পরিবেশ আন্দোলন, পরিবেশবাদ ও পরিবেশ সংরক্ষণে লড়াইয়ের ভূমিকা

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়

দূরপাল্লার ট্রেনে থ্রি-টায়ার সংরক্ষিত কামরায় চড়ে চলেছেন আপনার গন্তব্যে। ট্রেনে আপনার সংরক্ষিত আসন ওই মাঝের শয্যাটা হলে তার অস্তিত্ব সারাদিন টের পাবেন না। রাত হলে তবেই সে বিছানা খুলে পাতা যাবে। আর যিনি তলার বার্থ পেয়েছেন তাঁর বিছানাও সারাদিন মাঝের আর ওপরের বার্থের যাত্রীর বসার জন্য ব্যবহৃত হবে। কাজেই সে অর্থে তলার বার্থটা সারাদিন সবার, মাঝেরটা যেন কারুরই নয় আর ওপরের বার্থটা নিজের বার্থ। পরিবেশের কথা বলতে গিয়ে ট্রেনের বার্থের কথাটা মনে হল। পরিবেশ কি আসলে ট্রেনের মাঝের বার্থ, যার মালিকানা আসলে কারুর নয়? নাকি, পরিবেশ মানে ট্রেনের লোয়ার বার্থ, যা সবার অথচ আসলে কারুর নয়? 

ভেবে দেখুন, আপনার কোনও জিনিস হারিয়ে গেলে বা চুরি গেলে আপনি থানায় গিয়ে ডায়েরি করেন বা এফআই আর করেন, কিন্তু পাড়ার পুকুর বুজিয়ে দেওয়ার উপক্রম হলে বা বাড়ির পাশের গাছটা কাটা পড়লে আপনি কি থানায় গিয়ে আপনার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন? আর যদি তা লিপিবদ্ধ করতেও যান তবে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। “আপনার পুকুর?” “আপনার গাছ?” — এ জাতীয় প্রশ্ন আপনাকে শুনতে হয়। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জনস্বার্থের বিষয়টি। হ্যাঁ, আপনার পুকুর বা গাছ নয় বটে তবে আসলে তো তা সবার পুকুর, সবার গাছ। আর এই সবার মধ্যে আপনিও আছেন। কাজেই আপনি সাধারণের অংশ। আর এই সাধারণের সম্পত্তি হিসেবেই আমাদের পরিবেশের উপস্থিতি। এক অর্থে তা সবার, আবার অন্য অর্থে, (যা কিনা আপনি পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ের সময়ে শুনে থাকেন), কারুর নয়। 

পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই আসলে সাধারণের সম্পত্তি রক্ষার লড়াই। অন্তত আমাদের দেশে এভাবেই পরিবেশ আন্দোলনকে দেখা যায়। বস্তুত পরিবেশ রক্ষার রোমান্টিকতার পরিবর্তে এদেশে পরিবেশ আন্দোলনকে অধিকার রক্ষার লড়াই হিসেবেই দেখা যায়। উদাহরণ দেওয়া যাক। ব্রিটিশ শাসনাধীন ঔপনিবেশিক ভারতে শাসকেরা বন সংরক্ষণের নামে বনবাসী মানুষকেই বনে ঢুকতে বাধা দিতেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চল তৈরির নামে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যেত স্থানীয় মানুষের। তাঁরা নাকি বনের পরিবেশ ধ্বংস করবেন! এই ধারা যে স্বাধীনতার পরে পালটাল তা কিন্তু নয়। যদি চিপকো আন্দোলনের দিকে তাকান তবে দেখবেন তা কিন্তু পরিবেশ বাঁচানোর জন্য নয় বরং অরণ্যসম্পদে স্থানীয় মানুষের অধিকারের প্রশ্নে গড়ে উঠেছিল। বহু আলোচিত চিপকো আন্দোলন সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলা যায় যে গাড়োয়াল অঞ্চলের দেশোলি গ্রামে যখন এলাহাবাদের এক ক্রীড়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থাকে ক্রিকেট খেলার ব্যাট, টেনিস খেলার র‍্যাকেট তৈরি করার জন্য সরকারি বন দপ্তর ৩২টা গাছ কাটার অনুমতি দেয় তখন রুখে দাঁড়ান সেই অঞ্চলের গ্রামীণ মানুষ। গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নেন ওই ঠিকেদার সংস্থার লোকদের গাছ কাটতে দেবেন না। ঘটনাটা ১৯৭৩ সালের। গ্রামবাসীদের গাছ কাটতে বাধা দেওয়ার এই সংকল্পের কথা জানতে পেরে প্রথমে ঠিকেদার সংস্থার লোকেরা আর গাছ কাটতে আসেননি। পরে তারা গাছ কাটতে এলে স্থানীয় মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৭৪-এ ঠিকেদার সংস্থার লোকেরা গাছ কাটতে এলে রেণীগ্রামের ২৭ জন মহিলা গাছকে জড়িয়ে ধরে বনের প্রায় আড়াই হাজার গাছকে রক্ষা করেন। এখান থেকেই জন্ম হয় চিপকো আন্দোলনের। পরে গাড়োয়াল অঞ্চলের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে এই ধারার আন্দোলন। চিপকো আন্দোলন পরিবেশের ইতিহাসে বহুচর্চিত। কাজেই তা নিয়ে বিশদ আলোচনা নিরর্থক। শুধু একথাই বলার যে এই আন্দোলনকে একমাত্রিকভাবে দেখলে হবে না। বন বাঁচানোর আন্দোলনের চেনা বর্গে এই আন্দোলনকে বেঁধে ফেললে একথা বলা হবে না যে বন সংরক্ষণের নামে যদি বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত অরণ্যে রূপান্তরিত করা হয় তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েন সেই বনবাসী মানুষ যাঁর জীবনে বন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে, যাঁকে জীবনের প্রত্যেক প্রয়োজনে হাত পাততে হয় বনভূমির কাছে। আর এই বনসংরক্ষণের ধারাও নেহাত কম পুরানো নয়। সেই ব্রিটিশ আমলে এই প্রবণতার সূচনা।

ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসক, অরণ্যের ওপর নিজের আধিপত্য কায়েম করে। বনবাসী মানুষের বনের অধিকারকে লঙ্ঘিত করে চালু হয় অরণ্য আইন। ফলে সাধারণ সম্পত্তির ওপর সাধারণ মানুষের অধিকার লুণ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকার এদেশে অরণ্য নীতি প্রণয়ন করে। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ১৮৬৫ আর ১৮৭৮ সালের অরণ্য আইনের কথা। এই আইন দুটিতে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্র অরণ্যসম্পদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ১৮৭৮-এর আইনে সংরক্ষিত আর সুরক্ষিত, এই দুই ভাগে দেশের বনাঞ্চলকে ভাগ করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, সংরক্ষিত অঞ্চলের অরণ্যের ওপর রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে আর সুরক্ষিত অরণ্যে গ্রামবাসীদের শর্তসাপেক্ষে সীমাবদ্ধভাবে বন ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। সেখানে সাধারণ মানুষের সাধারণ সম্পত্তি ব্যবহারের সামান্য সুযোগ প্রদানের কথা বলা হল বটে তবে এও স্পষ্ট করে বলা হল যে তা হবে শুধুমাত্র শাসকের অনুমতিসাপেক্ষে। সেখানে সীমাবদ্ধ আকারে বনবাসী মানুষেরা জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের এবং পশুচারণের কিছু সুযোগ হয়তো পেলেন, কিন্তু হারালেন অরণ্যের ওপর তাঁদের প্রথাগত স্বাভাবিক অধিকার। অনুমতি বিনা বন ব্যবহারের কোনও অধিকার তাঁদের রইল না। আরও যেটা তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল সুরক্ষিত বনকে সংরক্ষিত বনে রূপান্তরের অধিকার। ফলে সাধারণ বনবাসী মানুষের বনের ওপর অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছিল। তথ্য হিসেবে জানানো যাক, সুরক্ষিত থেকে সংরক্ষিত বনে রূপান্তরের অধিকারের আইনকে কাজে লাগিয়ে আইন তৈরির বারো বছরের মধ্যে সংরক্ষিত বনের এলাকা চারগুণ বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৮৭৮ সালে সংরক্ষিত অরণ্য বলে চিহ্নিত এলাকার মোট আয়তন ছিল ১৪০০০ বর্গ মাইল যা ১৮৯০-তে বেড়ে হয় ৫৬০০০ বর্গ মাইল। আর এই এলাকা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তা বলে ভাববেন না যে ব্রিটিশ শাসক ছিল অরণ্যের রক্ষক। বরং রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে উঠে তারা অরণ্যসম্পদকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এদেশে যত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে তত বেড়েছে যোগাযোগের প্রয়োজন। ফলে রেললাইন বেড়েছে, লাইনের স্লিপার আর রেলগাড়ি তৈরির জন্য গাছকাটা বেড়েছে, কমেছে বন। আবার সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে কৃষির বিস্তার ঘটেছে। ফলে হারিয়ে গেছে বন আর জলা। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আইনের নামেই হোক আর সাম্রাজ্যের প্রসারের ফলেই হোক, পরিবেশের ওপর শাসকের থাবা ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বনবাসী, দেশের আদি বাসিন্দাদের লড়াইয়ের উৎস নিহিত রয়েছে এই পরিবেশগত কারণের মধ্যেই। 

