ওদের ডুবতে দাও — উষ্ণায়নের পৃথিবীতে অপরায়নের হিংস্রতা

নাওমি ক্লেইন

(অনুবাদ : কঙ্ক ঘোষ)

[নাওমি ক্লেইন প্রদত্ত ‘এডওয়ার্ড সাইদ স্মারক বক্তৃতা’-র অনুলিখন বর্তমান প্রবন্ধ। নাওমি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ লন্ডনে এই বক্তৃতা প্রদান করেন।]

এডওয়ার্ড সাইদ কোনোদিনই স্বভাবজাতভাবে বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন না। মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কারিগরি পেশার সঙ্গে যুক্ত পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকারী সাইদের আত্মবিশ্লেষণীয় জবানবন্দি— ‘আমি সরাসরি মাটির সঙ্গে সম্পর্করহিত এক চূড়ান্ত শহুরে প্যালেস্তিনীয় সমাজের ফসল’। ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে তিনি খুঁজে বেড়ান প্যালেস্তিনীয় জীবনের অজানা, অচেনা গৃহকোণ; জন মোরের আলোকচিত্রের বিশ্লেষণে সাইদ আবিষ্কার করেন প্যালেস্তিনীয় আতিথেয়তা, খেলাধুলা কিংবা গৃহসজ্জার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটির রকমফের। ছবির ফ্রেমের স্থানাঙ্ক থেকে শিশুর প্রতিস্পর্ধী ভঙ্গি, তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির জোয়ার উঠে আসে সাইদের অনুভবে, লেখনীতে। অথচ প্যালেস্তিনীয় কৃষকদের পশুপালন, মাঠে কৃষিকাজ করার ছবির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাইদ হারিয়ে ফেলেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টির বিশেষত্ব, স্বকীয় বিশ্লেষণ। কোন ফসল চাষ করা হচ্ছে? মাটির অবস্থা, বৈশিষ্ট্যই বা কী? কিংবা ফসল ফলানোর জন্য জলের জোগানই বা কীরকম? এই ধাঁচের কোনও বিশ্লেষণ, দূরদৃষ্টি ফুটে ওঠে না সাইদের মননে। ‘কৃষকদের কিংবা যন্ত্রণাদীর্ণ গরিব জনগোষ্ঠীকে এক অপরিবর্তনীয় যৌথ ইউনিট হিসেবেই ভাবতাম’ — সাইদের অকপট স্বীকারোক্তি। এবং এই উপলব্ধি অবাস্তব জেনেও বয়ে বেরিয়েছেন অনেকদিন। 

কৃষিকাজের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ অপরায়িত সাইদের পরিবেশদূষণ, জলদূষণ সম্পর্কিত বিষয়ে নিবেদিতপ্রাণ সক্রিয় কর্মীদের মনে হত অন্য গ্রহের বাসিন্দা। তাঁর সহকর্মী রব নিক্সনের সঙ্গে আলাপচারিতায় পরিবেশবাদ সম্পর্কে একদা সাইদের মনোভাব — ‘যথাযথ কারণবিমুখ এলিট বৃক্ষপ্রেমীদের আত্মতৃপ্তির মাধ্যম’। কিন্তু সাইদের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতির একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষকের পক্ষে, সেখানের ভূ-রাজনীতির সঙ্গে পরিবেশগত উপাদান এবং অসুবিধার যোগসূত্র উপেক্ষা করা কার্যত অসম্ভব। কারণ তাপপ্রবাহ থেকে জলকষ্ট, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি থেকে মরুকরণ; সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত বিষয়ের নিরিখে পৃথিবীর এই ভূখণ্ড অত্যন্ত দুর্বল এবং অসুরক্ষিত। সম্প্রতি, ‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ নামক গবেষণা পত্রিকার একটি গবেষণাপত্রে এই পূর্বাভাস উঠে এসেছে যে আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্যের কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য দূষিত গ্যাস নিঃসরণ ব্যাপকভাবে হ্রাস করাতে সক্ষম না হই, তবে এই শতাব্দীর শেষে সেখানকার তাপমাত্রা মানুষের সহ্যাতীত হতে বাধ্য। তা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের পরিবেশগত সুরক্ষা এমনও সামাজিক অগ্রাধিকারের প্রশ্নে নিছক অনুচিন্তা অথবা ভাবনার বিলাসিতা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে চলেছে। শুধু অজ্ঞতা বা উদাসীনতা নয়, এর কারণ প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের জীবন-জীবিকায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অজস্র মৌলিক অপূর্ণতা, ভয়, রোজকার জীবনের অনিশ্চয়তা। অজস্র না-পাওয়ার আবর্তের মধ্যে অগ্রাধিকারের জটিল হিসেব নিকেশ। পরিবেশ ধ্বংসের ভয়াবহ প্রভাব এখানে তাই এখনও সমস্যার নিরিখে স্থান পায় পিছনের সারিতে। দৈনন্দিন জীবনে তার চেয়েও অনেক বড়ো সমস্যা যুঝতে হয় প্রতিনিয়ত : সামরিক দখলদারি, যুদ্ধবিমান হামলা, সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি।   

পরিবেশবাদ একসময় সাইদের অনুভবে নিছক বুর্জোয়াদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে প্রতিভাত হবার প্রেক্ষাপটে ছিল আরও অন্যান্য কারণ। ইজরায়েল তার রাষ্ট্র এবং জাতি গঠন প্রকল্পকে সবুজায়নের ছদ্মবেশেই আত্মপ্রকাশ করিয়েছিল। জিওনিস্ট ‘জমির দিকে প্রত্যাবর্তন’ স্লোগানের মোড়কে শুরু হয়েছিল এই প্রকল্প। শুধুমাত্র অগুনতি অলিভ, পেস্তা গাছ কেটে ইজরায়েলি রাস্তা তৈরির মধ্যেই এই প্রকল্প সীমাবদ্ধ ছিল না, পরিবর্তে  কুখ্যাত জিউইশ ন্যাশনাল ফান্ড কর্তৃক প্যালেস্তিনীয় গ্রামে দিগন্ত বিস্তৃত পাইন, ইউক্যালিপটাসের অরণ্য তৈরির মধ্যেও লুকিয়ে ছিল জমিদখল এবং বৈষম্যের চোরাস্রোত। ১৯০১ সাল নাগাদ ইজরায়েলে শুরু হয় জিউইশ ন্যাশনাল ফান্ড (জে এন এফ) কর্তৃক প্রকল্পিত প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বৃক্ষ রোপণের কর্মসূচি ‘মরুভূমি সবুজায়ন’ (turning the desert green) স্লোগানের উপর ভর করে। যদিও জে এন এফ নিজেদের  জল, জঙ্গল, উদ্যান, বৃক্ষরোপণের সঙ্গে যুক্ত আর পাঁচটা ‘গ্রিন এন জি ও’-র মতোই নিজেদের প্রচার করত, আদতে তারা ছিল ইজরায়েলের সবচেয়ে বড়ো ব্যাক্তিগত জমির মালিক। এবং খুব জটিল আইনি নিয়মকানুন সত্ত্বেও জে এন এফ এখনও তাদের দখলিকৃত জমি অ-ইহুদি মানুষদের লিজ অথবা বিক্রি করতে অস্বীকার করে আসছে। 

আমি যে ইহুদি সমাজে বড়ো হয় উঠেছি সেখানে যেকোনও উপলক্ষ্য, জন্ম, মৃত্যু, মাদার’স ডে কিংবা শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণের, স্বনির্ভরতার আচার (bar mitzvahs) উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মানে একটি ‘জে এন এফ’ চারাগাছ কেনা। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগে আমি কখনও ভাবতে পারিনি ঐ দীর্ঘ, সরলবর্গীয় অরণ্যের দিগন্তবিস্তৃত সারি সারি গাছের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপজ্জনক বৈষম্যের বীজ। বাস্তবে এই বিস্তৃত গাছের সারি ইজরায়েলের ঘোষিত রাষ্ট্রীয় ভেদাভেদের অন্যতম স্পষ্ট প্রতীক। এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাস্তবায়িত করার অন্যতম প্রধান শর্ত এই প্রতীকের অপসারণ, নির্বাসন। 

জে এন এফ প্রকৃতপক্ষে ‘সবুজায়িত উপনিবেশিকতা (green colonialism)’-র এক সাম্প্রতিক চূড়ান্ত নিদর্শন। যদিও এই ঘটনা এবং ঘটনার স্থান কোনোটিই শুধুমাত্র ইজরায়েলে ঘটেছে এমন নয়। আমেরিকার দীর্ঘ পরিবেশ শোষণের ইতিহাস এর সাক্ষী, যেখানে ভূমি থেকে আদিবাসী মানুষদের উৎখাত করে, তাদের পৈতৃক জমির অধিকার,সঅরণ্যকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহের অধিকার কেড়ে নিয়ে মাইলের পর মাইল প্রাকৃতিক জঙ্গলের উপনিবেশিক পরিণতি জন্ম দিয়েছে অজস্র সংরক্ষিত উদ্যান (conservation park)। এই ঘটনা ইতিহাসে বার বার ঘটেছে যার সাম্প্রতিকতম রূপ হল কার্বন অফসেট। ব্রাজিল থেকে উগান্ডার আদিবাসীরা আজ পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠনগুলির তীব্র আক্রমণাত্মক জমি দখলের শিকার। আকস্মিকভাবে একটি জঙ্গলকে ‘কার্বন অফসেট জোন’ হিসেবে ঘোষণা করে সেখানের আদিবাসীদের জীবন জীবিকার উপর আরোপিত হয় নিষেধাজ্ঞা। ফলস্বরূপ, এই কার্বন অফসেটের বাজার জন্ম দিয়েছে এক নতুন মানবাধিকার লঙ্ঘনের আঙ্গিক। আদিবাসীদের তাদের জমি, জীবন, জীবিকা, বাসস্থান থেকে বিভিন্ন বাজারি প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা নির্ভর কোম্পানি কর্তৃক ছিন্নমূল করার এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়েই জন্ম নিয়েছে ‘গ্রিন হিউম্যান রাইট আবিউস’ বা ‘সবুজায়িত মানবাধিকার লঙ্ঘন’। ফিরে যাব সাইদের বৃক্ষপ্রেমীদের প্রতি প্রাথমিক সন্দেহের, এলিটিজমের প্রশ্নে। মনে রাখতে হবে সাইদের বৃক্ষপ্রেমীদের প্রতি সন্দিহান দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে লুকিয়ে আছে এই সবুজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের পোশাকে শোষণের ইতিকথা। 

এখানেই শেষ নয়। সাইদের জীবনের শেষদিকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখল করে ক্রমশ বেড়ে চলেছে ইজরায়েলের ‘বিভেদের প্রাচীর’। এই বিশাল ‘সেপারেশন ওয়ালের’ বিভেদরেখায় দু-টুকরো হয়ে গেছে প্যালেস্তাইনের সাধারণ নাগরিক জীবন। তৈরি হল শ্রমিকের সঙ্গে তাঁর কর্মক্ষেত্রের, কৃষকের সঙ্গে তাঁর জমির বিচ্ছেদ। বাড়ল রুগির সঙ্গে হাসপাতালের দূরত্ব। এই বিচ্ছেদে জুড়ল যন্ত্রণা, ভাগ বাঁটোয়ারা হল অজস্র পরিবার। মানবতার এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের বুক চিরে বানানো এই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ওয়াল বা তার উত্তরোত্তর উচ্চতা বৃদ্ধির বিরোধিতার অজস্র মানবিক কারণ ছিল। অথচ সেই সময়ে ইজরায়েলি ইহুদিদের তাবড় তাবড় বিরোধী-স্বর নিশ্চুপ থেকেছে। এই বিভেদের প্রাচীর গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন ইজরায়েলের পরিবেশমন্ত্রী ইয়েহুদিত নাওতের প্রতিক্রিয়া ছিল খানিকটা এইরকম — ‘অবশ্যই আমি পাঁচিল বানানোর কাজে দেরি করতে চাই না, কিন্তু আমি তা করতে গিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন’।প্যালেস্তিনীয় সমাজকর্মী ওমর বারগুতির অনুসন্ধান জানাচ্ছে — ‘মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় উদ্যান সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ প্রবল পরিশ্রম করে ইরিস সংরক্ষণ [Iris Atropurpurea সিরিয়া এবং ইজরায়েলে প্রাপ্ত এক ধরনের বিরল এবং সংরক্ষিত গাছ।] রক্ষা করার জন্য তাকে বিকল্প জায়গায় স্থানান্তরিত করেছে। এমনকি তারা পশুদের জন্য প্রাচীরের গায়ে কিছু ছোটো ছোটো পথ বানিয়ে রেখেছে।’

এই ঘটনাপ্রবাহ হয়তো সবুজ আন্দোলনের প্রতি সন্দেহপ্রবণতার প্রাসঙ্গিকতার জানান দেয় খানিকটা। মানুষের জীবনের, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ফুল, পশুপাখি, জীবজন্তু সংরক্ষণের অগ্রাধিকারের সংস্কৃতি খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের পরিবেশ আন্দোলনের প্রতি  সন্দেহপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে প্রতিনিয়ত। এবং সেখানেই, সাইদের বিস্তৃত জ্ঞানের, বিশ্লেষণের উত্তরাধিকার ক্রমাগত স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করে চলে বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত সংকটের সূত্র। সমকালীন বিচ্ছিন্ন বাজার এবং প্রচারমুখী প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে উঠে আসে সংকট প্রতিরোধের আরও সার্বিক, সমন্বিত রূপ। এই ইনক্লুসিভ মডেল আহত, বঞ্চিত মানুষকে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জেহাদকে স্থগিত না রেখে পরিবেশের সমস্যা এবং সমাধানকে এই বাকি সমস্ত অসাম্যের সূত্রের সঙ্গে যুক্ত রেখে দেখার নিদান দেয়। আদতে যদিও তথাকথিত  বৃক্ষপ্রেমীদের সাইদ সন্দেহের চোখে দেখতেন; কিন্তু সচেতন, সৎ বৃক্ষপ্রেমীদের সাইদ সহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাবিদদের ভাবনা, বিশ্লেষণে বারবার ফিরে যাওয়া প্রয়োজন কারণ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন এই সমস্যার ঐতিহাসিক গতিপ্রকৃতি জানা, বোঝা। সেই সূত্রেই আমরা এই গদ্যে, আংশিকভাবে সাইদের এই বিষয়ে চিন্তা, যুক্তি, গবেষণা এবং বিশ্লেষণ পাঠ করার চেষ্টা করব। উষ্ণায়নের পৃথিবীর প্রাকৃতিক অস্থিরতার ঘেরাটোপ থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজব আমরা। 

সাইদ সম্ভবত সেইসব যন্ত্রণাদীর্ণ, অভিব্যক্তিপূর্ণ তাত্ত্বিকদের অন্যতম, যাঁকে নির্বাসন এবং ‘ঘরে ফেরার গান’ তাড়া করে বেড়িয়েছে নিরন্তর। কিন্তু সাইদের টান এমন এক শিকড়ের প্রতি, যে ঘরের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে সময়ের সঙ্গে। এতটাই পরিবর্তিত সেই আশ্রয় যে তার অস্তিত্বই আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে।ফলে সাইদের অবস্থান এক জটিলতর রূপ নেয় — তিনি প্রবলভাবে শিকড়ে ফিরে যেতে চাইতেন কিন্তু কখনোই সেই ঘরকে এক জায়গায় বাঁধতে পারেননি। তাঁর কাছে ঘরের একমাত্র পরিমাপক সমস্ত মানবাধিকারের উপর সমগুরুত্ব আরোপণ এবং ন্যায়বিচারের পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এক অবস্থা। ক্ষয়িষ্ণু উপকূলরেখা, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রে ক্রমাগত তলিয়ে যেতে থাকা দেশ, নিশ্চিহ্ন হতে চলা প্রবাল-দ্বীপ কিংবা  ধীরে ধীরে মসৃণতায় মিলিয়ে যাওয়া সুমেরু মহাসাগর — এই কঠিন সময়ের প্রেক্ষাপটে এই সচেতনতার প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। কারণ, এক আমূল পরিবর্তিত স্বদেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা, যে স্বদেশের অস্তিত্ব হয়তো আর খুব বেশিদিন নেই, ক্রমাগত, দ্রুত এবং দুঃখজনকভাবে বিশ্বায়িত হয়ে চলেছে। মার্চ মাসে, দুটি উল্লেখযোগ্য, পর্যালোচিত গবেষণাপত্র পুরোনো ধারণার তুলনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার আরও দ্রুত ঘটতে চলেছে, এই মর্মে সতর্কবাণী ঘোষণা করেছে। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন জেমস  হ্যান্সেন, যিনি এই মুহূর্তের সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একজন। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী বর্তমান দূষণ-নির্গমন যে হারে ঘটছে তাতে এই শতাব্দীর মধ্যেই উপকূলবর্তী সহ পৃথিবীর বেশিরভাগ বড়ো শহর এবং তাদের ইতিহাস পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যেতে চলেছে। এই পরিস্থিতির মূলগত পরিবর্তন না চাইলে খুব তাড়াতাড়ি আমরা সেই জায়গায় পৌঁছাব যেখানে গোটা পৃথিবীজুড়ে মানুষের নিজের হারিয়ে যাওয়া আশ্রয়ের জন্য হাহাকার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। 

সাইদের অনুধাবনে উঠে আসে সেই বিপজ্জনক ভবিষ্যতের রূপরেখা। তাঁর দৌলতেই  মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আরবি শব্দ — ‘সুমুদ’ অর্থাৎ ‘ধরে রাখা’ — উৎখাতের চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও অবিচলভাবে নিজের ভূমি, জমি আঁকড়ে থাকার নাছোড়বান্দা লড়াই। হেব্রন, গাজার সাধারণ মানুষের জমির অধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা ‘সুমুদ’ এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আমেরিকার লুইসিয়ানার উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের কাছে কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও ছোটো দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছেও। স্লোগান উঠেছে ‘আমরা ডুবছি না, আমরা লড়ছি!’ মারশ্যাল দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি, তুভালুর — মানুষ ডুবে যাবার অনিবার্যতায়, অশনিসংকেতে বাঁধা পড়েও শুধুমাত্র নিজেদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অঞ্চলে স্থানান্তরিত হবার চিন্তায় আটকে নেই। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ দেশগুলি কতটা উদারভাবে নিজেদের সীমান্ত খুলে মানবতার পাশে দাঁড়াবে, তা যথেষ্ট সন্দেহের মুখে কারণ আন্তর্জাতিক নিয়মাবলিতে এখনও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এসবের বাইরে গিয়ে সমুদ্র-উপকূলের বাসিন্দারা আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি লঙ্ঘনকারী অস্ট্রেলিয়ান কয়লা বহনকারী জাহাজের চলাচল অবরুদ্ধ করে দিয়ে আরও সরাসরি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন। এপ্রিলে স্বাক্ষরিত পরিবেশ সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তির যদি খুব অল্প কিছু আশাব্যঞ্জক, উদযাপনের কিছু থেকে থাকে তা হল সাধারণ, পরিবেশগত ভাবে প্রান্তিক মানুষের অধিকার বুঝে নেবার দৃঢ় নীতিগত অবস্থানের উল্লেখ — সাইদের ভাষায় ‘সুমুদীয়’ অবস্থান। 

উপরোক্ত আলোচনা সাইদের বিস্তৃত গবেষণা পাঠের নামমাত্র। তাঁর কাজের এক বড়ো অংশ জুড়ে আছে ‘অপরায়ন’ (othering)-এর অনুসন্ধান, প্রাচ্যবাদ (orientalism) অনুযায়ী যার নির্যাস ‘অপর, ভিন্ন সাংস্কৃতিক বা ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষকে বিভাজন, উপেক্ষা এবং অস্বীকার করা’। সহজ কথায় ‘মানবিকতার বিভাজন’। একবার কোনও জনগোষ্ঠীকে ‘অপর’ (other) হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে হিংসাত্মক পদ্ধতিতে জমি দখল, উৎখাত, বহিষ্কার সহ সরাসরি দখলদারির কাজ করা যায় অনায়াসে। মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের জমি কর্ষিত হয় সহজে। কারণ অপরায়নের মূল সূত্রই হল অপরজনের একই অধিকার না থাকার ‘ফেনোমেনা’। এখন এই অপরায়নের সঙ্গে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক ঠিক কীরকম? সম্ভবত সামগ্রিকভাবেই এরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

আমরা ইতিমধ্যেই ভয়ংকরভাবে আমাদের পৃথিবীর উত্তাপ বাড়িয়ে ফেলেছি এবং আমাদের বিভিন্ন দেশের সরকার এখনও অবধি এই উত্তাপ বৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস করানোয় যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। এক সময় ছিল যখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় এবং এর গুরুতর প্রভাব অনেকের কাছেই অবিদিত ছিল। অন্তত অনেক রাষ্ট্রনেতা এই অজুহাত সাজাতে পারেন। কিন্তু শেষ তিন দশকে, যখন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্ত:রাষ্ট্রীয় প্যানেল গঠিত হয়েছে এবং সুস্থির জলবায়ু রক্ষার বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে, তখনও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে অস্বীকার করার অর্থ জেনেশুনে, সচেতনভাবে নিজেদের কবর খোঁড়া। এবং নিদেনপক্ষে প্রচ্ছন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণভেদ, বৈষম্য ছাড়া এই ধরনের বেপরোয়া মনোভাব কার্যকর করা সম্ভব হত না। অপরায়নের সমস্ত মেশিনারি ছাড়া শক্তিহীনের জীবনের বিনিময়ে প্রভাবশালীদের বাঁচিয়ে রাখার প্রক্রিয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ত। এই সমস্ত বিভেদের মেশিনারি মানবতার আপেক্ষিক মান নির্ধারণ করে, নির্ধারণ করে কোন্ মানুষের জীবনের মূল্য বেশি কার কম। কম-মূল্যের জীবনের দেশ এবং তার প্রাচীন সংস্কৃতি খুব সহজেই ধ্বংসের অনুমোদন পায়। এই বৈষম্যই  অনুমোদন দেয় ‘অপরায়িত’, ‘অপ্রয়োজনীয়’ অঞ্চলের খনিজ পদার্থ উত্তোলনের, শোষণের। 

জীবাশ্ম জ্বালানি বা ‘ফসিল ফুয়েল’-ই জলবায়ু পরিবর্তনের একমাত্র কারণ (শিল্পনির্ভর কৃষিকাজ, ডিফরেস্টেশন বা অরণ্যনির্মূল অন্যান্য কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য) না হলেও তার অবদানই সর্বোচ্চ। এই জীবাশ্ম জ্বালানির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এরা সহজাতভাবে এতটাই ক্ষতিকারক যে তার প্রভাবে মানুষ এবং মানুষের বাসস্থান দুই-ই প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়লাখনিতে কর্মরত মানুষের শরীরে, ফুসফুসে বাসা বাঁধে বিষাক্ত ধূলিকণা, অন্যদিকে খোলামুখ খনি কিংবা খনিজ তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা মানুষের বাসস্থান, জমি এবং জলাভূমিতে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে দেয়। ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত বিজ্ঞানীরা খোলাখুলি দেশের কিছু অঞ্চলকে ‘জাতীয় বিপজ্জনক অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমেরিকার উত্তরে অ্যাপালাচিয়ান পর্বত এই পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে পাহাড়চূড়ায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়লাখনি তৈরি করা হয়েছে। কারণ কয়লাখনি তৈরির পদ্ধতি হিসেবে মাটি খোঁড়ার পরিবর্তে পাহাড়চুড়া বিস্ফোরণ ঘটানো অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী। অবশ্যই এর পিছনেও কোনও তত্ত্ব নিহিত থাকে। একটা গোটা অঞ্চলকে অপরায়িত করে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার তত্ত্ব। ঐ অঞ্চলের অত্যন্ত গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন, সংস্কৃতির বিপন্নতার অনিবার্যতার তত্ত্ব। শত ছিন্ন গরিবের নিজের জীবন, পরিবেশ, নিজের পাহাড় কোনও কিছুরই অধিকার থাকে না। এরপর এই কয়লা থেকে তড়িৎ উৎপাদনের পদ্ধতিতে জুড়ে থাকে আরেক ধরনের অপরায়ন। এই ক্ষেত্রে বৈষম্যের আঁচ গিয়ে পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং শোধনাগার সংলগ্ন শহুরে এলাকায়। উত্তর আমেরিকায় এই সমস্ত অঞ্চলের জনবসতির একটা বড়ো অংশ বিভিন্ন বর্ণের মানুষ —  মূলত কালো চামড়ার এবং লাতিন আমেরিকা নিবাসী মানুষ, যারা জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি আমাদের সমবেত আসক্তির ক্ষতিকর বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। বয়ে বেড়াচ্ছে অনেক বেশিমাত্রায় শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা এবং ক্যান্সারের সম্ভাবনা। এই ধরনের পরিবেশগত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে আজকের ‘Climate Justice Movement’ বা ‘জলবায়ু ন্যায়বিচার আন্দোলন’। 

জীবাশ্ম জ্বালানি গোটা পৃথিবী জুড়েই অজস্র পরিবেশগতভাবে বিপজ্জনক, সংবেদনশীল অঞ্চল গড়ে তোলে। নাইজার ব-দ্বীপের কথাই ধরা যাক। ‘এক্সন ভ্যাল্ডিজ’-এর মতো বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম জাহাজ ট্যাঙ্কার থেকে প্রতি বছর খনিজ তেল সমুদ্রে মিশতে থাকে নাইজার ব-দ্বীপে, যাকে নাইজেরিয়ার লেখক, পরিবেশকর্মী কেন-সারো-উইয়া নাইজেরিয়া সরকারের হাতে খুন হবার আগে বলে গিয়েছিলেন — ‘পরিবেশগত গণহত্যা’ (ecological genocide)। বিভিন্ন জাতির, সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের খুনের নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে কেন তুলে আনেন অত্যন্ত ঘৃণ্য তেল নিষ্কাশনের রাজনীতি। আমার দেশ, কানাডায়, ‘আলবার্টা টার-স্যান্ড’ বা ‘অয়েল স্যান্ড’, অত্যন্ত ভারী অপরিশোধিত তেলের এক বিশাল ভান্ডার খনন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন চুক্তিভঙ্গ করার প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে সেই চুক্তি ভঙ্গ করার প্রয়োজন ছিল যা আদিবাসী মানুষদের তাদের নিজেদের জমির উপর বাঁচা, জীবিকা নির্বাহের অধিকার দিয়েছিল। এই চুক্তিভঙ্গ কানাডার কাছে প্রয়োজনীয় কারণ যে জমি একবার দূষিত হয়ে পড়েছে, যে নদীর জল দূষিত হয়ে পড়েছে, যে জলে টিউমারগ্রস্ত মাছের মৃতদেহ ভেসে বেড়ায় সে অঞ্চলের অধিকার, অধিকার রক্ষার চুক্তি সব অর্থহীন হয়ে পড়ে। এবং আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় এই আলবার্টা টার স্যান্ডের কেন্দ্রে গড়ে ওঠা শহর ফোর্ট ম্যাক মুরে, যা অনেক শ্রমিকের বাসভূমি এবং যার তাপমাত্রা এই মুহূর্তে নারকীয় দাবদাহের সমকক্ষ। এই শহরের ভয়ংকর রুক্ষ এবং উত্তপ্ত হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে নির্বিচারে এখানকার অপরিশোধিত তেলের ভান্ডার খনন। 

এই সমস্ত নাটকীয় ঘটনা ছাড়াও, এই ধরনের সম্পদ লুট আসলে এক ধরনের হিংস্রতার বীজ বপন করে। তীব্রমাত্রায় জল ও জমির ক্ষতিসাধন তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত জীবন, সংস্কৃতিরও মৃত্যু ঘটায় একইসঙ্গে। আদিবাসী জীবনের সঙ্গে তার সংস্কৃতির বিচ্ছেদ ঘটানো ছিল একসময়ের কানাডার রাষ্ট্রীয় পলিসি। এই নীতি কার্যকরী করার জন্য আদিবাসী সন্তানদের বলপূর্বক তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হত, যেখানে তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির চর্চা নিষিদ্ধ। যেখানে তাদের উপর চলত যথেচ্ছ মানসিক, শারীরিক, যৌন অত্যাচার। এক সাম্প্রতিক সত্য এবং সমন্বয়সাধন রিপোর্টে এই ঘটনাকে বলা হয়েছে ‘সাংস্কৃতিক জেনোসাইড’। মানুষকে নিজের ভিটেমাটি, সংস্কৃতি, পরিবার থেকে জোর জবরদস্তি বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে যে মানসিক আঘাত জুড়ে থাকে তা জন্ম দেয় হতাশার হাহাকার, যা প্রায় মহামারির আকারে আজ অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়কে ধ্বংসের মুখে এনে ফেলেছে। শুধুমাত্র এপ্রিল মাসের একটি শনিবারের রাতে, অ্যাটাওয়াপিস্কাট সম্প্রদায়ের (জনসংখ্যা ২০০০) ১১জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এদিকে ডি-বিয়ার্স নামক হিরে খননকারী কোম্পানি ঐ সম্প্রদায়ের জমিতে এখনো হিরে খনন করে চলেছে। অন্যান্য যেকোনও শোষণমূলক প্রকল্পের মতোই, এই প্রকল্পও কিছু আশা এবং কাজের সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদ, পণ্ডিতদের মনে প্রশ্ন জাগে — ‘মানুষগুলো পালিয়ে যাচ্ছে না কেন?’ আদতে অনেকেই পালিয়ে গেছে। এবং এই পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আরও এক ঘটনার যোগসূত্র আছে। সম্প্রতি, কানাডার অনেক বড়ো শহরে দেখা যাচ্ছে প্রায় এক হাজার আদিবাসী মহিলা খুন হয়েছেন অথবা নিরুদ্দেশ। মিডিয়ার খবরে নারীদের উপর অত্যাচার এবং জমির উপর অত্যাচারকে কখনও এক সুতোয় বেঁধে দেখা হয় না। দেখা হয় না এই জমি কেড়ে নেওয়ার নেপথ্যে থাকা জীবাশ্ম জ্বালানি দখলের কাহিনি। প্রত্যেক নতুন সরকার প্রতিবার ক্ষমতায় এসে আদিবাসী মানুষের অধিকার রক্ষা বিষয়ে প্রতিশ্রুতির ঢেউ বইয়ে দিলেও প্রতিশ্রুতি পূরণ কার্যত অসম্ভব। জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণায় বলা আছে যে, কোনও দেশের জাতীয় অর্থনীতির অনুকূল হলেও কোনও প্রকল্পের স্বার্থে আদিবাসী উৎখাতের ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়মকানুন যথেষ্ট সমস্যাজনক। কারণ যেন-তেন-প্রকারেণ অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিই এখন আমাদের ধ্যান, জ্ঞান, উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়ে উঠেছে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যাপনের অংশ। তাই কানাডার আকর্ষণীয় নতুন প্রধানমন্ত্রীও এই পথে চলতে একপ্রকার বাধ্য এবং নতুন ‘টার স্যান্ডের’ পাইপলাইন তৈরি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়ের জল, ভূমির ক্ষয়সাধন এবং পরিবেশ অস্থিতিশীলতা বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থাকা সত্ত্বেও।   

ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজনে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক অঞ্চল — চিরকালই এই চাহিদা বজায় ছিল। এখন এই প্রকৃতিগতভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া অঞ্চল এবং সেখানের বলিপ্রদত্ত বসবাসকারী মানুষের সন্নিকটে একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা অসম্ভব যদি না সেই ব্যবস্থার সমর্থনে কোনও ‘তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা’ তৈরি করা যায়। ‘প্রকাশ্য নিয়তি’ (‘Manifest desitny’ theory), ‘অনধিকৃত জমি’ (‘Terra nullius’), ‘প্রাচ্যবাদ’ (Orientalism) — এর মতো তত্ত্ব থেকে ‘অনগ্রসর হিলবিলি’ কিংবা ‘অনগ্রসর ভারতীয়’-র তত্ত্ব। আমরা প্রায়শই শুনে থাকি যে মানুষের স্বভাবই এই জলবায়ুগত পরিবর্তনের জন্য দায়ী, দায়ী মানুষের সহজাত লোভ, লালসা, অদূরদর্শিতা। অথবা আমরা শুনতে পাই যে আমরা পৃথিবীকে এতটাই পালটে ফেলেছি যে আমরা এখন নৃতাত্ত্বিক যুগে বাস করছি, যেখানে মানুষের ক্রিয়াকলাপ ভীষণভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে চলেছে। এইভাবে চারপাশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করার পিছনে খুব নির্দিষ্ট, অব্যক্ত যে অ্যাজেন্ডা লুকিয়ে থাকে তা হল সব মানুষই এক ধাঁচের, এক প্রকারের এবং পৃথিবীর এই ভয়াবহ বিপদের জন্য দায়ী মানুষের এই সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই ব্যাখ্যার ছলনা লক্ষ করার মতো। এত হাজার বছর ধরে মানুষের তৈরি সমাজব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষকে তার সামাজিক, লিঙ্গগত, জাতিগত, অর্থনৈতিক একাধিপত্য বিস্তার করতে সাহায্য করছে এবং এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ মানুষের প্রতিরোধ; পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, পুরুষতান্ত্রিকতা — এই পুরো অসাম্যের ধারাপাত এবং তাঁর বিরুদ্ধতা — এই পুরো ইতিহাসকে অস্বীকার করে এই ধরনের বিশ্লেষণ। সেই সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করে যা মানুষকে বাধ্য করে তা হল সাত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে। বাধ্য করে মানুষকে সুনাগরিক ছাড়াও সুপূর্বপুরুষ হিসেবে তৈরি করতে। এই ব্যবস্থা এখনও ভীষণভাবেই প্রকট। কিন্তু এই ব্যবস্থার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয় যখন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমগ্র মানবজাতি এবং ‘মানুষের সহজাত, সাধারণ বৈশিষ্ট্য’-কে দায়ী করা হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা হয় সামাজিক বৈষম্যের চিত্রকে। এই চিত্র আরও হিংস্র রূপ নেয়  যখন হন্ডুরাসে ‘গুয়ালকার্ক জলবিদ্যুৎ বাঁধ’ প্রকল্পের মতো বড়ো বড়ো প্রোজেক্ট  গড়ে ওঠে। তখন জমি, পরিবেশের পাশাপাশি বারটা কাকেরেসের (Berta Cáceres) মতো ভূমিরক্ষাকারী শোষিত মানুষের জীবনেও সরাসরি আঘাত নেমে আসে। মার্চ মাসে খুন হন বারটা কাকেরাস।                              

কেউ কেউ এখনও খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এবং অন্যদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেন যে ভবিষ্যৎ হয়তো এতটা অন্ধকারাছন্ন নয়। হন্ডুরাস, নাইজার ব-দ্বীপ কিংবা আলবার্টা টার স্যান্ড প্রকল্পের মতো পদ্ধতি অবলম্বন না করে আরও সুষ্ঠুভাবে সম্পদ নিষ্কাশন সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল আমরা ক্রমশ জীবাশ্ম জ্বালানি আহরণের সস্তা এবং সহজ উপায়গুলি নিঃশেষ করে ফেলছি। এই কারণেই ‘টার স্যান্ড’ নিষ্কাশনের বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ে আজকাল। এর প্রভাবেই শিল্পযুগের প্রথাগত ‘Faustian pact’ আজ চ্যালেঞ্জের মুখে, যার মূল কথাই হল শিল্প প্রক্রিয়া সম্পর্কিত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলির অন্য দেশে স্থানান্তরণ (আউটসোর্সিং), যা ধীরে ধীরে  অসম্ভব হয়ে উঠছে। ফ্র্যাকিং ইংল্যান্ডের অন্যতম মনোরম ভূখণ্ডকে ভয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। বিপদসংকুল এলাকার (sacrificed zone) পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে এমন অনেক তথাকথিত নিরাপদ ভৌগোলিক অঞ্চল। এই ঘটনা শুধুমাত্র ‘টার স্যান্ড’ খননের ক্ষতিকারক দিকই তুলে আনে না, বরং আমাদের এই সত্যির মুখোমুখি দাঁড় করায় যে এমন কোনও পরিষ্কার, নিরাপদ এবং নির্বিষ উপায় নেই বা ছিল না যা একটি জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারে। যেমন প্রকৃতিগতভাবে নিরাপদ কোনও উপায় নেই, তেমনই কোনও শান্তিপূর্ণ উপায়ও নেই, যার অজস্র প্রমাণ রয়েছে আমাদের কাছে। তাই এই সমস্যা বাস্তবতই গঠনগত বা স্ট্রাকচারাল। জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎসের মধ্যে (বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি) মূল পার্থক্য হল, জীবাশ্ম জ্বালানির উৎস সবসময় খুব নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। এবং অদ্ভুতভাবে এই নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য দেশের সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত, বিশেষত সবচেয়ে মূল্যবান ও শক্তিশালী জীবাশ্ম জ্বালানি — তেল। এই কারণেই আরব এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে অপরায়িত করার প্রাচ্যবাদের প্রোজেক্ট, শুরু থেকেই আমাদের তৈল-নির্ভরশীলতার সঙ্গে নীরবে সঙ্গত দিয়ে চলেছে। এবং এভাবেই অবিচ্ছিন্ন ভাবে সঙ্গত দিয়ে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে। কোনও দেশ এবং সেখানের মানুষজনকে অপরায়িত করলে, তাদের আদিম, রক্তপিপাসু, বহিরাগত হিসেবে উপস্থাপিত করলে, যুদ্ধ ঘোষণা এবং কোনও অভ্যুত্থান সাজানোর কাজ সহজ হয়ে যায়। পরিস্থিতি আরও সহজ হয় যখন কোনও ‘অদ্ভুত’ দেশ তার নিজের তৈলখনি তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের ‘অদ্ভুত’ সিদ্ধান্ত নেয়। সাইদের ১৯৭০-এর নথিতে উঠে আসে এই ভয়ংকর, অস্বস্তিকর সত্য। ১৯৫৩ সালে অ্যাংলো-ইরানীয় তেল কোম্পানির (বর্তমানে বিপি) জাতীয়করণের পর ইরানে মুহম্মদ মোসাদ্দেগের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার নেপথ্যে ছিল ব্রিটিশ-মার্কিন সহযোগিতা। ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে, ২০০৩ সালে, আর-একটি ব্রিটিশ-মার্কিন সহযোগিতা জন্ম দিল ইরাকে অবৈধ আগ্রাসন এবং দখলদারির। এই প্রত্যেক হস্তক্ষেপের প্রতিধ্বনি আমাদের বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। করে তুলছে অস্থিতিশীল। এবং এই খনিজ তেল পোড়ানোর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে গোটা পৃথিবীতে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন একদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে সৃষ্ট হিংস্রতা এবং অন্যদিকে সেই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রভাবের প্রকোপে জর্জরিত। উভয়সংকটের অনিবার্য সহাবস্থানে ক্ষত-বিক্ষত। ইজরায়েলি স্থপতি ইয়াল ওয়াইজম্যান, তাঁর সর্বশেষ বই, ‘দ্য কনফ্লিক্ট শোরলাইন’-এ বিভিন্ন শক্তিগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক এক যুগান্তকারী উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, আমরা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার মরুভূমির সীমানা বলতে যা বুঝি তা হল তথাকথিত ‘শুষ্কতা রেখা’, যা আদতে এমন এক অঞ্চল যেখানে বছরে গড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যা কিনা সাধারণভাবে সেচবিহীন বৃহৎ পরিসরে শস্য উৎপাদনের জন্য সর্বনিম্ন হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এই সীমানা স্থির বা ধ্রুবক নয়। বিভিন্ন কারণে এই রেখার সংশ্লিষ্ট অঞ্চল পরিবর্তিত হয়ে চলে, কখনও ইজরায়েলের ‘মরুভূমির সবুজায়ন’ করার প্রচেষ্টা এই সীমানাকে একদিকে প্রসারিত করে, কখনও চক্রাকার খরার প্রকোপ মরুভূমিকে অন্যদিকে প্রসারিত করে। এবং এখন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তীব্র খরা এই সীমারেখার উপর সব ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ওয়াইজম্যান সিরিয়ার সীমান্ত শহর দারা (Daraa)-র উল্লেখ করেছেন যা সরাসরি এই শুষ্কতা রেখার উপর অবস্থিত। এই শহরই এখনও অবধি সিরিয়ায় নথিভুক্ত হওয়া গভীরতম খরার ইতিহাস বহন করে চলেছে। এই খরা বিপুল সংখ্যক কৃষকদের বাস্তুচ্যুত করেছে যা কালক্রমে সিরিয়াকে গৃহযুদ্ধের সূচনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০১১ সালে এখানেই সূচনা হয় সিরিয়ার বিদ্রোহ। যদিও খরা এই গৃহযুদ্ধের একমাত্র কারণ নয়, কিন্তু খরার ফলে সিরিয়ায় প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল তা স্পষ্টতই এই গৃহযুদ্ধে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। তাপ ও জলের চাপ (heat and water stress) এবং গৃহযুদ্ধের সংঘাতের মধ্যে সংযোগ আসলে সমগ্র শুষ্কতার রেখা বরাবর একটি বিশেষ প্যাটার্নেরই পুনরাবৃত্তি ঘটায় : দেখা যাচ্ছে খরা, জলের ঘাটতি, জ্বলন্ত তাপমাত্রা এবং সামরিক সংঘাত দ্বারা চিহ্নিত স্থানগুলি সর্বদা এই ‘শুষ্কতা রেখার’ আশেপাশেই অবস্থান করে। লিবিয়া হোক বা প্যালেস্তাইন। আফগানিস্তান হোক কিংবা পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু ওয়াইজম্যান এ ছাড়াও আর-এক ‘আশ্চর্যজনক কাকতালীয়’ ঘটনা লক্ষ করেছেন। যখন এইসব অঞ্চলে পশ্চিমি ড্রোন হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলি ম্যাপ করা হয়, দেখা গেছে যে ‘এই আক্রমণগুলির বিস্তার দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান থেকে উত্তর ইয়েমেন, সোমালিয়া, মালি, ইরাক, গাজা কিংবা লিবিয়া — সেই সব অঞ্চলেই সংগঠিত হয় যা সরাসরি শুষ্ক লাইনের উপর বা তার ২০০ মিমির কাছাকাছি’। এখানে এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখানে প্রচুর পরিমাণে ড্রোন স্ট্রাইক ঘটেছে। জলবায়ু সংকটের নৃশংস চিত্র কল্পনা করার জন্য আমার কাছে এটি এখনও অবধি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। প্রায় এক দশক আগে মার্কিন সামরিক প্রতিবেদনে এর পূর্বাভাস দেওয়া হয়। সেই সামরিক প্রতিবেদনের একটি পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছে, ‘মধ্যপ্রাচ্য সর্বদা দুটি প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তেল (এর প্রাচুর্যের কারণে) এবং জল (এর অভাবের কারণে)।’ বাস্তবিকই, এর কিছু বৈশিষ্ট্য এখন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে : একদিকে পশ্চিমি ফাইটার জেট অনুসরণ করে চলে তেলের প্রাচুর্য, অন্যদিকে পশ্চিমি ড্রোন জলের অভাবযুক্ত অঞ্চলের উপর প্রবল নজরদারি করে চলেছে, যেহেতু খরা সংঘর্ষের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তোলে ক্রমাগত৷ বোমার যেমন তেলের প্রয়োজন এবং ড্রোন যেমন খরা অনুসরণ করে, তেমনি এই দুই ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করে উদ্বাস্তু বোঝাই নৌকা। যুদ্ধে, বোমায় এবং খরায় ধ্বংস, বিধ্বস্ত, ‘শুষ্কতার সীমারেখা’-য় দগ্ধ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা শরণার্থী বোঝাই নৌকা। 

অপরায়িত মানুষকে ‘পশু’ হিসেবে দেখিয়ে যেভাবে বোমা এবং ড্রোনকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়, মানুষকে অমানুষ দেখানোর সেই একই তাগিদের এখন নতুন শিকার এই শরণার্থীর দল। তাদের সুরক্ষার সঙ্গে জোর করে জুড়ে দেওয়া হয় আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নকে। তাদের বেঁচে থাকার মরিয়া পারাপার-কে দেখা হয় আক্রমণকারীর আদলে। প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাংক এবং অন্যান্য দখলিকৃত অঞ্চলে ব্যবহৃত পরিমার্জিত কৌশল এখন এসে পড়েছে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে। মেক্সিকোর সীমান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়াল তোলার প্রস্তাব প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প উবাচ : ‘ইজরায়েল জানে প্রাচীর (দেওয়াল) কত উপযোগী।’ ক্যালাইসে ক্যাম্পগুলি বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, হাজার হাজার মানুষ ভূমধ্যসাগরে ডুবতে থাকে, অস্ট্রেলিয়ান সরকার নাউরু এবং মানুসের প্রত্যন্ত দ্বীপের শিবিরে যুদ্ধ এবং স্বৈরাচারী শাসন থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের আটক করে রাখে। নাউরুতে পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর হয়ে পড়েছিল যে স্রেফ পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার তাগিদে গত মাসে একজন ইরানি অভিবাসী আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই, একইভাবে অগ্নিদগ্ধ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন সোমালিয়ার ২১ বছর বয়সী আরেক অভিবাসী মহিলা। প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল এই বলে সতর্ক করেছেন যে অস্ট্রেলিয়ানদের ‘এ বিষয়ে কোনও দ্বিধার অবকাশ থাকতে পারে না’ এবং ‘জাতীয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুব স্পষ্ট এবং সংকল্পবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন’। গত বছর কেটি হপকিন্স ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘যুদ্ধবিমান নিয়ে আসা প্রয়োজন, প্রয়োজন অভিবাসীদের তাদের সীমান্তের তীরে ফিরিয়ে দেওয়া এবং নৌকা পুড়িয়ে ফেলা’। পরের বার মারডক সংবাদপত্রের কোনও কলামিস্ট এই একই ধাঁচের ঘোষণা করলেন নাউরুকে মনে রাখা দরকার। নাউরু হল প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলির মধ্যে একটি যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখানকার বাসিন্দারা নিজেদের বাড়িগুলিকে অন্যদের জন্য কারাগারে পরিণত হয়ে যেতে দেখেছেন। এখানকার বাসিন্দাদের ভবিতব্য সম্ভবত স্থানান্তরণ। অথচ আগামীর এই ‘জলবায়ু উদ্বাস্তুদের’ আজকের কারারক্ষক হিসাবে চাকরিতে নিয়োগ করা হয়েছে। আমাদের বোঝা প্রয়োজন যে নাউরুতে যা ঘটছে এবং নাউরুর সঙ্গে যা ঘটেছে তা একই সূত্রে বাঁধা। একই যুক্তির দুই ভিন্ন প্রকাশ। এখানেই উঠে আসে মানবতার বিভাজন। যে সংস্কৃতি কালো এবং বাদামি চামড়ার মানুষদের সলিলসমাধি কিংবা আগুনে পুড়ে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিতে পিছপা হয় না, সেই সংস্কৃতি যে কালক্রমে ঐ অপরায়িত মানুষের দেশগুলিকেও সলিলসমাধি কিংবা তীব্র, রুক্ষ উত্তাপে দগ্ধ হতে প্ররোচিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। এবং যখন তা ঘটবে, ‘প্রথমে নিজেদের ভালো থাকার’ মানবিক অনুক্রমের তত্ত্বকে (থিওরিজ অফ হিউম্যান হায়ারার্কি) পরিচালনা করা হবে এই ভয়ংকর সিদ্ধান্তগুলির ন্যায্যতা প্রমাণের স্বার্থে। ইতিমধ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে এই ন্যায্যতা প্রমাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত সমগ্র মানবতার অস্তিত্বসংকটের কারণ হয়ে উঠবে, কিন্তু আমরা জানি যে প্রাথমিকভাবে এটি বৈষম্যসূচক এবং সবচেয়ে প্রথমে এবং সবচেয়ে তীব্রভাবে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আঘাত করে। ‘ক্যাটরিনা’ হারিকেনের সময় নিউ ওরলিয়ন্সের বাড়ির ছাদে এই মানুষদের ফেলে রাখা হয়। এরাই জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী সেই ৩৬ মিলিয়ন ‘সস্তা’ মানুষ যারা দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার খরার প্রভাবে অভুক্ত থাকে। 

ভবিষ্যতের নয়, এই সময়েরই একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয় বিশ্ব-উষ্ণায়ন, যদিও আমাদের পদক্ষেপ, নীতিপ্রণয়ন দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ‘প্যারিস চুক্তি’ উষ্ণতা বৃদ্ধির সীমা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রা অত্যন্ত সমস্যাজনক। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে যখন এটি প্রস্তাবিত করা হয়, তখন আফ্রিকান প্রতিনিধিরা একে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বেশ কয়েকটি নিম্নভূমির দ্বীপরাষ্ট্রের স্লোগান হল ‘বেঁচে থাকার জন্য ১.৫’। শেষ মুহূর্তে প্যারিস চুক্তিতে একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল এই বলে যে, দেশগুলি ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা’ চালিয়ে যাবে। কিন্তু এ এক সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি : আপাতত আমরা এই ধরনের কোনও প্রচেষ্টাই করছি না। যে সরকারগুলি এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা এখন আরও বেশি করে ফ্র্যাকিং এবং আরও টার স্যান্ড সংশ্লিষ্ট উন্নয়নের জন্য চাপ দিচ্ছে — যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বেমানান তো বটেই, ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড লক্ষ্যমাত্রার জন্যেও অকার্যকারী। তাও এটি ঘটে চলেছে কারণ বিশ্বের ধনী দেশগুলির ধনী ব্যক্তিরা এই ভেবে আশ্বস্ত হয় যে অন্য কেউ বড়ো ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও তারা নিজেরা সুরক্ষিতই থাকবে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের বিভীষিকা তাদের দোরগোড়ায় এলেও তারা বেঁচে যাবে। যখন তাদের এই বিশ্বাস ভুল বলে প্রমাণিত হয় তখন তার বহিঃপ্রকাশ আরও কুৎসিত রূপ ধারণ করে। এই কুৎসিত ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট আভাস আমরা পাই গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারির ইংল্যান্ডের বন্যার প্রেক্ষিতে। এই বন্যার প্রকোপে প্রায় ১৬০০০ বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু সেখানকার অপরায়িত, প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ শুধুমাত্র রেকর্ড-ভেজা ডিসেম্বরের বন্যার সঙ্গেই মোকাবিলা করছে না, ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির উপর এবং বন্যারক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া স্থানীয় কাউন্সিলগুলির উপর নিরন্তর আঘাতের আঁচও তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই, অনেকেই (পড়ুন মিডিয়া) রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এই সমস্যার এবং সেই সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়বস্তুর দিক পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা ছিল, ‘কেন ব্রিটেন শরণার্থী এবং বৈদেশিক সাহায্যের জন্য এত অর্থ ব্যয় করছে যখন তার নিজের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া উচিত?’ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ সংবাদপত্রের একটি সম্পাদকীয় দাবি করেছিল, ‘ব্রিটিশ করদাতাদের কেন বন্যা প্রতিরোধে বিদেশে অর্থ প্রদান করতে হবে, যখন দেশের ভিতরে অর্থের প্রয়োজন?’ এর উত্তর আমার জানা নেই। ইংল্যান্ড-ই যেহেতু প্রথম কয়লা পুড়িয়ে বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছে এবং তাকে একটি বড়ো শিল্পের পর্যায়ে পৃথিবীর যে কোনও জাতির চেয়ে বেশি সময় ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে চলেছে, হয়তো সেইজন্য! কিন্তু এখন এই আলোচনাকে একটু অন্য অভিমুখে নিয়ে যাওয়া যাক। মোদ্দা কথা হল, এই ঘটনা আমাদের কাছে একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে পারত, বোধের এক সন্ধিক্ষণ হতে পারত, যা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে একদিকে সচেতন করত এবং অন্যদিকে একে অপরের সংহতির পথেই এই সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেবার সূত্র খুঁজতে সাহায্য করত। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধুমাত্র পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না : আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মডেলে এর প্রভাব আরও ভয়ংকর এবং কদর্য রূপ নেয়। এই ঘটনা থেকে নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল জলবায়ু সংকটকে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় প্রযুক্তিগত পরিসরে নিহিত ব্যবস্থার (টেকনোক্র্যাটিক) সমস্যা হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে মোকাবিলা করার কোনও উপায় নেই। এটিকে অবশ্যই স্বৈরতন্ত্র এবং বেসরকারীকরণ, ঔপনিবেশিকতা এবং সামরিকবাদের প্রেক্ষাপটে এবং এগুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অপরায়নের ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। এই বিভিন্ন ব্যবস্থাগুলির মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট নিবিড়, স্বচ্ছ হওয়া সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেহারা ভীষণ বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন। স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী মানুষজন খুব কমই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন আবার অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে উদ্বিগ্ন মানুষেরা খুব কমই যুদ্ধ বা সামরিক-রাষ্ট্রীয় দখলদারি নিয়ে কথা বলে থাকেন। আমেরিকার শহরের রাস্তায় কিংবা পুলিশ হেফাজতে বন্দুকের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মৃত্যু এবং আরও অনেক বৃহত্তর শক্তির হাতে, শুষ্ক বধ্যভূমিতে কিংবা বিশ্বজুড়ে অনিশ্চিত, অনিরাপদ নৌকা পারাপারে মানুষের মৃত্যুর মধ্যে আমরা সাধারণভাবে খুব কমই যোগসূত্র, সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। আমার মতে, এই বিচ্ছিন্নতাগুলি কাটিয়ে ওঠা এবং আমাদের বিভিন্ন সমস্যা এবং আন্দোলনকে একত্রিত করে যোগসূত্রগুলিকে শক্তিশালী করা এই সময়ে আমাদের মুখ্য কর্মসূচি হওয়া উচিত। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানো যে কোনও মানুষের কাছে এখন এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পুঁজিবাদী এবং ক্ষয়িষ্ণু স্থিতাবস্থা রক্ষাকারী শক্তির বিরুদ্ধে জয়ের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট শক্তিশালী, মজবুত একটি বিকল্পশক্তি গড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তন অসাম্য, যুদ্ধ, বর্ণবাদের মতো আরও অনেক নেতিবাচক সামাজিক অসুস্থতা ছড়িয়ে দেবার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আবার এর বিপরীতে, তা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য এবং সামরিকবাদের বিরুদ্ধে কাজ করা শক্তিগুলিকে একসূত্রে বাঁধার কাজকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। বস্তুতই জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ আমাদের প্রজাতিকে একটি অস্তিত্বসংকটের কাছাকাছি নিয়ে এসে আমাদের জীবনকে এক অপরিবর্তনীয়, রূঢ় বিজ্ঞান-ভিত্তিক সময়সীমার মধ্যে বেঁধে রেখেছে। সেক্ষেত্রে এই অস্তিত্বসংকটই আমাদের অনেক শক্তিশালী আন্দোলনগুলির একত্রতার বীজ হতে পারে। অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বের উপর ভর করে আমাদের একত্রে যুক্ত রাখতে পারে। মানুষ অথবা স্থান নির্বিশেষে ‘প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল অঞ্চল’ নির্ধারণ, শোষণ-জাত মানসিকতার সমবেত, ঐক্যবদ্ধ প্রত্যাখ্যানই হতে পারে বন্ধুত্বের পথ। আমরা এত বেশি অধিক্রমণ এবং বিভিন্ন অন্তঃসম্পর্কযুক্ত সংকটের মুখোমুখি হই প্রতিনিয়ত যে কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুধুমাত্র একটি সমস্যার সমাধান খোঁজা অসম্ভব। সমন্বয় সাধনের মধ্যে দিয়েই আমাদের এই সমস্যার সমাধান খোঁজা প্রয়োজন, এমন সমাধান, যা কার্বন নির্গমনকে আমূলভাবে কমিয়ে আনবে, বিপুল সংখ্যক ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত, সুরক্ষিত চাকরি এবং কাজ সৃষ্টি করবে। তার সঙ্গে বর্তমান নিষ্কাশন অর্থনীতির দৌরাত্ম্যে উপেক্ষিত, নির্যাতিত প্রান্তিক মানুষদের অর্থপূর্ণ বিচার প্রদান করে ফিরিয়ে দেবে অধিকার। যে বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে সে বছরই সাইদ মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি ইরাকের গ্রন্থাগার এবং জাদুঘর লুট হতে দেখেছেন, অথচ তিনি দেখেছেন কীভাবে ইরাকের তেল মন্ত্রণালয়কে রক্ষা করা হয়েছিল। এই প্রবল নিষ্ঠুরতার মধ্যেও তিনি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে নতুন আশা দেখতে পেতেন। এবং পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তৃণমূল স্তরে নিবিড় যোগাযোগের নতুন ফর্মগুলির উপরেও তিনি আশাবাদী ছিলেন; তিনি উল্লেখ করেছেন ‘বিশ্বব্যাপী বিকল্প সংহতির অস্তিত্ব, বিকল্প সংবাদ উৎস দ্বারা অবহিত, এবং পরিবেশগত, মানবাধিকার ও  স্বাধীনতাবাদী প্রবণতা বিষয়ক সহমর্মী সচেতনতাই আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীতে একসাথে বেঁধে রেখেছে’। এমনকি তাঁর দর্শনে এবার বৃক্ষপ্রেমীদেরও ভূমিকা থাকছে। সম্প্রতি, ইংল্যান্ডের বন্যা নিয়ে পড়াশোনা করার সময় সেই কথাগুলো আমার আবার মনে পড়ে যায়। সংকটের মুহূর্তে একে অপরকে বলির পাঁঠা বানানো এবং দোষারোপের চাপানউতোরের মধ্যে আমি লিয়াম কক্স নামে একজন ব্যক্তির একটি পোস্ট লক্ষ করি। মিডিয়ার কিছু অংশের এই বিপর্যয়কে ব্যবহার করে তৈরি বিদেশি-বিরোধী ন্যারেটিভে বিরক্ত লিয়াম লিখছেন — ‘আমি ইয়র্কশায়ারের হেবডেন ব্রিজ শহরে বাস করি, যেটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির মধ্যে একটি। নিঃসন্দেহে বন্যা অত্যন্ত কষ্টকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে তবে আমি বেঁচে আছি। আমি নিরাপদ। আমার পরিবার নিরাপদ। আমরা সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে বাঁচি না। আমি স্বাধীন, মুক্ত। এখানের আকাশে অবিরাম গোলাগুলি, বোমাবর্ষণ হয় না। আমাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাতে বাধ্য করা হচ্ছে না এবং আমি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ দ্বারা অপরায়িত অথবা তার বাসিন্দাদের দ্বারা সমালোচিত হচ্ছি না। যে সমস্ত মূর্খেরা নিজেদের জেনোফোবিয়া, জাতিবিদ্বেষ উগরে দিচ্ছেন এই বলে যে  শুধুমাত্র ‘আমাদের নিজের জন্যই’ সমস্ত অর্থ ব্যয় করা উচিত, আপনাদের উচিত নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড়ানো। নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি কি সত্যিই একজন শালীন, ন্যায়পরায়ণ, সংবেদনশীল মানুষ? কারণ মানুষের আশ্রয়স্থল কিন্তু কেবলমাত্র ব্রিটেন নয়, এই গ্রহের সর্বত্রই।’

এবং আমার মতে এটাই আক্ষরিক ‘টেক হোম মেসেজ’। যথার্থ শেষকথা। 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান