পার্থিব বসু
প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ব্যবহার করে সীমাহীন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যে দিনের পর দিন চলতে পারেনা; সেই সীমাহীন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যে মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত এবং সর্বোপরি এই বৃদ্ধি ও পরিবেশের ভালো থাকা যে মৌলিক ভাবে প্রতিস্পর্ধী এ উপলব্ধি জোরদার হয় গত শতকের সত্তরের দশক নাগাদ। ১৯৭২-এ প্রথম বসুন্ধরা সম্মেলন স্টকহোমে। সেখানে পরিবেশের হাল হকিকত— তার ভালো থাকার সঙ্গে মানব কল্যানের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রে। ১৯৭৪ সালে বেরোয় Limits to Growth রিপোর্ট। সেই রিপোর্ট শুধু যে অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকা শিল্পোন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে অবাধ অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে লাগাম পরানোর কথা বলে তা নয় সওয়াল করে অনুন্নত দেশগুলিতেও অবাধ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। ১৯৭৩-এ শুমাচারের বই ‘Small is Beautiful’-যা সারা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয় তাতেও ছিল এই কথারই রকম ফের। গেল শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে বিশ্ব জুড়ে ক্রমজোরদার ও সংবদ্ধ হতে শুরু করে পরিবেশকে নিয়ে গভীর উদ্বেগ। লাগামহীন মুনাফার দৌড়ে যে আসলে হেরে যাচ্ছে পৃথিবী-ই, কবর খোঁড়া হচ্ছে মানব সভ্যতার সে কথা উঠে আসতে থাকে সোচ্চারে। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের পাশাপাশি শুরু হয় মুনাফা সর্বস্ব, প্রকৃতির স্বাস্থ্য-কে তোয়াক্কা না করা অর্থনীতির বিরুদ্ধেও আওয়াজ ওঠার।
বিশ্ব পুঁজির কাছে সে আওয়াজ যে শ্রুতি মধুর হল না তা বলাই বাহুল্য। অথচ, যে আওয়াজগুলো উঠছিল সে গুলোর সারবত্তা নিয়ে বাড়তেই থাকে সামাজিক সমর্থন। বিশ্ব পুঁজির তাই দরকার হয়ে পড়ে উন্নয়নের আর এক প্রত্যুত্তর মডেল। অনেকেই মনে করেন সুস্থায়ী উন্নয়ন বা টেকসই উন্নয়নের (আমরা সুস্থায়ী শব্দটি বেছে নিচ্ছি এই আলোচনাতে) ধারণা উঠে আসে এই Limits to Growth তত্ত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। প্রতিক্রিয়া হলেও সুস্থায়ী উন্নয়নের মূল ধারণা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রসারন নয় – স্থায়িত্বের ওপরেই। পরিবেশের স্থায়িত্বকে অবিঘ্নিত রেখে এমন এক উন্নয়নের ধারা যার বহমানতা হবে স্থায়ী। গত তিন দশকে এই সুস্থায়ী উন্নয়নের ধারণা স্বভাবতই উঠে এসেছে অন্যতম প্রধান চর্চিত এক উন্নয়ন আদর্শ হিসেবে। এমন এক আদর্শ যা বলে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে উন্নয়নের বদলে প্রকৃতিকে-পরিবেশকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের কথা। এমন এক উন্নয়ন আদর্শ যা স্বীকার করে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের মধ্যে উন্নয়নের সমতার কথা। উচ্চারণ করে অর্থনৈতিক সমতা, সামাজিক সমতা এবং সর্বোপরি পরিবেশগত সমতার কথা। যদি মেনেও নেওয়া যায় যে মূল স্রোতের সুস্থায়ী উন্নয়নের তত্ত্ব আসলে বিশ্বপুঁজির প্রতিক্রিয়াজাত তাহলেও সুস্থায়ী উন্নয়নের মূল ধারণার সঙ্গে বিরোধের জায়গা আছে কি? এই লেখায় চেষ্টা তারই উত্তর খোঁজার।
১৯৮৭-তে রাষ্ট্রসংঘ নরওয়ের তখনকার প্রধানমন্ত্রী গ্রো ব্রান্ডটল্যান্ড-এর নেতৃত্বে তৈরি করে World Commission on Environment and Development। ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশন বলে ভাবী প্রজন্মের উন্নয়নের ক্ষমতার কোনোভাবে ক্ষতি না করে বর্তমানের চাহিদা মেটায় যে উন্নয়ন সেই হল সুস্থায়ী উন্নয়ন। ব্রান্ডটল্যান্ড রিপোর্টের কেন্দ্রীয় বক্তব্য ছিল যে পৃথিবীর বিরাট অংশে রয়েছে দারিদ্র্য এবং পরিবেশ অবক্ষয়ের সহাবস্থান। বলা হয় যে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি এক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের কিনারায়। বলা হল যে দারিদ্র্য থেকে মুক্তিই হল তা মোকাবিলার রাস্তা। ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশন দারিদ্র্যকেই চিহ্নিত করে পরিবেশ অবক্ষয়ের মূল কারণ হিসেবে। কমিশন তার রিপোর্টে বলে যে দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার পেতে যেটা সর্বাগ্রে দরকার তা হল অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলির দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
আর এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার লক্ষ্যে এই রিপোর্ট যে দিশা দেখায় তা হল মুক্ত বাজারের দিশা। বলে যে অনুন্নত দেশগুলির অর্থনৈতিক ‘বৃদ্ধি’-র জন্যে দরকার প্রযুক্তি, পুঁজি, জ্ঞান সহ নানান রসদ — যার জোগান দেবে উন্নত দেশগুলি!
১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোর বসুন্ধরা সম্মেলনে আরও বিস্তৃত আলোচনা হল এই নিয়ে। এই সম্মেলন থেকে এজেন্ডা ২১ বলে যে সনদটি সাক্ষরিত হয় সেখানে বলা হল সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্ব অংশিদারীর কথা (global partnership for sustainable development)। বলা হল যে পরিবেশের স্বাস্থ্যের সঙ্গে তালমিল করে উন্নয়নের মাধ্যমেই একমাত্র মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো সম্ভব; সম্ভব সবার জন্যে উন্নততর জীবনযাত্রার মান সুনিশ্চিত করা, সম্ভব সবার জন্যে আরও সুরক্ষিত এবং সমৃদ্ধতর ভবিষ্যৎ।
আবার, সবকিছু বলার পরেও সমাধান খুঁজতে এজেন্ডা ২১-এর দিশা সেই মুক্ত বাজার অর্থনীতিরই। বলা হল বিশ্ব অর্থনীতিকে পরিবেশ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সুস্থিত সেই উন্নয়ন হাসিল করার হাতিয়ার হবে বিশ্ব বাণিজ্যের উদারীকরণ (United Nations Conference on Environment and Development, 1992, sec. 2.3)। এজেন্ডা ২১-র ছত্রে ছত্রে রয়েছে যে, এক মাত্র মুক্তবাজার অর্থনীতিই পারে পরিবেশ ও উন্নয়নকে একসঙ্গে মিলিয়ে পথ হাঁটতে। “Some enlightened leaders of enterprises are already implementing “responsible care” and product stewardship policies and programs, fostering openness and dialogue with employees and the public and carrying out environmental audits and assessments of compliance. These leaders in business and industry, including transnational corporations, are increasingly taking voluntary initiatives, promoting and implementing self-regulations and greater responsibilities in ensuring their activities have minimal impacts on human health and the environment. (United Nations Conference on Environment and Development, 1991” sec. 30.3). এর থেকে অন্যতর কোনও ভাষা হওয়ার কথাই ছিল না এই সনদের — যে দেশ নেতারা ভরিয়েছিলেন এই শীর্ষ বসুন্ধরা সম্মেলন তাঁদের বেশির ভাগই নিজের নিজের দেশে ইতিমধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন (অবশ্যই আজও আছেন) নয়া উদার অর্থনীতির অর্গলে।
লক্ষ না করে উপায় নেই যে ১৯৯২-তেই বিশ্ব ব্যাংক তাদের রিপোর্টে জোর গলায় সওয়াল করে সুস্থায়ী উন্নয়নের পক্ষে। এই রিপোর্ট সুস্থায়ী উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করে– এমন উন্নয়ন যা টিকবে এই বলে। পরিবেশের অবক্ষয়ের প্রভাব থেকে যে উন্নত দেশগুলোও বাদ যাবে না তা স্বীকার করে নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর পরিবেশের অবক্ষয়ের জন্যে এই রিপোর্ট দায়ী করে তাদের জনসংখ্যাকে। দায়ী করে পরিবেশ প্রকৃতির লাগামহীন ক্ষতি করে আসা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে নয়– দায়ী করে দারিদ্র্যকে। দায়ী করে তাদের প্রযুক্তিগত ভাবে পিছিয়ে থাকাকে। এই রিপোর্টও বাঁধা গতেই এবং অনুমানযোগ্য ভাবেই তুলে ধরে যে – “দারিদ্র্য, জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা এবং অজ্ঞতাই পরিবেশের অবক্ষয়ের মূল কারন” হলেও “উন্নয়নের বাজার বান্ধব রাস্তাই তার থেকে পরিত্রাণের উপায়”। বিশ্ব ব্যাংকের সুস্থায়ী উন্নয়নের সে পথের মূল চার উপাদান হল — “বানিজ্যিক উদ্যোগের বাড়বাড়ন্তের জন্যে অনুকূল পরিবেশ, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তার সমন্বয়সাধন”, “মানব সম্পদে বিনিয়োগ এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।“ দরকার দেশে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো। (P 65. World Bank 1992). যা দাঁড়াচ্ছে সুস্থায়ী উন্নয়নের বর্তমান মূল বক্তব্যে তাই ঘুরে ফিরে সেই বিশ্ব পুঁজিবাদেরই আবাহন। আবাহন বিশ্বপুঁজির শর্তে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকেই চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির দিশা মৌলিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসে তো নয়ই। অনেকেই তাই আঙুল তুলে বলে আসছেন যে সুস্থায়ী উন্নয়নের মূল স্রোতের যে ধারণা তা আসলে নয়া উদার অর্থনীতিভিত্তিক উন্নয়নের মডেলের বড়োজোর কিছু সংশোধন— তাকে চ্যালেঞ্জ করা তো একবারেই নয়। এই সময়ের অন্যতম ইকলজিকাল মার্কসিস্ট ও’কন্নর-এর কথায় পুঁজিবাদের কাছে সুস্থায়ী কথার মানে তাই পরিবেশের স্বাস্থ্যকে কোনোভাবে বাঁচিয়ে বর্তে রেখে সে পুরোনো গতে অর্থনৈতিক ‘বৃদ্ধি’-র স্থিতিশীলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এইখানেই ঝুলি থেকে বেরোয় বেড়াল। প্রশ্ন আসে — বিশ্ব পুঁজি তার মুনাফাকে নিশ্চিতও করবে আবার একই সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তার দখলদারি কমিয়ে পরিবেশকেও সুরক্ষিত রাখবে এটা কি সোনার পাথরবাটি নয়? এটা যে আদতে তাই সে কথা বুঝিয়েছেন ও’কন্নরের মতো ইকলজিকাল মার্কসিস্টরা। একটু বুঝে নেওয়া যাক।
পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত মূল দ্বন্দ্ব হল উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদনের সম্পর্কের। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে শুধু পণ্য তৈরি হয় তা নয়— তৈরি হয় শোষণজাত উদ্বৃত্ত মূল্য। মুনাফাকে টিকিয়ে রাখতে হলে শোষন বাড়িয়ে— উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি বাড়িয়ে চলতেই হবে। বাড়িয়ে চলতেই হবে পণ্য উৎপাদন। আর উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের জোগান বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাজারে কমবে তার চাহিদা। পুঁজিবাদের সমস্যা হল শোষণ জাত উৎপাদিত পণ্যের চাহিদাকে টিকিয়ে রাখা। এক কথায় অতি উৎপাদনের সংকট। এই সংকটের সঙ্গে ও’কন্নর যোগ করেছেন দ্বিতীয় আর এক দ্বন্দ্বের কথা।
পুঁজিবাদের এ দ্বন্দ্ব হল উৎপাদনের সম্পর্ক এবং উৎপাদন ব্যবস্থার কিছু সহায়ক শর্তের (Conditions of production) দ্বন্দ্ব। এই শর্তগুলি কী বা কেমন? এই শর্তের মধ্যে আসে পরিবেশের ভৌত বা জৈবিক উপাদানের গুণমান (জল, জঙ্গল, মাটি, বাতাসের গুণমান), শ্রমের গুণমান, এবং সামাজিক পরিস্থিতির গুণমান। উৎপাদনের এই সব শর্তগুলির গুণমান বজায় রাখার নিশ্চয়তা দেয় বা লভ্য করে বৃহত্তর সমাজ ও প্রকৃতি। পুঁজি নয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা তার মুনাফাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তার উৎপাদন ব্যবস্থার এই সব মৌলিক শর্তগুলিকেই ধীরে ধীরে ধ্বংস করে চলে। আসলে ধ্বংস করে সে নিজেকেই। মৌলিক শর্তগুলির দেখভাল করাকে অবহেলা করতে করতে তৈরি হয় এমন অবস্থা যে একটি উৎপাদন ব্যবস্থা নিজের মতো আর একটি আর তৈরি করতে পেরে ওঠে না। কারণ, যে প্রাকৃতিক, সামাজিক ভিতের ওপর সে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্বংস হয়ে গেছে সেটাই। ও’কন্নর বলেছেন এ হল Production-Reproduction এর দ্বন্দ্ব। এক কথায় উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করা উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে— এ আসলে আত্মঘাতী হয়ে যাওয়ার বিপদ। পুঁজিবাদের প্রথম অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব যদি হয় চাহিদা টিকিয়ে রাখার— তার দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব হল উৎপাদনের খরচের ভারসাম্য বজায় রাখার। মুনাফা টিকিয়ে রাখতে এবং বাজারে টিকে থাকতে তাকে বাধ্য হয়ে উৎপাদনের শর্তগুলির স্বাস্থ্য বজায় রাখার যে খরচ তাকে ছেঁটে ফেলতেই হয় পণ্যের দাম থেকে। এই দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের কারণ তাই পুঁজিবাদের যাবতীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের, ভূপ্রকৃতির খুল্লামখুল্লা ব্যবহার এবং তার ফলে ধীরে ধীরে সেগুলির ধ্বংস সাধনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের উৎপাদনের শর্তগুলিরই বারোটা বাজানো। পুঁজিবাদের প্রথম দ্বন্দ্বের থেকে যদি পরিসর তৈরি হয় শোষণের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের; পুঁজিবাদের এই দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের থেকে তবে তৈরি হয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ-প্রকৃতিকে বাঁচানোর লড়াইয়ের ক্ষেত্র।
তাহলে? মূলধারার যে সুস্থায়ী উন্নয়নের কথা উঠে এসেছে গেল তিরিশ বছর ধরে— যে উন্নয়নের মৌলিক ধারণার— মানব জাতির বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনের সর্বজনীন স্বীকৃতি মিলছে বিশ্বজুড়ে— মেনে নিয়েছে দেশের পর দেশ— বিশ্ব পুঁজিবাদের নেতৃত্বে সেই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর দিশা— যা কিনা ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশন রিপোর্ট থেকে শুরু করে এজেন্ডা ২১ বা বিশ্ব ব্যাংকের নথির ছত্রে ছত্রে— তা কি সোনার পাথরবাটি নয়?
অবশ্যই। কিন্তু, এ কথাও মানতে হয় যে দারিদ্র্যকে উন্নয়ন ও পরিবেশ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে সুস্থায়ী উন্নয়নের ধারণাই। সমতার কথা— অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সমতার কথাকে কেন্দ্রে এনে দিয়েছে এই সুস্থায়ী উন্নয়নের আদর্শই। যতই তার সমাধানের রাস্তা দেখানোর চেষ্টা হোক না কেন সেই পুঁজিবাদের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ‘বৃদ্ধি’-তেই। ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশনের রিপোর্টের পর পর যে সব বিশ্ব সম্মেলন হয় সেখানে বারবার উচ্চারিত হয়েছে দারিদ্র্য ও উন্নয়নের আন্তঃসম্পর্কের কথা। ১৯৯৪-তে কায়রোতে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন নিয়ে সারা পৃথিবীর সাংসদদের সম্মেলনের আলোচনায় এল জনসংখ্যা ও উন্নয়নের সম্পর্ক। সেই ঘোষণায় বলা হল “… population issue should be seen not in isolation, but within the larger context of sustainable development of the planet for the betterment of humankind: economic activity that increases the quality of life for all people through curbing excessive consumption and generating productive growth; alleviating poverty; achieving sustainable agricultural and industrial production, energy and natural resources in harmony with the environment; and improving health care and the quality of, and access to, education. Actions we take now to overcome the population and development problems of today will decide the future course of humankind.” পরের বছর ১৯৯৫-তে কোপেনহাগেনে সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে শীর্ষ সম্মেলনেও একই কথার প্রতিধবনি— বলা হল দারিদ্র্য থেকে মুক্তির কথা।
দারিদ্র্য থেকে মুক্তিই হতে হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। তবে কোন পথে সে মুক্তি? কী হবে সেই মুক্তির লড়াইয়ের রণ-নির্ঘোষ? এর উত্তর খুঁজতে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশনের প্রস্তাবিত সুস্থায়ী উন্নয়নের সংজ্ঞাকেই— সেই সংজ্ঞায় নির্ধারিত উন্নয়নের মাপকাঠিকে। অধ্যাপক সেন আপত্তি জানিয়েছেন সে সংজ্ঞার ‘চাহিদা’ শব্দটিতেই। প্রশ্ন তুলেছেন— উন্নয়নের মাপকাঠি কি মানুষের ‘চাহিদা’ না তার ‘স্বাধীনতা’; না তার ‘সক্ষমতা’? ভাবী প্রজন্ম কতটা স্বাধীন ও সক্ষমভাবে তার জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে তার স্বাধীনতা? এই ‘চাহিদা’ আর ‘স্বাধীনতা-সক্ষমতা’ মাপকাঠির পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল লড়াইয়ের চাবি— লুকিয়ে আছে কেন বারবার ‘চাহিদা পূরণ’-কে টিকিয়ে রাখার কথাই উচ্চারিত হয়েছে সুস্থায়ী উন্নয়ন সংক্রান্ত সনদগুলিতে। মানুষের চাহিদাকে বহুলাংশেই প্রভাবিত করে হয় রাষ্ট্র নয় বাজার। একজন গরিবগুর্বো প্রান্তিকতম মানুষ— যার লড়াইটাই বেঁচে থাকার লড়াই— দিনের শেষ দুমুঠো ভাতের লড়াই— তার চাহিদা তো হবে দুবেলা দুটি ভাত তার আর তার পরিবারের জন্যে। এমন হত দরিদ্র মানুষের চাহিদা কী করে হবে তার ছেলে মেয়ের জন্যে স্কুল— তার পরিবারের জন্যে বিনে পয়সায় চিকিৎসা, মাথার ওপর ছাদ বা শীতবস্ত্র? সে তো তার দূর স্বপ্ন? কোন চাহিদা তার জন্যে আগে আর কোন চাহিদা পরে সে তো ঠিক করে দেবে কোনও হর্তাকর্তা— তার নিজের সাধ্য কি তা ঠিক করা! আচ্ছা, এমন হত দরিদ্র গরিব মানুষের কথা রেখে না হয় ধরা যাক সচ্ছলতর মানুষের কথাই। তার চাহিদা কী হওয়া উচিত— সে তো ঠিক করে দেয় বাজার! কেমন নুন তার খাওয়া উচিত থেকে শুরু করে কোথায় তার যাওয়া উচিত স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্যে! উপায় আছে আপনার আমার কেমন ধরনের খাবার খেতে চাই তা নির্ধারণ করার স্বাধীনতার? বিষ মুক্ত খাবার খাওয়ার স্বাধীনতা? চালের বদলে মিলেট খাওয়ার স্বাধীনতা? কেমন জীবন বাঁচতে চাই তা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার? সুতরাং, উন্নয়নের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘চাহিদা মেটানোর’ সুস্থায়িতা নয়, বরং পছন্দের জীবন নির্বাহ করার ‘স্বাধীনতার’ ‘সক্ষমতার’ সুস্থায়িতা— এমনকি তার চাহিদা কী হবে তা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার সুস্থায়িতা। খিদের থেকে মুক্তির স্বাধীনতা, নিরক্ষরতা থেকে মুক্তির স্বাধীনতা, নীরোগ জীবন কাটানোর স্বাধীনতা, সম্মানের সঙ্গে বাঁচবার স্বাধীনতা।
দারিদ্র্য থেকে মুক্তির সে লড়াইকে তাই হতে হবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণির লড়াই। পরিবেশের অবক্ষয়ের সব দোষ দারিদ্র্যের ওপর চাপিয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদের নিজেদের ঘাড় থেকে সব দায় ঝেড়ে ফেলার যে চেষ্টা তার মোকাবিলা করার রাস্তা খুঁজে নেওয়া দরকার পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেলের সংশোধনে নয়— তাকে বদলে ফেলার লড়াইয়ের ময়দানে। চাহিদা পূরণকে টিকিয়ে রাখার সুস্থায়িতার লক্ষ্যে লড়াই নয়— প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পুজিবাদের থাবা থেকে সুরক্ষিত রাখার লড়াই; সম্মানজনক জীবন জীবিকা নির্বাহ করার স্বাধীনতার লক্ষ্যে লড়াই। সে স্বাধীনতা ভাবী প্রজন্মের জন্যেও সুরক্ষিত রাখবার লড়াই। প্রকৃত সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্যে সংগ্রামকে তীব্র থেকে তীব্রতর করা দরকার দেশে দেশে। পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই, গরিব মানুষের, প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নের লড়াই আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণির লড়াই আসলে একটাই সম্পৃক্ত লড়াই।