স্বাধীনতার পরে এই ধারা যে খুব পালটেছে তাও বলা যায় না। একটু আগে যে চিপকো আন্দোলনের কথা বলা হল সেখানেও মেলে ক্ষমতার আধিপত্য আর মানুষের প্রতিরোধের বয়ান। স্বাধীন ভারতে যে পরিবেশ আন্দোলনগুলো বিশিষ্ট সে-সবের দিকে তাকালে দেখবেন সেখানে সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের পরে পরিবেশবিরোধী প্রকল্প হয়তো পিছু হটেছে কিন্তু একই সঙ্গে নির্বাসিত হয়েছে পরিবেশের সাধারণ সম্পদের ওপর সাধারণ মানুষের অধিকার। কেরালায় প্রকৃতি নষ্ট করে সাইলেন্ট ভ্যালিতে যে বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়েছিল তা শেষ অবধি আন্দোলনের চাপে পরিত্যক্ত হয় সেটা ঠিকই কিন্তু পরবর্তী পর্বে যখন সাইলেন্ট ভ্যালি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রূপান্তরিত হয় তখন সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় স্থানীয় মানুষেরও। 

কাজেই পরিবেশ আন্দোলনের জটিলতার বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না। আমেরিকায় পরিবেশ আন্দোলন যে মূল লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল তা হল বন আর বন্যপ্রাণী এবং শহরের গাছ-জলাভূমি প্রভৃতির অধিকার রক্ষা। সেখানকার পরিবেশবাদের সঙ্গে ভারতের পরিবেশবাদের পার্থক্য রয়েছে। আর এই পার্থক্য নিহিত রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিতে। এদেশেও পরিবেশ আন্দোলনে গাছ, জমি, জলা রক্ষা করার চেষ্টা করা হয় তবে তা তাদের অধিকার রক্ষার জন্য নয়, তার মূল উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা বা প্রতিষ্ঠিত অধিকার বজায় রাখা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পরিবেশ আন্দোলনের বিষয়টি সামাজিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত।  

খেয়াল করে দেখুন, এদেশে যখন নর্মদা বাঁচানোর আন্দোলন শুরু হচ্ছে তখন আন্দোলনের কর্মী মেধা পাটকার প্রমুখ প্রথমেই যে বিষয়টির ওপর জোর দিলেন তা হল এই প্রকল্প রূপায়িত হলে বহু মানুষ তাঁদের বাসভূমি আর জীবিকা হারাবেন। প্রচলিত আইন অনুযায়ী, নর্মদা নদীর ওপর বাঁধ তৈরির জন্য যিনি তাঁর বাসভূমি থেকে উৎখাত হবেন সেটা তাঁর মালিকানাধীন নয়। কাজেই ক্ষমতা বলবে, তাঁকে তো তাঁর বাড়ি থেকে তোলা হচ্ছে না। অথচ যে নদীর ওপর তিনি তাঁর জীবন-জীবিকার জন্য নির্ভরশীল তা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়তো নয়, তা তাঁর সামুদায়িক সম্পত্তি। নর্মদা প্রকল্প রূপায়ণের সময়ে শুধু সর্দার সরোবর বাঁধনির্মাণে এক লক্ষ মানুষের উৎখাত হওয়ার সম্ভাবনার কথা আগাম সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছিল। এখনকার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি হিসেবে কোনও প্রকল্প নির্মাণের জন্য কেউ উৎখাত হলে তাঁর পুনর্বাসনের দায়িত্ব সেই প্রকল্পনির্মাতার, বকলমে ক্ষমতার। কিন্তু সেই পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হয় যাকে তাঁর বাসভূমি হারাতে হচ্ছে তাঁর জীবিকার দিকে। যদি নদীজীবী মানুষের পুনর্বাসন মেলে রুখা সুখা জায়গায় তবে তিনি নদীনির্ভর স্বাভাবিক জলসেচ অবলম্বন করে যে চাষবাস করতেন তা করবেন কী করে? আর যদি নতুন বসতির জায়গায় নদীই না থাকে তবে তিনি তাঁর মৎস্যজীবীর পেশাতেই বা নিয়োজিত থাকবেন কী করে? ভারতে যেহেতু পরিবেশবাদ সাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সাধারণ মানুষের অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত সেখানে এইসব প্রশ্ন পরিবেশের লড়াইতে বারবার উঠে এসেছে।  

আমেরিকায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে যে প্রগতিবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছিল সেখানে পরিবেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। পরিবেশ রক্ষায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, আইন প্রণীত হয়েছিল। ভারতে শাসনক্ষমতার লোক উন্নয়নের স্বার্থে পরিবেশকে নির্বিচারে বলি দিয়েছেন। স্বাধীনতার পরে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নদীর ওপর গড়ে তোলা বড়ো বাঁধকে ‘মন্দির’ আখ্যা দিয়েছেন আর সেই বাঁধ নির্মাণের জন্য উৎখাত হওয়া প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষকে বলেছেন, দেশের জন্য, দশের জন্য ব্যক্তিগত ত্যাগস্বীকারের কথা। পরবর্তীকালে যখনই কোনও তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের কথা উঠেছে তখন কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়েছেন ‘বহুজন হিতার্থে’ এই প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। বহুজন হিতার্থের এই ধারণাকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন কর্মী-লেখক অরুন্ধতী রায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বহুজনের জন্য যে ‘উন্নয়ন প্রকল্প’-এর পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের কথা বলা হচ্ছে সেটা আদৌ তাদের কোনও হিত করবে কিনা সে ব্যাপারে সেই বহুজনের মত নেওয়া হচ্ছে কী! মজা হছে, সেটা কোনও সময়েই হয়নি এবং হয় না। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর, সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। আজকাল কোনও নির্মাণ প্রকল্পের সামনের বোর্ডে লেখা থাকে আজকের কষ্ট শেষ অবধি লাভ এনে দেবে। কিন্তু “কষ্ট করলে কেষ্ট মেলা”-র এই তত্ত্বকথা আদৌ প্রযোজ্য নয় দেশের গরিবগুরবো মানুষের কাছে। কারণ ধরা যাক যে বিরাট নির্মীয়মান সেতুর সামনে এই কষ্ট করলে কেষ্ট মেলার বোর্ড টাঙানো থাকে সেই সেতু নির্মিত হয়ে গেলে রাস্তায় দিন গুজরান করা মানুষের আদৌ কোনও লাভ হবে কি? সেই সেতুতে হাঁটা নিষিদ্ধ, বাস ওঠে না, যাওয়া-আসা করে শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি। তাহলে তার কোন কষ্ট দূর হবে? বরং ঝাঁ-চকচকে সেই অঞ্চলে দৃশ্যদূষণ ঘটানোর দায়ে তার বসতিটাই অন্তর্হিত হয়ে যাবে। সেটা হবে শুধু নয়, হচ্ছে এবং হয়ে চলেছে। 

এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতেই পারে যে পরিবেশের প্রসঙ্গে এ প্রবন্ধে বারবার মানুষের কথা বলা হচ্ছে। একথা হয়তো ঠিক কিন্তু মনে রাখতে হবে তা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে পারিবেশিক সম্পদের অংশিদার মানুষের প্রেক্ষিতে। এদেশের পরিবেশ সংরক্ষণে যেটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইতে শামিল এই মানুষদের নাছোড় লড়াইয়ের ভূমিকা বড়ো কম নয়। ১৯৮৪ সালে মধ্যপ্রদেশের ভোপালে যে রাসায়নিক গ্যাস বের হওয়ার দুর্ঘটনা ঘটে যাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যান, অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার প্রেক্ষিতে “আর ভোপাল নয়”-এর ব্যানারের তলায় গড়ে ওঠে দেশজোড়া পরিবেশ আন্দোলন যাতে গুরুত্ব পায় দূষণহীন পরিবেশে মানুষের বাঁচার অধিকার। আর এই আন্দোলনের চাপেই ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবেশ সম্পর্কিত আইনগুলোকে জড়ো করে, নতুন কার্যকরী আইন যুক্ত করে রাষ্ট্র এক পরিবেশ আইন গড়ে তোলে। ১৯৮৬-তে গড়ে ওঠা এই আইন আগের সব আইনকে শুধু যে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসে তাই নয়, দেশের মানুষের মাথা আইনের ছাতা দিয়ে রক্ষা করার এক অঘোষিত প্রতিশ্রুতিও প্রদান করে। আর সেজন্যই দেখা যায়, আশির দশকের মাঝামাঝির পর থেকে দানা বাঁধা এদেশের সব পরিবেশের লড়াইতেই বড়ো অস্ত্র এবং আশ্রয় হয়ে ওঠে এই আইন। 

ভোপাল দুর্ঘটনার পরে পরিবেশ নিয়ে চিন্তা বা দুশ্চিন্তা নিঃসন্দেহে বাড়ে। আর সেজন্যই আশির দশকের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় সুন্দরবন অঞ্চলে রাসায়নিক সার কারখানা তৈরির পরিকল্পনার কথা প্রকাশিত হলে সেখানকার মানুষ কারখানা তৈরির আগেই প্রতিরোধে শামিল হন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, রাসায়নিক সার কারখানা স্থাপিত হলে বিষিয়ে যাবে সেখানকার জল আর জমি। চাষের খেতের ফসল থেকে নদী-খাল-বিলের মাছ সবই হবে দূষণের শিকার। কাজেই এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী। স্থানীয় মানুষের লড়াই, তাতে শহুরে শিক্ষিত মানুষের মদত এই আন্দোলনকে জয়যুক্ত করে। পিছু হটে প্রস্তাবিত রাসায়নিক সার কারখানার কর্তাব্যক্তিরা। রক্ষিত হয় গুরুত্বপূর্ণ বৃহত্তর সুন্দরবন অঞ্চল। 

একইরকমভাবে আশির দশকে প্রথমবার, পরে দু-হাজার পরবর্তী সময়ে আবার সুন্দরবনে এবং ২০০৬-তে পূর্ব মেদিনীপুরের হরিপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হলে পরিবেশের প্রশ্নে, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচাতে, তাঁদের বাস্তুচ্যুতি আটকাতে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতেও রক্ষা পায় পরিবেশ। শেষ অবধি পশ্চিমবঙ্গে কোথাও পারমাণবিক চুল্লি গড়ে উঠতে পারেনি। 

১৯৯০-এর দশকে ঝাড়গ্রামে পাথরখাদানে শ্রমিকদের সিলিকোসিস রোগকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে মুখ্য কুশীলব ছিলেন বিজন ষড়ঙ্গীর নেতৃত্বে টপ কোয়ার্ক পত্রিকা এবং নাগরিক মঞ্চ। সেখানে অনেক ক’টি বিষয় একইসঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল শ্রমিকের অধিকার, পেশাগত রোগ এবং অবশ্যই পরিবেশের প্রশ্ন। শেষ অবধি এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে পেশাগত রোগে আক্রান্ত শ্রমিকেরা ক্ষতিপূরণ পান। সুপ্রিম কোর্ট মৃত শ্রমিকদের আত্মীয়দের ক্ষতিপূরণ প্রদান করার আদেশ দেন। প্রাথমিকভাবে বিষয়টিকে শুধু শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সাফল্য বলে মনে হতে পারে কিন্তু আসলে সমস্যা নিহিত ছিল পাথরখাদানের পরিবেশের মধ্যে। তবে, এই সফল আন্দোলন এই প্রশ্নটাও তুলে দিয়েছিল যে শুধু ফুসফুস আর শ্বাসনালীতে পাথরের গুঁড়ো ঢোকার মাধ্যমে সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের কথাই ভাবব নাকি পাশাপাশি প্রশ্ন তুলব শহুরে বিত্তবানদের ভোগবাদী জীবনযাপন নিয়েও যাদের বাড়ি-ঘর-দোর মার্বেলে মোড়া। 

কাজেই পরিবেশের লড়াইতে শ্রেণির প্রশ্নটাও ফেলে দেওয়ার নয়। এরাজ্যে ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত বিভিন্ন জেলার সাধারণ মানুষের বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য যে লড়াই তাতে কতটা একাত্ম হতে পারেন সেই সব বিত্তবান মানুষ যাঁরা অক্লেশে জল কিনে খান? তাঁদের কাছে পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে অনেক চিন্তার বিষয় বরং বায়ুদূষণ কারণ এখনও সাধারণভাবে একই বাতাসে সবাইকে শ্বাস নিতে হয়। 

যেকথা বলে এ লেখায় দাঁড়ি টানা যায় তা হল, এদেশে পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই রোমান্টিকতায় মোড়া নয়, বরং তা সামগ্রিক অধিকার অন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আক্ষরিক অর্থেই তা দেশের মানুষের বাঁচার লড়াই।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান