্জন করে। পেশার সঙ্গে যুক্ত প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। বাঘের ডেরা থেকে মধু সংগ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। বেশ প্রাচীনও। সুন্দরবনের যে এলাকায় মউলদের প্রবেশাধিকার আছে সেখানে চাকে আর আগের মতো মধু মেলে না পূর্বেই বলা হয়েছে। ফলে তাদের অনেকেই অবৈধভাবে গভীর সুন্দরবনের প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকায় গোপনে মধু ভাঙতে যায়। পোষা মৌমাছি আট-দশ কিলোমিটারের মধ্য থেকে মধু সংগ্রহ করে, ফলে তার বাইরে গভীর বনে মধু প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। মউলরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোর এলাকায় লুকিয়ে প্রবেশ করে। অনেক সময় তারা বাঘের ও জলদস্যুর আক্রমণে ভয়ংকর পরিণতির মুখোমুখিও হয়। ২০২০-তে ২৪ জন এবং ২০২১-এ ২০ জন বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে। অনধিকার প্রবেশে জীবনহানি হলে কোনো সরকারি সাহায্য মেলে না। বর্তমানে পেশার ঝুঁকির জন্য নবীন প্রজন্মের অনেকেই আর প্রচলিত মধু ভাঙা পেশায় যুক্ত হতে চায় না। তারা কেউ কেউ মৌমাছি পালন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু মধুর বিশুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে তাই নয়, গাছের সংখ্যা হ্রাসের কারণে বনে গাছের ঘনত্ব কমে যাচ্ছে। ঘনত্ব হ্রাসের জন্য ঝড় বাদল সাইক্লোনে অল্পেই লবণাম্বু গাছের পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। 

করোনাকালে সুন্দরবনের স্বাস্থ্যের খানিকটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সুন্দরবনের মধু ভাঙার সিজন মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত, করোনা ভীতি শুরু হয়েছিল উনিশের মার্চের প্রথম থেকেই। লকডাউন শুরু হওয়ার জন্য মধু ভাঙার পাস দেওয়া হয়নি। আসেনি মৌমাছি পালকেরাও। ফলে সুন্দরবনের ডাঁশ মৌমাছি দ্বারা পরাগায়ণ প্রক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। করোনা আবহে সারা পথিবী প্রায় স্তব্ধ ছিল। কলকারখানা, যানবহন, প্লাস্টিকের ব্যবহার, বৃক্ষ নিধন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পরিবেশে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে দূষণমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন। সুন্দরবনে জাহাজ নি:সৃত তেলও কম ভেসেছে, গঙ্গাবাহিত সারা দেশের কলকারখানার বর্জ্যের মাত্রা জঙ্গলে কমে নেমেছে। বস্তুত সুন্দরবনে অসুস্থ মৌমাছির অনুপ্রবেশ না ঘটায় অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য ক্ষয় হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জৈব পরাগ মিলন হয়েছে স্বাভাবিক। জঙ্গলের উপর অতিরিক্ত মাত্রায় জীবিকা চাপও এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে গিয়েছিল। সুন্দরবনের স্বাস্থ্য রক্ষায় এই দূষণমুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দরবনে লবণাম্বু গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে অনেকাংশে। যদিও উমপুনের কারণে সুন্দরবনের জৈব মেকানিজম খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ জৈব পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। জঙ্গলের উপর জীবিকার চাপ ও নির্ভরতা কমানো দরকার। আর মৌমাছি শৃঙ্খলে রোগগ্রস্ত বিদেশি মৌমাছির অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। তা হলে সুন্দরবন নিজের স্বাস্থ্য নিজেই পুনরুদ্ধার করে নিতে পারবে। সুন্দরবন একটি জীবিত সত্তা, নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা তার নিজের আছে। তাকে শুধু নিজের মতো থাকতে দিতে হবে, তাহলেই সুন্দরবনে বইবে মৌ-বাতাস। মিলবে পদ্মমধু। মধুরেণ সমাপয়েৎ— উচ্চারিত হবে জঙ্গলময়।

(*‘সুন্দরবনের মহাল কইন্যা’, সসীমকুমার বাড়ৈ, একুশ শতক।)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান