সুশান্ত পাল
‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ — প্রবচন বলুন, হাল আমলের ডিসকোর্স বলুন, শ্রুতি-পরম্পরায় অথবা মুদ্রিত পাঠক্রমের প্রচারণায়, সর্বোপরি ধর্মানুশাস্ত্রের অনড় লিপিশাসনে — বাক্যবন্ধ সুবিদিত, সর্বজনমান্য; ডারউইনভাষ্যের পুরুষবাচক পূর্বসূরি।
‘বসুন্ধরা’ ব্যুৎপত্তিতে, মননে, কল্পনায়, প্রয়োগে স্ত্রী-বাচক শব্দ। ধনধারিণী, বসুধা, পৃথিবী; সমার্থক শব্দব্যাপ্তিতে ভূমি, ভূতল তথা দেশ। অতএব, বসুধাকে আপন বীর্যে, শৌর্যে, শক্তিমত্তায় উপভোগ করবেন কে বা কারা? উত্তর দিয়েছেন পরাশর– পুরুষবলীর ‘ভোগ্যা’ (যার আভিধানিক অর্থ ‘স্ত্রী’, ‘বেশ্যা’) হল প্রাণের ধাত্রী পৃথিবী। আর পৃথিবীর মালিক যখন পুরুষরাজা তখন স্ত্রী তথা বেশ্যা নারীর একমাত্র নিয়তি হয়ে যায় দাসীবৃত্তিতে অবনমিত টিকে থাকা। অপরিহার্য হয়ে ওঠে সামাজিক স্মৃতি-শাসনের আদেশ —
“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যর্মহতি।।”
ক্ষমতাধর পুরুষ করবেন শাসন, নারীর কাজ সংসার প্রতিপালন। ভণিতা ছেড়ে— ভাতার দেবেন ভাত, ভাতারি গন্ডায় গন্ডায় সন্তান জন্ম দেবে, রেঁধে-বেড়ে খাওয়াবে। রা-করবে না।
উৎপাদন, লালনের চারিত্রিকতার সাযুজ্যে নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে প্রতিষ্ঠাপিত করল পুরুষসাহিত্য। ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-বায়ুর সম্মেলনে জল-স্থল-অন্তরিক্ষের নিসর্গ তথা জীব অ-জীব-মিথোজীব বৈচিত্র্যের আধার প্রকৃতিও সৃজনের লীলাভূমি। দান করে সে জীবনের রসদ। নারী ও প্রকৃতি তাই হয়ে উঠল অভিন্ন সত্তা। নারীপ্রকৃতি। মানবী প্রকৃতি। প্রকৃতি জননী। কতই না একাত্মতা! ফলে নারীর ঘটে প্রকৃতিকরণ, প্রকৃতির নারীকরণ। দ্বিধা সংশয়ের অবকাশ আর থাকে না। পুনরুৎপাদন ও লালন-পালন করা নারীর প্রাকৃতিক (চারিত্রিক) বৈশিষ্ট্য রূপে লগ্নিকৃত হয়ে যায়। আর প্রকৃতি তো আশ্রয়দাত্রী মা। তাই ফুলে, ফলে, পাখির কূজনে মানবজীবনকে প্রাণবান রাখা তাঁর স্বভাবজ দায়। অভেদের এই রূপ-কল্পনায় পুরুষতন্ত্রের গূঢ় অভিসন্ধি সফল। নারী ও প্রকৃতির রূপ-প্রতিমা নির্মাণ করে তাকে কর্তব্যের নিগূঢ় বন্ধনে সীমায়িত করে বীরপুঙ্গব ক্ষমতার স্বেচ্ছাচার কায়েম করে। নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মতো করে। শুষে নিঃসাড় করতে চায় উভয়কে। প্রতিষ্ঠা করে লিঙ্গ-নির্ভর হায়ারার্কি। দ্বৈত পরিসর — কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক। অবদমনে অধস্তনের অবস্থানে থেকে নারী-প্রকৃতি (feminize nature) যেখানে চিহ্নিত হয় পেলব, কোমল, দুর্বল, দেহময় আবেগসর্বস্ব একান্ত অচ্ছেদ্য সত্তা রূপে। ঊর্ধ্বতন কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকে জ্ঞান, কর্ম, শক্তি, বুদ্ধিবৃত্তির পৌরুষ সংস্কৃতি (Masculine culture), যা জাতি তথা পৃথিবীর (প্রকৃতি ও নারীরও) অলঙ্ঘনীয় অধিপতি। এ অবস্থায় পুরুষের ভোগ-সেবায় নিয়োজন হয় স্বাভাবিক নিয়ম। শ্রমে ও উৎপাদনে নারীর প্রকৃতির অবদান হয় মূল্যহীন অথবা অবমূল্যায়িত। পুরুষের অর্থনীতি, সে শিল্পভিত্তিক অথবা কৃষিভিত্তিক, যাই-হোক-না-কেন, নারীপ্রকৃতির অবদমিত ক্ষয়িত বিপর্যাসের মূল্যমান শোষণের সেই সমাজতন্ত্রে বৈষম্যের সূচকে ধরা পড়ে না। ধরেই নেওয়া হয় আলো-বাতাস-জল-খনিজের মতো নারী সহজলভ্যা। ইচ্ছে মতো তাকে পাওয়া যায়, যা-ইচ্ছে-তাই করা যায়। গার্হস্থ্য অর্থনীতি, প্রকৃতির অর্থনীতি তাই রাষ্ট্রিক অর্থনীতির ধর্তব্যে আসে না। বছরের পর বছর সন্তান উৎপাদন, পালন, সেবা-শুশ্রূষা, পরিচর্যা, খাওয়ানো-পড়ানো যে বৃহত্তর সামাজিক অর্থনীতিতে উৎপাদক শক্তির জোগান সচল রাখে — ন্যূনতম স্বীকৃতিও কি জোটে তার? গ্রামীণ কৃষি-নারীতো শস্যবীজ সংরক্ষণ, বীজতলা তৈরি, জমির কাজে হাত লাগানো, ফসল মাড়াই-ঝাড়াই করে ঘরে তোলা — সবেতেই পুরুষের শ্রমভাগী। খনিজ সম্পদ আহরণে নারী তো পুরুষের সহযাত্রী। অথচ, পুরুষ শ্রমিকটির ন্যায় সমান শ্রমমূল্য, মান-মর্যাদা, দরাদরির আপাত স্বাধীনতা, অধিকার কী তার আছে? নেই। কাব্যকবিতায় বন্দিত হলেও নদীর অবাধ চলার পথ নেই। আপন খেয়ালে বুনো হিংস্র শ্বাপদের আবাসভূমি হয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই অরণ্যানীর। মেঘদূত যক্ষপুরীর ঠিকানা ভুলেছে। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির সঙ্গে সব পথ হারিয়েছে পুরুষকেন্দ্রিক (androcentric) উন্নয়নের গবেষণাগারে।
প্রকৃতির কিনারে খাঁজে ভাঁজে আজ পর্যটনের ঢল — বহুজাতিক থেকে ব্যক্তি নাগরিক। সবাই তাকে নিংড়ে খাবে। আর তার অভিন্ন সত্তা নারীকে পুরুষ দিয়েছে কসমেটিক বিভা। মেদ ঝরা ললনা হয়েছে ছিপছিপে সুতন্বী। রংবাহারি প্রসাধনে চলনে বলনে আধুনিকার গ্রহণযোগ্য মান নির্ধারণ করে দিয়েছেন বসুধাপতি ভর্তাজনেরা। পৃথিবীকে তো জীব-অ-জীব ‘সকলের আবাস’ থেকে ‘একমাত্র মানুষের আবাসে’ (anthropocentric) পরিণত করার প্রাণঘাতী প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে ‘প্রগতির’ প্রেতচক্রে পড়ে কয়েক দশক আগেই; যথেচ্ছাচারীর ভোগের রমণক্ষেত্র হয়েছে পৃথিবী। রমণী। প্রকৃতি। নির্বিচারে লুটেপুটে সম্ভোগ করছে বলশালী পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা…।’
দুই
এতক্ষণ পড়ার ধৈর্য দেখিয়েছেন — ধন্যবাদ পাঠক! ভেবেছি, নারীকে প্রকৃতিগত দেহসর্বস্বের প্রতিভূরূপে প্রতিষ্ঠার যে কূট আয়োজন — মানসে, জীবনে, সাহিত্যে— রক্তাক্ত-গতায়াতের সেই প্রতিচ্ছবি নিয়ে হাজির হব আমরা। আজকের নারীর যা-কিছু অর্জন, সমানাধিকারের দাবি — আলোচনায় আসবে না সেই ‘রণ-রক্ত-সফলতার’ ইতিহাস। সম্পাদক প্রকাশের পরিধি করেছেন শব্দনির্দিষ্ট। জানার রেখা যেহেতু পরিসীমায়িত, তাই আলোচনার বিস্তার পড়ে আসা কয়েকটি আখ্যানে সীমাবদ্ধ থাকবে। আপনি, পাঠক জুড়ে নেবেন আপনার আততি। আলোচনার অভিমুখে দ্ব্যণুক বিস্তার — নারীপ্রকৃতির দেহ-মন-যাপনে কর্তৃত্বের যে দাপাদাপি, বিপ্রতীপে কী শুধুই আত্মসমর্পণ? না উলটে যাবে প্রতিবাচন — কপিলা যেমন শক্ত-সমর্থ-ভরন্ত কুবেরকে ঠেস দিয়ে বলেছে — “আরে পুরুষ…”, তেমনি গোলাপের রোমান্টিক বিভাষাকে দলে-মাড়িয়ে শশীর ন্যাকামিকে সজোরে ফুৎকারে কুসুম বলে উঠবে — মন। মন। তোমার দেহ নাই শশী? আসুন পাঠক হাত মেলাই। চোখ রাখি নিজের নিজের জানা বোঝায়। দেখায়। আখ্যানের সীমা বিশ শতক। প্রশ্নে দাপটের একাধিপত্য পুরুষলিঙ্গের। সংকট চিরাচরিত তথা বর্তমানের। নারীর জীবন-জীবিকা-আত্মমর্যাদায় বাঁচার। আপন প্রণোদনায় প্রকৃতির বুকে সকাল-সাঁঝের লীলায়িত চাঞ্চল্যের।
তিন
‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের উপসংহারে কথক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন — “… যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংস আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।” বৈজ্ঞানিক রঞ্জনরশ্মিও মাংসপিণ্ড ভেদ করে পৌঁছাতে পারে না পৃথিবীর আদিম অন্ধকারে, মানুষের জৈব প্রবৃত্তির সংগুপ্ত কুঠুরিতে আলো ফেলতে পারে না — এ কথা জানা। কিন্তু, আসঙ্গের তাড়না প্রবৃত্তির উদ্দামতা তো ভিখু একা সংগ্রহ করে আনেনি, পাঁচীও বয়ে এনেছে তাঁর অন্তঃসলিলা রক্তস্রোতে। তবু কামনার হিংস্র অমার্জিত অকৃত্রিম প্রকাশ ভিখুকে কেন্দ্র করেই গর্জায়। নারী দেখলে তার ছাতি ফুলে ওঠে, হাতের-পিঠের মাংস-পেশি নেচে ওঠে। কখনও বাসির সঙ্গে, কখনও রাখু বাগ্দির বউকে নিয়ে উন্মত্ত রাত্রি যাপন করে। নারীসঙ্গহীনতায় ছটফটিয়ে হাহাকারে ভরে যায় তার জীবন। আসঙ্গ লিপ্সায় উন্মত্ত হয়ে ভিখু তখন পৃথিবীর সব নারী, যতসব খাদ্য একা দখল করতে চায়। পাঁচীকে সে রাখবে, খাওয়াবে, পরাবে। অথচ, পাঁচীও ভিখুর মতো ভিক্ষাজীবী। দুই পুরুষের লড়াইতে পাঁচীর ভূমিকা হাতবদলের। অনালম্ব ভোগ্যা নারীর। পাঁচীকে ছিনিয়ে নেয় ভিখু বসিরকে খুন করে। “ভিখুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া পাঁচী তাহার পিঠের উপর ঝুলিয়া রহিল। তাহার দেহের ভারে সামনে ঝুঁকিয়া ভিখু জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল।”
কুবের কোনও রাখ ঢাক না-রেখে বলেছে, “মাইয়ালোক চুপ মাইরা থাক। পোলা বিয়ানের লাইগা পিরথিমিতে আইছস, বিয়া পোলা যত পারস — রাও করস কেরে?” পদ্মানদীর মাঝি সে। নদী-নারী-প্রকৃতির খেলা তার শিরায় শিরায় ওতপ্রোত। বর্ষার যৌবনবতী পদ্মার বুকে নৌকা ভাসানো মাঝিকে আকুল করে ‘বাঁশের কঞ্চির’ মতো সোজা বেগুনে রঙের শাড়ি পরা চঞ্চলা কপিলা। রূপকথা বলে চলা খঞ্জ মালাকে ছেড়ে কুবের মাঝি কপিলাকে নিয়ে পাড়ি দেয় হোসেন মিঞার ময়নাদ্বীপে।
কামনার ক্ষুৎপিপাসা অস্থির করেছে বেণুকরকে। চাষি বেণুকর চার বছর হল বিয়ে করেছে জানকীকে। আজ যেন হঠাৎ এক ধরনের একঘেয়েমি, অবশ্যই যৌনজীবনে, বেণুকরের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সে চেয়েছে রসের পর রস উদ্ভাবনে, জানকীর রক্তাধর, শুভ্র দশন ও নিবিড় সঙ্গ বেণুকরের যৌনজীবনে নিত্যনূতন চমৎকারিত্বের সৃষ্টি করে তৃপ্ত করবে তাকে। কিন্তু আজ এক নিঃসীম অতৃপ্তি। তাই লাঙল বলদের মালিক বেণুকরের জানকীর প্রতি লুব্ধতা একটু একটু করে কমেছে। অথচ — “জানকী রাঁধে যেমন সুন্দর, গোছালোও তেমনি, আর দ্রুত কাজ সারতেও তেমনি পটু। সে জানে সবই — সুচ হাঁটিয়ে ছেঁড়া কাপড় সূক্ষ্মভাবে রিপু করতে যেমন জানে, তেমনি জানে ঢেঁকি পাড়িয়ে চাল, চিঁড়ে প্রস্তুত করতে; কিন্তু জানে না যে, বস্তু হিসেবে তার স্বকীয়তা এবং দর একটু কমে এসেছে।” কেন? কী কারণে? না, “বেণুকরের দৈবাৎ মনে হলো, জীবনের মধুস্বাদে যে-অপরিমেয় নিবিড়তা ছিল তা যেন আর নেই — তৃষ্ণা যেন নিঃশেষ হয়ে মিটছে না — কে যেন দ্রাক্ষারসে জল ঢেলে দিয়েছে।” তাই সে সব দ্বিধা কাটিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে — মেয়েদের আঠারো কলার অভিব্যক্তিতে, অর্থাৎ কামের ছলা-কলায় জানকী তার তৃষিত যৌনজীবন কামের বানে ভরপুর করে তুলুক। (‘আঠারো কলার একটি’ : জগদীশ গুপ্ত) আচ্ছা, রোজকার গতানুগতিক যৌনতা কি জানকীকে ক্লান্ত করেনি? নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছা কি তার জাগে না? নারীত্ব দূর অস্ত, তার বস্তুমূল্য নির্ধারিত হবে শুধুমাত্র নিষ্পাদিত যৌনকর্মের পুরুষালি তৃপ্তি-অ-তৃপ্তির নিক্তিতে? পাঠক, আমাদের তো জানা আছে — কামকলাকে নারীপ্রকৃতির সঙ্গে অন্বিত করেছেন স্বয়ং আমাদের পূর্বজ শাস্ত্রপুরুষ। প্রকৃতি ও নারী অবাধ অপার দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময়ী।
সঙ্গতে পুরুষহিতৈষী কত বেহায়া প্রবাদ বাক্য জুড়ে যায়। রক্তমাংসের লোলুপ আধার রূপে নারীর অবস্থান পাকাপোক্ত করা হয়। লভ্যাংশ রূপে তো আছেই প্রজন্মান্তরের প্রসব-কর্তব্য। গাত্র-গোত্র-দেহ একমাত্র পণ্য হয়ে উঠলে নারী স্বয়ং বিশ্বাস করতে থাকে — মেয়েমানুষ কুড়িতেই বুড়ি। অনঙ্গদেব নারী-যৌবনের সীমারেখা টেনে দিয়ে পুরুষকে করেছেন অনন্তকাম। দেহ পুরাতন হয়ে গেলে, তার অলি-গলির হদিস করায়ত্ত হলে, বিস্বাদিত ক্ষণে জন্ম নেয় নূতনের প্রলোভন। তবে, নূতন দেহের সঙ্গে খেলা করার, তাকে পুনরায় পণ্যায়িত করার একচ্ছত্র অধিকার পুরুষের। কারবারি দীনতারণ যেমন বছর উনিশের পুত্রবতী স্ত্রী ক্ষণপ্রভা বর্তমান থাকতেও তারই ভগিনী প্রফুল্লকে বিবাহ করলেন। (‘চন্দ্র-সূর্য যতোদিন’ : জগদীশ গুপ্ত) প্রথমত, প্রফুল্ল পঞ্চদশী, রুপলাবণ্যে, যৌবনের হিল্লোলে তাঁর জীবনকে উদোম করে তুলবে। সুদ-আসলের হিসেবে উপরিপাওনা— শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি একা ভোগদখলের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা। কিন্তু, “এই দেহকে উপলক্ষ আর অবলম্বন করিয়া স্ত্রী-পুরুষের যে যোগ আর মায়া, উৎক্ষিপ্ত লোষ্ট্রের মতো কেবল অধোদিকেই তার গতি …।” তবে দেহ-ই কেন নারীর সার ও সেরা? নারীর মূল্য? নারীর প্রেমের মর্যাদা? ক্ষনপ্রভা বেদনা উন্মথিত শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে উত্তর খুঁজেছে — “এই ক্ষণস্থায়ী দেহ মথিত করিয়া দেহাতীত চিরজীবী যে অমৃত বস্তুটি সে বহন করিয়া আনিয়া দিয়াছে তাহার দিকে তো কাহারো চোখ পরিল না! …” প্রেম, স্নেহ, বাৎসল্যে একে অপরকে জড়িয়ে থাকে নারী ও প্রকৃতি। কী উদার, প্রশস্ত ও বৃহৎ! এদিকে দখলদারি ছাড়া যে পৌরুষের হানি ঘটে।
কুবের, ভিখু, বেণুকর দীনতারণদের কোনও আড়াল নেই। মেয়েমানুষ তাদের ভোগ্যা, লালসা চরিতার্থের উপায়। মধ্যবিত্ত পুরুষ তো আবার বিবেকের আদর্শের বড়াই করে, প্রেম ও প্রবৃত্তির টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হয়; শেষপর্যন্ত দ্বিধা-সংশয়-ভ্রান্তি-সিদ্ধান্তহীনতায় হীনবল প্রতিপন্ন হয়। না আছে তাদের মনের জোর, না দেহের স্ফূর্তি। নারী এখানেও নিরালম্ব। প্রতারিত।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-য় শশী কুসুমকে নিয়ে খেলা করেছে। কুসুম কি কখনও তার স্বপ্নচারিণী ‘মহামানবী’ প্রতিমা হতে পারে? বন্ধুর স্ত্রী-র সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক স্থাপন কি রুচিসম্পন্ন? নানা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে তার কোনও এক সময় মনে হয়েছে — “সস্তা নই! কি গেঁয়ো অভদ্র কথা” — কুসুমের। ওর গায়ে ব্লাউজ ওঠে না, কেশ সুগন্ধি তেলে পরিপাট্য নয়। কুসুমের ভালোবাসা যেন “গেঁয়ো পুকুরের ঢেউ”। শশী তো খুঁজছে — “সাগর তরঙ্গ”। পাঠক আমাদের সবার স্মরণে তো আছেই কাপুরুষ শশীর মধ্যবিত্তোচিত শুচিবায়ুগ্রস্ত উক্তি — “দেহ। দেহ। তোমার মন নাই কুসুম”। সেই ঘুরে ফিরে দেহসর্বস্বতার সঙ্গে নারীসত্তাকে এক করে দেখা। নারীপ্রকৃতির এ এক অ-মানুষী অবমাননা।
প্রতারণা করেছিল ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের মধ্যমপুরুষ নায়ক। যামিনীর সঙ্গে। পুঁটি মাছ ধরার সামর্থ্য তার, কথা দিয়েছিল ছিপ-বড়শি দিয়ে যামিনীর হৃদয় শিকার করতে ফিরে আসবে শহর থেকে তেলেনাপোতার ধ্বংসাবশেষে। উদ্ধার করে নিয়ে যাবে যামিনীকে। সহমর্ম, করুণা, প্রেম মিলেমিশে হৃদ্স্পন্দনে রণিত হবে শপথ — “ফিরে আসব”। কেউ ফিরে আসে না। নাগরিক নায়ক আত্মপ্রতারকের প্রকোষ্ঠে বন্দি হয়ে নিজের শপথকেই মিথ্যা করে তোলে। আত্মপ্রত্যয় বলতে কিছুই তো তার নেই। তাই তেলেনাপোতা, যামিনী — সবকিছুকেই “কোনো দুর্বল মুহূর্তের অবাস্তব কুয়াশাময় কল্পনা মাত্র” রূপে মনে হয়। এদিকে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িত চাঁদের মতো ক্ষীণ, দীর্ঘ, অপুষ্ট যামিনী অপেক্ষায় থাকে ফুরিয়ে যাওয়ার। অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, অবিচল বিশ্বাস, সুনিশ্চিত আস্থার প্রতিফলে নিঃশেষে বিলীন হয়ে যাওয়াই কি তবে নারী, প্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী নিয়তি?
চার
অবিমৃশ্যকারীর অতিলোভ বিদ্রোহের দামামা বাজায় কখনও কখনও। প্রকাশ্যে সংগোপনে। অবদমিত ক্ষোভের দ্রোহ তখন যাবতীয় সংস্কার, প্রথা, বিধিবদ্ধ নিয়মাবলির বাঁধকে আপন অন্তর্দেশে আত্মসাৎ করে প্রচল কাঠামোর স্তম্ভে দারুণ আঘাত হানে।
“নদী খেপিয়া গিয়াছে, গাঢ়তর পঙ্কিল জল ফুলিয়া ফাঁপিয়া ফেনোচ্ছ্বসিত হইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। […] নদীর স্রোত ব্রিজের এই দিকের ধারকস্তম্ভগুলিতে বাধা পাইয়া ফেনিল আবর্ত রচনা করিতেছে। […] নদী হইতে একটা অশ্রুতপূর্ব শব্দ উঠিতেছিল, তাঁর সঙ্গে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মিশিয়া হঠাৎ এমন একটা সংগত সৃষ্টি করিয়াছে…। হোক ইট, সুরকি, সিমেন্ট, পাথর, লোহালক্কড়ে গড়া ব্রিজ, যে নদী এমনভাবে খেপিয়া যাইতে পারে তাহাকে বিশ্বাস নাই। […] ব্রিজটা ভাঙিয়া ভাসাইয়া লইয়া, দুপাশে মানুষের হাতে গড়া বাঁধ চুরমার করিয়া, সে স্বাভাবিক গতিতে বহিয়া যাইবার পথ করিয়া লইতে চায়। কিন্তু পারিবে কি?”
(‘নদীর বিদ্রোহ’ : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)
যৌন-ক্ষুধার সোচ্চার প্রকাশে নারী-সংযমের বাধা ছিন্ন করেছে তারা বিবি। ৪০ অথবা ৪২ বছরের তারাবিবি হয় ৮০ নয় ৮২ বছরের রমজান আলির কাছে যৌনসংসর্গের দাবি করেছে — “অ গোলজারের বাপ! এক্কেরে লাশটা হইয়া রইছো, না? আরে বুইড়া মরদ, খাটিয়ার লাশটাভি লড়ে-চড়ে, তোমার লড়ন নাই? বিছানা জুইড়া ভ্যাটকাইয়া রইছো, অ গোলজারের বাপ!” (‘তারাবিবির মরদপোলা’ : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) পুরুষের অহং বিপর্যস্ত হলে শুরু হয় যৌনকোন্দল — রমজান আলি ‘হাতপাখাটা নিয়ে বৌকে পেটাতে শুরু করবে, “খানকি মাগী তর মরদানি দ্যাখনের খাউজানি উঠছে না? র। তরে মরদ দ্যাখাই। তোর হাউস মিটাইয়া দেই, আয়।”
জোয়ান ছেলে গোলজার পাশের ঘরে কাজের মেয়ে সুরুজের মায়ের সঙ্গে সঙ্গম ক্রীড়ায় মেতে উঠলে পুত্রের প্রতি বিষোদ্গার করে পিতা রমজান। অথচ, সবাইকে চমকে দিয়ে জোয়ান ছেলের মরদ-ক্রিয়ার সমর্থনে গর্জে ওঠে তারাবিবি — “গোলজারে কি করছে? পোলায় আমার জুয়ান মরদ না একখান? তুমি বুইড়া মড়াটা, হান্দাইয়া গেছো কব্বরের মইদ্যে, জুয়ান মরদের কাম তুমি বুঝবা ক্যামনে?” নীতি-ভড়ং সর্বস্ব শুচি-শুদ্ধ সমাজ মুখ লোকাবে কী ভাবে? পুরুষলিঙ্গে তারাবিবির চাবুক পড়েছে। তা এখন রক্তাক্ত ক্লীব। পৌরুষের প্রতিরূপ যে ‘মর্দানা’ — তা-তো যৌনতার সামাজিক ক্ষমতায়ন। তারাবিবি যৌনজীবনের প্রতিরোধী বাচন তৈরি করে ‘জোয়ান মরদের’ প্রতিকল্পে আত্মকাম ও মর্ষকামের পরিপূরণ করেছে। নারীপ্রকৃতির এই সরবতা প্রগলভতা যৌনজীবনে সমানাধিকার দাবি করেছে। ব্যর্থ হলে নিজের মতো রাস্তা খুঁজে নিয়েছে।
বাল্যপ্রেমিক কানুকে পায়নি রাণু। (‘অরূপের রাস’ : জগদীশ গুপ্ত) নিরন্তর অপ্রাপ্তির সেই বোধ তাকে দগ্ধ করেছে দাম্পত্য জীবনেও। অপরের স্ত্রী, সন্তানের মা হয়েও রেহাই পায়নি প্রথম প্রেমের হোমশিখা থেকে। রাণু তো পারত প্লেটোনিক প্রেমের মহৎ আদর্শে প্রেমের দীপশিখা যতনে জ্বালিয়ে রাখতে হৃদয়ে। না, তা সে চায় না। দেহ-মনের সম্মিলনে প্রেম তার কাছে মধুর মোহময় অনির্বাণ। কানুদার শরীরে নিজের শরীরকে বিলীন করে দিতে চায় সে। এখন তারা উভয়েই বিবাহিত। পরকীয়ায় সমাজের রক্তচক্ষু। উপরন্তু, প্রেমিকার হ্যাংলামো সাজে না। অভিসারের ডাক আসে তো পুরুষের তরফ থেকে অথবা বলপূর্বক সম্ভোগ [‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর দৈব-লাম্পট্যের কথা পাঠক একবার ভেবে দেখুন]। তবে রাণুর কী হবে উপায়? রাণুর ডাকে কানুর স্ত্রী ইন্দিরা হয়েছে তার শয্যাসঙ্গিনী। সে হবে স্বামী, ইন্দিরা তার স্ত্রী। তন্ন তন্ন করে খুঁজে ইন্দিরার দেহ থেকে তার প্রেমিকের আসঙ্গের সমস্ত “স্পর্শ মুছিয়া লইয়া সে ত্বক রক্ত পূর্ণ করিয়া” অনাস্বাদিত রভসে প্রেম সার্থক করেছে রাণু। হয়তো “হিয়ায় হিয়ায় লাগিবে বলিয়া” রাণু ‘চন্দন’ মাখেনি অঙ্গে। আত্মেন্দ্রিয়প্রীতির কামনার্ত প্রেম সে পেতে চেয়েছে। প্রেম তার কাছে পূজা নয়, দেহাতীত অধ্যাত্মের বায়বীয় পরাকাষ্ঠা নয়, দেহ-মনের যৌথ সংবেদন। শরীরী রাসলীলায় মেতে উঠেছে দুই নারী — অনুপম এই প্রকৃতি।
বিধবা রতিমঞ্জরী গণিকা হতে চেয়েছে (‘বিধবা রতিমঞ্জরী’ : জগদীশ গুপ্ত)। এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে সে দেখেছে দাম্পত্যে প্রেমের লেশমাত্র অনুপস্থিত। এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানে শরীরের একতরফা পাওনায় আবর্তিত হয়েছে নারী-পুরুষের যাবতীয় সম্পর্ক। রতির অনুধাবন করতে কোনও দ্বিধা হয়নি যে, স্বামী অক্ষয় ও তার মধ্যে ভালোবাসার পরিবর্তে ছিল তারই দেহ প্রদান। লম্পট বেশ্যাকে দেখার চোখেই রতির দেহে ক্ষুধাতুর চোখ রাখত অক্ষয়। হৃদয়ভরা ভালবাসা খুঁজেছে রতি। চেয়েছে প্রেমের অনাবিল সৌন্দর্যে সুন্দরের সঙ্গে মিলিত হতে। কিন্তু, দিনযাপনের গ্লানি ও শ্রান্তিতে ধ্বস্ত হয়েছে। রতি তাই স্বামীর মৃত্যুর পর কোনও বিশেষ শূন্যতা বা দুঃখ অনুভব করে না। বরং, সমাজ, পুরুষ তাঁকে যেভাবে যেরূপে দেখতে চায় স্বেচ্ছায় সেই ভূমিকায় দাঁড়াতে চেয়েছে সে। গণিকা হবে সে। দেহবিক্রির সিদ্ধান্ত রইল নিজের আয়ত্তাধীন। কামুক পুরুষের ভিড় জমুক তার আলয়ের বাহির দুয়ারে। নৈঃসঙ্গ্যের এও এক প্রতিবাদী প্রকৃতি।
ভোগাতুর পুরুষের প্রতি ঘৃণা ফিরিয়ে দিয়েছে ক্ষণপ্রভা। স্ত্রী ও পুরুষের সকল যোগ আর মায়ার মূলে যে দেহ, ‘এই দেহটার দিকেই’ যে ‘সকলের লক্ষ্য’— ‘দেহের মাংস, দেহের চর্ম, দেহের বর্ণ’ — সাংসারিক বন্ধনের আলম্ব। রক্তাক্ত সত্যে পৌঁছে বিকৃত, বীভৎস, ভীষণ স্বামীদানবের প্রতি মন ঘৃণায় ঘুলিয়ে উঠল তার। প্রেমের বন্ধন যে শুধুমাত্র ‘ঊর্ণনাভের তন্তু’! পুনরায় স্বামীর শয্যায় প্রবেশ করতে বমি পেল — “অদূরবর্তী ঐ লোকটা কেবল একটা মাংসপিণ্ড — যেমন কদর্য তেমনি লোলুপ : তার মাংসাশী দেহটা যেন সর্বাঙ্গ দিয়া হা করিয়া আছে…।” পতনের শেষ দৃশ্য। যবনিকা উন্মোচিত হল। ক্ষণপ্রভা এখন উন্মাদিনী। সম্পূর্ণ নগ্নদেহ। শুধু ছেলেটি বুকে আঁকড়ে। ঘুরে ফিরে পুরুষ তো তার এই দেহ-ই কামনা করেছে, জয়গান গেয়েছে। ভব্যতা সভ্যতা সামাজিকতার সব আবরণকে নিশ্চিহ্ন করে উলঙ্গিনি হয়েছে ক্ষণপ্রভা। শুধু ভুলে যায়নি সে জননী। প্রকৃতিতে মা।
পাঁচ
লোভে-সম্ভোগে-লালসায় প্রাণদ প্রকৃতিও আজ রুক্ষ, ঊষর, মৃতপ্রায়। বাৎসল্য স্নেহে তবু উদলা জননী চেয়ে আছে তার মানব সন্তানের প্রতি। যদি সংবিৎ ফেরে।
শক্তিমান স্বাধিকারপ্রমত্ত পুরুষ তোমার কি মন নাই? চুইয়ে পড়া ভোগাভিলাষের সংস্কৃতিতে নিজেকে কেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী করতে চাও। তার চেয়ে বরং ‘দু-দণ্ড’ শান্তির তরে ঝিলমিল জোনাকি রঙা ‘শিশিরের’ শব্দসন্ধ্যায় বনলতা সেনের মুখোমুখি এসো। সে শুধোবে — “এতদিন কোথায় ছিলেন?” (‘বনলতা সেন’ : জীবনানন্দ দাশ)
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা :
১. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘গল্প সমগ্র’, কলকাতা, নয়া উদ্যোগ, ২০০০
২. জগদীশ গুপ্ত, ‘জগদীশ গুপ্তের গল্প’ (সুবীর রায়চৌধুরী সম্পাদিত), কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৯
৩. জীবনানন্দ দাশ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, কলকাতা, ভারবি, ১৯৮৮
৪. প্রেমেন্দ্র মিত্র, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ (সৌরীন ভট্টাচার্য সম্পাদিত), কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৪
৫. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘প্রেম অপ্রেমের গল্প’ (রবীন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত), কলকাতা, চিরায়ত প্রকাশন, ২০০৮
৬. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’ (হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা, ১৯৯৫
৭. Christof Mauch, ‘Slow Hope’, RCC Perspectives Transformation in Environment and Society, 2019
৮. Jason Hickel, ‘Less is More How Degrowth will save the World’, London, William Heinemann, 2020
৯. Ram Chandra Guha & Juan Martinez-Alier, ‘Varities of Environmentalism’ (Essays North and South), London, New Work, Earthscan, 2006
১০. The Asiatic Society, Monthly Bulletin (Vol.L, No.10), Kolkata, 2021